গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২০

রত্না বড়ুয়া (মজুমদার)

 

নিশানায় আঁধারমানিক

আমি কেবল চেয়ে আছি লাল নিশানাটার দিকে। মোবাইল ট্র্যাকার। আমার মোবাইল আমাকে ছাড়াই দিব্যি এগিয়ে যাচ্ছে একা একা। ও তো আমারই। কে যেন ফিসফিস করে বলল, ‘যখন যার হাতে থাকে তার, তোমার আবার কি?’

চারদিকে চেয়ে দেখলাম। না, কেউ নেই। তবু শুনতে পেলাম। একটু আগে আমার পকেট থেকেই ওটা তুলে নেওয়া হয়েছে। কারা করল? কে জানে কারা! আমি এসে দাঁড়ালাম মেট্রো স্টেশনে ঢোকার মুখটাতে। সিঁড়ি বেয়ে নামা। কথা বলছিলাম ফোনে। ঘণ্টায় অন্তত চোদ্দবার কল আসে। সবই কাজের কথাবার্তা। টেলি-কমিউনিকেশন আমার পেশা। ভারত-সরকারের স্বাধীন এক সংস্থায়। আমার অধীনে কর্মী অনেক। আমাকেই চালাতে হয় প্রায় একটা আস্ত অফিস। বিশ্রাম নেই। ফোন বন্ধ করা বারণ। অজস্র রিপোর্ট, কৈফিয়ত চলতেই থাকে।

 

ওধারে ডিউক রেস্টোর‍্যান্ট। কথা বলতে বলতে ভাবছিলাম সিঁড়ি ধরে এবার নামা যাক। হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত এসে বুক পকেট থেকে তুলে নিল আমার মোবাইল। বিদ্যুতের চাইতেও দ্রুত যেন সারা হয়ে গেল কাজটা। আরও একটা হাত এগিয়ে এল চোখের সামনে। পুরনো হাত থেকে নতুন হাতে চোখের পলকে এবার চালান হয়ে গেল মোবাইলটা। হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইলাম নতুন হাতটাকে। কিন্তু পুরনো সেই হাতটা আঙুল তুলে সাবধান করল যেন। আমি হাত নামিয়ে নিতেই শুরু হল দৌড়। লোক দুটো দেখতে না দেখতে হিন্দু মিউচুয়াল বিল্ডিং-এর দিকে চলে গেল।

 

কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি একটু ধাতস্ত হয়ে দেখি আশপাশের মানুষ কৌতূহলী চোখে আমার দিকে চেয়ে। আমিও নিজেকে দেখতে লাগলাম। এটা কি করে ঘটল! এ জাতীয় বিপদের আশঙ্কা হয়ত কেউ করেন না। অন্তত আমি তো না। আমার সামনে এতক্ষণ থমকে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে যে লোকটা সবার আগে জীবন্ত হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তাকে আমি চিনি। মেট্রো-স্টেশনের সামনে এক চা-বিক্রেতা। ফিসফিস করে বলল, ‘সাহেব, ওরা তিনজন অনেকক্ষণ আমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল। একদম মার্কামারা। ইলাইচি চা খেল, বিস্কুট দিয়ে। আপনি আসছিলেন ফোনে কথা বলতে বলতে, আপনার দিকেই দেখছিল। বলছিল, শালা দেখছি রোয়াব দেখাচ্ছে, সেটটা তুলে নে।‘

 

‘তুমি চেনো ওদের?’

 

‘চিনি তো। আসে যায়, চা-বিস্কুট খায়। উধাও হয়ে যায়। আমার নামটা কোথাও বলবেন না যেন, পরদিন আমার লাশ নামিয়ে দেবে। আমি একা কেন, সকলেই দেখেছে। অনেকে চেনেও। কিন্তু কেউ কিছু বলবে না। লোককে করে খেতে হয় স্যার। কিন্তু থানায় ডায়েরি লেখান এখুনি, ছাড়বেন না।‘

 

এবার আমি থানা। ও-সির সামনে এসে দাঁড়াতেই বাজখাই কণ্ঠে জানতে চাইলেন ---’কি ঘটেছে?’

 

‘একটা ডায়েরি করতে এসেছি স্যার।‘

 

‘কিন্তু ঘটেছেটা কি? ...আপনার নাম?’

 

‘সন্দীপ মুন্সি।‘

 

‘বয়স?’

 

‘তেত্রিশ।‘

 

‘কি হয়েছে? বউ পালিয়েছে?’

 

‘আজ্ঞে না। বিয়ে করিনি। বউ পালায়নি। মোবাইল ---’

 

‘চুরি গেছে? এই তো চক্কর মেরে এলাম একটু আগেই। সামনেই পুজো। ক্রাইম বেড়েছে চার গুণ। থিক থিক করছে বদমাশে। ...কিন্তু কি ঘটেছে বলবেন তো আগে?’ খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন তিনি।

 

‘আমার মোবাইলটা বুক পকেট থেকে তুলে নিয়েছে দুটো লোক। চাঁদনি মেট্রো স্টেশনের গেটের মুখটাতে ---’

 

‘চাইনিজ না তো? দাম কত?’ একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে উঠলেন অফিসার।

 

‘না স্যার। চাইনিজ নয়। ওটা আস্ত একটা কম্পিউটার। আমার সব কাজ আমি ওতেই করতে পারি। লাখ টাকার কাছাকাছি দাম। অনেক ফাইলপত্রও রয়ে গেছে মোবাইলে। আমি তো অসহায় হয়ে পড়েছি স্যার।‘

 

আমার মাথা থেকে পা অবধি একবার দেখে নিলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘হুম, তা একটা ডায়েরি লিখিয়ে যান, লালবাজার থেকে সেন্ট্রালি আমরা মোবাইলের আই-এম-ই-আই নাম্বার ধরে ট্র্যাক করি। যদি ধরা পড়ে আপনার মোবাইল, ফেরত পাবেন নিশ্চয়ই। আশি শতাংশ লোক চুরি যাওয়া মোবাইল ফিরে পান। আপনিও পাবেন আশা করছি। তবে সব কিছুর পরেও ভাগ্য বলে ব্যাপার আছে তো ---’ বলে একটু হাসলেন যেন।

 

‘আমার সেকেন্ড মোবাইল, এমন কি কম্পিউটার থেকে আমি নিজেও ট্র্যাক করতে পারি স্যার। আমার মোবাইল ট্র্যাকারে ওই সেটটা অ্যাড করা আছে। আমিও যদি কিছু জানতে পারি, আপনাদেরকে জানাব।‘

 

‘সে জানান। কিন্তু আমাদের ট্র্যাকারে ধরা না পড়া পর্যন্ত কোনও অ্যাকশন নিতে পারব না।‘ বলে ও-সি সাহেব অন্য কাজে মন দিলেন।

 

আমার অন্য মোবাইলের পর্দায় একটু রাতে লাল আলো জ্বলে উঠল। ট্র্যাকার অ্যাক্টিভ। অর্থাৎ চুরি যাওয়া মোবাইলটা অন করা হয়েছে। একটা বিপ বিপ সংকেতও আসছে। জিপিএসে দেখাচ্ছে, শিয়ালদা বা কাছাকাছি কোথাও ওটা রয়েছে এখন। হন্তদন্ত হয়ে থানায় ফোন করলাম। অন্য অফিসার। ডিউটি বদল হয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই। তিনি একটুক্ষণ শুনেই বেশ বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘পরে ফোন করুন। আজকেই চুরি গেছে আপনার ফোন, আর আপনি আজকেই ফেরত পাবেন আশা করছেন?’

 

পরদিন বিকেলে আবার থানায় গিয়ে ওই পুরনো ও-সি’কে পেলাম। কাতর স্বরে তাঁকে জানালাম, ‘কাল রাতে আমি ট্র্যাকারে দেখেছি আমার ফোনটা শিয়ালদার কাছাকাছি কোথাও আছে।‘

 

‘শিয়ালদা? হুম, তার মানে নির্ঘাত বসিরহাট পৌঁছে গেছে এতক্ষণে, তারপর, ...বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশে যদি চলে না গিয়ে থাকে ---’

 

‘বাংলাদেশ?’

 

‘ইয়েস স্যার। কলকাতায় চুরি যাওয়া ফোন বাংলাদেশে চলে যায়, আর মুম্বাইয়েরগুলো পাকিস্তান, আর খুব দামী ফোন হলে দুবাইয়েও চলে যেতে পারে। কিন্তু যদি একবার আপনার ফোন বাংলাদেশে চলে যায়, তবে ফেরত আসার সম্ভাবনা কম। কপু কিস্যু করতে পারবে না।‘

 

‘আমার ফোনটা কি একবারও আপনাদের ট্র্যাকারে ধরা পড়েছে স্যার?’

 

‘মনে হয় না। দাঁড়ান ---’ বলে কাকে একটা ফোন করলেন ডায়েরি নম্বরটা আমার থেকে চেয়ে নিয়ে। সম্ভবত লালবাজার। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘না স্যার। আপনার ফোন শেষ চব্বিশ ঘণ্টায় পুরোপুরি সুইচড অফ! কিন্তু আপনি বলছেন, আপনি আপনার ট্র্যাকারে ধরতে পেরেছেন ---আপনার ওই অ্যাপটা ঠিকঠাক আছে তো? নাকি আপনাকে ভাঁওতা দিচ্ছে?’ তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘আপনারটা লাখ টাকা দামের বলছিলেন না? দাঁড়ান, মুম্বাই পুলিশকেও আপনার কেসটা দিয়ে রাখি। আপনার ফোনের দুবাই যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।‘ তারপর ভীষণই অপ্রসন্ন মুখে আমার মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘কে যে বলে এত দামী দামী ফোন হাতে আপনাদেরকে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে? এখন বুঝুন ঠ্যালা! যদি একবার অন্য দেশে চলে যায় না ---জন্মের মত গেল। ফেরত আসবে না।‘

 

এরপর কেটে গেল আরও তিন-তিনটে দিন। মাঝে মাঝেই ট্র্যাকারে সঙ্কেত ভেসে ওঠে। কখনও আমার ফোনটা বসিরহাট রয়েছে দেখায়, কখনো বা জোড়াসাঁকো। কি মুশকিল! সত্যিই কি প্রাইভেট ট্র্যাকারগুলো একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়? ও-সি ঠিকই বলেছিলেন। এক রাতে দেখলাম, জিপিএসে জ্বলজ্বল করছে মুম্বাইয়ের কোনও একটা পিন কোড। মনটা ভেঙে গেল আমার। হায় রে, আমার সাধের ফোন এবার দুবাইয়ের ফ্লাইটের টিকিট কাটছে নিশ্চয়ই। পরদিন হন্তদন্ত হয়ে থানায় গেলাম আবার।

 

‘স্যার! আমার ফোনটা মুম্বাই পৌঁছে গেছে! জলদি কিছু একটা করুন স্যার।‘

 

‘হুম, আমরাও দেখেছি।‘ বলে আবার ফোন লাগালেন লালবাজারে। খানিক কথাবার্তার পর আমার দিকে চেয়ে আফসোসের সুরে বললেন, ‘আর হবে না স্যার। আজ ভোরের প্লেনে পাকিস্তান চলে গেছে আপনার ফোন। ব্যাড লাক আপনার, অ্যান্ড ফর কপু অলসো।‘

 

আমার মনে পড়ল, বছর দশেক প্রায় আগের একটা দিনের কথা। ডালহৌসি’তে কি একটা হিন্দি সিনেমার শুটিং চলছিল। লোকে লোকারণ্য। নায়িকা সোনাক্ষী সিনহা পরির মত বসে রিকশায়। সেটা চালাচ্ছেন ছবির নায়ক সইফ আলি খান। ভাদ্রের রোদে মুখ টকটকে লাল। সইফ যে এত ফরসা মানুষ, কাছের থেকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। সকলের মত আমিও ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে অভিজাত সুপুরুষ রিকশাচালক আর এক সুন্দরী যাত্রীর নানা কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম। কখন যে এক ফাঁকে আমার মোবাইলটা কেউ তুলে নিয়েছে পকেট থেকে, জানতে পেরেছিলাম ঘণ্টা কয়েক একটাও ফোন না আসাতে।

 

তখন সবে বোধহয় চাকরিতে ঢুকেছি। মোবাইলের দামও তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই কম। তখন এত রকমের দামী, অতি আধুনিক সব মোবাইল বাজারে আসেওনি। তবু বেমক্কা মোবাইলটা খোয়া যাওয়াতে দুঃখ হয়েছিল যথেষ্টই। ভাবছিলাম, কত লোকই না সেদিন হাঁ করে আমার মত শুটিং দেখছিল, আর মোবাইল চুরি গেল কি না সেই আমার! মনে হয়, আমার মত আরও অনেকেরই সেদিন মোবাইল খোয়া গেছে, আমার মতই দাঁতে দাঁত চেপে তারা দুঃখ লাঘব করার চেষ্টায় রয়েছে। যা হোক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন মোবাইল কেনা হল। পুরনো মোবাইলের দুঃখও ভুলে গেলাম আমি। নতুন চাকরি, নতুন উদ্যম। ভুলেই গেছিলাম, কোথায় গেল আমার সেই চুরি যাওয়া মোবাইল। আরবসাগর, বঙ্গোপসাগর, পেট্রাপোল, দুবাই, কাতার, দার্জিলিং, ডুয়ারস, এসব শব্দ কোনোদিন মাথাতেও আসেনি আমার।

 

কিন্তু এখন আসে। আঁধার রাতে ট্র্যাকার অন করে বসে থাকি আমি। যদি চোর ব্যাটাকে একবার পাই, এমন শিক্ষা দেব না! এক ঘুসিতে ওর মোবাইলটাই সবার আগে ভেঙে দেব। ট্র্যাকার আমাকে আরও আঁধারে নিয়ে যায়। কখনো দেখায় আমার সেই আঁধারমানিক লখনউতে, পরের দিন থিরুবনন্তপুরমে তো, তার পরের দিন জোকা, কিংবা ঘাটশিলায়।

 

আবার একটা নতুন মোবাইল কিনব-কিনব ভাবছি, একদিন লালবাজার থেকে ফোন এল। ‘মিঃ মুন্সি, আপনার চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন খুঁজে পাওয়া গেছে। ফোনের আই-এম-ই-আই নাম্বার মিলিয়ে নিয়ে যান। আর হ্যাঁ, নিজের একটা আইডেন্টিটি সঙ্গে আনাবেন। ...হ্যাঁ, আধার-কার্ড চলবে।‘

 

ছুটতে-ছুটতে গেলাম লালবাজারে। প্রায় কয়েক শো মোবাইল উদ্ধার হয়েছে কোনও একটা চোরাই আস্তানা রেইড করে। সেই কয়েক শো মোবাইলের মালিকানা উদ্ধারে প্রায় হাজার খানেক নারীপুরুষ লাইন লাগিয়েছে। এক সময়ে সকলের মত আমারও ডাক এল। আমার চুরি যাওয়া ফোনের মডেলের তিনটি মাত্র ফোন উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ। ফোন তিনটে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, ওগুলোর একটাও আমার নয়। তবু আই-এম-ই-আই নম্বর না মিলিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। মিলল না। আমাকে হতাশ দেখে কর্তব্যরত অফিসার হাসিমুখে বললেন, ‘খুব দামী ফোন তো, তাই মাত্র তিনটে পেয়েছি। আশা করছি পরের লটে আপনারটা পেয়ে যাব।‘

 

রাত-বিরেতে আমি ‘কলকাতা পুলিশ’-এর ফেসবুক-পেজটা দেখি। সত্যি, স্যালুট না করে উপায় নেই। কিভাবে কত না চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন তাঁরা সিনেমার চাইতেও রোমহর্ষক উপায়ে উদ্ধার করে আনছেন, আর তুলে দিচ্ছেন ফোনের মালিকের হাতে। কত না মানুষ তাদের ফোন ফেরত পেয়ে আনন্দে অভিভূত হয়ে ফেসবুক পেজে কলকাতা পুলিশের প্রতি ধন্যবাদ, অভিনন্দন, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতার বার্তা লিখছেন, তার ইয়ত্তা নেই। ইশ, আমি যদি আমার ফোনটা ফেরত পেতাম, আমিও লিখতাম। কত কিছু লিখতাম। প্রাণ ভরে লিখে দিতাম যা মনে আসে। এতগুলো মানুষের সঙ্গে চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন ফেরত পাওয়ার অনাবিল আনন্দ ভাগ করে নিতে পারতাম। থানার সেই ও-সি সাহেব ঠিকই বলেছিলেন, আমার ভাগ্যটাই খারাপ!

 

কিন্তু একদিন একটা কাণ্ড ঘটল। বেশ কিছু মাস পরের কথা। আমি আমার এক সিনিয়র বন্ধুর সঙ্গে কফিহাউজে আড্ডা মেরে কলেজ স্ট্রিট ধরে হাঁটছি। একটু আগেই ঝমঝমে বৃষ্টি ছিল, এখন বাইরেটা আরামের। আমার সঙ্গী অর্ধেন্দু’দা পেশায় এখন প্রমোটার। এককালে সরকারি চাকরি করতেন, এখন ভি-আর নিয়ে দিনভর শহরের পুরনো বাড়িগুলোর দিকে নজর তাঁর। গম্ভীর স্বরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে ভালবাসেন। হয়ত এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না, পুরনো বাড়ি না রবীন্দ্রনাথ, কে হবে তাঁর আগামী দিনের অনুচর। সেই নিয়েই আলোচনা করছিলেন আজ আমার সঙ্গে। বলছিলেন, ‘পুরনো বাড়ি হচ্ছে ঠিক রবীন্দ্রনাথের মত, যাকে ভাঙলে সবসময়েই নতুন কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।‘

 

এমন সময়ে এসেছিল মায়ের ফোন। রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। ‘শোনো, এখনি চলে যাও পার্ক সার্কাসের প্যারিস চার্চের সামনে। ওখানে এক ভদ্রলোক তোমার ফোনটা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। যত রাতই হোক, উনি তোমার জন্যে অপেক্ষা করবেন, হ্যাঁ, এখনই যাও, কারণ কাল থেকে উনি তিন দিনের জন্যে বাইরে চলে যাচ্ছেন।‘

 

‘কিন্তু উনি তোমার নম্বর কোথায় পেলেন? নাম জিগ্যেস করেছ ওনার?’

 

‘সন্ধ্যের পর শুয়েছিলাম, তোমরা বাড়িতে নেই কেউ, বাড়ি ফাঁকা। একটু ঘুম ঘুমও এসেছিল। তখনই ফোন। কি একটা নাম বলেছেন, আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে বললেন যে, তোমার ফোন থেকেই উনি আমার নাম্বার পেয়েছেন। মা –--নামে সেভ করা আছে। তাই সবার আগে আমাকেই ফোন করেছেন। তুমি আর দেরি কোরো না, এখনই যাও। যদি সঙ্গে কেউ থাকে তাকেও নিয়ে যাও। একলা যেও না।‘

 

‘কিন্তু মা, এত রাতে কেউ আর যাবে বলে তো মনে হয় না। দেখি দাঁড়াও ---’

 

মায়ের ফোনটা রেখে অর্ধেন্দু’দাকে বললাম, ‘কি যাবেন নাকি একবার পার্ক সার্কাস? প্যারিস চার্চের সামনে? এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করাটা খুব জরুরি ---’

 

‘প্যারিস চার্চ? ওরে বাবা! ও তো গোরস্থানের উল্টোদিকের রাস্তায়, এত রাতে যাবে? কাল সকালে গেলে হবে না? আমরা একসঙ্গে যাব।‘

 

আমি গোঁ ধরে থাকাতে উনি একটি ট্যাক্সি ডেকে দৌড়ে উঠে পড়লেন। মা’কে ফোন করে জানালাম, আমি একাই যাচ্ছি।

 

একটা খালি ট্যাক্সিকে রাজি করাতেও বেশ বেগ পেতে হল। সত্যিই ভাগ্যের মহিমা। আধ ঘণ্টা লেগে গেল একটা ট্যাক্সি পেতে, আর অর্ধেন্দু’দা পা বাড়াতে না বাড়াতেই ট্যাক্সি পেয়ে দিব্যি কেটে পড়লেন।

 

ট্যাক্সিতে বসে উত্তেজনা হচ্ছিল খুব। কে এই লোকটা? কি করে সে আমার মোবাইলটা পেল? ওটা কি তবে সত্যি এখনও শহরের বাইরে যায়নি? মুম্বাই হয়ে পাকিস্তানে যায়নি? লোকটা পাকিস্তান থেকে ওটা উদ্ধার করে এনেছে, বা কুড়িয়ে পেয়েছে বলে মনে হয় না, আচ্ছা, লোকটা ওই সন্ত্রাসবাদী-টাদী নয় তো? ভাবগতিক আমার সুবিধের ঠেকছে না। লোকটা আর যাই হোক, সন্ত্রাসবাদী নয়, এই চিন্তাটা মাথা থেকে অনেক চেষ্টায় সরাতে পারলেও, লোকটা পুলিশ, বা পুলিশের কাছের লোক, না হলে চোর-ডাকাত, গুণ্ডা-বদমাশ হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু পুলিশ না হয়ে ডাকাত হয় যদি? এত রাতে মোবাইল ফেরত দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ডেকে এনে যদি সর্বস্ব লুট করে? ওয়ালেটের ভেতর পাঁচশো আশি টাকা, হাত ঘড়ি, দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা, অফিস ব্যাগ, বারশো সম্ভবত, মোবাইলটা সাড়ে পাঁচ হাজার, জামা-জুতো ইত্যাদি মিলিয়ে আরও প্রায় হাজার তিনেক! অনেক টাকা লুটের সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। এতটা এসে ফেরার প্রশ্ন ওঠে না।

 

ট্যাক্সি-চালক অল্প বয়সী একটি ছেলে। আমাদেরই ওদিকে বাড়ি। নাম ওসমান। আমি পার্ক সার্কাস হয়ে বাড়ি ফিরব বলেই না সে এতটা উল্টো পথে আসতে রাজি হয়েছে। ওসমান’ই এখন আমার বন্ধু বলতে বন্ধু, বা সহযোদ্ধা। তাকে বললাম, তুমি কিন্তু গাড়ি ছেড়ে দূরে যেও না, যে কোনও সময়ে আমাকে দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসতে হতে পারে। ওসমান কিছু না বলে, অবাক হয়ে আয়নার ভেতর দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল।

 

প্যারিস-চার্চের ঠিক সামনেটায় আলো রয়েছে। যদিও গোটা রাস্তাটাই শুনশান। একটা-দুটো কুকুর ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। চার্চের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক। মাঝারি গড়ন, উচ্চতা মাঝারি। গায়ের রঙও মাঝারি। পরনে শ্যামলা ফতুয়া আর পাজামা। আমাকে দেখতে পেয়েই যেন একবারে চিনে ফেললেন।

 

‘আসুন, আসুন। এত রাতে আপনাকে ডেকে এনেছি বলে খুবই বিব্রত আমি। কিন্তু কিছু করার নেই। কালকেই পরিবার নিয়ে মাইথন চলে যাচ্ছি। তার আগে কুড়িয়ে পাওয়া মোবাইলটার একটা সদগতি করে যাই।‘ ভদ্রলোক বেশ হৃদ্যতা নিয়েই কথাগুলো বললেন আমার হাত দুটো ধরে।

 

‘কুড়িয়ে পেয়েছেন? কিভাবে পেলেন ফোনটা?’

 

‘যে হলুদ ট্যাক্সিতে আপনি এসেছেন, এরকমই একটা ট্যাক্সিতে। বিকেলে ডালহৌসিতে। একটা মদ্যপ লোক ভাড়া দিয়ে নামার সময়ে ওর পকেট থেকে তাড়াহুড়োতে পড়ে গেছিল সম্ভবত। চেহারাটা মনে নেই, তবে বেশ তাগড়াই ধরনের, এটুকু মনে পড়ছে। ফোনটা ছিল সুইচড অফ। প্রথমে ভেবেছিলাম থানায় জমা করে দিয়ে আসি। ল্যাঠা চুকে যাক। কিন্তু মনে হল, যদি চোরাই মাল হয়, তবে পুলিশ তো আমাকে জেরা করে করে মাথা খারাপ করে দেবে। ছাড়বে না। সাহস করে থানায় যেতে পারলাম না। বাড়িতে এসে মেয়েকে বললাম, দ্যাখ তো মা, কোনোভাবে এর মালিকের সন্ধান পাওয়া যায় কি না, ...থানা-পুলিশে আমার বড্ড ভয় ভাই।‘ ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন।

 

আমার বেশ লাগছিল ভদ্রলোকে। ‘আসুন, আমার বাড়িতে আসুন। এই দু-মিনিটের হাঁটা পথ।‘

 

‘কি জানেন তো, আপনার ওই ফোন, ...মেয়ে বলল, এ তো সাংঘাতিক দামী, এ জিনিস বাড়িতে রাখা যাবে না বাবা। যে করে হোক, এটা এর মালিককে পৌঁছে দিতে হবে। এত দামী ফোন হারালে তো মানুষ পাগল হয়ে যাবে! তাই আমাদেরও টেনশন হচ্ছিল।‘ হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রলোকের বাড়ি প্রায় চলে এসেছি আমরা।

 

রাত প্রায় পৌনে এগারোটা। ভদ্রলোকের বসার ঘরে দাঁড়িয়ে আমি। হাতে আমার মাস কয়েক আগে চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন। ভেবে পাচ্ছিলাম না, ঠিক কিভাবে ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানাব। সবুজ রঙের দেয়ালে সাদা ছোপ ধরেছে। ম্রিয়মাণ টিউবের আলোর ঠিক নীচে আমাদের এক প্রাক্তন ডাকসাইটে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি। গুরুগম্ভীর মানুষটা প্রতিকৃতিতে কিন্তু বেশ হাসিহাসি মুখে রয়েছেন। উল্টোদিকের দেয়ালে রয়েছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর সুপরিচিত হাসিটুকু নিয়ে। দুজনে মুখোমুখি হাসছেন। তার মাঝে, আমরা কয়েকজন একে অপরের সঙ্গে হাসি বিনিময়ের চেষ্টা করছি। বন্ধু হতে চেষ্টা করছি।

 

‘আপনি খুব বড় চাকরি করেন নিশ্চয়ই। নয়ত এত দামি ফোন! আমি খুব মাঝারি মানের মানুষ। রাজ্য সরকারের একটি দপ্তরে আছি। ছেলেটি বি-কম পাশ করেছে বছর দুই হল, চাকরির চেষ্টায় আছে, হয়েও হচ্ছে না। একটু দেখবেন ভাই, যদি আমার ছেলেটির কোনও হিল্লে করতে পারেন।‘ প্রায় মেঝের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন ভদ্রলোক তাঁর শেষ কথাগুলো।

 

ওঁর ছেলে উপস্থিত না থাকলেও, মেয়ে ছিল। উজ্জ্বল চোখের বেশ সুশ্রী একটি মেয়ে। সে তার বাবার দিকে কটমট করে একবার তাকাল বলে যেন মনে হল আমার।

 

‘দেখুন, আমিও মাঝারি। আমার উচ্চতা, গায়ের রঙ, মেধা, পড়াশোনা, রোজগারপাতি, সবই খুব মাঝারি।‘

 

‘কিন্তু আপনার ফোনটা দামী।‘ বলে উঠল মেয়েটি।

 

‘ওটাই হয়েছে ভুল। এই জন্যেই খোয়া গেছিল। এটা বোধহয় আমার জন্য নয়।‘

 

এবার একসাথে হেসে উঠলাম আমরা সকলে। আরও মিনিট দশেক ছিলাম আমি ওঁদের বাড়িতে। চা খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করছিলেন ভদ্রলোকের স্ত্রী। কথা দিলাম, পরে একদিন অবশ্য করে আসব।

 

ওসমানের ট্যাক্সিতে ফিরতে ফিরতে একবার মনে হল, মোবাইলটাকে কোথাও একটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে কেমন হয়? সত্যিই এটির আর কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই আমার জীবনে। অন্য একটা মোবাইলে তো দিব্যি কাজ চলে যাচ্ছে। কিন্তু, ...আমি যদি নিজের হাতে ফেলি, সব রাস্তার চতুর্দিকে পুলিশের ক্যামেরা বসানো, তার ওপর মোবাইলটাকে আজও ট্র্যাক করা হচ্ছে, ...সুতরাং বিপদের পর বিপদ। খুব বড় বিপদ হয়ে না এলেও, আমার কাছে মাঝারি মানের বিপদও যে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। ভালো লাগে এত ঝক্কি? চুপচাপ মোবাইলটা নিয়েই বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন। রাত তখন প্রায় বারোটা।