আজ কেন জানে না মন প্রচণ্ড অশান্ত হয়ে উঠেছে । মহীতোষ দেখে মেঠোপথটা এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে দিগন্তরেখায় । স্ত্রী সম্পূর্ণা এই পথ দিয়েই একদিন হাসতে হাসতে গিয়েছিলো হাসপাতালে । সহসা অদূরেই একটা বটগাছের পাতার আড়ালে একটা কোকিল কুহু-কুহু রবে ডেকে উঠলো । দূরে কোথাও সঙ্গিনীটি সাড়া দিলো । মহীতোষ জানে, এবার দু’জনে মিলে রচনা করবে নতুন নতুন জীবনের কথা । তারপর সেই নতুন জীবনও একদিন...
আচমকা কলিংবেল বেজে ওঠায় মহীতোষ যেন অশান্ত মুহূর্তগুলোর হাত থেকে কিছুটা
নিস্তার পেলো । দুষ্মন্ত এসে নতুন একটা খুরপি দিলো ওকে । অনেকদিন বাগানে হাত দেওয়া
হয়ে ওঠেনি । সেই সুযোগে আগাছায় ভরে গিয়েছে সম্পূর্ণার প্রিয় ফুলবাগান ।
খুরপি নিয়ে চলে এলো বাগানে । এসে দেখে, একদল লালপিঁপড়ে সার বেঁধে যাওয়া
আসা করছে । নিঃশব্দে অনুসরণ করে গিয়ে দেখে একটা মরা শালিখ পড়ে আছে শেফালী গাছের তলায়
। দেখেই বুকের ভিতরটায় বেদম মোচড় দিয়ে উঠলো । এবং তখনই মনে এলো বহুচর্চিত গানের সেই
বিখ্যাত লাইন - ‘শুধু যোগ বিয়োগের খেলাই জীবন’ ।
লাল পিঁপড়েগুলো শালিখটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে । আহা রে, মরে গিয়েও শালিখটা
যেন একমনে গেয়ে চলেছে জীবনের জয়গান ! কেন জানে না, মহীতোষের দু’চোখ ফেটে জল বেরোতে
চাইছে । দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো । এখুনি ভেঙে পড়লে হবে না । জীবনের অনেক কথাই যে বলা
হয়ে ওঠেনি । স্ত্রী সুম্পূর্ণা কথা দিয়েও রাখেনি । বলেছিলো, ‘অতো ভাবছো কেন ? আমি আছি
না তোমার সঙ্গে ?’ সঙ্গে আর থাকলো কোথায় ? হাসপাতালে কন্যা সন্তন প্রসব করতে সেই যে
গেল আর ফিরে এলো না । কন্যা পম্পাই এখন বড় হচ্ছে ওর মামাবাড়িতে । এবছর সাতে পড়লো ।
বাবা-মা’ও কথা রাখেননি । সম্পূর্ণা চলে যাবার পর মা খুব চেয়েছিলেন ছেলেকে
বুক দিয়ে আগলে রাখতে । কিন্তু তিনিও একদিন আচমকা না বলেকয়ে হাঁটা দিলেন অন্তবিহীন পথে
। বিরহ বেদনা সইতে না পেরে বাবা’ও মাস কয়েকের মধ্যে হাঁটা দিলেন মায়ের পথে । সেইথেকে
একেবারে একলা হয়ে গিয়েছে মহীতোষ । মাঝেমাঝে সেলফোনে কথা হয় মেয়ের সঙ্গে । পম্পাই ভুলেও
ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে না । সবসময় ‘বাবা-বাবা’ । মহীতোষ আবার অনেক কষ্টে চোখের জল
আটকালো ।
নিজেকে সামলে নিয়ে আগাছা নিড়োতে নিড়োতে ভাবলো, কতশত জীবনের কথা ছড়িয়ে
আছে এই বাগান জুড়ে ! ছোটোছোট লতাগাছগুলো হলুদ ফুল ফুটিয়েছে নিজের সবুজ শরীরের আনাচেকানাচে
। ফুলগুলো হেসে হেসে কথা বলছে দুটো ছোট ছোট সাদা প্রজাপতির সঙ্গে । ওরা নিশ্চয়ই জীবনের কথা বলছে ! ফুলগুলো
একসময় মরে গিয়ে ফলদের স্থান করে দেবে । ফলের বীজ থেকে জন্ম নেবে আবার নতুন আগাছা ।
প্রজাপতিরাও গাছের পাতায় ডিম পেড়ে সূচনা করবে নতুন নতুন জীবনের । এরপর আবার হলুদ ফুল,
আবার প্রজাপতি... অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে এই যোগ বিয়োগের খেলা ।
আজই গোটা বাগান আগাছামুক্ত করতে হবে ওকে । এই বাগানই তারপর কথার খই
ফোটাবে । মহীতোষ নিজের এই নিঃসঙ্গে জীবনটাকে এখনো বাতিলের দলে রাখতে পারেনি শুধুমাত্র
পম্পাইয়ের জন্য । মেয়েটা যদি কাছে থাকতো... সহসা চমকে ওঠে কচি কচি দুটো হাতের বেস্টনীতে
ধরা পড়ে গিয়ে । দ্রুত ঘুরে তাকিয়ে দেখে পম্পাই ! অদূরে দাঁড়িয়ে বড় শ্যালক শুভেন্দু
মুখ টিপে হাসছে । মহীতোষ সহসা অনুভব করে, ওর নিঃসঙ্গ জীবনে আবার একটু একটু করে বোল
ফুটতে শুরু করেছে ।