গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২০

তাপসকিরণ রায়

 হ্যান্টেড কাহিনী--৫৩


 
ট্রি হাউস


জীবন বাবু একটু আধটু লেখালেখি করেন। কবিতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভূতের গল্পও লেখেন। অলৌকিক ঘটনা তার জীবনে  অনেক বারই ঘটেছে। তবে বিচার বিশ্লেষণ করলে সে সব ঘটনা বেশির ভাগই মনে হয়েছে মানসিক ভীতি থেকে তৈরি হয়েছে। আসলে অনেক ক্ষেত্রে ভাবনা থেকেই আমরা মানসিক ভাবে পীড়িত হয়ে পড়ি। আর এ কারণে ভুয়ো দর্শনের  মত ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই ভয়ের কারণে আমরা আমাদের সামনে কার্যকারণহীন কিছু দৃশ্যাবলী দেখতে পাই। আমরা সামান্য ছায়াকে ভূত, স্বাভাবিক শব্দকে স্থান-কাল-পাত্রের অন্তরায় অলৌকিক পর্যায়ে টেনে নিই। এ ধরণের ঘটনা আমাদের নিজেদের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার নামান্তর বলা যায়। তবে জীবন বাবুর জীবনে বাস্তবিকই অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটেছে যাকে কার্যকারণের আওতায় কিছুতেই বেঁধে নেওয়া যায় না। 

ভৌতিক অলৌকিক ঘটনা নিয়ে লেখা জীবন বাবুর নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া আজকের গল্প--

চাকরির সুবাদে জীবন বেশ কিছু দিন রায়পুরে বাস করছেন। সরকারি চাকুরেরা নাকি অনিয়মিত অফিস করেন। যাকে বলে কাজে ফাঁকি দেওয়া।  জীবনের ক্ষেত্রে কিন্তু এ কথা প্রযোজ্য নয় বরং তিনি তার উল্টোটাই, সময়ের আগে অফিসে পৌঁছে যান, ছুটির পরেও বেশ কিছু সময় কাজ নিয়ে থাকেন। প্রত্যেকটা কাজই তিনি বেশ মনোযোগ সহকারে করেন। তাই চাকরি জীবনটা তার কাছে বড় ব্যস্ততায় কাটে।

অনেক দিন হয়ে গেল জীবন-বাবু কোথাও ঘুরতে যান না। অফিসের ব্যস্ততায় তিনি যেন বেশি জড়িয়ে পড়েছেন। ব্যস্ততার  মধ্যে কিছু দিন কাটাবার পর তার মনে হল, না, এবার একটু কোথাও ঘুরে আসতে পারলে মনটা যেন অনেকটা হালকা হবে। বর্তমানে তিনি ও তার স্ত্রী এই দুটি প্রাণী ঘরে থাকেন। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে আর মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা নিজেদের সংসার নিয়ে ভালোই আছে। 

ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব শুনে স্ত্রী নেচে উঠলেন, চলো চলো কতদিন ঘরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছি বল?

জীবন বাবু জানেন বেশি দূর যাওয়া যাবে না--যত কাছে স্পট হবে ততই মঙ্গল। এক তো নাকে-মুখে মাস্ক রাখতে হবে, প্রয়োজনে হ্যান্ড গ্লোব সঙ্গে থাকবে। তিনি বললেন, কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় বলো তো ? 

--তুমি যে জায়গা পছন্দ করবে সে জায়গাতেই যাব--স্ত্রী হাসিমুখে বললেন।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা যাক--জীবন বাবু এক জন লেখক। নামডাক তেমন না থাকলেও তিনি লেখেন এবং কিছু কিছু লেখা ছাপা হয়, আবার অনলাইনেও প্রকাশ পায়। কবিতা, গল্প তার লেখার বিষয়বস্তু--বিষয়বস্তুর মধ্যে একটু হেরফের আছে বটে। জীবন ভূতের গল্প লেখেন। কবিতা লেখার পাশে একেবারে অসামঞ্জস্য সাবজেক্ট বলা যায়, ভূতের গল্প! ভৌতিক গল্প তিনি নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। এই তো ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের  সম্পাদনায় অনলাইন পত্রিকা, গল্পগুচ্ছে তিনি ধারাবাহিক ভৌতিক গল্প দীর্ঘদিন ধরে লিখে চলেছেন। তাঁর ৫২ তম গল্পটা এই সবে মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। আগামী সংখ্যার লেখাটা তাঁর মনে কিছু দিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কি লেখা যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল, আচ্ছা যাওয়া যায় কি না এমন কোন জায়গায় যেখানকার পরিবেশটা থাকবে ভৌতিক, খানিকটা গা-ছমছম ভাব। অন্ধকার আর আধ-অন্ধকার নির্জনে বসে এসব ভৌতিক গল্প লিখতে ভালো লাগবে তাঁর। এমনিতেই সব গল্প তিনি সারাদিন পরে বিশ্রামের অবসরে রাত ১১ টার পরে লিখতে বসেন। জীবনের স্ত্রী অবশ্য ভীষণ ভীতু। জীবন বাবুকে তিনি খোটা দিতে ছাড়েন না, বলেন, আমি ভয় পাই তাই তুমি ওই সব ছাইপাঁশ বেশি করে লেখ তাই না ?

কি করবেন জীবন বাবু ? ভূতের গল্প লেখার নেশা তাঁর, বুজরুকি ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু সত্য ঘটনার মোকাবিলা তিনি করেছেন বৈকি আর এক মাত্র সেই কারণেই ভুত-প্রেত নিয়ে লেখায় তিনি বেশি ইন্টারেস্ট পান। 

জীবন মনে মনে ঠিক করেছেন, এবার অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ তিনি নেবেন। এক দিকে বর্ণ প্রাণী দর্শন যেমন হবে, তেমনি  অন্য দিকে ভৌতিক পরিবেশে বসে ভয় রোমাঞ্চকর আবহাওয়ায় থেকে তিনি আগামী ভৌতিক গল্পটা লিখে ফেলবেন। বর্ণাওয়াপাড়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এটি তিরিশ কিলোমিটারের মত একটি ছোট ব্যাসে ছড়িয়ে আছে।

কথা মত প্রোগ্রাম ঠিক হয়ে গেল। সঙ্গে ড্রাইভার নিয়ে নিজের কারে জীবন বাবু সস্ত্রীক বেরিয়ে পড়লেন সফরে। স্পটের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটারের মত। স্পট হল বর্ণওয়াপাড়া, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। জীবন বাবু জেনেছেন জায়গাটা মন্দ নয়--অনেকেই সপরিবারে এখানে ঘুরতে আসেন। এখানকার বিশেষত্ব হল ট্রি হাউস। গাছের ওপর তৈরি ঘর যেখানে দর্শনার্থীরা রোমাঞ্চকর পরিবেশে থাকতে পারেন। যে টা কিনা জীবন বাবুও চাইছিলেন। 

জীবন পরে স্ত্রীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নেবেন ঠিক করে নিয়ে অনলাইন বুক করে নিলেন একটা ট্রী হাউস, যার নাম কিনা, মাচান। তিনি ছবিতে দেখেছেন জঙ্গলের কিনারে গাছের উপর তৈরি বাঁশ ও কাঠের তৈরি ঘর। রাতে জ্বলবে টিম টিমে পাওয়ারের ছোট ছোট বাল্ব। এ মাচানের আশপাশে কিছুটা দূরে দূরে রয়েছে আরও কয়েকটা ট্রি হাউজ। রাতের পাহারার ব্যবস্থা আছে। জীবন এক দিকে নিশ্চিন্ত ছিলেন--ভয়ের কিছু থাকবে না--কত লোক সেখানে থাকছেন।  কেবল নিজের স্ত্রীর কথা ভেবে একটু অস্বস্তি অনুভব করছিলেন তিনি। স্ত্রী সারাক্ষণ ভয় পাবেন, হয়ত তিনি তাঁর পাশ ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। তা হোক, তেমনি পরিবেশ আধ অন্ধকার গা ছমছম ভয়ের পরিবেশিতই তো তিনি চাইছিলেন। ভাবতে গিয়েই তিনি রোমাঞ্চিত হচ্ছিলেন। বর্ণাওয়াপাড়া ছত্তিসগড় সরকারের সংরক্ষিত বন। এখানে আছে হরিণ, চিতল বাইসন, অনেক রকম পাখি, এ ছাড়া প্রায়ই দেখা যায় না, অথচ আছে, সেটা হল চিতাবাঘ। 

জীবন বাবুদের বর্ণাওয়াপাড়ার জঙ্গলে পৌঁছাতে বেলা ১২টা বেজে গেলো। তখন চারদিকে ঝলমলে রোদ, রিসোর্ট এরিয়াতে পৌঁছালেন ওঁরা। একটু এগিয়ে বেশ কিছু রিসোর্ট চোখে পড়লো। সামান্য দূরত্বে দেখা গেলো, বেশ কয়েকটি ট্রি হাউজ। বড় ঝাঁকরানো গাছের ডালপালা ছাঁটিয়ে গাছের প্রায় আট দশ ফুট উপরে তৈরি হয়েছে ট্রি হাউস। পাতলা হালকা লাকড়ি ও বাঁশ বেড়ায় তৈরি ঘর গুলি, অনেকটা গ্রামের কুড়ে ঘরের মত।  এ সব দৃশ্য দেখে জীবন আনন্দ পেলেন। তিনি বলে উঠলেন, আহা, কি সুন্দর ! পাখির বাসার মত মানুষের বাসা ! 

উচ্ছ্বসিত হলেন জীবন বাবুর স্ত্রী অলকা, চলো চলো, আমরা ওই বাসাতেই থাকি ! 

জীবন বাবু সুযোগ বুঝে তাৎক্ষণিক প্রস্তাব করে বসলেন, হ্যাঁ, জানি তোমার পছন্দ হবে, তাই আগেভাগে আমি বুক করে নিয়েছি।  

--বা বা, বলে উঠলেন অলকা, একটু থেমে তারপর বললেন কিন্তু রাতে এত নির্জনতায় থাকতে পারব তো ? এখনই কেমন খালি খালি গা ছমছম একটা ভাব লাগছে গো-- 

জীবন বাবু রসিক হয়ে উঠলেন, তোমার সঙ্গে আমি তো আছি ডার্লিং ! 

অলকা চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কারের দরজা খলা, তা ছাড়া ড্রাইভার ছাড়াও দু-চারজন লোক আশপাশেই দাঁড়িয়ে আছেন, বললেন, এই তুমি কি যে করো না, লোক জনের মধ্যেই তুমি যা তা কথা বল ! 

এক জন কেয়ার টেকার এসে সামনে দাঁড়ালো। জীবন তাঁকে  বললেন, মাচান, ট্রী হাউজ কি ধার হায় ? 

--ইয়ে, বিলকুল সামনে জী—আইয়ে ! কেয়ারটেকার বলল। 

কার সামনের ট্রি হাউসের কাছে আসতেই বোঝা গেলো এটাই মাচান ট্রি হাউজ। ট্রি হাউজে ওঠার মই লাগানো--মই হলেও শক্তপোক্ত লাকড়ির তৈরি। কেয়ারটেকারের সঙ্গে ধীরে ধীরে ওঁরা উঠে এলেন গাছের ওপরে, ট্রি-হাউজে। বাহ, বেশ সাজানো গোছানো ঘর, রাত্রিবাসের উপযুক্তই বটে। ঘরের মধ্যে সাজানো আছে চেয়ার টেবিল আলমারি। ঝাপড়িজানলায় পর্দা লাগানো। ঘরে লাইটগুলি কম পাওয়ারের--সেই গ্রাম-গাঁয়ের ঘরের মত। ল্যাম্প বাতির মত অনেকটা, যদিও এ সব বৈদ্যুতিক বাতি। ঘরের সেন্টার টেবিলের মাঝখানে রাখা একটা হ্যারিকেন জ্বলছে, যদিও সেটাও বৈদ্যুতিক কিন্তু আলোর ঝিলিক উজ্জ্বলতা তাতে নেই। অলকা আবার মুখ খুললেন, একি ! কোথায় এলাম গো আমারা ? এখনি কেমন ভয় ভয় করছে ! কেয়ারটেকার দরজা ভেজিয়ে চলে গেল। জীবন বাবু অলকার একটা হাত টেনে নিয়ে বলে উঠলেন, আমি আছি তো প্রিয়ে ! 

জীবন ঠিক করলেন, আজ নয়, আগামী কাল সকালে সাফারিতে বেরবেন। আজ রাতে ভৌতিক লেখাটা কমপ্লিট করবেন তিনি।

 

বিকেল থেকেই চারদিকে অন্ধকার নেমে এলো। ওঁরা দুপুরের খাওয়া দাওয়া ঘরে আনিয়ে নিয়েছিলেন। অলকা মাঝে মাঝে জালনা  দিয়ে বাইরে দেখছিলেন, ভয় পেয়ে বারবার বলছিলেন, আমার ভীষণ ভয় করছে গো ? 

রাত তখন নটা, নৈশ ভোজ কেয়ারটেকার রাত সাড়ে আটটায় নিয়ে এসেছিল। ডাল ভাত আর মাছের ঝোল, সব মিলিয়ে ভালো খেলেন তাঁরা। এখন চারদিকের আবহাওয়া বড় থমথমে--এ ভুবনে কোনও মনুষ্যজন আছে বলে মনে হচ্ছিল না!জালনার বাইরের দৃশ্য দেখছিলেন জীবন বাবু, সস্ত্রীক। মনে হয় কেউ যেন জেগে নেই, দূরে রেস্তোরাঁর আলো দেখা যাচ্ছে। জঙ্গলে জোনাকির ঝিকিমিকি দেখা যাচ্ছে, ঝিঁঝিঁরা বিলম্বিত লয়ে ডেকে ডেকে উঠছে। সন্ধ্যের সময় শিয়ালের দল সুর করে ডেকে উঠেছে। অলকার মনে হল কোন বিরান ভূমিতে ভুল করে ওঁরা এসে পড়েছেন। কিম্বা কোন অন্য গ্রহে তাঁরা নির্বাসিত হয়েছেন ! ভয়ে  অলকা জীবনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, আমার খুব ভয় করছে গো, অলকা বলেছিলেন। জীবন রসিক হয়ে বলে ওঠেন, কত দিন এমনি ভালোবাসার স্বাদ পায়নি গো ! 

জীবন বাবুর কথায় অলকা ইচ্ছে হলেও একটুও সরে দাঁড়াবার সাহস পেলেন না, তিনি বলে উঠলেন, রাখো তোমার রসিকতা, আমি বলে ভয়ে মরি !

জীবন অলকার কথায় ঘরের মাঝখানের টেবিলটা টেনে নিলেন, একেবারে খাটের সঙ্গে লাগিয়ে রাখলেন। তা না হলে যে অলকা ভয় পাবেন, একা খাটে শুয়ে থাকতে পারবেন না। 

অলকা শুয়ে পড়েছেন কিছু সময় আগে। মনে হচ্ছে তিনি ঘুমের কাছাকাছি আছেন। আর অপেক্ষা করা যায় না, নিজের ব্যাগ থেকে এবার জীবন বাবু টেনে বের করলেন খাতা ও কলম। লিখতে বসবেন তিনি। খাটের  ওপর স্ত্রীর পাশে বসে টেবিলে খাতা রেখে লিখতে শুরু করলেন তিনি। অন্য দিকে ভয় ও অবসাদে হবে অলকা ঘুমিয়ে পড়েছেন, ঘুমের মাঝে একবার জড়ানো গলায় বলে উঠলেন, এই আজকে যেন ভূতের গল্পটল্প লিখতে যেও না ! 

হু, ছোট্ট উত্তর দিয়েছিলেন জীবন, বোঝার উপায় ছিল না যে তিনি, হ্যাঁ কি না, বললেন। চুপচাপ লিখতে শুরু করলেন জীবন। সামনে টেবিলের ওপরে রাখা সাবেকি আকৃতির হ্যারিকেন, অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট আলো, চলবে, জীবন বাবু মনে মনে বলে উঠলেন, এমনি পরিবেশ উপযুক্ত হবে রাতের রোমান্স উপভোগ করার মতই পরিবেশ বটে ! জঙ্গলের জীবজন্তুর দেখার আনন্দ থেকে যেন এ ভৌতিক পরিবেশকে উপভোগ করার আনন্দ জীবনের কাছে অনেক বেশি। লিখতে লিখতে হঠাৎ জীবন বাবুর থেমে গেলেন, তিনি দেখলেন, তাঁর সামনে এক জায়গায় কয়েকটা মনুষ্য আকৃতির ছায়া জটলা করে বসে আছে। অন্তত চার পাঁচটা আবছা ছায়ামূর্তি যেন আসন করে বসে আছে  জীবনের ভেতরে একটা শিহরণ জেগে উঠলো, পরক্ষণেই দেখলেন কখন যেন ঘরের একটা জানালা তিনি খুলে দিয়েছেন!

কিছু সময় পরে তাঁর মনে হল, হতে পারে খোলা জালনা দিয়ে গাছের ছায়া এসে ওখানে পড়ছে। জীবন আবার লেখায় মন দিলেন। তিনি মনে মনে ভেবে নিলেন, না ওসব কিছু না, ছায়া, চাঁদের আবছা আলো গাছপালা ভেদ করে ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে হবে। পাশ ফিরে দেখলেন স্ত্রীর দিকে, মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছেন।

ট্রী হাউজের এক দিকে কতগুলি রিসোর্ট আর পাশাপাশি জঙ্গলের মধ্যে এই গাছ ঘরের টিমটিমে ডিম আলো জ্বলছে। জীবন বাবু লিখে যাচ্ছেন, তাঁর কেন যেন মনে হল, লেখা শেষ হলেই বুঝি তাঁকে সামনে বসে থাকা প্রেত ছায়াদের এই লেখা গল্প তাঁকে পড়ে শোনাতে হবে। খটখট শব্দ কানে এলো জীবন বাবুর,  তিনি তাকালেন জালনার দিকে, একি একি দেখছেন তিনি ! একটা ছায়া জালনা গলিয়ে ঘরে এসে ঢুকল, তারপর হাত বাড়িয়ে সে ছায়াটা অন্য একটা ছায়া শরীরকে ঘরে টেনে তুলল। চোর ডাকু নয় তো ? ভয়ে জীবন বাবুর অজান্তেই গলা চিরে ভয়ার্ত চাপা আওয়াজ বেরিয়ে এলো--কে ? কে তোমরা ?

কোন উত্তর নেই। মিনিট খানেক পরে খসখস শব্দ হল, কেউ যেন বলে মহি কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো, বাবু, লিখো, কাহানী লিখনা  পুরা করলো।  ফিসফিসানো শব্দ।

--কে কথা বলল ? ভয়ে উঠে দাঁড়ালেন জীবন। আবার শব্দে উঠে এলো, মিহি চিকন অথচ  গমগমে একটা আওয়াজ, হাম সব এহি রহেনেবালে। কথাগুলো মনে হচ্ছে দূর থেকে ভেসে আসছিল আর কাটা কাটা কাঁপাকাঁপা ছিল। এতটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তিনি কোন দিন পড়েননি--নিজেকে একটু সামলে নিলেন তিনি, মনে জোর নিয়ে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন, কে ? কে তোমরা ?? 

ঘরের বাইরে  জোরে হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। হাওয়ার শাঁ শাঁ শব্দের মাঝে কেউ যেন বলে উঠলো, ইস ঘর মে কিউ আয়া ? আবার চুপচাপ, কিছু সময় পর কেউ বলে উঠলো, ইয়ে হামারা ঘর হায়--আওয়াজগুলি কোন মাইকের আওয়াজের মত গমগমে অথচ খুব চাপা মনে হচ্ছিলো। অনেক দূর থেকে ভেসে আসার মত লাগছিল।

বেশ কিছু সময় ধরে ঘরের মধ্যে স্তব্ধতা বিরাজ করছে। জীবন বাবুর কলম থেমে গেছে, তিনি স্তব্ধ বসে আছেন--অনেকটা যেন স্ট্যাচুর মতই। হঠাৎ আবার একটা কণ্ঠ ভেসে এলো, হামারি কাহানী লিখ রাহে হো ? জলদী লিখো !  খানিক স্তব্ধতার পর জীবন ভেতর থেকে একটা তাগাদা অনুভব করছিলেন--কেউ যেন তাঁকে বলছে, তাড়াতাড়ি লেখ, না হলে-- 

ভয়ে ভয়ে জীবন কলম তুলে নিলেন কিন্তু তিনি কি লিখবেন ? তাঁর হাত যে কলম চালাতে পারছে না !

--হাহাহা হিহিহি, চারদিকে হাসির চাপা শব্দ যেন জীবনকে বিদ্রূপ করছে। হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন, দেখলেন,  হাতে ধরে রাখা কলম আপনি আপনি চলছে--কলম লিখে যাচ্ছে, তুমলোগ নে হামারে ঘর কব্জা কিয়া-- 

জীবন ভয়ে কলম ছেড়ে দিলেন, কি আশ্চর্য শুধু কলম কাগজের ওপর হিন্দি ভাষায় লিখে চলেছে--ইয়ে ঘর আভী ছোড় দাও-- সাবধান--আবার উৎকট হাসির  শব্দ। জীবনের কখনও মনে হতে লাগলো, এ গুলি হাসির শব্দ না, বাইরের বাতাসে ঝাপটানো গাছপালার আওয়াজ।  তাঁর মনে হল বাইরে ঝড় উঠেছে আর জালনা দিয়ে সে ঘূর্ণিঝড় ঘরের ভেতর ঢুকে গেছে। ঘরের ভেতর সে বাতাস ঘুরপাক খাচ্ছে। টা থেকেই একটা মিহি সুরের সৃষ্টি হয়েছে,  শাঁ শাঁ   শঁ শঁ এমনি হাজার রকমের শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে। জীবন বাবুর মনে হল তিনি ঘুমিয়ে আছেন, কোন স্বপ্ন দেখছেন না তো ? তাকালেন তিনি পাশে, না, ওই তো অলকা দিব্যি ঘুমাচ্ছে, জীবন বাবু এমন ঘটনা বাপের জন্মেও দেখেননি, বাপের জন্মে দেখা তো দূরের কথা কারো মুখেরও কোন দিন শোনেননি। তিনি স্তব্ধ হয়ে থাকলেন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকলেন। তারপর কি হল কে জানে ! জীবন দাঁড়িয়ে গেলেন, তাঁর মাথায় মধ্যে কেমন জিলিক দিয়ে যাচ্ছে। তাঁর শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। তার মধ্যে এখন যেন ভয় বলে কিছুই নেই। তিনি বলে উঠলেন, কে আমায় বিরক্ত করছিস ? আমি ভয় পাই না।

জীবনে এগিয়ে যাচ্ছেন অন্ধকারের দিকে, সামনের জালনা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরের এক কোনে এসে পড়েছে। তিনি হন হন করে এগিয়ে গেলেন জানালার কাছে। নির্ভয়ে উঁকি মারলেন বাইরের দিকে, তাঁর মনে হল কয়েকটা মনুষ্য আকৃতির কালো ছায়া আচমকা যেন অন্ধকার গাছের আড়ালে সরে গেল। জীবন গলা ছেড়ে বলে উঠলেন, আমরা এক রাত এখানে থাকবো। তোরা আমাদের বিরক্ত করতে আসবি না বলে দিচ্ছি। আবার চারদিকে স্তব্ধতা নেমে এলো। নির্জনতার মাঝে আবার ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা গেল, জোনাকিরা গাছপালার আড়ালে-আবডালে বারবার জ্বলে নিভে উঠতে লাগল। নির্ভয় জীবন বাবু এবার স্ত্রীর কাছে এসে বসলেন, কিছু সময় পর আবার তিনি স্বাভাবিক হলেন, দেখলেন কাগজের উপর কলমটা পড়ে আছে আর কাগজে বড় বড় করে লেখা, সরি, এক দিন কে লিয়ে রহে যাও !

একটা অনুভূতি হবে, জীবনের মনে হল, তাঁদের ট্রি হাউস যেন বাতাসে উড়ে যাচ্ছে--চারদিকে শাঁ শাঁ বাতাস বইছে। তার মাঝ দিয়ে তাঁদের গাছঘর উড়ে যাচ্ছে কোন অজানা ঠিকানায়। স্পষ্ট অনুভব করছেন জীবন, সামান্য হলেও ঘর দুলছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঝড়ের মাঝে মনে হচ্ছে জীবন যেন  কোন ফ্লাইটে বসে আছেন। গাছঘর আকাশ ধরে উড়ে যাচ্ছে--এমনি এক স্বপ্ন, নাটকের কথা ভাবতে ভাবতেই সব কিছু আগের মত হয়ে গেল। গাছঘর সস্থানে এসে স্থির হল। তখনও বাইরের বাতাসে গাছপালা ঝাপটানোর শব্দ আসছিল, বাতাসের শব্দে হাহা হিহি হাসির শব্দ সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছিল। 

                    সমাপ্ত