গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮

দীপলেখা মুখার্জী

সমর

প্রথম যখন স্বামীর ঘর করতে গেল পরী তার বয়স সবে আঠেরো। দশ বছরের বড় ব্যবসাদার ছেলের সাথে বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়েই সংসারে নেমে ছিল সে। না কোন প্রেম পীরিতের চক্কোরে পরেনি পরী। রীতিমত চুলের গোছা,পায়ের পাতা, শুক্তোর ফোড়ন, গানের গলা, হাতের লেখার পরীক্ষায় উতরে তবে, ওই শশুরঘরে আলতার ছাপ ফেলে প্রবেশাধিকার মিলেছিল। পরীর চাওয়া পাওয়া চিরকালই খুব সাধারন কুলের পাশে নুন, ভাতের পাশে কঁাচা পেঁয়াজ বা লাল জামার সাথে লাল টিপেই সে খুশি।
বাসর রাতে প্রথম তার বরকে দেখল পরী। সক্কলে বলছিল, ওমন ফর্সা, লম্বা মেয়ের এমন কালো মোটা বর!.কিন্তু পরীর নিজের স্বামীকে দেখে খুব যে অপচ্ছন্দ হল তাও নয়। দিম্মা বলত, ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে একটু কমা দেখতে হলেই ভাল, তাতে মেয়েদের সুখ বারে। মেয়েরা বর সোহাগি হয়,তাছাড়া সোনার আংটি আবার  বেঁকা?!
পরীর স্বামীর কুরিয়ারের ব্যবসা।সচ্ছল পরিবার।
  সকাল দশটায় বেরিয়ে যায় অমর, ফেরে রাত নটায়।তবে অমরকে একটু ভয়ই পায়।
সব বন্ধুরা, আত্মীয়রা জিজ্ঞেস করতে লাগল,হানিমুনে কোথায় যাবি রে?তাই সেদিন রাতে একটু ভয় ভয়েই জিজ্ঞেস করল স্বামী কে, "আচ্ছা আমরা হানিমুনে কোথাও যাব?" শুধুই জিজ্ঞাসার সুর, আবদার বা আদেশ কিছু নয়। কিন্তু সেইটুকুতেই যেন, আগুনে ঘি পারল। "কেন এরই মধ্যে ঘরে মনটিকছে না বুঝি?..বিয়ের আগে খুব বেড়াতে না? কার সাথে যেতে ওই পিসতুতো দাদা? নাকি ওই মাসির ছেলে,যে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়,তোমার জন্য,সাবানটা, চকলেটা নিয়ে আসে.. চকলেট খাবে, আমার ছোট বুনুরে!!" বলে এমন নোংরা অভিব্যক্তি করতে লাগল, ভয়ে পরী বাথরুমে ঢুকে পড়েছিল।
রোজ রাতেই প্রায় নেশা করে ফেরে তার স্বামী।
  তার বিরুদ্ধে গোছা গোছা অভিযোগ জমা পরে অমরের কাছে,খাবার টেবিলে, আজ বারান্দায় দঁাড়িয়ে চুল বঁাধছিল, আজ মাছ পুড়িয়ে কয়লা, সন্ধ্যেবেলা গা ধুয়ে চুল বেঁধে সেজে বসেছিল, পিসতুতো দাদা আসবে বলে, একটা কাজ যদি পারে তোর বউ, ভাত গলিয়ে পাঁক,.. কাপ ভেংগেছে, ছাদ ঝাড় দেওয়ার নাম করে, পাশের বাড়ির বউয়ের সাথে কি আড্ডা! কি আড্ডা!.. বড়ির নাক সব থেবরা, একটা রুটিও ফুললো না,রুটিবেলার এমন ছিরি!!...
দোষের শাস্তি পেত রাতে,মার,নোংরা গালাগালি, দৈহিক অত্যাচার। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পছিল পরী। নরম পরীর চোখে জলও আসে না। বাবা মায়ের ওপর অভিমান করে বাপের বাড়ি যাওয়া ছাড়ল, এরকম ভাবেই আস্তে আস্তে নিজেকে শেষ করে ফেলবে ঠিক করে ফেলেছিল সে, কিন্তু বিধি বাম। বছর তিনেকের মাথায় শরীর জনান দিল, সে একা নয়, তার শরীরে আর একটি ক্ষুদ্র প্রাণ বাসা বেঁধেছে। ভাবল, সে যা পারেনি,হয়ত এই পুচকিটা তাই পারবে, দালান বাড়িটাকে কে ঘর বানিয়ে দেবে। খবরটা পেয়ে বাবা মা এল, তাকে নিয়ে গেল সাথে করে, এই সময় মেয়েদের বাপের বাড়িই থাকা ভাল, তাই  সাত মাসে 'সাধ' দিল, পরীর মা ঘটা করে, শশুরবাড়ির লোকজন সব এল, খেল,  যাবার আগে জানিয়ে দিয়ে গেল, "শোন মা পরী, তোমাদের বাগানে তো একটা কুয়ো আছে দেখলাম। মেয়ে হলে ওখানে ফেলে দিয়ে যেও।" কথাটা শুনে আপাদমমস্তক কেঁপে উঠল পরী, পেটের ভিতর বাচ্চাটাও ভয়ে পাশ ফিরল বোধ হয়।"ওর স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখল, মিট মিট করে হাসছে! ঠিক সেই মূহুর্তেই ঠিক করে ফেলল, পরী সে আর কখনো ওই বাড়ি ফিরবেনা।
 ছেলেই হল,কিন্তু শশুরবড়ি আর ফিরলনা পরী। তারপর অনেক ঝড়, বাবা মারা যাওয়া, দাদারা আলাদা হওয়া, শশুরবাড়ির সাথে কোর্টকাছারি। উদয় অস্ত খেটে নিজের একটা বুটিক  খোলা,ছেলেকে মানুষ করে তোলা। মায়ের দেখা শোনা করা।সেই নরমসরম পরী আজ পালটে গেছে অনেকখানি। আজ পরী খুব ব্যাস্ত, কাল তার ছেলে সমরের আঠেরো বছরের জন্মদিন। ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠান, কিছু সমরের বন্ধুরা আসবে, তার ব্যবস্থা করেছে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে, সমরের জন্য টি সার্ট, জিন্স, কেক, কোল্ডডিন্স, মোমবাতি, চকলেট সব কিনে ঘরে ফিরল রাত করে। মা বলল, "দেখতো সমর কোথায়? সেই দুপুরে খেয়ে বেড়িয়েছে। 
"ও!দেখছি, চিন্তা করোনা মা,আমি ফোন করছি, তুমি প্রেশারের ওষুধ খেয়েছ?" বলতে বলতে সমর কে ফোন করল,  এই ছেলে তুই কোথায় রে? সেই দুপুরে বেড়িয়েছিস।" ওই প্রান্ত থেকে সমর বলল, বাবার সাথে কথা বলো, আমি এখন থেকে বাবার কাছেই থাকব, আমারতো একটা ভবিষ্যৎ আছে, বাবা আমাকে বিদেশে পাঠাবে বলেছে, হায়ার স্টাডিরর জন্য। তুমি আমায় আর ফোন করোনা মা।"......ফোনটা কেটে গেল। অনন্ত নিঃশব্দতা।হাত থেকে সদ্য কেনা উপহার সব মাটিতে ছড়িয়ে পরল!...মা পাশের ঘর থেকে ছুটে এল। বহুদিন পর, পরী তীক্ষ্ণ চিৎকার করে কেঁদে উঠল, "আমি পারলাম না মা!!হেরে গেলাম, আমি হেরে গেলাম.".. বলে মাটিতে লুটিয়ে পরল পরী। রাত যখন অনেক পরী,ঈশ্বরের কাছে   হাতজোড় করে প্রার্থনা করল,ওকে ক্ষমা করো,ওর স্বপ্ন সফল করো ঠাকুর।


অন্যদিকে তখন উৎসব, ঘড়ির
কাঁটায় বারোটা।