৪০তম সংখ্যা ২রা ডিসেম্বর ২০১৩ ।পাচটি গল্প লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ,রত্নদীপা দে ঘোষ, দেবাশীষ মিজুমদার , সূর্য ভট্টাচার্য ও মৌ মধুবন্তী
তিতি
তিতি
ভোর পাঁচটায় অ্যালার্মটা কর্কশ শব্দে বেজে
উঠতেই তিতি ধড়ফড় করে উঠে বসলো । তারপর দ্রুত অফ করে দিলো সেটা । আজ উঠতে ইচ্ছে
করছে না । অফিস লেট করলে বস ধ্যাতানি দেবে । তারচেয়ে আজ যাবেই না । ক্যাসুয়াল লিভ
পাওনা আছে গোটা তিনেক । কেউ কিছু বলবার নেই । তিতির কেউ নেই । কিছু নেই । থুরি ,
আছে , একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কের চাকরি আছে ,
একটা ছোট্ট বাড়ি আছে
কাঠা চারেক জায়গার ওপর । বাড়িটা বাবার দান । চাকরিটা দস্তুর মত খেটে যোগাড় করা ।
তিতির নিজেকে মাঝে মাঝে ছায়া বলে ভ্রম হয় । ঘর , দেয়াল , দেরাজের মধ্যে বিচরণ করা একটা নেই মানুষী
ছায়া । মাঝে মাঝে লোকজন নাম ধরে ডাকলে উত্তর নিতে দেরী হয় ; কে তিতি , কোথাকার তিতি , কেন তিতি – এসব বুঝে উঠতে খানিক সময় লাগে । তিতি কি
পাগল ? কি বলে পাবলিক ওর
সম্পর্কে , জানার
আগ্রহটাও হারিয়ে ফেলেছে । বর্তমানে বিশ্বাস করে তিতি । ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা
করার অভ্যাস ওর নেই । আর অতীত ? সেটা ঘাঁটার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই তিতির । অনীহা , তীব্র বিতৃষ্ণা ছাড়া কোন অনুভূতি আসতে চায়
না ।
তিতির মা খুব কম বয়সেই মারা যান । বাবা
বিয়ে করেন আবার বছর না ঘুরতেই । তিতি আর ভাই সেই থেকে হস্টেলে মানুষ । এম টেক করে
ভাই বিদেশে গেছিল রিসার্চ করতে । ফেরেনি আর । ফিরে আসবার মত কোন শেকড় বাকড়ও ছিল না
অবশ্য । তিতি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরই বাবা বিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছিলেন ।
তিতি ভালো থাকলো কি না তাতে তার মাথাব্যথা ছিল না । টেকেনি তিতির বিয়েটা । বর ছিল
বিসনেসম্যান । দুহাতে পয়সা ওড়াতে পারতো , আর জালা জালা মদ গিলতে পারত লোকটা । এহবাহ্য ।
ছিল মেয়ে মানুষের নেশাও । প্রায় দিন রাতেই বাড়ি ফিরত না । বান্ধবীদের বাড়ি থেকে
যদিও বা ফিরত কোন কোনদিন, বেদম পেটাত তিতিকে । মেতে উঠত স্যাডিস্টিক প্লেজারে । সহ্য করছিল তিতি
দাঁতে দাঁত চেপে । কি ভাবে যেন এরই মধ্যে তিতি কনসিভ করে ছিল ।
মাতাল বর যেদিন পেটে লাথি মেরে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলল তিতি সেই দিনই মনস্থির করে
ফেলল । ক’ দিন হাসপাতালে থাকার
পর যখন রিলিজ করল , ও
একবস্ত্রে আশ্রয় চাইল বিম্বিতের কাছে । তিতির ছোটবেলার বন্ধু । হয়ত ওর জন্য একটু
আধটু টানও অনুভব করে থাকবে বয়ঃসন্ধিকালে ।কিন্তু ব্যাপারটা বন্ধুত্বের সীমা ছাড়ায়
নি কখনো । তিনকুলে কেউ না থাকা বিম্বিতের কাছে আশ্রয় পাওয়াটা সহজ হয়েছিল । সেখানে
মাস ছয়েক ছিল তিতি । সেখানে থাকতে থাকতেই ব্যাঙ্কের চাকরিটা জুটিয়েছিল । এক কালে
কম্প্যুটারের কোর্স করেছিল একটা সখ করে । শেষমেশ সেটাই কাজে দিল । চাকরি পাওয়া
মাত্র আর বিম্বিতের গলগ্রহ হতে চায় নি তিতি । একটা লেডিস হস্টেলে প্রথমে ওঠে ,
তারপর লোন নিয়ে জমি
কিনে বাড়ি । বিম্বিত একটা প্রস্তাব দিয়েছিল । বলেছিল , ‘ না গেলে যদি হয় , নাই বা গেলি’। রাজি হয় নি তিতি । ‘ কি নাম হবে আমাদের সম্পর্কের?’
ও বলেছিল । ‘ চল রেজিস্ট্রি করে আসি’। না , সে হয় না । বিপদের দিনে বন্ধুর কাজ করেছিস
, কিন্তু করুণা করিস
না আমাকে , তুই যদি
বছর দশেক আগে এ কথা বলতি আমায় , আমি ভাবতাম । কিন্তু আজ একথা আমার পক্ষে সম্মানজনক নয় । আশাকরি আমি
তোকে বোঝাতে পেরেছি’।
বিম্বিত এর উত্তর দিতে পারেনি । তার পরেও ও পাশে থেকেছে তিতির । তিতি ওর । শর্ত
ব্যতিরেকে । সেই বর নামক বর্বর লোকটা তিতির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারীটার অভিযোগ
এনেছিল । তিতি বিনা খোরপোষে ডিভোর্সে রাজী হয়ে গিয়েছিল । বন্ধুরা , সহকর্মীরা তিতিকে আড়ালে বোকা বলেছিল ।
তিতি নির্বিকার । অফিসে তিতির পাশের টেবিলে বসেন বোসদা । প্রথম প্রথম গায়ে পরে এটা
সেটা জানার চেষ্টা করেছিলেন । তিতির শীতল ব্যবহারে খুব দুঃখ পেয়ে নতুন জয়েন করা
ললনার দিকে ঝুঁকে গেলেন । তিতি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল । এর পর একদিন বোসগিন্নী ফোন
করে তিতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছিলেন । বোস গিন্নীর সাথে ইদানীং ফোনে মাঝে মাঝে খেজুর
করে তিতি । জানতে চায় কেউ কেউ , তিতি ফের কবে বিয়ে করছে ? অনেকে আলাপের পর জানিয়েছে , তারা কত উদার মনস্ক , বিধবা বা ডিভোর্সি বিয়ে করতে তাদের কোন
আপত্তি নেই , বিশেষ
করে তিতি যখন চাকুরিরতা । মনে মনে হেসেছে তিতি । পয়সাই যদি মোক্ষ হয় , তবে বউএর কি দরকার ? সুদের কারবার করলেই তো পারে লোকগুলো ।
তিতির আজকাল শরীরও জাগে না । তিতি কি পারভার্ট ? সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে । লোকে বলে তিতি
বাতিক গ্রস্ত । তবে বসের সাথে তিতির সম্পর্ক অম্লমধুর । তিতি বেশ কাজের মেয়ে বলে ,
বস ওকে একটু
প্রেফারই করেন । তাতে পাঁচজনে পাঁচকথা বললেও তিতি গায়ে মাখে না । বসকে ওর বেশ লাগে
। চল্লিশোর্ধ পুরুষ । গাঁক গাঁক করে কথা বলেন , গাল পাড়েন , ধোঁয়া ছাড়েন – আবার কাজ আদায় করেও ছাড়েন দিব্যি । লোকটার
নাকি বউভাগ্য ভালো না । ওর আন্ডারে কাজ করা এক অল্পবয়েসি ছোকরার সাথে আশনাই করে
ভেগেছে । এইজন্যই কি তিতি লোকটার ব্যাপারে একটু নরম ? তিতি ভেবে দেখেছে এবং ভেবে পায় নি ।
এক রোববারের দুপুরে দুটি মাছভাত সাঁটিয়ে তিতি দিবানিদ্রার আয়োজন করছে , বেরসিক ফোনটা বেজে উঠলো । স্ক্রিনে নাম টা দেখে তিতি প্রায় আঁতকে উঠলো । হয়ে গেল ঘুম । মিনিমাম একঘণ্টা ।
এক রোববারের দুপুরে দুটি মাছভাত সাঁটিয়ে তিতি দিবানিদ্রার আয়োজন করছে , বেরসিক ফোনটা বেজে উঠলো । স্ক্রিনে নাম টা দেখে তিতি প্রায় আঁতকে উঠলো । হয়ে গেল ঘুম । মিনিমাম একঘণ্টা ।
নন্দিনী বন্ধুমহলে ঘোটকী নামে পরিচিত ।
সেই কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রায় গোটা বিশেক বিয়ের ঘটকালি করেছে ও ।
ঘোটকী বিদায়ের শাড়িগুলো বেশ গর্বের সাথে আবার বন্ধুদের দেখাত এসে । সেই নন্দিনী
বেছে বেছে রবিবারে ফোন করেছে মানে এখন শুনতে হবে কোন দূরসম্পর্কের পিসিশাশুড়ির
বোনপো কত রূপবান , গুণবান ,
উদারমনস্ক , ওর সাথে কি দারুণ রাজ যোটক হবে ইত্যাদি
ইত্যাদি ... । তিতি এসবে লিস্ট ইন্টারেস্টেড জানা সত্বেও ওর কিছু যায় আসে না ।
একাই বকে যাবে । নন্দিনীকে থামানো অসম্ভব বুঝে ও আরাম করে শুয়ে , হাতে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পাতা উল্টাতে
লাগল । ফোন টা রইল কানের থেকে যথাসম্ভব দূরে । ও ঘুমথেকে উঠেও শুনতে পারবে উপসংহার
টা । ঘুম ভাঙল ব্যাপক শব্দে। দরজা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম । খুলতেই তিরবেগে
নন্দিনী এসে ঢুকল । দিনের আলো মরে এসেছে । লাইট জ্বেলে দেখে পাঁচটা ছুঁয়েছে ঘড়ির
কাঁটা । শীতের আমেজ লেগেছে বাতাসে । ঘুম থেকে উঠে গা টা একটু শিরশির করে উঠলো । নন্দিনী ঢুকেই হই হই
করে উঠলো – ‘ কি
ব্যাপার তোর ? আমি কথা
বলেই যাচ্ছি , তোর কোন
উত্তর নেই ? ফোন ধরে
আছিস , এদিকে সাড়াশব্দ নেই ,
শরীর খারাপ হল কি না , আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম । এই দ্যাখ ,
বাড়ির কাপড়ে চলে
এসেছি । আর তুই কিনা নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছিলি ? দে , ব্যাটা , আমার ট্যাক্সি ফেয়ার টা দে , আমি বিদেয় হই । তোর সাথে আর কোন সম্পর্ক
নেই’। তিতি ওকে হাত ধরে
টেনে থামাল । বলল , ‘ দাঁড়া ,
আগে মাথা ঠাণ্ডা করে
বস , কফি টফি খা ,
তারপর এসব কথা হবে ।
তার আগে তোর সরদারজিকে বিদায় করে আসি , ব্যাটা ড্যাবড্যাবিয়ে রগড় দেখছে দ্যাখো’। সেদিন অনেক কষ্টে ভুজুং ভাজুং দিয়ে নন্দিনীকে
ম্যানেজ করতে হয়েছিল । খারাপও লেগেছিল নন্দিনীর জন্য । হয়ত ও সত্যিই তিতির ভালোর
জন্যই করছে এসব । কিন্তু তিতির যে আর মন থেকে আসে না এসব । তিতি কি সিনিক হয়ে
যাচ্ছে ? নাহ , আর এসব দায় নিতে ইচ্ছে করে না । এই বেশ
আছে । একা একা । নাকি আসলে বন্ধন মুক্তিতেই বিশ্বের সাথে যোগ টা বেশি দৃঢ় হয় ? লোকে খুব চিন্তায় পড়ে গেছে , কি হবে তিতির শেষ বয়সে ? কে দেখবে ওকে ? তিতি ভেবে রেখেছে । বাড়িতেই একটা
বৃদ্ধাশ্রম খুলবে । রিটায়ারমেন্টের পর কিছুদিন চষে বেড়াবে ভারতবর্ষ । তারপর বাকি
পুঁজি ঢালবে ওর স্বপ্নের প্রজেক্টে । তিতি নন্দিনীকেও নেমন্তন্ন করে রেখেছে । তা
শুনে ও বলেছে , ‘ দূর হ
মুখপুড়ি ! আমার ভরা সংসার ফেলে আমি তোর মত হিজড়ের সাথে থাকতে যাব কোন দুঃখে’?
আর বসকে বলায় তিনি
বলেছেন, ‘ এক্সেলেনট ! শেষ
বয়সে আপনার সাহচর্যে , আপনার
আশ্রমে ... ,’ বলেই
একটু যেন লজ্জা পেয়ে থেমে গেছেন ।
তিতি হেসেছে , বলেছে, ‘ ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার’! তিতি ভেবে রেখেছে , সুযোগমত বোসদাকেও নেমন্তন্ন করবে । কে
জানে বয়েস বাড়লে ভদ্রলোকের ছোঁকছোঁক স্বভাব বাড়বে না কমবে ! ফোন করতে হবে একদিন
বোসগিন্নীকে । খোঁজ নিতে হবে , ইদানিং কেমন চলছে মতিগতি !