গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

রত্নদীপা দে ঘোষ


কাহন

ফোনটা নামিয়ে রাখলেন মনিনাভ রায় । মুখ কালো । এই মুহূর্তে বাড়িতেও আর কেউ নেই । মৃদুলা ঢাকুরিয়া কালীবাড়িতে গেছে পুজো দিতে । বাবান অফিসে আর ...মুনমুন ... নাম টা মনে আসতেই আরও অন্ধকার হয়ে গেল সাঙ্ঘাতিক অন্ধকার ...মুনমুন এ বাড়ীর একমাত্র ছেলের বউ । বাবান আর মুনমুন যাদবপুরের ক্লাসমেট । বিয়ের আগেই মুনমুনের সাথে আলাপ হয়ে গিয়েছিল মনিনাভ আর মৃদুলার । সেদিন ছিল সোমবার , পুজোর ছুটির পর আজই প্রথম ক্লাস ।

বাবান সকালবেলাতেই ক্লাসে যাবার আগে মৃদুলাকে বলেছিল , মা আমার এক বান্ধবী তোমার আর বাবার সাথে আলাপ করতে চায় , আজ বিকেলে ওকে নিয়ে আসি ? ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবেমাত্র চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়েছেন মনিনাভ , বান্ধবী? কে রে ! মনে হচ্ছে বিশেষ কেউ ! মৃদুলার ভাব দেখে মনে হোলো সে আগেই জেনে গেছে সব । বাবান একটু গম্ভীর , সে অবশ্য বরাবরই গম্ভীর , হ্যাঁ বাবা , শর্মিষ্ঠা মানে মুনমুন আমার বিশেষ বন্ধু ... দেখো , তোমাদেরও ওকে ভালো লাগবে খুব ... আর কথা বাড়ায়নি বাবান । তাড়াহুড়ো করে ক্লাসের জন্য বেড়িয়ে গেছে । মনে আছে সেদিন অফিসেও মনিনাভ খুব উত্তেজিত বোধ করছিলেন ... আহা! আজ বিকেলে ছেলের বিশেষ বান্ধবী আসবে আলাপ করতে , সম্ভবত সেই পুত্রবধু হবে একদিন , কি বলে ডাকবেন তাকে ... বৌমা , না না কি বিচ্ছিরি ... মুনমুন ? ... না না এটাও ভালো লাগছে না ... ভাবছেন মনিনাভ ... ঘড়ির দিকেও ঘন ঘন চোখ চলে যাচ্ছে আজ ...না , আর ভালো লাগছে না , কাজ ফাজ চুলোয় যাক , আজ দোয়েলের জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাই যাক । হুম , মনে মনে নামটাও ঠিক করে ফেলেছেন । সত্যি কথা বলতে কি মৃদুলাও জানে না কি অসম্ভব মেয়ের শখ ছিল তাঁর । মেয়ের নাম ও ঠিক করাই ছিল । দোয়েল । ... কিন্তু হোলো ওই গম্ভীরানন্দ ছেলে , আর কি সিরিয়াস , কথা বলতেই ভয় লাগে মনিনাভর । কতো ভালো লাগে একটা মেয়ে ঘুরে বেড়াবে ঘরে , বায়না , আবদার করবে , এই ফুচকা আনো , ওই আইসক্রিম।। ...

আজ মনিনাভ বাড়িতে ঢুকলেন আইসক্রিম হাতে ... হানিনাট এক্সট্রা লারজ বার ... দরজায় বেল দিতেই আজ মৃদুলা নয় দরজা খুলে দিয়েছে দোয়েল ... আমি মুনমুন । মনিনাভ দেখলেন কাঁধ পর্যন্ত চুল , লাল চুড়িদার ওড়না কাজল আর লিপস্টিকে একটি ছটফটে পাখি ...প্রনাম করছিলো মুনমুন , উস্খোখুস্কো চুল , আহারে মেয়েটা ক্লাস সেরে এসেছে , কতো ক্লান্ত , মাথায় হাত রাখলেন , কপালে চুমু খেলেন মনিনাভ , না মুনমুন নয় , আমি তোমাকে দোয়েল বলে ডাকবো ... রাজী ? ইয়েস বস , কি অসম্ভভ উচ্ছল আর প্রানবন্ত মেয়ে ! ... পুরোটা সময় জমিয়ে রাখলো বাড়িটা কথা বার্তা হাসি ঠাট্টায় । মৃদুলা খাবার বানিয়েছিল , ডালপুরি আলুর দম আর পায়েস । এতটুকু লজ্জা নেই চেটেপুটে সম্পূর্ণ খেয়ে নিলো মেয়েটা , আমার মা নেইতো , তাই এত ভালো ভালো খাবার খেতেই পাই না ... করুণ মুখে বললো দোয়েল ... তুমি খাও , ভালো করে খাও , ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মৃদুলা ...খাওয়া শেষ করে সোফায় এসে বসেছে সবাই , হাতে হাতে আইসক্রিম । আরে বস , তুমি জানলে কি করে আমার ফেভারিট হানি নাট ? হাসছেন মনিনাভ , প্রানখুলে , হা হা হা , যেন তিনিও কলেজ লাইফে ফিরে গেছেন , আরে ইয়ার , তুমি তো আমার মেয়েই , আমি জানবো নাতো কে জানবে ? ...হা হা হা ... এবার আমি আসি ? ... মৃদুলার দিকে তাকালো মুনমুন , আমি কিন্তু মাঝে মাঝেই চলে আসবো বলে দিলুম ...খুব হাসছে মৃদুলাও , হা হা হা , আসিস আসিস , যতবার খুশি যখন খুশি ...তুমি থেকে তুইতে নেমে গেছে কখন জানেনা মৃদুলা নিজেও ।

তারপর বাবান আর মুনমুন দুজনেই বি ই কমপ্লিট করে টিসিএস এ জয়েন করেছে । দুই পরিবারের মধ্যেও অনেক বার যাওয়া আসা হয়ে গেছে এর মধ্যে । কথা বার্তাও হয়েছে । আরও একটা চেনাশোনার সূত্র বেরিয়েছে দুই পরিবারের মধ্যে । ডঃ মল্লিক দু তরফেরই শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু । পাকা কথার দিন তিনিও সাথে থাকলেন । সবাই খুব খুশি । আর দেরী করে লাভ নেই । চার হাত এক করে দেয়া হোক । মৃদুলা মনিনাভ আর দোয়েল এই তিনজন মিলে বিয়ের বাজার টাজার সব করছেন , কোনো কোনো দিন দোয়েলের বাবাও । তবে তিনি একলা মানুষ , তাই তার ওপর চাপ করতে চাননি মনিনাভ আর মৃদুলা ... মানুষটি বার বার হাত ধরেছেন মনিনাভর ... আমার মা মরা মেয়েটা ... এরপর আর কথা বলতে পারেনি মুনমুনের বাবা ... একেবারে ভেঙে পড়েছেন কান্নায় আন্তরিকতার হাত পিঠে রেখেছেন মনিনাভ , আপনি আর একলাটি নন ভাই , এখন আপনার দাদা বৌদি মেয়ে জামাই সবাই আপনার সাথে ... আনন্দে ভাসছিল দুটি পরিবার । এমন সময় এক বিশাল সমস্যা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো ... বাবানকে বউভাতের দিন ই রাতের ফ্লাইটে অ্যামেরিকায় যেতে হবে তাও আবার ছ মাসের জন্য ... মুনমুনের চোখ ছলছল ...মেয়ের চোখের জল মোটেই সহ্য করতে পারেন না মনিনাভ , বললেন , তুই চাকরি ছেড়ে দে এখুনি , তারপর বাবানের সাথে চলে যা , আমি টিকিট কেটে দেবো ... কি সব বলো বাবা উল্টোপাল্টা ? হুট করে চাকরি ছেড়ে আমার সাথে বেড়াতে চলে যাবে ? তিন মাসের নোটিশ পিরিয়ড আছে না ? যতো সব বোকার মতো কথা বার্তা ... ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বাবান ... অনেক হইহুল্লোড় , হাসি মস্করা । বিয়ে হোলো বাবুন আর মুনমুনের , খুব খুশি সবাই । তারপর বউভাত। রাতদুপুরে বাবান অ্যামেরিকার উদ্দ্যেশে রওনা দিলো ... বাবানকে প্লেনে তুলে দিয়ে ফেরার সময় খুব কেঁদেছে দোয়েল ... গাড়ির সামনের সিটে বসেও ঠিক টের পেয়েছেন মনিনাভ , কাঁদবেই তো , এমন একটি বিশেষ দিনে বর কত দূরে চলে যাচ্ছে তাও আবার ছ মাসের জন্য ... মৃদুলাও খুব গম্ভীর বিষণ্ণ ... সেদিন রাতে দোয়েলকে বুকে জড়িয়েঘুমিয়েছে মৃদুলা , দেখতে দেখতে ছ মাস কেটে যাবে লক্ষ্মীসোনা ...

তবে বাবানের পৌঁছ সংবাদ পাবার পর থেকেই মেয়েটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে ... অফিসের ব্যাস্ততাও আছে তার মধ্যে । এই ছটি মাস মনিনাভর জীবনের স্বর্ণযুগ যাকে বলে গোল্ডেন পিরিয়ড ... একটা ঠিকঠাক মেয়ের বাবা হওয়া যে কি আনন্দের তা এই প্রথম জানলেন মনিনাভ বস , কাল আমাকে আর মাকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যাবে , টিকিট কেটে এনো বস , আইস্ক্রিম , মনে করে কিন্তু ...হা হা হা , মৃদুলাকে মা ডাকে মেয়েটা আর শ্বশুরকে বস ... হা হা হা ... সারা সন্ধ্যে ফেস বুকে চ্যাট করছে দুজনে , বাবা আর মেয়ে , পাশাপাশি দুটো ল্যাপটপ থেকে ... বস , বলে দিলুম আগে থেকে , এবার বিয়ের তারিখে মাকে একটা ল্যাপটপ কিনে দেবে ... হা হা হা , দোয়েল ... মেয়েটা এক্কেবারে ঝর্ণা , মনিনাভ ভাবছেন ... অপেক্ষারও শেষ আছে । ছমাস কেটে গেলো ... বাবানের ফিরে আসার দিনটা যেন উৎসবের । অনেক ভালো ভালো রান্না হয়েছে । সবই বাবানের পছন্দের । নিজের হাতে কেক বানিয়েছে দোয়েল । তিনজনে এয়ারপোর্টে গেছে বাবানকে আনতে ... কি সুন্দর যে লাগছে দোয়েলকে আজ ... আহা ! মেয়েটা এই প্রথম স্বামীকে কাছে পাবে । বিয়ের পর থেকে দোয়েল যেন মেয়ে হয়েই ছিল , আজ থেকে সে গিন্নী , পুরোপুরি ছেলের বউ । এরপর , মা হবে দোয়েল ... আরো একটা ছোট্ট পাখী দোয়েলের কোলে উড়ে বেরাবে ... উফফ! আর ভাবতে পারছেন না মনিনাভ । আনন্দে কাঁচা পাকা চুলে হাত বুলিয়ে নিলেন ... ওই যে এগিয়ে আসছে বাবান ...সন্দীপ , সমস্ত ভুলে চিৎকার করছে দোয়েল , মনিনাভ লক্ষ্য করলেন আজ আরো বেশি ঝকঝকে লাগছে মেয়েটাকে , নীল জিন্স , কুর্তি আর সিঁদুরের টিপে কি ঝলমলে মেয়ে তাঁর ।

এই মেয়েটির বাবা হিসেবে আজ মনিনাভ অহংকারী হতেই পারেন ... প্রণাম করছে বাবান , মৃদুলাকেও । হাই ! হাত স্পর্শ করেছে মুনমুনের । ছেলেটা যেন কেমন , আবেগহীন উচ্ছ্বাসহীন একটা মানুষ , ভাবলেন মনিনাভ । বাড়ি ফিরে খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে নেওয়া হোলো । মনিনাভ আর মৃদুলা নিজেদের শোবার ঘরে ঢুকে পরলেন।

বিয়ের ছ মাস পর আজ বাবান আর মুনমুনের ফুলশয্যা ... সমস্যা দেখা দিলো এর পরই ... কি যে হোলো দুজনের মধ্যে মনিনাভ বা মৃদুলা কেউ কিছু বুঝলেন না , জানলেন না , দোয়েল চুপ হয়ে গেল একদম , সে আর কারনে অকারনে হাসিতে গড়িয়ে পড়লো না , তার আর কোনো বায়না মর্জি আবদার কিচ্ছুটি নেই , আর বাবান আরও গম্ভীর । দিন দশেকের মধ্যেই দুজনের কথা এক্কেবারে বন্ধ হয়ে গেলো ... দুজনেই আলাদা আলাদা অফিস যায় , একসাথে রাতের খাবারটাও খায়না অব্দি । টেবিলে মনিনাভ আর মৃদুলার সাথে খাবার খায় দোয়েল আর বাবানকে তার ঘরে খাবার দিয়ে আসে মৃদুলা ... মৃদুলা অনেক চেষ্টা করেছে , বল , বল মা , কি সমস্যা তোদের ? আমি ঠিক করে দেবো সব ... কি চাস তোরা আলাদা থাকতে চাস ? একবার মুখ ফুটে বল , তাও করে দেব ব্যাবস্থা ... তুমি আমার মা , কান্নায় ভেঙে পড়েছে দোয়েল , মুখ শুকিয়ে গেছে , চোখের কোণে কালি ... কথা বন্ধ হয়ে গেলে সম্পর্কে আর কি বাকি থাকে ...আর পারছেন না মনিনাভ , ছেলেকে পাকড়াও করলেন একদিন , দোয়েল তখনো বাড়ি ফেরেনি ...ওয়াট ইজ গোইং অন ? কি হয়েছে তোমাদের ? সমস্যাটা কি বলবে তো ? মিষ্টি হাসি খুশি মেয়েটা শুকিয়ে যাচ্ছে , কি হয়েছে বলো , তোমাকে বলতেই হবে আজ ... ক্রমশ উঁচু হচ্ছে মনিনাভর গলার আওয়াজ । চিৎকার করে উঠেছে বাবান , স্টে আউট অফ ইট বাবা , দোয়েল আমাকে আর পছন্দ করছে না ... সি ইজ হাবিং অ্যান এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার , তোমাদের বলতে পারেনি মুনমুন ... ও ওর বসের সাথে জড়িয়ে পড়েছে বাবা ... কান্নায় ভেঙে পরেছে বাবান , অতো শক্ত ছেলে আঁকড়ে ধরেছে মৃদুলাকে ... ... হেসে গড়িয়ে পরছে তোমরা ওকে এতো ভালবাসা দিয়েছ , আমি কি কম বেসেছি ? ...কি পায়নি ও এখানে ? ...... ছাড়বো না , ওকে আমিছাড়বো না বাবা , ফুঁসে উঠছে বাবান ...

মৃদুলা স্তম্ভিত , একটা কথাও বলতে পারছেন না মনিনাভ। আমি এডাল্ট্রির চার্জ আনছি বাবা , আজই উকিলের কাছে গেছিলাম ...সমস্ত কথাবার্তা হয়ে গেছে কোনো অসুবিধে নেই , ওর পা আমি ভেঙে দেবো ... মনিনাভ খুব ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে , পেছনে স্তব্ধ মৃদুলা ...

দোয়েল আর এ বাড়িতে পা রাখেনি । বাবার বাড়িতে চলে গেছে । টি সি এস - এর জবটা ছেড়ে দিয়েছে বাবান ... মৃদুলা খুব রোগা হয়ে গেছে ইদানীং । ঘুম হয়না ঘুমের ওষুধ খেয়েও ... দুজনেই এপাশ ওপাশ করেন সারারাত ... মেয়েটা এভাব বিশ্বাসঘাতকতা করলো , দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করেন দুজনেই ... মনিনাভ...আর ইচ্ছে করেনি দোয়েলের সাথে কথা বলতে , ইচ্ছে করেনি ওদের বাড়িতে গিয়ে একবার দেখা করতে আস্তে , অথবা ওর বাবার সাথে একবার কথা বলতে ... মৃদুলা বলেছিল , চলো একবার ওদের বাড়িতে যাই , দোয়েলকে জিজ্ঞাসা করি , তুমি তো বাবানকে ভালোবেসেছিলে , তাহলে কেন কেন ? ... কি নেই আমার ছেলের , বলো ? রাজি হননি মনিনাভ । কতদিন বাবা মেয়ের কথা নেই ... কতদিন ... হানি নাট নেই , ফুচকা নেই , ফেসবুক সন্ধ্যা ...চুপ হয়ে গেছে ফ্ল্যাটটা ... কলিং বেল , মৃদুলা ফিরলো বোধহয় ... হ্যাঁ , মৃদুলাই । বাবান ফোন করেছিল ? হাঁপাচ্ছে মৃদুলা সোফায় বসে । ফ্রিজ খুলে জলের বোতল এনে দিলেন মনিনাভ , আগে একটু জল খাও ... মেয়েটা এভাবে আমাদের ছেলেটাকে ধোঁকা দিলো ? ...পারলো কি করে , কি করে ...আমরা কেউ ওকে চিনতে পারলুম না ... মৃদুলার হাহাকার ঘুরে বেড়াচ্ছে ফ্ল্যাটে ... আজ দুপুরে দুজনেই একটুও খেতে পারেননি , বাবান আর মুনমুন আজ দেখা করবে । দু পক্ষের উকিলও সাথে থাকবে । বাবান বলেছিল কি হোলো না হোলো জানিয়ে দেবে ফোন করে ... বাবানের ফোনও আসেনি , দুশ্চিন্তায় ঘরবার করছেন মৃদুলা । মনিনাভ ডাকলেন মৃদুলাকে এক কাপ চা করে দেবে ? অসম্ভব মাথা ব্যাথা করছে ... কেন যে বাবান ফোন করছে না ... ওই ফোন বাজছে ! ফোন বাজছে ! প্রায় দৌড়েছেন মনিনাভ , না বাবান তো নয় , ডঃ মল্লিক ! এই সময়ে ডঃ মল্লিক , পাশে দাঁড়ানো মৃদুলাকে বললেন মনিনাভ , মৃদুলাও অবাক 

হ্যালো , বলুন ডঃ মল্লিক , কি ব্যাপার ? আপনি কি কিছুই জানতেন না , এই ছেলেকে আপনি বিয়ে দিলেন কোন সাহসে ? ছিঃ ছিঃ , শর্মিষ্ঠা ,মা মরা অমন মিষ্টি একটা মেয়ে , তার জীবনটা আপনারা এভাবে শেষ করলেন ? ...সরলতার সুযোগ নিলেন মেয়েটার ? আবার চরিত্রহীনতার চার্জ এনেছে আপনার সুপুত্র ? ...আপনি আমার পরিচিত বলে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে ... কোন প্রশ্ন করতে সাহস পাচ্ছেননা মনিনাভ । ডঃ মল্লিক প্রায় চিৎকার করছেন ওপাশে , ডোন্ট উ নো ইয়োর সান ইজ ইম্পোটেন্ট ? মিথ্যে প্রেমের অভিযোগ এনে মেয়েটাকে এখন বদনাম করছে ... আপনি কিছুই জানেন না ... বাপ মা হয়ে জানেন না , বিয়ের আগে সে নিজেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে আলোচনা করেছে তারপর ডাক্তার মানা করা সত্ত্বেও আপনার ছেলে পুরো ব্যাপারটা লুকিয়ে বিয়ে করেছে ......সন্দীপের মেডিকেল রিপোর্ট এখন আমার হাতে ... ওকে জানিয়ে দেবেন সামনে কি অপেক্ষা করছে ও ধারনাও করতে পারছে না ... এখন শক্ত থাকতে হবে মনিনাভকে । শান্ত হাতে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন , ...মৃদুলা উৎকণ্ঠ , উদগ্রীব । মৃদুলার হাত ধরলেন , শোনো একটা কথা ,শান্ত হয়ে শোনো , আমরা এতদিন ছেলের মা বাবা ছিলাম , আজ থেকে আমরা একটা মেয়ের মা বাবা হবো ... শুধু একটা মেয়ের বাবা মা , তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলছি ? .........শুধু মেয়ের ......শুধু মেয়ের ... তুমি পারবে তো মৃদুলা

... মনিনাভ স্পষ্ট শুনতে পারছিলেন অনেক দূরে একটা ঝর্ণা হেসে গড়িয়ে পড়ছে ... শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি । মৃদুলাও ।


ভাগ্য


সূর্য ভট্টাচার্য

         
এক নাগাড়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছিল, ট্রেনের গতিতে মনে হচ্ছিল যেন বেশ জোরেই পড়ছে। উদাসভাবে তাকিয়ে ছিল নীলেশ জানলার বাইরে। বৃষ্টির ছাঁট পড়া ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে একঘেয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য। সামনের সিটে বসে রামকানাই। দু'জনে অল্পপরিচিত, ট্রেনেই আলাপ। আজ কিন্তু রামকানাইও চুপচাপ। বাদলা দিনের বিমর্ষ মেজাজের সঙ্গে ট্রেনটার দুলকি চাল বেশ মানিয়ে গেছিল

- 'বউ কাল আমাকে ছেড়ে চলে গেছে', রামকানাই হঠাতই বললো, দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নীলেশ চমকে উঠলো। তার সঙ্গে রামকানাইয়ের বয়সের বেশ খানিকটা ফারাক আছে, কিন্তু একি সমাপতন? কাল মিনতির সঙ্গে তারও তো ডিভোর্সের ফয়সালা হল।

- 'আমিও কাল ডিভোর্স পেয়ে গেছি, রামকানাইদা’

- 'ওঃ, আর কোনো উপায় ছিল না ?'
- 'নাহ ' নীলেশের আর বিস্তারিত কিছু বলার ইচ্ছে হল না। নীরবতায় কাটল কিছুক্ষণ তারপর রামকানাই নীরবতা ভাঙ্গলো, 'এক একটা সময় এ'রকম আসে, বুঝলে? যখন কিছুই ঠিক চলে না। হপ্তাখানেক আগেই আমার হাজারখানেক টাকা হারালো এই ট্রেনেই, পকেটমার হয়ে।' এই বলে জুতোটা খুলে তার ভেতর হাত ঢুকিয়ে কি দেখতে লাগলো।
- 'আপনার ভাগ্যের সঙ্গে আমার বেশ মিল দেখছি তো গতমাসে আমিও আমার হ্যান্ডব্যাগটা বাসে ভুলে এসেছিলাম 'আষ্টেক টাকা ছিল তাতে।'- 'আর পাওনি নিশ্চই ?'
- 'প্রশ্নই ওঠে না। জুতোর ভেতর কি দেখছ, রামকানাইদা?'
- 'আর বোলো না। নতুন জুতোয় এমন মোক্ষম জায়গায় একটা পেরেক উঠেছে ' এবার সত্যিই অবাক হল নীলেশ। পনের দিন আগে কেনা তারও জুতোর সুকতলা খুলে এসেছে, সামনের দিকটা।
- 'অদ্ভুত ব্যাপার রামকানাইদা, এই দ্যাখো আমার জুতোর অবস্থা। জাস্ট পনের দিন হয়েছে বোধহয় কিনেছি।'
- 'সব কিছু সহ্য করা ছাড়া কোনো গতি নেই। আর সব খবর ভালো তো ?'
- 'আর ভালো। সাংসারিক এই ঝামেলা, তার ওপর মেয়েটা পরীক্ষা দিতে পারল না, ম্যালেরিয়া হয়ে। আমারও গ্যাস্ট্রিকের অম্বলটা এমন জায়গায় পৌঁচেছে...।'
- 'আর বোলো না ভাই, আমার ব্রংকাইটিসটাও ক্রনিকে দাঁড়িয়েছে। ছেলেদের পড়াশুনো নিয়েও চিন্তার শেষ নেই। বড়টির এখনও তো কিছু হল না, ছোটটাও এবার পাশ করতে পারে নি...।'

         ট্রেনটা একরকমভাবে চলছিল, থামছিল। নীলেশের মুখটা তেতো লাগছিল। দু'জনেই নেতিবাচক অলোচনায় যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। হঠাত নীলেশ লক্ষ করল রামকানাইয়ের পাশে বসা বুড়ো লোকটি নিজের মালগুলো বের করে গুছিয়ে নিয়ে তার দিকে হাসি-হাসি মুখে চেয়ে আছে। নীলেশের সাথে চোখা-চোখি হতে বললেন, 'আপনাদের কথা সব শুনছিলাম।' নীলেশ ও রামকানাই দু'জনেই অপ্রসন্ন চোখে তার দিকে চাইল। - 'আপনাদের দুর্দশা সত্যিই দঃখজনক। অথচ আমার অবস্থা দেখুন। এই বয়সে আবার দার পরিগ্রহ করেছি।' বুড়ো চোখ টিপে হাসলো, তারপর বলল, 'আর এই তো কদিন হলো এক হাজার টাকা জিতেছি লটারিতে।' দু'জনের হিংসের দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা বুড়ো বলে চলল, 'আমার পায়ে এই যে জুতোটা দেখছেন, গত চার বছর ধরে একটানা পরছি, দেখে বোঝা যায় ? দুই ছেলেই প্রতিষ্ঠিত, নাতি-নাতনীরাও প্রতি বছর ভালো রেজাল্ট করছে। আর শরীরও আমার বেশ ফিট। এই শ্রাবনে বাহাত্তর পুরো হল, লাষ্ট কবে মাথা ধরেছিল তাও মনে পড়ে না।...এই যে আন্দুল এসে গেছে, আচ্ছা, আমি চলি।' এই বলতে বলতে বুড়ো নেমে গেল। ট্রেনও আবার ছেড়ে দিল।

- 'আন্দুল বেরিয়ে গেল ? যাঃ, আমি এক স্টেশন বেশি চলে এসেছি।' রামকানাইয়ের খেদোক্তি।
-'আর আমি দু'স্টেশন, রামকানাইদা। 'নীলেশ দীর্ঘশ্বাসফেলল।

*একটি রাশিয়ান গল্পের ভাবানুবাদ।



দেবাশীষ মজুমদার

এই খেলাটা ভালোই রপ্ত করেছে বক্কর। এসব শুরু হলেই সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়, প্রথম দিকে কিছুটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়, কত আর পাঁচ বড়জোড় দশ মিনিট, এরপর আর কোন সমস্যা হয়না। বাবা মা এর দেয়া পুরো নাম ছিল মোঃ আবু বক্কর। একটা চোখ নাই তাই কানা বক্কর ডাকে লোকে। নতুন লোকের সাথে পরিচয় হলে বক্করও মাঝে মাঝে নিজেকে কানা বক্কর নামে পরিচয় দেয়। এতে মাঝে মাঝে বেশ একটা ভাব আসে। অনেকে সমীহ করে কথা বলে।
কানা বক্করের গড়নটা খুব সাদামাটা, উচ্চতা ৫ ফুট, গায়ের রং শ্যামলা, মাথায় অল্পকিছু কাঁচাপাকা চুল এখনো অবশিষ্ট থেকে জানান দিচ্ছে এই মাথা ভর্তি একসময় চুল ছিল। তার উপরের পাটির সামনের দিকের দুটো দাঁত আধভাঙ্গা। এই নিয়ে তার দুঃখের সীমা নাই। দাঁত ঠিকমতো থাকবেনা এইটা একটা কথা! দাঁত না থাকলে মানুষের দাম থাকে নাকি, হাসলে কি বেআক্কেলের মতো দেখায়তার দাঁত অবশ্য ছিল, দুই বছর আগে একটা ঘটনা ঘটলো। সেইবার উত্তর পাড়ায় অপারেশনটা করতে গিয়েই দাঁতটা হারাতে হলো।

বক্কর এসবে খুব এক্সপার্ট, আজকাল তার ভুল হয়না বললেই চলে, এখনতো আবার ট্রেনিংও দেয়। তার অনেক সাগরেদ আছে। সেই ঘটনার পর থেকে বক্কর অপারেশনে মেয়েদের মুখের দিকে তাকায় না। আগেও তেমন তাকাতোনা, কিন্তু সেদিন যে কি হল! মেয়েটার মুখ অবিকল কুসুমের মতো। কুসুমও ওইভাবে মাথার উপর ডান হাত ভাঁজ করে রেখে ঘুমাতো। এরপর কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল বক্কর, কয়দিন আগেই লঞ্চঘাটে দেখা কুসুমের মুখটা মনে ভেসে উঠছিল বারবার। এই কাজ অনেকবার ছেড়ে দিতে বলেছিল কুসুম। পারেনি বক্কর। বাচ্চাটা মারা যাবার পরে তাই লেইস ফিতাওলা ইদ্রিসের সঙ্গে চলে গেল। এইসব ভাবতে গিয়েই কেমন যেন মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। হাতে লেগে একটা কাঁচের কি যেন পরে চুরমার। থাক এই গল্প আরেকদিন হবে। তবে দাঁত বক্করের খুব প্রিয় জিনিস। সে প্রতিদিন দুইবার নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজে। আর এই প্রতিদিনই ওই ভাঙ্গা দাঁতদুটো তার বুকে জ্বালা ধরায়। আর তখনই ওই দাঁতের ফাঁক দিয়ে কুৎসিতভাবে থুতু ছিটায়। বক্করের ডান পাটা একটু বাঁকা, সেইটাও আরেক অপারেশনের ঘটনা। ওইসব নিয়ে সে আর অতো ভাবেনা, হাত-পা ভাঙ্গা তার কাছে এখন ডাল-ভাত। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বন্ধ চোখটা একটু খুললো সে। আজকের পরিস্থিতি ভাল ঠেকছেনা তার। অন্যদিন এতক্ষনে সবকিছু ঠান্ডা হয়ে আসে। মানুষের উৎসাহে কিছুটা ভাটা পরে। অথচ আজ তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেল, তারপরও চারিদিকে বেশ ভিড়। ঘটনা কী? বক্করের দুই হাত পিছন দিকে বাঁধা, গায়ের লুঙ্গিও প্রায় খুলে গেছে। ধরা পরবার পর পরই মার শুরু হল। কিল, ঘুষি, লাথি, চর-থাপ্পর; যে যেটা মেরে খুশি হয়। বক্করের এসবে খুব একটা আপত্তি নেই। আহা মারুক না মানুষগুলো,কতো কিছুর রাগইনা তার উপর ঝাড়ে। কতো কষ্ট মানুষের, তাকে মেরে যদি একটু আনন্দ পায় ক্ষতি কি! প্রথম পাঁচমিনিট ব্যথা লাগে বক্করের, তারপর সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়, তখন আর ব্যথা মালুম হয়না। চোখ বন্ধ করলেই শুরু হয় ঝি ঝি পোকার ডাক, ওই ঘোরের মধ্যেই বক্কর দেখতে পায় কুসুমকে, তার কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। হাতপাখা দিয়ে তাদের বাতাস করছে বক্কর। এই ঘোরে একবার ঢুকে গেলে আর কোনো ব্যথা লাগেনা। কিন্তু আজ নিশ্চয় কোনো গোলমাল আছে। এতোক্ষনেতো সবকিছু মোটামুটি ঠান্ডা হবার কথা। বক্কর আস্তে আস্তে একটু ঘাড়টা ঘুরাবার চেষ্টা করল। আর তখনি চোখে পড়ল দৃশ্যটা, লোহা গরম করা হচ্ছে। এইবার ভয় পেল সে। এরা আজ বোধহয় তার বাকী চোখটাও তুলে নেবে। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কেন, হে আল্লাহ তোমার আশরাফুল মাখলুকাত, তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এতো নিষ্ঠুর কেন? হঠাৎ বক্করের মনে হল সে আর কুসুমকে দেখতে পাবেনা। অনেকদিন পর কান্না আসলো তার, ভালো চোখটা দিয়ে গড়িয়ে এলো জল।

ঝাপসা চোখে দেখতে পেল চারিদিকে ভিড় আরো বাড়ছে। কেউ এই চোখ তুলে ফেলার মত বিরল দৃশ্যটা হেলায় হারাতে চায়না।

কুইন অব কিং স্ট্রিট 

মৌ মধুবন্তী
               মে মাস। রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সপ্তাহের প্রথম দিন । এখনো শরীরে উইক এন্ডের আমেজ মেশানো আছে। মন টাও পাখির কিচির মিচিরে ভরা। নীল টয়োটা মাত্র একজন প্যাসেঞ্জার পাশে নিয়ে দক্ষ হাতে ছুটে যাচ্ছে হ্যামিল্টনের দিকে। বরাবরের মতই ফোর-হো-ওয়ান ওয়েস্ট। পথে  কোন সার্ভিস স্টেশান চোখে পড়ছে না। মনের কিচির মিচির থামে না। পাশের মানুষটাও খুব চেনা কেউ নয়। দুজনের উদ্দেশ্য এক। হ্যামিল্টন শহরকে কাজের শেষে কিছুটা  নতুন উদ্যমে উপভোগ করা।

গাড়িতে গান বাজছে। ক্যারি আন্ডারউডের হোয়েনেভার ইউ রিমেম্বার এলবাম থেকে হোয়েনেভার ইউ লুক ব্যাক ওন টাইমস ইউ হ্যাড”—মিরঞ্জার সুবিধা হল জুকার বেশী কথা জানতে চাইবে না তার জীবন নিয়ে। চঞ্চল সে ; কিন্তু চাপা স্বভাবের মেয়ে। গানের প্রতিটি শব্দ  তার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে তানপুরা বা পিয়ানোর মত ঝংকার তুলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া কিছু মিষ্টি দিনের দিকে মন ফিরে তাকাতে থাকে। তবু সে বর্তমানের মাঝেই নিজেকে প্রবহমান রাখতে সচেষ্ট হয়।

-জুকার, কেন তুমি গানটায় ঠোট মিলাচ্ছ না?
জুকার বেশ হকচকিয়ে গেল।  নড়ে চড়ে বসে হেঁড়ে গলায় একটা শব্দ উচ্চারণ করেই থেমে গেল। মিরঞ্জা জানতেও পারলো  না, জুকার কেন গানটা গাইলো না। জুকার এক সময়ের তুখোড় গিটারিস্ট , উদাত্ত গলায় সে হাইওয়েতে গাড়ি চালাতে চালাতে তার গানে গাড়ির চাকার মাথা গরম করে দিত। সে আজ নীরবে গান থামিয়ে দিল।
মিরঞ্জার গাড়ি এখন একশ বিশেই চলছে। ফোর-ওহ-ওয়ান এ। এই হাই ওয়ের আসল নাম হলো, কিংস হাইওয়ে ফোর-ওহ-ওয়ান। চারশ সিরিজের রাস্তার  একটা। এই রাস্তার অফিসিয়াল নাম হলো ম্যাকডোনাল্ড কার্টিয়ার ফ্রি ওয়ে। স্থানীয় ভাষায় বলা হয়। ফোর-ওহ-ওয়ান অন্টারিও প্রভিন্সে এই রাস্তার দৈর্ঘ হলো মোট আতশ সতের দশমিক নয় কিলোমিটার। এই হাইওয়ে শুরু হয় কিবেক থেকে মাঝে টরন্টো ভেদ করে সোজা গিয়ে শেষ হয় উইন্ডসরে । পৃথিবীর অনেক প্রশস্ত ও বিজি হাই ওয়ের মধ্যে ফোর-ওহ-ওয়ান ও একটা। যেমন এই মুহুর্তে মিরঞ্জা, সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষ চিন্তায় ও কাজে। গাড়ি ছুটছে সাঁ সাঁ গতিতে। পথের সাথে সাথে গাড়িতে গান বদলে যাচ্ছে ।

 -আমি সার্ভিস স্টেশান এ একটা ব্রেক নেব, তোমার ওয়াস রুমে যেতে হলে ফীল ফ্রি। ও একটু মজা করে জুকারকে হালকা করতে চাইল।
-আই জাস্ট হ্যাড ইট আওয়ার এগো। ম্যান ডাজনট গো টু ওয়াস রুম সো ফ্রিকোয়েন্টলি।
মিরঞ্জা বাঁকা চোখে তাকালে জুকার হাসার চেষ্টা করলো, কিন্তু মন খুলে হাসলো না। অতীত বুঝি কখনো কখনো এমনি করেই চেপে রাখে সকল হাসির খোলা জানালা। গাড়ি ফোর-ওহ ওয়ান ওয়েস্ট থেকে এক্সিট নিয়েঙ্গড়াতে থাকে ফোর-ওহ-থ্রি ওয়েস্টে। ফোর-ওহ-থ্রি ওয়েস্টে উডস্টক ও মিসিসাগার  পেট চিরে নতুন পথে যাত্রা শুরু । ফোর-ওহ-থ্রী  নতুন রাস্তায় গাড়ি চলে প্রায় বাইশ কিলোমিটার।  বাইশ বছর আগের অতীত  জুকার তার স্মৃতির মাঠে  নামিয়ে দিয়ে মনে মনে হা-ডু-ডু খেলছে। মিরঞ্জা জানতেও পারছে না কে আছে জুকারের স্মৃতির মাঠে। কতকাল ধরে এই স্মৃতির ছায়ায় জুকার বাস করছে? কেবল জুকার জানে।
-কোন এক্সিট তোমার পছন্দ?  ততক্ষণে গাড়ি ফোরও থ্রি থেকে বিদায় নিয়ে হ্যামিল্টনের উদ্দেশ্যে উঠে যাচ্ছে কিউই ডাব্লিউ কোলে। চলছে পশ্চিমের দিকে গাড়ি। দুইধারে মে মাসের পাতাহীন গাছ। ধুসর আবহ। শীত এখনো কোল ঘেঁষে বসে আছে। কবে কোল থেকে নাম্বে কে জানে। প্রতি বছর আবহাওয়া ভিন্ন মাত্রা নিচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং  এর প্রভাব।
-এক্সিটের কি রঙ বা আকৃতি আলাদা নাকি যে পছন্দ করতে হবে?
- সামনের যে বিমভিল এক্সিট তাতে একটা সুন্দর টীমহর্টনস আছে, তাই বলা। চাইলেকথা শেষ হলো না, এক্সিট টা ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ।

মিরঞ্জা ততক্ষণে গাড়ী  কিউইডাব্লিউ থেকে ওন্টারিও স্ট্রীট, বিমস ভিলের র‍্যাম্প থেকে ফুল  স্পীডে টান দিয়েছে বাদামী রঙ এর বিল্ডিং এর উপরে লেখা টিম হর্টনসের দিকে। গাড়ি পার্ক করেই টয়োটাকে সে বললও, টেক রেস্ট। লেট মি পি এন্ড হ্যাভ  আ কফি। ক্লিক, দূর থেকে রিমোর্ট চাপ পড়ে। দরজা লক ।  ওয়াস রুম থেকে রিফ্রেশ  হয়ে এসে মিরঞ্জা অর্ডার দিল । হ্যালাপিনিও ব্যাগল উইথ বাটার আর ১  ডলার ডিলের ক্যাফে মোকা। জুকার নিল চীজ ক্রোস্যান্ট আর ১ ডলার ডিলের ক্যাফে ল্যাট্টে।
এইজন্যই টিম হর্টন এতো জনপ্রিয়।
কুইক সার্ভিস।
মজার সব খাবার।
রকমারি কফির বাহারি।
দামে সস্তা। কোনায় কোনায় এখন ব্যাঙ’এর ছাতার মত গজিয়েছে এই টিম হর্টনস।
         গাড়িতে উঠেই শ্যাল গ্যাস ষ্টেশানে গেল সে গ্যাস নিতে। গ্যাস নিয়ে বিল দিতে গিয়ে মনে হল ভাগ্য পরীক্ষা করার যাক। সামনের শুক্রবারে লোটো ম্যাক্স পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার। ইউথ এঙ্কর, মিরঞ্জা তার দীর্ঘ দিনের প্রিয় কিছু নাম্বার ছক কেটে কাগজটা বাড়িয়ে দিল কাউন্টারে। জুকার জানলো না তার ভাগ্য আজ এই লটারির টিকেটে জমা পড়েছে।

         উনিশশ ষাট সাল। টিম হর্টনস যখন প্রথম ওপেন হয়। কফি টাইমের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারে নি বলা যায়। প্রায় মরে গেছে কয়েক বছরের মধ্যেই। সবাই কি আসলেই মরে? কবি লেখক ও ব্যবসায়ীরা আসলেই মরে না।
- জুকার, তুমি যে কফি পান করছ টিম হর্টনস থেকে সে কে তা কি জানো?
মুচকি হেসে জুকার বলতে শুরু করে। আমার গ্র্যান্ড ফা জন্মেছে কোসরেন, অন্টারিও  তে। তা থেকেই  কি ক্রোস্যান্ট এর উৎপত্তি? জানিনা। সেই শহরেই জন্মেছে টিম।  উনিশশ তিরিশ সালে।  হকি কানাডার একটা জনপ্রিয় খেলা। সে একজন দক্ষ ডিফেন্স হকি প্লেয়ার ।  দীর্ঘ বাইশ বছরে সে  চৌদ্দ শ ছিচল্লিশটা সিজন  গেম খেলেছিল, একশ পনের বার গোল করেছিল আর চারশো তিনবার সে এসিস্ট করেছিল গোল করতে । সব মিলিয়ে সে পাঁচশ আঠার পয়েন্ট করেছিল’
-‘তুমি কি জানো মিরঞ্জা, এই পর্যন্ত কত কাপ কফি কিনেছ এই টিম হর্টনস থেকে আর নিজে কত কাপ কফি পান করেছ’? মিরঞ্জা অবাক হয়ে শুনছে আর গাড়ির মিরর থেকে চোখ না সরিয়ে মাথা নেড়ে জানালো , না সে জানে না। কোনদিন ভাবেনি তাকে এই হিসাব জানতে হবে।
জীবনের ওসব অঙ্কের হিসাব কেউ রাখেনা, রাখলেও মেলেনা। জীবন সরল অংক নয়, তবু ফলাফল হয় শূন্য , নয় এক।
-জুকার মাই ডিয়ার, ডু ইউ নো?

কথা শেষ করতে না দিয়েই জুকার গড় গড় করে বলআ শুরু করে, কবে, কোন তারিখ থেকে সে প্রথম টিম হর্টনের কফি পান করা শুরু করেছে এবং আজ পর্যন্ত সে কত কাপ কফি পান করেছে, সব তার ডায়েরিতে লেখা আছে। একদিন সে এর হিসাব নিয়ে বসবে। কিন্তু কেন? তার ও যে সেই স্বপ্ন চোখে-মনে -চোখে, একদিন সে জুকার ক্যাফের চেইন স্টোর খুলবে-জুকার হারাতে চায় না তার চারিপাশের স্বজনদের মন থেকে।
-জুকার! তা হলে টিম হর্টনসের ইতিহাস বলো। নিশ্চয় জানো তুমি। এমন সময় সুর্য ঝলসে ওঠে পুব আকাশে। মিরঞ্জার  গাড়ি চালাতে সুবিধেই হচ্ছে , পেছনে রোদ, তাকে ড্রাইভ করছে।  সোনালি রোদের ছটা তার চুলে ঝিলিক দিচ্ছে। মাথার উপরে সান রুফ খোলা। তবু রোদের উজ্জ্বলতায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। জুকার ডেস বোর্ড থেকে সান গ্লাস বের করে পরিয়ে দেয় মিরঞ্জাকে। মিরঞ্জার মনে অদ্ভুত এক আবেশ সৃষ্টি হয়ে মেঘের মত উড়তে থাকে অজানা আকাশে।

থ্যাংকস, বলে অপেক্ষা করে ইতিহাস শুনতে। আসলে তো আমরা সারা দিন টিম হর্টনসের কফি পান করি, ডোনাট খাই, কিন্তু ইতিহাস জানি না। কে এই টিম হর্টন কেন সে এই ব্যবসায়ে এলো? রিঙ্কের বাইরে টিম একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। সে বুঝে গিয়েছিল হকি ক্যারিয়ার তাকে সারা জীবনের জন্য সাধুবাদ যোগাবে না, পেটের খাবার যোগাড় করবে না। তার শক্তি শেষ তো ক্যারিয়ার শেষ। তাই সে পথ খুঁজছিল । হকি সেলারির সাথে নতুন আয়ের পথ। অনেক বছর ধরে সামারে সে সাইড বিজিন্যাস করবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে কফি আর ডোনাট নিয়ে পড়লো। এর ফাকে সে ক্যাফে ল্যাট্টে তে চুমুক দিচ্ছে আর ক্রোস্যান্ট  এ কামড় দিচ্ছে।  গল্প বলতে গিয়ে সে গভীরে ডুবে যাচ্ছে। এর মাঝে মিরঞ্জা তার ভিউ মিরর ঠিক করে নিল। পাশ দিয়ে একটা বড় ২৬ ফিটের লরি দ্রুত গতিতে যাবার সময় হংক করে গেল। কেন করলো, মিরঞ্জা ভেবে পেলো না। পরে বুঝলো, সে খুব আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিল। হাইওয়েতে স্পীডের একটা নিম্নসীমা থাকে । তার নিচে গেলে  হাইওয়ের ফ্লো নষ্ট হতে বাধ্য। মিরঞ্জা গ্যাসে চাপ দিয়ে স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে লেন চেঞ্জ করে লেফট লেনে চলে যায়। এর মাঝে জুকার নিজেকে আরেকবার তটস্থ করে নেয়।

মিরঞ্জা যখন মিউজিক সেন্টারে সিডি বদলাচ্ছে তখন অলক্ষ্যেই জুকারের হাতের সাথে হাত লেগে যায়, আর মিরঞ্জার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। মিরঞ্জা ভাবে, তবে  কি ক্যামিষ্ট্রি কাজ করছে? লোল।
হা হা হা আমি বলি, ক্যামিষ্ট্রি শুনতে বাংলায় স্বামী-স্ত্রীর মত শোনা যায়, তাই না?
ক্যামিষ্ট্রি শুরু হয় ডোনাট ও কফির জীবনে উনিশ চৌষট্টি সালে ফ্রেঞ্চাইজ আকারে।  কানাডার প্রথম প্রিমিয়ার যেমন  হ্যামিল্টনে বসবাস করতো, তেমনি টিম হর্টনস ও শুরু হয় হ্যামিল্টনে। উনিশশ সাতষট্টি সালের মধ্যে তিনটে স্টোর ওপেন হয়। মিরঞ্জা হেসে দিয়ে বলে, তুমি ইতিহাসে দারুণ ভালো মার্ক পেয়েছ বুঝি? এই টিম হর্টনসের প্রথম পার্টনার হলো প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। হা হা হা টিম বুঝি ভয় পেয়েছে? তার নিরাপত্তা বিধান করেছে প্রাক্তন পুলিশকে পার্টনার করে। আর কেউ কি ছিলহ্যাঁ ছিল রণ জয়েস বলে আরেক জন পার্টনার ছিল। আর সিগনেচারটা টিম হর্টনেরই নামে প্রোজ্জ্বল হয়ে থাকে ।

-ইট বিকেম আ প্রমিন্যান্ট ফিক্সার ইন দা কানাডিয়ান ল্যান্ডস্কেপ।
মিরঞ্জা এবার  অতি উৎসাহে বলে উঠলো, হে চলো, তা হলে আজকেই টিমের সাথে দেখা করব। আমার কাজ তো মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা। তারপর তো আমরা কেবল সময় কাটাব হ্যামিল্টনে। হ্যাঁ ঠিক আছে বলে জুকার চুপ করে থাকে।
গাড়ি চলতে থাকে । স্পীডের কাটা এখন একশ বিশ কিলোমিটারের ঘরে।  সিডিতে গান বাজছে  

মিরঞ্জার সামনে ওয়েস্ট ম্যানেজম্যান্টের গাড়ি। জুকারের ভালো লাগছেনা। কিন্তু মিরঞ্জা কেমন যেন উদাসীন। বড় বিচিত্র। দুটো মানুষ পাশাপাশি বসে থেকেও কত দূরের কথা ভাবে বা হারিয়ে যেতে পারে অনায়াসে নিজস্ব অতীতে। বর্তমানের চেয়ে অতীত তখনই বেশী প্রধান হয়ে ওঠে যখন বর্তমান মনের মধ্যে কোন বাঁধন না থাকে। দুইজন যাত্রী।  একই গাড়ীতে । কেবল একটা গিয়ার সেটআপের দূরত্বে বসে বসে কত কি আকাশ পাতাল ভাবছে। কেউ জানে না , কারো মনের খবর। মন কোথায় থাকে? এই প্রশ্ন আমি সব সময় জিজ্ঞেস করি, উত্তর মেলেনা।

মিরঞ্জা অকারণেই লেন চেঞ্জ করছে বারে বারে, এই দেখে জুকার জিজ্ঞেস করলো। মিরঞ্জা তোমার কি ঘুম পেয়েছে? মিরঞ্জা মাথা নেড়ে জানালো , না। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে জুকারের চোখে চোখ রেখে বললো, আমি গাড়ি চালাতে গিয়ে কোনদিন ঘুমাই না। কেন এই কথা বললে?
তুমি বারে বারে লেন চেঞ্জ করছিলে।
অভ্যেস। ভালো লাগে। বোরিংনেস কেটে যায়। ভাবছি টিমের কথা। কি করে মানুষ এক ক্যারিয়ারে থেকে আরেকটা বিরাট ভবিষ্যতের কথা ভাবে পারে। আমি তো পারিনা।
তুমি যা পারো, তা অনেকেই পারেনা।
মিরঞ্জা হেসে দিল।

মিরঞ্জার গাড়ি হাতের ডানদিকে ব্রেনফোর্ড  এর রাস্তা  রেখে কিউইডাব্লিউ এর উপর দিয়ে চলছে পশ্চিম মুখী। যদি  ও দূরত্ব মাত্র এক ঘণ্টার, কিন্তু সকালে অফিস ট্রাফিকের কারণে গাড়ি প্রায় থেমেই যাচ্ছে। হাতে অনেক সময় আছে। এই ট্রাফিকের কথা ভেবেই মিরঞ্জা অনেক সকালেই যাত্রা শুরু করেছে। হঠাৎ মিরঞ্জার মনে হলো কাজে না গিয়ে এক্সিট নিয়ে ব্রেন্টফোর্ড ঢুকে লেক অন্টারিওর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। টরন্টো থেকে শুরু করে হ্যামিল্টন পর্যন্ত পুরো পথটাই লেক অন্টারিওকে হাতের বা দিকে রেখে এগিয়ে গেছে। হ্রদ আর হৃদয় যমজ দুই স্বত্বা। মিশে আছে এক হয়ে। দুই-ই গোল, আবার গোলমাল নয়। একজন স্থলের মধ্যে বাস করে আরেকজন দেহের ভেতরে বাস করে। ট্রাফিক কিছুটা  হাল্কা হয়েছে গাড়ির স্পীডের কাটা এখন প্রায় পঁচাত্তর কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই করছে। হাই-ওয়েতে কে এতো অল্প স্পীডে গাড়ি চালাতে পছন্দ করে? এমন যৌবনে কেউ নয়।  লেকের আকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে এবার গাড়ী কিছুটা বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে  হ্যামিল্টনের পথে ছুটছে। লেকের পাড় ঘেঁষে ড্রাইভ করবার অনাবিল এই আনন্দ যে ড্রাইভ না করেছে সে কি করে জানবে?

-জুকার তুমি কি এই পথে ড্রাইভ করেছ?
-এপ্রক্সিমেটলি টু হান্ড্রেড টাইমস।
-ওয়াও!
ছোট ছোট কথা বার্তার মধ্যেই মিরঞ্জা মেইন স্ট্রিটে এ এক্সিট নিতে র‍্যাম্পে গাড়ী উঠিয়ে দিয়েছে। ডাউন্টাউনের চঞ্চলতা মনকে গ্রাস করে ফেলেছে। মেইন স্ট্রিট থেকে কিং স্ট্রীটে এ  টার্ণ নিতে সে রাইট সিগনাল অন করে দিয়েছে।

-      ম্যাজিক জুকার, যখন আমি কাজ করব, তুমি টিমহর্টনসে বসে, ইট প্রেএন্ড লাভ এই বইটা পড়তে পারো। আমার গাড়ির পেছনের সীটে আছে বইটি। এলিজাবেথ গিলবার্টের বই।
-      জুকার সোৎসাহে পেছনে তাকালো। বই পড়া তার ছোটবেলাকার অভ্যেস। একবার বই হাতে পেলে সে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে যায়।
-      মিরঞ্জা এসে তার অফিসের সামনে দাঁড়ালো। স্যোসাল ওয়েলফেয়ার অফিস। এখানে একটা স্পেশাল
কেইস নিয়ে তাকে এডভোকেসী করতে হবে। সিস্টেমের গণ্ডগোলের শিকার হয় সহজ ও সত্য কথা বলা মানুষগুলো। তার ক্লায়েন্ট বলেছিল ওয়েল ফেয়ারকে, তার বোন তাকে এই মাসে পাঁচশ ডলার গিফট পাঠিয়েছে তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে। ব্যস এই মাসে তাকে কোন চেক দেয়া হবে না। এমন ফ্যাসাদ হর হামেশাই ঘটছে। না বললে কোন দোষ নেই। তাই মানুষ করাপ্টেড হতে বাধ্য হয়।

যতক্ষণ মিরঞ্জার কাজ ছিল, জুকার বই পড়ছিল  টিম হর্টনসে বসে।  এক কাপ কফিও সে অর্ডার দেয় নাই। মাঝে মাঝে কাউন্টার থেকে একটা মেয়ে দেখছিল তাকে, টিম হর্টনসে এসে কেউ কফি না নিয়ে বসে বই পড়তে পারে, এমন ঘটনা বিরল। কারন কফি হলো নেশার মত ।  জুকারের কিছুতেই নেশা নেই। মেয়েটা জানে না।
মিরঞ্জার বিচিত্র সখের মধ্যে এটি একটি। যখনই সে লং ডিস্টেন্সে কাজে যায়, সাথে একজন কাউকে তার  চাই। এই চাওয়া থেকেই কাজের জায়গায় আগের পরিচিত  জুকার কে সে আহবান জানায় তার সাথী হতে সেদিন। জুকার বেচারা চাকুরী হারিয়েছ কয়েকদিন আগে। এই বেকার জীবনে ঘরে বসে টিভি না দেখে একটু বেড়ালে ক্ষতি কি? তবে সে বেশ নাজুক প্রকৃতির লোক।

সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসে একটা সেমিনার চলছে। সেখানে একজন হাল্কা পাতলা ইয়ং মেয়ে বলছে, নির্যাতন ঘরে বাইরে! কারা এর শিকার? যে কোন দুর্যোগে কিংবা আক্রোশের প্রধান শিকার নারি ও শিশু। সেখানেও কিছুটা তারতম্য দেখা যায়। শিশুদের ভেতরে নারী শিশু বা মেয়ে শিশু যাই বলিনা কেন সেই বেশীর ভাগ নির্যাতনের শিকার হয়। পরিবারের এবং সমাজের দায়ভারের ক্ষেত্রেও সেই নারী ও শিশু নারীকেই বেশির ভাগ অংশ বহন করতে হয়। তা হলে কি দাঁড়াচ্ছে? এক পক্ষ ও প্রতিপক্ষ এবং সেই এক পক্ষের হাত ধরে আছে পুরুষ। এবার যদি প্রশ্ন করি সর্ব জান্তাকে তা হলে উত্তর কি আসতে পারে? প্রশ্ন ? এই পুরুষের উৎপত্তি কোথা থেকে? কার জরায়ু ভেদ করেযদি একজন নারীকেই দরকার হয়, সেই পুরুষের জন্মের জন্য, তা হলে এই নারীর উপর খড়গ উঠে কি করে? ঘরেঘরের বাইরে, কর্মক্ষেত্রে। এই আলোচনায় দুটো দিক আলাদা করে দেখাতে হবে। একঃ কখন থেকে নারী শ্রম কারখানায় বা অফিস আদালতে অভ্যুথান তৈরী করেছে? দুইঃ কখন থেকে  উন্নত বিশ্বে তথা পশ্চিমা দেশে ও  অর্থের বিনিময়ে শিশু শ্রম শুরু হয়েছে । এই দুই ইতিহাস যদি জানতে পারি, তাহলে বর্তমান বিশ্বে, এই শিশু ও নারী শ্রমের যে অবকাঠামো আজকে বিস্তৃত আছে তার একটা চিত্র পাওয়া যেতে পারে।  কথাগুলো মিরঞ্জার কানে আঠার মত লেগে আছে। ভাবছে আজকে রাতেই সে একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলবে এর উপরে। তার চারিপাশে যা কিছু ঘটছে তার থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জড়ো করলেই একটা সাবলীল প্রবন্ধ লেখা হয়ে যাবে।

কাজ শেষে মিরঞ্জা এসেই বলছে, জুকার লেটস গো। আই ওয়ান্ট টু মিট উইথ টিম। জুকার মিরঞ্জার হাত ধরে বেরিয়ে আসে টিম হর্টোন'থেকে। তখনই তার মনে হলো, একটা কফি নেয়া উচিত এতক্ষণ এদের সুবিধা ভোগ করেছে সে। ফিরে গিয়ে দুটো ক্যাফে মোকা নিয়ে এলোগাড়িতে বসে মিরঞ্জা তার টেক্সট ম্যাসেজ চেক করছিল। অনেকগুলো ম্যাসেজ জমা হয়েছে। সবই অফিসের বসের। আজকাল বসরাও  ফোন না করে টেক্সট ম্যাসেজ পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ভাবছে সে আগে উত্তর দিয়ে পরে যাবে। তাই ব্যস্ত হয়ে রইলো। জুকার ক্যাফে মোকা পাশে রেখে গাড়ীর বাইরে অপেক্ষা করছে।

টেক্সট ম্যাসেজ শেষ করে সে তাড়া দিল। জুকার লেটস গো। গাড়িতে বসে জুকার বললো, চলো ডানদিকে। এই করে জুকার তাকে নিয়ে গেল  হ্যামিল্টনের ডানডার্ণ ক্যাসেলের দিকে। সেখানে সুন্দর একটা পার্ক আছে। পার্কে বসে জুকার বললো, মিরঞ্জাসেটা ছিল ফেব্রুয়ারি মাসে একুশ তারিখ। ১৯৭৪ সাল। টিম হর্টনস তর তর করে বাড়ছে। সেদিন টিম বাফ্যালোর ম্যপল লীপ গার্ডেন  থেকে খেলা শেষ করে ফেরার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে । তুমি কি  জানো সে একজন দক্ষ ডিফেন্সম্যান ছিল ন্যাশানাল হকি লীগের ব্লু লাইনে । সেদিন আমার মা বাবা সারা দিন না খেয়ে ছিল।  বাফ্যালো সাব্রেজ তার দুই নাম্বার সোয়েটার  থেকে রিটায়ার্ড করেছে টিমের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। সেই সময় টিম হর্টনসের সংখ্যা ছিল ৪০টার মত।
আজকে তিন হাজারের উপরে রেস্টুরেন্ট আছে কানাডায় আর ছয়শএর বেশী আছে আমেরিকায়। সেদিন ছিল ডোনাট আর কফি। মনে মনে বললো, টিম এর কিছুই দেখে যেতে পারেনি। হঠাৎ মিরঞ্জা উঠে দাঁড়ায়।

দুজনেই এসে গাড়িতে বসে। মিরঞ্জা চুপচাপ। কোন কথা নেই মুখে। জুকার জানেনা মিরঞ্জা কি বুঝেছে। মিরঞ্জা গাড়িতে  স্টার্ট দিয়ে বাঁ দিকে কুইন ষ্ট্রীটে গাড়ী টার্ণ করলো। কিং  স্ট্রীটে এ ক্রস করবার আগে জুকার বললো, তার মৃত্যু আমাদের জন্য খুবই লসের। খুবই দুঃখ জনক।  মিরঞ্জা খ্যাচ করে ব্র্যাক করতে গিয়েও পারলো না।  কিং ষ্ট্রীটে এর ডান দিকে থেকে ওয়েস্ট ম্যানেজম্যান্টের ট্রাক এসে সোজা হিট করে মিরঞ্জার সাইডে।  মিরঞ্জার গাড়ি দুইবার ঘুরে গোলচক্করের বাম পাশ ঘেঁসে সোজা গিয়ে ধাক্কা খায়,ল্যাম্প পোষ্টের সাথে। মুখ থুবড়ে পড়ে  গেল গাড়ি মুহুর্তের মধ্যে।  জুকার হাতবাড়িয়ে দিয়েছে মিরঞ্জার দিকে। অস্ফুট উচ্চারণ আই লাভ ইউ। হাত ধরে দুজনেই টিমকে দেখতে  চলে গেল । কেমিস্ট্রি কি সুন্দর রিকেশান করে একটা নতুন টিম বানিয়ে দিল। টিম বরাবরের একজন দক্ষ খেলোয়াড়। এবারো জিতে নিল শেষ খেলা। 

আগেরসংখ্যাদেখুনএখানে http://galpogucchho.blogspot.in/2012/11/blog-post_7742.html