গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৪ মার্চ, ২০১৩

মৌ দা শ গু প্তা


আশিয়া
                                                     এক

শিয়ার আজ আর কিছুতেই ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ- পাতাল ভাবছে। দূরে কোথাও বিয়েবাড়ীর সানাই বাজছে, মাঝে মধ্যে অনতিদূরের পাকা রাস্তা থেকে চলন্ত গাড়ীর আওয়াজ মুহর্তের জন্য রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলে পরক্ষনেই ডুবে যাচ্ছে আদিম নিশার স্তব্ধ গভীরে। বিছানা থেকে উঠে মেয়েটা আলগোছে জানালা খুলে দেয়। তার ভয় হয়;- হয়ত পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষটা জেগে যাবে। এটা কোন মাস; আজ কত তারিখ কিছুই-আশিয়া মনে করতে পারেনা।হাসপাতালে কতগুলো দিন যে কাটিয়ে এল, তারপর আবার কদিনের জন্য মানসিক হাসপাতাল, সে স্মৃতি সত্যিই মনে পড়েনা আর।কটা দিন,টা মাস,বোধহয় বছরও তার এই বাইশ বছরের জীবন কাহিনীর পাতা থেকে যেন বেমালুম উবে গেছে দুত্তোরী! ভাদ্র- আশ্বিনে কী আসে যায়!

আশিয়ার অলস নিদ্রাহীন মনটা বিরক্তিতে ভরে ওঠে। কটা রাতচরা পাখী নাকি বাদুড় বুঝি মাথার দিকের বন্ধ জানলটার গা ঘেঁষা কামরাঙ্গা গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়াউড়ি করছে। কেমন অদ্ভুত জীবন ওদের! আশিয়া ভাবে- সে যদি মেয়েমানুষ না হয়ে ওদের মত হতো।পেটটা মোচড় দিয়ে উঠে।একটা শক্ত কিছু পেটের ভেতর খোঁচা মেরে থেকে থেকে ব্যাথা দিয়ে জানান দেয়।আশিয়া কষ্টে-সৃষ্টে জানালার সামনে বসে পড়ে। সে যদি ওদের মত হতো- অন্ততপক্ষে এই কষ্ট ভোগ করতে হতো না। ওর মন খারাপ লাগে। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে;- কিন্তু কান্না আসে না। 

                                              দুই

অগ্রহায়নে ধান ওঠার পর পরই বাবু মুদীর বড়মেয়েটার বিয়ে হওয়ার কথা। অষ্টাদশী অনাঘ্রাতা মেয়েটি বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই গত কয়েকমাসে কত রকম স্বপ্নই না দেখেছে। ঠিক করে রেখেছে, জোছনা রাতে না দেখা তার বরটিকে নিয়ে চুপিচুপি খোলামাঠে বসে সারারাত জোছনা দেখবে। কানেকানে গান শোনাবে, সূয্যি ওঠারও আগের নরম ভোরে শিশির ভেজা আলপথ বেয়ে হেঁটে যাবে হাতে হাত রেখে, এমন কি একটা দুষ্টুমিষ্টি গালফোলা পুঁচকিরও স্বপ্ন দেখেছে।অথচ বিয়ের পর থেকেই সব স্বপ্ন উধাও। একে তো পণ নিয়ে ঝামেলা, তার ওপর নতুন বৌ ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে ভাসুরের একমাত্র ছেলে মারা গেল সাপের কামড়ে।দ্বিরাগমনে এসে সেই যে জামাই রেখে গেল আর ওবাড়ীর কেউ এমুখোও হয়না। বলেই দিয়েছে বাকী পণের দাবি মিটালেও ও অপয়া বউ আর ঘরে নেবে না। স্বামী নিয়ে কোন আফশোস নেই মেয়েটার।যদিও কানাঘুষোয় মেয়েমানুষজনিত অনেক নোংরা উল্টোপাল্টা গল্প কানে এসেছে আশিয়ার, কিন্তু মানুষটাকে সামনে থেকে দেখে তা বিন্দুমাত্র বোঝা যায়নি। বরঞ্চ সত্যি বলতে কি, মানুষটা ভালো ছিলো।দিনে বাড়ীর বড়দের কথার ঝালে ধারেকাছে না থাকলেও রাতভর আদরের কমতি ছিল না। সে আদরে ব্যাথার ভাগ বেশী হলেও সে ব্যাথাটাও বড় সুখের ছিলো।সে আদরের স্মৃতিটুকুই ছিল আশিয়ার সম্বল।

                                                   তিন

সকালটা অনেকদিন পর আজ একটু অন্যভাবে শুরু হয়েছে মেয়েটার। এমন নয় যে আজ কোন পালাপার্বন আছে কি উৎসবের দিন, ঘুম থেকে উঠে সে আগে পাতকূয়োর জলে সাবান মেখে স্নান করেছে, নতুন শাড়িকাপড় পরেছে, আজ তার বর আসছে । নিন্দুকেরা বলছে ওদের এলকায় কোন মেয়েকে নিয়ে নাকি স্ফূর্তি করতে গিয়ে ফেঁসে গেছে।মেয়ের বাপ দাদা এক রাজনৈতিক নেতার ধামাধরা পোষা গুন্ডা। তাদের হাত থেকে বাঁচাতে প্রথমে ছেলের বিয়ে দিয়েছিল,তারপরে তালেগোলে হরিবোলে বউকে বাপের বাড়ী ছেড়ে আসায় ছেলে আরও পুরানো কেচ্ছায় বেশী করে জড়িয়ে পড়ে।অবস্থা বেগতিক দেখে ছেলেকে অপাংক্তেয় সেই শ্বশুরবাড়ীতেই লুকিয়ে রাখার ব্যাবস্থা হয়েছে। আনন্দে মাটিতে আর পা পড়েনা মেয়ের। আবার সেই মানুষটা,সেই ব্যাথাভরা রাতের আদর,সেই সুখের অনুভূতি।

আসার পর থেকে কেমন যেন মনমরা হয়ে আছে মানুষটা। ঘর থেকে বেরোনো তো দূর,রাতবিরেতে সামান্য আওয়াজে এমন চমকে উঠছে যে বলার নয়। অনেক কষ্টে বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে নদীর ধারে চখাচখীর মেলায় যেতে রাজী করানো গেছে। মেলা থেকে ফিরতে দেরী হয়নি। বরঞ্চ মানুষটার হড়বরিতে অন্যসবাই ফেরার আগেই মেলায় না ঘুরে ফেরত আসছিলো দুজনে। আশিয়ার ডানহাতে কাঁচের রঙীন পাখী,পুতুল, বামহাতে মেলায় কেনা জিলিপি গজা। জগুমিয়ার ধানক্ষেতের পাশে আসতে না আসতেই কে যেন পাশ থেকে অশ্রাব্য গালি দিয়ে বললো,- ……. বেলেল্লাপনার সময় বৌয়ের আঁচল মনে ছিলো না’ ------আশিয়া চমকে থেমে যায় থেমে যায়, আসলে থেমে না গিয়ে উপায়ও থাকে না, একটা বাঁকের মুখে আচমকা অচেনা কজন মানুষ পথ আটকে ধরেছে তাদের শরীরের একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, লোকগুলোর গায়ে মদ সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ টের পায় আশিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ওকে একা বিপদের মধ্যে ফেলে দুদ্দার করে হাটের আলো,লোকের ভীড়ের দিকে পালাচ্ছে ভীতু মানুষটা। পেছনে কজন তাড়া করে যাচ্ছে । বিপদ বুঝে আশিয়াও দৌড়ে পালাতে চায়, কিন্তু জোড়া পায়ে জোর পায় না। সব জোর যেন ঘাম হয়ে ঝরে পা বেয়ে বেয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। চিৎকার করতে চায়, মাঝপুকুরে ডুবে যাওয়া ক্ষীণ স্বরটুকু সে নিজেই শোনে। কেউ একজন মুহূর্তের মধ্যে পিছন থেকে মুখ চেপে ধরে, অন্য কেউ ওর বিবশ শরীরটা পাঁজাকোলা করে তুলে পাশেই জগুমিয়ার ক্ষেতে ঢুকে পড়ে।
                                                    
                                                           চার

মেয়েমানুষেরও বোধহয় বিড়ালের মত নয়টা প্রাণ থাকে নয়তো ঐ অতগুলো নরপশুর প্রতিশোধ নেবার বীভৎস মানসিকতার পাশবিক অত্যাচার সয়েও মানুষ যে বাঁচে তার প্রমাণ তো সে নিজে তবে মন্দের ভালো, তার মানুষটা কিন্তু তার সঙ্গ আর ছাড়ে নি। শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আশিয়া আত্মহত্যার কথা ভাবতে পারে নি। পেটের ভিতর আবার মোচড় দিয়ে উঠে। শত্তুরটা যেন পেটের ভিতর লাথালাথি শুরু করছে- যেন এখনই পেট ফুঁড়ে বের হয়ে আসবে। ব্যাথার একের পর এক তরঙ্গ যেন ঢেউ-এর দোলায় দোলাতে থাকে আশিয়ার সারা শরীর। একটু জল খেলে হোতো। ঘুমন্ত মানুষটাকে না জাগিয়ে মেয়েটা প্রাণপনে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা চাপতে চাপতে মাটি থেকে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। আশিয়ার মনে হয়, ওর চোখ বারবার বন্ধ হতে চাচ্ছে কেন? ও বারবার চেষ্টা করেও চোখটা খোলা রাখতে পারছে না। ও ভাবতে থকে, ও কি পারবে কালকের দিনটা দেখতে? পেটের শত্তুরটার মুখ দেখতে? যেখানে ওর সব স্বপ্নগুলো ঘুমিয়ে আছে! ভাবতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়ে।