গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সুবল দত্ত


                      খোলো... খোলো...খোলো...                                

            দেব বিছানায় চিত্‍ হয়ে শুয়ে পড়ল। মন বড়ই চঞ্চল,অসহায়। রাত দুটো বাজে। কানে প্লাগ লাগিয়ে  সিষ্টেম থেকে,নেট থেকে, স্টাডি মেটিরিয়াল পড়ছিল বটে,মাথায় একটুও ঢুকছিল না। ওই একঘেয়ে শব্দ কানের ভিতরে ঢুকে মাথায় হানা দিচ্ছিল। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে ওর দাদা সফটওয়ারে ডক্টরেট করছে,একটা ছোট্ট মাইন্ড সেন্সর এখনো বাজারে ছাড়া হয়নি, পেটেন্টও হয়নি,পাঠিয়ে দিয়েছে,দেবের জন্মদিনে। জন্মদিনের উপহার । দেব মেশিনটি কপালে রেখে চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবল,লাইট অফ হয়ে যাক। তক্ষুনি ঘরের আলো নিবে গেল। অবশ্যি ঘরের বাতি এসি সব রিমোটে চলে। ঘর অন্ধকার হল বটে,ঘরের ভিতরে শব্দের গুঞ্জন আরও বেড়ে গেল যেন।ঘরের ভিতর হাই পিচড সাউন্ড অনুরণন তুলেছে... হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরে কৃষ্ণা হরে হরে হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরে কৃষ্ণা হরে হরে...। শব্দের অনুনাদ কানের ভিতর দিয়ে মাথার শিরা উপশিরা ফাটিয়ে তুলছে যেন। ওরা পাশের মন্দির থেকে চৌমাথার চার দিশায় প্রায় দশখানা চোঙ্গা মাইক লাগিয়েছে। অনুমোদিত ডেসিবলের অনেকগুণ বেশি ,যা দণ্ডনীয় অপরাধ,সেই উঁচু আওয়াজে ঈশ্বরের নামগান ঘোষিত হচ্ছে বেসুর কোরাসে।হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরেকৃষ্ণা হরে হরে হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরে কৃষ্ণা হরে হরে...। এখন গভীর রাত আড়াইটে। নিচে চার পাঁচটা কুকুরের কেউ কেউ আর্তনাদ। দেব তার সাথে গলা মিলিয়ে গুঙিয়ে উঠল। পাশের গাছটা থেকে, থেকে থেকে পাখিদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ।
আগামীকাল দেবের পারটিকল ফিজিক্স এর দুটো পেপার। কালই রেজাল্ট আর ভিডিও কনফারেন্সে নির্ধারণ,ট্রম্বে যাবে কি না। এই পরীক্ষায় পাস করতে পারলে দেব ওর জীবনের সফলতম সিঁড়ির অন্তিম ধাপে। দেব তাতে স্থির নিশ্চিত,শুধু দু ঘন্টার ঘুম চাই। কিন্তু ঘুম আসবে কী,কানের পর্দায় জোর ধাক্কা,হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরেকৃষ্ণা হরে হরে হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরে কৃষ্ণা হরে হরে...। ও বালিশ মুড়ে কান ঢাকলো,উপুড় হল কিন্তু নাহ । যে বিষয় নিয়ে ওর ধ্যান জ্ঞান এত পড়াশুনো,গবেষণা করতে তীব্র আকাঙ্ক্ষা,সে তো ঈশ্বরের খোঁজের পথ ! কিন্তু এ কেমন ঈশ্বরের আরাধনা? গভীর নিশুতি রাতে পরিশ্রান্ত প্রকৃতিকে শব্দদূষণ দিয়ে আঘাত? ধমাধম ধমাধম হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরেকৃষ্ণা হরে হরে হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরে কৃষ্ণা হরে...
বছর আটেক বয়েস থেকেই দেব তার বাবার সাথে রোজ সন্ধেবেলায়  ধ্যানে বসত। তার ফলে অতীত আর ভবিষ্যত্‍ নিয়ে সে খুব একটা উদ্বিগ্ন হয় না। কণা বিজ্ঞান বা পার্টিকল ফিজিক্স পড়তে পড়তে দেব সার কথা বুঝেছে,ঘটমান বর্তমান ও তার পরিণতি, সম্ভাবনার সাথে ওতপ্রোত । এই সম্ভাবনা কিন্তু সময় গতি ভর এবং আরও যা যা সম্ভাব্য ডাইমেন্শন আছে সে সবের উপর নির্ভরশীল নয়। তাই ভবিষ্যতে কী হবে কেউ বলতে পারে না। সম্ভাবনাই ঈশ্বর। এই ধারনা দেবের মনের ভিতর শিকড় গেড়ে আছে।
কিন্তু... আহ ! এই নষ্টকারী শব্দের আবর্ত ! এও কী মেনে নিতে হবে! মন বিদ্রোহ করে উঠছে থেকে থেকে । কাল সকালেই অন লাইনে ভিডিও কনফারেন্সে টানা চার ঘণ্টা প্রশ্ন উত্তর চলবে। সে সময়ে যদি সে ঝিমিয়ে পড়ে? যদি মাথার ঠিক না থাকে? মাথার ভিতরে অহরহ বাজতে থাকে  হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরে কৃষ্ণা হরে হরে হরে রাম্মা হরে রাম্মা হরে কৃষ্ণা হরে হরে...বেসুরো অনুরণন? দেব টের পেল,আসছে ... ক্রোধ ভয় আক্রোশ হতাশা ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে তাকে। দেব উঠে পড়ল । নাঃ ধ্যানে বসতে হবে। ধ্যানের গভীরে না ঢুকলে এর থেকে নিষ্কৃতি নেই ।
দেব পদ্মাসনে বসল । মহামুদ্রায় দুহাত হাঁঠুতে রেখে চোখ বন্ধ করে মনকে দুই ভুরুর মাঝখানে নিয়ে এল। শরীর শিথিল... একাগ্রতা গভীরে... আরও গভীরে... কয়েক মিনিটেই দেব টের পেল সেই শৈশব থেকে পাওয়া এক নীলাভ আলো ছটফট করতে করতে দুই ভুরুর মাঝখানে বসল... স্থির। কিন্তু আজকেরটা যেন রোজকারের মতো না। এ যেন এক নীল দরোজা। মনের ভিতরে এক তীব্র ইচ্ছে জাগলো। একে খুলতেই হবে। কী ভাবে খুলবো ? দেবের বুকের ভিতর থেকে আকুতি উথলে উঠল। দরজার পিছনে কে আছো? খোলো...খোলো... । দেবের অন্তরের গভীরতম প্রদেশ থেকে এক স্নিগ্ধ উত্তর উঠে এল আপ্রাণ মন দিয়ে চাও দরজা খুলুক... আমি খুলবো। তুমি আদেশ কর খো...লো... আমি খুলবো। তুমি নিঃস্বার্থ হয়ে আমায় ডাকো, আমি তোমার কাছে উন্মুক্ত হবো । তুমি চোখের জল দিয়ে আমাকে খোলো,আমি খুলে যাব.... । দেবের চোখ খুলে গেল। দেখল চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়ছে। চোখ মুছ্ল। রাত তিনটে। এলোমেলো বেসুরো হরিনাম আরও উঁচু আওয়াজে। একটানা। নাঃ আর ঘুম হবেনা। দেব ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল।প্রকৃতি নিঝুম কিন্তু বাইরে প্রলয়ঙ্কর আওয়াজ। একটু এগিয়ে দেখল ফুটপাথে ল্যাম্পপোষ্টের নিচে আলোআঁধারে এক ভিখারী বউ তার সামনে পড়ে থাকা এক শরীরের কাছে বসে অস্পষ্ট ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মাথা অব্দি ঢাকা,নিস্পন্দ দেহ। পরিস্থিতি বুঝে গেল দেব। অসুস্থ স্বামী এই অসহ্য শব্দ দূষণে আর টিকতে পারলনা। মাথার ভিতরে আবার বিদ্রোহ জেগে উঠল। দেব বাড়ী ফিরে বিছানায় বসল। অশান্ত মন। সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে চায়। হাতে ঠেকলো সেই মাইন্ড সেন্সর মেশিন । মেশিনটা হাতে নিয়ে এক মনে দেখতে লাগলো দেব। দেখতে দেখতে মেশিনের ভিতরে ডুবে গেল সে। আবার নীলাভ দ্যুতি এলো দুই ভুরুর মাঝখানে। দেব জিজ্ঞেস করল তুমি কী আমার কনট্রোলার, না, বিশ্বের মহাবিশ্বের ? কোনও উত্তর নেই । দেব বলল,যদি তুমি সম্ভাবনা ,এসেছ থট সেন্সর হয়ে,যদি তুমি সেইসব সাব অ্যাটমিক শক্তি কণা ,যা মহাবিশ্বে নষ্টকারী শক্তি রোধ করে নতুন নতুন নির্মাণের কাজ করে,কৃষ্ণ শক্তি (ডার্ক ম্যাটার) থেকে যদি তুমিই আলো আহরণকারী সেই শক্তি হও,তবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ হয়ে এই মূহুর্তে এই নষ্টকারী শব্দদূষণ বন্ধ করো বন্ধ করো বন্ধ করো... । দেবের মাথার ভিতরে সেই স্নিগ্ধতম ধ্বনি,খোলো... খোলো...খোলো  দেব সমস্ত মানসিক শক্তি কেন্দ্রীভূত করে মনে মনে বলতে লাগলো, খোলো... খোলো...খোলো...
বাইরে থেকে একঝলক আলোতে দেবের শোবার ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো । তারপর বুম করে আওয়াজ এবং অন্ধকার। মন্দিরের পাশে ট্রান্সফরমার দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো।