ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিণী—৪৮
লোহাঘাট, উত্তরাখণ্ডের
এক অলৌকিক কাহিণী
তাপসকিরণ রায়
এ কাহিনী উত্তরাখণ্ডের। ইউ.টিউব খুললে এই গল্পের নানান ধরনের ভিডিও খুঁজে
পাওয়া যায়। ভ্রমণার্থীরা অনেকেই ঘুরতে যান উত্তরাখণ্ডের এই চম্পাবত জেলায়। উত্তরাখণ্ডের চম্পাবত একটি অত্যন্ত বিখ্যাত পর্যটন
কেন্দ্র এবং এক সময়
চন্দ শাসকদের রাজধানীও ছিল। চম্পাবত এই ভাবে ইতিহাসে সমৃদ্ধ এবং পাশাপাশি এখানে প্রচুর ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে।
ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীতে এইখানেই ভগবান বিষ্ণু ‘কুর্মাবতার’ (কচ্ছপ রূপে আবির্ভূত) হিসাবে উপস্থিত হয়েছিলেন।
এই অঞ্চলে অবস্থিত অসংখ্য মন্দিরের কারণে চম্পাবত বহু
তীর্থযাত্রীকে আকর্ষণ করে। মন্দিরগুলি সুন্দরভাবে নির্মিত এবং খোদাই করা। তাদের
মধ্যে কিছু মন্দির চন্দ শাসকদের সময়ে তৈরি। চম্পাবত
জেলা শহর থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে লোহাঘাট এলাকা। এখানে জঙ্গল
পাহাড় এলাকায় ইংরেজ আমলের এক বিখ্যাত ডাক্তার, মরিস সপরিবার বাস করতেন। এ অঞ্চলে
তাঁর বেশ নামডাক ছিল। ইংরেজ
আমলে সেখানকার
কিছু জমি লিজ নিয়ে তিনি বাস
করতে শুরু করেন। তাঁর বাংলো পরিসরে একটা হসপিটাল ও চার্চ ছিল। হাসপাতাল
ছিল পাকা দেওয়ালের ওপরে এসব্যাস্টাসের চাল দিয়ে ঘেরা। অনেকটা গোডাউন আকৃতির। আর চার্চ ছিল
সাধারণ আর চারটা চার্চের মতই। প্রার্থনার সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট, তার সামনে
পাদ্রীর বক্তৃতা মঞ্চ ছিল। বাকি ছিল সংলগ্ন কিছু ঘর। পরবর্তী সময়ে এখানে চার্চের পাশে কবরখানা তৈরি হয়েছিল।
ডক্টর মরিস আশপাশের
গ্রামগুলোতে ঘুরেফিরে রোগী দেখতেন। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে খুব মান্যতা দিত।
ডাক্তারের হাতে অনেক কঠিন রোগগ্রস্ত রোগী ভালো হয়েছে। এভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁর বেশ
নাম-যশ হয়েছিল। গ্রামবাসীরা এও জানতে পেরেছিল যে মরিস শুধু ডাক্তার নন, তিনি
একজন ভবিষ্যৎ বক্তাও বটে। রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখে তিনি রোগীর মৃত্যুর
দিন ও সময় বলে
দিতে পারতেন। তিনি
বলে দিতে পারতেন কোন
রোগীর মৃত্যু
কবে ও কখন হবে। এ ধরনের ভবিষ্যৎ বাণীর ফলাফলগুলি হত একেবারে সঠিক। মরিসের মধ্যে নাকি এমনি ভাবে বলে দেবার মত অলৌকিক শক্তি ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা শুরুতে ডাক্তারের কার্যকলাপে
আশ্চর্য চকিত হয়ে থাকত। তারপর ধীরে ধীরে জানা গেল ডাক্তার মরিসের মধ্যে
নাকি এক
ধরণের পাগলামি
রয়েছে। তিনি
যে সব
রোগীর ওপর ভবিষ্যৎ বাণী করতেন সে সব
মৃতপ্রায় রোগীদের নিয়ে তুলতেন নিজের হাসপাতালের নিজস্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষার গবেষণাগৃহে। হাসপাতাল
সংলগ্ন এই গবেষণা ঘরের নাম দেওয়া হয়েছিল মুক্তিকুটির। এই মুক্তিকুটিরে যে
সব রোগীকে ডাক্তার নিয়ে যেতেন তারা কিন্তু আর জীবিত ফিরে আসত না। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী হিসাবে ওই
নির্দিষ্ট দিন ও
সময়ে ওই
রোগীর মৃত্যু ছিল অবধারিত। কি
ভাবে সে রোগীর মৃত্যু হত ? ডাক্তার মরিস সে
রোগীর ওপর তাঁর গবেষণা শুরু করতেন। রোগীদের
তিনি ইনজেকশন দিয়ে বেহুশ করে দিতেন। এর
পর চলত রোগীর দেহে কাটা ছেঁড়া। হাতুড়ির বাড়িতে তিনি রোগীর মাথার খুলি ফাটিয়ে দিতেন, চালাতেন বীভৎস রকমের গবেষণা ! এ ভাবে স্থানীয় লোকের কাছে ডাক্তার পাগলা ডাক্তার বলে
পরিচিত হলেন। তাঁর গবেষণার
প্রধান বিষয় না কি ছিল, মানুষের মৃত ও জীবিত কালের মাঝখানের অবস্থাটা কেমন
হতে পারে তা জানার। স্থানীয়
কেউ কেউ বলে, মানুষের মস্তিষ্ক আসলে কি ভাবে কাজ করে--এটা জানার ব্যাপারটা তার গবেষণার মধ্যে ছিল। আবার কেউ কেউ বলে, পাগল ডাক্তার
মরিস তাঁর গবেষণা দিয়ে স্বর্গ ও নরকের দ্বার খুঁজে বেড়াতেন।
এই উত্তরাখণ্ডের লোহাঘাট অঞ্চলটা আসলে জঙ্গলে পরিপূর্ণ। জঙ্গলের মাঝখান মাঝখান দিয়ে চলেছে গেছে রাস্তা। সে
রাস্তা হয়ত কোন পাহাড়ের কোলে গিয়ে শেষ হয়েছে। আশপাশের জঙ্গল পাহাড়ের নদীর মিলিত দৃশ্যাবলী অতীব মনোহর।
বরফে পাহাড়ের মাথা ঢেকে যায়, তাতে সূর্য রশ্মি
পড়ে বিকীর্ণ হয় নানা রঙ। কখনও তারই মাঝে ফুটে উঠছে সাত রঙা রামধনু। এ ভাবেই চম্পাবত জেলার চারপাশ হয়ে উঠেছে অপূর্ব, আকর্ষণীয়। তা ছাড়া এখানকার তুষারপাতের অপূর্ব দৃশ্যাবলী ভ্রমণার্থীদের
যেন স্বর্গীয় আনন্দ দেয়।
ভ্রমণার্থীদের মধ্যে আবার কেউ কেউ জানতে পারলে আগ্রহী হয়ে
ওঠেন লোহাঘাটের
হ্যান্টেড প্লেস দেখার জন্যে। একটা
সময় ছিল যখন ডাক্তার মরিস ও তাঁর পরিবার এখানেই বাস করতেন। তাঁর পরিবারের কবরও এখানে রয়েছে। এও
জানা যায় যে ডাক্তার মরিচের স্ত্রী ও বাচ্চাদের মৃত্যু তাঁর আগেই ঘটে
ছিল। এ সব উনিশ
শতকের গোড়ার দিকের কথা। এ সব
জায়গা এখন শুনশান, বিরান স্থান হয়ে পড়ে আছে। ভূতগ্রস্ত এই পরিসর সাধারণ জনের প্রবেশের অধিকারের বাইরে।
বর্তমানে ডাক্তার মরিসের বাংলো
ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ থাকে। প্রবেশদ্বারে আঁটা আছে এক বিজ্ঞপ্তি--প্রবেশ নিষেধ। মরিসের
জীবিত অবস্থাতেও এ জাগার ভৌতিক
বদনাম ছিল। এখানকার হাসপাতাল নাকি
এখন প্রধান ভয়ের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাত হলে মুক্তিকুটি সংলগ্ন হাসপাতা্ল, বাংলো বাড়ি, চার্চ
ও কবরস্থান থেকে
বিভিন্ন প্রকার আওয়াজ ও কান্নার শব্দ শোনা যায়। আর এ সব জাগায় ভূত থাকবে নাই বা কেন ? এখানেই তো
ডাক্তার অনেক জীবিত লোকের মাথার খুলি ফাটিয়ে তাঁর বীভৎস গবেষণা চালিয়ে ছিলেন! এ সব রোগী মৃত্যু
যন্ত্রণায় ছটফট করেছে, প্রাণ ফাটা চিৎকার করে মৃত্যু বরণ করে ছিল। ডাক্তার
মরিচ তাঁর নিজস্ব গবেষণার ঘরে নাকি অবৈধ কাজও চালাত। ঘরের ভেতরে কারোরই প্রবেশাধিকার ছিল না।
এ ব্যাপারে স্থানীয় এক বৃদ্ধ বললেন, তিনি কখনও কিছু
দেখেননি, কোন ছায়া বা অশরীরীর দেখা পাননি, তবে আওয়াজ
শুনেছেন। গভীর রাতে নানা রকম আওয়াজ, রান্নার
বাসন-কোসন নাড়াচাড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছেন। তিনি আরও বলেছিলেন, তাঁর বাপ
ঠাকুরদার মুখে শুনেছেন, ডাক্তার মরিস যখন মানুষের মাথার খুলি ফাটিয়ে
পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন তখন
তাঁর ঘর মানে মুক্তিকুটি থেকে নাকি গানের আওয়াজ ভেসে আসত। সে সব গানের বেশিরভাগই
নাকি ছিল হিন্দি গান। অনেকে বলেন, এ ব্যবস্থা রোগীর
মৃত্যুর যন্ত্রণা আর তার চীৎকার চাপা দেবার জন্যই হয়ত করা হয়ে ছিল। স্থানীয় লোকের
কথা হল--মরিস তাঁর গবেষণার নাম করে অনেক লোককে মেরেছেন। সেই মৃত লোকদের আত্মারই
নাকি চার্চ, কবরস্থান, হাসপাতাল ও
মুক্তিকুটির চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ নাকি আত্মাদের ছায়া ঘুরে বেড়াতে
দেখেছে। উত্তরাখণ্ডের এই লোহাঘাটের কাহিনী বেশ লোক প্রচার
হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়াতে এর চাউর হয়েছিল। ইউটিউবে এর ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। এ
সব কিছুর পরেও আজতক নিউজ চ্যানেল থেকে এই ঘটনার সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য একদল
এখানে আসেন। তাদের সঙ্গে রাখা ছিল সেন্সাস ক্যামেরা, সাউন্ড ডিটেক্টর, এমনি ধরনের আরও
যন্ত্রপাতি যা দিয়ে কিনা ভূত-ভৌতিক ও অলৌকিক ঘটনাগুলো যাচাই করা সম্ভবপর হয়।
আজতক চ্যানেলের এ গ্রুপের তৈরি, অদ্ভুত অবিশ্বাস্য অকল্পনীয়, প্রোগ্রামটা নিয়মিত
প্রচার-প্রসারিত হয়। আজতকের দল হাজির হয়েছিলেন লোহাঘাটে--মরিচের বাংলো বাড়ি ও
তার পাশের কবরস্থান ঘুরে দেখার জন্যে। তবে ওঁরা যখন পৌঁছালেন তখন সময়টা ছিল দিনের
বেলা। সে সময় অলৌকিক ভৌতিক কোন প্রকার কার্য্যকলাপের আভাস বা সংকেত পাওয়ার
সম্ভাবনা ছিল অনেক কম। তাই আজতকের দল দিন ভর আশপাশের গ্রামে ঘুরে ঘুরে হ্যান্টেড
প্লেসের ব্যাপারে তাদের স্টেটমেন্ট নিতে থাকলেন। বয়স্ক, বৃদ্ধ
গ্রামবাসীদের কাছ থেকে অনেক কথা ওঁরা সংগ্রহ করলেন। অনেক
অলৌকিক ঘটনার কথা গ্রামের অনেকেই বলল। তাদের মধ্যে কেউ বলল, ঐ পরিসরে রাতে
ছায়াদের ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। সবার মুখেই নানা রকম শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা জানা
গেল। কেউ কান্নার আওয়াজ শুনেছে, ওই সব ঘরের মধ্যে থেকে ফিসফাস শব্দ শোনার কথা
বলেছে। কখনও গভীর রাতে ঘর থেকে বাসন-কোসন সরানো বা ধোয়ার আওয়াজ অনেকেই পেয়েছে।
না, ওদের মধ্যে কেউ বলেনি যে ডাক্তার মরিসকে তারা দেখতে পেয়েছে
বা তাদের গ্রামের কোন অত্যাচারিত মৃত ব্যক্তির আত্মাকে তারা কোন দিন দেখেছে বলে।
এ পর্যন্ত জানার পর আজতকের দল গভীর রাতে হাজির হয়েছিলেন
ডাক্তার মরিসের বাংলো বাড়ির পরিসরে। বাংলো ছাড়াও তার কাছাকাছি হাসপাতাল, চার্চ, হাসপাতাল সংলগ্ল
মুক্তিকুটি এ সব কিছুই ওঁদের ভৌতিক ইনভেস্টিগেশনের আওতায় ছিল। ওঁরা তিন-চার জনের
একটা দল অনুসন্ধান করে চলেছেন। ওদের
সঙ্গে ভৌতিক এনার্জির উপস্থিতি টের পাওয়ার জন্য রয়েছে নানা যন্ত্রপাতি। সে সব
ওঁরা চালু করে দিয়েছেন। গ্রুপের একজন অশরীরীদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, আমাদের উপস্থিতি
কি আপনারা পছন্দ করছেন না ? আমরা শুধু জানতে
চাইছি আপনাদের কেউ এখানে উপস্থিত আছেন কি না ? আর উপস্থিত যদি কেউ থেকে থাকেন তা হলে প্লীজ আমাদের
সংবেদন শীল সেন্সাস যন্ত্রের তিনটি আলো জ্বালিয়ে দেখান !
খানিক পরেই সেন্সাস যন্ত্রের লাইট জ্বলে উঠল--একটা, দুটো, তিনটে লাইট
জ্বলার সংকেত দিল। এর অর্থ হল কোন অলৌকিক অস্তিত্বের উপস্থিতি সেখানে রয়েছে।
যন্ত্র নাকি এভাবেই অস্বাভাবিক সংকেত দিয়ে ভৌতিক উপস্থিতির কথা বলে দেয়। সাউন্ড
ডিটেক্টর কিছু সংকেত শব্দ দিলেও অলৌকিক কোন শব্দের যথাযথ অনুমান লাগানো সম্ভব হল
না। এর
মধ্যে হঠাৎই ওদের ক্যামেরায় ধরা পড়ল একটা স্পষ্ট লাইট, একটা উজ্জ্বল সবুজ রঙের বড়সড় আলোক বিন্দু। সে
ব্যাপারটাও অলৌকিক উপস্থিতির সত্যতার প্রমাণ দিচ্ছিল। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়ে গ্রুপের লোকরা বেশ ভীত
রোমাঞ্চিত হয়ে পড় ছিলেন। তাঁদের মনে হচ্ছিল, এই বুঝি তাঁরা
কিছু একটা দেখে ফেলবেন, হয়ত হঠাৎই ডাক্তার মরিচ এসে তাদের সামনে দাঁড়াবেন !
কিংবা অন্য কেউ যাকে ডাক্তার মরিস তাঁর গবেষণার সময় হাতুড়ি দিয়ে মাথা ভেঙে টুকরো
টুকরো করেছিলেন, সেই সব নিগৃহীত যন্ত্রণা কাতর কোন আত্মা হয়ত তাদের
সামনে এসে হাজির হবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হল না। এমন কি কোন রকম ছায়াও তাঁরা দেখতে
পেলেন না। তাঁদের যন্ত্রপাতি ভৌতিক উপস্থিতির প্রমাণ দিলেও শারীরিক আকৃতিতে কোন
আত্মারাই তাঁদের দর্শন দিলো না। এভাবেই প্রায় রাতভর কাটিয়ে আজতক দল তাঁদের
প্রোগ্রাম সেরে ফিরে এসেছিল। বলতে হবে তাঁদের সে অভিযান ব্যর্থ হয়নি, ভৌতিক উপস্থিতি
তাঁরা যন্ত্রের পরিমাপে ধরতে পেরেছিলেন। যন্ত্রের তিনটি আলো জ্বলে উঠেছিল, এভাবেই অলৌকিক
উপস্থিতির সংকেত তাঁরা পেয়েছিলেন। আর সেখানেই আজতক চ্যানেলের সে দিনের অভিযান ছিল
সার্থক।