গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১২


    সুন্দরী
                             
মিত্রপক্ষ সাই

         আজ দুপুরটা ছিল অন্যরকম কেন জানিনা , অন্য রকম একটা দূপুর লোহার কড়াইয়ে তেঁতুল আর পাঁচ ফোঁড়নের সম্বর দিয়ে ঢক ঢক করে জল ঢালতেই ছ্যাঁত করে উঠলো তপ্ত লোহা তেঁতুলের অম্বল দিয়ে এক পেট ভাত খেয়ে সবে দিবা নিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছি , এমনি সময় একটা হলুদ প্রজাপতি এসে ঢুকলো ঘরে চৈত্র দূপুরের যা তেজ ! ভাবলাম দূপুরের অতিথিকে জল, বাতাসা দিই । একটা মাটির সরায় দুটি বাতাসা আর চায়ের কাঁপে একটু জল দিয়ে বসে থাকলাম
          
আমার আতিথেয়তা পছন্দ হয়নি বোধহয় ছুয়েও দেখল না যে পথে এসেছিল সে পথেই উড়ে গেল হলুদ প্রজাপতি আমার ঘর ছেড়ে চোখটা সবে লেগেছে, এমনি সময় বাঁশের দরজায় ঠকঠক মৃদু আওয়াজ এই অসময়ে আবার কে এলো ! দরজা খুলতেই দেখি সুন্দরী, নির্ঘাত আমায় আবার গালিগালাজ করতে এসেছে চোখ ছল ছল করছে ঘরে বসালাম রোদে ঘেমে নেয়ে এক্কেবারে হাঁপাচ্ছে। কি ব্যাপার সুন্দরী, এই সময়ে ! আজ তো কিছু আনিনি তোমার বাগান থেকে ! ধপ করে মাটিতেই বসে পড়লো প্রজাপতির জল, কিছু না বলেই কাপ উপুড় করে গলায় ঢাললো বাতাসাটা ছুয়েও দেখল না একবার আমার হলুদ প্রজাপতির জল শেষে কিনা সুন্দরীর পেটে ! আসলে ওর সঙ্গে আমার আজীবনের শ্ত্রুতা ওর পেঁপে, সজনে, লেবু, লঙ্কা, কাঁচা আম আমি নিজের মনে করে সবসময় খেয়েছি পান এনে দিয়ে, বই নিয়ে পালিয়েছি। ইচ্ছে করেই খপ করে হাত চেপে ধরেনি আমার। গালাগাল করেছে কে শোনে কার কথা

- আবার কাল আসবো সুন্দরী । কচুর শাক করে রেখো তো বাদাম দিয়ে আমায় দেখলেই তাড়ায় আবার ডেকে সন্দেশও খাওয়ায় । খিস্তিটা মুফতে পাই। আমায় মিনসে বলে ডাকে আমি ডাকি সুন্দরী রংটা এক্কেবারে কচি আমপাতার মতো ব্যাতিক্রম শুধু একাদশীর দিন , সেদিন আবার সুন্দরী শান্ত, স্থির, ধীর কি যেন ভাবে, কাকে যেন সারাদিন খুঁজে বেড়ায়
- এই মিনসে নে এটা ধর
-
কি আবার! ভেবেছিলাম লেবু হবে বা পেয়ারা । খুব বেশী হলে নারকেল নাড়ু হাত বাড়ালাম সুন্দরীর দিকে মুচকি হেসে
সুন্দরী আমায় যা দিল হাতে, আমি অবাক !
কালচে হয়ে যাওয়া সোনায় বাধানো সাদা পাথরের একটা নাকছাবি মুহূর্তেই মাথাটা যেন ঘুরে গেল।
অবাক আমি, এটা কেন ? আমাকে কেন ? কি করবো এটা !
-
মিনসে তোর নয়, ওই পোড়ামুখিটার জন্য অমন চাঁদ পানা মুখে নাকছাবি না থাকলে সুন্দর দেখায় ! এটা ওকে দিস
কাকে...!
-
তোর সুন্দরীকে আমার রক্তকরবী দে মিনসে আমি বের করে দিলাম বইটা বালিশের নীচে থেকে কখন জানলো কে জানে, আমি এনেছি বইটা !
আর দাঁড়ালো না সুন্দরী আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখছি জ্ঞানশূন্য হয়ে তাঁর চলে যাওয়া একবারও পিছু ফিরে তাকাল না
          
পোস্ট মাস্টারের মেয়ে ছিল পদ্য লিখত। রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চাটুজ্যে গুলে খেয়েছে আমি ‘রক্তকরবী’ প্রথম সুন্দরীর কাছ থেকেই সন্তর্পণে চুরি করে এনেছিলাম, দিতে ভুলেও গিয়েছিলাম ইচ্ছে করেই আজ ছিল দশমীর ভাসান বাসন্তীর এই অসময়ে বাপের বাড়িতে আসাটা যেন কেউ বিশেষ একটা পছন্দ করে না। তাই অনাদরেই আবার পাড়ি দেয় স্বামীর ঘরে
এতো রোদ্দুর সহ্য হয়নি সুন্দরীর ঘরে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিন্তে শীতল পাটিতে মাটির বিছানায় উমনের চিৎকারে দৌড়ে গেলাম , ততক্ষণে হাত দুটি হিম হয়ে গেছে সুন্দরীর হাতে ‘রক্তকরবী’র শেষ পাতাটি মুঠো করে ধরা, লাইন গুলি স্পষ্ট, 'ঐ দেখো, ধুলায় লুটচ্ছে তার রক্তকরবীর কঙ্কণ ডান হাত থেকে কখন খসে পড়েছে আজ সে রিক্ত করে দিয়ে চলে গেল...' 
          
আমার হলুদ প্রজাপতিও আজ ভাসানে গেছে । সুন্দরীর শরীরে তেল হলুদ মাখাচ্ছি আমি, চাঁদের আলোয় সুন্দরীর রঙে ভাটা পড়েছে, চামড়া কুচকে গেছে অনেককাল। 
রয়ে গেছে নাকছাবিটা এখনও অক্ষত আমার পকেটে হায়রে নন্দিনী, তোমার জন্য আমার সুন্দরীর উপহার, নেবে না তুমি ?