গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৭ মার্চ, ২০২০

ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী


তিন বন্ধু



বল্টু, নন্টে আর ঝন্টু তিন বন্ধু l  যেন হরি হর আত্মা l একসঙ্গে ছোটবেলা থেকে একি স্কুলে পড়াশুনো l খেলা ধুলো l ঘুড়ি ওড়ানো, বাড়িথেকে পয়সা চুরি করে সিনেমা দেখা l  খেলার মাঠে জমিয়ে ইস্ট বেঙ্গল মোহনবাগান খেলা দেখা l  সব কাজেই ওরা পটু l এরমধ্যে সোল বসন্ত পেরিয়ে তিনজনেই কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দিল l স্কুলের গণ্ডি পেরুতে তিন জনকেই বেগ পেতে হল  l তখন স্কুল ফাইনাল টুকলি করে পাশকরা কঠিন ছিল l তাই একবার গাড্ডু খেয়ে কোনমতে পরের বার কম্পার্টমেন্টালে পাস করে l তিনজনেই অংক আর ইংরেজি তে ফেল করে l ওদের মধ্যে মিলটা সত্যি মানতে হয় l 
কাল ক্রমে কারুর সঙ্গে কারুর সম্পর্ক রইলো না l যে যার নিজের কর্ম সংস্থানের জন্য বিদেশ ভুঁই তে পা দিল l

           বল্টুর কথা

বল্টু, মুম্বাইতে ওর মামার সুপারিশে এক জাহাজ কোম্পানির খালাসি হল l নানা দেশে পাড়ি দিয়ে নানা দেশের ভাষা এবং তাঁদের আচার ব্যবহার জানলো l তাঁদের সঙ্গে ওঠা বসা করে বেশ চালাক চতুর হল l লোকে বলে নাকি স্মাগলিং করতে আরম্ভ করলো দশ পনের বছর চাকরি করার পর l আন্ডার ওয়ার্ল্ড ডন এর সঙ্গে ভিড়ে কিছু অপরাধ ঘটাল তবে ওই সোনা পাচার, মাদক দ্রব্য পাচার এই আর কি l  পকেটে কাঁচা পয়সা এলো l যা হয় মেয়ে মানুষ জুটল l একটা ছেড়ে আরেকটা এই আরম্ভ করলো l শেষে সিঙ্গাপুরে ফ্ল্যাট কিনে ওখানেই সংসার পাতলো l  কলকাতা আসেই না বলতে গেলে কারণ ওর বাবা মারা যাওয়াতেও আসেনি l বল্টুর ওখানে একটা হোটেল আছে শুনেছি l ওর স্ত্রী করিত কর্মা মহিলা l মুম্বাইয়ের মহিলা. বল্টুর সঙ্গে ওখানেই আলাপ. তারপর প্রেম এবং বিবাহ l বল্টু এখনো বাংলা ভাষাটা বলতে পারে l ওর আবার মদিরা সেবন করলে হুঁশ থাকেনা l 
এবছর 2020 নতুন বছরে বল্টু পার্টির আয়োজন করে এক হোটেলে. মদের ফোয়ারা ছোটে l  মান্না দের গান চলে :- এইতো জীবন... যাকনা যেদিকে চায় প্রাণ ...বেয়ারা চালাও ফোয়ারা... জীন শেরি শ্যাম্পেন ... খাও খাও বুঁদ হও.....
বল্টুর মদ্যপান এতোই বেশি হয় যে ড্রাইভারকে ডেকে বলে.. ড্রাইভার গাড়ি লাও.... তারপর অতিথিদের উদ্দেশ্যে বলে... য্যাদা  পিনেসে গাড়ি চলানা  ঠিক নেহিঁ l  বিবি গুস্সা করেগি বলে ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলে l এরপর ড্রাইভারকে নিয়ে চলে যায় বাইরে. তখন ওর স্ত্রী ছিলোনা কাছে l স্ত্রী ফিরে সকলকে জিজ্ঞাসা করাতে সকলে বলে ঝন্টু বাড়ি চলে গিয়েছে l বল্টুর বৌ আশ্চর্য হয়ে বলে... হারামি জাহান্নম মে জায়গা... শালা ঘর তো এহি হ্যায় হামারা ... কাঁহা গিয়া হারামি? ঔর ড্রাইভার? ভি পিয়াথা ক্যা??
সকলে হাঁ করে ঝন্টুর বৌয়ের মুখের পানে চায় l 
একেই বলে মাতাল....

       নন্টের কথা

নন্টে ইলেকট্রিকের মিস্ত্রী l  ছা পোষা ঘোর সংসারী l বৌয়ের বাধ্য স্বামী l বৌ ভিন পাড়ার মেয়ে l  প্রেম বিবাহ l তবে হ্যাঁ নন্টের মদিরা সেবন ছাড়া অন্য কোন বদ গুন নেই l ওই পেটে পড়লে একটু বেতাল হয় এই যা l  নতুন বছরে নণ্টের বাড়িতে কিছু বন্ধু আসে l নন্টে বিলিতি মাল এনেছে l বন্ধুরা খুব খুশি l বৌ কাছে না এলেও পাকোড়া পাঠিয়ে দেয় l কিন্তু জানেনা এরা মদ গিলে মাতলামি করবে বলে l  নন্টে খেয়ে বলে শালা ঝন্টুটা খুব বড়লোক হয়েছে বুঝেছিস l কোন খবর নেই শালার l তবে সিঙ্গাপুরে আছে শুনেছি ওর ছোট ভাইয়ের কাছে l হেব্বি আছে বুঝলি l সিঙ্গাপুরের ডলার এখন পকেটে আছে l বৌ মারাঠি l মঞ্জু আপতে না কি নাম l  এখন আমাদের দেখলে চিনতে পারবেনা l শালা ছোটবেলার দিনগুলো ভুলে গেল মাইরি l  কত মজাই না করতাম.... বলে এক পেগ গলাধঃকরণ হয়ে গেল l 
বন্ধুরা বলে ছাড়ত l এইতো আমরা বেশ আছি বল..
- হ্যাঁ তা আছি l তবে কি জানিস ওই মানি l বলেনা মানি মানি সুইটার দেন হনি l আমাদের ওটার বড় অভাব l শালা মুম্বাই গিয়ে মানুষ হয়ে গেল l আমরা জাহান্নমে আছি মাইরি l মাস আর ফুরতে চায়না l বৌয়ের ঝাঁটা আর মেয়ের বায়না দুটোই আমার কপালে বুঝলি l  কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারিনা l  মাঝে মাঝে ভাবি সব ছেড়ে হিমালয়ে চলে যাব l 
- নে আরেকটু খা...
- হ্যাঁ দে...
ভেতর থেকে এক মহিলা হাতে সত্যি সত্যি ঝাঁটা নিয়ে ঘরে ঢুকেই সকলকে বলে.. চলে যান আপনারা... কি করতে আমার মানুষটাকে ছাই পাঁশ খাওয়াচ্ছেন শুনি l আমাদের সংসারে আগুন লাগাতে এসেছেন l 
- নণ্টের দিকে তাকিয়ে ওর বন্ধুরা একে একে কেটে পড়ে... নণ্টের চোখে জল l বলে আজকের দিনটা একটু ফুর্তি করছিলাম তাও তোমার সইলোনা?
- না সইলোনা ! মেয়ে বড় হচ্ছে খেয়াল আছে !! পাঁড় মাতাল সব l ঝেঁটিয়ে বিষ ছাড়িয়ে দেব l  খবরদার আর ওদের ঘরে আনবেনা l বাপ হয়েছ মেয়ের দায়িত্ব নিতে জানোনা l মদ গেলা হচ্ছে ! কি শিখবে শুনি?
- আমার পকেটে টাকার বান্ডিল থাকলে কি আর ওই কথা বলতে?
- না বলতামনা !! সাধু পুরুষ আমার. বিয়ে করেছিলে কেন যদি সংসার চালাতে না পারো?
- কি অভাব রেখেছি তোমাদের?
- লজ্জা করেনা বলতে ? কি অভাব রেখেছ? নিজে ভেবে দেখ.
-বছরের প্রথমেই খোঁটা দিচ্ছ ! আমিত আপ্রাণ চেষ্টা করছি তোমাদের সুখে রাখতে কেন রাগ করছ ডার্লিং !! 
-এই খবরদার আমাকে ডার্লিং বলবেনা উঁ ডার্লিং পেটে মদ পড়লে ডার্লিং 
- নন্টে টলতে টলতে বাড়ির বাইরে চলে যায় তখন রাত ১১টা ওপর তবুও কোলাহলের শেষ নেই নববর্ষের হিড়িক সামলাতে ট্রাফিক পুলিস হিমসিম খাচ্ছে সব বেপরোয়া ড্রাইভিং পেটে মদ আর হাতে স্টিয়ারিং পাশে যদি ফুর্তির জন্য মহিলা ( বাজে কথা লিখবোনা তাই মহিলা লিখলাম) থাকে কথাই নেই এস ইউ ভি ,রেঞ্জ রোভার , অডি , বিএমডব্ল্যু , মারসিডস , চাই কি দেশি ইনোভা স্পীড বেড়ে যায়। চাকার তলায় কে পড়লো দেখার অবকাশ থাকেনা হঠাত রোড ডিভাইডার ভেঙ্গে একটা মারসিডস ধাক্কা দিল এক পথচারিকে রাস্তায় রক্তের বন্যা ট্রাফিক আসার আগেই গাড়ি চম্পট লোকটিকে সঙ্গে সঙ্গে ট্র্যাফিক পুলিস হাঁসপাতালে পাঠিয়ে গাড়িটি সনাক্ত করার জন্য চারিদিকে ফোন করে
সি সি টিভি ফুটেজে গাড়িটির ছবি ফুটে ওঠে এবং সহজেই সনাক্ত করে চালক কে কিন্তু চালকটি- বড়লোক মা বাবার বকাটে সন্তান সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীর ছেলে। তাকে ধরতে-গেলে নানা ঝামেলা। চাইকি ওপর মহল থেকে ফোন আসবে তদন্ত বন্দ করুন হায়রে কোলকাতা ! 

হ্যাঁ আপনারা যা ভেবেছেন তাই l নন্টু মদের নেশায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় বৌয়ের গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে l ব্যাপারটা হল রাস্তার প্রায় মধ্যেখানে টলতে টলতে হাঁটছিল হঠাৎ পেছন থেকে এক এস ইউ ভি গাড়ি ধাক্কা মারে l ঐখানেই পড়ে যায় l শক্ত আঘাত লাগে মাথায় এবং শরীর সম্পূর্ণ থেঁতলে যায় গাড়ির ধাক্কায় l হসপিটালে পোস্ট মর্টেম হয় lপুলিশ অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করে l নণ্টের বৌ মৃত দেহে সনাক্ত করে কান্নায় ভেঙে পড়ে l নিজেকে ধিক্কার দেয় l বাচ্চা মেয়েটি বুঝতে পারে সে বাবাকে চির দিনের জন্য হারালো l বছরের প্রথমে এই মর্মন্তুক বেদনা দায়ক দৃশ্য l যার যায় সেই বোঝে l নন্টে কি জানতো তার ওই দিনের মদ গেলাটাই জীবনের শেষ অধ্যায়! না নণ্টের বৌ জানতো ওর স্বামী অকালে চলে যাবে তাকে ছেড়ে ! কি হবে ওই সংসারের? মদ কি অসম্ভব পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যা জীবনের সমস্ত সুখ নিমিষে ছিনিয়ে নেয় l তবুও বাজারে মদ বিক্রি চলবে l  কারণ সরকার টাকা পাচ্ছে l  মানুষ       মরলে সরকারের  কি যায় আসে? ওদের কে খেতে বলেছে?  কত অসহায় নারী এই মাতালের  স্ত্রী হওয়ার জন্য সারা জীবন দুঃখে কষ্টে কাটান l কে কার কথা বোঝে এই যুগে? শেষে নণ্টের স্ত্রী সামান্য পুঁজি নিয়ে এক চায়ের দোকান করে  সংসার চালাতে বাধ্য হয় l  মেয়েকে মানুষ করতে হবে l সেটা এখন তার দায়িত্ব l এক মুহূর্তে তার জীবনে চরম বিপত্তি চলে আসে l তার মূল কারণ কিন্তু 'মদ' l সেইদিন থেকে নণ্টের বৌ একদম চুপ চাপ l কারণ  তার  চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে l আর কেই বা আছে ? নণ্টের সেই বন্ধুদের কারুর দেখা নেই l এই হচ্ছে দুনিয়া !! যে ছিলো ভালো মন্দ যাই হোগ না কেন রোজগার করে আনতো l তাতেই সংসার চলত l  এখন কি হবে? সমস্ত দুঃখ গিলে খেয়ে নিয়েছে নণ্টের বৌ l নীল কণ্ঠের মতন বিষ পান করেছে l উপায় নেই এই দুনিয়া বড়ই স্বার্থপর l কেউ কারুর খোঁজ রাখেনা l 


           ঝণ্টের কথা

ঝণ্টে মানুষটা সরল চিরদিন l কোন বদ  অভ্যাস নেই l একটা প্রাইভেট ফার্মে চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী l বাবুদের চা সিগারেট আনা অন্য ফাই ফরমাস খাটা l  এই আরকি ! মাস গেলে যা মাইনে পায় সংসার চলে যায় l  স্ত্রী অত্যন্ত ঠাকুর ভক্ত l ঝণ্টের জীবনে ওর স্ত্রীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি l গৃহ লক্ষ্মী হিসেবে ওর স্ত্রী অতুলনীয়া l ওর স্ত্রী শান্ত সরল স্বভাবের তাই ঝণ্টের ঘরে খুব শান্তি l  অফিস,ঘর আর মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিনীর মন্দির ছাড়া কোথাউ যায় না ঝণ্টে l  ওদের কোন সন্তান নেই. সেই জন্য ঝণ্টের বৌয়ের পুজো আচ্ছায় বেশি মন l মনে কষ্ট আছে তবে প্রকাশ করে না l  ভগবান মানুষ কে কখনো সব দিয়ে দেন না l কিছু খামতি রাখেন l  ওটা নাহলে বোধ হয় কেউ ঠাকুর দেবতা মানবেনা l  ঝণ্টের বাড়ি একটা মন্দিরের মতন l ঠাকুর ঘরটা দেখবার মতন l সুন্দর মার্বেলের সিংহাসনে লক্ষ্মী নারায়ণের ফটো l ফুলের সুবাসে ঘর মুখরিত l সুগৃহিনী হলে সেখানে ঠাকুর দেবতা থাকেন l সংসারে শান্তি বজায় থাকে l
 এটাই এই তিন বন্ধুর কথা