মহাপ্রস্থান
[পূর্ব প্রকাশিত
অংশের পর]
মাত্রই সাতটি গল্প আর একটি একটু দীর্ঘ
উপন্যাস। মাসখানেকের মধ্যে পড়ে শেষ করল হিমেশ। এবং কয়েকদিন অভিভূত হয়ে কাটাল।
তারপর সে সংকল্প করল,এই অসাধারণ লেখাগুলি দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। ততদিনে সে যে
উদ্দেশ্য নিয়ে আর্য বসুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল সেটা ভুলে গেছে। তাঁর দুর্বলতা
খঁজতে এসেছিল। পেলও খুঁজে,কিন্তু তাঁর দুর্বলতা কখন যে হিমেশের নিজেরই দুর্বলতা
হয়ে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি সে। এখন সে পাগলের মত একটা উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে কীভাবে সে
আর্য বসুর লেখাগুলি ছড়িয়ে দিতে পারে দেশেবিদেশে।
রবিবার না
হলেও একটা ছুটিরই দিন ছিল সেটা। সকালেই হাজির হয়েছিল হিমেশ আর্য বসুর বাড়িতে।
আজকাল আর অদ্রির আড়াল নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর্য বসু ছুটির দিনে তার জন্যে
সাগ্রহে অপেক্ষা করেন। চা খেতে খেতে হিমেশ বলল, -- কাকু, অনেক ভেবে দেখলুম আপনার
উপন্যাসটি জীবনের মহাকাব্য আর গল্প সাতটি যেন সেই মহাকাব্যের ভেতরে ঢোকার দরজা।
মহাভারত ছাড়া এর তুলনীয় কিছু আমি বিশ্বসাহিত্যে দেখতে পাচ্ছি না।,মহাভারতের
বাহুল্য আর অতিকথন বাদ দিয়ে এ এক আধুনিক মহাকাব্য। কুরুক্ষেত্রের চৌদ্দ দিনের
যুদ্ধ যেন আপনার উপন্যাসে চৌদ্দটি মানুষের সম্পরকের টানাপোড়েন,স্নায়ুর যুদ্ধ।
পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থান যেন আপনার নায়কের একই জীবনে জন্মান্তর যাত্রা।
আর্য বসু কোন মন্তব্য করলেন না। মৃদু
হাসলেন শুধু। হিমেশ বলল, -- আর কিছু লিখবেন না কাকু? আর্য বসু বললেন, -- না। লেখার
প্রয়োজন আর তাগিদ দুটোই ফুরিয়েছে। এখন মিলন-আকাঙ্খায় অধীর হয়ে আছি। তুমি আমার
উপন্যাস পড়েছ। তার তাৎপর্য বুঝেছ। সুতরাং তোমাকে আশা করি সেটা ব্যাখ্যা করে বলতে
হবে না।
হিমেশ বুঝল। নিজের ভেতরে সেই বোধ এখন
পর্যন্ত না জাগলেও আর্য বসুর জীবনতত্ত্ব বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার। কথাপ্রসঙ্গে
একদিন তিনি ব্যাখ্যাও করেছিলেন সেই তত্ত্ব। বলেছিলেন, -- মিলন-আকাঙ্খাই জীবনের
চালিকা-শক্তি। তিনি যখন এক থেকে বহু হলেন এবং বিচিত্রভাবে নিজেকে দিগ্বিদিকে
ছড়িয়ে দিলেন তখন তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সেই বহুধাসত্ত্বা হৃদয়ে বিরহবেদনা নিয়ে
একে অপরের প্রতি মিলন-আকাঙ্খায় তৈরি করবে প্রাণময় বিশ্ব। উপনিষদ যেমন এই কথা
বলেছে, ডারউইনের বিবর্তনবাদও তেমনি প্রকারান্তরে এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছে। আবার
দেখ, দেশবিদেশের সমস্ত অমর কাব্যের বিষয়ই হল বিরহমিলন। আমাদের বৈষ্ণব পদাবলী তো এর
চূড়ান্ত উদাহরণ। শ্রীকৃষ্ণ সেই চৈতন্যময় সত্ত্বার প্রতীক মাত্র,যার বিরহবেদনা ও
মিলনানন্দে শ্রীরাধা বিভোর। আবার তাঁর সাথে মিলবেন বলেই শ্রীগৌরাঙ্গ আকুল হয়ে
সারাজীবন বিশ্বমানবকে প্রেমের মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে নীলাচলে বিলীন হলেন। সেই অর্থে
বিশ্বের তাবৎ প্রেমিক-প্রেমিকাই সেই চরম অদ্বৈতের দ্বৈত রূপ।
আর্য বসু যে মিলন-আকাঙ্খার কথা
বলছেন,সেটা সহজ কথায় মৃত্যু-আকাঙ্খা। তুলনীয়, রবীন্দ্রনাথের “ মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান “। আর্য বসুর মতে প্রতিটি জীব মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই চৈতন্যময়
সত্ত্বার সাথে মিলিত হয় । হিমেশ বলল, -- কিন্তু কাকু,আপনার লেখা
কেমন করে পৌঁছাবে পাঠকদের কাছে? আর্য বসু বললেন, -- ‘কেন,এই তো সেদিন বললি, ‘ঋদ্ধি’ তে ছাপবি’।
তাঁর হঠাৎ এই অন্তরঙ্গ সম্বোধনে মনটা
ভাল-লাগায় ভরে গেল হিমেশের। সে বলল, -- ক’টা লোক পড়বে ‘ঋদ্ধি’? তাছাড়া, উপন্যাসটির কী হবে? ভালো
প্রকাশক না পেলে পাঠকের কাছে পৌঁছানো মুশকিল। আর অনামী লেখকের উপন্যাস কোন ভালো
প্রকাশক ছাপবে না। আর্য বসু বললেন, -- একটা কাজ করতে পারিস। ‘ঋদ্ধি’ তে একটা গল্প প্রকাশ করে তার আলোচনা
যদি বাতায়ন-এ ভালো করে করিস তাহলে পাঠকের আগ্রহ জন্মাতে পারে। তোদের কাগজের
প্রচারসংখ্যা তো ভালোই।
‘ধুস্,ওতে লাভ হবে না। সংবাদপত্রের পাঠকদের এক শতাংশও
সাহিত্য-আলোচনা পড়ে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া সপ্তাহে একদিন তো মাত্র দু-পৃষ্ঠার একটা
সাহিত্যপত্র থাকে। সেখানেও সাহিত্য আলোচনার জন্যে বরাদ্দ অতি সামান্য’।
এইসব বলতে বলতেই হিমেশের মাথায়
বিদ্যুচ্চমকের মত একটা মতলব খেলে গেল। কেন যে এটা এতদিন তার মাথায় আসেনি সেটা
ভেবেই সে অবাক হচ্ছিল। সে তো এই মতলবেই এসেছিল আর্য বসুর কাছে। আর ঘটনাচক্রে সে
এখন তাঁর লেখা ছাপাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে;অথচ,যে চাঞ্চল্যকর সংবাদ তুলবে বলে
এসেছিল সেটার কথা বেমালুম ভুলেই বসে আছে! সটান সোফা থেকে উঠে এসে আর্য বসুর পায়ের
কাছে উবু হয়ে বসে তাঁর হাঁটুর উপর নিজের দু’হাত রাখল।
আর্য বসু বললেন, -- ‘হল কী তোর? ওঠ,উঠে
ভালো করে বোস;বিছানার উপরেই বোস না হয়’। হিমেশ বলল, -- ‘কাকু আমি আমার বাবাকে
হারিয়েছি। বাবা আমার কাছে কী ছিল,আপনাকে বলেছি। আজ আপনাকে পেয়ে আমি বাবাকে হারানোর
দুঃখও ভুলে গেছি। এখন যে প্রস্তাবটা আপনার কাছে রাখছি সেটা ফেরাবেন না। আমি খবরের
কাগজের লোক – আজ আর প্রকাশ করতে লজ্জা নেই প্রথম যখন
আপনার কাছে আসি,একটা বিশেষ মতলব নিয়েই আসি। আসলে অদ্রি নয়, অদ্রির এক সহকর্মী গৌরব
আমার বন্ধু। আপনি যে বিশেষ ক্ষমতাটি অর্জন করেছেন সেটা সে একদিন প্রকাশ করে ফেলে
গৌরবের কাছে। গৌরব তা বিশ্বাস করে এবং সেটা একটা চাঞ্চল্যকর খবর হতে পারে ভেবে
আমাকে জানায়। আমি তাই অদ্রির সাথে আলাপ করে তার বন্ধু সেজে আপনার সঙ্গে দেখা করি।
অদ্রি অবশ্য আমার মতলবটা জানত না। এখনও জানে না। গৌরব যে গোপন কথাটা আমার কাছে
ফাঁস করে দিয়েছে সেটাই তো সে জানে না! আপনার লেখার সাথে পরিচিত হওয়ার উদ্দেশ্যেই
আমার এখানে আসা বলে সে জানে। কিন্তু
বিশ্বাস করুন...’
তাকে থামিয়ে দিলেন আর্য বসু, বললেন, -- ‘আজ
অদ্রির জানাটাই সত্য হয়ে উঠেছে – এটাই তো বলতে চাস,তাই না? শোন
হিমেশ,প্রথম দিন থেকেই তোর আগমনের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল; কারণ,অদ্রি যখন
জেনেছে সেটা কারুর না কারুর কাছে প্রকাশ না করে সে থাকতে পারবে না এটা আমি জানতাম।
তবু যে তোকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছি তার কারণ তোর কথাবার্তায় আমি নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম যে
তোর সাহিত্যের উপর পড়াশুনা এবং সাহিত্যবোধ – দুটোই আছে। আর তুই যতই কেননা কাগজআলা
হোস,আমার অনুমতি ছাড়া এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা নিয়ে খবর করতে যাবি না। সুতরাং
জবাবদিহির দরকার নেই,অন্য কিছু বলার থাকলে বল’।
হিমেশ
বলল, -- বিশুদ্ধ লেখক ছাড়াও অন্যান্য লোকের লেখাও কখনো কখনো বেস্ট-সেলার হয়। কখন
বলুন তো?
আর্য বসু বললেন, -- প্রচারে হয়। তাছাড়া, অন্য ক্ষেত্রের
নামজাদা লোক – যেমন ধর, রাজনীতিক, ফিল্ম-স্টার,খেলোয়াড় – যাদের নিয়ে জনমানসে কৌতূহল – তাঁরা তেমন লেখা লিখলে বহু মানুষ তা পড়তে আগ্রহী হয়। নিঃশ্বাস
বন্ধ করে হিমেশ বলল, -- কাকু আপনি ভাবুন। আপনি যদি সর্বসমক্ষে একবার ওই ক্ষমতা
প্রদর্শন করেন,আপন রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবেন।
গম্ভীর হয়ে গেলেন আর্য বসু। হিমেশ বলল,
-- তখন আপনার রচনাবলি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আপনার রচনায় আনন্দের যে ফল্গুধারা
তার স্বাদ পাবে পাঠক। নইলে তাদের যেমন বঞ্চিত করা হবে, তেমনি আপনি নিজেও স্রষ্টা
হিসেবে সার্থকতার স্বাদ পাবেন না। তবে একটা আশঙ্কা থাকছে। আপনি একবার সেভাবে
আত্মপ্রকাশ করার পর সবাই মিলে আপনার জীবন বিড়ম্বিত করে তুলবে।
কোন
উত্তর দিলেন না আর্য বসু। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হিমেশ বলল, -- কাকু,ব্যাপারটা
সম্ভব কী করে হল বলবেন একটু। তাছাড়া,এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটাই বা কী?
আর্য
বসু বললেন, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি জানি না।; খানিকটা আন্দাজ করতে পারি মাত্র।
হিমেশ বলল, -- আপনি কোন সাধু-সন্ন্যাসী মানুষ নন কাকু। আপনার
বাড়িতে যেমন আমি উপনিষদ,ভগবদগীতা দেখছি;তেমনি নেচার, সায়েন্স-এর মতো গবেষণাধর্মী
বিজ্ঞানপত্রিকাও দেখছি। কাজেই আপনি ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না – এটা আমি বিশ্বাস করছি না।
আর্য বসু বললেন, -- ব্যাপারটা আমি একটা একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনা
হিসেবে নিয়েছি। এটা প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার নেই। আমার বিশ্বাস,তাঁরই
ইচ্ছায় এটা ঘটেছে। এমনটি ঘটানোর জন্য আমাকেই তিনি কেন বেছে নিলেন তা আমার জানা
নেই। বেশ কিছুদিন যাবত অফিস থেকে ফিরে ধ্যানে বসার চেষ্টা করছিলাম। সেটা আহামরি
কিছু নয়। প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিরা করতেন,এখনও কিছু কিছু সাধু-সন্ন্যাসী হয়ত করেন।
গৃহী মানুষেরাও নির্বিকল্প শান্তি বা মনের জোর বাড়ানোর জন্যে করেন। মস্তিষ্ককে
চিন্তাশূন্য করে মনকে শরীরের এক বিশেষ বিন্দুতে স্থির রাখা। প্রথম প্রথম সকলেরই
অসুবিধে হয়; লেগে থাকলে অনেকেই কম-বেশি সফল হন। প্রথম দিকে তিন-চার ঘন্টা বসতাম।
মাস ছয়েক কেটে যাওয়ার পর দেখি ধ্যান থেকে উঠতে উঠতে ভোর হয়ে যাচ্ছে,কিচ্ছুটি টের
পাচ্ছি না। আমার মানসিক শান্তি ও স্থৈর্য – দুটোই বাড়তে লাগল। অদ্রিকে নিয়ে আগে
একটু চিন্তা হত – লঘু চিত্তের ছেলে, মা-ও তাড়াতাড়ি চলে
গেল। তার বিয়ের ব্যাপারেও ভাবনা-চিন্তা আসছিল মনে। কিন্তু এই সময় থেকে অদ্রির
ভাবনাটাও মন থেকে বেরিয়ে গেল। এমনই একদিন ধ্যানের মধ্যে মনে হল শরীরে যেন তরঙ্গ
বইছে। আর তার অভিঘাতে সারা শরীরে কিছু প্রতিক্রিয়া হচ্ছে টের পেলাম। মেঝেতে আসন
পেতে বসি। সামনে ড্রেসিং টেবিলের আয়না। বেশ কিছুক্ষণ সেই অনুভুতিতে মগ্ন থাকার পর
চোখ খুলতে আবছা আলোয় দেখি সামনের আয়নায় কার যেন ছায়া পড়েছে। ধ্যান তো ভেঙ্গেই
গিয়েছিল। এবার উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার কাছে এলাম। উজ্জ্বল আলো জ্বাললাম। তারপরেই হতবাক
হয়ে গেলাম। এ তো দেখি আমিই! তবে বর্তমানের নয়,আজ থেকে চল্লিশ আগে যখন কলেজের ছাত্র
ছিলাম সেই আমি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আয়নার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কুড়ি বছরের
ছেলেটি হয়ে! বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরল। মনে হল, আবার ধ্যানে বসতে হবে; নইলে
কুড়ি বছরের ছেলেটি হয়ে যাবতীয় অনর্থের মূল হয়ে কতদিন কাটাতে হবে তিনিই জানেন! তখন
দুটো বাজে। ধ্যানে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল শরীরে তরঙ্গের অভিঘাত। একসময়
তা বন্ধ হল,কিন্তু আমার চোখ খুলতে সাহস হল না। ধ্যানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
আবার শুরু হল তরঙ্গের মৃদু দোলা। যখন বন্ধ হল তখন চোখ খুললাম। স্বস্তির সঙ্গে
দেখলাম যে আপন চেহারায় ফিরে এসেছি। ঘড়ি দেখলাম –
ছটা বাজে। অর্থাৎ,চার ঘন্টায় আমার শরীর চল্লিশ বছর অতিক্রম করেছে। পরের কয়েকদিন
একই জিনিষ লক্ষ্য করলাম। ধ্যানের গভীরে ঢুকে পড়ার পরেই অজানা তরঙ্গের অভিঘাতে আমি
পিছনে ফিরছি। ফিরতে ফিরতে যেন দুটো স্টেশন পার হচ্ছি। একটাতে চল্লিশে এসে
কিছুক্ষণের বিরতি,তরঙ্গের অভিঘাত বন্ধ। তখন চোখ খুলতে পারছি। তক্ষুনি ধ্যানে না
বসলে সেখানেই থেমে থাকছে শরীরের পরিবর্তন। আবার ধ্যানে বসলে কুড়ি বছরে পৌঁছে
অভিঘাত থামছে। সেখান থেকে একই প্রক্রিয়ায় আবার শরীর ফিরে আসছে কুড়ি থেকে চল্লিশ
হয়ে ষাটে। কিন্তু এই যে বর্তমান থেকে অতীতে যাত্রা,আবার অতীত থেকে বর্তমানে – তা একইভাবে আমার ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে ঘটছে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করার
কোন ক্ষমতা আমার থাকছে না।
আর্য বসু এবার একটু থামলেন, তারপর
বললেন, -- আমি নিজের মত করে একটা ব্যাখ্যা ভেবেছি, সেটা ঠিক কিনা আমি জানি না।
হিমেশ মনে মনে ছটফট করছিল। তার পরিকল্পনা সফল করতে হলে যেমন হোক একটা ব্যাখ্যা
দরকার। সে বলল, -- বলুন কাকু। আর্য বসু বললেন, -- বিশ্বের তাবৎ পদার্থকণার একটি
জুড়ি আছে। তাকে বলা হয় অ্যান্টি-পার্টিক্ল। এই তত্ত্বের জনক পদার্থবিজ্ঞানী মরিস
ডিরাক। পরবর্তীকালে সত্যসত্যই পরীক্ষাগারে সন্ধান মিলল এই দোসর কণার। কিন্তু
পরীক্ষাগার ছাড়া এই কণার খোঁজ মেলেনি এই মহাবিশ্বের কোথাও। এমনটি হওয়ার কথা নয়।
ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সময় পার্টিক্ল এবং অ্যান্টি-পার্টিক্ল সমপরিমানে সৃষ্টি
হয়েছিল। সেগুলো তাহলে গেল কোথায়? বিজ্ঞানীদের কাছে এটা একটা রহস্য। এই রহস্যে আলো
ফেলতে পারে নিউট্রিনো কণা। ইতালির এক পদার্থবিজ্ঞানী এত্তরো মায়োরানা এই কণার আচরণ
নিয়ে এক চিত্তাকর্ষক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এই বিজ্ঞানীটি মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে
রহস্যময়ভাবে অদৃশ্য হয়ে যান। তারপর তাঁর আর কোন খবর পাওয়া যায়নি; তাঁর দেহেরও কোন
সন্ধান মেলেনি। ইদানীং তাঁর সেই তত্ত্ব নিয়ে খুব হইচই হচ্ছে, সারা পৃথিবী জুড়ে তার
উপর গবেষণা চলছে। অ্যান্টি-পার্টিক্লের সাধারণ ধর্ম হল এরা পার্টিক্লের বিপরীত
তড়িৎবিশিষ্ট। ফলে পরস্পরের আকর্ষণে এই কণাগুলির গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত থাকে।
মায়োরানার তত্ত্ব বলল, নিউট্রিনো কণা নিস্তড়িৎ হওয়ায় তার এবং তার দোসর কণার মধ্যে
কোন ফারাকই নেই। ফলে তারা বাধাবদ্ধহীন ভাবে একই সঙ্গে বর্তমান থেকে অতীত এবং
ভবিষ্যৎ দুদিকেই ছুটছে। প্রতি সেকেন্ডে কুড়ি হাজার কোটি নিউট্রিনো কণা স্রোতের মত
মানুষের শরীর ভেদ করে চলে যাচ্ছে। শুধু মানুষের শরীর কেন, একইভাবে পৃথিবী ভেদ করে
মহাবিশ্বের দিগ্বিদিকে এদের ছড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু ধ্যানে থাকাকালীন এই
নিউট্রিনো কণাগুলিই কোন রহস্যময় কারণে আমার শরীরে আটকা পড়ে এই পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।
সম্ভবত, ধ্যানের সময় আমার শারীরবৃত্তে এমন কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া হচ্ছে যা
নিউট্রিনো কণাগুলির বেরিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। ধ্যান ভেঙে গেলে এই
বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কণাগুলিও শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিবর্তন স্তব্ধ
হয়ে যাচ্ছে। আবার ধ্যান শুরু করলে তারা শরীরে আটকে গিয়ে তরুণকে বৃদ্ধ করছে, বৃদ্ধকে
তরুণ।
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য ]
ইন্দ্রাণী সরকার
পিকুরা গরমের ছুটিতে ঠিক করল এবার পুরীতে বেড়াতে যাবে | পিকু সবে মাত্র এগারোতে পা দিয়েছে | পিকুর দিদি রুমি ওর থেকে সাত বছরের বড়, সবে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল | পিকুর বাবা হলেন একজন মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ার | বাড়ি যাদবপুরে | মা হলেন এক আদর্শ গৃহবধূ এবং তিনি ছোটদের সপ্তাহে একদিন করে গানের ক্লাস নেন | ওরা সবাই পুরী একসপ্রেসের ফার্স্টক্লাস কামরায় চড়ে বসল | পাশের বাড়ির কাকাবাবু ওনাদের হাওড়া স্টেশনে তুলে দিতে এসেছিলেন | কামরায় খুব বেশি লোকজন ছিল না | ট্রেন ছাড়ার ঠিক একটু আগে একটি পরিবার বেশ হন্তদন্ত হয়ে ওদের কামরায় উঠলেন | ওদের কাছাকাছি তাঁরা স্থান করে নিলেন | রুমি আর পিকু তখনো জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল | কথার আওয়াজ পেয়ে রুমি মুখ ঘুরে তাকাতেই দেখল একটি অসম্ভব সুন্দর ছেলে তার দিকে একটু হাসিমুখে তাকিয়ে আছে | ছেলেটির গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ কিন্তু চোখ মুখ যেন পাথরে খোদাই করা | রুমির কেমন যেন চেনা চেনা লাগল | হঠাত মনে পড়ে গেল রুমি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন একবার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে একটি গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল | বেশ কিছু নামকরা সংগীত শিল্পীরা এসেছিলেন | তখন ওর পাশে একটি ছেলে বসে ছিল এবং সেও অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত ছিল | অনুষ্ঠানের শেষে বেরোবার ঠিক আগে দুজনের মধ্যে কিছু কথার আদান প্রদান হয় এবং রুমি জানতে পারে ছেলেটি সায়েন্স কলেজে বি. টেক. করছে | তার বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর চেহারাটি রুমির মনে দাগ কেটে গিয়েছিল| ছেলেটি খুবই সপ্রতিভ ছিল এবং খুব ভদ্রভাবে তাকে আগলে আগলে ভিড়ের থেকে বাঁচিয়ে বাস রাস্তা অবধি এনে দিয়েছিল | রুমির প্রতি কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করেনি | ও হ্যাঁ, রুমিকে কেমন দেখতে বলা হয় নি না ? গায়ের রং উজ্জ্বল গোলাপি, মাথায় একমাথা কোঁকড়া চুল, চোখ দুটি যেন তুলি দিয়ে আঁকা | মাঝারি উচ্চতার চেহারায় একটি ভীষন আদুরে পুতুল পুতুল ভাব | শরীরের প্রতি খাঁজে খাঁজে দুর্বার আকর্ষণ | এইসব কথা মনে পড়তে তার মুখে এক চিলতে সলজ্জ হাসি খেলে গেল এবং ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নাড়ল যার মানে যেন আমি তোমায় চিনতে পেরেছি | ছেলেটিও একটু মাথা নেড়ে চোখ অন্যত্র ঘুরিয়ে নিল | একে একে দুই পরিবারের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে হতে জানা গেল যে তারা পুরীতে একই হোটেলে উঠছেন | ক্রমশঃ দুই পরিবারের মধ্যে খুব ভাব হয়ে গেল |
ইন্দ্রাণী সরকার
পুরীতে বেড়ানোর গল্প
পিকুরা গরমের ছুটিতে ঠিক করল এবার পুরীতে বেড়াতে যাবে | পিকু সবে মাত্র এগারোতে পা দিয়েছে | পিকুর দিদি রুমি ওর থেকে সাত বছরের বড়, সবে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল | পিকুর বাবা হলেন একজন মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ার | বাড়ি যাদবপুরে | মা হলেন এক আদর্শ গৃহবধূ এবং তিনি ছোটদের সপ্তাহে একদিন করে গানের ক্লাস নেন | ওরা সবাই পুরী একসপ্রেসের ফার্স্টক্লাস কামরায় চড়ে বসল | পাশের বাড়ির কাকাবাবু ওনাদের হাওড়া স্টেশনে তুলে দিতে এসেছিলেন | কামরায় খুব বেশি লোকজন ছিল না | ট্রেন ছাড়ার ঠিক একটু আগে একটি পরিবার বেশ হন্তদন্ত হয়ে ওদের কামরায় উঠলেন | ওদের কাছাকাছি তাঁরা স্থান করে নিলেন | রুমি আর পিকু তখনো জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল | কথার আওয়াজ পেয়ে রুমি মুখ ঘুরে তাকাতেই দেখল একটি অসম্ভব সুন্দর ছেলে তার দিকে একটু হাসিমুখে তাকিয়ে আছে | ছেলেটির গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ কিন্তু চোখ মুখ যেন পাথরে খোদাই করা | রুমির কেমন যেন চেনা চেনা লাগল | হঠাত মনে পড়ে গেল রুমি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন একবার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে একটি গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল | বেশ কিছু নামকরা সংগীত শিল্পীরা এসেছিলেন | তখন ওর পাশে একটি ছেলে বসে ছিল এবং সেও অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত ছিল | অনুষ্ঠানের শেষে বেরোবার ঠিক আগে দুজনের মধ্যে কিছু কথার আদান প্রদান হয় এবং রুমি জানতে পারে ছেলেটি সায়েন্স কলেজে বি. টেক. করছে | তার বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর চেহারাটি রুমির মনে দাগ কেটে গিয়েছিল| ছেলেটি খুবই সপ্রতিভ ছিল এবং খুব ভদ্রভাবে তাকে আগলে আগলে ভিড়ের থেকে বাঁচিয়ে বাস রাস্তা অবধি এনে দিয়েছিল | রুমির প্রতি কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করেনি | ও হ্যাঁ, রুমিকে কেমন দেখতে বলা হয় নি না ? গায়ের রং উজ্জ্বল গোলাপি, মাথায় একমাথা কোঁকড়া চুল, চোখ দুটি যেন তুলি দিয়ে আঁকা | মাঝারি উচ্চতার চেহারায় একটি ভীষন আদুরে পুতুল পুতুল ভাব | শরীরের প্রতি খাঁজে খাঁজে দুর্বার আকর্ষণ | এইসব কথা মনে পড়তে তার মুখে এক চিলতে সলজ্জ হাসি খেলে গেল এবং ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নাড়ল যার মানে যেন আমি তোমায় চিনতে পেরেছি | ছেলেটিও একটু মাথা নেড়ে চোখ অন্যত্র ঘুরিয়ে নিল | একে একে দুই পরিবারের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে হতে জানা গেল যে তারা পুরীতে একই হোটেলে উঠছেন | ক্রমশঃ দুই পরিবারের মধ্যে খুব ভাব হয়ে গেল |
ছেলেটির নাম হল জয় | পুরীতে পৌঁছে ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল গোছগাছ করতে | তারপর দুই পরিবার ঠিক করলেন যে ওনারা একই সঙ্গে বিভিন্ন
জায়গায় বেড়াতে যাবেন | মনে মনে রুমি একটু
লজ্জা পেলেও খুব খুশি হলে এই ভেবে যে এই সুযোগে ও জয়ের খুব কাছে আসতে পারবে | পুরীতে জগন্নাথ দেবের মন্দির দর্শন করে তাঁরা স্থানীয়
দোকানগুলি থেকে কিছু কিছু জিনিসপত্র কিনতে লাগলেন | পুরীর কটকি
শাড়ি খুব বিখ্যাত | দোকানে ঢুকে রুমির মা
ওর জন্য শাড়ি দেখতে লাগলেন | একটি শাড়ি
তিনি পছন্দ করে রুমি জিজ্ঞাসা করলেন, "রুমি মা, এই শাড়িটি কি তোমার পছন্দ ?" রুমি কিছু
বলার আগেই হঠাত জয় বলে উঠল, "মাসীমা, ওর রং ত' খুব ফর্সা, ওকে একটা পার্পল কালারের শাড়ি কিনে দিন না |" রুমির মা একটু অবাক হলেও স্মিতহাস্যে
বললেন, "নিশ্চই, ঠিকই ত' বলেছ |" রুমি লজ্জায়
লাল হয়ে উঠলেও মনে মনে ব্যাপারটা খুবই উপভোগ করল | কেনাকাটা
শেষ করে ওনারা হোটেলে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে ঠিক করলেন বিকেলে সমুদ্রের ধররে যাবেন
এবং পরের দিন সকালে সমুদ্রস্নান করবেন | বিকেলে
সমুদ্রের ধারে খোলা হাওয়ায় ওনারা অনেকক্ষণ বেড়ালেন | সবাই খুব
খুশি মনে গল্পগুজব করতে লাগলেন | এদিকে পিকু
বালি থেকে ঝিনুক খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে গেল | ওর দেখাদেখি
রুমিও ঝিনুক কুড়োতে শুরু করল | জয় ও ওদের
সঙ্গে যোগ দিল | জয় একগাদা ঝিনুক কুড়িয়ে
সব পিকুকে দিয়ে দিল | তারপর একটা আশ্চর্য্য
ঝিনুক নিয়ে রুমিকে বলল, "তোমার মাথায় যে হেয়ার
ক্লিপটা আছে, তাতে কি এই ঝিনুকটা
আটকে নেবে ? খুব সুন্দর লাগবে তোমায়
|" রুমি বলল, "তুমি লাগিয়ে দাও না |" জয় হো হো করে হেসে উঠল | বলল, "দিচ্ছি |" তখন রুমি ব্যস্ত হয়ে বলল, "আরে না না | আমি ত' মজা করে
বললাম |" জয় হেসে বলল, "আমিও |" রুমি তখন
নিজেই ঝিনুকটা মাথায় লাগিয়ে নিল | পিকু বলল, "ও দিদি, কি সুন্দর
দেখাচ্ছে তোমায় !" এই শুনে রুমি আর জয় দুজনেই খুব হেসে উঠল |
পরের দিন বেলার দিকে
ওরা সমুদ্রের দিকে হাঁটা দিল | স্থির হল যে
শুধু ছোটরাই সমুদ্রস্নান করবে আর বড়রা সেটা বসে বসে দেখবেন | ওরা কেউই সুইমিং স্যুট পড়ে না | রুমি একটা
থ্রি কোয়াটার্স প্যান্ট আর লুস শার্ট পড়েছিল | পিকু আর জয়
পাতলা টি শার্ট আর শর্টস পড়েছিল | নুলিয়ারা এল
ওদের সাহায্য করতে | একটি নুলিয়া পিকুকে
নিয়ে জলে নামল | আর এক জন রুমিকে
নামানোর জন্য এল | রুমির খুব অস্বস্তি
লাগছিল প্রথম দিকে কিন্তু পরে সে রাজি হল | জয় বলল ওর
নুলিয়া লাগবে না কারণ ও জানে কিভাবে ঢেউয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয় | রুমি একটা নিচু ঢেউ আসতে নুলিয়ার কথামত ওর হাত ধরে লাফিয়ে উঠল
| এর পর একটা বিশাল উঁচু ঢেউ আসতে দেখল | নুলিয়া বলল, "দিদি, শিগগির মাথা নিচু করুন, ঢেউ আপনার
মাথার উপর দিয়ে চলে যাবে |" রুমি শুনে
ভয়ে আঁতকে উঠল, "ও মা গো !" হঠাত
শুনল জয় পাশ থেকে বলছে, "চিন্তা নেই আমি আছি |" এই বলে ও রুমির কোমরটা জড়িয়ে তাকে
শক্ত করে ধরে রাখল | ঢেউটা ওদের মাথার উপর
দিয়ে চলে গেল | এর পর ওরা আর কিছুক্ষণ
ঢেউয়ের সাথে খেলা করে ধীরে ধীরে বালির দিকে এগিয়ে গেল | পিকু চেঁচিয়ে বলল, " ও দিদি, কি মজাই যে হল কি বলব আর ! তুমি ভয় পাও নি ত ?" শুনে রুমি একটু লজ্জা পেয়ে বলল, "না রে, তোর জয়-দা
আমায় ধরেছিল, নয়ত আমি হার্ট ফেল করে
যেতাম |" তারপর সব কিছু শুনে বড়রাও ছোটদের
সঙ্গে হো হো হেসে উঠলেন | ফেরার সময় দুই পরিবার
রুমি আর জয়ের ঘনিষ্ঠতা দেখে ঠিক করলেন যে ওদের দুজনকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলে ওরা
সুখী হবে | ওদের মতামত নেওয়ার জন্য
জয়ের মা রুমিকে আর জয়কে আলাদা করে ডেকে বললেন, "মা রুমি, আমি চাই তুমি আমার ঘরে বউ হয়ে এস | এতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে ?" রুমি মাথা
নিচু করে রইল, কিছু বলতে তার ভীষন
লজ্জা করছিল | জয় বলে উঠল, "কেন আপত্তি থাকবে ? আমি ছাড়া ওকে কে সমুদ্রে চান করাবে ?" এই না শুনে জয়ের মা বললেন, " এই দুষ্টু ছেলে, এখন থেকেই এত ভালবাসা, শেষ পর্যন্ত
যেন থাকে |" জয় বলল, " কেন থাকবে না মা, তুমি ত আছো মনে করিয়ে দেবার জন্য |" মা বললেন, "আর আমার অবর্তমানে ?" জয় শুনে বলল, "কচিগুলো থাকবে ত' তখন, তারা মনে
করিয়ে দেবে |" হাহাহাহা....মধুরেন
সমাপয়েত!!
আজকের দিনটা বিজুর কাছে
স্পেশাল্। ঘুম থেকে উঠেই শেভিং করে, স্নান সেরে
বার বার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের মুখটা দেখছে আর মনে করছে বড়দার কথাটা-
তোকে কিন্তু দেখতে বুম্বাদার মত লাগছে। বুম্বাদা কে?-জানতে চাইল
বিজু। আরে বুম্বাদা মানে প্রসেনজিৎ, বাঙালির শেষ
নায়ক--বড়দার উত্তর। হাসি পেল বিজুর, তাড়াতাড়ি
শার্ট-পেন্ট পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবল বড়দাকে জানিয়ে গেলে কেমন
হয় যে সে আজ ঝিলমিলদের বাড়িতে যাচ্ছে এবং সম্ভবত আজই নিজের মনের কথাটি ঝিলকে
বলবে। বড়দা মানে সুবোধ দাস হিন্দুত্ব বাদী রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। আগামীতে
পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলকে জেতানোর দায়িত্ব সম্ভবত তার কাঁধেই পড়বে। সেদিন ঝিল
বিজুদের বাড়িতে আসার পর কত গল্প করল। অথচ ঝিল যাওয়ার পর হঠাৎ বলে উঠলেন, ঝিল বোধহয় মুসলমান! বিজুর প্রতিক্রিয়া--- কী বলছ বড়দা! ঝিল
ওরফে ঝিলমিল নাথ একজন হিন্দু । দেখিস সামনেই কিন্তু
নির্বাচন।
শৈলেন দাশ
বড়দাকে একটু চিন্তিত দেখাল সেদিন।
বড়দাকে আর জানানো হলনা। সাত সকালেই পার্টির কাজে কোথাও বেরিয়ে পড়েছেন, বিজু তাই ধীরে ধীরে খেয়া পার হয়ে ইণ্ডিয়া ক্লাব পয়েন্ট
থেকে রিক্সায় চড়ে রওয়ানা দিল ঝিলদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। জেল রোডের আপ্ টা নামলেই
অম্বিকাপট্টির মুখে একটি ছোট্ট দোতলায় ঝিল ও তার বাবা-মা থাকেন। রিক্সা থেকে নেমে
বিজু দেখল, যে বাড়িটার ব্যালকনি
থেকে ঝিল তার জন্য অপেক্ষা করছে। সেটি বেশ মনোরম, সামনে
ফুলেরবাগান, ব্যালকনিতে টবে টবে
বিভিন্ন জাতের ফুল, দেওয়াল বেয়ে উঠেছে
একটি পাতা বাহার। গেইট খুলে বারান্দায় উঠতেই বিজুকে স্বাগত জানাতে এল ঝিল। সাথে
বেশ সুন্দরী এক মহিলা। পরনে খুব দামী একখান তাঁতের শাড়ি, হাতে মাত্র একটি করে সোনার বালা, কানে ছোট টপ। লক্ষ্যণীয় হল, কপালে
সিঁদুর নেই।
ঝিল বলল,--- বিজু ইনি হলেন আমার মা, বাবা বাড়িতে নেই। বেরিয়েছেন কোথাও অফিসের কাজে। সেদিন বিজু
ঝিলের বেড রুম থেকে একে একে বাড়ির প্রতিটি ঘর দেখল। নিজের নতুন কম্পুটারে ঝিল
কিভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় তাও শিখল । তারপর অনেক্ষণ গল্প
হল ঝিলের মায়ের সাথে। বিজু খুব মন দিয়ে শুনছিল ঝিলের মায়ের কথা, তার ছোট বেলা নাকি কেটেছে বিজুদেরই গ্রামে। বিজুর বড়দাকেও
তিনি চেনেন ভালোভাবেই। তবে এখন আর কোন খবরই রাখেন না সেখানের। তার মা-বাবা নাকি
চলে গেছেন অন্য গ্রামে ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে ঝিলের মায়ের পরিবেশন করা
মুখরোচক খাবার খেয়ে বিজু খেয়ালই করেনি বেলা কখন গড়িয়েছে এগারটায়। এমন সময়
মোবাইলে বড়দার মেসেজ,--- বারটায় বাড়িতে থাকিস্, যুবমোর্চার মিটিং আছে তোকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এদিকে ঝিলের
মা বললেন,-- আজ প্রথম এসেছো বাড়িতে তাই খেয়ে
যেতে হবে। বিজু তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল, আরেক দিন
এসে খাব, বলেই ঝিলকে দেখাল বড়দার মেসেজ। ঝিল
মাকে বুঝিয়ে বলে নীচে নেমে এল বিজুকে বিদায় জানাতে।
বিজু বলল,- তোমাকে কিছু বলার ছিল
ঝিল এবং তা আজকেই বলব বলে ঠিক করে এসেছি। ঝিল বলল, তার আগে
আমাকে কিছু জানাতে হবে তোমাকে আমার মায়ের সম্পর্কে। বিজু বলল, কী? তারপর ঝিল যা বলল তা
শুনে বিজুর মাথায় শুধু বড়দার কথাগুলিই ঘুরপাক খাচ্ছিল- দেখিস সামনেই কিন্তু
নির্বাচন.......... ঝিল বোধহয় ........। ঝিলকে বলল, আজ আসি আবার
দেখা হবে। বারান্দায় অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ঝিল। গ্লানি না অভিমান জাগল মনে বোঝা
গেলনা। চেয়ে থকল দূর পথে যেখানে ক্রমশঃ ছোট হয়ে যাচ্ছে বিজুর অস্তিত্ব। জানতে
চায়নি সে, তার মনের কথা বললনা কেন
বিজু।
শিবলী শাহেদ
বড়দের প্রেম মানে শুধু
মনের ব্যাপার নয় , মনের সাথে যুক্ত হয় আরো
কিছু । আর ছোটবেলার প্রেম মানে শুধুই প্রেম - যার আগে সচেতন ভাবেই ‘ পবিত্র ’ শব্দটি জুড়ে
দেয়া চলে । আমার বয়স তখন কত হবে ? বড়জোর ১০-১১
। রাজধানীর এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে স্ট্যান্ডার্ড ফাইভে পড়তাম । ক্লাসে যেতাম
আসতাম , আসতাম যেতাম । তো হঠাৎ একদিন শুনলাম
আমাদের ক্লাসে এক মেয়ে ভর্তি হতে চলেছে যে কিনা অর্ধেক বাঙালি অর্ধেক আইরিশ । পরে
বিস্তারিত জানা গেল – মেয়েটির বাবা আমাদের
চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোক আর মা নর্দান আয়ারল্যান্ডের । দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার , সকাল ৮.৩০ । আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন ক্লাসরুম আলোকিত করে যে
মেয়েটি প্রবেশ করল তার নাম জ্যাসমিন । এক অচেনা ফুলের হৃদয়চেরা ঘ্রাণ টের পেলাম
হঠাৎ । সেই থেকে আমার বুকের ব্যথা শুরু ( আশ্চর্যের ব্যাপার, এই ব্যথা অন্য ব্যথার মতো বেদনাদায়ক নয় , আনন্দদায়ক ) । নাফিসা ম্যাম ক্লাসে এসে যথারীতি পড়াতে শুরু
করলেন ‘নেক্সট মর্নিং তোমাকেও ...’ তিনি বলেই যাচ্ছেন আর
আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি জেসমিনের দিকে । কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই , শুধুমাত্র সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আমি তার প্রেমে পড়ি । অবশ্য
সেই বয়সে ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝি নি । শুধু বুঝতাম – তাকে দেখলেই
বুকের ব্যথাটা প্রবল হয় । এর কয়েকদিন পর , ক্রিয়েটিভ
ওয়ার্কিং এর অংশ হিসেবে আমাদেরকে স্কুল থেকে বলা হলো কাগজ দিয়ে কিছু একটা তৈরি করে
সাবমিট করতে হবে একসপ্তাহের মধ্যে এবং এর উপর ভিত্তি করে নাম্বার দেয়া হবে যা কিনা
টার্ম পরীক্ষায় যোগ হবে । নিজেদের সুবিধার্থে অনেককেই দেখলাম পার্টনারশিপ তৈরি করে
কাজ করতে । ভাবলাম – জ্যাসমিনকে আমার সাথে
কাজ করতে বলবো ; কিন্তু প্রচণ্ড
অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে তা আর বলা হলো না । বাসায় এসে কাগজ দিয়ে একটা বড় ঘুড়ি
বানাবার প্ল্যান করি । খুব মনযোগ দিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম । হঠাৎ আবারো জেসমিনের
কথা মনে পড়ে যায় । বুকের ভেতরটা কেমন জানি একটা মোচড় দিল ! একটা কাগজে ইংরাজিতে লিখলাম
–‘জেসমিন, আই লাভ ইউ’ লেখার পর নিজের কাছেই কেমন জানি লজ্জা লাগছিলো । কাগজটা ছিঁড়ে
টুকরো টুকরো করে ফেলি ,কেউ দেখে ফেললে তো আর
রক্ষা নেই । কাঁপা কাঁপা হাতে আরেকটি কাগজে লিখলাম ‘লেটস মেক এ কাইট টুগেদার’। একটা দীর্ঘ
নিঃশ্বাস ছাড়লাম । কাগজটা সাবধানে লুকিয়ে রাখলাম একটা বইয়ের ভেতর । পরের দিন টিফিন
ব্রেকের সময় কৌশলে চিরকুটটি তার হিস্ট্রি বইয়ের ভেতর রেখে দিলাম । উত্তেজনা আর ভয়ে
সেদিন আর কোনো ক্লাস না করেই বাসায় চলে আসি । পরদিন , ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি ; হঠাৎ দেখি জেসমিন আমার দিকেই এগিয়ে আসছে । ভয়ে আমার গলা
শুকিয়ে কাঠ । আশেপাশে তাকিয়ে পালাবার পথ খুঁজছিলাম । ভাবলাম – যা হবার হবে , নাক বরাবর
দৌড় দিই । পারলাম না । মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলাম । জেসমিন এলো,
ইংরাজিতেই জিজ্ঞাসা করলো আমি চিঠিতে নাম লিখিনি কেন ? জানালো, হাতের লেখা দেখেই
আমাকে চিনতে পেরেছে । আরো বললো আমি এতো লাজুক কেন ? আমি তো খুশিতে অজ্ঞান হয়ে যাই – এমন অবস্থা ।
তো এভাবেই শুরু হলো
আমাদের ভালবাসার পটভূমি । দু বছর আমরা একটি আত্মা
হয়ে বেঁচে ছিলাম । একদিন ওর সাথে কথা না বললেই দম বন্ধ হয়ে যেত । তখন তো আর মোবাইল
ছিল না । ল্যান্ড ফোনই ছিল ভরসা । এভাবেই কেটে যায় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম দুটি
বছর । পৃথিবীর সব প্রেমই ট্রাজেডির দিকে ধাবমান । আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটে
নি । কাকতালীয় ভাবে সেদিনটিও ছিল বৃহস্পতিবার , রাত ৮.৩০ । জেসমিন
আমাকে ফোন দেয় । কোনো কথা বলে নি । বলতে পারে নি । শুধু কেঁদেছিল । এতো খারাপ
লাগছিল ওর জন্য ! তারপর হঠাৎ করেই লাইন কেটে যায় । আমি শত চেষ্টা করেও ফোন করে
তাকে পেলাম না । পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখি সে নেই । একদিন , দুদিন , এক মাস ...।
সে আর আসে নি । প্রায় চল্লিশ দিন পর ওর এলাকার এক পরিচিত ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে
পারলাম তার মা –বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে
গেছে । মা তাকে আয়ারল্যান্ডে নিয়ে গেছে । আমার স্পষ্ট মনে আছে , ঈশ্বরের কাছে আমি সেদিন আমার মৃত্যু কামনা করেছিলাম ।
স্বাভাবিক হতে আমার অনেক সময় লেগেছিল । সময় বড় অদ্ভুত এক জিনিস । সব কিছুকেই ধীরে ধীরে হালকা করে দেয় । তবুও মনের গভীরে কোথাও ব্যথারা দপদপ জ্বলেই যাচ্ছে এখনো । আজো আমি জেসমিনের জন্য অপেক্ষা করি । আজও কোথাও ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বাক্যটি দেখলে মনে মনে তার অনুবাদ করি – ‘লেটস মেক এ কাইট টুগেদার’ - ‘এসো, আমরা দুজনে ঘুড়ির মত উড়ি’ ।
স্বাভাবিক হতে আমার অনেক সময় লেগেছিল । সময় বড় অদ্ভুত এক জিনিস । সব কিছুকেই ধীরে ধীরে হালকা করে দেয় । তবুও মনের গভীরে কোথাও ব্যথারা দপদপ জ্বলেই যাচ্ছে এখনো । আজো আমি জেসমিনের জন্য অপেক্ষা করি । আজও কোথাও ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বাক্যটি দেখলে মনে মনে তার অনুবাদ করি – ‘লেটস মেক এ কাইট টুগেদার’ - ‘এসো, আমরা দুজনে ঘুড়ির মত উড়ি’ ।
প্রজন্ম
২রা ডিসেম্বর
-
ইস্ স্ স্ একদম চিনি দাও নি !
-
ভাল। সুগারটা কতো বেড়েছে জানো ? প্রায় দুশো তিরিশ । ডাক্তার বারন করেছে, তাই চিনি ছাড়াই চা খাও।
-
ঠিক আছে , ঠিক আছে, সাত সকালে আর শুরু করো না।
তিক্ত মেজাজে চা খাওয়া
দিয়ে দিন শুরু আমার , হালকা ঠাণ্ডা
পড়েছে, ডিসেম্বরের প্রথম
সপ্তাহ, তবে চা খাওয়া আমার কলেজ
জীবনের নেশা। চাকরি জীবন শেষ করেএই অবসর জীবনেও সেই নেশা অটুট। তবে বিদিশা আজকাল
আর এত খেতে দেয় না। ডাক্তারের বারনের পরে আরও কড়াকড়ি বেড়েছে। যাদবপুরের এই
ফ্ল্যাটে আসার পরে আড্ডার নেশাও কমে গেছে।
-
হ্যাঁ গো ! বাবু এল না এখনও ?
না , সংক্ষিপ্ত উত্তরে
জানান দিলাম আমি। বাবু, ভাল নাম
অমিত, আমাদের ছেলে। শিবপুর
থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন সেক্টর ফাইভের ছিল, সারা দিনে অবশ্য চোদ্দ ঘণ্টা রোজই সে কর্মব্যাস্ত থাকে, খাওয়া- ঘুমানো বাদে খুব একটা বাড়ির
সাথে সম্পর্ক থাকে না। এদের কাজকর্ম আমি বুঝি না। ভাবতে
ভাবতে বেল বাজল, আমি গিয়ে
দরজা খুললাম। অমিত ঢুকল, উস্ক-খুস্ক
চুল, ঢুকেই ব্যাগটা সোফাতে
ছুঁড়ে ফেলে নিজের ঘরে ধুকে গেল। পেছন পেছন আমি গেলাম।
-
খুব ক্লান্ত লাগছে ? কিছু খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম নে। আচ্ছা আজ
বিকেলে একটু বাড়ি থাকবি ?
কোনও কথারই উত্তর দিল না, ওর ঘরেই ঢুকে যাছ্ছিলাম , বিদিশা ডেকে বলল,
‘ও খুব ক্লান্ত আসলে ! ছেড়ে দাও , পরে বোলো’।
আমি
বিদিশার কথা ফেলতে পারি না। আজ বলে না , চল্লিশ বছর আগে থেকেই। কলেজের
পাশের গলির একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতো ওরা। যেদিন রঙ গুলে কলেজের দেওয়ালে লিখছিলাম :
চে , চারু, মার্ক্স , লেনিন / তোমাদের পথেই আসছে সুদিন।
পড়ন্ত বিকেলবেলা আমাকে কলেজের পেছনের পাঁচিলের আড়ালে
ডেকে হাত চেপে ধরে বলেছিল, ‘দয়া করে আর এসব করবেন না, রাজনীতি ছেড়ে দিন। পুলিশ বহু ছেলেকে ধরে নির্বিচারে গুলি করে
মারছে- কোনও রেহাই পাবেন না’। সেদিনের সেই করুণ
স্বরের আদেশ করা আর্তনাদ আমার আদর্শ , স্বপ্ন সব টালমাটাল করে দিয়েছিল, ওর চোখে দেখেছিলাম আকাশ কতো বড়।
প্রথম ভয় পেলাম, কেন ভয় পেয়েছিলাম তা এখন উপলব্ধি করি। এরপর অনেক জল বয়ে গেছে।
আমি কলেজ শেষ করে সি .এস. সি. –তে চাকরি
করেছি, বাড়ির বিরুদ্ধে একরোখা হয়ে বিদিশাকে বিয়ে করেছি। বরানগরের সেই ছোট বাড়ি ছেড়ে
এখানে ফ্ল্যাট কিনে উঠে এসেছি। ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছি, আজ ওরা প্রতিষ্ঠিত। অবসর নেওয়ার পর এখন তো জীবন মানে শুধু জি-বাংলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু বাড়ির
কাজ, আর এই সারাদিন এমনিই
কেটে যায়। ‘নাহ্ ! বেলা হয়ে এল, বাজার আনতে হবে’, বিদিশাকে বললাম ‘তাড়াতাড়ি করো আজ’।
খাবার
টেবিলে অমিতের সাথে দেখা হল। বারোটা বাজে, এখনও বেরোয় নি। মনে হয়, আজ ছুটি নিয়েছে, কিছু বলেও না। আমি মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বললাম, ‘বাবু, আজ বিকেলে একটা কাজ করে দিস, তোর মায়ের পেটের বেশ কয়েক দিন ধরে
ব্যাথা করছে বলছে, একটা
অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিস তো ডঃ চ্যাটার্জ্জীর কাছে’ । বাবু মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,‘ব্যাথা ? কবে থেকে ?”
বিদিশা ব্যাপারটা চাপা দেবার চেষ্টা
করে বুঝিয়ে দিল দুএকদিনের সামান্য ব্যাপার এটা। যদিও আমি জানি ওর ব্যাথা হলে কেমন
কাতরায়।
-
না বাবা, আমার হবে না, বিকেলে বেরোবো ।
-
আরে সে না হয় যাবি, কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়ে যাস।
এই দেশপ্রিয় পার্কের কাছেই তো ; আমি বললাম।
-
না, পারব না আমি, তুমি মিতুলদিকে ফোনে বোলো না, ওই বলে দেবে ওষুধ
অমিতের এই
উত্তরের পর আর আমি কিছু বললাম না, বলতে ইচ্ছে করল না। আমিতের দিদি মানে সুরঞ্জনা আমাদের মেয়ে।
পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল। আমাদের বাড়ির প্রথম
ডাক্তার। বিয়ে করে দিল্লীতে আছে এখন। সেখানেই কাজকর্ম। দিনে দুবার ফোনে কথা হয় – অরাও খুব ব্যাস্ত, বুঝি। দুপুরের
ফোনে বিদিশা, মিতুল কে
ওর ব্যাথার কথা জানাতেই ওর উৎকণ্ঠা বুঝলাম। বিকেল গড়িয়ে এল। পাড়ার এক ট্যাক্সি ধরে
আমি একাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে চলে এলাম।
কাল দুপুর তিনটে। রাতে মেয়ে খোঁজ নিল, ছেলেও দায়িত্ব রক্ষা করল। কালও যে আমি
একাই ওদের মা কে নিয়ে যাব, সেটা বুঝলাম। আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। রাতে শুয়ে বুঝলাম বিদিশার পেটের ব্যাথাটা আবার বেড়েছে- কাতরে
চলেছে। পাশের ঘরের থেকে ভেসে আসছে “ পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে...” সাথে অসঙ্খ্য ধুপ-ধাপ রকমের শব্দ। অত্যাধুনিক সাউন্ড
সিস্টেমের কল্যানে আমার ছেলের বিনোদন চলছে, আর গানটা শুনতে শুনতে
বিরক্তির সাথে ভাবি, রবীন্দ্রনাথকেও
এরা ছাড়ল না ! জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক, বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু । রাত ঘনিয়ে
এল, কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না।
৩ ডিসেম্বর
গতানুগতিক দিন শুরু
আমার, ছেলে সকালে অফিস চলে
গেছে। আমি আমার কাজ, বাড়ির কাজ
নিয়ে ব্যাস্ত, দুপুরে
ইলেকট্রিকের বিল জমা দিয়ে চলে গেলাম ডাক্তারের কাছে। আজ সকাল থেকে ওর
পেট ব্যাথা হয় নি। মেয়ে খোঁজ নিয়েছে, তার মা কে বলেও দিয়েছে ঘাবড়াবার কিছু নেই, ঠিক হয়ে যাবে। ট্যাক্সি
করে যেতে যেতে জানলার বাইরে দিয়ে শহরটা দেখছিলাম, বেশ কয়েক বছরে শহরটা অনেক পাল্টেছে। সত্যি কল্লোলিনী
তিলোত্তমা হয়ে উঠছে। ব্যাঙ্কগুলো কার লোন দেওয়া শুরু করার
পর থেকে গাড়ীর সংখ্যা বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে যেখান সেখান থেকে উঠে গেছে ফ্লাইওভার । নতুন
মেট্রো হবে শুনছি। ছেলেমেয়েদের পোশাকে অনেক নতুনত্ব
এসেছে। কতকিছু পাল্টে গেছে, শুধু একটা ব্যাপার আজও একই রকম আছে দেখি – এখনও মানুষ ভালোবাসে। আমিতো বিদিশার
হাত ধরে এই রাস্তায় কতো হেঁটেছি। জানিনা, ও একই কথা ভাবছে কি না – চুপ করে আছে।
ডাক্তার ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে খসখস
করে ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
কথা বলে এলাম, কাল সকালে ৯টায় যেতে হবে।
ইউ এস জি করে আনতে, স্টোন হতে পারে। ওনার চেম্বারটা একটা পলিক্লিনিকেই, সেখানেই ।
৫ ডিসেম্বর
কাল সকালে
সব পরীক্ষা করিয়ে নিয়েছি, রাতে রিপোর্টও পেয়ে গেছি, আজ ডাক্তারের কাছে এসেছি। ডাক্তার দেখেশুনে বললেন গলব্লাডারে
স্টোন হয়েছে। দেরি করা একদম উচিত হবে না।
কালকেই অপারেশান করাতে পারলে ভাল হয়, আমি কিছু বুঝে ওথার আগেই উনি মনে করিয়ে দিলেন যে উনিই
সার্জেন। এখন বিকেলবেলা হঠাত করে ভরতি করা যায় !
আমি একা মানুষ। শেষে ঠিক হল, কাল রাতে ভরতি হবে- ঢাকুরিয়া আমরি।
পরশু ওনার দুপুরে একটা ও. টি. আছে তারপরেই বিদিশার অপরেশান । আমরা বাড়ি চলে এলাম।
রাতে মিতুল সব শুনে সাহস দিল ওর মা কে। বিদিশা এমনিতেই ভয়
পায় একটু। বাবুর সাথে রাতে আর কথা হয় নি।
৬ ডিসেম্বর
বাবু সব
শুনে বলল, ওর আজ ছুটি নেওয়া সম্ভব
না- কাল পারলে নেবে, দুপুরে
যাবে। সারাদিন বিদিশা খানিকটা গুম মেরে বসে রইল। ভয় পেয়েছে বোধায় কি হয়েছে ভেবে ! আমিই ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিলাম। টুকটাক যে কটা
জিনিস নিতে হয়, নিয়ে
নিলাম। বিকেলে আমি ওকে নিয়ে ভরতি করাতে গেলাম। বিছানায় বসে, ওর মোবাইলটা
আমাকে দিয়ে দিল। মাস-খানেক আগে কিনে দিয়েছিলাম। খুব একটা ভাল চালাতেও পারে না-
নোকিয়া কি আর ভোডাফোন কি সেটাই ঠিকঠাক বোঝে না , কিন্তু শখ করে বলেছিল সুমনের গান থেকে
ওর রিংটোন করে দিতে, ওর ভাল
লাগে। পাশের বাড়ির ছেলেটাকে দিয়ে করিয়ে দিয়েছিলাম, বাবুর তো এসবের সময় নেই, আমিও ভাল পারিনা, ওই অফিসের কাজ সামলাতে যতটুকু
কম্পিউটার শেখা । বাড়ি থেকে হসপিটালটা খুব দূর না, ব্যাবস্থাও খুব সুন্দর। বেশ কয়েকটা বিল্ডিং অনেক লোকেই এখানে চিকিৎসা করাতে আসে, কোলকাতার একটা ভাল বেসরকারি হাসপাতাল
হিসেবে খুব নামডাক। আমাদের সময় অবশ্য সরকারি হাসপাতাল গুলোই
যথেষ্ট ছিল। বেরোবার সময় চারপাশটা ভালকরে দেখলাম- খুব সুন্দর ব্যাবস্থা, চারদিক ঝকঝক করছে, পরিস্কার, সাহায্য করতে বেশ কয়েকজন ঘুরছে । হাসপাতালে
কফির দোকানও আছে। এখানে খরচা যেমনই হোক, চিকিৎসা ভাল হবে- বিদিশাকে ভরতি করে বাড়ি ফিরলাম, রাতের খাবার ও করেই গেছে।
৭ ডিসেম্বর
আমি একাই
এসেছি, ছেলে আসবে বলেছে আবার
এখান থেকে ও অফিস ফিরেও যাবে, মিতুল কলকাতা আসবে বললেও পরে বলল ছুটি পাবে না। যাই হোক, ভালয় ভালয় অপারেশান হয়ে গেলে শান্তি। দেখতে
দেখতে, অপারেশান শেষ করে
ডাক্তার বেরিয়ে এলেন, সব ঠিকঠাক
হয়ে গেছে। ডাক্তারের সাথে দেখাও হল, আজকের দিনটা থাকবেতো বটেই, কালও থাকবে, বিকেলে উনি দেখবেন, সব ভাল থাকলে পরশু বিকেলে বিদিশার
ছুটি। ওকে এবার কেবিনে দিয়ে দেবে, একবার দেখে এলাম, ঘুমে আচ্ছন্ন । বেশ তৃপ্তিতে
ঘুমোচ্ছে।
৯ডিসেম্বর
আজ
শুক্রবার, ব্যাঙ্কে একটু যেতে হত, কাল খুব ভিড় হবে। আজ বিদিশা বাড়ি
ফিরবে, সকাল থেকে আমার মনটা
বেশ ভাল লাগছে। কাল ও দেখে এসেছি, বিকেলে- একদম সুস্থ ছিল।
চিন্তা নেই তেমন আর। একটা আয়া সেন্টারে বলেও রেখেছি, আজ বিকেলে ওরা লোক পাঠাবে। বাবু বিকেলে আমরিতে চলে যাবে, আমি আর বাবু ওকে নিয়ে ফিরব। বাবু এখনও ঘুমিয়ে আছে। আজ আমার ঘুমটাও তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে
গেছে, এখনও কাগজ দেয় নি।
পাশের বাড়িতে টিভি চালিয়েছে, এত জোরে! কোথাও কিছু একটা
হট্টগোল হয়েছে মনে হয়। আমিও চা নিয়ে টিভি খুলে বসলাম, খবরের চ্যানেল গুলোই দেখি। এটা কি
দেখাচ্ছে !
এ কি !!
ঢাকুরিয়া ... আমরিতে !! আমি বাকরুদ্ধ। কিছু বুঝতে পারছি না। বাবুকে ডেকে তুলে দিয়ে
আমি একাই একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম। হসপিটালের
সামনে যেতেই দেখতে পেলাম, লোকে লোকারণ্য ! আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করেছে অনেক কিছুই, চিমনীর মত কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে
তখনও বেরিয়ে চলেছে । একের পর এক
শার্সি ভেঙ্গে পড়ছে, দমকল তখনও
আগুন নেভাতে লড়ছে। ভাঙ্গা জানলা গুলো দিয়ে নেমে আসছে এক একটা লাশ। কেউ ঝলসে গেছে, কেউ দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে
বিষাক্ত গ্যাসে।
আমি জানি
না কার দোষ, কেন আগুন
লাগল – আমি শুধু বিদিশার একটা
খোঁজ চাইছি। বেলা বেড়ে চলল। পুলিসের থেকে খবর নিয়ে বাবু আমাকে নিয়ে রওনা দিল হসপিটালে। ওখানেই মর্গ। কি বীভৎস
অবস্থা এখানে ! মৃতদেহের ভিড়ে চার দিকে শুধু হাহাকার। একটার পর একটা পোস্টমর্টেম হয়ে চলেছে কোনার ঘরটায়, তার আগে লাশ পাওয়া যাবে না।
অস্বাভাবিক দুর্গন্ধ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আমার অবশ্য এসব
অনুভূতি আসছে না- আমার কাছে এখন আইন, নিয়ম এ সব কিছুই যেন অবান্তর মনে
হচ্ছে ।
সবে একটা লিস্ট
টাঙ্গিয়েছে মৃতদের, আমি দৌড়ে
গেলাম খুঁজতে, ভিড়ের
মধ্যে কষ্ট করে কোনক্রমে দেখার চেষ্টা করলাম। কোথাও
পেলাম না – কেমন একটা
মৃদু আশা পেলাম। কিন্তু, তখনই পাশ থেকে শুনলাম বাবুর গলা – “ বাবা, আঠারো নম্বর নামটা...” ।
আমার পকেটে বিদিশার
মোবাইল ছিল, ওর প্রিয়
রিংটোন বাজছে-
‘ আমার জীবন থেকে ঊঠে আসা সুর, তোমাকে শুনিয়ে আমি যাবো বহুদূর ফিরেও আসব আমি তোমার সুবাসে, থাকবো তোমার বুকে আর আশে পাশে। আমাকে পড়লে
মনে খুঁজ এইখানে, এখানে
খুঁজছি আমি জীবনের মানে’ ।
মিতুল বোধয়
জানতে চায় ওর মা কেমন আছে....আর আমার পাশে কারা যেন ক্ষতিপূরণের
কথা বলছে, ক্ষতিপূরণ !!