সীতাপুরাণ
সীতার
জন্ম
বাংলাদেশের নড়াইলের কালিয়া
উপজেলায় সীতা জন্ম নিলেন। সেদিন বৃষ্টির জলে ভরা ছিল নড়াইল। সীতার বাবা তখন হাল
চষতে বাড়ির বাইরে। ঘরে আর কেউ নাই। নবগঙ্গা নদী তখন জলে ভরপুর। অথৈ নদীর ডাক দিন-রাত এপার থেকে ছুটে
কেড়ায় ওপারে। এরকম মেঘ কালো দিনে সীতা এসে জন্ম
নিলেন নড়াইলের কুলে।
সীতা নামকরণ ও এলাকাবাসীর নানা আলাপ
ঘর মেয়ের হাসিতে আলোয় ভরে ওঠেছে
যেনে হাল চাষ ফেলে দৌঁড়ে আসেন সীতার বাবা। এসেই মেয়েকে কুলে নিয়ে তার নাম দেন
সীতা। ঘরে পাড়া-প্রতিবেশীর সবাই এসে জড়
হয়েছেন। সীতা নাম দেওয়া হয়েছে শুনে অনেকেই বললেন- এই নাম কেউ রাখেন না।
সীতা মানে দু:খ,সীতার
আজন্ম জীবন ছিল দুঃখের । মা বাবাকে অনুরোধ করেন মেয়ের নাম যেন সীতা না রাখা হয়।
কিন্তু বাবার কথা অন্য,যে সীরধ্বজ রাজার হলকর্ষণের সময়
সীতার জন্ম হয়,জমি চাষ করার সময়
লাঙলের আঘাতে ভূমি বিদীর্ণ করে যে
সীতার জন্ম হয়,কোনও কৃষকের ঘরে মেয়ে হলে তার নাম
তো সীতাই রাখতে হবে। সীতা শুধুই দু:খের এ ভুল, সীতা একজন কৃষকের হাল কর্ষণে
আনন্দের জন্ম। একজন কৃষক সারা জীবন এইই চায়।
সীতার রূপ ও চরিত্রের বর্ণনা
বয়স যতই বাড়ে সীতার রূপও ততই বাড়তে
থাকে। এলাকাবাসীর নজরেও পড়তে থাকে সীতা । শুধু রূপে নয়,গুণেও। মা-বাবার হেন কাজ নেই যে
সীতা তা করে দেয়না। সীতার মা-বাবা সীতাকে নিয়ে
খুবই খুশি আর আনন্দিত। এলাকাবাসীও সীতার রূপগুণে খুব মুগ্ধ। সবার মনে কেবল একই কথা- সবার ঘরে যেন সীতার মত মেয়ে জন্ম নেয়।
নবগঙ্গার ভাঙন ও সীতার পরিবারসহ ঢাকায় আগমন
সীতার বয়স যখন ১৬ কি ১৭,সীতার বিয়ে নিয়ে কথা বলছেন তার মা-বাবা,দু-একটা ছেলে পক্ষও এসে
দেখে গেছে সীতাকে সে বছরই শুরু হল নবগঙ্গা নদীর ভাঙন। নদীর
এই যে ভাঙন শুরু হল তার আর শেষ নেই। অনেক মানুষকে গ্রাম ছেড়ে দিতে হল। কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে। সীতাদেরও একই অবস্থা।
ধানী জমিগুলোও সব নদী খেয়ে নিল। সীতারা চলে এল ঢাকায়। ঢাকায় তাদের কিছুই চেনা নেই।
এলাকার যে লোকটির সাথে তারা ঢাকায় এসেছিল, সেই লোকটিই বলল সীতা আর তার মাকে গার্মেন্টে কাজ করতে। আর সীতার বাবা কাজ নিল
রিক্সা চালনার। বস্তিতে অজস্র মানুষের সাথে একটি ভাঙ্গন অতিক্রম করে তারা এমন এক জগতে
এসে পৌঁছল,তাদের মনে হল- কোনোরকম জীবনটা এখন
কাটিয়ে দিতে পারলেই চলে।
সীতার বিয়ে ও অপহরণ
এরকম সুন্দর একটি মেয়ে বস্তিতে থাকে, বস্তির কোনও ছেলেরই নজর এড়াল না
বিষয়টা। মা-বাবা এটা বুঝতে পেরে আর আজানা-অচেনা জায়গা, কিছু একটা হয়ে গেলে এরকম ভেবেই
মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল মা-বাবা। ছেলে সেই বস্তিতেই থাকে। কাজ
করে একই গার্মেন্টে। বিয়ের দু একদিন যেতে না যেতেই বস্তির ছেলেরা অপহরণ করে নিয়ে যায় সীতাকে।
সীতার অগ্নিপরীক্ষা:
সীতার কান্না দেখে মায়ায় পড়ে যায়
সেইসব ছেলেরা। সেদিনই বস্তির পাশেই বখাটে ছেলেরা ফেলে রেখে যায় সীতাকে। এবার শুরু
হয় স্বামীর সাথে সীতার ঝগড়া। সীতার স্বামী সীতাকে আর ঘরে নিতে চায় না। কারণ সীতা
এখন অসূয়া। সীতা কিছুতেই বোঝাতে পারে না, বখাটে ছেলেরা তার শরীর পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেন নি। রাতভর কান্না । স্বামী কোন
কথাই মানতে চাইলনা । সীতাকে এখন অগ্নী পরীক্ষাই দিতে হবে । পরদিন রাতে রান্নাঘরে
সীতা তার শরীরে নিজেই আগুন ধরিয়ে দিল ।
সীতার নাম মাহাত্ম্য
সীতাকে লংকার রাজা রাবণ অপহরণ করে
নিয়ে গেলে তাকে উদ্ধার করতে রাম,লক্ষণ,হনুমানসহ বিশাল বাহিনী লংকা আক্রমণ
ও ধ্বংস করে। সীতাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেও পরবর্তীতে রামচন্দ্রের অযোধ্যা রাজ্যের
প্রজারা সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সীতার চরিত্রের পবিত্রতা প্রমাণের জন্য
রাম অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করেন। অগ্নিপরীক্ষার অংশ হিসাবে সীতাকে অগ্নিকুণ্ডে
প্রবেশ করতে হয়। সীতা সতীসাধ্বী হলে আগুন তার কোনো ক্ষতি করবে না,এই ছিলো সবার বিশ্বাস। অগ্নি
পরীক্ষার মাধ্যমে সীতার চরিত্রের পবিত্রতা প্রমাণ হলে রামচন্দ্র সীতাকে ঘরে
ফিরিয়ে নেন। কিন্তু পরবর্তীতে আবারও সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন রাম
সীতাকে আবারও বনবাসে পাঠান। সেখানে বাল্মিকী মুণির আশ্রমে সীতা আশ্রয় পান। এর
কিছুদিন পরেই সীতার দুই পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। লব ও কুশ নামের দুই পুত্র সন্তান
বড় হওবার পরে রাম একবার শিকার করতে বনে গেলে রামের সাথে পুত্রদের দেখা হয়। তখন
আবারও সীতার চরিত্র নিয়ে প্রজাদের নিন্দা শুরু হয়। এতে লজ্জা ও ক্ষোভে সীতা
পাতালে প্রবেশ করেন।
এরপর থেকে কোনও মা-বাবাই তাদের মেয়ের নাম সীতা রাখেন না।