দু’হাজার পঞ্চাশ
শুভর বয়স কত হ’ল মনে মনে হিসেব করলাম। শুভর বয়স দেখতে দেখতে ৩৭ হল । আর আমি এই শীতে ৮২
ছুঁলাম । এখন দুহাজার পঞ্চাশ । জন্মেছিলাম সেই কবে, ১৯৬৮র
ডিসেম্বরে । ছোট বেলার কথা আমার তেমন কিছু মনে নেই । অথচ পরে শুনেছিলাম মনে রাখার
মত অনেক কিছুই নাকি হয়েছিল তখন । আট নয় বছর বয়সের কথা অবশ্য এখনও বেশ মনে পড়ে । মনে আছে নয় বছর বয়সে,
যখন ক্লাস থ্রীতে পড়ি, প্রথম বাবাকে দেখলাম ।
বাবা জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছিল তখন । তখন ভবতাম, জেলখানায়তো
চোর ডাকাতরা থাকে, কিন্তু বাবা কেন ওখানে ছিল ? কেন ছিল, কতদিন ছিল এসব কথা মা আর দাশুকাকার কাছে
শুনেছিলাম । দাশুকাকা খুব ভালো কবিতা বলতো । কয়েকটা পংক্তি এখনো আমার মনে আছে ।
বলতো ‘কিনু গোয়ালার গলি / সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের
বলি /বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোছনা / ময়লা হাতে ওকে তোরা ছুস না / ওরে
মন, পৃথিবীর গভীর /গভীরতর অসুখ এখন” । দাশুকাকা
বলেছিল তোর বাবা ছিল সোনার টুকরো ছেলেদের একজন । তা সেই সোনার টুকরো ছেলেদের কথা
দাশুকাকাই শোনাত । দাশুকাকা যে গলিটা দিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতো,
একদিন নাকি ফেরার সময় আধঘন্টা মাথার ওপর হাত তুলে হাঁটতে হয়েছিল,
আর পাঁচ ছটা লাশ ডিঙ্গিয়ে আসতে হয়েছিল । সে থাক । এই দুহাজার
পঞ্চাশে ওসব প্রায় আশি বছর আগের কথা কে আর শুনতে চাইবে ? লোকে
পাগল বলবে । তাছাড়া, আমার কথা তো বলতে চাই না । আমার চিন্তা
শুভকে নিয়ে ।
শুভ আমার ছেলে
নয়, বলতে গেলে কেউই নয় । আবার শুভ আমার অনেক কিছুই ।
শুভশ্রী মানে আমার স্ত্রী সেও ওর মা নয় ।
শুভ নামটা ওরই দেওয়া । শুভ বছর পাঁচেকের হতেই ওর বাবা মায়ের কথা ওকে
বলে দিয়েছিলাম । বলেছিলাম তাদের মারা যাওয়ার কথা । আমাকে জেঠু বলে ডাকতে
শিখিয়েছিলাম ।
শুভকে নিয়ে
ইদানিং আমার খুব চিন্তা হয় । দুহাজার পঞ্চাশের পক্ষে ও বড়ই বে- মানান । পাড়ায় ওর কোন বন্ধু নেই বললেই চলে । ও নাকি অস্বাভাকিক ।
লাইব্রেরিতে যায় বটে, কিন্তু সব চল্লিশ
পঞ্চাশ বছর আগেকার বই খোঁজে । পায় না । কি করে সময় কাটে কে জানে । সরকার জুয়াখেলা
আইনসিদ্ধ করে দিয়েছে শুনেছি, ওসবে শুভর কোন রুচি নেই । শুভ
কি আমার মত হয়ে গেলো ? আমিতো বিশ পঁচিশ বছর হল বাড়ি বাইরেই
বেরোইনা । কিন্তু শুভ ? ও তো মাত্র ৩৭বছরের যুবক । ভেবেছিলাম
ওর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করি । পাত্রীর সন্ধান পেয়েছিলামও । বাবা মায়ের সঙ্গে
মেয়েটিও এসেছিল । মেয়েটির বাবার সঙ্গে দুএকটা কথা চালাচালির পর মেয়েটি শুভকে
জিজ্ঞাসা করল ‘আপনি কতজন মেয়ের সঙ্গে শুয়েছেন ? আমি কিন্তু জনা দশেকের সঙ্গে রাত কাটিয়েছি এখনো পর্যন্ত’ । ওরাই অতয়েব
রাজি হ’ল না । মেয়েটির মা যাবার সময় বলেছিল দুহাজার
পঞ্চাশে এরকম অস্বাভাকিক যুবক কেউ থাকতে পারে এটা তাদের ধারণা ছিল না । ওর শরীরে
অসুবিধা আছে মনে হচ্ছে । তো এমন বেমানান ছেলেকে নিয়ে আমার চিন্তা তো হবেই ।
শুভকে
বলেছিলাম ছেলে পড়াতে অনেক দূরে যেতে হয়, একটা
বাইক কিনে নে । আর দু একটা নাহয় বেশি পড়া । শুভ বলেছিল, দুটো
ছেলে পড়িয়ে মাস ফুরোলে ৯হাজার পাই, তাতে কি বাইক কেনা যায় ?
তাছাড়া, তুমি আমাকে বাইক কিনতে বলছো জেঠু ?
তুমিই তো গল্পটা শুনিয়েছিলে যে, পাঁচজন লোক
মোটরবাইক চেপে ... । শুভ আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে সাঁইত্রিশ বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে
গেল ।
ছেলেগুলো
মোটরবাইক চেপেই এসেছিল সেদিন । আমি তখন বাঁকুড়ার এক গ্রামে এক সরকারী হাসপাতালের
চিকিৎসক । অনেকগুলো গ্রামের জন্য ওটাই ছিল একমাত্র সরকারী হাসপাতাল । শুভর বাপ
বিন্ধ্যেশ্বর সোরেনের একটা ছোট চায়ের দোকান ছিল হাসপাতাল লাগোয়া আমার কোয়ার্টারের
কাছে । হাসপাতালে রোগীদের , তাদের আত্মীয়-স্বজনদের
আনাগোনা ছিলই । আর হাসপাতালের কাছেই ছিল পুলিশের ফাঁড়ি । সুতরাং মোটামুটি চালু
দোকানই ছিল বিন্ধ্যেশ্বরের । জনা পাঁচেক মুখঢাকা ছেলে বাইকে চেপে এসেছিল । বিন্ধেশ্বর তখন
দুপুরে দোকান বন্ধ করে খেতে গিয়েছিল । ছেলেগুলো সাতে-পাঁচে না থাকা বিন্ধেশ্বরকে
ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে এনে পরপর কয়েকটা গুলি চালিয়েছিল । বৌটা বাধা দিতে
এসেছিল । তার জন্য একটা গুলিই যথেষ্ঠ ছিল ।
যাওয়ার সময় ওরা অপটু হাতে একটা কাগজ রেখে গিয়েছিল লাশ দুটোর পাশে ‘পুলিশের চর বিন্ধেশ্বর সোরেনকে চরম শাস্তি দেওয়া হ’ল । চালা ঘরের ভেতর ওর দু’বছরের ছেলেটার তখন শত্রু-মিত্র, রক্ত, খুন এসব বোঝার কথা নয় । ছেলেটাকে আমি নিয়ে এসেছিলাম ।
তারপর কত কি
বদলে গেলো, পঁয়ত্রিশটা বছর পেরিয়ে গেল । সব
অচেনা হতে লাগলো । নিজেকেও যেন আর চিনতে পারছি না । চিন্তা হয় শুভটাও কি আমার মত
ভুল শিখছে ? বড় চিন্তা হয় ওকে নিয়ে ।
হটাৎ ঘুমটা
ভেঙ্গে গেলো , শুভশ্রীর ঠেলায় । বললো কিগো ?
আজ শুভ সাতে পা দিল, আর তুমি খবরের কাগজ পড়তে
পড়তে ঘুমিয়ে পড়লে ? বাজার যেতে হবে না ?