গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

মৌ দাশগুপ্তা

স্মৃতিটুকু থাক
বর্ষাকাল যাই যাই করছে। অলস রবিবারের শেষ বিকালের আকাশে হালকাভাবে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে। পূজোপূজো ভাবটা আকাশে বাতাসে বিজ্ঞাপনে ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রামক ব্যাধির মত। প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া শ্যামলবাবু পার্কের একমাত্র কৃষ্ণচূড়া গাছটার গা ঘেঁষে বসানো লোহার বেঞ্চে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছেন আসলে এই সময়টায় মনটা বড় আলসে হয়ে যায়। অলস মনে ভেসে আসে স্মৃতি বালুকণা। চোখ কটকট করে। জলে ভরে আসে। কিন্তু সে অস্বস্তি বড় আপন লাগে। নেশা ধরায়।
শ্যামলবাবু বয়স যখন ছিল ওনার ছেলে সবুজের মত, মানে ভরা যৌবনেই আর কি, তিনি ভালোবেসে ফেলেছিলেন, এক কালো মেয়েকে। কালো তা সে যত কালো হোক দেখেছি তার  কালো হরিণ চোখ। না, নাম তার কৃষ্ণকলি ছিল না , যদিও আদর করে মাঝেমধ্যে তিনি স্মৃতিকে কৃষ্ণকলি বলেই ডাকতেন। স্বপ্নের নায়িকা হয়ে উঠতে একজন মানুষের মধ্যে যতটা দরকার, স্মৃতির মধ্যে তার সব ছিল। তিনি ভালো করে বুঝে গিয়েছিলেন, জীবনে মেয়েটাকে না পেলে ওনার জীবন পুরোটাই ব্যার্থ হয়ে যাবে। দূর্দান্ত সব লাভ স্টোরীর মত, শ্যামলবাবুর প্রেমকাহিনীতেও কিন্তু হ্যাপি এণ্ডিং এলনা এক, ফরসা নাতির কালো বউয়ে ছেলের ঠাকুমার আপত্তি, দুই, সম্পন্ন ব্রাহ্মন পরিবারে তেলী পরিবার থেকে মেয়ে নিতে ছেলের বাবার আপত্তি। তিন, মা আর দুই মেয়ের সংসারের একমাত্র রোজগেরে হিসাবে বিয়ের পর স্কুলের চাকরীটা ছেড়ে দিতে স্বয়ং পাত্রীর ঘোরতর আপত্তি।সব মিলিয়ে দুটি প্রাণ আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে একে অপরের হাত ধরে এগিয়ে চলার অঙ্গীকারটা বজায় রাখতে পারে নি। তাও শেষ চেষ্টা করেছিলেন তিনি বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা সংসার পাতার। কিন্তু স্মৃতি আর রাজি হয়নি, তখন মনে হয়েছিল, হয়ত ওনাদের ভালোবাসাতেই কোন খুঁত থেকে গেছিলো, নয়ত ওনার এত আবেগের ঢেউ উপেক্ষা করে স্মৃতি এভাবে চলে যেতে পারতো না প্রথম প্রথম বিশ্বাসই করতে পারেননি , ভেবেছেন, ওনার বাড়ীর গুরুজনদের অহেতুক জিদে স্মৃতির মনে বুঝি রাগ জমেছে, জিদ্দি তো সে কম ছিলো নাতাই অপেক্ষা করেছেন যে সময়ের সাথে এই মনান্তরের কুয়াশা এমনিই কেটে যাবে কিন্তু ক্রমেই কুয়াশা গাঢ় হয়ে সবকিছু আচ্ছন্ন করে দিয়ে গেছে সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবার পরেও রাত ঘন হয়েছে, রাতের পরে এসেছে আরো একটা নিঃসঙ্গ ভোর স্মৃতির ছোঁয়াবিহীন, অস্তিত্ববিহীন  সূর্যের আলো আর ভালোবাসার কথা বলে নি।কেবল মন- ভাঙ্গনের গান শুনিয়ে গেছিল প্রকৃতি দুজন মানুষের গন্তব্য ঠিক করে দিয়েছিল দু দিকে। কত ঋতু বদল হয়েছে এই তিরিশটা বছরে তবু স্মৃতির স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই শ্যামলবাবু আঁকড়ে রাখতে পারেন নি। আজ উনি সংসারে প্রতিষ্ঠিত, পরিবারের মাথা,দশটা লোক ওনাকে চেনে। কিন্তু স্মৃতি আজ শুধুই স্মৃতি ওনার কাছে। যে স্মৃতি সতত কাঁদায়, সতত ভাবায়।
হঠাৎ খেয়াল করলেন, একই বেঞ্চির অন্যপ্রান্তে আনমনে উদাস হয়ে বসে কী যেন ভাবছে একটা কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ে। অনেকটা স্বভাববিরুদ্ধভাবেই শ্যামল বাবু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন মেয়েটির দিকে মেয়েটি জলভরা মৃগনয়নে একবার তাকিয়েই মুখ নিচু করে নেয় গুরুত্ব না দেয়ার ভঙ্গিতে। বোঝা যায়, তার মন খারাপ মেয়ে পারফেক্ট কৃষ্ণকলি, কালো রঙে রূপ যেন ফেটে পড়ছে। লম্বা বেণী, ছোট্ট কপাল, টিকালো নাক, সাজের বাহুল্য নেই। একটা টিপ অবধি পড়ে নি। রঙ চঙ মাখা তো দূর অস্ত। হালকা বেগুনীর ওপর ছোট ছোট সাদাবুটির তাঁতের একটা শাড়ীই পড়েছে। ওর বয়সী অন্য মেয়েদের মত সালোয়ার, স্কার্ট বা জিন্স নয়। হাতে একটা মোবাইল। আনমনে নাড়াচড়া করছে, যেন কাউকে কল করার কথা, কিন্তু করে উঠতে পারছে না। ঘনঘন মোবাইলের স্ক্রীন দেখছে আর উশখুশ করছে। কিন্তু উঠেও যাচ্ছে না।
কেউ চেনা বোধহয় পাশ  দিয়ে হেঁটে গেল।
 “হাই, তিন্নি”,
তিন্নি জবাবে দুগালে টোল ফেলে মিষ্টি হেসে বললো
কি রে, আজ একা যে বড়ো ?”
জবাবটা হাওয়ায় ভেসে গেল। মেয়েটার নাম তবে তিন্নি। ভীষণ মিষ্টি হাসিতো, গলাটাও সুন্দর। আদুরে, সুরেলা। শ্যামল বাবুর অভিজ্ঞ দৃষ্টিও আকর্ষিত হলো মেয়েটির এইসব বিশেষত্বে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এমন একটা বউ সবুজের  থাকলে মন্দ হতো না। ছেলেটার   তো বিয়ের বয়স হয়ে এসেছে।  বাড়িটাতেও ওনারা আর সবুজ ছাড়া কেউ নেই,শ্যামলবাবুর স্ত্রীর সাথে প্রথম থেকেই একটা মানসিক দুরত্ব আছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি সারাদিনই ঠাকুর ঘর, পূজাপাঠ, গঙ্গাস্নান, গুরুভজনায় ব্যস্ত থাকেন। মুখ দেখাদেখি হলেও কথা বিশেষ হয় না। কাজের মেয়েটা সাতবাড়ী কাজ করে খায়। তার আর মুখ চালানোর ফুরসত কোথায়! বন্ধুবান্ধবরাও কেউ কাছাকাছি থাকেন না। স্বভাবে বেশী কথা বলিয়ে শ্যামলবাবুর তাই মনে হয়, ঘরে সবুজ না ঘরটা বড় খালি খালি লাগে একটা টুকটুকে  ছেলের বউয়ের স্বপ্ন তো ছিলই কিন্তু এখন এই কৃষ্ণাঙ্গীকে দেখে সেই ইচ্ছেটাই আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। মেয়ে যদি সবুজের বউ হয় তো কি সুন্দরই না মানাবে দুজনকে। মেয়েটার দিকে চোখ রেখে এইসব সাতপাঁচ ভাবছিলেন শ্যামলবাবু।একটা অচেনা লোক উপেক্ষা করা সত্বেও এভাবে পাশে বসে হা করে তাকিয়ে আছে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটি। শ্যামলবাবু তখন ভবিষ্যতের কল্পনায় বিভোর। মুখ আলতো হাসি। বাপের বয়সী লোকটার এহেন অহেতুক আদিখ্যেতায় গা জ্বলে যায় তিন্নির। রাগতভাবে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে যেতেই আঁচলে টান পড়ে। আঁচলের একটা কোণ শ্যামলবাবুর হাতে ধরা ছাতার কোণে আটকানো যে !

জানোয়ার কোথাকার। বয়সের তো গাছপাথর নেই। একা মেয়ে দেখলেই জিভ লকলকিয়ে ওঠে না ? ইতর,অমানুষ! বাড়ীতে মেয়ে বউ নেই বুঝি? বলেই হন-হন করে পার্কের সবুজ ঘাসের বুকচেরা সর্পিল সরু পথ ধরে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেলো মেয়েটি। শ্যামল বাবু এমনই হতভম্ব হয়ে গেলেন যে প্রতিবাদের কথাও খুঁজে পেলেন না।বলে কি মেয়েটা! অনেকদিন পর খুব নিজেকে ছোট মনের মানুষ নে হচ্ছিল!! ছি ছি কি কান্ডটাই না হলো? কি ভাবলো মেয়েটা! বেশ কিছুক্ষণ সেই বেঞ্চেই বসে থাকবার পর মন্থর গতিতে বাড়ির পথ ধরলেন তিনি।

তিন্নির সাথে শ্যামলবাবুর দ্বিতীয়ার দেখা মাসদুয়েক পর, ভিড়ঠাসা  78C বাসে। শ্যামলবাবুর সেদিন অফিসের গো ডাউন ইন্সপেক্সন ছিল। বাসটা একদম চিড়িয়ামোড়ের কাছে ওনাদের গোডাউনটা ঘেঁসে যায়। অফিস টাইমের ভীড়ে বয়স্কমানুষ কোথায় দাঁড়াবেন ভেবে ওঠার আগেই কন্ডাক্টরের চেঁচানি আর আশেপাশের লোকের ঠেলাঠেলিতে বামদিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। সামনেই লেডিস সীট। তিন্নি বসা। আজও শাড়ী। কচি কলাপাতা রঙের ওপর সাদা গোলাপী কলকা। বইয়ের ব্যাগ কোলে। বোধহয় কলেজ যাচ্ছে। পড়ন্ত চশমা আর কাঁধের ঝোলাব্যাগ সামলে মাথার ওপর হ্যান্ডলটা ধরে একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন শ্যামলবাবু তিন্নির সাথে চোখাচোখি হল তিন্নির সুন্দর মুখটা কঠিন হয়ে উঠল সেদিনের গালিগালাজের ঝড়টা মনে পড়ে গেল শ্যামলবাবুর, বুঝলেন তিন্নি সেদিনের বিচ্ছিরি ব্যাপারটা আদৌ ভোলেনি। সাত তাড়াতাড়ি সরতে যাবেন, তখনই বিপত্তি। বাসটা কোন কারণে সজোরে ব্রেক কষলো আর শ্যামলবাবুও ্টাল সামলাতে না পেরে পড়বি তো পড় সোজা তিন্নির গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা সশব্দ চড় এসে পড়লো শ্যামল বাবুর গালে।
-অসভ্য ইতর, বুড়ো ভাম কোথাকার ! লজ্জা করে না আপনার এই বুড়ো বয়সে মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে এইভাবে বিরক্ত করতে !

বাসে চেনা দু একজন লোক ছিল আর হঠাৎ ব্রেক কষায় আরো দু তিনজন হুমড়ি খেয়ে পড়ায় গনপিটুনির হাত থেকে বাঁচলেও অপমানে মাটিতে মিশে যেথে ইচছা হচ্ছিল। জীবনে কোনদিন নিজেকে এত অপমানিত, এত অসহায় বোধ করেননি। লোকের উড়ো টিপ্পনী আর কটু কথার মাঝেই বাস থেকে মাঝ রাস্তাতেই নেমে পড়েছিলেন। অনেকদিন পর ওনার দুচোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল নেমে এসেছিল। গালের জ্বালার থেকেও অপমানের জ্বালাটা বেশী জ্বলুনি ধরাচ্ছিল মনে হয়। পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও হু হু করা বাতাসের স্পর্শ ছুঁয়ে মনের ভিতর অহেতুক অপমানের জ্বালাটা পুষে রেখে একা একা খররোদে হেঁটে চলছিলেন বয়স্ক মানুষটা।
সময় থেমে থাকেনা। সময়ের সাথে আবছা হয় বিষাক্ত অনুভবের স্মৃতি। বিস্মৃতির ধোঁয়া ঢাকা আবছা পথ ধরে একসময় বুঝি বা হারিয়েই যায়। শ্যামলবাবুও হয়ত ভুলে গেছেন তিনবছর আগের সেদিনের ঘটনা। সবুজ নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছে। নিজের ব্যর্থ প্রেমের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাননি উনি। একদম আপত্তি করেন নি। বরঞ্চ স্ত্রীকেও বুঝিয়েছেন নিজের মত করে। তিলোত্তমা মানে ভাবী বউকে প্রথম যেদিন নিয়ে এসেছিল সবুজ বাবা মায়ের সাথে আলাপ করয়ে দেবে বলে, সেদিন শ্যামলবাবুর সাথে দেখা হয়নি। উনি অফিসের কাজে আটকা পড়েছিলেন। তাই বিয়ের দিন সকালে তিলোত্তমাদের বাড়ী গিয়ে ধান-দূর্বা, সোনার সিঁথিহার দিয়ে আশীর্বাদ করার সময়ই নতনেত্রা তিলোত্তমার মুখের দিকে প্রথম নজর গেল শ্যামল বাবুর থমকে দাঁড়ালেন! বিয়ের হৈ হট্টগোলের মধ্যেও তাঁর চোখ এড়ালো না কৃষ্ণকলি মেয়েটার ছোট্ট কপাল, টিকালো নাক, জলভরা অপরাধী চোখদুটোর দিকে।
নতুন বউএর ঠোঁটটেপা গালে টোল ফেলা মিষ্টি হাসি তখন নিমেষে উধাও। লজ্জায় চোখ বুজে ফেলেছিলো তিন্নি। ওকে আর অপ্রস্তুত না করে দুপক্ষের আত্মীয় স্বজনের ভীড় কাটিয়ে দরজার দিকে সরে আসতেই দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে টলে উঠলেন। মাথা ঘুরে গেল। চোখের সামনে অন্ধকার। শ্বাস নেবার মত অক্সিজেনটুকুতেও যেন টান পড়েছে। কেউ একজন শক্তহাতে জড়িয়ে তাড়াতাড়ি চেয়ারে বসিয়ে না দিলে হয়ত হুমড়ি খেয়ে পড়েই যেতেন। চোখবন্ধ শ্যামলবাবুর চোখে তখনও ভাসছে রজনীগন্ধার মালা পড়ানো চন্দন সাজানো স্মৃতির হাসিমুখের ফটোটা। সবুজ বলেছিলো বটে জন্মের পরপরই নাকি তিলোত্তমা ওর মা কে হারিয়েছে