গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

আফরোজা অদিতি

পুরানো বন্ধুর সঙ্গে একদিন

অনেকদিন পর পুরানো বন্ধুর সঙ্গে  দেখা জমিরউদ্দিনের   রাস্তায় নয়, গিয়েছিল বন্ধুর বাড়ি এক শহরে থাকে না ওরা থাকে জেলা শহরে আর বন্ধু থাকে রাজধানীতে ঢাকা এসেছে ছেলের বাড়িতে জমিরউদ্দিন মোবাইল করেছে বন্ধুকে বন্ধু বলল, চলে আয় সঙ্গে সঙ্গে  চলে এসেছে জমিরউদ্দিন স্ত্রী, ছেলে, ছেলেবউ, নাতনি সঙ্গে চলে এসেছে বন্ধুর বাড়ি
ছোটবেলার বন্ধু পড়তো এক ক্লাস নিচে পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার কারণেই দুজনের বন্ধুত্ব হয়েছিল গভীর, বলা যায় গভীর প্রেম ওরা হোস্টেলে থাকতো  একই রূমে  কতোদিন মারামারি করেছে কথা বন্ধ করেছে কিন্তু করে বেশিদিন থাকতে পারেনি কথা হয়েছে ভাবও হয়েছে ছুটিতে বাড়ি আসতো একসঙ্গে ছুটিটা কেটে যেতো আনন্দে দুই বাড়িতেই চলতো উৎসব পিঠা বানানো, পোলাও খাওয়া, বড় বড় মাছ খাওয়া   জমিরউদ্দিনের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল অনেক জমি ওর বাবার সারা বছর জমি থেকে পাওয়া ধান, কাউন, মসুর, মুগ সব আসতো আম-কাঁঠালের দিনে আসতো আম-কাঁঠাল ওদের ছিল হাটের ইজারা সেখান থেকে প্রতি রবিবার, বুধবার টাকার সঙ্গে আসতো সবজি শীতের দিনে খেজুরের গুড় শীতের দিনে খেজুর রস খেতে কী যে মজা ছিল ওদের খামার-বাড়ি ছিল শহরের কাছেই    সেখানে ছিল বিশাল পুকুর মাছ থাকতো সারা বছর শুধু ছিল গোস্তের অভাব এক কোরবানি ছাড়া ওরা গোস্ত খুব একটা খেতো না মাসে একবার গোস্ত হতো ওর বাড়ির জিনিস পিযুষের বাড়ি দিয়ে আসতো হোস্টেলে নিয়ে গেলে দুজনে ভাগ করে খেতো ওর মা, দুজনের জন্যই খাবার দিতো এমনকি জামা কাপড়ও দিতো
জমিরউদ্দিন বড় চেয়ারটাতে দুলছিল আর ভাবছিল পিযুষের বাবার অবস্থা  ভালো ছিল না পিযুষও খুব একটা ঝকমকে ছিল না কিন্তু আজ  পিযুষবেশ সুখে আছে ওর আর পিযুষের প্রায় দশ মাসের ব্যবধানে বিয়ে হয় পিযুষের বউ, মনিষাকে চিনতো জমিরউদ্দিন ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিল নিজেও  কিন' বাধা হয়েছিল দুজনের ধর্ম জমিরউদ্দিনের কথা ভেবে রাজী হয়েছিল মাকিন্তু ওর বাবার জমিদারী মেজাজ কিছুতেই রাজী হয়নি জমিরউদ্দিন, বাবার  কথা মেনে নিয়ে ভুলে গিয়েছিল মনিষাকে ওর ভালোবাসার কথা জানতো না মনিষা মনিষা ভালোবাসতো পিযুষকে কিন' জমিরউদ্দিনের মনের কথা  জানতো ওর স্ত্রী, বিথী বিথী বিয়ে করতে চায়নি ওকে দুই পরিবার থেকে চাপ সুষ্টি করাতে বিয়ে হয় বিয়ের পর থেকে মাথায় গোলমাল দেখা দেয় বিথীর এখনও আছে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় বিথী এখন একটু ভালো আগের মতো মনিষাকে নিয়ে গন্ডগোল করে না বয়স হয়ে গেছে তা প্রায় ষাটের কাছাকাছি আর কতো পাগলামী করবে সারাক্ষণ দুলতো আর বলতো, রিতি, মিতি, কনিকা, দিপ্তী, নিহার, বেলা আর মনিষা দত্ত ওর রূপ-যৌবন সব চুরি করেছে, ওকে কুৎসিতডাইনি বানিয়েছে
আরো বলতো মনিষা দত্ত কে তা-কি তোমরা জানো, জানো না ! মনিষা দত্তকে আমিই বই খাতা দিয়ে পড়িয়েছি, দিয়েছি স্কুলের বেতন প্রতিদিন টিফিন খাইয়েছি কাপড় দিয়েছি একদিন জানো কি হয়েছে বেড়াতে যাবো ; শীতের দিন, শৈত্যপ্রবাহ দাঁত-কাঁপানি ঠান্ডা, গরম কাপড় নেই আমার গরম কাপড় দিয়েছি ওকে তারপর বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি আর সেই মনিষা কী করলো ! মনিষা চুরি করলো কী জানো ! চুরি করলো আমার রূপ, আমার যৌবন ! চুরি করলো  আমার স্বামীর মন ! আমার স্বামী, জেগে-ঘুমে স্বপ্ন দেখে মনিষাকে ! তোমরা বিশ্বাস করতে পারো ! পারো না ! পারছো না, না পারবেও না কারণ এসব গোপন বিষয় !
রোজ রোজ এইসব কথা বলতো বিথী প্রতিদিন চিৎকারচলতো কথার ফুলঝুরি ! প্রথমে সব ভালো কথা বলা শেষ  হলে শুরু হতো খারাপ কথা ! তারপর ওকে গালাগালি ওর গালাগালি গায়ে মাখতো না কখনো ! সেজন্যও চলতো রাগারাগি সহ্য করতো পারতো না ! তবুও সহ্য করতো  কিন' সব সময় কী আর মুখ বুঁজে সহ্য করা যায় ! কতো আর সহ্য করা যায়মাঝে-মধ্যে জবাব দিতো আর যখন জবাব দিতো তখন ডাক্তার ডাকা ছাড়া উপায়ান্তর থাকতো না
ডাক্তার মাঝেসাঝে ভালো ব্যবহার দিয়ে করুণা দেখাতো ওকে ওর  রাগ হতো কিন্তু করার কিছু ছিল না ডাক্তারের কথা মতো চলতে হতো বিথীকে বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল ডাক্তারেরও কিন্তু বিথী বিয়ে করেছে ওকে সেই প্রতিশোধ নিতেই ডাক্তার বলতো আপনাকে যা বলে তাই করতে হবে ! -ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে ওর দুলুনি রোগ বউ সারাক্ষণ দুলছে আর দুলছে ওর সঙ্গে দুলতে হতো তাকেও না দুললেই বাড়ি মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে বাড়ির ছাদে পাখিরা সব যেতো উড়ে বউয়ের সঙ্গে রাতদিন ঝগড়া না করতে চেয়ে জীবনের পলায়নপর মনোবৃত্তি বেছে নিয়েছিল জমিরউদ্দিন
জমিরউদ্দিন পলায়নবাদী জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো এক মানুষ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি কিছুই করতে পারেনি বিথীর জন্য বিথীর জন্য চাকরি  ছাড়তে হয়েছে ব্যাংকে চাকরি করতো চাকরি করলে জি.এম হিসেবে রিটায়ার্ড করতো এখন কিন' তা হয়নি বিথী বলেছে চাকরি করতে হবে না তোমাদের তো এজমালি সম্পত্তি কিন্তু আমার তো তা নয়
বিথীর জমি আছে আছে বাড়ি শহরে চারতলা বাড়ি ওই বাড়িতেই থাকে ওর কখনও ইচ্ছা হয়নি থাকতে কিন' সংসারের শান্তির জন্য থাকে ওখানেই ওর জমি ভাই বোনদের কাছে বিক্রি করেছে এমনিতেই রেখেছিল; বাপ-দাদার ভিটেমাটি কিন' সেটাও রাখতে দেয়নি বিথী যতোদিন বিক্রি না করেছে ততোদিন চলেছে রাগ, জিনিসপত্র ভাঙাভাঙি ভিটেমাটি বিক্রি করার পর তবে ঠান্ডা বিথী কখনো চায়নি ওর নিজের বলে কিছু থাকুক না টাকা না সম্পত্তি
পিযুষকে দেখে ভালো লাগছে আবার মনের কোণে একটা দুঃখবোধ জেগে উঠেছে পিযুষ আজ অনেক ওপরে উঠেছে ছেলে মেয়েরা ভালো চাকরি করছে মেয়েজামাই, ছেলেবউ তারাও ভালো চাকরি করে দিন ফিরে গেছে তোর পিযুষকে বলেছে, তোর দিন ফিরে গেছে পিযুষ
পিযুষ হেসেছে বলেছে, হ্যাঁ   
আসলে সংসারের শান্তি বড় শান্তি সংসারে শান্তি পেলে মনেও শান্তি মেলে পিযুষ অনেক অনেক ভালো আছে মনিষা, বিথীর চেয়ে প্রায় দুই বছরের বড় হবে তো ছোট হবে না তবুও মনিষা কতো শক্ত সামর্থ এক মহিলা ষাটের কোঠা পার হয়ে গেছে দেখলে  মনেই হয় না মনিষাই রান্না করে খাওয়ালো রকিং-চেয়ারে দুলতে দুলতে ভাবছিল দুলুনি একটা অভ্যাস রকিং-চেয়ারে তাও দোলা যায় কিন' বিছানা কিংবা সোফাতে তো দোলা যায় না খারাপ দেখায় ! ওর দুলুনি দেখে পিযুষ তো বলেই ফেলল তুই এতো দুলছিস কেন?
এমনি !
বউদিকেও  দেখলাম বিছানায় দুলছে পিযুষের কথায় খুবই রাগ হয়েছিল রাগ সামলাতে পারেনি, বলেছিল, ওর জন্যই তো এই অবস্থা আরও কিছু বলতো ! মনিষা ঘরে আসায় থেমে গিয়েছিল মনিষা বুঝতে পেরেই ঘরে এসেছিল পিযুষকে ডেকে নিয়ে গেছে মনিষা ঘর থেকে পিযুষের সব কথা শুনেছে মনিষা ডেকে নিয়ে স্বামীর ওপর একটু রাগ করেই  বলেছে, তোমার যে বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে বুঝতে পারি না ! তুমি দাদাকে এইসব কথা বলছো ! এইসব কথা কেউ বলে 
কেন বলবো না  খারাপ দেখালে বলবো না !
না বলবে না এসব কথা বলা উচিত নয়
বন্ধু হলেও না ? আমার ছোট বেলার বন্ধু
না বন্ধু হলেও না এমনকি ছোটবেলার বন্ধু হলেও না এখনতো আর সেই ছোটবেলায় নেই তোমরা বয়স হলে ছোটবেলার সেই মন আর থাকে না তাছাড়া দাদা একাও নয়, বউদি আছে আছে তাদের ছেলেমেয়েরা ওরা শুনলে কী ভাববে বলোতো
মনিষার কথা শূনে হেসে বলেছে পিযুষ, তুমি যে কি বলো না ! ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে তো কি হয়েছে ! আর বয়স বাড়লেই ছেলেমেয়ে বড় হলেই মন কি সেই আগের মতো থাকে না কে বলেছে তোমাকে ! আমার তো বয়স হয়েছে, কিন' মন তো আমার সেই আগের মতোই আছে ! পিযুষ অনুযোগভরা কন্ঠে বলে তোমার তো কেবলই দোষ ধরা স্বভাব
এই তো আবার শুরু করলে !
 আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই না বলছি দেখ দাদা যদি সেই ছোটবেলায় থাকতো তবে কী আর তোমার কথায় রাগ করতো ! করতো না মনিষা রাগ করে না আদুরে কন্ঠেই বলে তারপর বলে, যাও মন খারাপ করো না, দাদার সঙ্গে কথা বলো
পিযুষ ঘরে যেতেই জমিরউদ্দিন বলে, আমরা যাইরে
একটু অপেক্ষা কর, ড্রাইভার আসুক, পৌঁছে দিবে ওরা আবার কথা বলতে থাকে এমন সময় ফোন আসে মোবাইলে কথা বলে যাওয়ার জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ে জমিরউদ্দিন ওকে কিছু বলছে না কিন্তু মোবাইলে কথা শুনে পিযুষের মনে হলো খুবই খারাপ খবর ড্রাইভারকে ফোন করে আরে তুমি কোথায় ! তাড়াতাড়ি আসো
জমিরউদ্দিনের কাছে বারবার জানতে চাইছে পিযুষ কি হয়েছে ?  জমিরউদ্দিন কিছু বলে না ! পিযুষ দেখতে পায় জমিরউদ্দিনের চোখ দুটো জলে ভরে আছে  বিথীকে ডেকে দে চলে যাই
ঠিক আছে, ডাকছি খুব কী খারাপ খবর ! তোকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে চল, আমিও যাবো তোদের সঙ্গে জমিরউদ্দিন বলল, নারে তোকে যেতে হবে না  ওরা চলে গেল
জমিরউদ্দিন কেন সব কথা বলল না ওকে তাই নিয়ে ভাবছিল পিযুষ পিযুষ মনে হলো, মনিষা ঠিকই বলেছে, বয়স হলে ছোটবেলার আগের সেই মনটা আর থাকে না মানুষের কিন্তু ওর তো সেই ছোটবেলার মনটা আছে জমিরের কেন নেই !
মনিষা এলো ট্রেতে দুইকাপ চা নিয়ে দুজন চা খেতে খেতে টেলিভিশনের খবর দেখছিল মিছিলের ছবি দেখাচ্ছে মিছিল আগে ওই ছেলেটা কে ? ? ভালো করে দেখতে থাকে পিযুষ একটা ছেলেকে প্রকাশ্যে  চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারছে ছেলেটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন' পারছে না ওরা পাঁচজন, একা পেরে ওঠার কথা তো নয় ! এরপরে অনেক চেষ্টার পরে রাস্তায় বের হয়ে দৌড় দিল সামনের দিকে ওরা আবার ধরে ফেলল ওকে লাঠি দিয়ে পিটালো ব্রেক নিউজে দেখাচ্ছে রায়ানকে পিটিয়ে মারছে দুর্বৃত্তরা মারা গেছে ছেলেটি
মনীষা বলল, জমির দাদার ছেলের নাম তো রায়ান ছেলেটা না কোথায় চাকরি করতো তাহলে কিপিযুষ ফোন করে জমিরউদ্দিনকে সব শুনে মনীষাকে বলে, চলো যাই
গাড়িটা ওদের রেখে ফিরে এসেছে ওরা রওয়ানা হলো এখন জমিরউদ্দিন আর বিথীর কাছাকাছি থাকতে হবে ওদের কাছাকাছি থাকাটা পিযুষ আর মনীষার জন্য খুবই প্রয়োজন না, ঋণশোধ নয়, বন্ধুত্বের প্রয়োজন