গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩

রাজন নন্দী


বিভ্রান্ত বিবুধ

মি করি। সব মানুষই আদতে বহুগামিতায় বিশ্বাস করে। দেখে শুনে এরকমই মনে হয় আমার। তবে অন্যরা আমার থেকে আলাদা। কারন সাধারনত কেউ এ বিষয়ে স্টেটমেন্ট দিয়ে বেড়ায় না মনের ভাব লুকানোর কৌশল আমার জানা নেই। অনেকেই মনের ভাব লুকিয়ে সুন্দর করে হাসতে জানেন। আমি পারি না। আমার চেহারায় নিশ্চয়ই অসমর্থন ফুটে উঠেছিল। বুঝতে পেরেই কিনা কে জানে, তিনি একটু থামলেন। খানিক পরেই, যেন বোঝাচ্ছেন, তেমনি সহজ ঢঙ্গে শুরু করলেন, ‘আরে, আমাদের সমাজে তো এই ভাবনাটারেই কোন প্রশ্রয় দেয়া হয় না। তাই না? এই ধর আমাগো সংস্কৃতিশিক্ষা। সেইখানেও তো এই ভাবনাটা রীতিমত ব্রাত্য। কিন্তু তারপরেও তো আমরা ভাবি। যখন আমরা নিজের সাথে একলা হই তখন ভাবি। তখন ঐ সংস্কারের শিকল কিছুটা আলগা হয়। মগজের অলিগলিতে রতি বাসনার নানা চোরা স্রোত আমাগো সিক্ত করে। কি মিয়া করে না?’
আমি, হ্যা বা না দুটোই হতে পারে ধরনের হাসি দিলাম। আমার স্টকে নানা ধরনের হাসি আছে। হাসিদের নামও আছে। এই হাসিটার নাম কৈতব হাসি হাফ বোতল স্কচের প্রভাবে জাফর ভাই তখন সপ্তম আসমানে। কৈতব হাসি তাকে বিশেষ বিচলিত করল না। তিনি অবিচল ভাবে বলতে লাগলেন, ‘কৈশরে, মহল্লার এক বন্ধুর মুখে প্রথম শুনছিলাম। তারই নারী সঙ্গের কথা। নিষিদ্ধ পল্লীতে তার অভিযানের গপ্প। আমর গা ঘিনঘিন করছিল। নিছক শরীরের জন্য কোন নারীর কাছে যাওয়াটাকে আমার মনে হইছিল রুচিহীন। আমার কিন্তু এখনও তাই মনে হয়
কথা শেষ হতেই, ষষ্ঠ পেগে শেষ চুমুক দিলেন জাফর ভাই। গ্লাসটাকে পাশের টেবিলে রাখলেন। রকিং চেয়ারটায় ঘাড়টা রেখে চোখ বুজলেন। মৃদু দুলতে লাগলেন। কিছুটা বিরতি। আমি আমার দ্বিতীয় পেগটা ঢাললাম। আমার কি এখন কিছু বলা উচিত? এই যে আমি কখনও একা আবার কখনও দলবল নিয়ে জাফর ভাইয়ের মদ ধংস করতে আসি। অন্তত সেই খাতিরে তো কিছু বলা উচিত। কি বলব? আজকের আলোচনার প্রসঙ্গটা কেন শুরু হল? কোন দিকে যাচ্ছে? আমার শালা কোন ধারনাই নেই। আষাঢ়ের বৃস্টির মত আ কা শুরু হয়ে গেছে। আজ মনে হয় জাফর ভাইকে কথায় পেয়েছে। হঠাৎ , চোখ না খুলেই জাফর ভাই শুরু করলেন, ‘বুঝলা, মেয়েগো গভীর চোখ, নদীর মতন চুল আমারে টানে। নারীর শরীরের গন্ধ আমারে মদির করে। যে কোন প্রেমিকের মতই আমি নারীর রুপের তারিফ করি। কিন্তু সারাটা জীবন আমার প্রেমিকাদের কাছে আমি অন্যরকম কিছু চাইছিবলে, ‘আমার দিকে তাকালেন। যেন যাচাই করছেন। আমি বলতে চাইলাম, কি চেয়েছেন? তিনি আমাকে কোন সুযোগ না দিয়ে, আবার শুরু করলেন, খালি শরীরের জন্য কোন নারীরে কামনা করাটা আমি ঘেন্না করি। চাতক যেমন মেঘের কাছে যায়। দলছুট হরিণ যেমন যায় পাহাড়ি ঝরনার কাছে। নারীর কাছে আমি সেইরকম তৃষ্ণা নিয়াই যাই এই পর্যন্ত বলে, জাফর ভাই বাথরুমে গেলেন।
প্রায় চার বছর হল আমাদের পরিচয়। উনি বয়সে আমার চেয়ে প্রায় এক যুগেরও বড়কিন্তু আমরা প্রায় বন্ধু। প্রায় বলছি, কারন তার প্রবল ব্যাক্তিত্বের কাছে আমি খানিক কোনঠাসা। প্রায় সবসময়ই তিনি বক্তা এবং আমি স্রোতা। তবে মদ খেলে তিনি অনেক সহজ হয়ে উঠেন। এবং অদ্ভূত কারনে তার প্রিয় গালীগালাজ একদম ভুলে যান। তখন ফরাদ মহাজনের মতন চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন। জাফর ভাই আবার মহাজন সাহেবের জীবনাচরনের প্রবল সমর্থক। এই তো সেদিন। শাহবাগে তখন কেবল যুদ্ধাপরাধ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। জাফর ভাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সাথে আমরাও। কদিন বাদেই দেখি জাফর ভাইয়ের কোন খবর নাই। কেন ? কারন ফরাদ মহাজন এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে। অমনি জাফর ভাইও হাত ধুঁয়া ফেললেন। মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছিল তার উপরে। তবে এই শীতের দেশে কয়েকজন মাত্র বাঙ্গালী থাকি সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে সময় লাগে নি ।
স্টকহোমে আজ মাইনাস চার। এমন শীতে সব কিছুই জমে যায়। বাথরুমের দরজা খুলল। আমি তাকিয়ে দেখি, জাফর ভাই বাথরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। সাদা লুঙ্গি আর ফতুয়া। আধপাকা চুল ভর্তি মাথা বললাম, বস্ ঠিক আছেন তো ? তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হাসলে উনার চোখের নীচের চামড়াগুলো খানিক কুচকে একটা বিচিত্র মুখভঙ্গি হয়। আমি তার হাসির নাম দিলাম, ‘ভেংচি হাসিনামটা দিয়েই আমার ভীষন হাসি পেল। একটা নাম গোত্রহীন জেনুইন হাসি। স্কচে ধরছে আমারে!
কি বল মিয়া! ছয় পেগে জাফর আলমের কিছ্ছু হয় না। তুমি তো এখনও দুই পেগ শেষ করতে পারলা না বললাম, বস্ বেশী খাওয়া যাবে না। বউ রাগ করে। পরে সারারাত সোফায় থাকতে হইব। যেন আমার কথা উড়িয়ে দিলেন, সেই ভঙ্গিতে শূন্যে হাত ছুড়লেন জাফর ভাই। তোমরা মিয়া বউরে যে কেন এত ভয় পাও! বিয়েটারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভাব কেন? একটাই তো জীবন। ও তোমাদের তো আবার পূণর্জন্ম আছে। তা পরের জন্মে হাতি ঘোড়া কি না কি হবা। এই জীবনটাই একটু চেখে দেখ না!বলে, সাত নাম্বার পেগ নিলেন। আমি বললাম, ভাই! আজকে আর নাই খাইলেন। তিনি আবার সেই ভেংচি হাসি দিলেন। বললেন, ‘শোন পিয়াল, আমার বিয়ের পরে পরেই, আমার এক পুরানো প্রেমিকার সাথে প্রথম সেক্স হইছিল। সেও তখন বিবাহিত। যেন বিয়ের পরেই আমরা দুজনে টের পাইলাম যে আমরা কি হারাইছি! সেই হারানো আর তারে খুঁজে পাওয়াটাই প্রেম। শরীরটা উপরি। তোমারে যেমন বলতাছি, তেমনি আমার বউকেও সব বলছিলাম কারণ আমি কোন লুকোচুরির মধ্যে থাকতে চাই নাই। দেখ, বিয়েটা কিন্তু টেকে নাই। কিন্তু আমি টিকা আছি। আমার প্রেম টিকা আছে। আচ্ছা যাও তুমিই বল, বিয়েটা আসলে কি ?’
আমার মেজাজে তখন স্কচের মৌতাত। তেতে উঠছি। বললাম, জানিনা বস্। তবে যারে তারে লাগানোর মধ্যে আমি কোন ক্রেডিট দেখি না। আদিম সমাজেও মানুষ তাই করত। সভ্যতা মানুষের জীবন যাপনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত যৌনাচরণেও পরিমিতি বোধ যোগ করছে। বহুগামিতা কোন আধুনিকতা না,  আদিমতা আর পূণর্জন্ম কেন আমি তো বস্ কোন ধর্মেই বিশ্বাস করি না। জাফর ভাইয়ের কোন প্রতিক্রিয়া নাই। কেবল চোখটা আবার বন্ধ করলেন। আস্তে আস্তে সাত নাম্বার পেগটা শেষ করলেন। তোমাদের নিয়া এই একটা সমস্যা। তর্ক করতে শিখলা না। খালি রাইগা যাও। কিছু হইলেই আমি নাস্তিক’, ‘প্রগতিশীলএই বইলা আলগা ভাব নাও। বললাম, বাদ দ্যান। কালকে এগারটায় মানব বন্ধন আছে যাবেন ? জাফর ভাই একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কিসের মানব বন্ধন? শাহবাগটা নাস্তিকদের আড্ডা হইছে একটা। কান্ড জ্ঞানহীন সব পুলাপাইন। অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়া মজা নেয়। সরকারের ব্যাকিংয়ে সব লাফাইতাছে সব শালা ভারতের দালাল।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। মনে মনে বললাম, লে হালুয়া! মুখে বললাম, জাফর ভাই, যাই। আপনার নেশা কাটলে আর একদিন কথা বলা যাবে। জাফর ভাই আবার ভেংচি হাসিদিলেন। সেই উপলক্ষ্য উপেক্ষা করে আমি ততক্ষণে পথে।

অরিন্দম চন্দ্র


আধি-ভৌতিক

য়েকদিন আগে বক্রেশ্বর গিয়েছিলাম,তারাপীঠ থেকে সিউড়ী হয়ে।শ্মশানের ধারে বাসুদেব মিশনে ভোলাবাবা আমাদের সেবা-যত্নে অতন্দ্র প্রহরী।যাইহোক,দুপুরে ওনাদের চাষের মোটা চালের ভাত,উচ্ছে চচ্চড়ী,কচু দিয়ে মুসর ডাল,সজনে ডাঁটা আলু কুমড়োর তরকারী,মোচার ঘন্ট আর টমেটোর চাটনী খেয়ে জব্বর একটা ভাতঘুম দিলাম।বিকালে চা খেয়ে ঘুরতে বেরিয়ে আবিস্কার করলাম যে গোটা টাউনে আমি একা পর্যটক।
ফেরার সময় অন্ধকার পথ দিয়ে শ্মশানের পাশ দিয়ে আসতে বেশ গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।আশ্রমের কাছে পৌঁছবার আগেই লোডশেডিং।সিগারেট ভিতরে মানা,তাই আরেকটু আগিয়ে গেলাম...গোটা এলাকা অন্ধকার,ঝিঁ-ঝিঁ পোকার অবিরাম ডাক,আকাশে আধ-ফালি চাঁদ,পাশে বক্রেশ্বর নদী,ইতিউতি দু-একটা মড়া পোড়ানোর পর নিভুনিভু চুল্লী আর অন্ধকার পটভূমিতে অনেকদূরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আলোকিত চুল্লী,বেশ কবি কবি ভাব এল,প্রেমিকার চাঁদমুখ ভেবে পিছন ঘুরতেই শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত নামল।অন্ধকার এক দাড়িগোঁফের জংগল নিয়ে ক্ষয়াটে একটা চেহারা,পরণে হাঁটু ছাড়ানো সাদা আলখাল্লা,ভাঁটার মত চোখ...বড় বড় দাঁত......
সিগারেটের ধোঁয়ায় কাশতে কাশতে খেয়াল করলাম ভোলাবাবার পোষা ভুটুর তর্জন-গর্জনে পাগলটা দৌড় দিয়েছে...