গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৭ মার্চ, ২০২০

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

দুহাজার পঞ্চাশ


শুভর বয়স কত হল মনে মনে হিসেব করলাম। শুভর বয়স দেখতে দেখতে ৩৭ হল । আর আমি এই শীতে ৮২ ছুঁলাম । এখন দুহাজার পঞ্চাশ । জন্মেছিলাম সেই কবে, ১৯৬৮র ডিসেম্বরে । ছোট বেলার কথা আমার তেমন কিছু মনে নেই । অথচ পরে শুনেছিলাম মনে রাখার মত অনেক কিছুই নাকি হয়েছিল তখন । আট নয় বছর বয়সের কথা অবশ্য এখনও বেশ মনে পড়ে  মনে আছে নয় বছর বয়সে, যখন ক্লাস থ্রীতে পড়ি, প্রথম বাবাকে দেখলাম । বাবা জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছিল তখন । তখন ভবতাম, জেলখানায়তো চোর ডাকাতরা থাকে, কিন্তু বাবা কেন ওখানে ছিল ? কেন ছিল, কতদিন ছিল এসব কথা মা আর দাশুকাকার কাছে শুনেছিলাম । দাশুকাকা খুব ভালো কবিতা বলতো । কয়েকটা পংক্তি এখনো আমার মনে আছে । বলতো কিনু গোয়ালার গলি / সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি /বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোছনা / ময়লা হাতে ওকে তোরা ছুস না / ওরে মন, পৃথিবীর গভীর /গভীরতর অসুখ এখনদাশুকাকা বলেছিল তোর বাবা ছিল সোনার টুকরো ছেলেদের একজন । তা সেই সোনার টুকরো ছেলেদের কথা দাশুকাকাই শোনাত । দাশুকাকা যে গলিটা দিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতো, একদিন নাকি ফেরার সময় আধঘন্টা মাথার ওপর হাত তুলে হাঁটতে হয়েছিল, আর পাঁচ ছটা লাশ ডিঙ্গিয়ে আসতে হয়েছিল । সে থাক । এই দুহাজার পঞ্চাশে ওসব প্রায় আশি বছর আগের কথা কে আর শুনতে চাইবে ? লোকে পাগল বলবে । তাছাড়া, আমার কথা তো বলতে চাই না । আমার চিন্তা শুভকে নিয়ে ।

শুভ আমার ছেলে নয়, বলতে গেলে কেউই নয় । আবার শুভ আমার অনেক কিছুই । শুভশ্রী মানে আমার স্ত্রী সেও ওর মা নয়   শুভ নামটা ওরই দেওয়া । শুভ বছর পাঁচেকের হতেই ওর বাবা মায়ের কথা ওকে বলে দিয়েছিলাম । বলেছিলাম তাদের মারা যাওয়ার কথা । আমাকে জেঠু বলে ডাকতে শিখিয়েছিলাম ।

শুভকে নিয়ে ইদানিং আমার খুব চিন্তা হয় । দুহাজার  পঞ্চাশের পক্ষে ও বড়ই বে- মানান । পাড়ায় ওর কোন বন্ধু নেই বললেই চলে । ও নাকি অস্বাভাকিক । লাইব্রেরিতে যায় বটে, কিন্তু সব চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেকার বই খোঁজে । পায় না । কি করে সময় কাটে কে জানে । সরকার জুয়াখেলা আইনসিদ্ধ করে দিয়েছে শুনেছি, ওসবে শুভর কোন রুচি নেই । শুভ কি আমার মত হয়ে গেলো ? আমিতো বিশ পঁচিশ বছর হল বাড়ি বাইরেই বেরোইনা । কিন্তু শুভ ? ও তো মাত্র ৩৭বছরের যুবক । ভেবেছিলাম ওর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করি । পাত্রীর সন্ধান পেয়েছিলামও । বাবা মায়ের সঙ্গে মেয়েটিও এসেছিল । মেয়েটির বাবার সঙ্গে দুএকটা কথা চালাচালির পর মেয়েটি শুভকে জিজ্ঞাসা করল আপনি কতজন মেয়ের সঙ্গে শুয়েছেন ? আমি কিন্তু জনা দশেকের সঙ্গে রাত কাটিয়েছি এখনো পর্যন্তওরাই অতয়েব রাজি হল না । মেয়েটির মা যাবার সময় বলেছিল দুহাজার পঞ্চাশে এরকম অস্বাভাকিক যুবক কেউ থাকতে পারে এটা তাদের ধারণা ছিল না । ওর শরীরে অসুবিধা আছে মনে হচ্ছে । তো এমন বেমানান ছেলেকে নিয়ে আমার চিন্তা তো হবেই ।

শুভকে বলেছিলাম ছেলে পড়াতে অনেক দূরে যেতে হয়, একটা বাইক কিনে নে । আর দু একটা নাহয় বেশি পড়া । শুভ বলেছিল, দুটো ছেলে পড়িয়ে মাস ফুরোলে ৯হাজার পাই, তাতে কি বাইক কেনা যায় ? তাছাড়া, তুমি আমাকে বাইক কিনতে বলছো জেঠু ? তুমিই তো গল্পটা শুনিয়েছিলে যে, পাঁচজন লোক মোটরবাইক চেপে ... । শুভ আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে সাঁইত্রিশ বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে গেল ।

ছেলেগুলো মোটরবাইক চেপেই এসেছিল সেদিন । আমি তখন বাঁকুড়ার এক গ্রামে এক সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসক । অনেকগুলো গ্রামের জন্য ওটাই ছিল একমাত্র সরকারী হাসপাতাল । শুভর বাপ বিন্ধ্যেশ্বর সোরেনের একটা ছোট চায়ের দোকান ছিল হাসপাতাল লাগোয়া আমার কোয়ার্টারের কাছে । হাসপাতালে রোগীদের , তাদের আত্মীয়-স্বজনদের আনাগোনা ছিলই । আর হাসপাতালের কাছেই ছিল পুলিশের ফাঁড়ি । সুতরাং মোটামুটি চালু দোকানই ছিল বিন্ধ্যেশ্বরের ।  জনা পাঁচেক মুখঢাকা ছেলে বাইকে চেপে এসেছিল । বিন্ধেশ্বর তখন দুপুরে দোকান বন্ধ করে খেতে গিয়েছিল । ছেলেগুলো সাতে-পাঁচে না থাকা বিন্ধেশ্বরকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে এনে পরপর কয়েকটা গুলি চালিয়েছিল । বৌটা বাধা দিতে এসেছিল  তার জন্য একটা গুলিই যথেষ্ঠ ছিল । যাওয়ার সময় ওরা অপটু হাতে একটা কাগজ রেখে গিয়েছিল লাশ দুটোর পাশে পুলিশের চর বিন্ধেশ্বর সোরেনকে চরম শাস্তি দেওয়া হ   চালা ঘরের ভেতর ওর দুবছরের ছেলেটার তখন শত্রু-মিত্র, রক্ত, খুন এসব বোঝার কথা নয় । ছেলেটাকে আমি নিয়ে এসেছিলাম ।

তারপর কত কি বদলে গেলো, পঁয়ত্রিশটা বছর পেরিয়ে গেল । সব অচেনা হতে লাগলো । নিজেকেও যেন আর চিনতে পারছি না । চিন্তা হয় শুভটাও কি আমার মত ভুল শিখছে ? বড় চিন্তা হয় ওকে নিয়ে ।


হটাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো , শুভশ্রীর ঠেলায় । বললো কিগো ? আজ শুভ সাতে পা দিল, আর তুমি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লে ? বাজার যেতে হবে না ?