গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮

মনোজিৎকুমার দাস

লজ্জা                                                                                  

ব্রিটিশ আমল। গ্রামগঞ্জে থিয়েটারের হতো সেকালে।কলকাতা থেকে বাবুরা পুজোর সময় বাড়ি এসে থিয়েটার করতো গ্রামের ছেলেদের নিয়ে।মেয়েরা তখন এদিক মারাতো না।তাই ছেলেদেরকে সখি নায়িকা সাজতে হতো।দাঁড়ি গোঁফ না গজানা ফুটফুটে চেহারার ছেলেদের কদর ছিল মেয়ে সেজে সখি কিংবা নায়িকা হবার জন্যে।

পাশাপাশি দুটো গ্রাম ফুলঝুরি, আর মৌকুড়ি।গ্রাম দুটোর মধ্যে মিলমহব্বত থাকলেও গান বাজনা নিয়ে তাদের প্রতিযোগিতা ছিল বেজায় রকমের। ফুলঝুরির সেন জমিদার মৌকুড়ির মজুমদার জমিদারকে টেক্কা দেবার জন্য সেবার পুজোয় যাত্রাগানের বদলে থিয়েটার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সনাতন মল্লিকের ছেলে মুকুল এর নাচের তালে তালে সিন উঠবে। মুকুলকে মেয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে দেবার পর কে বলবে সে সনাতনের ছেলে মুকুল, ও যেন সনাতনের মেয়ে মুকুলিকা।                                                            সীতা সাজলো বনমালির মেজো ছেলে শোভন, সাজঘরে উঁকি দিয়ে পাড়ার অনেকেই বলাবলি করলো,বনমালির ভীমরতি ধরেছে। যৌবন উছলে পড়া মেয়ে শোভনাকে শেষ পর্যন্ত থিয়েটারে নামালো। ঘোর কলিকাল আর কারে কয়! আসলে শোভনা শোভনের যমজ বোন।

মজুমদার জমিদারের বাড়িতে যাত্রা দেখতে তেমন লোক  গেল না। সেন জমিদার বাড়িতে থিয়েটার দেখতে সন্ধ্যা হতে না হতেই পটল ভেঙলো লোকজন। দর্শকদের প্রথম সারিতে বসেছেন গ্রামের মাইনর স্কুলের হেড পন্ডিত গজেনবাবু,ডাক্তার ডমুরু প্রামানিক, পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট বঙ্কুবাবু ও আরো অনেকে। গ্রীনরুমে সাজগোজ কমপ্লিট। অকৃতদার কেশব খুড়ো সেজেছে মন্দাদরী। করো বলার সাধ্য নেই তাকে দেখে, তিনি আমাদের কেশব খুড়ো। নাটক শুরুর প্রস্তুতি প্রায় শেষ। স্টেজে একটা চৌকি পাতা হলো।মুকুল সুন্দরী বালিকা সেজে চৌকিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো নৃত্য পরিচালক ধীমানঋদ্ধ বটবেলের কথা মতো।তিনি ওকে দেখে পান চিবোতে চিবোতে মুচকি হেসে নিজে নিজে বললেন কে বলবে এ আমাদের বনমালি ছেলে মুকুল, এ যেন ওর যমজ মেয়ে মুকুলিকা। বটবেলবাবু মুকুলকে সব বুঝিয়ে সুজিয়ে দিলেন,সিন ওঠা মাত্র মুকুল সামনের দিকে মাথা উচিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক পাক ঘুরে নাচ শুরু করবে। সিন তোলার দায়িত্বে আছে গোপাল ঢালী, আর আলোক সঞ্চালনে অলোক বাকচী। সিন ওঠানোর জন্য পরিচালক সিগনাল দিতেই গোপাল ঢালী সিনের দঁড়িতে টান দিলো, মুকুল  একবার মাথা তুলেই আবার চৌকিতে মাথা রাখলে পরিচালক গলা নামিয়ে বার বার বললেন,'বিগিন বিগিন মু-----' কিন্তু মুকুলের নড়ন চড়ন নেই। এদিকে দর্শকদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। পরিচালক ভাবলেন,সবতো মাঠে মারা গেলো। তিনি গোপাল ঢালীকে সিন ফেলে দিতে বললেন। ড্রপ সিন ফেলা মাত্র দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে হৈ হৈ করে উঠলো। তারপর পরিচালক সব কিছু ম্যানেজ করে শেষমেষে নাটক মোটামুটি সুন্দর ভাবেই শেষ করলেন।
মুকুল তখনো মেয়ে সেজে গ্রীনরুমে বসে আছে। নৃত্য পরিচালক বটবেল বাবু তাকে দেখে রেগে আগুন। ' তুই এখনো এখান বসে আছিস্ কোন লজ্জায়!' বটবেল বাবু'র রাগ দেখে মুকুল লজ্জিত মুখে মিনমিন করে কী যেন বলতে গেলে বটবেল বাবু বললেন,' তুই আমাকে এমন ভাবে লজ্জায় ফেলবি তা জানলে তোকে বালিকা সাজাতাম না। আর তুই যদি আমার নাতি না হতি তোকে আমি আড়ঙ ধোলাই দিতাম এতক্ষণে। আমি এখনো লজ্জায় মরে যাচ্ছি।'
 'বটবেল দাদু, লজ্জাই তো আমার কাল হয়েছে। মাথা উঁচু করে সামনে তাকাতেই দেখি- বড় তাওইমশায় মাথায় পাগড়ি বেঁধে সামনের সিটে বসে আছেন। তাই না দেখে আমার পা কাঁপতে শুরু করলো। তাকে দেখে লজ্জায় আমি উঠে দাঁড়াতে পাড়লাম না। লজ্জায়ই আমার কাল হলো!'                               
নিজের গিন্নিকে গ্রীনরুমে আসতে দেখে অপূর্ব সুন্দরী বেশে  মুকুলের বালিকা রূপটি দেখে বটবেল মনে দুষ্ট বুদ্ধ খেলে গেল । গিন্নি তাদের কাছে পৌছালে বটবেলবাবু তার সামনে দাঁড়ানো ষোড়শী বেশী মুকুলকে জাপটে ধরে তার গালে একটা চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। এ দৃশ্য দেখে তার গিন্নি বলে উঠলেন, এ কী লজ্জা! ঘরে আমার মতো সুন্দরী বউ থাকতে এ কী কান্ড মিনসের!ছি,ছি;এ কী  লজ্জা!