গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৬ জুন, ২০১২

তিনটি গল্প - আনোয়ার হোসেন /'অটোবায়োগ্রাফি', পারোমিতা চট্টোপাধ্যায় / 'অনামিকা' ) দেবাশিষ দে /'পত্রমিতালি


অটোবায়োগ্রাফি

নো য়া র হো সে

নীলিমার নীল আর বন-বাদারে ফুটে থাকা অযুত ফুলের পাঁপড়ির রঙে একদিন যাকে সাজিয়েছিলাম বালিয়াড়ির মরীচিকায় তাকে হারিয়েছি আজ থেকে দু’-দুটি বছর আগে । কিছুদিন আগেও হৃদয়াকাশে ঘন মেঘ ছিলো,গুমোট আবহাওয়া ছিলো, বিষন্ন ম্লান প্রকৃতির মাঝে রিক্ততার দাপাদাপি ছিলো । হঠাৎ কোথা থেকে এক পশলা শীতল বাতাস বিষাদের ঘন মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গেলো । গাছ-পালায় ঘন সবুজ ফিরে এলো । দূরে কোথাও শীস দিয়ে গেল বউ কথা কও । এইতো , এইমাত্র আমার ভালোলাগার শুরু হলো । স্মৃতির পাতায় ময়লা জমলেও তার কিছু কিছু অক্ষর নাকি একেবারে অস্পষ্ট হয়ে যায় না । কোনো কোনো ঘটনা স্মৃতিবাহী জীর্র্ন পাতাগুলোর মলিনতা অগ্রাহ্য করে রক্তাক্ত অক্ষরে ফুটে থাকে । সেই শৈশব আর কৈশোরের অবুজ সবুজের অর্ন্তদ্বন্দ্বময় সময়ের হাতছানি দিয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতি কিছু বিস্মৃতি আজও আমাকে একাকি কাঁদায়।আমার ভালোলাগার পাঁপড়িগুলো তখনও বাস্তবের শানানো কষাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে যায়নি । কৈশোরের সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় হঠাৎ কখন যেন আমার ভালোলাগার সমস্ত আবেশ সদাস চঞ্চলা , হরিনী চোখের একটি মেয়েতে জড়িয়ে গেলো। বয়স আর বুদ্ধির ক্রমবহমানতা আমাদের পৌঁছে দিলো একে অন্যের হৃদয় কন্দরে । কৈশোরের হিরন্ময় সময় চিরাচরিত নিয়মে হাঁটি হাঁটি পা-পা করে আমাদের নিয়ে যেতে লাগলো যৌবনের অজানা বন্দরে। পাশাপাশি উড়ে চলা দুটি পাখি একটি একান্ত ছোট্ট বাসা বাধার বাসনা নিয়ে পেড়িয়ে যেতে লাগলো বিস্তীর্ণ আকাশ । একান্ত চাওয়া পাওয়া গুলো মিলিত হতে চললো একটি পুস্পিত বিন্দুতে । একান্ত সুখময় অনুভূতি গুলো ছুঁয়ে যেতে লাগলো দুজনার ছন্দময় জীবনে ।


এমনি করে তীঁর বেগে ছুঁটে চলা দুটি জীবনে হঠাৎ করে রেখাপাত করলো অন্ধকার কালো মেঘ । দৃষ্টি লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে লাগলো । মুহুর্তেই নেমে এলো দূরন্ত বৈশাখি ঝড় । ডানাভাঙা দুটি পাখি পথ হারালো দুটি অজানা মেরুতে ।হৃদয়ের সমস্ত ভালো লাগার সিক্ত অনুভূতিগুলো যৌবনের তপ্ত মরুর খর-রোদ্দুরে পুড়িয়ে একাকি হাঁটছিলাম । লক্ষ্যহীন,গন্তব্যহীন একটি জীবন এগিয়ে যেতে লাগলো হতাশার মরুপথ ধরে। গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যেতে লাগলো এক কালের সম্বাবনাময় একটি কিশোরের ফেরারি যৌবন। তখন বয়স আর কত হবে এগার কি বারো ! ক্লাশ সেভেনে পড়ি। পাড়া-গাঁয়ের স্কুল হলেও আমার স্কুলটির একটি আলাদা প্রসিদ্ধি ছিলো। প্রতি বছরই এস,এস,সি পরীক্ষায় কেউ না কেউ স্ট্যান্ড করতো । আর আমি সেই ঐতিহ্যবহী স্কুলটির ক্লাশ সেভেনের দুই নম্বর রোলধারী স্টুডেন্ট ছিলাম ।স্কুলটিতে তখন সহশিক্ষা প্রচলিত ছিলো। এখনও আছে।ছোটকাল থেকেই চঞ্চল প্রকৃতির আর বন্ধু বৎসল হওয়ায় প্রায় সকলেই আমাকে চিনতো। আমাদের ক্লাশে ত্রিশ জন ছাত্রী আর পঞ্চাশজন ছাত্র ছিলো। বিরাট ক্লাশরুমে আমাদের ক্লাশ হতো্ ক্লাশ ওয়ান থেকে এক সাথে পড়ে আসায় ক্লাশের সবার সাথেই আন্তরিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। তখনও কৈশোরের লজ্জারাঙা আভা আদল থেকে একেবারে মুছেঁ যায়নি।


একদিন ক্লাশে একটা ঘটনা ঘটলো। আমি অবশ্য পরে জানতে পেরেছি ক্লাশের পাঁচ নম্বর রোলধারী মেয়েটির নাম ছিলো উর্মিলা চক্রবর্তী ।তখন বিজ্ঞানের ক্লাশ চলছিলো । আমি মনোযোগ দিয়ে স্যারের লেকচার শুনছি। ক্লাশ শেষে এক বন্ধু আমাকে জানালো উর্মিলা নাকি ক্লাশ চলাকালীন সময়ে আমার দিকে মোট একচল্লিশ বার তাকিয়েছে। বোকা ছেরে বলে ওকে আমি দুচারটা কানমলা দিয়ে ক্ষান্ত হলাম। কিছুদিন পরে এক বান্ধবী জানালো তন্ময় উর্মিলা তোর খুব প্রশংসা করে।ওর কথা তেমন গায়ে লাগালাম না । মনে মনে কিছুটা লজ্জিত হলাম।বান্ধবীটির নাম মৌটুসি। উর্মিলার ঘনিষ্ট বান্ধবী, দুজনার বাড়িও খুবই কাছাকাছি ওর কথায় তেমন পাত্তা দিচ্ছিনা দেখে ও আমার পিঠে খোঁচা মেরে বললো, “জানিস , সেদিন আমি আর উর্মিলা স্কুল শেষে একসাথে বাড়ি ফিরছিলাম।পথে উর্মিলা আমাকে বললো তন্ময় যখন বাড়ি থেকে মাইল খানেক হেঁটে এসে ক্লাশরুমে ঢোকে, তখন ওর কালো চেহারায় বিন্দু বিন্দু ঘামের ঝিকিমিকি দেখতে খুব ভালোলাগে আমি লজ্জারাঙা হয়ে মৌটুসিকে বললাম যা ছেমরি !

সেদিন ছিলো বিষ্যুদবার । স্কুল একটু আগেভাগেই শেষ হলো । বইখাতা বগলবন্দী করে বাড়ি ফিরবো । এমন সময় উর্মিলা হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলো। ততক্ষনে ক্লাশের অন্য সবাই ক্লাশরুম ছেড়ে বাড়ির পানে বেড়িয়ে পড়েছে। ও আমাকে বললো, “ তোর বাংলা বইটা আমাকে একটু দে এক্ষুনি ফেরৎ দিচ্ছি।আামি বিনা বাক্য ব্যয়ে বইটি কে দিলাম। ও বেইটিকে আড়াল করে তার মধ্যে কী যেনো গুঁজে দিয়ে বইটি বন্ধ করে আমাকে ফিরিয়ে দিলো।বইটিকে আমার হাতে দিয়েই ও কেটে পড়লো।আমার সন্দেহ হলো।ক্লাশরুমেই বইটি খুললাম। দেখতে পেলাম একটি চিঠি আর সদ্য ছেঁড়া গোলাপের কয়েকটি পাঁপড়িআমার হৃৎপিন্ডের গতিবেগ বেড়ে গেল। প্রচন্ড তেষ্টা পেলো। এক দৌড়ে স্কুলের সামনের টিউবওয়েলে চাপ দিয়ে দুই গ্লাস পানি ঢক্ ঢক্ করে খেয়ে নিলাম্ । বাড়ি ফেরার পথে কয়েকবার আছাড় খেয়েছি। পথে এক মুরুব্বী জিজ্ঞেস করলেন,” কিরে তন্ময় তুই অত দ্রুত বাড়ি ফিরছিস ! বাড়িতে কিছু হয়েছে নাকি ?  আমি বললাম না চাচা, এমন । বাড়ি এসে আমার রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লক্ করে এক নি:শ্বাসে চিঠিটা পড়ে ফেললাম।পর পর দশ বারো বার পড়লাম । আরও পড়তে ইচ্ছে হলো। হঠাৎ কেমন এক অজানা শিহরন আমার সমস্ত অস্তিত্বে ঢউ খেলে গেল। আমি না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম্ । স্বপ্নে দেখলাম,  দুজন পাশাপাশি বসে গল্প করছি। পেছন থেকে স্কুলের সবচেয়ে কড়া শিক্ষক নরেন বাবু আমার কান টেনে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “এই ছেলে এখানে কী হচ্ছে ? চলো লাইব্রেরিতে চলো , তোমাদের বিচার হবে।আমরা দুজন স্যারের পায়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। দুপুরে খাওয়ার পর মা পাশের রুমে ঘুমুচ্ছিলেন। আমার কান্নার শব্দ শুনে উঠে পড়লেন। বাইরে থেকে দরজা ধাক্কা দিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলেন , “ কিরে তন্ময় , কাঁদছিস কেন ?দরজা খোল ।মায়ের ডাকাডাকিতে আমার ঘুম ভেংগে গেল। দরজা খুলে দিয়ে মায়ের সামনে বোকা বনে গেলাম। শণিবার একটু আগে ভাগেই ক্লাশে গেলাম দেখলাম সবেমাত্র দশ-বারো জন ছাত্র-ছাত্রী ক্লাশে এসেছে।


আমার চোখ বা্র বার ও কে খঁজে ফিরছিল। বন্ধু বান্ধবীরা আজ আমার চোখে কী যেনো দেখতে পেলো।আজ আমার স্বভাব সুলভ চঞ্চলতা নেই। অন্য যে কোন দিন হলে ক্লাশে ঢুকেই বেঞ্চে থাপ্পড় মেরে সবাইকে জিজ্হেস করতাম,” কীরে ক্যামন আছিস সবাই ?” আজ তেমন কিছুই করছি না । ক্লাশের পেছনে একটি সিট নিয়ে নিরিবিলি বসে আছি।আমার এমন দূরবস্থা দেখে এক সহপাঠী কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করলো , কিরে তন্ময় ,একেবারে চুপচাপ; আলমারি থেকে টাকা চুরি করে আজও খালাম্মার মার খেয়েছিস ?!” আমি একটু হাসলাম মাত্র। কিছুক্ষন পরে উর্মিলা ক্লাশে ঢুকলো। ওর দিকে ক্যানো জানি তাকাতে পারলাম না।ক্লাশে মুখ নিচু করে বসে রইলাম। মনে হতে লাগলো কে যেন আমার হাতে-পায়ে শেকল পড়িয়ে দিয়েছে। আমি ইচ্ছে করলেই নড়ে-চড়ে বসতে পারিনা। কারো দিকে তাকাতে পারিনা। কিংবা স্বভাব সুলভ ভংগিতে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিনা আজ মানিক মিয়ার বেলগাছ থেকে কটি বেল চুরি করেছিস ? “স্কুল ছুটি হলো । আমি আনমনে বাড়ির পাণে হাঁটছিলাম্।ক্লাশে বসে বার দুয়েক ওর দিকে তাকাতে গিয়েও চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি।আর লক্ষ্য করেছি , আজকে ও অন্যদিনের মতো চঞ্চলা নয়।কতদূর বাড়ির দিকে এগুতেই দেখলাম,মৌটুসিকে নিয়ে উর্মিলা আমার বাড়ি ফেরার পথের কিছু দূরে দাড়িয়ে আছে। ওদের দেখেও না দেখার ভান করে হন হন করে ওদের অতিক্রম করে যাচ্ছিলাম্।পেছন থেকে মৌটুসি ডাক দিল, “ এই তন্ময় , শোন।আমি দাড়ালাম । দূরে একটি নির্জন যায়গার ইংগিত করে ওরা দুজন আমার আগে আগে হাঁটতে লাগলো। আমি ওদের অনুসরন করলাম্ । কিছুদূর গিয়ে ওরা থামলে আমি জিজ্ঞেস করলাম,কিরে মৌটুসি, এখানে আমাকে ডেকেছিস কেন ? মৌটুসি প্রশ্নবোধক হাসি দিয়ে আমাকে আর উর্মিলাকে রেখে দৌড়ে পালালো। আমি উর্মিলাকে কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না ।


দীর্ঘক্ষণ নিরবতার পর ও শুরু করলো,” আমাকে ক্ষমা করো তন্ময়।আমি হয়তো একটা ভুল করে ফেলেছি। ওর প্রতি আমার এক অজানা সহানুভূতি জেগে উঠলো । বললাম, না, তুমি কোন অন্যায় করোনি ।এই বলে ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম,ওর মায়াবী চোখ দুটো সজল হয়ে উঠেছে।কিছুক্ষন পরে ও আমার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বললো , “ তন্ময়, আমি তোমাকে ভালোবাসি ।এরপর ক্যানো যেনো ওর কাঁন্না দেখে আমিও কেঁদে ফেললাম। এরপর থেকে রোজ ওর জন্যে আগে-ভাগে ক্লাশে আসতাম। ক্লাশ শুরুর আগে ও পরে দুজনে মিলে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করতাম।লক্ষ্য করলাম,আমরা দুজন অন্যদের থেকে আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে যাচ্ছি এরপর সময়ের বহমানতার সাথে সাথে আমরা ভালোবাসার প্রবাহমানতাকে নানা জিজ্ঞাসা,অভিব্যক্তি ও অংগীকারের পিঞ্জরে আবদ্ধ করলাম বলে রাখা ভালো যে, আমরা দুজন ভিন্ন ধর্মের।ও হিন্দু আমি মুসলমান। ধর্মের ব্যবধান আমাদের ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র রেখাপাত করতে পারেনি। ছোটকাল থেকেই ধর্মের ব্যাপারে কোথায় যেনো একটা খটকা আমার মধ্যে কাজ করে আসছে।অবশ্য এর মর্মোদ্ধার আমি আজও করতে পারিনি। তবে আমরা দুই অপরিপক্ক হৃদয় অন্তত: এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে ধর্মের দেয়াল ডিঙিয়ে ভালোবাসা কোন অপরাধ নয়।

এরপর আস্তে আস্তে সমাজের জটিলতাগুলো আমাদের দিকে শানানো ছুরির মতো এগিয়ে আসতে থাকে। আমি একটু একরোখা স্বভাবের বলে ওসব বাঁধা পরোয়া করিনি এবং দেখতে পেয়েছি সমাজের সবাই অন্যদের ব্যাপারে তেমনটি নয়। । জানিনা আমি মারমুখী স্বভাবের ছিলাম বলেই এমনটি হয়েছিল কিনা। তখন আমরা এস,এস,সি দেবো। গভীর রাতে আমি ওদের বাড়িতে গেলাম দেখতে, “ ও পড়ে কিনা ।একলা এক বাড়ি। চারিদিকে বাগান। আমি ছোটকাল থেকে ভূতের ভয় পেতাম। কিন্তু প্রেমে পড়ার বছর দুয়ের মধ্যে এই ভয়টা আমার মাথা থেকে পালিয়ে যায়। জানিনা প্রেমকে ভূত ভয় করে কিনা ! আমি ওদের পেছনের দরোজায় হাল্কা টোকা দিলাম। ও আমার সাংকেতিক করাঘাতে সাড়া দিয়ে চুপিসারে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।বাড়ির কিছুদূরে একটা খালের কিনারায় চাঁদনী রাতে দুজন হাত ধরাধরি করে বসলাম। এখন আমরা অনেককিছু বুঝি। ভালোবাসার দূর্দান্ত লাগামহীন টান অনুভব করতে পারি।মিলনের আকাংখা উপলব্ধি করি। এরই মধ্যে আমি কিভাবে যেনো বুঝে ফেলেছিলাম বিবাহ পূর্ব শারিরীক সম্পর্ক প্রেমের পাঁপড়িকে ম্লান করে দেয়্।তাই চাঁদনী রাতে মহাবিশ্বের পাণে তাকিয়ে দুজন বলেছিলাম----
যদস্থ হৃদয়ং মম তদস্থ হৃদয়ং তব 


এস,এস,সি পরীক্ষায় দুজনেই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম। ও আমাকে পরামর্শ দিলো , “ আমি যেন ঢাকার কোনো ভালো কলেজে ভর্তি হই।আমি মানতে পারলাম না। বললাম, “দুজন একই কলেজে পড়বো।ও আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মানতে বাধ্য করলো যে, আমাকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য ঢাকার কোনো নামি দামী কলেজে পড়তে হবে। ওর কথা মতো ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী কলেজে চান্স পেয়ে গেলাম্ভর্তি হওয়ার আগে ওর সাথে দেখা করে বললাম, “ জানি না , তুমি আমাকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছো ।ও প্রত্যুত্তরে নানা কথায় জীবন গড়ার পরামর্শ দিলো। আমাকে ঘিরে ওর যে বাসনা পল্লবিত হচ্ছে তাতেই নাকি ,তা ষোলকলায় পূর্ণ হবে। আমার প্রতিবাদ ধোপে টিকলো না্ । ওর কথা মতো দুজনে দুযায়গায ভর্তি হলাম্ । কলেজে ক্লাশ শুরুর আগে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই তখন দুজনেই দীর্ঘক্ষন কেঁদেছিলাম। বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ছিলনা। জানিনা, তারপরেও আমি কেন যেন আমার বুকের ভেতরে মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা কিংবা ব্যাবিলনীয় সভ্যতার শশব্দ বিলুপ্তির বিশাল কম্পন অনুভব করলাম।

      অনামিকা
                               

পা রো মি তা চ ট্টো পা ধ্যা য়

তার নাম অনামিকা । অনামিকার জীবনে বলার মত তেমন গল্প নেই । তবু অনামিকা ভাবে অনেক না বলা কথা জমা হয়ে আছে – সেগুলো থেকে অনেক গল্প হতে পারে । কিন্তু অনামিকা জেনে গেছে মেয়েদের নিয়েতো গল্প হয়না – গল্প হয় তার শরীর তার রূপ তার ভোগ্য সামগ্রী হয়ে ওঠার কাহিনি নিয়ে । অনামিকার বয়স এখন প্রায় প্রোঢত্ব ছুঁই ছুঁই । দুই সন্তানের জননী, স্বামী ভালো কাজ করেন, মোটামুট সচ্ছল সংসার । তবু নিজেকে ফিরে দেখতে ইচ্ছে হয় অনামিকার । আর তখনই সূবর্ণলতার কথা মনে পড়ে যায় অনামিকার –আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস সুবর্ণলতার কথা । ভাবে, সুবর্ণলতা কি তার চেয়েও বেশি অসহায় ছিল ? রবীন্দ্রনাথকে কেন আকুতি জানাতে হয়েছিল ‘একটা মেয়ের গল্প লেখ শরৎবাবু’ বলে ? এসব কথাই মনে আসে অনামিকার ।

কত সাত সকালে বিয়ে দিয়ে দিলেন তাঁর অতি শিক্ষিত বাবা। যিনি সারাজীবন বিদ্যাসাগরের আদর্শ নিয়ে দিন কাটালেন ,ব্যাস্ত থাকলেন নিজের জীবন আর বিদ্যাসাগর নিয়ে। খালি একটা চিন্তা তাকে ঘিরে রাখত কোথায় লেখা বার হল, কটা বই বার হল। সংসারের প্রতি তাঁর খেয়াল থাকতোনা । না স্ত্রীকে বোঝার চেষ্টা করেছেন না মেয়েদের বড়ো মেয়ের ভাগ্যগুণে এক শিক্ষিত পরিবারে বিয়ে হয়েছিল ছোট-অনামিকার বিয়ে হল এক সংষ্কার আচ্ছন্ন ব্যবসায়িক পরিবারে । বিশাল পরিবার, অফুরন্ত অর্থ , কিন্তু সেটুকুই আর কিছু ছিলনা ছোট পরিবারের মেয়ে অনামিকা হারিয়ে ফেলেছিল তার অস্তিত্ব । সে যে ভালো ছাত্রী ছিল , ভালো গান গাইতে পারত, ভালো লিখতে পারত সব ,সব মূল্যহীন হয়ে গেল; যেন সে নিজেই ভুলে গেল এসব কথা শ্বসুরের প্রবল প্রতাপে মেয়েদের শিক্ষা দীক্ষার কোন মূল্য থাকলোনা । দাসীর মতোন সবার ফরমাস খাটত তার স্বামী অজয়কেও  পাসে পায়নি অনামিকা । পিতৃবাক্য ছিল তার কাছে বেদবাক্য।

যথা নিয়মে দুই কণ্যা সন্তানের মা হল অনামিকাএইখানে সে যেন নিজেকে আবিষ্কার করল, কি ছিল আর কি হয়েছে। সংসারের প্রবল চাপে স্বামীর সাথে একটা দূরত্ব এসে গেল তারযখন মুখ ফেরাবার অবকাস হল তখন দেখল স্বামীর জীবন তার প্রয়োজন শুধু সংসারের রান্না এবং তার পরিবারের লোকজনদের সামলাবার জন্য এক উচ্চমানের আয়া ছাড়া আর কিছু নয় সে একদিন ঝগড়ার সময় বলেই ফেলল তুমি রান্না বান্না সংসার সামলানো এসব ভালো পার আর তোমার দ্বারা কিছু হবেনা। তার জীবনে তখন নতুন বন্ধু অতি আধুনিকা কবিতা, যারসাথে দিনের বেশীর সময় কাটত।

বন্ধুবান্ধবের ফোন আসতে লাগল অনামিকার কাছে অজয়কে দেখলাম কবিতার সাথে গাড়ী করে যাচ্ছে, অমুক ক্লাবে আড্ডা দিচ্ছে ইত্যাদি । অজয় তা লুকানোর বিশেষ চেষ্টাও করছেনা এমন কি অনামিকা এবং মেয়েদের সামনে দিয়েই কবিতাকে নিয়ে সেজেগুজে বেরিয়ে যেত। অপমানে অসন্মানে অনামিকা অসুস্থ হয়ে পড়ল তাতেও অজয়ের কনো পরিবর্তন এলোনা

আস্তে আস্তে অনামিকা মাথা তুলে দাঁড়াল, তার দুই মেয়ে সুশিক্ষিত হয়ে চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেল , মায়ের পাশে দাঁড়াল সব শক্তি দিয়ে। মায়ের জীবনের দুঃখ তাদের অন্তরকে স্পর্শ করেছিল। অনামিকা নিজেকে মেলে ধরল। নিজের শিল্পসৃষ্টি দিয়ে গড়ে তুলল বুটিক , খুব অল্প সময়ের মধ্যে বুটিকটি দাঁড়িয়ে গেল। স্ব নির্ভর হল স্বামীর গণ্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল। তার সুন্দর চেহারা শিক্ষা রুচি ব্যাক্তিত্ব দিয়ে অনেকের কাছে সন্মানিত হল । বরাবর তার পাশে ছিল তার মায়ের মতন বড়ো দিদি আর তার দুই সন্তান।

এদিকে মনযোগের অভাবে অজয়ের ব্যাবসার অবস্থা অনেক খারাপ হল । কবিতাও তার বড়োলোক স্বামীর অর্থের দম্ভে অজয়ের থেকে দূরে সরে গেল। সেদিন অজয় স্ত্রী মেয়েদের কাছে পেতে চাইল , কিন্তু তারা তখন মানসিক ভাবে অনেক দূরে চলে গেছে। আজও অনামিকা থাকে স্বামীর সাথেই , কিছুটা সন্তান্দের স্বার্থে , তাদের সুস্থ জীবন থেকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছা হয়নি, কিন্তু দুজনের দুটি ভিন্ন ভিন্ন জগত। দু প্রান্তে থাকে । খাবার সময় স্বামীকে ডাকে খেতে দেওয়া হয়েছে’, বা অজয়ের খিদে পেলে স্ত্রীর কাছে এসে বলে খেতে দেবে নাকি?’এইভাবেই বয়ে চলেছে সংসার সমুদ্রে অনামিকার হালভাঙা নৌকা দুই মেয়ে শুধু এই ভাঙা নৌকার সফল যাত্রী।

      পত্রমিতালি
          
দে বা শি স দে

কেউ কেউ বলে অনিরুদ্ধ পাড়ার সেরা ছেলে । লেখাপড়ায় খুব ভালো । কিন্তু কেন কে জানে, ও নিজেও হয়তো জানেনা কারণটা , ওর কোন ভালো বন্ধু ছিলনা । বাবা মা ওকে খেলা ধুলো তেমন করতে দিতেননা । অনিরুদ্ধও তার পড়াশোনা নিয়ে থাকতো, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খুব একতা মিশতোনা । ছেলেবেলাটা কাটিয়ে এসেছে অনিরুদ্ধ, এখন গ্রাজুয়েশনও হয়ে গেলো । অনিরুদ্ধ কবিতা লেখেনা, গল্প-কবিতার বইও পড়েনা , সিনেমা দেখাতেও তেমন উৎসাহ নেই । এহেন অনিমেষের বন্ধু না থাকাটাই স্বাভাবিক ।

ইদানিং অনিরুদ্ধর নিজেকে খুব  নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে । অনিরুদ্ধ জানে আর দুএকবছরের মধ্যে মা বাবা তাদের পছন্দমত কোন মেয়ের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করবেন । কলেজ ছুটি হতো, অনিরুদ্ধ দেখতো ওর পরিচিত ছেলে মেয়েরা কেমন কলকল মুখরিত করে রাস্তা দিয়ে যায়, বাড়ি ফেরে , কত কথা বলে। তারওতো অনেক কথা আছে , কিন্তু বলবে কাকে ? তেমন বন্ধু যে নেই অনিমেষের ।  অনিরুদ্ধ নিজেকেই অবাক করে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির পর কফি হাউসে ধুকে গেল একাএকা । দেখলো এককাপ চা নিয়ে  ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে চলেছে তারা । একদিন ‘নন্দন’ চত্তরেও একাএকা চলে গেলো । অনিরুদ্ধ ভাবে এরা এতো কথা বলছে , তারও তো অনেক কথা আছে সেগুলো বলবে কাকে । একটা সময়ের পর মা বাবাকে তো সব কথা বলা যায়না । কিন্তু আগ বাড়িয়ে কোন মেয়েতো দুরের কথা কোন সমবয়সী ছেলের সঙ্গেও  আলাপ করবে এরকম মনের জোরও অনিরুদ্ধর নেই ।

এই সব ভাবতে ভাবতে অনিরুদ্ধ ভাবলো চিঠিতে বন্ধুত্ব করলে কেমন হয় ? ধীরে ধীরে আলাপ হবে ,মনের অনেক কথা বলতে পারবে । আজইতো রবিবার । অনিরুদ্ধ আনন্দবাজার পত্রিকায় চোখ রাখলো পত্রমিতালি কলমে । একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকালো ।
স্মার্ট, উচ্চশিখিত ব্যবসায়ী, সাক্ষাতেচ্ছু উদারমনা বন্ধু / বান্ধবীরা ফোন করুন । 

নিরুদ্ধ তাড়াতাড়ি বাঁ হাতের চেটোয় ফোন নাম্বারটা টুকে নিল ক ঝটকায় সিড়িগুলো  কোন রকমে টপকে খোলা ছাদে, খোলা মনে, মোবাইলে ডায়াল করে ভয় কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করলো  ‘হ্যালো,আজ আনন্দবাজার পত্রিকায় আপনার বিজ্ঞাপন দেখলাম ‘আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই’ ।

ওপার থেকে ভেসে এলো – কিন্তু আমি তো ওটা ফিমেলদের জন্য দিয়েছি, বিজ্ঞাপনটা দেবার সময় ওরা বলল ‘বন্ধু’ না লিখলে এই কলমে দেওয়া যাবে না তাই...... আসলে আমি নিজে দেখে যাচাই করে বিয়ে করতে চাই ।