গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১২

দুটি অনু গল্প - 'বাসন্তি' / নন্দিতা ভট্টাচার্য ও 'স্বীকারোক্তি' / ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


       
     বাসন্তি 

           নন্দিতা ভট্টাচার্য

       
মোবাইল বাজলেই আজকাল আড় চোখে তাকিয়ে দেখি । ভোডাফোনের বিরক্তিকর বিজ্ঞাপন কলগুলো জ্বালানোর পক্ষে যথেষ্ট । দিনে যে কতবার তারা নিয়ম মাফিক এই অত্যাচার চালিয়ে যায় তার কোন ইয়ত্বা নেই । এ ছাড়াও আছে ! কখনো কখ্নো ভুল করে তুললে শুনতে পাই বাসন্তি আছে ?' প্রথম কদিন বুঝতে পারিনি ভেবেছি হয়ত রঙ নাম্বার । ঠিকঠাক ভদ্রতা বজায় রেখে উত্তর দিয়েছি । তারপর বুঝতে পারলাম, না এটা ঠিক রঙ নাম্বার নয় । প্রায়ই আসতে লাগল সেই ফোন । কিন্তু একেবারেই যে ধরব না তাতো হয় না । অনেক দরকারি ফোন মিস হয়ে যাচ্ছে । 
      
কদিন আগেই পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বেশ ঝামেলা গেছে । বেশ ভাল রকম টাকা পয়সা পাওয়া গেছে ভাবলাম এরা নয়ত ! ভয় দেখাতে চাইছে ? মাথাটা গরম হয়ে থাকে । এবার ঠিক করি যথেচ্ছ গালাগাল দিয়ে দেব । আবার ফোন 'বাসন্তি আছে ? কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল । --'আপনি কে বলুন তো , রোজ রোজ এ ভাবে বিরক্ত করেন কেন ? আপনার কি খেয়ে দেয়ে কোনও কাজ নেই ?'  চুপ করে শুনল, খট করে মোবাইল অফ করে দিলাম কিছুক্ষণ

চারদিকে খেয়াল রাখি । বেরোতে গেলে আশপাশ ভাল করে লক্ষ্য করি কেউ পেছু নিল কি না । ওমা ওই তো থুতনিতে অমিতাভ বচ্চনের মত দাড়ি একটি লোক আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে । ভাবলাম আজ আর বাসের জন্যে অপেক্ষা করব না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্যে রিক্সায় উঠে পড়লাম । আবার বাসন্তি । আবার এক ঝাক গালাগাল । আশ্চর্য এক একদিন এক এক নম্বর থেকে ফোন করে । কখনো কখনো কাজের মেয়েটি ধরে , সেও ছেড়ে কথা বলে না । হুমকি দিলাম পুলিসে জানাব । আমার এক পরিচিত বেশ রাগি রাগি একটি ছেলেকে দিয়ে আচ্ছা করে হুমকি ও দেওয়ালাম । উ হু কোন কাজ হয় নাভাবলাম তবে কি কোন রাজনৈতিক দল ? জেনে গেছে আমি কোন দলকে ভোট দেই ! পাড়ার ইলেকট্রিসিয়ান দেখি আমাদের গেটের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টে আমার ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে আছে । সে আবার আমার বিপক্ষের সমর্থক । চারিদিকে হাওয়া গরম । জেনে গেছে হয়ত! সুড়ুত করে ব্যালকনি থেকে সরে এলাম ।  আবার কিছুদিন পর , 'বাসন্তি '
      
ফ্ল্যাটের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে কদিন আগেই খুব তুলকালাম হয়েছে একটি মা্রোয়াড়ি পরিবারের সঙ্গে । যথেচ্ছভাবে জলের অপচয় করে । কাজের লোককে জ্বরের মধ্যে ছাদে শুতে দিয়েছে । ফ্ল্যাটে চারখানা বাথরুম থাকা সত্ত্বেও কাজের লোককে টয়লেট করতে দেয় না ইত্যাদি ইত্যাদি । এ ভাবে একটা অশান্তির মধ্যে দিন কাটছিল । মাথা নোয়াবার স্বভাব মোটেই নেই । তা সত্ত্বেও এমন একটা অসভ্যতাকে দিনের পর দিন সহ্য করা মানসিক চাপ তৈরি করছিল । স্বভাব খারাপ । কথায় কথায় ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া আকছার ঘটে । কখন কখন ভাবি এরকম ভাবছি কেন ? লোকটি হয়ত আমার প্রেমে পড়ে গেছে । হয়ত আমাকে বলতে পারছে না । আমি তার সাগরিকা ! আমি বাসন্তি ! অলস দুপুরে ফোনটি বেজে উঠলো । মায়াময় চোখে তাকিয়ে রইলাম । বেজে বেজে ক্লান্ত হল সে। 


                                                                      স্বীকারোক্তি 


                                      ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়       


কয়েকদিন আগে ট্রেনে করে ফিরছি এক জায়গা থেকে কোন এক স্টেশনে ট্রেন থামতেই এক মহিলা উঠলেন। মহিলা বলব কিনা জানিনা, সোজা কথায় আমরা যাকে হিজড়ে বলি,তাই সামনে যাকে দেখছে তাকেই বলছে টাকা দাও মেয়েদের কামরা, খুব বেশী ভিড় নেই কয়েকজনের কাছে টাকা চাইলেন মহিলা কিন্তু, এ পর্যন্ত দিলেন মাত্র একজন । আমি এত বছর বয়স পর্যন্ত ট্রেনে এত জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছি কিন্তু আমার সামনে এসে কোনোদিন কোন হিজড়ে মহিলা/পুরুষ এভাবে টাকা চায়নি গায়ে ঠেলা মেরে তিনি হাত পাতলেন টাকা চাইলেন কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলেন না,ওপাশে চলে গেলেন ফিরে এসে আমার উল্টো দিকে বসা এক অবাঙ্গালী মহিলার গায়ে ঠেলা মারতেই রেগে উঠলেন তিনি--যা ভাগ ! তোদের জন্য টাকা নিয়ে বসে আছি নাকি’ ? সব সময় তোদের বদমাইশি ‘...হিজড়েটি রেগে উঠলেন পরণের কাপড় প্রায় হাঁটু অবধি তুলে একটা খারাপ ইঙ্গিত করে বললেন...আমরা কী করে বেঁচে আছি, জানিস না ? তুই ত ভারী হারামি আছিস রে’ ! কামরা সুদ্ধ লোক হতবাক ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার কাছে আসতেই খুচরো পয়সার ব্যাগ খুললাম এক টাকা ভেবে একটা পাঁচটাকার কয়েন দিয়ে ফেললাম যাঃ, গেল পাঁচটাকা, কিন্তু ওর কথার ভয়ে আর কিছু ভাবিনি মহিলাটি এগিয়ে এসে আমার মাথায় চুমো খেলেন, ‘ তুই কি ভালো রে, ছোড়দি ‘...আমি অবাক গলার স্বর কর্কশ, কিন্তু ভঙ্গী মেয়েলী। 

পরবর্তী স্টেশন আসতেই উল্টো দিকের বেঞ্চে জায়গা খালি হল, এসে বসলেন একবার মাথার খোঁপায় হাত দিয়ে চুল ঠিক করে নিলেন তারপর চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন কোনদিন এভাবে এদের কাউকে বসে থাকতে দেখিনি দলবেঁধে ওঠে, চ্যাঁচামেচি করে পয়সা চায় আবার দলবেঁধে নেমে যায় ক্লান্ত হবেও ব ! এই মেয়েটি কি একলা ? পরণে লাল-কালোর সিন্থেটিক শাড়ী, লাল ব্লাউজ, হাতে মেয়েলী ব্যাগ মুখখানি কিন্তু খুব পুরুষালী নয় গন্তব্য স্টেশন এলে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যাবার আগে যিনি একটাকা দিয়েছিলেন তার দিকে হাত তুলে নমস্কার করলেন । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। নেমে যাবার আগে একটু হেসে হাত নেড়ে আমাকে বললেন চলি রে ছোড়দি, আবার দেখা হবে‘... পাঁচটাকায় এত মায়া কেনা যায় ! আমি ভাবি ।
         
সেই মহিলা যিনি একটাকা দিয়েছিলেন, বললেন--সরকার থেকে ওদের কিছু টাকা দেয়, কিন্তু ওতে কিছুই হয় না আজ কালকার দিনে আমরা দুজনে চাকরি করেও সংসার চালাতে পারি না, ওরা কি করে বেঁচে থাকবে বলুন তো ?এতজন এখানে আছে, একটা করে টাকা দিলেও তো কিছু টাকা হত,বলুন ? ভাবছে, মানুষ ভাবছে এভাবেই তৈরি হবে সহমর্মিতা,ভালবাসা ওদের প্রতি আমি ভাবিনি কেন ! বাড়ী ফিরে কাতর হয়ে একটা কবিতা লিখেছি , কিন্তু সেটা কি জীবনবোধের শিক্ষা থেকে নাকি প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তা এখনো বুঝিনি