মহাপ্রস্থান
(শেষ অংশ)
(পূর্ব
প্রকাশিতের পর)
বাতায়নের অফিসে তাঁর নিজের ঘরে ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে একটু বিশ্রাম
নিচ্ছিলেন আশিস সান্যাল। হিমেশ এসে একটা টুল নিয়ে তাঁর পায়ের কাছে বসল। বলল, --
পায়ে ব্যথা হচ্ছে নাকি জেঠু? বলেই দুহাত দিয়ে আস্তে আস্তে তাঁর পা টিপতে শুরু করল।
সান্যালের মুখ দিয়ে আরামের অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল। তিনি চোখ খুলে হিমেশকে
দেখলেন। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে বললেন,-- মতলবখানা কী?
হিমেশ
বলল, -- আছে একখানা। আগে পা দুটো একটু ভালো করে টিপে দিই। ভালো ব্যথা মনে হচ্ছে?
সে তো
আছেই অষ্টপ্রহর! এটাকে সঙ্গে নিয়েই ওপারে যেতে হবে। তোর ব্যাপারটা শুনি।
হিমেশ আর্য বসুর বৃত্তান্ত প্রথম থেকে শেষ অবধি খুঁটিয়ে বর্ণনা
করল। সান্যালের বোঁজা চোখ আস্তে আস্তে খুলে গেল। মেদবহুল গন্ডদেশের আড়াল থেকে তাঁর
ছোট্ট চোখের কুতকুতে চাহনি বিঁধতে থাকল হিমেশকে। কিন্তু কোন মন্তব্য করলেন না
তিনি। হিমেশ বলল, -- কালকের কাগজে এটা লিড নিউজ করুন জেঠু,আমি কপি তৈরি করে এনেছি।
একটু দেখে নিন।
সান্যাল
বললেন, -- কাগজটা কি তুলে দেওয়ার মতলব করেছ?
--
আপনি বিশ্বাস করছেন না ব্যাপারটা?
-- আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু যায়-আসে না। একবার খবরটা প্রকাশিত
হলে আর্য বসুর কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছ? আমাদের এতদিনের পুরানো কাগজ – আমরা যদি ব্যাপারটা ছাপি,যতই অবিশ্বাস্য হোক লোকে হামলে পড়বে তার
উপরে।
সত্যিই তো, এদিকটা ভেবে দেখেনি হিমেশ। সে শুধু সর্বসমক্ষে প্রদর্শন
করার পর আর্য বসুর বিড়ম্বনার কথা ভেবেছিল। তার আগের সময়টুকুও তো তাঁকে জনসমক্ষের
আড়ালে রাখা দরকার। সে বলল, -- কী করা যায় জেঠু?
সান্যাল
বললেন, -- আগে তোমার কপিটা পড়ি। তারপর ভাবছি।
শেষ পর্যন্ত আর্য বসুর নাম-পরিচয় গোপন রাখা হল।
এমন কি,হিমেশ যে এই ঘটনার সুত্রধার সেটা যাতে তার কাগজেরও কেউ জানতে না পারে সেই
ব্যবস্থা করলেন সান্যাল। সংশোধিত কপিটি সেভ করার পর হিমেশের ল্যাপটপ থেকে সেটি
মুছে দেওয়া হল। তার খসড়ার প্রিন্ট আউট-টিও নষ্ট করে দেওয়া হল। সবশেষে হিমেশকে
সাবধান করলেন সান্যাল,সে যেন কোনমতেই তার মোবাইল থেকে বা অফিস কিম্বা বাড়ির টেলিফোন
থেকে কালকের পর আর্য বা অদ্রিকে ফোন না করে। আর্য বসুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে
আজকেই একটা নতুন সিম নিক সে,তার নম্বরটা যেন সে কাউকে না দেয় এবং আর্য বসু ছাড়া
সেই নম্বর থেকে দ্বিতীয় কাউকে ফোন না করে।
হিমেশ বিদায় নেওয়ার সময় সান্যাল বললেন, -- শুধু তোমার মুখ চেয়েই
রিস্কটা নিলুম। যদি শেষরক্ষা হয় – ইট্স গোয়িং টু বি দ্য
নিউজ অব দ্য সেঞ্চুরি!
পরের দিন বাতায়ন-এর বিক্রি সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে
গেল। আগের থেকে অনুমান করে দ্বিগুণ কপি ছাপার ব্যবস্থা করেছিলেন সান্যাল। সমস্ত
কপি নিঃশেষিত বেলা আটটা বাজতে না বাজতেই। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী - দু’ধরনের মানুষের কৌতূহলের চাপে কাগজের অফিসের টেলিফোন নামিয়ে রাখতে
হল। কাগজের কর্মচারীদের মোবাইল তাদের পরিচিত জনেদের জিজ্ঞাসার প্রাবল্যে সুইচ অফ
করতে হল। বাতায়ন-এর প্রতিদ্বন্দ্বী দৈনিকটি পরদিন সম্পাদকীয়তে কোন ম্যাজিসিয়ানের
এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক কাণ্ডকারখানাকে সংবাদ বলে প্রচার করে সংবাদপত্রের মহান
ঐতিহ্যকে কালিমালিপ্ত করেছে বলে বাতায়ন-এর কঠোর সমালোচনা করল। পরিশেষে এই আশা
ব্যক্ত হল যে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকেরা এবং যুক্তিনিষ্ঠ মানুসেরা প্রদর্শনের দিন
বাতায়ন নিযুক্ত জাদুকরের সব জারিজুরি ফাঁস করে দেবেন।
দিন পনের পর আর্য বসু তাঁর অলৌকিকভাবে পাওয়া
ক্ষমতা প্রদর্শন করবেন। আশিস সান্যালের নেতৃত্বে সমস্ত ব্যবস্থার আয়োজন চলতে লাগল।
ইতিমধ্যে বাতায়ন এর সংবাদের সূত্র ধরে দেশবিদেশের বিভিন্ন কাগজে আর্টিক্ল এবং
জনসাধারণের মতামত প্রকাশ পেতে থাকল।
বিবিসি কয়েকজন তরুণ বিজ্ঞানীকে নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে সরাসরি তার
সম্প্রচার করল। আশ্চর্যের ব্যাপার, বিজ্ঞানীদের কেউই ধারণাটিকে সম্পূর্ণ আজগুবি
বলে উড়িয়ে দিলেন না। আর্য বসুর নাম প্রকাশিত না হওয়ায় তাঁরা তাঁকে ‘ভারতীয় যোগী’ বলে উল্লেখ করলেন।
নিউট্রিনো কণার রহস্যময় আচরণের সঙ্গে কোয়ান্টাম থিওরি দিয়েও তাঁরা এর ব্যাখ্যা
পেতে সচেষ্ট হলেন।
আর্য বসু হিমেশকে কয়েকটি
শর্ত দিয়েছেন। প্রথমত,দর্শকসংখ্যা যাই হোক না কেন তাদেরকে সম্পূর্ণ নীরব রাখার
দায়িত্ব নিতে হবে। দ্বিতীয়ত,চড়া আলো চলবে না। মঞ্চে মৃদু,নরম আলো রাখতে হবে। কারুর
সন্দেহ হলে অবশ্য তাঁরা মঞ্চের উপরে তাঁর পাশে বসে সব পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
ক্যামেরা ব্যবহার করতে পারেন সাংবাদিকেরা। কিন্তু শব্দ হয় বা ফ্ল্যাশ-বাল্ব অথবা
চড়া আলো ব্যবহার করতে হয় এমন ক্যামেরা চলবে না।
সেইমতই সব ব্যবস্থা
করলেন আশিস সান্যাল। সমস্ত নিউজ এজেন্সি এবং দেশবিদেশের টিভি চ্যানেলকে আর্য বসুর
শর্ত জানিয়ে আমন্ত্রণ করলেন। বেছে বেছে কিছু বিজ্ঞানী ও গুণী মানুষকেও ডাকা হল।
এছাড়া,আমন্ত্রিতের তালিকায় থাকলেন দেশবিদেশের বিখ্যাত সব সংস্থার প্রতিনিধিরা।
মঞ্চের বাইরে যাতে ভালোমত পুলিশ প্রহরা থাকে সেই ব্যবস্থাও করা হল।
নির্দিষ্ট দিনে
সন্ধে আটটার সময় পুলিশের গাড়ি আর্য বসু ও হিমেশকে নিয়ে বাতায়ন-এর অফিসে পৌঁছাল।
অফিস সংলগ্ন একটি হলে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে দর্শক
সংখ্যা খুব সীমিত রাখতে পারেননি সান্যাল। রাজনীতি জগতের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিকে
আমন্ত্রণ দিতে হয়েছে তাঁকে। সাড়ে ন’টায় শুরু হবে প্রদর্শনী।
রাত দশটায় ধ্যানে বসবেন আর্য বসু। তার আগে কয়েকটি কথা দর্শকদের জানাবেন তিনি।
তারপর হিমেশ তাঁর পরিচয় এবং এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য জানাবে।
ন’টার মধ্যেই আমন্ত্রিতরা সব এসে গেলেন। বাইরে কৌতূহলী বিশাল জনতা।
যথেষ্ট পরিমানে পুলিশবাহিনী হলটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আর্য বসুর শর্তের কারণে টিভি
চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সাংবাদিকেরা গোপন ক্যামেরা
নিয়ে মঞ্চ ঘিরে জায়গা নিয়েছেন। বিজ্ঞানমঞ্চের লোকেরাও পিছিয়ে নেই। অনেকেরই সন্দেহ
ব্যাপারটা বিশুদ্ধ ম্যাজিক বই কিছু নয়। আর্য বসুকে না দেখা পর্যন্ত আশিস সান্যাল
খুব উদ্বেগে ছিলেন। তাঁর বুক কাঁপছিল রীতিমত – আজ যদি তিনি ধ্যানে
নিমগ্ন না হতে পারেন! কিন্তু তাঁকে দেখার পর আশ্বস্ত হলেন তিনি। আর্য বসুর প্রসন্ন
মুখ ও আত্মবিশ্বাসী অবয়ব দেখে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সান্যালের।
ঠিক সাড়ে ন’টার সময় মঞ্চে এলেন আর্য বসু। সঙ্গে কেবল হিমেশ। আর্য বসু
মাইক্রোফোন হাতে তিন মিনিট মাত্র কথা বললেন। বললেন, -- যে ব্যাপারটি আমার জীবনে
ঘটেছে সেটি আমার একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনা বলে মানি। কোনভাবে এটি প্রকাশ পাক আমি
চাইনি। দুঃখের বিষয়,প্রকাশ তো হলই – রীতিমতো নাটকীয়ভাবে এর
প্রচারও করতে হল। এতে নিজের দায় অস্বীকার করি এমন কৃতঘ্ন আমি নই। তবে এর প্রধান
দায়িত্ব আমার পুত্রপ্রতিম হিমেশের। কেন সে এমন সিদ্ধান্ত নিতে আমায় বাধ্য করল সেটা
সে-ই আপনাদের বিশদ বলবে। আমি শুধু আর দুটো কথা আপনাদের বলব। বাতায়নে এর বৈজ্ঞানিক
ব্যাখ্যা যা দেওয়া হয়েছে তার অতিরিক্ত আমার কিছু জানা নেই। সেটি সঠিক কিনা তাও আমি
বলতে পারব না। আমি শুধু আমার ধারণার কথা জানিয়েছি। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস
করি,বিনা প্রমাণে বিশ্বাস করা বিনা প্রমাণে অবিশ্বাস করার চেয়ে কম অবৈজ্ঞানিক।
আপাত-অবিশ্বাস্য কিন্তু সুন্দর সমস্ত ধারণা একদিন না একদিন প্রমাণিত সত্য হবে বলেই
আমি বিশ্বাস করি। কেউ কেউ আমাকে ভারতীয় যোগী ভেবেছেন। তা সঠিক নয়,আমি অতি সাধারণ
এক মানুষ মাত্র। যা ঘটেছে তা একান্তই ‘তাঁর’ ইচ্ছায় ঘটেছে এবং ঘটতে থাকবে। সবশেষে আমি করজোড়ে মিনতি করছি, আপনারা সম্পূর্ণ নীরব
থাকবেন। নইলে ধ্যানে নিমগ্ন হতে অসুবিধে হবে। আমি চাই না এত আয়োজন বৃথা হোক -
বিশ্ববাসীর সামনে যেন আমাদের প্রতারক
প্রতিপন্ন না হতে হয়।
আর্য বসু হিমেশের হাতে মাইক্রোফোন দিয়ে
নিজের আসনে বসে পড়লেন।
হিমেশ শুরু করল আর্য
বসুর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে। তারপর তাঁর লেখা সাতটি গল্প ও একমাত্র উপন্যাসটির
প্রসঙ্গে এল। পরিশেষে সে বলল, -- আজকের এই অলৌকিক প্রদর্শনের উদ্দেশ্য নয় কোনোভাবেই
ক্ষমতার অপব্যবহার করা। তিনি ইচ্ছে করলেই নিজের তরুণ বয়সে ফিরে গিয়ে নতুন করে
জীবনকে উপভোগ করতে পারতেন। আজকের পর তিনি চাইলে তাঁর বিত্ত-বৈভবের অভাব থাকবে না।
অথচ, তিনি কিছুতেই চাননি নিজেকে এইভাবে প্রকাশ করতে। আমি তাঁকে জোর করেছি
কেবলমাত্র তাঁকে বিখ্যাত করে তুলতে যাতে বিশ্ববাসী তাঁর লেখাগুলির প্রতি আকৃষ্ট
হয়। নইলে অনামী এই লেখকের লেখা পাঠকদের অগোচরেই থেকে যাবে চিরদিন। তিনিও মনেপ্রাণে
চান তাঁর হৃদয়-নির্যাস, তাঁর আনন্দ পাঠকদের সাথে ভাগ করে নিতে। এই প্রসঙ্গে
বলি,তিনি আগে থেকেই তাঁর সমস্ত রচনার গ্রন্থস্বত্ত্ব বাতায়ন-কে লিখিত দলিল করে দান
করেছেন এই শর্তে যে সেই পুস্তক বিক্রির লভ্যাংশের পঁচাত্তর ভাগ সরকারি
নিয়ন্ত্রণাধীন এক ট্রাস্টে যাবে,যে ট্রাস্ট বিজ্ঞান-গবেষণা ও সাহিত্য-সাধনায় ব্রতী
তরুণদের অর্থসাহায্য করবে। বাকি পঁচিশ ভাগ অর্থ দিয়ে বাতায়ন একটি সাহিত্য পত্রিকা
প্রকাশ করবে। সারা বিশ্বের সাংবাদিকেরা আজ এখানে উপস্থিত আছেন। তাঁদের কাছে আমার
সবিনয় প্রার্থনা, তাঁরা যেন আজকের পর কোনভাবেই আর্য বসুকে বিরক্ত না করেন। মনে
রাখবেন,খ্যাতি তিনি নিজের কোন স্বার্থে চাননি – খ্যাতির বিড়ম্বনা
কোনভাবেই তাঁর প্রাপ্য নয়। তিনি শুধু চান তাঁর রচনা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক,
বিশ্ববাসী যেন তাঁকে ভুলে গিয়ে তাঁর লেখাগুলি নিয়েই পরিতৃপ্ত থাকেন।
দশটার সময় ধ্যানে
বসলেন আর্য বসু। বহু গোপন ক্যামেরা বিভিন্ন কোণ থেকে তাঁর শরীরকে ছেঁকে ধরল। হিমেশ
আশ্বস্ত হল যে দর্শকরা আর্যবসুর আবেদনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। হলে অখন্ড নীরবতা।
এগারটা বাজার পর থেকে তাঁর শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেতে লাগল। মুখের চামড়া
টানটান হতে শুরু করল,চুলের রঙে বদল দেখা গেল। একটিমাত্র কৌপীন পরে বসেছিলেন তিনি।
ধীরে ধীরে তাঁর হাতের ঈষৎ শিথিল পেশী শক্ত হতে থাকল, শরীরে যেন খানিকটা মেদেরও
সঞ্চার হল। ঠিক বারটার সময় যখন তিনি চোখ খুললেন তখন তাঁর মাথায় পাতলা নুনমরিচ রঙের
চুলের জায়গায় ঝাঁকড়া কালো চুল,কেবল ঝুলপির কাছে সামান্য রূপোলী আভাস। দর্শকরা
মন্ত্রমুগ্ধ! কেউ কেউ নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেলেন। আশিস সান্যাল মঞ্চের সামনেই
ছিলেন,তাঁর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল বিদেশি এক মহিলা সাংবাদিক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
একটা মৃদু গুঞ্জনের ঢেউ বয়ে গেল সারা হলে। আর্য বসু দু’হাত তুলে দর্শকদের সংযত হবার ইশারা করেই আবার চোখ বুজলেন। সান্যাল
ভাবলেন, ঈশ্বর কি এমনি করেই মাঝে মাঝে তাঁর অস্তিত্বের জানান দেন!
রাত্রি একটা থেকে
আবার পরিবর্তন শুরু হল আর্য বসুর শরীরে। রাত দুটোয় চোখ খুললেন তিনি। সামান্য যা
মেদের সঞ্চার হয়েছিল তা ঝরে গিয়ে শরীর এখন ছিপছিপে। চুল আরও ঝাঁকড়া হয়ে নেমে এসেছে
কপালে। গালে পাতলা দাড়ি,চোখের খানিক নীচে দু-একটা ব্রণও দেখা যাচ্ছে। আর্য বসু এখন
বিশ বছরের তরতাজা তরুণ। এরপর যা করলেন তিনি,হিমেশও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। উঠে
দাঁড়িয়ে হাতের উপর ভর দিয়ে শুরু করে পরপর কয়েকটা আরচিং করে নিলেন অত্যন্ত
সাবলীলভাবে। তারপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বললেন, -- ঈশ্বর আমাকে মাফ
করুন,ক্ষণিকের জন্য মতিভ্রংশ হয়েছিল,সেই বয়সের স্মৃতিতে আক্রান্ত হয়ে সেভাবেই নিজের শরীরকে চালনা করে ফেললাম। ভুলে গিয়েছিলাম
এই শরীরের প্রকৃত অধিকারী আর আমি নই।
হিমেশ মঞ্চের একপাশ থেকে দর্শকদের দিকে
তাকিয়ে দেখল,অনেকেই রুমাল বের করে নিঃশব্দে চোখের জল মুছছেন। তারও কান্না পেতে
থাকল।
সকাল সাড়ে ছ’টায় হিমেশ যখন কোনক্রমে সাংবাদিকদের নাগাল এড়িয়ে আর্য বসুকে নিয়ে
পুলিশের গাড়িতে তাঁর বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে পারল তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য
সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই তাদের ছেড়ে আসা রাস্তার উপর পড়ে কাঁদতে কাঁদতে গড়াগড়ি
দিচ্ছে।
আর্য বসুর বাড়িতে
পুলিশ-পাহারার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু পরের দিন তাঁর আর খোঁজ পাওয়া গেল না। অদ্রি
একটু বেলা করে ওঠে। সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠে বাবার ঘরে এসে দেখে দরজা খোলা।
বিছানা নিভাঁজ। বাবা হয়ত ধ্যানে বসেই কাটিয়েছে সারা রাত। কিন্তু এত সকালে বেরোল
কোথায়? এখন তো তাঁর আর অফিস নেই। বাইরে বেরোতে গিয়ে দেখে সদর দরজা ভেতর থেকেই
বন্ধ। ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখল গেটও তালাবন্ধ। সেখানে যথারীতি তিনজন পুলিশ
বন্দুক নিয়ে বসে। তাজ্জব বনে সে হিমেশকে ফোন করল।
বছরখানেক কেটে গেছে।
বন্ধ ঘর থেকে আর্য বসুর উধাও হয়ে যাওয়া রহস্যের কোন কিনারা হয়নি। রাজ্যের গোয়েন্দা
পুলিশের হাত থেকে সিবিআই তদন্তের ভার নিয়েও এখন পর্যন্ত সেই রহস্যের কোন সূত্র বের
করতে পারেনি। তবে আর্য বসুর কোন সন্ধান না পাওয়া গেলেও তাঁর রচনাবলি ইতিমধ্যেই
বাংলা জয় করে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি তা দেশকে
অতিক্রম করে পৃথিবী জয় করতে বেরোবার উদ্যোগ নিচ্ছে। হিমেশ বাতায়ন-এর সাংবাদিকতা
ছেড়ে তার প্রকাশনা বিভাগের ভার নিয়েছে।সে এখন হিমশিম খাচ্ছে অসংখ্য আবেদনকারীর
মধ্যে রুশ,জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষার অনুবাদক বাছাই করতে। সে এত ব্যস্ত যে তার বাবার
অকাল মৃত্যুর শোকও সে ভুলতে বসেছে। আর্য বসুর অন্তর্ধান রহস্যের বোঝা একা নিজের
বুকে বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে সে মাস তিনেক আগে একদিন তার মায়ের কাছে সেই নিগূঢ়
তথ্যটি প্রকাশ করে ফেলেছিল যা বিশ্বের কোন গোয়েন্দা দপ্তরই কোনদিন জানতে পারবে না।
সেই রাতে আর্য বসু তাঁর অজ্ঞাত শারীরি বিক্রিয়ায় নিউট্রিনো কণাকে আটকে কুড়ি থেকে চল্লিশের
দিকে না ফিরে সোজা শূন্যের দিকে চলে গেছেন। মাকে তথ্যটি জানিয়ে দেওয়ার পরই হিমেশ
নিশ্চিতভাবে জেনে গেল মায়ের কাছে তা প্রকাশ করার সিদ্ধান্তটি ছিল একান্তভাবে ‘তাঁরই’ নির্দেশ। কেননা দেখা গেল, বাবার মৃত্যুর পর
থেকে মায়ের অবয়ব ও আচরণে নিরাসক্তির যে প্রলেপ পড়েছিল,সেদিনের পর থেকে তা ফিকে হতে
হতে অন্তর্হিত হয়ে গেল। তাঁর মুখে ফিরে এল আগেকার লাবণ্য। ধীরে ধীরে বইতে লাগল সেই
সুবাতাস যা তার বাবার জীবিতকালে বইত। তার মা এখন নিয়মিত ধ্যানে বসছেন। ধ্যানের
মধ্যে প্রায়ই নাকি তিনি বাবার গলার আওয়াজ পান,এমনকি মাঝে মাঝে তাঁর হাতের স্পর্শও
পান।
* *
* * *