ভাগ্য
সূর্য ভট্টাচার্য
এক নাগাড়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি
পড়ছিল, ট্রেনের গতিতে মনে হচ্ছিল যেন বেশ
জোরেই পড়ছে। উদাসভাবে তাকিয়ে ছিল নীলেশ জানলার বাইরে। বৃষ্টির ছাঁট পড়া ঝাপসা কাচের
ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে একঘেয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য। সামনের সিটে বসে রামকানাই। দু'জনে অল্পপরিচিত, ট্রেনেই
আলাপ। আজ কিন্তু রামকানাইও চুপচাপ। বাদলা দিনের বিমর্ষ মেজাজের সঙ্গে ট্রেনটার
দুলকি চাল বেশ মানিয়ে গেছিল ।
- 'বউ কাল আমাকে ছেড়ে চলে গেছে', রামকানাই হঠাতই বললো, দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নীলেশ চমকে উঠলো। তার সঙ্গে রামকানাইয়ের
বয়সের বেশ খানিকটা ফারাক আছে, কিন্তু একি
সমাপতন? কাল মিনতির সঙ্গে তারও তো ডিভোর্সের
ফয়সালা হল।
- 'আমিও কাল ডিভোর্স পেয়ে গেছি, রামকানাইদা’।
- 'ওঃ, আর কোনো উপায় ছিল না ?'
- 'নাহ ।' নীলেশের আর বিস্তারিত কিছু বলার ইচ্ছে হল না। নীরবতায় কাটল
কিছুক্ষণ । তারপর রামকানাই নীরবতা ভাঙ্গলো, 'এক একটা সময় এ'রকম আসে, বুঝলে? যখন কিছুই ঠিক চলে না। হপ্তাখানেক আগেই আমার হাজারখানেক টাকা
হারালো । এই ট্রেনেই, পকেটমার হয়ে।' এই বলে
জুতোটা খুলে তার ভেতর হাত ঢুকিয়ে কি দেখতে লাগলো।
- 'আপনার ভাগ্যের সঙ্গে আমার বেশ মিল দেখছি তো । গতমাসে আমিও আমার হ্যান্ডব্যাগটা
বাসে ভুলে এসেছিলাম । শ'আষ্টেক টাকা ছিল তাতে।'- 'আর পাওনি নিশ্চই ?'
- 'প্রশ্নই ওঠে না। জুতোর ভেতর কি দেখছ, রামকানাইদা?'
- 'আর বোলো না। নতুন জুতোয় এমন মোক্ষম জায়গায় একটা পেরেক উঠেছে ।' এবার সত্যিই অবাক হল
নীলেশ। পনের দিন আগে কেনা তারও জুতোর সুকতলা খুলে এসেছে, সামনের দিকটা।
- 'অদ্ভুত ব্যাপার রামকানাইদা, এই দ্যাখো আমার জুতোর অবস্থা। জাস্ট পনের দিন হয়েছে বোধহয়
কিনেছি।'
- 'সব কিছু সহ্য করা ছাড়া কোনো গতি নেই। আর সব খবর ভালো তো ?'
- 'আর ভালো। সাংসারিক এই ঝামেলা, তার ওপর মেয়েটা পরীক্ষা দিতে পারল না, ম্যালেরিয়া হয়ে। আমারও গ্যাস্ট্রিকের অম্বলটা এমন জায়গায়
পৌঁচেছে...।'
- 'আর বোলো না ভাই, আমার ব্রংকাইটিসটাও ক্রনিকে দাঁড়িয়েছে। ছেলেদের পড়াশুনো নিয়েও চিন্তার শেষ নেই। বড়টির এখনও তো কিছু হল না, ছোটটাও এবার পাশ করতে পারে নি...।'
- 'আর বোলো না ভাই, আমার ব্রংকাইটিসটাও ক্রনিকে দাঁড়িয়েছে। ছেলেদের পড়াশুনো নিয়েও চিন্তার শেষ নেই। বড়টির এখনও তো কিছু হল না, ছোটটাও এবার পাশ করতে পারে নি...।'
ট্রেনটা একরকমভাবে চলছিল, থামছিল। নীলেশের মুখটা তেতো লাগছিল। দু'জনেই নেতিবাচক অলোচনায় যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। হঠাত নীলেশ
লক্ষ করল রামকানাইয়ের পাশে বসা বুড়ো লোকটি নিজের মালগুলো বের করে গুছিয়ে নিয়ে তার
দিকে হাসি-হাসি মুখে চেয়ে আছে। নীলেশের সাথে চোখা-চোখি হতে বললেন, 'আপনাদের কথা সব শুনছিলাম।' নীলেশ ও রামকানাই দু'জনেই অপ্রসন্ন চোখে তার দিকে চাইল। - 'আপনাদের দুর্দশা সত্যিই দঃখজনক। অথচ আমার অবস্থা দেখুন। এই
বয়সে আবার দার পরিগ্রহ করেছি।' বুড়ো চোখ
টিপে হাসলো, তারপর বলল, 'আর এই তো ক’দিন হলো এক
হাজার টাকা জিতেছি লটারিতে।' দু'জনের হিংসের দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা বুড়ো বলে চলল, 'আমার পায়ে এই যে জুতোটা দেখছেন, গত চার বছর ধরে একটানা পরছি, দেখে বোঝা যায় ? দুই ছেলেই
প্রতিষ্ঠিত, নাতি-নাতনীরাও প্রতি বছর ভালো রেজাল্ট
করছে। আর শরীরও আমার বেশ ফিট। এই শ্রাবনে বাহাত্তর পুরো হল, লাষ্ট কবে মাথা ধরেছিল তাও মনে পড়ে না।...এই যে আন্দুল এসে
গেছে, আচ্ছা, আমি চলি।' এই বলতে বলতে
বুড়ো নেমে গেল। ট্রেনও আবার ছেড়ে দিল।
- 'আন্দুল বেরিয়ে গেল ? যাঃ, আমি এক স্টেশন বেশি চলে
এসেছি।' রামকানাইয়ের খেদোক্তি।
-'আর আমি দু'স্টেশন, রামকানাইদা। 'নীলেশদীর্ঘশ্বাসফেলল।
*একটি রাশিয়ান গল্পের ভাবানুবাদ।