স্বার্থপর
রাতে ঘুমের ঘাটতি
ঘটাতাম তাই দুপুরে দুঘন্টা ভাতঘুমের একটা অভ্যেস ছিল আমার ।
তারপর একঘন্টা শরীরচর্চার বরাদ্দ ছিল বাঁধা। বাড়ীর কেউও ঐ সময়টা কাছে ঘেঁষার
চেষ্টা করেনি কখনও ।
মাধ্যমিকের টেষ্ট মনের মত হওয়ায় খুশীমনে সেদিন সকাল থেকে শুধু আকাশবানীর নানা অনুষ্ঠানেই সময় কাটিয়েছি-সারা পাড়ায় তখন শুধু হেডস্যার এর - মানে তপতীদের বাড়ীতেই দূরদর্শনের অবাক বাক্সটা ছিল । প্রাইমারী থেকেই তপতী আমার ক্লাসমেট । কিন্তু খেলা আর পড়াশুনা ছাড়া অন্য কোন অনুষ্ঠান দেখাশোনার ছাড়পত্র তপতীও পেতো না কখনও । আমি কিন্তু পড়ার সময়েও রেডিওতে গান,নাটক কোন অনুষ্ঠানই ছাড়তাম না-সব বন্ধুদের মত তপতীও হিংসেই করত। কারণ এরপরও আমাকে ডিঙিয়ে কেউ ফার্স্ট হতে পারত না। ঘুম চোখ ধুয়ে ফেরার সময় দেখি তপতী বোনের সাথে কথা বলছে। আমার ঘরটা আমার জগত- বোনেদেরও ঢুকতে দিই না খুব একটা । হঠাৎ তপতীকে ঢুকতে দেখে তাই অবাক হতে যাচ্ছি তখনই ওর চোখের জলে থমকে গেলাম। ---- ‘এখনই একবার দিঘীর পাড়ে আয়’
মাধ্যমিকের টেষ্ট মনের মত হওয়ায় খুশীমনে সেদিন সকাল থেকে শুধু আকাশবানীর নানা অনুষ্ঠানেই সময় কাটিয়েছি-সারা পাড়ায় তখন শুধু হেডস্যার এর - মানে তপতীদের বাড়ীতেই দূরদর্শনের অবাক বাক্সটা ছিল । প্রাইমারী থেকেই তপতী আমার ক্লাসমেট । কিন্তু খেলা আর পড়াশুনা ছাড়া অন্য কোন অনুষ্ঠান দেখাশোনার ছাড়পত্র তপতীও পেতো না কখনও । আমি কিন্তু পড়ার সময়েও রেডিওতে গান,নাটক কোন অনুষ্ঠানই ছাড়তাম না-সব বন্ধুদের মত তপতীও হিংসেই করত। কারণ এরপরও আমাকে ডিঙিয়ে কেউ ফার্স্ট হতে পারত না। ঘুম চোখ ধুয়ে ফেরার সময় দেখি তপতী বোনের সাথে কথা বলছে। আমার ঘরটা আমার জগত- বোনেদেরও ঢুকতে দিই না খুব একটা । হঠাৎ তপতীকে ঢুকতে দেখে তাই অবাক হতে যাচ্ছি তখনই ওর চোখের জলে থমকে গেলাম। ---- ‘এখনই একবার দিঘীর পাড়ে আয়’
কোন প্রশ্নের সুযোগ না
দিয়েই ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল। কিছু বোঝার অবকাশ ছিলনা,অগত্যা পিছু ধাওয়া করতে
হল। দিঘীর পাড়ে একটা বুড়ো বট আছে –ঠাকুর্দাও ওটার বয়স
জানতো না। বাগাল ছেলেরা গরু চড়াতে এসে দুপুর তক ওর ছায়া দখল করে-গরুগুলো দিঘীর
পাড়ে ঘাস খায় । সন্ধ্যে পর্যন্ত কাকীমা-বৌদি আর পাড়ার সব মহিলাদের
পেট ও মগজ সাফাইয়ের ঠাঁই এ জায়গাটা আমি সজত্নে এড়িয়ে চলি। এখনও বোধহয় সময় হয়নি
ওদের আসার তাই জায়গাটা শুনশান। মেয়েটা মরতে এখানেই জায়গা পেল ভেবে মগজ আমার ঝাঁঝাঁ
করছে-নেহাৎ চোখভরা জল আমাকে আসতে বাধ্য করলা। এসে ওকে না দেখে আরও রাগ বাড়ল আমার।
পালানোর জন্য পিছন ফিরতেই পিছন থেকে কে যেন দুহাতে জড়িয়ে ধরল। ফোঁসফোঁসানি শুনে
ঝুঁটি ধরে সামনে টানতেই ওই সাপ আমাকে আরও কঠিন বাঁধনে বাঁধল।
----আমি মরে যাব তোকে ছাড়া । তুই আমাকে বাঁচাবি, কথা দে। নাহলে ছাড়বো না – এই দিঘির জলে এখনই ডুবে মরব তোকে নিয়ে ।
----আমি মরে যাব তোকে ছাড়া । তুই আমাকে বাঁচাবি, কথা দে। নাহলে ছাড়বো না – এই দিঘির জলে এখনই ডুবে মরব তোকে নিয়ে ।
----আরে বাবা, বলবি তো কি হয়েছে।
নাহলে আমি কি করব। তাড়াতাড়ি বল। এখনই সব গেজেটের দল এসে হাজির হবে, আমি পালাব কিন্তু।
----কাল আমাকে দেখতে আসছে।
ছবিতে পছন্দ করে রেখেছে। বৌদির মাসীর ছেলে-ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার। দেখলেই গিলে
খাবে-ছোটবেলা আমি দেখেছি হিরোকে। আমি তোকে ছাড়া বাঁচব না। কথা দে তুই আমাকে নিয়ে
পালাবি কিনা।
----আচ্ছা মুশকিল ! পছন্দ হলে এমন পাত্র কেউ হাতছাড়া করে । হিরোর উপযুক্ত হিরোইন
হবি ।
তোর এই পিঙ্গল আঁখি,শুভ্র ত্বক-হিরোইন হয়েই
তো জন্মছিস ।
আমাকে জ্বালাসনে,যা লক্ষ্মী মেয়ের মত বাড়ি
গিয়ে কাকিমার বেনারসী ট্রায়াল করগে । নাহলে আমি গিয়ে সব বলছি
স্যারকে-আমি বিশ্বাসঘাতক হতে পারবো না । জানিসতো আমাকে সবাই কত
বিশ্বাস করে ।
----অহংকারে কোনদিন চোখতুলে
তো আমাকে দেখলিনা । আমার কটা চোখ নিয়ে আবার ঠাট্টা করছিস,সব বলার কি ভয় আমাকে
দেখাচ্ছিস- নিজেই বইখেকো ভীতুর ডিম একটা । আমার এই অপমানের শাস্তি
থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না দেখিস । তোকেও কাঁদতে হবেই – আমি জানি তুই আমাকে
ছেড়ে আর কাউকে ভালবাসতেই পারবি না। মনের কথা বলার সাহসই নেই তোর মত ভিতুর ডিমের ।
সারাজীবন বই নিয়েই থাকবি, বউ জুটবে না দেখে নিস।
আরেক দফা গর্জন ও বর্ষণ
এবং আমার বুকের মাঝে ওর নিজেকে লুকোনোর নিষ্ফল চেষ্টাকে বাধা দিতে পারিনি সেদিন ।
ওর কান্নার কাঁপুনিটা অজান্তে কখন আমার সিস্টোল-ডায়াস্টোলে মিশিয়ে দিয়েছে
মেয়েটা তা টের পেতে সত্যি কদিন দেরী হয়েই গেল। হেডস্যার ভাল ছাত্রটিকেই পাত্রের
রিসেপশনের জন্য বাসস্ট্যান্ডে রেখেছিলেন। পছন্দ সেরে যাওয়া পর্যন্ত সারাক্ষণ তপতির
মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার-ওকে অদ্ভুত কাঠিন্য দিয়ে নিজেকে বাঁধতে দেখে ভিতরে কেঁপে
উঠেছি,জানুয়ারির বিকেলেও ঘেমেছি গেঞ্জী ভিজিয়ে। খেতে পারিনি -সুখাদ্যের থালা ককুরে
খেয়েছে আমি অভূক্ত থেকেছি মনখারাপকে পেটখারাপ প্রমাণিত করে। ও পারেনি খেতে-কাকিমা
আন্দাজে চেপে ধরেছেন পাত্রকে বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে আসতেই,জরুরী কাজের অজুহাতে
পালিয়েছি। ওর মুখের দিকে আজ সত্যি সত্যি এই প্রথম
দেখলাম - ফর্সা মুখটা যেন রক্তহীন মনে হল।
রাতে সত্যি জ্বর এল ।
ব্যথায় ছটফট করেছি। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি বিছানায় নিমপাতা - ডালসুদ্ধ। মা এসে
কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল--– এখনও জ্বর আছ,বেরোবি না,তোর পক্স হয়েছে।
সারাদিন সমাজসেবা করে এসব যে বাধালি - সামনে পরীক্ষা বুঝে নিয়ম মেনে তেরটা দিন
কাটালে নিম হলুদ দেব,তারপর বাইরে যাস।
তেরাত্রি এখন বইও ছুঁবি না,বুঝলি। মা বেরোতেই বোন এসে
জানাল একটু আগেই কলকাতা থেকে ফোনে তপতীর বিয়ের তারিখ পাকা হয়েছে পরের রবিবার ।
আমি একবার তপতীকে ডাকার কথা বলতে গিয়েও পারলাম না
–যদি আবার ছোঁয়াচে রোগটা
ওর বিপদ ঘটায় ! একটু পরে শুনতে পেলাম যে নিম হলুদের পরদিন মা তপতীকে আইবুড়ো ভাতে
ডেকেছে, আর সময় কৈ তাই – মনটা ভাল হয়ে গেল
শুনেই। ও এসে ভাত খেয়ে গেল কিন্তু মা নাকি আমার ঘরে আসতে দেয়নি পরের মেয়ের
দায়িত্বের কথা মনে রেখে। বাইরের জানালা থেকে একটা কঠোর চাউনি ছুড়ে দিয়ে পালাল কোন
কথা না ব’লে। বিকলে ওর মা এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে তাকাল একচোখ জিঞ্জাসা নিয়ে-আমার
দুচোখের জলে কিছু বুঝল হয়তো--- আমি কিছু করতে পারলাম নারে তোদের জন্য। মাষ্টারটাও
সব জেনেও এমন করবে ভাবিনি রে। মাষ্টারটারও তোকে পছন্দ করে কিন্তু আরও পাঁচটা বছর
এই আগুনে মেয়েকে ঘরে রাখতে রাজী নয় তাই জানাশোনা পাত্রটা হাতছাড়া করতে চাইছে নারে, নহলে তোর মাও তো অরাজী
নয় রে! মেয়েটাও গুমরে মরছে – আমার হয়েছে যত জ্বালা।
রোগটা না বাধালে.... এখন পালাতেও তো পারবি না। মুখপোড়া বিধাতাটা যে কি চায় । বিড়িবিড় করতে করতে
পালিয়ে বোধহয় চোখের জল আড়াল করল ককিমা। এরা আমাদের নিয়ে এত ভাবে – টেরটিও পাইনি শুধু আমিই
। কি নির্বোধ আমি !
আমার এই বন্দীত্বের ন’দিনের
মাথায় ওর গায়ে হলুদ নিয়ে পুকুরঘাটে যাওয়ার সময় বাইরের জানালায় মুহূর্তের স্যিলুট
দর্শন দিয়ে যাওয়ার সময় একটা শব্দ শুধু হাওয়ায় ছুড়ে দিল – স্বার্থপর ।
মগডাল বাহাদুর
হাতের লাঠিটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে হুংকার ছুড়লো মা, ‘নেমে আয় বলছি রাজু, তোর হাড়-হুড্ডি কিন্তু গুঁড়ো করে ছাড়বো !’ গাছের মগডালে চড়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে রাজু। পা নাড়াতে নাড়াতে রাজু এমন ভাব করে
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো যে,
এসব হুংকাফুংকারে তার কোনো কেয়ার নেই!
মা এবার লাঠিটা উঁচিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে
বললো, ‘কি হলো, কথা কানে যায় না তোর? নেমে আয় বলছি। তোর পিঠের চামড়া কিন্তু ছিলে ফেলবো!’
পা নাড়াতে নাড়াতে রাজু
একবার মাকে ভেঙচি কাটলো। তারপর মনে মনে বললো, ‘আসো, উঠে আসো, দেখি কেমন পারো! পিটবা তো উঠে আসো, উপরে উঠে এসে পিটো, যতো খুশি পিটো!’ কিন্তু মুখে কিছু বললো না । আরেকবার ভেঙচি কেটে পা নাড়াতে নাড়াতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো ।
মা এখন ক্ষেপে আছে খুব । ক্ষেপে থাকে না কখন!
সারাক্ষণই তো ক্ষেপে থাকে। থাকে! না কী রাখে! দুটোই, মা যেমন ক্ষেপে থাকে, রাজুও তেমন ক্ষেপিয়ে রাখে। ক্ষেপিয়ে দিয়েই মগডালে চড়ে বসে।
মায়ের লম্বা লাঠি থেকে বাঁচতে এ মগডালই
রাজুর বড় আশ্রয়। বাড়ি থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরের বিশাল এই শিমুল গাছের মগডালটা রাজুর
ছোটখাটো একটা সংসার। মা ক্ষেপে গিয়ে লম্বা লাঠিটা নিয়ে তাড়া করলেই রাজু এই মগডালে
চড়ে বসে ।
নিচে দাঁড়িয়ে মা লাঠি
উঁচিয়ে হুংকার ছোড়ে, কিন্তু নিজে চড়তে পারে না,
রাজুর তাই নাগালও পায় না। মা শান্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজুকে এই
মগডালেই চড়ে থাকতে হয় । মায়ের রাগ পড়ে শান্ত হতে কখনো আধা ঘণ্টা, কখনো দুই ঘণ্টা, কখনো সারাদিনই কেটে যায়! এই পুরো সময়টা যে মা লাঠি হাতে নিচে দাঁড়িয়ে থাকে, তা নয়। বাসা থেকে তীক্ষ্ণ চোখে গাছের দিকে নজর রাখে। রাজু নামতে গেলেই লাঠি
হাতে তেড়ে আসে। রাজুকে তাই মায়ের রাগ পড়ে শান্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়। এই
সময়টা তো আর ডালে বসে শুধু পা নাড়িয়ে কাটানো সম্ভব না। এক-দুইদিন না হয় কাটানো
গেলো, কিন্তু বিষয়টা যখন নিত্য-নৈমিত্তিক তখন সেটা অসম্ভব। আর তাই দিনে দিনে রাজু
তার খেলনাপাতিগুলো এই মগডালে জড়ো করে সংসার পেতে নিয়েছে । আশেপাশের ডালগুলোতেও তা
বিস্তৃত হয়েছে। মায়ের রাগ পড়ার অপেক্ষায় তাকে মুখ ভার করে তাই শুধু পা নাড়াতে হয়
না। খেলনাপাতিগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে পুরোটা দিনও পার করে দেয়া যায়। মা গাছের নিচ
থেকে সরে গেলেও আজকাল আর রাজু নামার চিন্তা করে না। খাওয়া-দাওয়ার প্রতি তার
এমনিতেই অনাগ্রহ, সেটা নিয়েও তাই ভাবনা নেই। মগডালেই তার সুন্দর সময় কেটে যায়। নিচ দিয়ে হেঁটে
যাওয়া লোকগুলো তাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসে, কেউ কেউ বান্দর বলে টিটকারি মারে, তাতে রাজুর পাত্তা দেয়ার সময় হয় না।
মগডালে রাজুর সংসারের
মূল অংশটা টেলিভিশন রাখার বাক্সগুলোর মতো বড় একটা বাক্সে। আরো তিনটা ছোট ছোট বাক্স
আছে আশেপাশের তিন ডালে। বাক্সগুলো দড়ি দিয়ে বাঁধা যাতে বাতাসে বা ঝাঁকিতে পড়ে না
যায়। এ বাক্সগুলোতেই তার খেলনাপাতিগুলো রাখা। যখন যেটা নিয়ে খেলতে মন চায় সেটা বের
করে নেয় বাক্স থেকে। কখনো এ ডালে বসে খেলে, কখনো খেলে ও ডালে বসে। এ ডাল থেকে ও
ডালে যাওয়ার সময় তাকে অবিকল বান্দরের মতোই লাগে! বড় বাক্সটা যে ডালে, রাজুর সংসারের মূল অংশ যেটা তার ওপরের দিকে মোটা পলিথিন ছাউনির মতো করে
বাঁধা। সব মিলিয়ে সাজানো গোছানো খুব সুন্দর সংসার রাজুর। কিন্তু, রাজুর এই সাজানো সংসার মাঝে মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় । না, মাকে কিছু করতে হয় না। মা আর কী-ই বা করবে! সে তো গাছে চড়তে পারে না!
কোনোভাবে রাজুর কোনো খেলনা যদি নিচে পড়ে যায়, গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া
ছেলে-ছোকড়া-লোকজন কেউ তা ছোঁয় না, সেভাবেই পড়ে থাকে। এমনকি গাছে চড়ে
খেলনাপাতিগুলো নিজের সম্পত্তি বানানোর চেষ্টাও কেউ কখনো করে না। রাজুর সংসারে
ভিলেন হয়ে দাঁড়ায় ঝড়-বৃষ্টি। পুরো বর্ষাটাই রাজুকে তার সংসার গুটিয়ে রাখতে হয় । আর বৈশাখী ঝড় প্রায়ই
লণ্ডভণ্ড করে রেখে যায় তার সংসার। দিনের বেলা ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস পেলে রাজু
অবশ্য আগাম সব গুটিয়ে ফেলে, কিন্তু মধ্যরাতে উশখুশ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। অনেকগুলো বাক্স এবং
খেলনা তার এ কারণে নষ্ট হয়েছে।
মা লাঠিটা উঁচিয়ে রেখে নাড়াতে নাড়াতে
এবার মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, ‘কি, নামবি না? মগডালে চড়ে বাহাদুরি দেখাস! সাহস থাকে তো একবার খালি নেমে আয়, দেখি কেমন তুই বাহাদুর!’
রাজু বাহাদুরি দেখানোর বোকামি করলো না । কোনো জবাবও দিলো না।
মাকে আবারো ভেঙচি কেটে মগডালে বসে পা নাড়াতে থাকলো ।
রাজু তার খেলনাপাতিগুলো
মগডালে জড়ো করে সংসার পাতলেও সারাক্ষণ মগডালে বসে খেলা করে না। অন্য সময় বন্ধুদের
সঙ্গে ক্রিকেট-ফুটবল-গোল্লাছুট-কানামাছি খেলে। কেবল মা লাঠি নিয়ে তাড়িয়ে বেড়ালেই
সে এই মগডালে আশ্রয় নেয়। মায়ের তাড়িয়ে বেড়ানোর পেছনে সব সময়ই একটা ঘটনা থাকে। আজকের
ঘটনাটা দুপুরের খানিক আগের। রাজুর স্কুল আজ ছুটি ছিল। এই একটা দিন ছুটিতেই বন্ধুরা
সব গায়েব। আশেপাশে যাদের মামা-খালা-চাচার বাড়ি, তারা সেখানে বেড়াতে গেছে। কেউ বাড়ির বড়
কারো সঙ্গে শিশুপার্ক না হয় চিড়িয়াখানায় গেছে । একজন তো বাবার সঙ্গে
অফিসেই গেছে ! আশেপাশে রাজুর কোনো মামা-খালা-চাচার বাসা নেই। বাড়িতে মা ছাড়া বড়
কেউ নেই যে শিশুপার্ক বা চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবে। মাকে সঙ্গে করে যাওয়া যাবে না, রান্না করবে তবে কে? আর বাবার সঙ্গে অফিস যাওয়া?
সে কল্পনার বাহির! বাড়ির উঠোনে ফুটবল নিয়ে রাজু অগত্যা তাই
খেলছিল একা একা। একপাশের দেয়ালে সপাটে শট করছিল বলটাকে। মা অনেকক্ষণ থেকে বলছিল
বাইরে গিয়ে খেলতে। কিন্তু একা একা ফুটবল নিয়ে খেলতে দেখলে লোকজন হাসতে পারে, এই ভয়ে রাজু রাইরে যেতে চাইছিলো না। শটগুলো সব সোজা দেয়ালে করছিল রাজু। বল
দেয়ালে লেগে সোজা ফিরে আসছিলো রাজুর পায়ে। ভালো জমেছিল খেলাটা। হঠাৎ একবার আচমকা
একটা শটে বল গিয়ে লাগলো দেয়ালের কাণায়। তারপর সোজা রান্নাঘরে ঢুকে চুলোয় থাকা
কড়াইকে ডিগবাজি খাইয়ে দিলো। হাঁড়ি-পাতিল, পেঁয়াজ-মরিচের ঝাঁকা, চাল-ডালের বাসন সব কিছুকে টর্নেডোর মতো মুহূর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে
বেরিয়ে আসলো বলটা । আর রাজু এক দৌড়ে মগডালে !
তখন থেকেই রাজু মগডালে। দুপুর থেকে এর
মাঝে মা কয়েকবার লাঠি হাতে নিচে এসে দাঁড়িয়ে হুংকার ছুড়েছে, রাজু কানে তোলে নি। এখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। সূর্য পুরোপুরি ডুবে গেছে। আকাশের
পশ্চিম কোণে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মাগরিবের আজান এই দিলো বলে। দুপুরে রাজুর আজ
খাওয়া হয় নি। ক্ষিদেও অবশ্য পায় নি। মা-ও খায় নি দুপুরে। খুব সম্ভবত তার ক্ষিদে
পেয়েছে । ক্ষিদের জ্বালাতেই বোধহয় মা লাঠিটা নামিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায়
বললো, ‘রাত হয়ে যাচ্ছে রাজু, নেমে আয় এক্ষুনি।’
রাজু শর্ত জুড়ে দিলো, ‘তাহলে বলো মারবে না।’
‘মারবো না মানে! একবার খালি নেমে আয়, তারপর দেখ তোকে কী করি !’ আবার মায়ের হুংকার ।
‘তাহলে আর নামছি না। সারারাত গাছে থেকে যাবো। এ ডালেই ঘুমোবো। ঘুমের ঘোরে যখন
ধুপ করে পড়ে টুপ করে মরে যাবো তখন বুঝো মজা!’
রাজু ঠোঁট উল্টিয়ে
ভেঙচি কেটে কথাটা বলতেই মা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে ফেললো, কান্না জড়ানো কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘আর একটা কথাও বলবি না রাজু। সোজা নেমে
আয় বলছি এক্ষুনি।’ রাজু এবার সুড়সুড় করে নেমে এলো। মা কেঁদে ফেলেছে, মানে মামলা ডিসমিস। মায়ের থেকে যথেষ্ট দূরত্বে লাফ দিয়েই দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে
গেলো রাজু।
মগডালে যেখানে যা ছিলো, সেভাবেই থাকলো । কখন আবার চড়ে বসতে হয় কে জানে।