শুভ নববর্ষ
আলাদা করে এই দিনটি নিয়ে কোন উচ্ছ্বাস আমার
নেই। তবে হ্যা শুভকামনা তো করা যেতেই পারে, তাই আবারও শুভেচ্ছা সহ সবাইকে আমার শুভ
নববর্ষের অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানালাম। জানি অনেকেই চোখ ট্যাঁরা করে তাকাচ্ছেন আমার
দিকে! ভাবছেন এই হলো ইন্টেলেকচ্যুয়েল আতেলদের সমস্যা। কারনে অকারনে সেন্টিমেন্টাল
হয়ে পড়ে। কি তাই তো !
আসলে পাশের বাড়ি থেকে কচি পাঁঠার মাংসের
গন্ধ ভেসে আসছে। আমার নিমন্ত্রণ নেই। তাই একটু সেন্টু সেন্টু গন্ধ! উমন'টাও আমার পাশে বসে আছে মাটিতে। ও বেশ
অস্বস্তিতে রয়েছে। মনটা ভালো নেই, এবার চালের গুড়োর নাড়ু হয়নি। মাহাজন চাল
দেয়নি। বলেছি
বিকেলে মেলায় নিয়ে যাবো। তাই সেই লোভে মাংসের গন্ধ কে আপাতত পাত্তা দিচ্ছে না।
ওর বাবা বেড়িয়েছে শেষ বাজারে পাঁঠার, খাসির ভুঁড়ি গুলি কিনে আনতে। কচি বাশের
ভেতর ঢুকিয়ে ভর্তা হবে পাঁঠার নাড়ীভুঁড়ির। আমি ওকে না করেছি আজ খাবি না তুই।
কালই ওর বাবা কে দারুণ ধমকে গেছে চৌধুরী। সারা বছর চৌধুরীর মাঠে খেটেও তার তিন হাজার টাকার ঋণ শোধ হয়নি। শেষে বলে গেছে আজ এসে টাকা না পেলে পোষা শুয়োরটা নিয়ে যাবে। রুপবতীকে বলে গেছে বাংলা মাল এক নম্বরটা গরম গরম তৈরী রাখতে। ডান ঘার নেড়েছে রুপবতী। তখনই কোলের'টা মুখ দিতে গেল বুকে। বুকের কাপড় আলগা হতেই চৌধুরী আরও একশ টাকা পুষিয়ে নিল। বলে গেছে আসার সময় একটা লাল বেলাউজ নিয়ে আসবে । ভেতরের টা আনবে নাকি সেটাও জিজ্ঞেস করতে ভুলে নি চৌধুরী ।
কালই ওর বাবা কে দারুণ ধমকে গেছে চৌধুরী। সারা বছর চৌধুরীর মাঠে খেটেও তার তিন হাজার টাকার ঋণ শোধ হয়নি। শেষে বলে গেছে আজ এসে টাকা না পেলে পোষা শুয়োরটা নিয়ে যাবে। রুপবতীকে বলে গেছে বাংলা মাল এক নম্বরটা গরম গরম তৈরী রাখতে। ডান ঘার নেড়েছে রুপবতী। তখনই কোলের'টা মুখ দিতে গেল বুকে। বুকের কাপড় আলগা হতেই চৌধুরী আরও একশ টাকা পুষিয়ে নিল। বলে গেছে আসার সময় একটা লাল বেলাউজ নিয়ে আসবে । ভেতরের টা আনবে নাকি সেটাও জিজ্ঞেস করতে ভুলে নি চৌধুরী ।
দিবাকর গত ক'বছর বাড়ী ফিরতে পারেনি। ছুটি পায়নি।
বিদ্যুৎকে প্যারিসের কোন মায়া আর ধরে রাখতে পারছে না। আজ সকালেও বলছিল মায়ের
কথা। নন্দিনী রান্না করছে ইলিশ সেদ্ধ। আর ভাবছে ইস একবার যদি রাজা এসে খেতে চাইত!
মনামী শুনেছি বেশ ব্যাস্ত আজকাল। পিছন
ফিরে তাকানোর সময় নেই।ইন্দ্রটা আজও রাতের কবিতা
লিখে চলেছে। নায়মা'র মনটা সক্কাল থেকেই খারাপ। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আর রোখা
যাবেনা বিয়েটা আসছে বছর। রাজীবের রঙের দোকানে প্রচুর বাকি হয়ে গেছে। একটা ছবিও
বিক্রী হয়নি। রঙ ফুরিয়েছে সব। রাকিব আজও অপেক্ষা করবে তার প্রিয়তমার জন্য দুপুর
রোদ্দুরেই লাল টি শার্ট পরে ।
ব্রেকিং নিউজের জন্য
আজও ছুটি পায়নি গৌতম । মায়ের শাড়ী দুটো জমেছে। একটা পুজোর আর
একটা পয়লা বৈশাখের । দেয়া হবে কিনা কোনদিন কে জানে !
রিয়া জানেনা কোনদিন আর কাউকে ভালবাসতে পারবে কিনা!
তানিয়া আজও ভাবে বোনটা কেন চলে গেল দুদিনের
জ্বরে! এতো অভিমান! অর্পিতা
আজও শেষের কবিতা পরে, প্রতিদিন সক্কাল বেলায় ভাবে এই বুঝি এলো অমিত...। আমি জানিনা এরপরেও কিভাবে ভালো থাকার চেষ্টা
করবো মিষ্টি মিষ্টি হাসি মুখ করে! ইতিহাসের
খীলান গুলি দেখে মনে পরে গেলো, কোনদিনই মানুষ ভালো থাকতে পারেনি এই দিনগুলিতে। ইতিহাস বলে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট
আকবরের যুগে প্রবর্তন হয়েছিল বাংলা সালের। বর্ষশুরুর সে দিনটিই এখন বাঙালির
প্রাণের উৎসব । বাদশাহ আকবরের নবরত্ন সভার আমির ফতেহ উল
সিরাজি বাদশাহি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ফসলি সালের শুরু করেছিলেন হিজরি
চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষের মতো মিলিয়ে নিয়ে। তিনিই হিজরিকে বাংলা সালের সঙ্গে সমন্বয়
সাধন করেছিলেন ও পয়লা বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেছিলেন। আর বৈশাখ
নামটি নেওয়া হয়েছিলো নক্ষত্র ‘বিশাখা’র নাম থেকে । পয়লা
বৈশাখে নাকি আকবর মিলিত হতেন প্রজাদের সঙ্গে । চারদিকে বিতরণ হতো মিষ্টি । সঙ্গে চলতো খাজনা আদায় । এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
আমলে বর্ষবরণ উৎসব চলে আসে
জমিদার বাড়ির আঙিনায় । খাজনা
আদায়ের মতো একটি রসহীন বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় গান বাজনা, মেলা আর হালখাতার অনুষ্ঠান । আজও খাজনা আদায় করতে আসবে চৌধুরী ফুলবতীর বাড়ি
। তবে ফুলবতী আপাতত সব
ভুলে ব্যাস্ত সকাল থেকে কালী গরুর দুধ ওগলাতে বিশাল লোহার কড়াইয়ে কাঠের চুলোয়।
এতে নাকি সংসারের শ্রীবৃদ্ধি হয়। উমনটা কখন যে পালাল আমার পাশ থেকে চুপটি করে! ও
পালালেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে নিশ্চিত।
যাই এবার আমিও, নন্দিনীর কোন খোঁজ পাই কিনা দেখি একবার আমার
পাহাড়ে !
প্রতিচ্ছবি
রান্নাঘরে ট্রেতে শরবতের গ্লাস সাজাতে সাজাতে জয়ী মুখ
টিপে নিজের মনেই একটু হেসে নিল। সুমিত্রা দেবীর কথা তার
কানে ভেসে আসছিল। পাশের বাড়ির রিতু পিসি আর মিত্রা কাকিমার কাছে
জয়ীর নামে প্রশংসার ফুলঝুরি আজ তাঁর মুখে। জয়ীর মতো বৌমা নাকি লাখে - দু
লাখে একটা মেলে । অথচ ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে প্রায় বছর পাঁচেক আগে এই
জয়ীকেই তাঁর মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল একমাত্র ছেলে নীলের স্ত্রী
হিসেবে ।
শরবত নিয়ে ড্রয়িং-রুমে ঢুকে সে দেখল তার রাশভারি শাশুড়ি ফলাও করে
তার গুণকীর্তন করছেন। বাকি দুজনও বেশ মনোযোগ সহকারেই তাঁর কথা
শুনছেন ; সমর্থনও করে চলেছেন। জয়ী জানে, এসব মেকি নয়।
ওকে দেখেই তিনজন হৈহৈ করে উঠলেন, "আয়, আয়, বোস
এখানে।" বসলো ও কিছুক্ষণ , তারপর কাজের অছিলায় উঠে এলো নিজের
ঘরে । আসলে মুখের সামনে এত প্রশংসা শুনে একটু লজ্জাই পাচ্ছিল । বিশেষ কিছুই না, মিত্রা
কাকিমার মেয়ে সোমালি কিছুদিন যাবতবেড়াতে এসেছে ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটা যেমন মিষ্টি, তেমনই দুরন্ত; পাঁচ বছর বয়েস।
আজ দুপুরে চারটে সিঁড়ির ওপর থেকে লাফ মেরেছে তার দেখা কোনও একটাপ্রিয় কার্টুন
চরিত্রের মতো। ফলে যা হবার তাই হয়েছে, মাথা ফেটে রক্তারক্তি কান্ড। সবাই যখন
চীৎকার করে কান্নাকাটি করছে, সে তখন সময় নষ্ট না করে, গ্যারাজ থেকে গাড়িটা বার করে এনেছে।
নিমেষে সোমালি আর গুবলুকে নিয়ে রুবি জেনারাল হসপিটাল
পৌঁছে গেছে। সেখানে নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই গুবলুকে চিকিৎসাও করানো হয়ে
যাবার পর আবার বাড়ি।
মিত্রা কাকিমা একাই থাকেন, কাকু গত বছর
মারা গেছেন। তাই এসব কিছু করার আর কেউ সে সময় উপস্থিত ছিলনা। জয়ী এক নামকরা সংবাদপত্রের সাংবাদিক। নীলের সাথে পরিচয়
সেই সুবাদেই। নীলও সেখানেই সাংবাদিকতা করত। ক্রমে
সেই পরিচয় গড়াল ছাদনাতলায়। সুমিত্রা দেবি এই জিন্স-টপ পরা সাংবাদিক বৌমাকে পছন্দ
করেননি। তাঁর মতে, বাড়ির বউরা এরকম হলে মানায় না। একেকবার সে ভেবেছে চাকরি
ছাড়ার কথা, কিন্তু নীল সমানে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে, ওকে উৎসাহ
দিয়ে গেছে, আর মাকেও বোঝানর চেষ্টা করে গেছে; বুঝিয়েছে, তার এই
পোশাকটাই তার পরিচয় নয়। এভাবেই চলছিল। তারপর হঠাৎ একদিন কি
যেন হয়ে গেল। মাত্র বত্রিশ বছর বয়েসে, আঠাশ বছরের জয়ী কে ছেড়ে, ম্যাসিভ
স্ট্রোকে সে চলে গেল । সেই থেকে জয়ী একাধারে জয়ী ও নীল । যদিও এসবের জন্য তাকে নিজের গলার কাছে উঠে আসা দলাপাকানো ব্যথাটা বারেবারে গিলে ফেলতে হয়েছে ।
আজ সুমিত্রা দেবী তার শাশুড়ি নন, তার মা । এখন তিনি ওকে আঁকড়ে বেঁচে আছেন । ঋজু, তাঁর নাতি, নীল-জয়ীর তিন বছরের ছেলে সারাক্ষণ
তাঁর আঁচলের সাথে লেপটে থাকে ।
আর মা, আবার তাঁর সেই নীলকে মানুষ করে
তুলছেন। "জয়ী, খাবি আয় মা...", মার ডাক ভেসে
আসে। সুমিত্রা দেবি রাতের খাবার সাজিয়ে ডাক দেন রোজ এইভাবে; খুব ভালো লাগে
তখন। নীলের ছবিটাকে হাতে নিয়ে আজও বলে গেল সে,"আমি পেরেছি, ......।"
সেইসব কথা
অর্দ্ধেন্দু শেখর গোস্বামী
আগুন ও জলের ভয়াবহ রুদ্র রূপ দর্শন ছাড়া শৈশবে ভয় পাওয়ার তেমন ঘটনা স্মৃতি হাতড়ে
পাওয়া যাচ্ছে না । বাচ্চাদের ভূতের
ভয়টাই বেশি করে
পাওয়ার কথা। কিন্তু শৈশবে তেনাদের
সাথে আমার যেটুকু চেনাশোনা ছিল তাতে তেনাদের খুব ভয়ংকর বলে মনে হয়নি
কখনও। আমাদের গাঁয়ের দশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোথাও
বিজলিবাতি ছিল না। সন্ধেবেলায় হ্যারি- কেন বা লণ্ঠনের টিমটিমে আলো ব্যতীত
অন্য কোন আলোরও চল ছিল না। সারা গাঁ খুঁজলে হয়তো দুএকটা অচল
তিন-ব্যাটারির লম্বা এভারেডি টর্চ মিলত। মাঝে মাঝে ডাকাতদের ভয়ে গ্রামপাহারা
দেওয়ার হুজুগ উঠত। তখন থানা থেকে বোধ হয় ওইরকম টর্চ ছাড়াও লাঠি-ফাটির
বরাদ্দ হত। কিছুদিনের মধ্যেই টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে যেত, পাহারা-পার্টিও
অচিরে অদৃশ্য। আশেপাশের কোথায়ও ডাকাতির খবর না পাওয়া পর্যন্ত নতুন
করে আর পাহারাদল গড়ার উদ্যোগ দেখা যেত না। সন্ধের পর তাই বেশীরভাগ সময়ই
অন্ধকার ছিল আমাদের সঙ্গী। চলাফেরা করার সময় আমরা অন্তত আলো আর
অন্ধকারের মধ্যে বিশেষ ফারাক বুঝতাম না।
ভূতের ভয় মনে চেপে বসতে না পারার সেটা একটা কারণ হতে পারে । অন্য কারণটা অবশ্যই আমার মা । মা খুব সুন্দর করে গল্প বলতে পারতেন। বহু মজার মজার গল্প ছাড়াও ভূতের গল্পেও তাঁর ভাঁড়ার পরিপূর্ণ ছিল ।
ভূতের ভয় মনে চেপে বসতে না পারার সেটা একটা কারণ হতে পারে । অন্য কারণটা অবশ্যই আমার মা । মা খুব সুন্দর করে গল্প বলতে পারতেন। বহু মজার মজার গল্প ছাড়াও ভূতের গল্পেও তাঁর ভাঁড়ার পরিপূর্ণ ছিল ।
আমার পাঠশালা যাওয়া শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত যে সব সন্ধ্যায় মা সকাল
সকাল হেঁসেল থেকে ছুটি পেতেন,আমাকে নিয়ে শুয়েই তাঁকে 'কাইনি' শুরু করতে হত। তাঁর সন্তানদের মধ্যে আমিই ছিলাম কনিষ্ঠতম। সুতরাং যথেষ্ট বড় হয়েও তাঁর পীযূষভাণ্ডে আমার অধিকার
কায়েম ছিল।
সেই শুষ্ক ভাণ্ডে আমার অত্যাচার থেকে
অব্যাহতি পেতে হলে 'কাইনি'বলে যাওয়া আবশ্যিক ছিল আমি ঘুমিয়ে না পড়া
পর্যন্ত। তাঁর ভূতের গল্পের মধ্য দিয়েই আমার তেনাদের সঙ্গে
পরিচয় হয়। তবে সেই পরিচয়ে ভীতির পরিবর্তে মজারই উদ্রেক হল। মায়ের সমস্ত ভূতই
ভূভারতের একটি জায়গাতেই বসবাস করত। সেটি তাঁর বাপের বাড়ি আর মামাশ্বশুর বাড়ির মধ্যিখানে
শিলাবতী নদীর বালির চরে। তাঁর অধিকাংশ
ভূতের গল্পের নায়ক ছিলেন আমার বাবার এক মামা অর্থাৎ তাঁর মামাশ্বশুর।
ভূতের গল্পের নায়ক ছিলেন আমার বাবার এক মামা অর্থাৎ তাঁর মামাশ্বশুর।
আমার ঠাকুমা,আমরা বলতাম -
দিদিগোঁসাই,ছিলেন ছোটোখাটো এক জমিদারের মেয়ে । সেই জমিদারকে সবাই বলত 'ভেলাইডিহার রাজা'। তো সেই রাজারই এক ছেলে, নাম সম্ভবত হরনাথ
সিংহ বাবু (মা বলতেন,'আরসিং'-কেননা গুরুজনের নাম অনুচ্চার্য)গভীর রাত্রে প্রতিদিন কে
জানে কোথা থেকে নদীর চর পেরিয়ে বাড়ি ফিরতেন। আর চরের মধ্যিখানে তাঁকে
ভূতের দল ঘিরে ফেলত। তারা গোল হয়ে তাঁকে ঘিরে নাচ শুরু করত - খুচ-চু-নাচন, খুচ-চুনা-চন,-খুচ্চু-নাচন... মা সুর করে করে তাদের নাচের বোল বলতেন অনেকক্ষণ ধরে। গল্পের ওই জায়গাটাই আমার সবচেয়ে ভাল
লাগত। এমনও হয়েছে কোন কোনদিন ওই সুরেলা বোল শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়েছি।
আরসিং এর মাথায় থাকত পাগড়ি আর হাতে লোহা বাঁধানো বাঁশের লাঠি। তিনি বনবন করে সুদর্শন চক্রের চেয়েও বেশী বেগে লাঠিটি
ক্রমান্বয়ে মাথার উপর,ডানপাশে,শূন্যে লাফ দিয়ে
উঠে পায়ের তলায়,তারপর বাঁ পাশ হয়ে আবার মাথার উপর এমনই ঘোরাতেন যে তার
ফাঁক দিয়ে ছুঁচটিও গলতে পারত না যে দুএকটা সাহসী ভুত ছুঁচের আকার ধরে গলবার চেষ্টা
করত তারা লাঠির ঘায়ে বহু দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ত। ক্রমে ক্রমে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে
আরসিং একটি
হুঙ্কার ছেড়ে ধীরে ধীরে নদী পার হয়ে
ঘরে ফিরতেন আর দূর থেকে ভূতের দল খোনা গলায় চিৎকার করে বলত,- যাঁ যাঁ,আঁজ খুঁব বেঁচে
গেঁলি,এঁকদিন না এঁকদিন তোঁর ঘাঁড় মটকাঁবই । কাজেই আরসিং এর লড়াই জারি থাকত। আর
সে জিতবে বলে জেনেও আমি পরের দিনের যুদ্ধের জন্য সাগ্রহে
অপেক্ষা করতাম। তবে কি,আরসিং নামটি শুনলেই যেমন একটা শিংশুদ্ধু বীরের ছবি মনে
ভেসে উঠত(সিং যে কোন নামের অংশ হতে পারে সেটা সেদিন ভাবনার অগম্য ছিল),ভুতেদের তেমন
ভয়ঙ্কর কিছু মনে হোত না।ভূতের ভয়টাও সেজন্যে বুঝি শৈশবে তেমন দানা বাঁধেনি। একা
ঘরের মধ্যে কখনো সখনো গা ছমছম করলেও তার পিছনে আর যাই থাক ভুতের আশঙ্কা ছিল না।
ঘরের বাইরে বেরোলেই ছমছমানি কেটে যেত। সেই
শৈশব থেকেই বদ্ধ ঘরের চাইতে অবারিত বাহির আমার অধিক আপন মনে হত। সে প্রসঙ্গ এখন থাক,ভূতেদের ব্যাপারটা
আগে শেষ করা যাক। যেহেতু জানতাম ভূতেদের
স্থায়ী ঠিকানা ভেলাইডিহার নদীর চর, সুতরাং অন্য কোথাও তাদের সাক্ষাতের
আশঙ্কা নেই।
বাবার মুখে অবশ্যি একবার আমাদের গ্রামের মাঠেই ঘোড়া-ভূত দেখার
কথা শুনেছিলাম। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী যখন নিজেই শেষ করতেন এইভাবে যে - ভোরবেলার ঝাপসা আলোয় ছুটন্ত ঘোড়া বোধ হলেও সেটা সম্ভবত দৃষ্টিবিভ্রমই ছিল
- তখন তাঁর সংশয়ী সুর কোনভাবেই ভূতের উপস্থিতির পক্ষে জোরালো সাক্ষ্য দিত না। তবে অনেকটা বড় হয়ে,যখন আমি বারো, ক্লাস সিক্স-এ পড়ি,সন্ধেবেলায় খোলা ছাদে ভুতের ঢেলা
খেয়েছিলাম। গ্রীষ্মকাল,বড়ো জোর নটা হবে। সে আমলে অজ গাঁয়ের লোকেরা সন্ধে হতে না হতেই খেয়েদেয়ে
শুয়ে পড়ত। আমাদের বিশাল একান্নবর্তী পরিবার।পাশাপাশি দুটি দোতলা বাড়ি,একটি টিনের ছাউনি মেটে,অন্যটি ইঁট সুরকির গাঁথনি পাকা। পাকা
বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠেই দোতলার খোলা ছাদ,ছাদ সংলগ্ন পর পর দুটি ঘর। প্রথম
ঘরটির সামনে খোলা ছাদে মাদুর পেতে বসে হ্যারিকেনের আলোয় আমি পাটিগনিতের
অঙ্ক করছি। ঘরটির ভেতর বাবা ঘুমিয়ে।
সারা গ্রাম নিস্তব্ধ। ধীরে বইছে
দখিনা হাওয়া। নতুন প্রশ্নমালার একটার পর একটা অঙ্ক
আমার মিলে যাচ্ছে,আমি তাতে এমনই নিমগ্ন যে বাহ্যজ্ঞান প্রায় লুপ্ত। হঠাৎ ঠক করে একটা শব্দ!চমকে মুখ তুলে দেখি একটা ছোট ইঁটের টুকরো গড়াতে গড়াতে আমার খাতার উপর এসে থেমে গেল। ধক করে লাফিয়ে উঠেই হৃৎপিণ্ডটা সজোরে ছুটতে শুর করল। আমিও একলাফে ঘরের ভিতরে বাবার পাশে বিছানায় মুখ গুঁজলাম। কতক্ষণ পরে খেয়াল নেই - একটু ধাতস্থ হয়ে বাবাকে ডেকে তুললাম। বললাম,-কিসে ঢিল ছুঁড়ল - ছাদে--! বাবা উঠলেন, বললেন,- চলো তো দেখি...
আমার মিলে যাচ্ছে,আমি তাতে এমনই নিমগ্ন যে বাহ্যজ্ঞান প্রায় লুপ্ত। হঠাৎ ঠক করে একটা শব্দ!চমকে মুখ তুলে দেখি একটা ছোট ইঁটের টুকরো গড়াতে গড়াতে আমার খাতার উপর এসে থেমে গেল। ধক করে লাফিয়ে উঠেই হৃৎপিণ্ডটা সজোরে ছুটতে শুর করল। আমিও একলাফে ঘরের ভিতরে বাবার পাশে বিছানায় মুখ গুঁজলাম। কতক্ষণ পরে খেয়াল নেই - একটু ধাতস্থ হয়ে বাবাকে ডেকে তুললাম। বললাম,-কিসে ঢিল ছুঁড়ল - ছাদে--! বাবা উঠলেন, বললেন,- চলো তো দেখি...
ছাদে বেরিয়ে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল--কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই,মাদুরের উপর হ্যারিকেন
জ্বলছে,আমার বই খাতাও খোলা পড়ে-খাতার উপর থেকে শুধু ঢিলটাই উধাও! বাবা কী ভেবেছিলেন
জানি না। হয়ত ভেবে থাকবেন আমার মনের ভুল। কিন্তু আমি সেদিন সেই রহস্যের কোন
কিনারা খুঁজে পাইনি। এখন পরিণত বয়সে এসে,ছোটদের দৃষ্টিকোণ থেকে বড়দের জগতের
আধচেনা,অস্পষ্ট ঘটনাবলী স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে সেই রহস্যের একটা ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম। সেটা
উপযুক্ত জায়গায় বলা যাবে
।