গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২০

সুবীর কুমার রায়


রতনের রক্তদান

স্ত্রী নমিতা, ও ছোট ছোট তিনটি শিশু সন্তানকে নিয়ে অটলবাবু ফুলবাড়ি গ্রামের একবারে শেষপ্রান্তে, অভাবের সংসারেও দিব্যি ছিলেন। চাকরিসূত্রে তাঁকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের একটা মহকুমা শহরে থাকতে হতো। একটা হোটেলে তিনি কাজ করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার হোটেল বন্ধ থাকায়, বুধবার বেশ রাতে বাড়ি ফিরে শুক্রবার খুব ভোরে কর্মস্থলে ফিরে যেতেন।

হোটেলে তাঁর বড় ছেলে সনাতনের বয়সি, বছর দশেক বয়সের রতন নামে একটা ছেলে কাজ করতো। বিভিন্ন কারণে ছেলেটিকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। অভাবের তাড়নায় বহু দূরের এক গ্রাম থেকে কাজ করতে আসা অতি দরিদ্র এক ভদ্র পরিবারের ছেলেটি তাঁর বড় ছেলের বয়সি, সৎ ও পরিশ্রমী। অতি লোভী ও সুযোগ সন্ধানী হোটেল মালিক, সুযোগ পেয়ে তাকে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমস্ত কাজ করিয়ে নেয়। মাইনে-কড়ি সেরকম না দিলেও, পান থেকে চুন খসলেই প্রহারের ব্যাপারে কখনও কার্পণ্য করেন না। পরিবর্তে রতনের কপালে উচ্ছিষ্ট খাবার, আর রাতে খাবার টেবিলে হাঁটুমুড়ে মশার কামড়ের মধ্যে ঘুমবার সুযোগ মেলে। ছুটি না মেলায় সে তার ইচ্ছামতো নিজের গ্রামেও যেতে পারে না, আর গ্রামে যেতে না পারায়, মাইনের সব টাকাটাই বাড়ি যাওয়ার সময় একসাথে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালিক তাঁর নিজের কাছেই রেখে দেন।

বেশ চলছিল, কিন্তু একদিন খাবার টেবিল থেকে গায়ে বেশ জ্বর নিয়ে কাপ-ডিশের ট্রে রান্নঘরে রাখতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা কাপ-ডিশ ভেঙে ফেলায়, কপালে প্রচণ্ড প্রহার জোটে। অভুক্ত অবস্থায় সারারাত টেবিলের ওপর শুয়ে থেকে সে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঘটনাটা অটলবাবুর খুব খারাপ লাগলেও নিজের চাকরি রক্ষার্থে মুখ বুজে ছিলেন। তারপর দুটো দিন সে গায়ে বেশ জ্বর নিয়ে আচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে থাকে। বুধবার দুপুরের পর থেকে তাকে কিন্তু আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে কেউ আর সেভাবে তার খোঁজও করলো না।

বুধবার রাতের দিকে অটলবাবু বাড়ি ফেরার জন্য রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখেন, প্ল্যাটফর্মের ওপর রতন গায়ে বেশ জ্বর নিয়ে কুকুরকুণ্ডলী হয়ে শুয়ে আছে। অটলবাবু তাকে সাথে করে নিজের বাসায় নিয়ে যেতে আর দ্বিধা করেননি। সেই থেকে রতন, অটলবাবুর বাড়ির একজন সদস্য হয়ে গিয়ে আজও আছে। অটলবাবু তাকে সনাতনের সাথে লেখাপড়াও শেখাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দু’-তিন বছর স্কুলে গিয়ে, সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে একটা কারখানায় কাজ করতে শুরু করে, ও সন্ধ্যার পর বাড়ির সমস্ত কাজে সাহায্য করে। অটলবাবু কিন্তু আগের মতোই হোটেল বাড়ি করেন। বাজার দোকান ঘরের কাজ নিয়ে নমিতাকে এখন আর কোন চিন্তা করতে হয় না। এখন অটলবাবুর সুখের সংসারে অসুবিধা হয় তখন, যখন রতন তার গ্রামের বাড়িতে যায়। তা সেও তো দু’-তিনমাস অন্তর দিন দশ-পনেরোর জন্য। এইভাবে বেশ চলছিল। এখন রতনকে ছাড়া একটা দিনও নমিতার নিশ্চিন্তে বা শান্তিতে কাটে না।

অন্যান্য বারের মতো একদিন গ্রামের বাড়িতে দিন পনেরোর জন্য গিয়ে, রতন আর ফিরে এলো না। অটলবাবু বা তার কারখানার মালিক, কেউই তার গ্রামের বাড়ি চিনতেন না। এইভাবে একদিন সকলেই  ধরে নিলো যে রতন আর ফিরবে না। মাস দুয়েক পরে এক সন্ধ্যায়, প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রতন অটলবাবুর বাড়িতে ফিরে এলো। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই, যে তার মাথায় ছাতা না থাকলেও সে বিশেষ ভেজেনি। সে যাইহোক, রতন জানালো, যে একটা পথ দুর্ঘটনায় ভীষণরকম আঘাত পেয়ে তাকে কাছের এক শহরের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। সেখানেই জানা যায়, যে তার ব্লাডগ্রূপ নাকি এবি নেগেটিভ। ফলে রক্তের প্রয়োজন হলেও ওই বিশেষ গ্রুপের রক্ত না পাওয়ায়, ডাক্তাররা খুব অসুবিধায় পড়েন। যাইহোক এই কারণেই সে সময়মতো ফিরতে পারেনি। পরদিন সকালে রতন কারখানায় গিয়ে তার সময়মতো ফিরে না আসার কারণ, সবিস্তারে জানালো। সে যে খুব সৎ, কর্মঠ, ও ভালো কর্মী, এটা তার কারখানার মালিকও বুঝতেন। ফলে সেখানে কাজ ফিরে পেতেও তার কোন সমস্যা হলো না, বরং সে ফিরে আসায়, মালিকটি খুশি ও নিশ্চিন্ত হয়ে, তাকে এই দুই মাসের মাইনেও নিজেহতেই দিয়ে দিলেন।
এইভাবে দীর্ঘ অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। রতন কিন্তু আর কোনদিন তার গ্রামের বাড়িতে যায়নি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও, রতনের চেহারার কোন পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু তার কর্মক্ষমতা যেন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘরের ও কারখানার সব কাজ সে খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিখুঁতভাবে গুছিয়ে করে ফেলে। কারখানার এখন বেশ উন্নতি হওয়ায় ও আয় বৃদ্ধি হওয়ায়, মালিক খুশি হয়ে তার মাইনেও অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছেন।

খুব হইচই করে একদিন পূর্ণিমা নামে একটি মেয়ের সাথে সনাতনের বিয়ে হয়ে গেল। বরকর্তা অটলবাবু হলে কি হবে, প্রকৃত বরকর্তার কাজটা রতনই একা হাতে সামলেছে। শুধু কি তাই? তার জমানো প্রায় সমস্ত টাকাই সে সনাতনের বিয়েতে খরচা করে ফেলেছে। অটলবাবু, নমিতা ও সনাতনের তীব্র আপত্তিতে সে শুধু বলেছে, “আমার আর টাকা কিসের দরকার বলো? প্রয়োজন হলে তখন তোমরা তো আছোই, আমি জানি তোমরা আমায় দেখবেই”।
 
দেখতে দেখতে আরও দুটো বছর কেটে গেল। আসন্ন সন্তান সম্ভবা পূর্ণিমাকে, মহকুমা শহরের একটা নার্সিং হোমে ভর্তি করা হলো। কিন্তু অবস্থার জটিলতা দেখা দেওয়ায় টাকা ও রক্তের প্রয়োজন দেখা দিলো। অটলবাবু তাঁর হোটেল মালিকের কাছে কিছু টাকা ধার চাইলেন, কিন্তু হোটেল মালিক নানা অজুহাত দেখিয়ে একটা টাকাও ধার দিতে অস্বীকার করলেন। রাগে দুঃখে অটলবাবু এককথায় এতদিনের চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। রতনের কারখানার মালিক কিন্তু রতনের অনুরোধে, এক কথায় মাসে মাসে তার মাইনে থেকে কেটে নেওয়ার শর্তে বেশ কিছু টাকা ধার দিয়ে দিলেন। টাকার সমস্যা মিটলেও, রক্তের ব্যবস্থা কিন্তু করা গেল না। কারণ সেই একই, সনাতনের স্ত্রী পূর্ণিমার ব্লাড গ্রূপ এবি নেগেটিভ।

কোনভাবেই রক্তের ব্যবস্থা করতে না পারায়, ও রতন এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব থাকায়, অটলবাবু ও নমিতা সেই অগতির গতি রতনকেই রক্ত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু এই প্রথম সে তাঁদের সাহায্য করতে অস্বীকার করলো। চোখের সামনে সনাতনের স্ত্রী ও বাচ্চার মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা বুঝিয়েও কোন লাভ হলো না। ডাক্তারও তাকে অনেকভাবে বোঝালেন, যে রক্তদান করলে কারও ক্ষতি হয় না। তার রক্ত অত্যন্ত মূল্যবান, কারণ এবি নেগেটিভ রক্তের গ্রূপের মানুষের সংখ্যা খুব কম। যদিও রতন একবার বললো, যে সে এটা ভালভাবেই জানে, তবু এরপরেও সে তার শরীর থেকে এক ফোঁটাও রক্ত দিতে রাজি হলো না। এর পরেও কোনভাবে রক্ত জোগাড় না হওয়ায়, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সকলেই ঠিক করলেন, যে দু’-দুটো মানুষকে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে, জোর করে রতনের দেহ থেকে আপাতপ্রয়োজনে রক্ত নিয়ে সনাতনের স্ত্রী পূর্ণিমাকে দেওয়া হবে।

পরিকল্পনামাফিক জোর করে শুইয়ে চেপে ধরে রক্ত নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে, রতনকে কিন্তু কোন বাধা দিতে দেখা গেল না। ডাক্তার তার শরীর থেকে রক্ত নিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন, যে রতনের শরীরে কোন রক্ত নেই। বিষ্ময়ের আরও বাকি ছিল। দেখা গেল রতনের শরীরটা ধীরে ধীরে টেবিলের ওপর থেকে কর্পূরের মতো উবে গেল। যাহোক শেষপর্যন্ত অনেক চেষ্টায় রক্তের সংস্থান হওয়ায়, কোন সমস্যা ছাড়াই সনাতনের স্ত্রী একটি সুস্থ ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করে বটে, কিন্তু আর মাত্র চারটি ঘটনায় অটলবাবুর পরিবারকে যারপরনাই বিষ্মিত হতে হয়।

এতোগুলো বছর পরে অনেক খোঁজখবর করে রতনের গ্রামে গিয়ে জানা যায়, যে বহু বছর আগে সেদিনের সেই পথ দুর্ঘটনায় রতনের মৃত্যু হয়। মহকুমা শহরের অটলবাবু যে হোটেলটায় কাজ করতেন, সেটি হঠাৎ আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ ভষ্মীভুত হয়ে হোটেলের মালিক সর্বস্বান্ত হন। রতনের কারখানার মালিক, সকলকে টপকে একটা অনেক টাকার টেন্ডার পান, ও কোন পূর্বাভাস ছাড়াই সনাতনের চাকরিতে বেশ বড়সড় একটা পদোন্নতি হয়।