গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৭ মার্চ, ২০২০

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিণী--৪৯


ছায়া-ছায়া মায়া !


ত্রিবেণীর পাশেই আছে মগরা স্টেশন। ধীরেন বাবু এখানে রেলের চাকরি করেন। তিনি বুকিংক্লার্ক। প্রতি শনিবারে সন্ধ্যে বেলায় তিনি বাড়ির জন্যে রওনা হন। মগরা থেকে রানাঘাট এর দূরত্ব প্রায় ষাট কিলোমিটারের মত হবে। ট্রেন বাস মিলিয়ে শর্টকাটে তিনি প্রায় তিন ঘণ্টায় পৌঁছান নিজের বাড়ি, রানাঘাটে। স্টেশন থেকে পাঁচ সাত মিনিট পায়ে হাঁটার দূরত্বে তাঁর বাড়ি। নিয়মিত ভাবে প্রতি শনিবার রাত দশটার মধ্যে নিজের বাড়িতে তিনি পৌঁছে যান।
আগামীকাল তার বাড়ি যাওয়ার দিন কিন্তু ইতিমধ্যে বাড়ি থেকে একজন লোক এসে খবর দিয়ে যান যে তার স্ত্রী বেশ অসুস্থ। সদর হসপিটালে ভর্তি। এখনই যেন তিনি বাড়ির দিকে রওনা হন। এটুকু বুঝতে পেরে ছিলেন ধীরেন বাবু যে ইমার্জেন্সি কিছু হবে।
ধীরেন বাবু তড়িঘড়ি করে রাত্রে নটার ট্রেন ধরলেন। তার আগে কোন ট্রেনই ছিল না। খুব তাড়াতাড়ি হলেও রাত সাড়ে এগারটার আগে তিনি কিছুতেই ঘরে পৌঁছাতে পারবেন না। আজ তিনি পৌঁছবার জন্য একটু অন্য পথ ধরলেন। তিনি উল্টো পথ ধরে পৌঁছলেন অম্বিকা কালনা। সেখান থেকে কালনা ঘাট পৌঁছতে প্রায় রাত সাড়ে দশটা হয়ে গেল। কালনা ঘাট টু রানাঘাট যাবার শেষ বাস তিনি যত দূর জানেন, রাত সাড়ে দশটায়। গঙ্গা নদী পার করে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে দশ মিনিটের মত সময় লাগবে। তাও ভ্যান রিক্সায় গেলে। পায়ে হাঁটলে আরও বেশি সময় লাগে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন, কোন ভ্যান রিকশা নেই। অগত্যা তিনি হাঁটতে লাগলেন। সামান্য এগিয়ে একটা ভ্যান রিক্সা দেখতে পেলেন কিন্তু তার চালক কোথায়? এবার তার চোখে পড়ল, দূরে গাছের তলাতে অন্ধকারে একটা লোক শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু এত রাত্রে ঘোর ঘুম ছেড়ে সে কি যাবে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত ? বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর লোকটা উঠে বসল। আড়মোড়া খেয়ে বলল, দেখেন তো বাবু কয়টা বাজে?
ধীরেন অন্ধকারে ঘড়ির সময় ঠিক বুঝতে পারলেন না, আন্দাজ করে বললেন, সারে দশটা হয়নি এখনও--
লোকটা আবার একটা হাই তুলে নিয়ে বলল, তাইলে কেমনে যাইবেন? শেষ বাস রাইত দশটায় ছিল।
--না না আমি জানি, সাড়ে দশটায় শেষ বাস।
--না বাবু, আপনি জানেন না--লোকটা আবার তার জায়গায় শুয়ে তৎক্ষণাৎ নাক ডাকা শুরু করল।
ধীরেন বাবু হেঁটে চললেন বাসস্ট্যান্ডের দিকে। অন্ধকার আলো-ছায়ার মধ্যে তাঁর চোখে পড়লো, দূরে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মনে হল এই বুঝি শেষ বাস, তার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ব্যাগটা একটু ভারী হলেও তিনি জোরে পা চালাবার চেষ্টা করলেন। বাসের কাছে গিয়ে দেখলেন, তাতে একটাও লোক নেই। তবে কি বাস যাচ্ছে না? কিছুটা দূরে একটা দোকানে তখনও টিম টিমে আলো জ্বলছে, সে দিকে তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন। এটা পান-বিড়ির দোকান হবে, লোকটা দোকান বন্ধ করবে বলে তৈরি হচ্ছিল। তাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রানাঘাটের বাস--
--রাত দশটায় চলে গেছে।
--আমি তো জানতাম সাড়ে দশটায় শেষ বাস।
--না, আপনি ঠিক জানেন না--আজ আর কোন বাস নাই - -
-- যে দাড়িয়ে আছে, ওটা যাবে না ?
 - -না না, ওটা কাল ভোরে যাবে।
ধীরেন বসু ভীষণ মুশকিলে পড়লেন। এবার তিনি কি করেন? এখান থেকে তো অন্য কোন গাড়ির যাতায়াত নেই বললেই চলে। তবে একটা আধটা প্রাইভেট গাড়ি গেলেও যেতে পারে। এই ভরসায় তিনি রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলেন, তাঁকে যে যে ভাবেই হোক বাড়িতে পৌঁছাতে হবে।
বেশ কিছুটা রাস্তা এগিয়ে গেলেন তিনি। বেশ কিছু সময় ধরে হেঁটে চলেছেন তিনি। মনে মনে ঠিক করে নিলেন, পথে ট্যাক্সি ট্রাক যা কিছু পান না কেন, তাতেই তিনি চড়ে বসবেন।
এমনি ভাবে তিনি ঘন্টাখানেক হেঁটে চলেছেন। সময় কালের বোধ যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
আকাশের এক কোণে এক ফালি চাঁদ উঁকি মারছে। তার ম্লান আলো চারদিকের পরিবেশকে অনেকটা ঘোলাটে মায়াময় করে তুলেছে। আশপাশে রাস্তার দুদিকে ঝোপ জঙ্গল ছাড়া কোন বাড়িঘর বা আলোর চিহ্ন নেই। তবে মুহুর্মুহু জোনাকির ঝিকিরমিকির আলো যেন রহস্যময় খেলায় মেতে উঠছে। মাঝে মাঝে বোবা নির্জনতা ভেঙে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে উঠছে, সবকিছু মিলিয়ে মায়াবী চাঁদের আলো ধূসর এক চরাচর সৃষ্টি করে নিয়েছে যেন!
ঠিক এমনি সময় ধীরেন বাবু চমকে উঠলেন। গাড়ির শব্দ না ! বড় কোন গাড়ির গোঁগানোর মত একটা শব্দ। ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। ধীরেন বাবু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। দু কান পেতে থাকলেন। হ্যাঁ, একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। তখনও জঙ্গল গাছপালার সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে তার আলোকরশ্মি পৌঁছায়নি বটে। তবে একটু পরে আলো দেখতে পাবেন এমনি আশায় চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি।
মিনিট পাঁচেক পার হয়ে গেল। হঠাৎ ধীরেন চমকে উঠলেন। ক্ষীণ একটা আলোর শিখা এসে তাঁর চোখের ওপর পড়ল। আর মুহূর্তের মধ্যে হাত দেখাবার আগেই একটা বাস এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখার সময় নেই, গাড়িটা সামনে দাঁড়াতেই কন্ডাক্টরের একটা কালো লম্বা হাত এসে বাসের দরজা খুলে ধরল। ধীরেন বাবু হুড়মুড় করে উঠে পড়লেন বাসে। তাকালেন তিনি, বাসের ভেতরে অনেক যাত্রী। যে কোন কারণেই হোক ভেতরে আলো নেই। যাত্রীদের ছায়াগুলো বারবার কেঁপে উঠছে। অন্ধকারে হালকা চাঁদের আলোয়  ধরনের অবস্থা তো হতেই পারে। সিট দেখে ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। পায়ের সামনে রেখে দিলেন তাঁর ব্যাগটা।
--এই যে রানাঘাটের টিকিটটা নিন
আশ্চর্য, রানাঘাটে যাবো, বুঝল কি করে লোকটা ? ধীরেন বাবু তাড়াতাড়ি তার বুক পকেট হাতড়ে একশ টাকার নোট একটা বের করে কন্ডাক্টরের হাতে দিলেন। বাসের মধ্যে অন্ধকার ছায়া ছায়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এমন কি কন্ডাক্টরের ছায়াটাও কাছ থেকে এক তাল কালো অন্ধকার বলেই মনে হচ্ছে। এটুকু বোঝা যাচ্ছে দুরন্ত গতিতে বাস ছুটে চলেছে। বাসের হেডলাইট দুটো থেকে আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু তাতে রাস্তাঘাট কিছুই ধরা পড়ছিল না। ধীরেন বাবু মনে হল নির্জন রাস্তায় কোথাও লোকালয় নেই। বাসের মধ্যের লোকগুলোর নাক ডাকার অদ্ভুত রকম সব শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মিনিট পনেরো চলে যাওয়ার পর ধীরেন বাবুর মনে কেমন যেন খটকা লাগতে লাগল। মনে হল তার পড়া কোন এক ভৌতিক গল্পের সঙ্গে আজের ঘটনার যেন অনেকটা মিল রয়েছে।  কথা মনে হতেই তিনি সোজা হয়ে বসলেন। ছায়ার আভাসে বুঝতে পারছিলেন কন্ডাক্টর দরজার সামনের সিটে বসে আছে। তার কালো লম্বা চেহারা যেন বারবার অকারণে দুলে দুলে উঠছে !
ধীরেন বাবু প্রশ্ন করলেন, রানাঘাট আর কত দূরে?
কোন উত্তর নেই। কি হল রে বাবা, কন্ডাক্টটার কি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। সেখানে একটা লম্বা কালো বড় হাত হেলে দুলে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে যাচ্ছে। আর বাস হু হু শব্দ করে ছুটে যাচ্ছে।
বাস চলছিল। হঠাৎ মাঝ পথে ঘটঘটাং আওয়াজ করে থেমে গেলো। ধীরেন বাবু বাইরের দিকে তাকালেন। এক মহিলা যাত্রী।  কি আশ্চর্য! তার পোশাক তাঁর চোখে মাঝে মাঝে ধরা পড়ছে, আবার ছায়া অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। বাসে উঠতে উঠতে মহিলা একবার তাঁর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তীব্র, অথচ কোমল একটা চাহনি যেন ধীরেন বাবুর মনের ভেতরে ঢুকে গেল। তিনি ভয়ে শিহরিত হলেন। মহিলা তাঁর এক সারি আগের সিটের একটিতে এসে বসলো। ধীরেন বাবুর দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল সে। ধীরেন বাবুর মনে হল, সেই দৃষ্টি পলকে তিনি বুঝি জ্ঞান হারাবেন। সে দৃষ্টি ছিল কোমল, মায়াময় অথচ তার তীব্র গ্রাহ্যতা বড় গভীর !
হঠাৎ সেই মহিলা দাঁড়িয়ে পড়ল, ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠল, এই গাড়ি কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? রানাঘাটে আমাদের পৌঁছে দিয়ে তারপর নদীতে গিয়ে তোমরা ডুবে মরো!  ধীরেন বাবুর কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। একবার মনে হয়েছিল, মহিলার কণ্ঠস্বরটা যেন বড় চেনা চেনা লাগছে ! আর এই ডুবে মরো কথারই বা অর্থ কি ? গাড়ি মুড়ে  অন্য পথ ধরল, আর মিনিট পরেই এক জায়গায় এসে থামল। ঢ্যাঙা কালো লম্বা কন্ডাক্টর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে, কর্কশ গলায়  চিৎকার দিয়ে উঠল, রানাঘাট, রানাঘাট, রানাঘাট--
বাস থেকে নেমে আসলেন ধীরেন বাবু। তার পেছনে পেছনে নেমে আসলো সেই মহিলাটি। হঠাৎ অন্ধকারের মাঝে ঝিলিক দিয়ে মহিলার মুখটা মুহূর্ত সময়ের জন্য তাঁর সামনে জেগে উঠলো। ধীরেন চমকে উঠলেন, পরিচিত, অতি পরিচিত সেই মুখটা, ভাবঘোরে  তবু তিনি আর কিছুই মনে করতে পারলেন না।
--তাড়াতাড়ি ঘরে যাও ! যেন বাতাস থেকে ভেসে এলো এক কণ্ঠস্বর।
--কে ? কে ?? সামনের মহিলা তখন অন্ধকারে অদৃশ্য হলেন। ধীরেন বাবুর ঘোর কেটে যাচ্ছে, তিনি হন হন করে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। ঘরে পৌঁছে দেখলেন সেখানে কেউ নেই, দরজায় তালা ঝুলছে।   স্ত্রী সদর হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আর ভাবনার সময় নেই, হাতে ব্যাগ নিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন তিনি।
হসপিটালে পৌঁছাতে ছেলে-মেয়েরা ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। পাড়ার দু-তিন  জন লোক এগিয়ে এলেন। একজন করুন কণ্ঠে জানালেন, ধীরেন বাবু, আপনার স্ত্রী মারা গেছেন। কোথা থেকে যেন একটা কান্না ঠেলে ঠেলে উঠে আসছে, ধীরেন বাবু বুঝতে পারলেন না। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন, হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। ছেলেমেয়েরা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
পাশের বাড়ির দুলাল বাবু এগিয়ে এসে ধীরেন বাবুর পিঠে একটা হাত রেখে বললেন, যান, স্ত্রীর কাছে যান ! সংসারের নিয়ম আমরা কেউ ভাঙতে পারি না। এখন ছেলে মেয়েকে কাছে টেনে নিন
অস্পষ্ট চোখে খানিক দুলাল বাবুর দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরেন বাবু পাশে স্ত্রীর মৃতদেহ রাখা স্ট্রেচারের দিকে উন্মাদের মত ছুটে গেলেন। স্ত্রীর মুখের চাদর সরিয়ে চমকে উঠলেন তিনি,  কি    ! আবছা আলো ছায়ার মাঝে  কাকে দেখছেন তিনি ?  তো সেই বাসের সেই মহিলা ! চোখ কচলে নিয়ে আবার তাকালেন তিনি, এবার স্পষ্ট হল স্ত্রীর মুখটা, স্পষ্টতর হয়ে তার চোখের সামনে ফুটে উঠল।