কুইন অব কিং স্ট্রিট
মে মাস।
রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সপ্তাহের প্রথম দিন । এখনো শরীরে উইক এন্ডের আমেজ মেশানো আছে। মন
টাও পাখির কিচির মিচিরে ভরা। নীল টয়োটা মাত্র একজন প্যাসেঞ্জার পাশে নিয়ে দক্ষ
হাতে ছুটে যাচ্ছে হ্যামিল্টনের দিকে। বরাবরের মতই ফোর-হো-ওয়ান ওয়েস্ট। পথে কোন সার্ভিস
স্টেশান চোখে পড়ছে না। মনের কিচির মিচির থামে না। পাশের মানুষটাও খুব চেনা কেউ
নয়। দু’জনের উদ্দেশ্য এক। হ্যামিল্টন শহরকে
কাজের শেষে কিছুটা নতুন উদ্যমে উপভোগ
করা।
গাড়িতে গান বাজছে। ক্যারি আন্ডারউডের হোয়েনেভার ইউ রিমেম্বার – এলবাম থেকে “হোয়েনেভার
ইউ লুক ব্যাক ওন টাইমস ইউ হ্যাড”—মিরঞ্জার
সুবিধা হল জুকার বেশী কথা জানতে চাইবে না তার জীবন নিয়ে। চঞ্চল সে ; কিন্তু চাপা স্বভাবের মেয়ে। গানের প্রতিটি শব্দ তার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে তানপুরা বা পিয়ানোর মত ঝংকার তুলে
যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া কিছু মিষ্টি দিনের দিকে মন ফিরে তাকাতে থাকে। তবু সে
বর্তমানের মাঝেই নিজেকে প্রবহমান রাখতে সচেষ্ট হয়।
-জুকার, কেন তুমি গানটায় ঠোট মিলাচ্ছ না?
জুকার বেশ হকচকিয়ে গেল। নড়ে চড়ে
বসে হেঁড়ে গলায় একটা শব্দ উচ্চারণ করেই থেমে গেল। মিরঞ্জা জানতেও পারলো না, জুকার কেন গানটা গাইলো না। জুকার এক সময়ের তুখোড় গিটারিস্ট , উদাত্ত গলায় সে হাইওয়েতে গাড়ি চালাতে চালাতে তার গানে
গাড়ির চাকার মাথা গরম করে দিত। সে আজ নীরবে গান থামিয়ে দিল।
মিরঞ্জার গাড়ি এখন একশ বিশেই চলছে। ফোর-ওহ-ওয়ান এ। এই হাই ওয়ের আসল নাম
হলো,
কিং’স হাইওয়ে ফোর-ওহ-ওয়ান। চারশ সিরিজের রাস্তার একটা। এই রাস্তার অফিসিয়াল নাম হলো ম্যাকডোনাল্ড কার্টিয়ার
ফ্রি ওয়ে। স্থানীয় ভাষায় বলা হয়। ফোর-ওহ-ওয়ান অন্টারিও প্রভিন্সে এই রাস্তার
দৈর্ঘ হলো মোট আতশ সতের দশমিক নয় কিলোমিটার। এই হাইওয়ে শুরু হয় কিবেক থেকে মাঝে
টরন্টো ভেদ করে সোজা গিয়ে শেষ হয় উইন্ডসরে । পৃথিবীর অনেক প্রশস্ত ও বিজি হাই
ওয়ের মধ্যে ফোর-ওহ-ওয়ান ও একটা। যেমন এই মুহুর্তে মিরঞ্জা, সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষ চিন্তায় ও কাজে। গাড়ি ছুটছে সাঁ সাঁ
গতিতে। পথের সাথে সাথে গাড়িতে গান বদলে যাচ্ছে ।
-আমি সার্ভিস স্টেশান এ একটা ব্রেক নেব, তোমার ওয়াস রুমে যেতে হলে ফীল ফ্রি। ও একটু মজা করে জুকারকে
হালকা করতে চাইল।
-আই জাস্ট হ্যাড ইট
আওয়ার এগো। ম্যান ডাজন’ট গো টু ওয়াস রুম সো
ফ্রিকোয়েন্টলি।
মিরঞ্জা বাঁকা চোখে তাকালে জুকার হাসার চেষ্টা করলো, কিন্তু মন খুলে হাসলো না। অতীত বুঝি কখনো কখনো এমনি করেই চেপে
রাখে সকল হাসির খোলা জানালা। গাড়ি ফোর-ওহ –ওয়ান ওয়েস্ট থেকে এক্সিট নিয়েঙ্গড়াতে থাকে ফোর-ওহ-থ্রি
ওয়েস্টে। ফোর-ওহ-থ্রি ওয়েস্টে উডস্টক ও মিসিসাগার পেট চিরে নতুন পথে
যাত্রা শুরু । ফোর-ওহ-থ্রী নতুন রাস্তায় গাড়ি চলে প্রায় বাইশ কিলোমিটার। বাইশ বছর
আগের অতীত জুকার তার স্মৃতির মাঠে নামিয়ে দিয়ে মনে মনে
হা-ডু-ডু খেলছে। মিরঞ্জা জানতেও পারছে না কে আছে জুকারের স্মৃতির মাঠে। কতকাল ধরে
এই স্মৃতির ছায়ায় জুকার বাস করছে? কেবল জুকার
জানে।
-কোন এক্সিট তোমার পছন্দ? ততক্ষণে গাড়ি ফোরও থ্রি থেকে বিদায় নিয়ে হ্যামিল্টনের
উদ্দেশ্যে উঠে যাচ্ছে কিউই ডাব্লিউ কোলে। চলছে পশ্চিমের দিকে গাড়ি। দুইধারে মে
মাসের পাতাহীন গাছ। ধুসর আবহ। শীত এখনো কোল ঘেঁষে বসে আছে। কবে কোল থেকে নাম্বে কে
জানে। প্রতি বছর আবহাওয়া ভিন্ন মাত্রা নিচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাব।
-এক্সিটের কি রঙ বা আকৃতি আলাদা নাকি যে পছন্দ করতে হবে?
- সামনের যে বিমভিল এক্সিট
তাতে একটা সুন্দর টীমহর্টনস আছে, তাই বলা।
চাইলে—কথা শেষ হলো না, এক্সিট টা ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ।
মিরঞ্জা ততক্ষণে গাড়ী কিউইডাব্লিউ থেকে ওন্টারিও স্ট্রীট, বিমস ভিলের র্যাম্প থেকে ফুল স্পীডে টান দিয়েছে
বাদামী রঙ এর বিল্ডিং এর উপরে লেখা টিম হর্টনসের দিকে। গাড়ি পার্ক করেই টয়োটাকে
সে বললও, টেক রেস্ট। লেট মি পি এন্ড হ্যাভ আ কফি। ক্লিক, দূর থেকে রিমোর্ট চাপ পড়ে। দরজা লক । ওয়াস রুম থেকে রিফ্রেশ হয়ে এসে
মিরঞ্জা অর্ডার দিল । হ্যালাপিনিও ব্যাগল উইথ বাটার আর ১ ডলার ডিলের ক্যাফে মোকা।
জুকার নিল চীজ ক্রোস্যান্ট আর ১ ডলার ডিলের ক্যাফে ল্যাট্টে।
এইজন্যই টিম হর্টন এতো
জনপ্রিয়।
কুইক সার্ভিস।
মজার সব খাবার।
রকমারি কফির বাহারি।
দামে সস্তা। কোনায়
কোনায় এখন ব্যাঙ’এর ছাতার মত গজিয়েছে এই টিম হর্টনস।
গাড়িতে উঠেই
শ্যাল গ্যাস ষ্টেশানে গেল সে গ্যাস নিতে। গ্যাস নিয়ে বিল দিতে গিয়ে মনে হল ভাগ্য
পরীক্ষা করার যাক। সামনের শুক্রবারে লোটো ম্যাক্স পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার। ইউথ এঙ্কর, মিরঞ্জা তার দীর্ঘ দিনের প্রিয় কিছু নাম্বার ছক কেটে কাগজটা
বাড়িয়ে দিল কাউন্টারে। জুকার জানলো না তার ভাগ্য আজ এই লটারির টিকেটে জমা
পড়েছে।
উনিশ’শ ষাট সাল। টিম হর্টন’স যখন প্রথম ওপেন হয়। কফি টাইমের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে
থাকতে পারে নি বলা যায়। প্রায় মরে গেছে কয়েক বছরের মধ্যেই। সবাই কি আসলেই মরে? কবি লেখক ও ব্যবসায়ীরা আসলেই মরে না।
- জুকার, তুমি যে কফি পান করছ টিম হর্টনস থেকে সে কে তা কি জানো?
মুচকি হেসে জুকার বলতে শুরু করে। আমার গ্র্যান্ড ফা জন্মেছে কোসরেন, অন্টারিও তে। তা থেকেই কি ক্রোস্যান্ট এর উৎপত্তি? জানিনা। সেই শহরেই জন্মেছে টিম। উনিশ’শ তিরিশ সালে। হকি কানাডার একটা জনপ্রিয় খেলা। সে একজন দক্ষ ডিফেন্স হকি
প্লেয়ার । দীর্ঘ বাইশ বছরে সে চৌদ্দ শ ছিচল্লিশটা সিজন গেম খেলেছিল, একশ পনের বার
গোল করেছিল আর চারশো তিনবার সে এসিস্ট করেছিল গোল করতে । সব মিলিয়ে সে পাঁচশ আঠার
পয়েন্ট করেছিল’।
-‘তুমি কি জানো মিরঞ্জা, এই পর্যন্ত কত কাপ কফি কিনেছ এই টিম হর্টন’স থেকে আর নিজে কত কাপ কফি পান করেছ’? মিরঞ্জা অবাক হয়ে শুনছে আর গাড়ির মিরর থেকে চোখ না সরিয়ে
মাথা নেড়ে জানালো , না সে জানে না। কোনদিন
ভাবেনি তাকে এই হিসাব জানতে হবে।
জীবনের ওসব অঙ্কের হিসাব কেউ রাখেনা, রাখলেও মেলেনা। জীবন সরল অংক নয়, তবু ফলাফল হয় শূন্য , নয় এক।
-জুকার মাই ডিয়ার, ডু ইউ নো?
কথা শেষ করতে না দিয়েই জুকার গড় গড় করে বলআ শুরু করে, কবে, কোন তারিখ থেকে সে প্রথম
টিম হর্টনের কফি পান করা শুরু করেছে এবং আজ পর্যন্ত সে কত কাপ কফি পান করেছে, সব তার ডায়েরিতে লেখা আছে। একদিন সে এর হিসাব নিয়ে বসবে।
কিন্তু কেন? তার ও যে সেই স্বপ্ন চোখে-মনে -চোখে, একদিন সে জুকার ক্যাফের চেইন স্টোর খুলবে-জুকার হারাতে চায় না
তার চারিপাশের স্বজনদের মন থেকে।
-জুকার! তা হলে টিম হর্টনসের ইতিহাস বলো। নিশ্চয় জানো তুমি।
এমন সময় সুর্য ঝলসে ওঠে পুব আকাশে। মিরঞ্জার গাড়ি চালাতে সুবিধেই
হচ্ছে , পেছনে রোদ, তাকে ড্রাইভ করছে। সোনালি রোদের ছটা তার চুলে ঝিলিক দিচ্ছে। মাথার উপরে সান রুফ
খোলা। তবু রোদের উজ্জ্বলতায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। জুকার ডেস বোর্ড থেকে সান গ্লাস
বের করে পরিয়ে দেয় মিরঞ্জাকে। মিরঞ্জার মনে অদ্ভুত এক আবেশ সৃষ্টি হয়ে মেঘের মত
উড়তে থাকে অজানা আকাশে।
থ্যাংকস, বলে অপেক্ষা করে ইতিহাস
শুনতে। আসলে তো আমরা সারা দিন টিম হর্টনসের কফি পান করি, ডোনাট খাই, কিন্তু
ইতিহাস জানি না। কে এই টিম হর্টন কেন সে এই ব্যবসায়ে এলো? রিঙ্কের বাইরে টিম একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। সে বুঝে
গিয়েছিল হকি ক্যারিয়ার তাকে সারা জীবনের জন্য সাধুবাদ যোগাবে না, পেটের খাবার যোগাড় করবে না। তার শক্তি শেষ তো ক্যারিয়ার শেষ।
তাই সে পথ খুঁজছিল । হকি সেলারির সাথে নতুন আয়ের পথ। অনেক বছর ধরে সামারে সে সাইড
বিজিন্যাস করবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে কফি আর ডোনাট নিয়ে পড়লো। এর ফাকে
সে ক্যাফে ল্যাট্টে তে চুমুক দিচ্ছে আর ক্রোস্যান্ট এ কামড় দিচ্ছে। গল্প বলতে
গিয়ে সে গভীরে ডুবে যাচ্ছে। এর মাঝে মিরঞ্জা তার ভিউ মিরর ঠিক করে নিল। পাশ দিয়ে
একটা বড় ২৬ ফিটের লরি দ্রুত গতিতে যাবার সময় হংক করে গেল। কেন করলো, মিরঞ্জা ভেবে পেলো না। পরে বুঝলো, সে খুব আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিল। হাইওয়েতে স্পীডের একটা
নিম্নসীমা থাকে । তার নিচে গেলে হাইওয়ের ফ্লো নষ্ট হতে বাধ্য। মিরঞ্জা গ্যাসে চাপ দিয়ে স্পীড
বাড়িয়ে দিয়ে লেন চেঞ্জ করে লেফট লেনে চলে যায়। এর মাঝে জুকার নিজেকে আরেকবার
তটস্থ করে নেয়।
মিরঞ্জা যখন মিউজিক সেন্টারে সিডি বদলাচ্ছে তখন অলক্ষ্যেই জুকারের হাতের সাথে
হাত লেগে যায়, আর মিরঞ্জার শরীরে
বিদ্যুৎ খেলে যায়। মিরঞ্জা ভাবে, তবে কি
ক্যামিষ্ট্রি কাজ করছে? লোল।
হা হা হা আমি বলি, ক্যামিষ্ট্রি শুনতে বাংলায় স্বামী-স্ত্রীর মত শোনা যায়, তাই না?
ক্যামিষ্ট্রি শুরু হয় ডোনাট ও কফির জীবনে উনিশ চৌষট্টি সালে ফ্রেঞ্চাইজ
আকারে। কানাডার প্রথম
প্রিমিয়ার যেমন হ্যামিল্টনে বসবাস
করতো, তেমনি টিম হর্টনস ও শুরু হয়
হ্যামিল্টনে। উনিশ’শ সাতষট্টি সালের মধ্যে
তিনটে স্টোর ওপেন হয়। মিরঞ্জা হেসে দিয়ে বলে, তুমি ইতিহাসে দারুণ ভালো মার্ক পেয়েছ বুঝি? এই টিম হর্টনসের প্রথম পার্টনার হলো প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। হা
হা হা টিম বুঝি ভয় পেয়েছে? তার
নিরাপত্তা বিধান করেছে প্রাক্তন পুলিশকে পার্টনার করে। আর কেউ কি ছিল? হ্যাঁ ছিল রণ জয়েস বলে আরেক জন পার্টনার ছিল। আর সিগনেচারটা
টিম হর্টনেরই নামে প্রোজ্জ্বল হয়ে থাকে ।
-ইট বিকেম আ প্রমিন্যান্ট
ফিক্সার ইন দা কানাডিয়ান ল্যান্ডস্কেপ।
মিরঞ্জা এবার অতি উৎসাহে
বলে উঠলো, হে চলো, তা হলে আজকেই টিমের সাথে দেখা করব। আমার কাজ তো মাত্র দুই থেকে
তিন ঘণ্টা। তারপর তো আমরা কেবল সময় কাটাব হ্যামিল্টনে। হ্যাঁ ঠিক আছে বলে জুকার
চুপ করে থাকে।
গাড়ি চলতে থাকে ।
স্পীডের কাটা এখন একশ বিশ কিলোমিটারের ঘরে। সিডিতে গান বাজছে ।
মিরঞ্জার সামনে ওয়েস্ট ম্যানেজম্যান্টের গাড়ি। জুকারের ভালো লাগছেনা।
কিন্তু মিরঞ্জা কেমন যেন উদাসীন। বড় বিচিত্র। দুটো মানুষ পাশাপাশি বসে থেকেও কত
দূরের কথা ভাবে বা হারিয়ে যেতে পারে অনায়াসে নিজস্ব অতীতে। বর্তমানের চেয়ে অতীত
তখনই বেশী প্রধান হয়ে ওঠে যখন বর্তমান মনের মধ্যে কোন বাঁধন না থাকে। দুইজন
যাত্রী। একই গাড়ীতে । কেবল একটা গিয়ার সেটআপের দূরত্বে বসে বসে কত কি
আকাশ পাতাল ভাবছে। কেউ জানে না , কারো মনের
খবর। মন কোথায় থাকে? এই প্রশ্ন আমি সব সময়
জিজ্ঞেস করি, উত্তর মেলেনা।
মিরঞ্জা অকারণেই লেন চেঞ্জ করছে বারে বারে, এই দেখে জুকার জিজ্ঞেস করলো। মিরঞ্জা তোমার কি ঘুম পেয়েছে? মিরঞ্জা মাথা নেড়ে জানালো , না। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে জুকারের চোখে চোখ রেখে বললো, আমি গাড়ি চালাতে গিয়ে কোনদিন ঘুমাই না। কেন এই কথা বললে?
তুমি বারে বারে লেন
চেঞ্জ করছিলে।
অভ্যেস। ভালো লাগে। বোরিংনেস কেটে যায়। ভাবছি টিমের কথা। কি করে মানুষ এক
ক্যারিয়ারে থেকে আরেকটা বিরাট ভবিষ্যতের কথা ভাবে পারে। আমি তো পারিনা।
তুমি যা পারো, তা অনেকেই পারেনা।
মিরঞ্জা হেসে দিল।
মিরঞ্জার গাড়ি হাতের ডানদিকে ব্রেনফোর্ড এর রাস্তা রেখে কিউইডাব্লিউ এর উপর দিয়ে চলছে পশ্চিম মুখী। যদি ও দূরত্ব
মাত্র এক ঘণ্টার, কিন্তু সকালে অফিস
ট্রাফিকের কারণে গাড়ি প্রায় থেমেই যাচ্ছে। হাতে অনেক সময় আছে। এই ট্রাফিকের কথা
ভেবেই মিরঞ্জা অনেক সকালেই যাত্রা শুরু করেছে। হঠাৎ মিরঞ্জার মনে হলো কাজে না
গিয়ে এক্সিট নিয়ে ব্রেন্টফোর্ড ঢুকে লেক অন্টারিওর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। টরন্টো
থেকে শুরু করে হ্যামিল্টন পর্যন্ত পুরো পথটাই লেক অন্টারিওকে হাতের বা দিকে রেখে
এগিয়ে গেছে। হ্রদ আর হৃদয় যমজ দুই স্বত্বা। মিশে আছে এক হয়ে। দুই-ই গোল, আবার গোলমাল নয়। একজন স্থলের মধ্যে বাস করে আরেকজন দেহের
ভেতরে বাস করে। ট্রাফিক কিছুটা হাল্কা
হয়েছে গাড়ির স্পীডের কাটা এখন প্রায় পঁচাত্তর কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই করছে।
হাই-ওয়েতে কে এতো অল্প স্পীডে গাড়ি চালাতে পছন্দ করে? এমন যৌবনে কেউ নয়। লেকের আকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে এবার গাড়ী কিছুটা বাঁ দিকে
বাঁক নিয়ে হ্যামিল্টনের পথে ছুটছে।
লেকের পাড় ঘেঁষে ড্রাইভ করবার অনাবিল এই আনন্দ যে ড্রাইভ না করেছে সে কি করে
জানবে?
-জুকার তুমি কি এই পথে
ড্রাইভ করেছ?
-এপ্রক্সিমেটলি টু
হান্ড্রেড টাইমস।
-ওয়াও!
ছোট ছোট কথা বার্তার মধ্যেই মিরঞ্জা মেইন স্ট্রিটে এ এক্সিট নিতে র্যাম্পে
গাড়ী উঠিয়ে দিয়েছে। ডাউন্টাউনের চঞ্চলতা মনকে গ্রাস করে ফেলেছে। মেইন স্ট্রিট
থেকে কিং স্ট্রীটে এ টার্ণ নিতে
সে রাইট সিগনাল অন করে দিয়েছে।
- ম্যাজিক জুকার, যখন আমি কাজ
করব,
তুমি টিমহর্টনসে বসে, ইট প্রেএন্ড লাভ –এই বইটা পড়তে পারো। আমার গাড়ির পেছনের সীটে আছে বইটি।
এলিজাবেথ গিলবার্টের বই।
- জুকার সোৎসাহে পেছনে তাকালো। বই পড়া তার ছোটবেলাকার অভ্যেস।
একবার বই হাতে পেলে সে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে যায়।
- মিরঞ্জা এসে তার অফিসের সামনে দাঁড়ালো। স্যোসাল ওয়েলফেয়ার
অফিস। এখানে একটা স্পেশাল
কেইস নিয়ে তাকে এডভোকেসী করতে হবে। সিস্টেমের গণ্ডগোলের শিকার হয় সহজ ও
সত্য কথা বলা মানুষগুলো। তার ক্লায়েন্ট বলেছিল ওয়েল ফেয়ারকে, তার বোন তাকে এই মাসে পাঁচশ ডলার গিফট পাঠিয়েছে তার জন্মদিন
উপলক্ষ্যে। ব্যস এই মাসে তাকে কোন চেক দেয়া হবে না। এমন ফ্যাসাদ হর হামেশাই ঘটছে।
না বললে কোন দোষ নেই। তাই মানুষ করাপ্টেড হতে বাধ্য হয়।
যতক্ষণ মিরঞ্জার কাজ ছিল, জুকার বই
পড়ছিল টিম হর্টন’সে বসে। এক কাপ কফিও সে অর্ডার দেয় নাই। মাঝে মাঝে কাউন্টার থেকে একটা
মেয়ে দেখছিল তাকে, টিম হর্টন’সে এসে কেউ কফি না নিয়ে বসে বই পড়তে পারে, এমন ঘটনা বিরল। কারন কফি হলো নেশার মত । জুকারের কিছুতেই নেশা
নেই। মেয়েটা জানে না।
মিরঞ্জার বিচিত্র সখের মধ্যে এটি একটি। যখনই সে লং ডিস্টেন্সে কাজে যায়, সাথে একজন কাউকে তার চাই। এই চাওয়া থেকেই কাজের জায়গায় আগের পরিচিত জুকার কে সে আহবান জানায় তার সাথী হতে সেদিন। জুকার বেচারা চাকুরী হারিয়েছ কয়েকদিন আগে। এই বেকার
জীবনে ঘরে বসে টিভি না দেখে একটু বেড়ালে ক্ষতি কি? তবে সে বেশ নাজুক প্রকৃতির লোক।
সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসে একটা সেমিনার চলছে। সেখানে একজন হাল্কা পাতলা ইয়ং
মেয়ে বলছে, নির্যাতন ঘরে বাইরে! কারা এর শিকার? যে কোন দুর্যোগে কিংবা আক্রোশের প্রধান শিকার নারি ও শিশু।
সেখানেও কিছুটা তারতম্য দেখা যায়। শিশুদের ভেতরে নারী শিশু বা মেয়ে শিশু যাই
বলিনা কেন সেই বেশীর ভাগ নির্যাতনের শিকার হয়। পরিবারের এবং সমাজের দায়ভারের
ক্ষেত্রেও সেই নারী ও শিশু নারীকেই বেশির ভাগ অংশ বহন করতে হয়। তা হলে কি
দাঁড়াচ্ছে? এক পক্ষ ও প্রতিপক্ষ এবং সেই এক পক্ষের
হাত ধরে আছে পুরুষ। এবার যদি প্রশ্ন করি সর্ব জান্তাকে তা হলে উত্তর কি আসতে পারে? প্রশ্ন ? এই পুরুষের
উৎপত্তি কোথা থেকে? কার জরায়ু ভেদ করে? যদি একজন নারীকেই দরকার হয়, সেই পুরুষের জন্মের জন্য, তা হলে এই নারীর উপর খড়গ উঠে কি করে? ঘরে, ঘরের বাইরে, কর্মক্ষেত্রে। এই আলোচনায় দু’টো দিক আলাদা করে দেখাতে হবে। একঃ কখন থেকে নারী শ্রম
কারখানায় বা অফিস আদালতে অভ্যুথান তৈরী করেছে? দুইঃ কখন থেকে উন্নত বিশ্বে
তথা পশ্চিমা দেশে ও অর্থের
বিনিময়ে শিশু শ্রম শুরু হয়েছে । এই দুই ইতিহাস যদি জানতে পারি, তাহলে বর্তমান বিশ্বে, এই শিশু ও নারী শ্রমের যে অবকাঠামো আজকে বিস্তৃত আছে তার একটা
চিত্র পাওয়া যেতে পারে। কথাগুলো মিরঞ্জার কানে আঠার মত লেগে আছে। ভাবছে আজকে রাতেই সে
একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলবে এর উপরে। তার চারিপাশে যা কিছু ঘটছে তার থেকে তথ্য সংগ্রহ
করে জড়ো করলেই একটা সাবলীল প্রবন্ধ লেখা হয়ে যাবে।
কাজ শেষে মিরঞ্জা এসেই বলছে, জুকার লেটস
গো। আই ওয়ান্ট টু মিট উইথ টিম। জুকার মিরঞ্জার হাত ধরে বেরিয়ে আসে টিম হর্টোন’স 'থেকে। তখনই তার মনে হলো, একটা কফি নেয়া উচিত এতক্ষণ এদের সুবিধা ভোগ করেছে সে। ফিরে
গিয়ে দু’টো ক্যাফে মোকা নিয়ে এলো। গাড়িতে বসে মিরঞ্জা তার টেক্সট ম্যাসেজ চেক করছিল। অনেকগুলো
ম্যাসেজ জমা হয়েছে। সবই অফিসের বসের। আজকাল বসরাও ফোন না করে টেক্সট
ম্যাসেজ পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ভাবছে সে আগে উত্তর দিয়ে পরে যাবে। তাই
ব্যস্ত হয়ে রইলো। জুকার ক্যাফে মোকা পাশে রেখে গাড়ীর বাইরে অপেক্ষা করছে।
টেক্সট ম্যাসেজ শেষ করে সে তাড়া দিল। জুকার লেটস গো। গাড়িতে বসে জুকার বললো, চলো ডানদিকে। এই করে জুকার তাকে নিয়ে গেল হ্যামিল্টনের ডানডার্ণ ক্যাসেলের দিকে। সেখানে সুন্দর একটা
পার্ক আছে। পার্কে বসে জুকার বললো, মিরঞ্জা, সেটা ছিল ফেব্রুয়ারি মাসে একুশ তারিখ। ১৯৭৪ সাল। টিম হর্টন’স তর তর করে বাড়ছে। সেদিন টিম বাফ্যালোর ম্যপল লীপ গার্ডেন থেকে খেলা শেষ করে ফেরার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে । তুমি কি জানো সে একজন দক্ষ ডিফেন্সম্যান ছিল ন্যাশানাল হকি লীগের ব্লু
লাইনে । সেদিন আমার মা বাবা সারা দিন না খেয়ে ছিল। বাফ্যালো সাব্রেজ তার
দুই নাম্বার সোয়েটার থেকে
রিটায়ার্ড করেছে টিমের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। সেই সময় টিম হর্টনসের সংখ্যা
ছিল ৪০টার মত।
আজকে তিন হাজারের উপরে রেস্টুরেন্ট আছে কানাডায় আর ছয়শ’এর বেশী আছে আমেরিকায়। সেদিন ছিল ডোনাট আর কফি। মনে মনে বললো, টিম এর কিছুই দেখে যেতে পারেনি। হঠাৎ মিরঞ্জা উঠে দাঁড়ায়।
দু’জনেই এসে গাড়িতে বসে। মিরঞ্জা চুপচাপ।
কোন কথা নেই মুখে। জুকার জানেনা মিরঞ্জা কি বুঝেছে। মিরঞ্জা গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বাঁ দিকে কুইন ষ্ট্রীটে গাড়ী টার্ণ করলো। কিং স্ট্রীটে এ ক্রস করবার আগে জুকার বললো, তার মৃত্যু আমাদের জন্য খুবই লসের। খুবই দুঃখ জনক। মিরঞ্জা
খ্যাচ করে ব্র্যাক করতে গিয়েও পারলো না। কিং ষ্ট্রীটে এর ডান দিকে থেকে ওয়েস্ট ম্যানেজম্যান্টের ট্রাক
এসে সোজা হিট করে মিরঞ্জার সাইডে। মিরঞ্জার গাড়ি দুইবার ঘুরে গোলচক্করের বাম পাশ ঘেঁসে সোজা
গিয়ে ধাক্কা খায় ।
ল্যাম্প পোষ্টের সাথে। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল গাড়ি মুহুর্তের মধ্যে। জুকার হাতবাড়িয়ে
দিয়েছে মিরঞ্জার দিকে। অস্ফুট উচ্চারণ আই লাভ ইউ। হাত ধরে দু’জনেই টিমকে দেখতে চলে গেল । কেমিস্ট্রি কি সুন্দর রিকেশান করে একটা নতুন টিম
বানিয়ে দিল। টিম বরাবরের একজন দক্ষ খেলোয়াড়। এবারো জিতে নিল শেষ খেলা।