রহমতের বিয়ে
রহমত আলির একটাই নেশা,সেটা হল ঘন ঘন চা পান করা আর চেনা বা অচেনা যেই হোক সবার সাথে সেধে আলাপ জমানো । তার মা এখনও বেঁচে
আছেন ,তিনি বলেন এমন নেশা নাকি তার বাপেরও ছিল । তার আব্বার নাম ছিল আকবর আলি ,লোকে তার ওই বিশেষ গুনের জন্য আলাপ আলি বলে ডাকতেন ।তাতে
আব্বু রাগ করতেন না । উল্টে যারা তাকে আলাপ নামে ডাকতেন,তাদেরকে তিনি চা খাইয়ে বকশিস দিতেন ।এখনও এই গঞ্জের মুরুব্বি যারা ,তারা তাকে আলাপের বেটা
বলেই উল্লেখ করেন । রহমতও সে জন্য রাগরোশ করে না ।তার কাজ হল সকাল হলেই মোরের মাথায় এসে কাজলের চায়ের দোকানে বসা । এখন সকাল সাতটা । এর
মধ্যেই সে তিন কাপ চা হজম করে ফেলেছে । রহমত এখন খড় কেনাবেচার ব্যবসা করে । এবার তাকে কাজের জায়গায় যেতে হবে । এই এলাকায় যত গ্রাম আছে প্রায়
সব গ্রামের চাষিবাসি মানুষই তার পরিচিত । তার কথার দাম আছে । আব্বার কাছ থেকেই সে এই ব্যবসাটা শিখেছে । তিনি বলতেন , 'বেটা ব্যবসায় কথার দাম রাখাটাই
আসল কাজ । এই কাজটা ঠিকমত করতে পারলেই দেখবি তোর ব্যবসা তড়তড় করে এগিয়ে যাবে ।'
রহমত নিজের অভিঙ্গতায় দেখেছে আব্বার বলা উপদেশ কতটা সত্য । মনে মনে সে আব্বাকে সালাম জানায় । তার দোয়ায় সে আজ করে কম্মে খাচ্ছে । আকাশে আজ
ঘন মেঘের আনাগোনা । রহমত ভয় পায় । এখন যদি বৃষ্টি নামে তাহলে সর্ব্বনাশ । তার একদল লেবার গেছে নন্দপুরে খড় বাঁধতে । সেই খড় গাড়িতে লোড করার কথা ঠিক
দুপুর তিনটেয় । বৃষ্টি হলে প্রথমত লেবাররা কাজ করতে পারবে না ।দ্বিতীয়ত বোঝা বাঁধা খড়ের ওজন বেড়ে যাবে । গৃহস্থ ভুল বুঝবে । ভাববে রহমত বুঝি বেশি খড় নিয়ে
তাদের ঠকিয়েছে । তার যতটুকু নামডাক তার পিছনে সততার হাত আছে । যদি সেই সততা না থাকে তাহলে বিশ্বাসের ভিতটা নড়ে যাবে । রহমত তখন আর ব্যবসা করে
খেতে পারবে না । সেজন্য সে এসব বিষয়ে খুব সচেতন ।
তার জীবনের একটাই দুঃখ , বোনটি পোলিও রোগাক্রান্ত । ওর পা দুটো দিনদিন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে । অনেক চেষ্টা করেও রহমত রুকসানার পা দুটো ভালো
করতে পারে নি । এখনো সে চেষ্টার কসুর করে না । যে যা বলে রহমত তাই করে ।কেউ হয়তো বলল কোন একজন ম্নত্রপুত তেল বানিয়ে দেয় , যা মালিশ করলে পা সোজা হয়ে
যাবে । রহমত সেই তেল এনে দেয় , আম্মা সেই তেল নিয়মিত মালিশও করে দেয় । কিন্তু রুকসানার পা তাতেও দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে । কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না । বোনকে
সে একটা তিন চাকা হাতে চালানো ভ্যান কিনে দিয়েছে । ফলে ঘরে চুপচাপ বসে থাকা থেকে সে রেহাই পেয়েছে । এখন মাঝে মাঝে সে এদিক সেদিক যেতে পারে । মেয়েটার মনের
জোর আছে বটে । গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে পাশ করার পর আম্মা বলেছিল আর ওকে পড়াবার দরকার নেই । রুকসানা কারো কথা শোনে নি ।তিন কিমি দূরের হাই স্কুলে ভর্তি
হয়েছে সে । রহমত আপত্তি করে নি । তবে আম্মার কথার অবাধ্য হয়ে রুকসানা হাই মাদ্রাসায় না পড়ে সাধারণ হাই স্কুলে জেদ ধরে ভর্তি হওয়ায় সে একটু বিরক্ত যে হয় নি , তা
কিন্তু নয় । বোনের কথার যুক্তিতে সে হার মেনেছিল । রুকসানা বলেছিল , 'এখন পৃথিবীটা আর ছোট নয় ,মুসলিম জাহান নিয়ে দুনিয়া চলে না বড়ভাই । পড়তে হলে ভাল করে পড়াটাই
উচিত । ওখানে সুযোগ এবং প্রতিযোগিতা দুটোই পাওয়া যাবে '। তাই রহমত আর কিছু বলে নি । ছোট বোনটার জন্য করতে পারে না এমন কাজ এই জগতে নেই । রুকসানা তার সাধের
তিন চাকা গাড়িটাকে প্রচণ্ড যত্ন করে । নিয়ম করে ধুয়ে-মুছে সাফসুতরো করে সপ্তাহে এক দিন ।
এ বছর বড় পূজার আগেই ঈদ হয়ে গেছে । আর পূজার ঠিক পরেই কুরবানি ঈদ । রুকসানার মনে ভীষণ আনন্দ । ওর শরত কালটা খুব ভালো লাগে । বড় ভাই আর মা - এদের
দু'জনের উচ্চারণেই অনেক খামতি আছে । আসলে মুসলিম সমাজে বড় হওয়া মা কখনও বাড়ির বাইরে বের হয় নি । শুনে শুনে যা শিখেছে তাই বলে এসেছে । মা কে দোষ দিয়ে লাভ নেই ।
বড় ভাই রহমত বাইরে ঘোরে বটে কিন্তু সেও বেশি দূর শিক্ষার আলো গ্রহণ করতে পারে নি । ফলে নিজে যতটুকু শিখেছে সবটাই শুনে এবং দেখে । পড়াশুনা করলে ঘাটতি থাকত না । বাড়িতে
এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিন মা-মেয়ে নয়তো ভাইবোনে তর্কাতর্কি হয় । শেষমেশ মা বা বড়ভাই তার কাছে হেরে যায় । হারলেও তারা গর্বিত হয় । কারন রুকসানা যে এত কিছু জেনেছে তাতে তাদের
খুশি হওয়া ছাড়া উপায় কি !
রহমত পাশের গ্রামে এক চাকুরীজীবী যুবককে তার বোনের কথা বলেছে । যুবকটি কোলকাতায় বড় চাকরি করে । রুকসানার জীবন সংগ্রামের কথা শুনে সে তো অবাক। সে
বলেছে শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা আছে । রুকসানার জন্য সে চেষ্টা করবে । তবে সেটা এখনই নয় । নন্দপুরের পাঁজা ফ্যামিলির নাম সকলেই জানে । ওরা
খুব শিক্ষিত এবং পরোপকারি । মনে মনে সে তার প্রতিবন্ধী বোনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে । রুকসানা শারীরিক ভাবে অক্ষম তো কি হয়েছে ? সে শিক্ষায় , বিদ্যায় , ঞ্জানে , বুদ্ধিতে একদিন
সকলকে ছাপিয়ে যাবে ।
রহমত কিছুতেই চায় না এখন বিয়ে করতে । কিন্তু বাড়িতে তার মা আর বাচাল বোনটি উঠেপড়ে লেগেছে তার বিয়ে দেবার জন্য । আয়েসা বলে একটি মেয়ে ইদানিং খুব আসাযাওয়া
করছে তাদের বাড়ি । ওর আব্বা ইদ্রিশ চাচা । এই গ্রামেরই। তার আব্বার সাথে দহরম মহরম ছিল খুব । ছেলেবেলায় দুই বন্ধুতে নাকি বেয়াই পাতাবার কসম অবধি খেয়েছিল । কিন্তু সে সব
বহুদিন আগের ঘটনা । তার আব্বা আজ বেঁচে নেই । সুতরাং কসম বা ওয়াদা যাই হোক , সেটা পূরণ করার দায় বা দায়িত্ব কোনটাই রহমতের ওপর বর্তায় না ।
পোলিও একবার হয়ে গেলে সে রোগ নাকি সারে না । রুকসানা ওড়গ্রামে , গুশকরায় এমনকি বর্ধমান অবধি বহু ডাক্তারের সাথে আলোচনা করেছে । সকলেই বলেছে এ রোগ সারবার
নয় । তাই সে তার অক্ষমতাকে আর কোনভাবেই আড়াল করার চেষ্টা করে না । রুকসানা শুধু মন দিয়ে পড়াশুনা করে । ও বুঝে নিয়েছে শিক্ষাই তাকে দিতে পারে মুক্তি । আর সে চায় তার বড়ভাইটি
বিয়ে-থা করে সংসারী হোক । তার জন্য যেন পরিবারের কারোর কোন সমস্যা না হয় । আয়েসা তার সমবয়সী । একসময় সে স্কুলে যেত । এখন আর যায় না । ওর আব্বা বলে দিয়েছে ,'মেয়ে মানুষের
বেশি লেখাপড়া শেখার দরকার নেই ।' বেচারা আয়েসা ! বিয়ে করে সংসার আর ছেলেপুলে মানুষ করাই ওর ভবিতব্য । অবশ্য তার অবস্থাও আয়েসার মতোই হত , যদি সে আর পাঁচটা গড়পড়তা
মুসলিম মেয়েদের মতো স্বাভাবিক হত । রুকসানা মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবে । খুশিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ।
আয়েসা এখন যে কোন ছুতোয় ঘন ঘন তাদের বাড়ি আসে । রুকসানা ঘরে বসে একমনে পড়ছিল । সবে গৃহস্থের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে । রহমত দিবানিদ্রা দিচ্ছে । মা
এঁটো বাসন কোসন ধোয়ায় ব্যস্ত কলতলায় । ঠিক এসময়ে আয়েসা একবাটি কয়েত বেল বেশ জম্পেশ করে নুন , লঙ্কা ,তেল সহযোগে মেখে হাজির হয় রুকসানার ঘরে । ক'ত বেল খেতে রুকসানা
ভীষণ ভালোবাসে । হৈ হৈ করে ওঠে রুকসানা । বলে ,' তুমি আমার ভাবি হবার উপযুক্ত আয়েসা । আমি কি খেতে ভালোবাসি , কি পড়তে ভালোবাসি, কোন গান আমার পচ্ছন্দ - সব তুমি জান আর
খেয়াল রাখ । বড় ভাইকে বলে আমি আজই রাজি করাব ।'
আয়েসা লজ্জ্বায় রাঙ্গা হয়ে বলে ,' আহা , আমি যেন সেজন্য তোমার কাছে এসেছি ? মরণ আর কি ! '
'আচ্ছা বাবা আমার ঘাট হয়েছে । তবে তোমাকে ভাবি হিসাবে পেলে আমার যে কি উপকার হবে ,তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না । বলো না ,আমার বড়ভাইকে তোমার পচ্ছন্দ কি না ?'
রুকসানা জটিল বিষয়টাকে হাল্কা করে দেয় ।
আয়েসা আরও লজ্জ্বা পেয়ে বলে , ' জানি না যাও ! তুমি না ভীষণ বদ !'
রুকসানা সুযোগ পেয়ে আয়েসাকে জড়িয়ে ধরে ,তারপর চুমায় চুমায় ভরিয়ে দেয় । কাতুকুতু একদম সহ্য করতে পারে না আয়েসা । সে খিলখিল করে হেসে ওঠে । আম্মা এবং রহমত দু'জনেই
ওদের উপস্থিতি টের পায়। মায়ের পশ্রয় আছে । রহমতের কাঁচা ঘুম ভাঙ্গানোর মাশুল গুনতে হল আয়েসাকে । ' কি হচ্ছেটা কি ? নিজে তো লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছ কবে ? এখন আমার বোনের পড়াটা
নষ্ট করতে এসেছ ,না ?'
কয়েকটা মুহুর্ত কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে আয়েসা । তারপর ঝরঝর করে তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে । রুকসানা বিহ্বলতা কাটিয়ে কি করবে ভেবে পায় না ? মা হাতের কাজ
ফেলে দৌড়ে আসে , বলে , ' এ আবার কি কথার ছিরি ? মেয়েটাকে শুধু শুধু কাঁদিয়ে ছাড়লি তো ? ' মা, আয়েসার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলে , ' ওর কথা ধরিস নে মা ! আমার ছেলেটা ওরকমই।
কখন কাকে কোন কথাটা বলতে হয় ও জানেনা ।' তবুও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আয়েসা ।
রহমত আলির একটাই নেশা,সেটা হল ঘন ঘন চা পান করা আর চেনা বা অচেনা যেই হোক সবার সাথে সেধে আলাপ জমানো । তার মা এখনও বেঁচে
আছেন ,তিনি বলেন এমন নেশা নাকি তার বাপেরও ছিল । তার আব্বার নাম ছিল আকবর আলি ,লোকে তার ওই বিশেষ গুনের জন্য আলাপ আলি বলে ডাকতেন ।তাতে
আব্বু রাগ করতেন না । উল্টে যারা তাকে আলাপ নামে ডাকতেন,তাদেরকে তিনি চা খাইয়ে বকশিস দিতেন ।এখনও এই গঞ্জের মুরুব্বি যারা ,তারা তাকে আলাপের বেটা
বলেই উল্লেখ করেন । রহমতও সে জন্য রাগরোশ করে না ।তার কাজ হল সকাল হলেই মোরের মাথায় এসে কাজলের চায়ের দোকানে বসা । এখন সকাল সাতটা । এর
মধ্যেই সে তিন কাপ চা হজম করে ফেলেছে । রহমত এখন খড় কেনাবেচার ব্যবসা করে । এবার তাকে কাজের জায়গায় যেতে হবে । এই এলাকায় যত গ্রাম আছে প্রায়
সব গ্রামের চাষিবাসি মানুষই তার পরিচিত । তার কথার দাম আছে । আব্বার কাছ থেকেই সে এই ব্যবসাটা শিখেছে । তিনি বলতেন , 'বেটা ব্যবসায় কথার দাম রাখাটাই
আসল কাজ । এই কাজটা ঠিকমত করতে পারলেই দেখবি তোর ব্যবসা তড়তড় করে এগিয়ে যাবে ।'
রহমত নিজের অভিঙ্গতায় দেখেছে আব্বার বলা উপদেশ কতটা সত্য । মনে মনে সে আব্বাকে সালাম জানায় । তার দোয়ায় সে আজ করে কম্মে খাচ্ছে । আকাশে আজ
ঘন মেঘের আনাগোনা । রহমত ভয় পায় । এখন যদি বৃষ্টি নামে তাহলে সর্ব্বনাশ । তার একদল লেবার গেছে নন্দপুরে খড় বাঁধতে । সেই খড় গাড়িতে লোড করার কথা ঠিক
দুপুর তিনটেয় । বৃষ্টি হলে প্রথমত লেবাররা কাজ করতে পারবে না ।দ্বিতীয়ত বোঝা বাঁধা খড়ের ওজন বেড়ে যাবে । গৃহস্থ ভুল বুঝবে । ভাববে রহমত বুঝি বেশি খড় নিয়ে
তাদের ঠকিয়েছে । তার যতটুকু নামডাক তার পিছনে সততার হাত আছে । যদি সেই সততা না থাকে তাহলে বিশ্বাসের ভিতটা নড়ে যাবে । রহমত তখন আর ব্যবসা করে
খেতে পারবে না । সেজন্য সে এসব বিষয়ে খুব সচেতন ।
তার জীবনের একটাই দুঃখ , বোনটি পোলিও রোগাক্রান্ত । ওর পা দুটো দিনদিন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে । অনেক চেষ্টা করেও রহমত রুকসানার পা দুটো ভালো
করতে পারে নি । এখনো সে চেষ্টার কসুর করে না । যে যা বলে রহমত তাই করে ।কেউ হয়তো বলল কোন একজন ম্নত্রপুত তেল বানিয়ে দেয় , যা মালিশ করলে পা সোজা হয়ে
যাবে । রহমত সেই তেল এনে দেয় , আম্মা সেই তেল নিয়মিত মালিশও করে দেয় । কিন্তু রুকসানার পা তাতেও দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে । কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না । বোনকে
সে একটা তিন চাকা হাতে চালানো ভ্যান কিনে দিয়েছে । ফলে ঘরে চুপচাপ বসে থাকা থেকে সে রেহাই পেয়েছে । এখন মাঝে মাঝে সে এদিক সেদিক যেতে পারে । মেয়েটার মনের
জোর আছে বটে । গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে পাশ করার পর আম্মা বলেছিল আর ওকে পড়াবার দরকার নেই । রুকসানা কারো কথা শোনে নি ।তিন কিমি দূরের হাই স্কুলে ভর্তি
হয়েছে সে । রহমত আপত্তি করে নি । তবে আম্মার কথার অবাধ্য হয়ে রুকসানা হাই মাদ্রাসায় না পড়ে সাধারণ হাই স্কুলে জেদ ধরে ভর্তি হওয়ায় সে একটু বিরক্ত যে হয় নি , তা
কিন্তু নয় । বোনের কথার যুক্তিতে সে হার মেনেছিল । রুকসানা বলেছিল , 'এখন পৃথিবীটা আর ছোট নয় ,মুসলিম জাহান নিয়ে দুনিয়া চলে না বড়ভাই । পড়তে হলে ভাল করে পড়াটাই
উচিত । ওখানে সুযোগ এবং প্রতিযোগিতা দুটোই পাওয়া যাবে '। তাই রহমত আর কিছু বলে নি । ছোট বোনটার জন্য করতে পারে না এমন কাজ এই জগতে নেই । রুকসানা তার সাধের
তিন চাকা গাড়িটাকে প্রচণ্ড যত্ন করে । নিয়ম করে ধুয়ে-মুছে সাফসুতরো করে সপ্তাহে এক দিন ।
এ বছর বড় পূজার আগেই ঈদ হয়ে গেছে । আর পূজার ঠিক পরেই কুরবানি ঈদ । রুকসানার মনে ভীষণ আনন্দ । ওর শরত কালটা খুব ভালো লাগে । বড় ভাই আর মা - এদের
দু'জনের উচ্চারণেই অনেক খামতি আছে । আসলে মুসলিম সমাজে বড় হওয়া মা কখনও বাড়ির বাইরে বের হয় নি । শুনে শুনে যা শিখেছে তাই বলে এসেছে । মা কে দোষ দিয়ে লাভ নেই ।
বড় ভাই রহমত বাইরে ঘোরে বটে কিন্তু সেও বেশি দূর শিক্ষার আলো গ্রহণ করতে পারে নি । ফলে নিজে যতটুকু শিখেছে সবটাই শুনে এবং দেখে । পড়াশুনা করলে ঘাটতি থাকত না । বাড়িতে
এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিন মা-মেয়ে নয়তো ভাইবোনে তর্কাতর্কি হয় । শেষমেশ মা বা বড়ভাই তার কাছে হেরে যায় । হারলেও তারা গর্বিত হয় । কারন রুকসানা যে এত কিছু জেনেছে তাতে তাদের
খুশি হওয়া ছাড়া উপায় কি !
রহমত পাশের গ্রামে এক চাকুরীজীবী যুবককে তার বোনের কথা বলেছে । যুবকটি কোলকাতায় বড় চাকরি করে । রুকসানার জীবন সংগ্রামের কথা শুনে সে তো অবাক। সে
বলেছে শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা আছে । রুকসানার জন্য সে চেষ্টা করবে । তবে সেটা এখনই নয় । নন্দপুরের পাঁজা ফ্যামিলির নাম সকলেই জানে । ওরা
খুব শিক্ষিত এবং পরোপকারি । মনে মনে সে তার প্রতিবন্ধী বোনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে । রুকসানা শারীরিক ভাবে অক্ষম তো কি হয়েছে ? সে শিক্ষায় , বিদ্যায় , ঞ্জানে , বুদ্ধিতে একদিন
সকলকে ছাপিয়ে যাবে ।
রহমত কিছুতেই চায় না এখন বিয়ে করতে । কিন্তু বাড়িতে তার মা আর বাচাল বোনটি উঠেপড়ে লেগেছে তার বিয়ে দেবার জন্য । আয়েসা বলে একটি মেয়ে ইদানিং খুব আসাযাওয়া
করছে তাদের বাড়ি । ওর আব্বা ইদ্রিশ চাচা । এই গ্রামেরই। তার আব্বার সাথে দহরম মহরম ছিল খুব । ছেলেবেলায় দুই বন্ধুতে নাকি বেয়াই পাতাবার কসম অবধি খেয়েছিল । কিন্তু সে সব
বহুদিন আগের ঘটনা । তার আব্বা আজ বেঁচে নেই । সুতরাং কসম বা ওয়াদা যাই হোক , সেটা পূরণ করার দায় বা দায়িত্ব কোনটাই রহমতের ওপর বর্তায় না ।
পোলিও একবার হয়ে গেলে সে রোগ নাকি সারে না । রুকসানা ওড়গ্রামে , গুশকরায় এমনকি বর্ধমান অবধি বহু ডাক্তারের সাথে আলোচনা করেছে । সকলেই বলেছে এ রোগ সারবার
নয় । তাই সে তার অক্ষমতাকে আর কোনভাবেই আড়াল করার চেষ্টা করে না । রুকসানা শুধু মন দিয়ে পড়াশুনা করে । ও বুঝে নিয়েছে শিক্ষাই তাকে দিতে পারে মুক্তি । আর সে চায় তার বড়ভাইটি
বিয়ে-থা করে সংসারী হোক । তার জন্য যেন পরিবারের কারোর কোন সমস্যা না হয় । আয়েসা তার সমবয়সী । একসময় সে স্কুলে যেত । এখন আর যায় না । ওর আব্বা বলে দিয়েছে ,'মেয়ে মানুষের
বেশি লেখাপড়া শেখার দরকার নেই ।' বেচারা আয়েসা ! বিয়ে করে সংসার আর ছেলেপুলে মানুষ করাই ওর ভবিতব্য । অবশ্য তার অবস্থাও আয়েসার মতোই হত , যদি সে আর পাঁচটা গড়পড়তা
মুসলিম মেয়েদের মতো স্বাভাবিক হত । রুকসানা মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবে । খুশিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ।
আয়েসা এখন যে কোন ছুতোয় ঘন ঘন তাদের বাড়ি আসে । রুকসানা ঘরে বসে একমনে পড়ছিল । সবে গৃহস্থের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে । রহমত দিবানিদ্রা দিচ্ছে । মা
এঁটো বাসন কোসন ধোয়ায় ব্যস্ত কলতলায় । ঠিক এসময়ে আয়েসা একবাটি কয়েত বেল বেশ জম্পেশ করে নুন , লঙ্কা ,তেল সহযোগে মেখে হাজির হয় রুকসানার ঘরে । ক'ত বেল খেতে রুকসানা
ভীষণ ভালোবাসে । হৈ হৈ করে ওঠে রুকসানা । বলে ,' তুমি আমার ভাবি হবার উপযুক্ত আয়েসা । আমি কি খেতে ভালোবাসি , কি পড়তে ভালোবাসি, কোন গান আমার পচ্ছন্দ - সব তুমি জান আর
খেয়াল রাখ । বড় ভাইকে বলে আমি আজই রাজি করাব ।'
আয়েসা লজ্জ্বায় রাঙ্গা হয়ে বলে ,' আহা , আমি যেন সেজন্য তোমার কাছে এসেছি ? মরণ আর কি ! '
'আচ্ছা বাবা আমার ঘাট হয়েছে । তবে তোমাকে ভাবি হিসাবে পেলে আমার যে কি উপকার হবে ,তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না । বলো না ,আমার বড়ভাইকে তোমার পচ্ছন্দ কি না ?'
রুকসানা জটিল বিষয়টাকে হাল্কা করে দেয় ।
আয়েসা আরও লজ্জ্বা পেয়ে বলে , ' জানি না যাও ! তুমি না ভীষণ বদ !'
রুকসানা সুযোগ পেয়ে আয়েসাকে জড়িয়ে ধরে ,তারপর চুমায় চুমায় ভরিয়ে দেয় । কাতুকুতু একদম সহ্য করতে পারে না আয়েসা । সে খিলখিল করে হেসে ওঠে । আম্মা এবং রহমত দু'জনেই
ওদের উপস্থিতি টের পায়। মায়ের পশ্রয় আছে । রহমতের কাঁচা ঘুম ভাঙ্গানোর মাশুল গুনতে হল আয়েসাকে । ' কি হচ্ছেটা কি ? নিজে তো লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছ কবে ? এখন আমার বোনের পড়াটা
নষ্ট করতে এসেছ ,না ?'
কয়েকটা মুহুর্ত কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে আয়েসা । তারপর ঝরঝর করে তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে । রুকসানা বিহ্বলতা কাটিয়ে কি করবে ভেবে পায় না ? মা হাতের কাজ
ফেলে দৌড়ে আসে , বলে , ' এ আবার কি কথার ছিরি ? মেয়েটাকে শুধু শুধু কাঁদিয়ে ছাড়লি তো ? ' মা, আয়েসার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলে , ' ওর কথা ধরিস নে মা ! আমার ছেলেটা ওরকমই।
কখন কাকে কোন কথাটা বলতে হয় ও জানেনা ।' তবুও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আয়েসা ।