গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

দেবাশীষ মজুমদার




এই খেলাটা ভালোই রপ্ত করেছে বক্কর। এসব শুরু হলেই সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়, প্রথম দিকে কিছুটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়, কত আর পাঁচ বড়জোড় দশ মিনিট, এরপর আর কোন সমস্যা হয়না। বাবা মা এর দেয়া পুরো নাম ছিল মোঃ আবু বক্কর। একটা চোখ নাই তাই কানা বক্কর ডাকে লোকে। নতুন লোকের সাথে পরিচয় হলে বক্করও মাঝে মাঝে নিজেকে কানা বক্কর নামে পরিচয় দেয়। এতে মাঝে মাঝে বেশ একটা ভাব আসে। অনেকে সমীহ করে কথা বলে।
কানা বক্করের গড়নটা খুব সাদামাটা, উচ্চতা ৫ ফুট, গায়ের রং শ্যামলা, মাথায় অল্পকিছু কাঁচাপাকা চুল এখনো অবশিষ্ট থেকে জানান দিচ্ছে এই মাথা ভর্তি একসময় চুল ছিল। তার উপরের পাটির সামনের দিকের দুটো দাঁত আধভাঙ্গা। এই নিয়ে তার দুঃখের সীমা নাই। দাঁত ঠিকমতো থাকবেনা এইটা একটা কথা! দাঁত না থাকলে মানুষের দাম থাকে নাকি, হাসলে কি বেআক্কেলের মতো দেখায়তার দাঁত অবশ্য ছিল, দুই বছর আগে একটা ঘটনা ঘটলো। সেইবার উত্তর পাড়ায় অপারেশনটা করতে গিয়েই দাঁতটা হারাতে হলো।
বক্কর এসবে খুব এক্সপার্ট, আজকাল তার ভুল হয়না বললেই চলে, এখনতো আবার ট্রেনিংও দেয়। তার অনেক সাগরেদ আছে। সেই ঘটনার পর থেকে বক্কর অপারেশনে মেয়েদের মুখের দিকে তাকায় না। আগেও তেমন তাকাতোনা, কিন্তু সেদিন যে কি হল! মেয়েটার মুখ অবিকল কুসুমের মতো। কুসুমও ওইভাবে মাথার উপর ডান হাত ভাঁজ করে রেখে ঘুমাতো। এরপর কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল বক্কর, কয়দিন আগেই লঞ্চঘাটে দেখা কুসুমের মুখটা মনে ভেসে উঠছিল বারবার। এই কাজ অনেকবার ছেড়ে দিতে বলেছিল কুসুম। পারেনি বক্কর। বাচ্চাটা মারা যাবার পরে তাই লেইস ফিতাওলা ইদ্রিসের সঙ্গে চলে গেল। এইসব ভাবতে গিয়েই কেমন যেন মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। হাতে লেগে একটা কাঁচের কি যেন পরে চুরমার। থাক এই গল্প আরেকদিন হবে। তবে দাঁত বক্করের খুব প্রিয় জিনিস। সে প্রতিদিন দুইবার নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজে। আর এই প্রতিদিনই ওই ভাঙ্গা দাঁতদুটো তার বুকে জ্বালা ধরায়। আর তখনই ওই দাঁতের ফাঁক দিয়ে কুৎসিতভাবে থুতু ছিটায়। বক্করের ডান পাটা একটু বাঁকা, সেইটাও আরেক অপারেশনের ঘটনা। ওইসব নিয়ে সে আর অতো ভাবেনা, হাত-পা ভাঙ্গা তার কাছে এখন ডাল-ভাত। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বন্ধ চোখটা একটু খুললো সে। আজকের পরিস্থিতি ভাল ঠেকছেনা তার। অন্যদিন এতক্ষনে সবকিছু ঠান্ডা হয়ে আসে। মানুষের উৎসাহে কিছুটা ভাটা পরে। অথচ আজ তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেল, তারপরও চারিদিকে বেশ ভিড়। ঘটনা কী? বক্করের দুই হাত পিছন দিকে বাঁধা, গায়ের লুঙ্গিও প্রায় খুলে গেছে। ধরা পরবার পর পরই মার শুরু হল। কিল, ঘুষি, লাথি, চর-থাপ্পর; যে যেটা মেরে খুশি হয়। বক্করের এসবে খুব একটা আপত্তি নেই। আহা মারুক না মানুষগুলো,কতো কিছুর রাগইনা তার উপর ঝাড়ে। কতো কষ্ট মানুষের, তাকে মেরে যদি একটু আনন্দ পায় ক্ষতি কি! প্রথম পাঁচমিনিট ব্যথা লাগে বক্করের, তারপর সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়, তখন আর ব্যথা মালুম হয়না। চোখ বন্ধ করলেই শুরু হয় ঝি ঝি পোকার ডাক, ওই ঘোরের মধ্যেই বক্কর দেখতে পায় কুসুমকে, তার কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। হাতপাখা দিয়ে তাদের বাতাস করছে বক্কর। এই ঘোরে একবার ঢুকে গেলে আর কোনো ব্যথা লাগেনা। কিন্তু আজ নিশ্চয় কোনো গোলমাল আছে। এতোক্ষনেতো সবকিছু মোটামুটি ঠান্ডা হবার কথা। বক্কর আস্তে আস্তে একটু ঘাড়টা ঘুরাবার চেষ্টা করল। আর তখনি চোখে পড়ল দৃশ্যটা, লোহা গরম করা হচ্ছে। এইবার ভয় পেল সে। এরা আজ বোধহয় তার বাকী চোখটাও তুলে নেবে। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কেন, হে আল্লাহ তোমার আশরাফুল মাখলুকাত, তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এতো নিষ্ঠুর কেন? হঠাৎ বক্করের মনে হল সে আর কুসুমকে দেখতে পাবেনা। অনেকদিন পর কান্না আসলো তার, ভালো চোখটা দিয়ে গড়িয়ে এলো জল।
ঝাপসা চোখে দেখতে পেল চারিদিকে ভিড় আরো বাড়ছে। কেউ এই চোখ তুলে ফেলার মত বিরল দৃশ্যটা হেলায় হারাতে চায়না।