গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

শর্মিষ্ঠা ঘোষ

৪০তম সংখ্যা ২রা ডিসেম্বর ২০১৩ ।পাচটি গল্প লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ,রত্নদীপা দে ঘোষ,  দেবাশীষ মিজুমদার , সূর্য ভট্টাচার্য ও মৌ মধুবন্তী



তিতি 

ভোর পাঁচটায় অ্যালার্মটা কর্কশ শব্দে বেজে উঠতেই তিতি ধড়ফড় করে উঠে বসলো । তারপর দ্রুত অফ করে দিলো সেটা । আজ উঠতে ইচ্ছে করছে না । অফিস লেট করলে বস ধ্যাতানি দেবে । তারচেয়ে আজ যাবেই না । ক্যাসুয়াল লিভ পাওনা আছে গোটা তিনেক । কেউ কিছু বলবার নেই । তিতির কেউ নেই । কিছু নেই । থুরি , আছে , একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কের চাকরি আছে , একটা ছোট্ট বাড়ি আছে কাঠা চারেক জায়গার ওপর । বাড়িটা বাবার দান । চাকরিটা দস্তুর মত খেটে যোগাড় করা । তিতির নিজেকে মাঝে মাঝে ছায়া বলে ভ্রম হয় । ঘর , দেয়াল , দেরাজের মধ্যে বিচরণ করা একটা নেই মানুষী ছায়া । মাঝে মাঝে লোকজন নাম ধরে ডাকলে উত্তর নিতে দেরী হয় ; কে তিতি , কোথাকার তিতি , কেন তিতি এসব বুঝে উঠতে খানিক সময় লাগে । তিতি কি পাগল ? কি বলে পাবলিক ওর সম্পর্কে , জানার আগ্রহটাও হারিয়ে ফেলেছে । বর্তমানে বিশ্বাস করে তিতি । ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার অভ্যাস ওর নেই । আর অতীত ? সেটা ঘাঁটার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই তিতির । অনীহা , তীব্র বিতৃষ্ণা ছাড়া কোন অনুভূতি আসতে চায় না । 

তিতির মা খুব কম বয়সেই মারা যান । বাবা বিয়ে করেন আবার বছর না ঘুরতেই । তিতি আর ভাই সেই থেকে হস্টেলে মানুষ । এম টেক করে ভাই বিদেশে গেছিল রিসার্চ করতে । ফেরেনি আর । ফিরে আসবার মত কোন শেকড় বাকড়ও ছিল না অবশ্য । তিতি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরই বাবা বিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছিলেন । তিতি ভালো থাকলো কি না তাতে তার মাথাব্যথা ছিল না । টেকেনি তিতির বিয়েটা । বর ছিল বিসনেসম্যান । দুহাতে পয়সা ওড়াতে পারতো , আর জালা জালা মদ গিলতে পারত লোকটা । এহবাহ্য । ছিল মেয়ে মানুষের নেশাও । প্রায় দিন রাতেই বাড়ি ফিরত না । বান্ধবীদের বাড়ি থেকে যদিও বা ফিরত কোন কোনদিন, বেদম পেটাত তিতিকে । মেতে উঠত স্যাডিস্টিক প্লেজারে । সহ্য করছিল তিতি দাঁতে দাঁত চেপে । কি ভাবে যেন এরই মধ্যে তিতি কনসিভ করে ছিল । মাতাল বর যেদিন পেটে লাথি মেরে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলল তিতি সেই দিনই মনস্থির করে ফেলল । কদিন হাসপাতালে থাকার পর যখন রিলিজ করল , ও একবস্ত্রে আশ্রয় চাইল বিম্বিতের কাছে । তিতির ছোটবেলার বন্ধু । হয়ত ওর জন্য একটু আধটু টানও অনুভব করে থাকবে বয়ঃসন্ধিকালে ।কিন্তু ব্যাপারটা বন্ধুত্বের সীমা ছাড়ায় নি কখনো । তিনকুলে কেউ না থাকা বিম্বিতের কাছে আশ্রয় পাওয়াটা সহজ হয়েছিল । সেখানে মাস ছয়েক ছিল তিতি । সেখানে থাকতে থাকতেই ব্যাঙ্কের চাকরিটা জুটিয়েছিল । এক কালে কম্প্যুটারের কোর্স করেছিল একটা সখ করে । শেষমেশ সেটাই কাজে দিল । চাকরি পাওয়া মাত্র আর বিম্বিতের গলগ্রহ হতে চায় নি তিতি । একটা লেডিস হস্টেলে প্রথমে ওঠে , তারপর লোন নিয়ে জমি কিনে বাড়ি । বিম্বিত একটা প্রস্তাব দিয়েছিল । বলেছিল , ‘ না গেলে যদি হয় , নাই বা গেলি। রাজি হয় নি তিতি । কি নাম হবে আমাদের সম্পর্কের?’

ও বলেছিল । চল রেজিস্ট্রি করে আসি। না , সে হয় না । বিপদের দিনে বন্ধুর কাজ করেছিস , কিন্তু করুণা করিস না আমাকে , তুই যদি বছর দশেক আগে এ কথা বলতি আমায় , আমি ভাবতাম । কিন্তু আজ একথা আমার পক্ষে সম্মানজনক নয় । আশাকরি আমি তোকে বোঝাতে পেরেছি। বিম্বিত এর উত্তর দিতে পারেনি । তার পরেও ও পাশে থেকেছে তিতির । তিতি ওর । শর্ত ব্যতিরেকে । সেই বর নামক বর্বর লোকটা তিতির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারীটার অভিযোগ এনেছিল । তিতি বিনা খোরপোষে ডিভোর্সে রাজী হয়ে গিয়েছিল । বন্ধুরা , সহকর্মীরা তিতিকে আড়ালে বোকা বলেছিল । তিতি নির্বিকার । অফিসে তিতির পাশের টেবিলে বসেন বোসদা । প্রথম প্রথম গায়ে পরে এটা সেটা জানার চেষ্টা করেছিলেন । তিতির শীতল ব্যবহারে খুব দুঃখ পেয়ে নতুন জয়েন করা ললনার দিকে ঝুঁকে গেলেন । তিতি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল । এর পর একদিন বোসগিন্নী ফোন করে তিতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছিলেন । বোস গিন্নীর সাথে ইদানীং ফোনে মাঝে মাঝে খেজুর করে তিতি । জানতে চায় কেউ কেউ , তিতি ফের কবে বিয়ে করছে ? অনেকে আলাপের পর জানিয়েছে , তারা কত উদার মনস্ক , বিধবা বা ডিভোর্সি বিয়ে করতে তাদের কোন আপত্তি নেই , বিশেষ করে তিতি যখন চাকুরিরতা । মনে মনে হেসেছে তিতি । পয়সাই যদি মোক্ষ হয় , তবে বউএর কি দরকার ? সুদের কারবার করলেই তো পারে লোকগুলো । তিতির আজকাল শরীরও জাগে না । তিতি কি পারভার্ট ? সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে । লোকে বলে তিতি বাতিক গ্রস্ত । তবে বসের সাথে তিতির সম্পর্ক অম্লমধুর । তিতি বেশ কাজের মেয়ে বলে , বস ওকে একটু প্রেফারই করেন । তাতে পাঁচজনে পাঁচকথা বললেও তিতি গায়ে মাখে না । বসকে ওর বেশ লাগে । চল্লিশোর্ধ পুরুষ । গাঁক গাঁক করে কথা বলেন , গাল পাড়েন , ধোঁয়া ছাড়েন আবার কাজ আদায় করেও ছাড়েন দিব্যি । লোকটার নাকি বউভাগ্য ভালো না । ওর আন্ডারে কাজ করা এক অল্পবয়েসি ছোকরার সাথে আশনাই করে ভেগেছে । এইজন্যই কি তিতি লোকটার ব্যাপারে একটু নরম ? তিতি ভেবে দেখেছে এবং ভেবে পায় নি ।
এক রোববারের দুপুরে দুটি মাছভাত সাঁটিয়ে তিতি দিবানিদ্রার আয়োজন করছে , বেরসিক ফোনটা বেজে উঠলো । স্ক্রিনে নাম টা দেখে তিতি প্রায় আঁতকে উঠলো । হয়ে গেল ঘুম । মিনিমাম একঘণ্টা ।

নন্দিনী বন্ধুমহলে ঘোটকী নামে পরিচিত । সেই কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রায় গোটা বিশেক বিয়ের ঘটকালি করেছে ও । ঘোটকী বিদায়ের শাড়িগুলো বেশ গর্বের সাথে আবার বন্ধুদের দেখাত এসে । সেই নন্দিনী বেছে বেছে রবিবারে ফোন করেছে মানে এখন শুনতে হবে কোন দূরসম্পর্কের পিসিশাশুড়ির বোনপো কত রূপবান , গুণবান , উদারমনস্ক , ওর সাথে কি দারুণ রাজ যোটক হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ... । তিতি এসবে লিস্ট ইন্টারেস্টেড জানা সত্বেও ওর কিছু যায় আসে না । একাই বকে যাবে । নন্দিনীকে থামানো অসম্ভব বুঝে ও আরাম করে শুয়ে , হাতে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগল । ফোন টা রইল কানের থেকে যথাসম্ভব দূরে । ও ঘুমথেকে উঠেও শুনতে পারবে উপসংহার টা । ঘুম ভাঙল ব্যাপক শব্দে। দরজা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম । খুলতেই তিরবেগে নন্দিনী এসে ঢুকল । দিনের আলো মরে এসেছে । লাইট জ্বেলে দেখে পাঁচটা ছুঁয়েছে ঘড়ির কাঁটা । শীতের আমেজ লেগেছে বাতাসে । ঘুম থেকে উঠে গা টা একটু শিরশির করে উঠলো । নন্দিনী ঢুকেই হই হই করে উঠলো – ‘ কি ব্যাপার তোর ? আমি কথা বলেই যাচ্ছি , তোর কোন উত্তর নেই ? ফোন ধরে আছিস , এদিকে সাড়াশব্দ নেই , শরীর  খারাপ হল কি না , আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম । এই দ্যাখ , বাড়ির কাপড়ে চলে এসেছি । আর তুই কিনা নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছিলি ? দে , ব্যাটা , আমার ট্যাক্সি ফেয়ার টা দে , আমি বিদেয় হই । তোর সাথে আর কোন সম্পর্ক নেই। তিতি ওকে হাত ধরে টেনে থামাল । বলল , ‘ দাঁড়া , আগে মাথা ঠাণ্ডা করে বস , কফি টফি খা , তারপর এসব কথা হবে । তার আগে তোর সরদারজিকে বিদায় করে আসি , ব্যাটা ড্যাবড্যাবিয়ে রগড় দেখছে দ্যাখো। সেদিন অনেক কষ্টে ভুজুং ভাজুং দিয়ে নন্দিনীকে ম্যানেজ করতে হয়েছিল । খারাপও লেগেছিল নন্দিনীর জন্য । হয়ত ও সত্যিই তিতির ভালোর জন্যই করছে এসব । কিন্তু তিতির যে আর মন থেকে আসে না এসব । তিতি কি সিনিক হয়ে যাচ্ছে ? নাহ , আর এসব দায় নিতে ইচ্ছে করে না । এই বেশ আছে । একা একা । নাকি আসলে বন্ধন মুক্তিতেই বিশ্বের সাথে যোগ টা বেশি দৃঢ় হয় লোকে খুব চিন্তায় পড়ে গেছে , কি হবে তিতির শেষ বয়সে ? কে দেখবে ওকে ? তিতি ভেবে রেখেছে । বাড়িতেই একটা বৃদ্ধাশ্রম খুলবে । রিটায়ারমেন্টের পর কিছুদিন চষে বেড়াবে ভারতবর্ষ । তারপর বাকি পুঁজি ঢালবে ওর স্বপ্নের প্রজেক্টে । তিতি নন্দিনীকেও নেমন্তন্ন করে রেখেছে । তা শুনে ও বলেছে , ‘ দূর হ মুখপুড়ি ! আমার ভরা সংসার ফেলে আমি তোর মত হিজড়ের সাথে থাকতে যাব কোন দুঃখে’? আর বসকে বলায় তিনি বলেছেন, ‘ এক্সেলেনট ! শেষ বয়সে আপনার সাহচর্যে , আপনার আশ্রমে ... ,’ বলেই একটু যেন লজ্জা পেয়ে থেমে গেছেন । 

তিতি হেসেছে , বলেছে, ‘ ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার’! তিতি ভেবে রেখেছে , সুযোগমত বোসদাকেও নেমন্তন্ন করবে । কে জানে বয়েস বাড়লে ভদ্রলোকের ছোঁকছোঁক স্বভাব বাড়বে না কমবে ! ফোন করতে হবে একদিন বোসগিন্নীকে । খোঁজ নিতে হবে , ইদানিং কেমন চলছে মতিগতি !