গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৯

নীহার চক্রবর্তী

অনন্তপুরের পথে


দরজা ভ্যাজানো ছিল ।
রক্তিমের আলতো ছোঁয়ায় খুলে গেলো । ঘরে না ঢুকতেই ও যারপরনাই বিস্মিত । ওর বিধবা মা আয়নার সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দুই স্তনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মুহুর্মুহু খিলখিল করে হাসছে । রক্তিম মার সাদা ধবধবে পিঠ কলস-আকারের নিতম্ব দেখে মনে-মনে খুব অস্থির হয়ে উঠলো ।
দ্রুত চলে যাচ্ছিলো ও দরজা থেকে ।
কিন্তু মুহূর্তে ওর মা সামনে মুখ করে সারা মুখে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে ওকে বলল,'লজ্জার কী আছে ? তুমি তো চিত্রকর । গ্রীসের কোন দেবীর আদলে আমাকে এঁকে ফেলো । যা করার এক্ষুনি কর । আমার আর তর সইছে না ।'
সাথে-সাথে রক্তিমের মধ্যে চিত্রকরের সত্তা জেগে উঠলো ।
একগাল হেসে মাকে বলল,'ওকে । জাস্ট ওয়েট ।'
বলেই ও পাশের ঘর থেকে ও একটা আর্ট-কাগজ,রঙ আর তুলি নিয়ে এলো ।
কাগজটা ঘরে ঢুকে দেয়ালে সেঁটে দিলো ও ।
মাকে তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,'আমিই জগতের বুঝি প্রথম চিত্রকর যে নগ্ন মাকে দেখে তার কল্পনার জাল ছড়াবে ।'
ওর মা টোল-পড়া-গালে হেসে বলল,'এ দুজনের সৌভাগ্য আর কি । আঁকো । চালচিত্রে আকাশী রঙ দিও কিন্তু ।'
তারপরেই রক্তিম আঁকতে শুরু করলো । গ্রীসের কোন দেবী ওর মাথায় নেই তখন । এঁকে চলল আনমনে মুখে মহাসাগরীয় হাসি নিয়ে । কোথাও কোন ভুল হল না ।
ছবি দেখে ওর মা আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলো । রক্তিমের সামনে তার দুই তরঙ্গের উচ্ছ্বাসের মতো তার সুডৌল স্তন দুটো নেচে উঠলো সেইসাথে । তাতে অবশ্য ওর ভ্রূক্ষেপ নেই ।
জিজ্ঞেস করলো,'কেমন হল ? বল কিছু ।'
'খুব সুন্দর । আজ নিজেকে অনন্যা মনে হচ্ছে আমার । এ ছবি আর কোথাও নেই । অজন্তা-ইলোরা বা খাজুরাহো খুঁজে দেখতে পারো । সেখানে পাবে না ।'
কিন্তু একথা বলার পরেই তার মুখ কেমন মেঘ-মেদুর হয়ে উঠলো । দেখে বিস্মিত রক্তিম ।
বলল,'কী হল তোমার ?'
তখন ওর মা প্রায় অস্ফুট-গলায় ওকে কান্না-ভেজা গলায় বলল,'চালচিত্রের রঙটা খুব বুকে লাগছে আমার । এ রঙ আর আমার জন্য নয় । মেঘের রঙে ভরে দাও । যে সে মেঘ নয় । কঠিন প্রস্তরের মতো ।'
কথা শেষ হওয়ামাত্র সে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ওর পাশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে । বুঝি দোতলার ঘরে গেলো সে ।
রক্তিম এক ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলো,এই হয় । এ অন্ধ সমাজের অন্ধ কানুন এমন মানুষের চোখের জল ঝরিয়েই যাবে । তবে কি শুকনোর দায় আমাকেই নিতে হবে ?
সত্বর রক্তিম দোতলার সিঁড়ি ধরল । কিন্তু ওপরে পা দিতেই ও দেখল ওর মা একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে সেই আগের মতো একা-একা খিলখিল করে হেসে যাচ্ছে ।
ছুটে গিয়ে নির্দ্বিধায় রক্তিম মাকে বুকে চেপে ধরে তার দু'গালে ঝড়ের বেগে চুম্বন-চিত্র আঁকতে থাকলো । মাও বেশ কবার চুম্বন দিলো ওর সদ্য দাড়ি কামানো পেলব গালে ।
কিছু দায় । কিছু দায় পূরণ করতে করতে একসময় রক্তিম মার সঙ্গে কেঁদে উঠলো ।
একইসাথে তখন বৃষ্টি আর কোকিলের কুহুতান শোনা যাচ্ছে । একবার কাছে আর একবার দূরে । আবার খুব কাছে । কি মধুর সুর সে । নেচে-নেচে আর ঘুরে-ঘুরে ।