গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

জয়িতা ভট্টাচার্য

ভার্চুয়াল 


আজ সকাল থেকেই গন্ডগোল ।দিম্মা বিছানা থেকে উঠ়ছেনা ।ঠায় শুয়ে আ়ছে ।সাদা ওয়াড় পাশবালিশের মতো ।না পাশবালিশটা সুন্দর ।
দিম্মার মুখটা তোবড়ানো,আঁকি বুকি কোঁচকানো চামড়া ।মা গজ গজ করছে ।মা স্কুল যেতে পারেনি ।
আমি যাব ।আমার বই গুছিয়ে দেবে মা ।খাইয়ে দেবে ।
মনে হয় নিয়ে ও যাবে ।
ভ্যান ভ্যান করে উড়ছে মাছিটা ।জল পড়ছে কলে ।
একটা কাক ডাকছে এক ঘেঁয়ে ।বাসনের শব্দ............
সব মিলিয়ে একটা কনসার্ট  মন দিয়ে ছন্দটা খুঁজছি ।
খুঁজতে খুঁজতে চলে যাচ্ছি দূর পাহাড়র নীচে জঙ্গলটাতে ।সেখানেও এমন সুর বাজছে ।
জঙ্গলের গল্পটা মা মাঝে মাঝেই বলে।
এখন আমি বড়ো হচ্ছি ।বুঝতে পারি অনেক কিছু ।
বাবা আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমার ভালো লাগেনা ।মদের গন্ধ মুখে ।সারাদিন মদ খায় বাবা ।কাজ করেনা ।
__"
কিরে অঙ্কগুলো দিলাম হাঁ করে বসে আছিস ,এখনো চারটে বাকী "
চমকে যাই __"স্কুল থেকে ফিরে করবো "জেদ করি আমিও ।
স্কুল যেতে ভালো লাগেনা ।মার কাছে পড়তে ভালো লাগে ।স্কুলে ওরা কেমন যেন ।আমার মতো সুর শুনতে পায়না ।স্বপ্ন দেখতে পায়না ।
___"
ওপরে এসো একবার "বাবা চেঁচাচ্ছে
____"
ছেলেকে খাওয়াবো সময় নেই " মা ভাত বাড়ছে ।
বাবা চেঁচাচ্ছে ।গালি দিচ্ছে ।আমিও বলি বন্ধুদের ।মনেমনে ।শিখে নিয়েছি ।

রোজদিন বাবা টাকা চায় মার কাছে ।মা কেন দেয়? বাবা তো মদ খাবে।তবু দেয়।
মা ভীতু ।আমি মার মতো হবোনা ।পছন্দ করিনা যা কিছু মা করে ।
মা ছাড়া আমার কেউ নেই ।আমি ত সবার মতো নয় কিন্তু মার সামনে তা বলিনা কখনও।
       স্কুল যাওয়াটা অভ্যেস হয়ে গেছে ।়বন্ধু নেই বেশি আমার ।এক ঘেঁয়ে নিম্নচাপের বৃষ্টির মতো পড়িয়ে যায় স্যর আর ম্যামরা ।কেউ হাসেনা ।
যেন সবাই সমস্যায় ।
আমি মনে মনে অনেক বেড়াতে যাই তখন ।এ়খন অঙ্ক ক্লাস চলছে ,দুপুর ঢুকছে ক্লাসময় ।
বোর্ডে ম্যাম লিখছেন ।আমি জানি কি লিখবেন এরপর ।
শাড়িটা মানায়নি ।কটকটে সবুজে বড়ো বড়ো লাল ফুল ।ছোট্ট করে কাটা চুল ।পা়ছাটা দুম্বো ।মার সামনে অবশ্য পাছা বলা নিষেধ ।বাবার নিষেধ নেই ।বড়োরা সব বলতে পারে ।
__"
সুকল্প ,জানলা দিয়ে কি দেখছো ।বোর্ড ওয়ার্ক দ্যাখো ,নেক্সট টাইম তোমার মা কে জানাতে বাধ্য হবো "
সামনেটা তত খারাপ নয় ।মুখটা সুন্দর ।রাগ রাগ ।বড়ো বুক
___"
সরি ম্যাম " আমার বেলা স্ট্যান্ড আপ নেই ।
কিন্তু আমি ওখানেই ফিরে যাই ।সারি সারি লাল পিঁপড়ে ।লাইন ভাঙ়ছেনা ।একটা মরা প্রজাপতি টেনে টেনে নিয়ে চলেছে ।
গাছটায় এখন পাতা নেই বেশি ।ঝরে গেছে ।মরা প্রজাপতিটা র শুকনো ডানাটায় এখনো রঙ ।হাওয়ায় কাঁপছে ।
আমার পা যেন ।
রোজ বিকেলে পার্কে যাই ।আজো ।ওরা খেলছে ।বড়ো বলটা কখনো গড়িয়ে আসছে আমার কাছে আমার খুব শট মারতে ইচ্ছে করে ।পারিনা ।আমি ক্রাচ নিয়ে হাঁটি বা হুইলচেয়ার অসহ্য রাগ হয় কান্না পায় ।কাঁদিনা ।মার সামনে কখনো নয় ।
__"
আইসক্রীম খাবি ?"
_"
হ্যঁ"  না ।
মা খুশী হবে ওটা খেলে ।মা কাঁদলে খুব বাজে লাগে দেখতে ।
বাবা র সঙ্গে মারপিট হলে মা কাঁদে ।তখন মার মুখ দেখিনা ।
দিম্মাকেও ভালো লাগেনা ।তথন আমি পালিয়ে যাই বাড়ি থেকে ।
সমুদ্রের ধার বরাবর ।অনেক দূর।অনেক দূর ।পেছনে ধাওয়া করে পুরোনো দেওয়াল ,মা,বাবা ,দিম্মা ,শিখা আন্টি ,শেখর কাকু......আমার  সঙ্গে কেউ পারেনা।
ভীড় ।মা ।আইসক্রীম ।আমি যেন আইসক্রীম জমাট ,ঠান্ডা ।
___"
খেয়ে নে ।বাড়ি গিয়ে আজ নিজে পড়া করবে ।দিম্মার শরীর খারাপ ।ডাক্তারের কাছে যেতে হবে "
সায় দিই ।একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি আইসক্রীমের দিকে ।
গলে গলে পরছে ।কাঠিটা বেরিয়ে পরছে ।
মা মোবাইলে কথা বলছে কার সঙ্গে ,হাসছে ,অনেক কথা ।মাকে সুন্দর দেখাচ্ছে ।বিকেলের নরম রোদ্দুর মা র মুখে আলো ।
বরফ গলে গলে পড়ছে ঘাসের বিছানায় ।
আমি ক্রাচ নিয়ে আরও একটু এগিয়ে যাই ।দূরে ।মার থেকে

          ট্রেনটা আজো মিস হলো ।ভীড় খুব ।আমি ক্যানিং নামবো তখন খালি হয়ে যাবে অনেকদিন পর শাড়ি পরেছি ।সেজেছি ।এমনিই ।গুনগুন করে গান গাইছি ।
__"
দিদি সরে যান ট্রেন ঢুকছে "
হুরমুর করে বসে পড়েছি ।ব্যস আধঘন্টা নিশ্চ্ন্ত ।আজ ঘুম আসছেনা ।
লেখা ভেসে উঠেছে " খেয়ে বেরিয়েছো? সাব়ধানে যেও"
__"
তুমি কোথায় ।ব্রেকফাস্ট করলে"
___"
হুম ।মিটিং এ ,পরে ফোন করছি "
__"
আচ্ছা "
লাভ ও চুম্বনের স্টিকার ভেসে ওঠে ।
এদিক থেকেও ।

রুমাল ,চাবির রিং ,টিপ আর ঝুটো গয়না ওলা ।
সবুজ মাঠ আর সর্পিল রাস্তা দৌড়চ্ছে সঙ্গে  নিয়ে যাবতীয় ধূলো ।

____"
তোমার ছেলে আছে তাকে নিয়ে সুখী হতে পারোনা?", মা বলেছিলো
বলতে পারিনি "না"
বলতে পারিনি এক নারী সে কি শুধুই মা !

বলতে পারিনি আমি মানুষ আমারো খিদে পায় ।
এক ব্যর্থ বিবাহে নির্যাতিত হয়ে দ্বিতীয়বার আবার এক অপদার্থ মদ্যপ কে বিয়ে। তবুও কি আশ মেটেনি?
মন মাটিতে খরা ।ফুটিফাটা সে ফাটলে বাস করে ইঁদুর ।লোভী সাপ।
নিরন্তর দায়বদ্ধতার মাঝেই এক ঝলক বৃষ্টির মতো ভার্চুয়াল প্রেম শীতলপাটি ।
হোক না নকল ।তবুও তো বলে __" তোমাকে ভালোবাসি "
হোক না মিথ্যে তবুও তো সারাদিন কিছু অর্থহীন কথা আলো জ্বালে ।
এখানে বাতাস স্তব্ধ কেউ তো ঝড় তোলে রাতে, কেউ তো __" কেমন আছে শরীর ,"
__"
সাবধানে যেও "এটুকুও বলে ।হোক সে মিথ্যা ।
সত্যের কারাগার থেকে মুক্ত করে আমার
নেটওয়ার্ক ।
ওরা স্বপ্নের মতো ।পরীদের মতো পরশ ছুঁয়ে যায়।
কর্কশ রোদ থেকে বাঁচি ওদের হাত ধরেই।
আপন মনে দেখি কত সু -প্রভাত আর দিনের শুভেচ্ছা ।
একা নয় আমি ছায়াদের মাঝে ।
__"
কিরে মুখ গোমরা কেন "
মধুমিতা ।আমার স্কুলেরই আরেক শিক্ষিকা ।শাঁখা পলা চওড়া সিঁদুর ।টিভি সিরিয়াল ,উল-কাঁটা।
সুখী গৃহস্থী ।
মানিয়ে চলার পোষা পাখি ।নিজেকে ভুলে খেলনাবাটির ভেতর ....মধুমিতা মৃত কবেই।
___"
কিছুনা রে এমনি " বাইরে সরে সরে যায় গাছ পালা কালো পুকুর ,কচুরি পানা ............
___"
  সত্যি তোর ভাগ্য খারাপ " বাংলার বধূ বলে ।"ছেলেটাও......তবে তোরও দোষ আছে ।বড্ড জেদ ।ছেলেরা তো অমনই "
____"
কেমন রে ?"
__"
কেমন আবার ।ওরা ওরকমই তবু কত্তা তো !"
"
বর যা বলছে মেনে চললেই পারিস ।পুরুষমানুষ তো ,একটু রাগী হয় নেশা করে ।ভুলিসনা তোর স্বামি ,তোর সিঁদুর ......."
মোবাইলটা ঘাঁটি ।মুখ লুকোই ভার্চুয়ালে
আমি পালাই দূরে অনেক দূরে দৌড়তে থাকি সমুদ্রের পার ধরে বাবানকে বলা গল্পের সেই জঙ্গল ......একটা শালগাছ অপেক্ষা করছে আমার জন্য ।