পলাশের সূর্য
রেল লাইনের পাশের বস্তিতে পলাশদের টালির একচালা ঘর l লাইনের কিনারায় ঘরগুলির মানুষরা তবু একটু আলো বাতাস পায়, আকাশ দেখতে পারে, কিন্তু পলাশদের বাড়িটা এমন একদিকে, যাকে চারিদিক থেকে বন্দি করে রেখেছে বিশাল উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি
l দিনের
বেশির ভাগটাই
অন্ধকার
ঘেরা,
ছায়া ছায়া
l রোদের
আঁচ পাওয়াই
যায় না বলতে গেলে
l সেজন্য
পলাশের
মনে ভারী দুঃখ
l সে
যে আলো ভালোবাসে,
রোদ্দুর
ভালোবাসে,
সূর্য দেখতে ভালোবাসে
l প্রাণভরে আকাশের নীলিমা দেখার জন্য ছটফট করে l
পলাশেরা তিন ভাই বোন l ও সবার বড় l বোনটা সবে টলমল পায়ে হাঁটে l ভাইয়ের বয়েস চার l পলাশ গত জ্যৈষ্ঠে আট পেরিয়ে ন'য়ে পা দিয়েছে l বস্তিতে ওর অনেক খেলার সাথী l বিল্টু, মনুয়া, রতন, বিশু, ভোলা, মন্টু l
বস্তির পাশের একটা ছোট মাঠে ওরা ফুটবল, খো-খো এসব খেলতো l সেই মাঠেও যেদিন দেখলো লোকেরা মাটি খুঁড়ছে, সবার মন বেজায় খারাপ হয়ে গেল l সেখানে নাকি পাঁচতলা এক ফ্লাট বাড়ি উঠবে
l ক'টা দিন খুব মনমরা হয়ে রইলো ওরা
l তারপর থেকে প্রতিদিন
না হলেও সপ্তাহে
তিন চার দিন পলাশরা
খেলতে যেত অনেক দূরে এক প্লাষ্টিক
কারখানার
পাশের মাঠে
l একদিন
একটানা
অনেকক্ষণ
খেলার পর ওরা বসে জিরোচ্ছিলো
l পশ্চিম
আকাশে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে
l মনে
হচ্ছিলো
মুঠো মুঠো সিঁদুর
জলে গুলে কে যেন ঢেলে দিয়েছে
দিগন্ত
জুড়ে
l এক
মায়াবী
আলোয় ভ'রে উঠেছে চারিদিক
l পলাশ
দু চোখ ভ'রে অপলকে চেয়ে দেখছিলো
সেই রক্তিম
আকাশের
রূপ
l বাকি
বন্ধুরা
নানা গল্প গুজবে মত্ত,
কিন্তু
পলাশ নির্বাক
হয়ে দেখছিলো
অস্তমিত
সূর্যের
শোভা
l তার
মনে পড়ে যাচ্ছিলো
বহুদিন
আগে তাদের স্কুলের
দিদিমনির
প'ড়ে শোনানো
এক বড় লেখকের
গল্পের
খানিক অংশ
l দাদু
নাতিকে
বলছেন,
সূর্য হলো এক মহান দাতা
l সে
উদিত হবার সময় যেমন আকাশকে
রাঙিয়ে
তোলে,
দিনান্তে
বিদায় নেবার সময় তেমনই নানা রঙ ঢেলে দিয়ে যায় আকাশের
বুকে
l তাঁর
সেই অজস্র দানের ছবি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীময়
l
মায়ের মুখে, বাবার ভালোবাসায়, বোনের চোখের দৃষ্টিতে,আমাদের সকলের হাসিতে মিশে আছে আছে সেই রং l ফলে-ফুলে আছে, পাখির পালকে আছে, প্রজাপতির ডানায় আছে l আমাদের স্নেহে,আদরে, ভালোবাসায় লুকিয়ে আছে সে রং l সূর্যের দেওয়া এই রঙেই পৃথিবী এত রঙিন l"
শুনতে শুনতে আবেগে চোখের কোল জলে ভরে উঠেছিল পলাশের l
দূর্বাদি বড্ড ভালো l পলাশের সবচাইতে প্রিয় দিদিমনি l গল্পটা তিনিই বলেছিলেন l পলাশের চোখে জল দেখে কাছে এসে মাথায় হাত রেখেছিলেন l দূর্বাদিও পলাশকে খুব ভালোবাসেন l বিয়ে থা করেননি l সব ছাত্রদের জন্মদিনে সুন্দর সুন্দর বই উপহার দেন l একবার জন্মদিনে ওকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অনেক ভালো মন্দ খাবার খাইয়েছিলেন l পলাশ বাড়ি ফিরে যখন মাকে সে গল্প করেছিল, মা বলেছিলেন, "আর কখনও যেও না বাবা, আমরা তো গরিব, বারেবারে গেলে হ্যাংলামো মনে হবে l"মায়ের এই কথায় পলাশ খুব দুঃখ পেয়েছিল সেদিনl দূর্বাদি একদম অন্যরকম মনের মানুষ l পলাশকে অমন ভাবতেই পারেন না !
স্কুল ছুটির পর ওর সাথে কত গল্প করেন, কি সহজ হয়ে মেশেন সব ছাত্রদের
সাথে
l
কারখানার পাশের ওই মাঠটা পলাশকে খুব টানে l যত-না খেলার জন্যে, তার চেয়ে বেশি পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্ত দেখার নেশায় l যেদিন আকাশ মেঘমুক্ত থাকে, ডিমের কুসুমের মতো টকটকে লাল সূর্য আর তার রঙের খেলা পলাশকে মোহিত করে দেয় l
একদিন মন্টু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, হ্যাঁরে পলাশ, তুই আকাশের দিকে এত হাঁ করে তাকিয়ে কী দেখিস ? পলাশ কোনও জবাব দেয় না এসব প্রশ্নের l ছোট থেকেই সে খানিক চাপা স্বভাবের l মন্টুকে সে কি বোঝাতে পারবে পশ্চিম আকাশের ওই সূর্যটা তার মনকে কতখানি রাঙিয়ে দেয় ? রোদ্দুরের রশ্মি পড়ে যখন গাছের পাতাগুলো ঝলমল করে তখন পলাশের মন কেমন দুলে ওঠে ?
পলাশ বাড়ির থেকে খানিক দূরের এক অবৈতনিক স্কুলে পড়ে l এ বস্তির আরও কিছু ছেলে মেয়ে যায় সেই স্কুলে l শুনেছে ওটাকে নাকি 'এন-জি-ও' স্কুল বলে l বিদেশর অর্থ সাহায্যে স্কুলের যাবতীয় খরচ চলে l তাদের বই খাতা টিফিন, সবই স্কুল থেকে দেওয়া হয় l তবে দূর্বাদিদিমনি সবার চেয়ে আলাদা পলাশের কাছে l দিদিমনিরা সকলেই বড়ো ঘর থেকে আসেন l তাদের পোশাক আশাক আদবকায়দা দেখেই বুঝতে পারে পলাশ l সে যখন লেখার পর খাতা দেখাতে যায়, খুব সুন্দর গন্ধ পায় দিদিমণিদের শাড়ির আঁচল থেকে l পলাশ তখন মনে মনে নিজের মাকে মেলায় এই দিদিমণিদের সাথে l মেলেনা, কিছুই মেলেনা l দিদিমণিদের হাত গুলো কেমন নিটোল, সুন্দর চুড়ি পরা l মায়ের শিরা ওঠা রুগ্ন হাতটা ভেসে ওঠে ওর চোখে l মা আয়ার কাজ করেন দুই বাড়িতে l ওর এক দূরসম্পর্কের মাসি থাকে ওদের সাথে l মা বেরিয়ে গেলে ভাইবোনদের সে-ই দেখে রাখে, খাওয়ায় l এই মাসির নাকি মা বাবা কেউ বেঁচে নেই l বিয়ের একমাস পরেই স্বামী কোথায় চলে গেছেন, আর ফেরেননি l তারপর থেকেই ওদের বাড়িতে আছেন মাসি l সারাদিন ঘরের অনেক কাজ করে যান মুখ বুজে l পলাশের মা সাত সকালে সেই যে ব্যাগে দুটো সেদ্ধভাত ভরে নিয়ে বেরিয়ে যায়, ফিরতে সেই সন্ধ্যে আটটা l ফিরে এসে স্নান করেই সবজি কুটে রাঁধতে বসে যায় l তখন মাসিকে আর কাজ করতে দেয় না মা l ফাঁকে ফাঁকে ভাই বোনকে সামলায় l বাবা একটা ছোট কারখানায় কাজ করে l মায়ের একটু আগে ফেরে বাবা l বাজার হাট বাবা-ই করে l সবজির সাথে যেদিন গোনাগুন্তি কটা মাছ আসে সেদিন পলাশদের বাড়িতে খুশির ঢেউ l আর মাসে এক দুইদিন কয়েক টুকরো মুরগির মাংস l মা যখন সেই মাংস বড় বড় আলু দিয়ে কষিয়ে রাঁধে কি যে সুন্দর গন্ধ বেরোয় l পলাশ একটা পিঁড়ি পেতে ঠায় বসে থাকে মায়ের রান্নার পাশে l মা মাঝে সাঝে ছোট একটা বাটিতে একটু ঝোল চাখতে দেয় l পলাশ এক চুমুকে সুরুৎ করে খেয়ে নেয় সেই ঝোল l মা'কে বলে, আরো কটা আলু দিয়ে দাও না মা ঝোলে l
মা ম্লান হেসে বলে, আলুরও যে এখন অনেক দাম বাবা !
পলাশের খুব কষ্ট হয় মায়ের ওই বিষণ্ণ হাসিটা
দেখে
l
একদিন ছুটির পর দূর্বাদিদি পলাশকে বললেন, মাকে বোলো আমার সাথে দুই একদিনের মধ্যে দেখা করতে l খুব জরুরি কথা আছে l পলাশ একটু অবাক হয় l সে কি কোনও অন্যায় করে ফেলেছে ? তবে দূর্বাদিদির চোখের ভাষা পলাশ পড়তে পারে l কোনও রাগের ছায়া নেই তাতে l
মা বাড়ি ফিরতেই পলাশ উত্তেজিত গলায় বলে, মা তোমার কিন্তু একদিন কাজে ছুটি করতে হবে, দূর্বাদিদিমনি তোমায় দেখা করতে বলেছেন l কি জরুরি কথা আছে নাকি l
ছেলের দিকে চমকে তাকালেন মিনতি -কিছু দুষ্টুমি করেছো নাকি ? গলায় উদ্বেগ l
-না মা, কিন্তু
দূর্বাদি
বলেছেন,
আমার জন্য একটা সারপ্রাইস
আছে
l
-সারপ্রাইস মানে জানো মা ? ভালো কিছু কথা
l
মিনতি খানিক হাঁপ ছেড়ে স্নানঘরে ঢোকেন l
পরদিন সকালের কাজের বাড়িতে ছুটি নিয়ে ধুয়ে রাখা পরিষ্কার এক শাড়ি পরে, পরিপাটি হয়ে পলাশের স্কুলে গেলেন টিফিনের সময় l
পলাশ বন্ধুদের সাথে খেলছিল l দূর থেকে মা'কে দেখতে পেয়ে ছুটে এলো
l
মায়ের হাত ধরে নিয়ে এলো স্কুলের বারান্দার কাছে l তারপরেই দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল তরতরিয়ে
l কিছু
পরেই নেমে এলেন দূর্বা
সিনহা,
পলাশকে
সঙ্গে নিয়ে
l মিনতি
সংকুচিত
হয়ে দু'হাত জড়ো করে মাথা ঝুঁকিয়ে
নমস্কার
জানালেন
l দূর্বা
বললেন,
একটা বিষয়ে অনুমতি
নেবার জন্যেই
আপনাকে
ডেকেছি
l মিনতি
একটু অবাক চোখে তাকিয়ে
রইলেন
l অনুমতি ? কীসের অনুমতি ! মিনতির অভিব্যক্তির বিস্ময় লক্ষ্য করলেন দূর্বা l বললেন, স্কুল গত তিন বছর যাবৎ আমাদের একেকজন শিক্ষিকাকে বিদেশে ঘুরতে পাঠাচ্ছেন গ্রীষ্মের ছুটিতে l নিজের পছন্দের কোনও দেশে l এ বছর আমার পালা l আমি প্রস্তাব দিয়েছি উত্তর ইওরোপের নরওয়েতে যেতে চাই l আমার সমস্ত খরচ স্কুল কর্তৃপক্ষ বহন করবে l আমার খুব ইচ্ছে পলাশ আমার সাথে চলুক l মিনতি চমকে উঠলেন l মুখে একরাশ কুন্ঠা এনে বললেন, কিন্তু দিদি সে যে অনেক টাকার ব্যাপার, আমরা গরিব মানুষ...কথা শেষ হবার আগেই দূর্বা সিনহা মিনতির শীর্ণ বাহু ছুঁয়ে বললেন, ও নিয়ে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, পলাশের সব খরচ আমার l মিনতি সলজ্জ ভাবে মাথা নিচু করে রইলেন l
"আপনারা কেবল অনুমতি
দিলে আমি ওর যাবার বন্দোবস্ত
শুরু করি
l দূর্বা
সিনহা হেসে আরও বললেন,
আপনাদের
অনুমতি
আমায় লিখিত ভাবে দিতে হবে
l
মিনতি পরদিন স্বামীর সাথে কথা বলে পাশের বাড়ির একজনকে দিয়ে চিঠি লেখালেন l তলায় আঁকাবাঁকা সই করে পলাশের হাতে পাঠিয়ে দিলেন চিঠি l
পলাশ এই অপ্রত্যাশিত আনন্দ কোথায় রাখবে ভেবে পায়না l বন্ধুদের কাছেও বেশি মন খুলে বলতে পারেনা, যদি যেতে না পারার জন্য ওরা দুঃখ পায় !
পলাশের মনে হয় একি স্বপ্ন না সত্যি ?
সে যাবে অন্য এক দূর দেশে বেড়াতে ? তাও আবার এরোপ্লেনে চড়ে ? বইতে সে উড়োজাহাজের ছবি দেখেছে l গল্প শুনেছে মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে যায় মানুষরা, নীচের ঘরবাড়ি সব খেলনার মতো দেখায় l উত্তেজনায় তার ক'দিন ঘুমই হলো না ভালো l
অবশেষে এলো তাদের যাবার দিনটি l দূর্বাদিদির হাত ধরে দুরু দুরু বুকে পলাশ উঠে বসলো মস্ত বড় এক এরোপ্লেনের ভিতর l দূর্বাদিদি তাকে জানলার ধারে বসতে দিলেন l প্লেনটা কিছুক্ষণ ধীরে চলার পর যখন খুব দ্রুত গতি নিল, পলাশ ভয়ে আঁকড়ে রইলো দূর্বাদিদির হাত l মাটি ছেড়ে ওঠার পর অপলকে চেয়ে রইলো জানালায় নাক ঠেকিয়ে l দিল্লির মাটি কিছুক্ষনের জন্য ছুঁয়ে আকাশপথে তারা পৌঁছে গেল গন্তব্য, নরওয়ের রাজধানী অসলো শহরে l বিমানবন্দর থেকে গাড়ি যখন হোটেলের পথে ছুটছে, পথের দু'পাশে অপরূপ দৃশ্য l দূর্বাদিদি পলাশের কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বললেন, দেখো পলাশ, চোখ ভরে দেখে নাও কি সুন্দর এ দেশ l তুমি সূর্য দেখতে ভালোবাসো, তাইতো এদেশে নিয়ে এলাম তোমায় l এখানে এসময় দিনে কুড়ি ঘন্টা আকাশে সূর্য দেখা যায় l ওই দেখো দূরে নীল পাহাড়ের সারি l পলাশের মনে হলো সে যেন গল্পের বইতে পড়া কোনও রূপকথার দেশে পৌঁছে গেছে l কোন দিক ছেড়ে যে কোন দিকে চোখ ফেরায় l ছবিতে সে দেখেছে এমন গাঢ় নীল পাহাড়, তার কোলে ঘন সবুজ ঢালু জমিl কি অদ্ভুত সুন্দর সব গাছ !! আর তার তাদের ওপর ছড়িয়ে আছে সোনা রঙের রোদ্দুর l হোটেলে পৌঁছে তারা গরম জলে স্নান সেরে নিলো l এদেশে নাকি গরমকাল বলে কিছু নেই l তাই বাক্স ভরে আনতে হয়েছে বেশ কিছু গরম জামা l খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল l দূর্বাদিদি বারে বারে বলছেন, কখনও হাত ছেড়ে না চলতে l
--দ্যাখো পলাশ,
ঘড়িতে এখানকার
সময় ছ'টা, যখন আমাদের
দেশে সন্ধ্যে
নেমে আসে,
কিন্তু
এখানে এখনও কেমন চড়চড়ে রোদ
l
দূর্বাদিদির কথায় পলাশ অবাক চোখে চারিদিক দেখলো l সত্যিই তো তাদের দেশের দুপুরবেলাকার মতো চনমনে রোদ্দুরে ঝলমল করছে শহরের পথঘাট l দু'পা হাঁটলেই সুন্দর সুন্দর সাজানো বাগান, তাতে ফুটে আছে কত নাম না জানা রং বেরঙের ফুল ! কত ছেলেমেয়েরা আনন্দে হাসছে, খেলছে সেই পার্কে l হঠাৎ পলাশের মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেলো l দূর্বাদিদির থেকে সে জেনেছে এখানে সময় চার ঘন্টা পিছিয়ে l তার মা এখন সারাদিন খেটেখুটে ফিরে রান্না সেরে সবাইকে খেতে দিচ্ছে হয়তো l ইশ কবে যে পলাশ বড় হবে, চাকরি করবে, মাকে তখন কোনও কাজ করতে দেবেনা l
এদেশে লোকসংখ্যা অনেক কম, তাই বাসে ট্রামে তেমন ভিড় নেই l তারা এমন একটা ট্রামে চড়ে বসলো যেটা শহরের প্রধান অঞ্চলগুলো দিয়ে যায় l ট্রামের জানালা দিয়ে পলাশ অপলকে দেখতে লাগলো কি সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি আর এদেশের মানুষজন l ট্রাম থেকে নেমে তারা পায়ে হেঁটে প্রথমে দেখলো 'ন্যাশনাল অপেরা হাউস' l সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তার প্রাচীরে l ঈষৎ হলদেটে পাথরে মোড়া বিশাল চাতালে
বসলো খানিকক্ষণ
l ঘড়িতে
তখন দশটা অথচ কি উজ্জ্বল
রোদ
l সবার
চোখে রোদচশমা
l পলাশকে
সবচাইতে
আশ্চর্য
করছে ঘড়ির কাঁটা'র সময় আর আকাশে সূর্যের
এই স্থায়িত্ব
l জন্ম
থেকে সে দেখে এসেছে গরমের দিনে বড়োজোর
সাড়ে ছটা আর শীতকালে
পাঁচটা
অবধি থাকে দিনের আলো,
কিন্তু
এ কোন স্বপ্নের
দেশে সে এলো
? যখন
ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা
অথচ চারিদিকে
ছড়িয়ে আছে ঝকঝকে বিকেলের
আলো
? সে
অবাক চোখে দেখে আর দূর্বাদিদিকে
বলে,
"দিদি
এ কি অদ্ভুত
কান্ড
! দূর্বাদিদি স্নেহের চোখে তার দিকে চেয়ে বলেন, এই জন্যই তো একে বলা হয় 'নিশীথ সূর্যের দেশ' l তুমি তো রোদ্দুর ভালোবাসো,পলাশ ! আমি জানতাম তুমি খুব অবাক আর খুশি হবে এখানে এসে l
পরদিন এক বিরাট লঞ্চে চড়ে ওরা এলো এক দ্বীপে
l যেদিকে
চোখ যায় সবুজের
ছড়াছড়ি
l ঝিরিঝিরি পাতার গাছের সারি, মখমলের মতো হালকা সবুজ ঘাসের গালিচা l একসাথে এত সবুজ কখনো দেখেনি পলাশ l চোখ ও মন শান্ত হয়ে গেল এই দ্বীপে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে l
শেষ বিকেলে যখন তারা এলো অসলো'র বিখ্যাত 'ভিগেল্যান্ড পার্ক' এ, ধূসর রঙের বিশাল, মূর্তিগুলি'র গায়ে তখন পিছলে পড়ছে মোলায়েম রোদ l মা-বাবা-ছেলেমেয়েদের পারিবারিক মিলন, আহ্লাদের নানা মুহূর্তকে পাথর কেটে কি অপূর্ব বানিয়েছেন শিল্পী গুস্তব ভিগেল্যান্ড l মূর্তিগুলি দেখে পলাশের চোখ আর সরেনা ! বাবা ছেলেকে দুহাতে উঁচু করে তুলে আদর করছেন, মা ছেলেকে বকছেন, আবার সস্নেহে খাইয়ে দিচ্ছেন, আরো কত কি !
পরদিন দিনের অনেকটা সময় জুড়ে ওরা জাহাজে চড়ে ঘুরলো l দেখলো সামুদ্রিক 'ফিয়র্ড' l পাহাড়ের গভীর খাতে সমুদ্রের জল ঢুকে তৈরী হয়েছে এই ফিয়র্ড l এভাবে আরো নানান জায়গা ঘুরে কোথা দিয়ে কেটে গেলো সাতদিন
l যে
কোনও সুন্দর
জায়গা দেখেই পলাশের
মা বাবার মুখ মনে পড়ে যায়
l খুব
কষ্ট হয় তখন বুকের ভিতর
l ওর
খেলার সাথীদের
কথাও মনে পড়ে
l নিজেকে
মনে হয় খুব স্বার্থপর,
এত সব আশ্চর্য
সুন্দর
জিনিস একা একা দেখে নিলো
l
দূর্বাদিদি হঠাৎ এক অদ্ভুত কথা বললেন, আচ্ছা পলাশ, তোমার তো এ দেশটা এত ভালো লাগছে, বছরের ছয়মাস এখানে রাত এগারোটা অবধি সূর্যের আলো, যা তোমার এত প্রিয় l তোমায় যদি এদেশের কোনও হোস্টেলে
রেখে পড়াশোনা
করার ব্যবস্থা
করি,
তুমি খুশি হবে
?
এ কথায় চমকে ওঠে পলাশ l তার গলায় হঠাৎ কান্না
উঠে আসে
l না
না কিছুতেই
না l এক নিমেষে
মা বাবা,
মাসি,
ভাই বোন,
পল্টু,
ভোলা সবার মুখগুলো
ভেসে ওঠে মনের পর্দায়,
এমন কি রোজ বিকেলে
'আইসক্রিম' বলে হেকে যাওয়া বিশুকাকুর মুখটাও l দূর্বাদিদিও কি তার কম প্রিয় ! এদের ছেড়ে সে কোথাও থাকবেনা, কোত্থাও না !!
প্রবল বেগে মাথা নেড়ে দূর্বাদিদির দিকে ছলছলে চোখ তুলে চায় পলাশ l
সবার থেকে দূরে এসে পলাশ যে বুঝতে পেরেছে জীবনে প্রিয় মানুষরাও একরকমের আলো দেয়, উষ্ণতাl ছড়ায় l
প্রতিটি প্রিয় মানুষই যে তার জীবনে একেকটা সূর্য !!