গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮

আফরোজা অদিতি

গৃহপ্রবেশের দিন


   বাড়িটি সুন্দর হয়েছে! ফ্ল্যাটটি অনেক যত্নে গুছিয়ে করেছে বীথি; গুছিয়ে করার চেয়ে বড় কথা নিজের মাথা গুঁজবার একটি নির্দ্দিষ্ট ঠাঁই; বাবুই পাখির বাসাবাড়ি! এতোদিন ভাড়া বাসায় থেকেছে, থাকতে থাকতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েও কিছু বলতে পারেনি কিছু, ইচ্ছে হলেও মনের মতো গুছিয়ে রাখতে পারেনি। স্থান সংকুলান হয়নি তাই তৈরি করতে পারেনি নিজের পছন্দের আসবাব। ভাড়া বাড়িতে নিজের পছন্দমতো আসবাব তৈরি করা যায় না। স্থানাভাব ছাড়াও আছে বাসা বদলের ঝক্কি! এই সব ঝয়-ঝক্কি যাতে পোহাতে না হয় সেজন্য নিজের শখকে বুকের ভেতর কষ্ট-চাপা দিয়ে রেখেছিল বীথি। স্বামী, মহিদুল একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে; একজিকিউটিভ। ভালো বেতন। এছাড়া বীথিও একটা চাকরি করে; ওদের সংসার বড় নয়। ওরা দুজন আর ওদের একটি ছেলে। শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রামে থাকেন। মাসে একবার এসে ঘুরে যান। দুজনের বেতন মিলিয়ে সংসার চালাতে কোন অসুবিধা হয় না বীথির।  তাই মহিদুল যখন গৃহনির্মাণ ঋণ নিয়ে এই ফ্ল্যাটটি বুকিং দিলো তখন খুব খুশি হয়েছিল বীথি; ভেবেছিল ফ্ল্যাটের আসবাব ফিটিংস সবই নিজের পছন্দমতো কিনবে, সেকথা জানিয়েছিল স্বামীকে। স্বামীর পরামর্শে নিজের পছন্দে কিছু কিনেছে, কিছু তৈরি করেছে তারপর সাজিয়েছে। পছন্দের জিনিসে তৃপ্তি থাকে, পরিপূর্ণ থাকে মন। ওরও তাই!

    যেদিন নতুন বাড়িতে এলো সেদিন বীথির চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়লো বসন্তের আভা; দুপায়ে ভর করলো শালিক পাখির চঞ্চলতা। হৃদয় জুড়ে শান্ত নদীর উদাম্মতা! নিজের একটি ফ্ল্যাট! একান্তই নিজস্ব। পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছা করছে ওর! উচ্ছল উদ্বেল বুকের ভিতর প্রশান্তি! বাড়িওয়ালার চোখ রাঙানি থাকবে না, থাকবে না বাসা বদলের নোটিশ। যখন তখন টোপলা-টুুপলি বাঁধা, কার্টুনের পর কার্টুন সাজিয়ে ঠেলা গাড়ির পেছন পেছন এসে খোলাখুলি করে আবার সজানো-গোছানো লাগবে না! উঃ বাসা পাল্টাতে পাল্টাতে হাঁফিয়ে গিয়েছিল বীথি! এখন একটু নিস্তার পাবে। প্রতিমাসে সংসার খরচের সিংহভাগ তুলে দিতে হবে না বাড়িওয়ালা নামক ঐ মহাজনের হাতে; একদিন দেরীতে হলে শুনতে হবে না বাড়িওয়ালার কোন হম্বিতম্বি!  কী বিশাল ভার নেমে গেছে মাথা থেকে!
গৃহপ্রবেশের দিন ছুটি পায়নি মহিদুল। অফিসে জরুরি কাজ থাকায় ছুটি দেয়নি ম্যানেজার সাহেব। ওদের শনিবারেও অফিস করতে হবে তাই সাপ্তাহিক ছুটির একটি দিনেই সব মালপত্র আনতে হয়েছে। সবকিছু গাদাগাদি করে রাখা। পা ফেলার জায়গা নেই। এর মধ্যে শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছেন।  ওদের আসার কথা কয়েকদিন পর; বীথি ভেবেছিল ঘর-বাড়ি একটু গুছিয়ে নিয়েই শ্বশুর-শাশুড়িকে আসতে বলবে! কিন' আগেই চলে এসেছেন তাঁরা; তাদের কোথায় বসাবে, কোথায় বিশ্রামের জায়গা দিবে, খেতে দিবেই বা কী এসব নিয়ে বড় বিব্রত হয়ে আছে বীথি। একঘর  একঘর করে যতোটা সম্ভব এবং জরুরি জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখছে বীথি আর ব্যস্ত মহিদুল ঘর-বার করছে ঠেলাওয়ালাদের সঙ্গে। বীথি শ্বশুরের বিশ্রামের জায়গা ঠিক করে নিজের বেড-রূমটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। হঠাৎ মহিদুলের চিৎকারে চমকে উঠে বাইরে আসে।কী হয়েছেজিজ্ঞেস করার আগেই দেখতে পায় ওর হ্যান্ডব্যাগ যেটি শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভুলে মেঝেতে নামিয়ে রেখেছিল সেটি নিয়ে বাথরূমে রেখে এলো মহিদুল। কেন? কেন বাথরূমে রেখে এলো! মহিদুল তো ব্যাগটি ঘরের বিছানায় রাখতে পারতো! ঠিক আছে ব্যাগটা ঘরে না রেখে ঐ খানে রাখাটা ওর ভুল হয়েছে! কিন' ও তো ইচ্ছে করে ওখানে রাখেনি, শাশুড়িকে সাহায্য করার জন্যই ব্যাগ নামিয়ে রেখেছিল ওখানে। এই কথা ভেবেই বিরক্ত হলো বীথি; সেই সঙ্গে রাগও। বিরক্ত আর রাগ হলে বীথির কান্না পায়। ঘরে এসে কাঁদলো কিছুক্ষণ! কেঁদে কেঁদে মন হালকা হলে চোখ মুছে বাইরে এসে আবার গোছানোর কাজে হাত লাগায়। এই গোছগাছের মধ্যেই পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা এলেন দেখতে; ‘আপনারা আজই এলেন বুঝি।
হ্যাঁ।বীথি ছোট্ট দিয়ে বলে, ‘বসুন আপা।
না-না। আপনাদের কাজের সময় বিরক্ত করছি।
বিরক্ত কিসের আপা, বসুন। কাজ তো থাকবে।পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা বসলেন না। এঘর-ওঘর ঘুরে ফিরে গেলেন।

   মহিলা চলে গেলে রান্নাঘরে এলো বীথি। তৈজসপত্র গোছাতে গোছতে দেখতে পেলো যা ভেবেছিল তা হয়নি; আসলে সবকিছু পরিকল্পনামতো হয় না। আর সেই কথাটি বলতেই স্বামীকে ডাকলো বীথি। স্বামী এলে বলল, ‘দেখ, এখানে চালের ড্রামটা ঢুকছে না।
ড্রাম ঢুকছে না তো শাবল এনে ভেঙে ফেল।মহিদুলের এই রকম বাঁকা জবাব শুনে বীথির সহ্য হলো না। বুক ভেঙে কান্না এলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এতো খারাপ ব্যবহার করো কেন? এই রকম ব্যবহার কোন স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে করে না। তুমি কী একাই কাজ করছো, আর কেউ করছে না।মহিদুল কথা বলে বেরিয়ে গেছে; বীথির কান্না তো আর থামে না। মহিদুল এমনই। একটু বাড়তি কাজ করতে গেলেই মেজাজ গরম হয়ে যায়! কিছুই যেন পছন্দমাফিক হয় না তার কাছে। সব সময়ই তার ধারণা, কাউকে দিয়ে কিছুই হয় না। এবারও তাই হয়েছে; ফ্ল্যাটের কাজকর্ম দেখেছে বীথি তাই সব দোষ এখন ওর। মানুষ এমনই। সবকিছুই নিজের মতো করতে চায়! মহিদুলও এর ব্যতিক্রম নয়! মহিদুল সম্পর্কে এসব জেনেও কান্না থামাতে পারে না বীথি; কেঁদেই চলে।

   রান্নাঘরে জল খেতে এসে দেখে তখনও কাঁদছে বীথি। বীথির কান্না সহ্য করতে পারে না মহিদুল; কান্নায় বিচলিত হয়ে ওর গা ঘেঁষে বসে মহিদুল। পিঠের পরে হাত রেখে আলতো জড়িয়ে ধরে। বীথি কেঁদেই চলে; কিছুক্ষণ কান্নার পরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে, ‘এই বাড়িটি অপয়া, এ বাড়ি ভালো নয়! এখানে ঢুকেই চোখের পানি ফেলতে হলো। কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছিলাম।আবার কাঁদতে শুরু করে। ডোর-বেলের আওয়াজ শুনে মহিদুল উঠে যায়। বীথিও কান্না বন্ধ করে; করতে হয়! জীবনে সবসময় কান্না করা যায় না! কষ্ট চেপে কান্না বন্ধ করতে হয় এটিই হলো জীবনের নিয়ম। দোতলা থেকে ভদ্রলোক এসেছেন পরিচিত হতে। ভদ্রলোক কথা বললেন কিছুক্ষণ। এখানে মাত্র কয়েকদিন, কাজের জন্য কোন লোক পায়নি এখনও। ঐ এলাকার বুয়া এই এলাকায় কাজ করতে আসবে না। বাড়ি গোছানো পর্যন্ত থাকতে বলেছিল ওকে  কিন' থাকেনি। বুয়ার স্বামীর বারণ। এখন একাই সব করতে হচ্ছে। দোতলার ভদ্রলোককে এক গ্লাস শরবত আর মিষ্টি দিতে যেতে হয় বীথিকেই।  

   রাত বারোটা বেজে গেছে। সকাল থেকে কাজ করছে। খাওয়াও হয়নি! সব ঘরেই কিছু কিছু জিনিস ডাঁই করে রাখা; রাখতে হয়েছে। একদিনে সব গুছিয়ে ওঠা সম্ভব নয়! এখন মধ্যরাত; শ্বশুর,শাশুড়ি, ছেলে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। ওরা দুজন খেতে বসেছে।  সারাদিনের কাজের ধকলের পর এমনিতেই খাওয়ার ইচ্ছা থাকে না, তার পরে আবার রাত হয়েছে অনেক! এতো রাতে খাওয়ার অভ্যেস নেই ওদের; সামান্যই খেল ওরা। খাওয়ার সময় ম্লান মুখে বলে মহিদুল, ‘ তুমি আমার ওপর রাগ করো না। আমি তো এইরকমই। বেশি কাজের ঝামেলা হলেই অকারণ রাগ হয় আমার। আর রাগ হলে কী যে করি সে খেয়ালও থাকে না। সরি।মহিদুলের কথার কোন উত্তর করে না বীথি; করতে ইচ্ছে করে না। একমনে খাবার-দাবার গুছিয়ে রাখতে থাকে। বীথি কাজ করলেও যে কাঁদছে তা বুঝতে পারে মহিদুল। এগিয়ে আসে কাছে; বলে, ‘অমন করে কেঁদো না সোনা, আমার ভালো লাগে না।
তবুও কথা বলে না বীথি। ওকে দুই হাতে জড়িয়ে বলে, ‘তুুুমি এমন করে কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়!’
থাক ন্যাকামো না করে, শুতে যাও।
কী বলছো ন্যাকামো করছি! না না তা করছি না। তুমি আমার সব! এই সবই তো তোমার জন্য! আমার আর কে আছে বলো! তুমি ছাড়া কেউ নেই আমার! তাই রাগ-গোস্সা যাই বলো সব দেখাই তোমাকে। সরি, আমার কলাবতী বউ!’ বীথি তবুও মুখ ঘুরিয়ে থাকে। মহিদুল পাগলের মতো স্ত্রীর হাতে পায়ে মুখে চুমু খেতে থাকে। এবারে বীথি অস্বস্তিতে পড়ে! বলে, ‘থাম, করো কী! আমি তো রাগ করিনি, কষ্ট পেয়েছি! আজকের যে কষ্ট দিয়েছ তুমি, এই কষ্ট আমার কখনও যাবে না।বীথি আবার কাঁদতে শুরু করে। মহিদুল স্ত্রীর কান্না সহ্য করতে পারে না। বুকের ওমে জড়িয়ে রাখে। বলে, ‘আার কাঁদিস না বউ; আর কখনও এরকম করবো না। কত্তবার ভাবি এই অভ্যাস বদলে ফেলবো কিন' হয় না, পারি না, পারি না রে বউ! আমারে বিশ্বাস কর। না হলে জান.. .স্বামীর কথায় এবারে জোরে ফেুঁপিয়ে ওঠে; ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়েই বলে, ‘ এমন কথা বলো না। তোমার জন্যই তো সব কিছু করি! তুমি আর ছেলে ছাড়া আমাকে দেখার আর কে আছে বলো তো! তাছাড়া তুমি জানো এই রকম ছোট ছোট কথাতেই ভেঙে যায় আমার মন, অথচ অনেক বড় আঘাতেও কিছু হয় না আমার।এই কথার পরে নিরব হয়ে যায় দুজনে। মহিদুল বুকের ওমে গভীরভাবে জড়িয়ে রাখে আর বীথি স্বামীর এই মমতামাখা ভালোবাসার স্পর্শ নিয়ে বসে থাকে। ওকে এভাবে জড়িয়ে রেখে কিছুক্ষণ পরে বলে মহিদুল, ‘আর ভুল হবে না, এবারের মতো .. ..’ বলেই বীথির মুখ দুহাতে তুলে ধরে চুমু দিয়ে মুছে নেয় চোখের জল।