জীবন
সারা দুপুর শাড়ীর গাঁটরি মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে
ক্লান্ত হয়ে পড়ল জীবন। আর পারছে না সে। সেই
কোন সকালে সাইকেল নিয়ে বেরোনো, তারপর সাইকেল
মহাজনের কাছে রেখে, মহাজনের কাজ থেকে
শাড়ির গাঁটরি নিয়ে মাথায় করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করা। এখন প্রায় বেলা
তিনটে। পেটে খিদে, কিন্তু পেটে পড়েনি
কিছুই। এর মধ্যে যে ক’টা বাড়ি ঘুরেছে, তার মধ্যে মাত্র একজন ছাড়া আর কেউ শাড়ি কেনেননি, তাও ধারে, মাসে মাসে টাকা শোধ দেন তিনি।
আজ টাকাও দিতে চাইছিলেন না, জোর করে কোনরকমে
একশ টাকা চেয়ে নিয়েছে জীবন। দু-একজন তো দেখেই হাত
নেড়ে না বলে দিয়েছেন। একজন উঁকি মেরে দেখে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কি সব মানুষ! বড়লোকেরাই যদি এমন করে,
তাহলে
আর......রাগে,
দুঃখে, খিদেতে মাথা ধরে গেছে জীবনের। শাড়ির পুরো টাকাটা পেলে
আজ মহাজনের কাছে কিছু চাইতে পারতো। একশ টাকা সারাদিনে মহাজনকে দিলে কোনমুখে সে
টাকা চাইবে? আর মহাজনই বা দিনের শেষে একশ টাকা ধরালে তাকে
রাখতে চাইবে কেন, শাড়ির গাঁটরি তাকে দেবে কেন? কিন্তু কি করে
বোঝাবে জীবন যে আজকাল আর এসব শাড়ি লোকে কিনতে চায় না,
কতরকম
বাহারি শাড়ি বেরিয়েছে, এসব ছেড়ে কেন মানুষ
কিনবে এই একঘেয়ে তাঁতের শাড়ি? সত্যি কথা বলতে কি, এই মাগ্যি-গন্ডার বাজারে লোকে
রোজ রোজ শাড়িই বা কিনবে কেন? সংসারে শাড়ি ছাড়া
আর কি কিছু কেনার নেই? হতাশ হয়ে একটা
বাড়ির বারান্দার সিঁড়িতে ছায়া দেখে বসে পড়ল জীবন।
বারান্দা গ্রীল দিয়ে ঘেরা, সিঁড়ির কাছে গ্রীলের গেট,
তাতে
তালা ঝোলানো। চারিদিক নিঃশব্দ। কেউ আছে কিনা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। বেশ বড় বাড়ি।
এদিকওদিক তাকিয়ে মনে হল, যদি এবাড়ির গিন্নি
দু-একখানা শাড়ি কেনেন, বড় উপকার হয় জীবনের। কিছু টাকা পেলে আজ মহাজনের কাছে
কিছু টাকা চাইত সে, তার খুব দরকার। ডেকে দেখবে নাকি একবার! পরক্ষণেই মনে হল,
দুপুরবেলা, ভাতঘুমের সময়...ডাকা কি এখন ঠিক
হবে? মেজাজ হারালে কেনা তো দুর অস্ত্, তখন এখানে বসে দু-দন্ড জিরোনও দায় হবে। কিন্তু জলতেষ্টা পেয়েছে
খুব, গলা একেবারে শুকিয়ে এসেছে, একটু জল না খেলেই নয়। রাস্তার কলে জল আসতে এখনও দেরী
আছে। জলের জন্য সাত-পাঁচ ভেবেও গ্রীলের
ওপরে কলিং বেলে হাত দিল জীবন।
(২)
সরমা ঠিক ঘুমোননি, খাটের উপরে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলেন।
হাতের খবর কাগজটা কখন পাশে রেখে দিয়েছেন নিজেই জানেন না। তবে কি ঘুম এসেছিল! খাওয়ার পর শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়া একটা অভ্যাসে
দাঁড়িয়ে গেছে। অনেকদিনের অভ্যাস। একা একা বাড়িতে করারই বা কি আছে? ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল,
তখন
তারা দুপুরে স্কুলে, কলেজে। বড় হয়ে
মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে চাকরি সূত্রে
বাইরে। স্বামীর চাকরি আর কয়েকমাস।
তাড়াতাড়ি এই ক’টা মাস কেটে গেলে একা থাকার দায়
থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন সরমা। আর ভাল লাগে না। কিন্তু এই ভরদুপুরে কে এলো, কেউ যেন কলিংবেল বাজাল মনে হল !
উঠে
পড়লেন সরমা। দোতলার ব্যলকনি থেকে নিচে উঁকি মেরে গ্রীলের গেটটা দেখা যায়। ওপর
থেকেই দেখলেন একটা লোক দাঁড়িয়ে, উস্কো-খুস্কো চেহারা। কে আবার এলো এখন--বিরক্ত হলেন সরমা।
ওপর থেকেই বললেন সরমা---কে, কি...চাই?
জীবন গলার আওয়াজ পেয়ে উপরে মুখ
তুলে তাকাল। অনুনয় করে বলল---একবার নিচে আসুন না
দিদি, দরকার আছে।‘
চট করে মেয়েদের ‘মা’ বলে না জীবন।
দেখেছে মেয়েরা তাতে খুশী হয় না, দিদি কিংবা বৌদি
বললে খুশী হয়, তাই সবাইকেই সে দিদি বলে কিংবা
বৌদি। সরমা আবার ওপর
থেকেই জিজ্ঞেস করলেন---কি দরকার?
এবার আরো করুণ স্বরে ডাকল জীবন---একবার আসুন দিদি, দয়া করে আসুন একবার...’
গলাটা কি চেনা মনে হল! না...ভুল শুনেছেন।
বিরক্ত হল সরমা। নিশ্চয়ই সেলস্ম্যান, সেন্ট-পাউডার বিক্রি করতে
এসেছে, নয়তো ধূপের প্যাকেট। না, দুপুরবেলায় একা বাড়িতে কাউকে ঘরের ভিতরে ঢুকতে দেবেন
না। কিন্তু এমনভাবে বলল লোকটি, সরমা নিচে যাবেন না
ভেবেও ওপর থেকে নিচে নেমে এসে ঘরের দরজা খুললেন। দেখলেন,
বারান্দায়
গ্রীলের বাইরে সিঁড়িতে বসে আছে
একটি লোক, উস্কো-খুস্কো চেহারা, রোদে পোড়া, মাঝবয়সী মনে হল।
পাশে রাখা আছে একটি কাপড়ের গাঁটরি। না, এখন দুপুরবেলা তিনি কাপড়ের মোট খুলে কাপড় দেখার মুডেও
নেই, কিনতেও চান না। মোটের উপর তিনি ঘরে ঢুকতে দেবেন
না। দিনকাল ভালো নয়, চেনাশোনা লোক নাহলে
কাউকে ঘরে ঢুকতে দেয় নাকি! আগে সুনীল বলে একটি
ছেলে ছিল, শাড়ি বেচতে আসত। সে অনেকবার
নানাসময়ে এসেছে, শাড়ি দিয়ে গেছে তাঁকে। অনেকসময়
এদিক দিয়ে গেলে নিজের কাজে কাপড়ের গাঁটরি সরমার কাছে দিয়ে গেছে, কাজ সেরে ফেরার পথে আবার নিয়ে গেছে। সুনীলের
সঙ্গে একটা আত্মীয়তার মতো হয়ে গিয়েছিল। তার ভদ্র ব্যবহার,
দিদি
বলে ডাক ভাল লাগত সরমার। কতদিন দুপুরে জল চাইলে সে মিষ্টিও দিয়েছে জলের
সঙ্গে। আহা, বেচারা...রোদে গরমে কত
ঘোরাঘুরি করতে হয়! অনেকদিন আর সুনীলকে দেখেনি সরমা, প্রায় দশ-বারো বছর হয়ে গেল।
সুনীল এখন কোথায়, কে জানে! কিন্তু তাই বলে একজন অচেনা কে তা সম্ভব নয়। লোকটির
দিকে জিজ্ঞাসুর দৃষ্টিতে চাইলেন সরমা।
(৩)
দরজাটা খুলবেন নাই ভেবেছিলেন
সরমা। তারপর কি যে হল---দরজা খুললেন, গেট খুললেন, জীবন বারান্দায় উঠল, জল খেল, মিষ্টি খেল...শাড়ি কেনা হল না বটে,
কিন্তু
জীবন কিছু টাকা পেল সরমার কাছ থেকে। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সরমা। মাত্র দশ-বার বছরে এত পরিবর্তন হয় একটা মানুষের চেহারায়! সুনীলের চেহারাটা এত পালটে গেল কি করে, কেমন ক্ষয়াটে,
বুড়ো-বুড়ো। সুনীল এখন জীবন হয়েছে। কিন্তু সুনীল তাঁকে চিনতে
পারল না, নাকি চিনতে চাইল না !
সরমা কি এরপরেও তার বারান্দার দরজা জীবনের জন্য খুলবেন
-- এটাই বুঝতে পারছিলেন না...।