অনুতাপ
মৌ দা শ গু প্তা
অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসার বেণুগোপালবাবুর বাড়ীর অদূরে ট্যাক্সিষ্ট্যান্ডটাতেই বুড়ী
ভিখারিনীটার বাস। যেতে আসতেই চোখে পড়ে,আর চোখাচোখি হলেই হাতের দোমড়ানো নোংরা
টিনটা বাড়িয়ে তোবড়ানো ফোকলা মুখে বুড়ীটা বিকৃত উচ্চারণে একটা কথাই বলে, _ “এট্টা ট্যাহা দে না বাবু, মুড়িটুক খাই” । শহর কলকাতার বুকে এই রকম অভিজাত
পাড়াতেও ভিখারি ? বেণুগোপালবাবু
বড় অস্বস্তি বোধ
করেন। শেষমেষ একদিন বিরক্তি চাপতে না পেরে আবাসনের সেক্রেটারী শ্রীনিবাসনকে বলেই ফেললেন, “আরে মশাই, ওই ভিখারীটাকে তাড়ান তো ! আর সহ্য হয়না”
। শ্রীনিবাসন আমতা আমতা করে জবাব দিল, - “না মানে, এত বয়স্ক, ওর তো ভালো করে হাঁটাচলার ক্ষমতাই নেই, থাকুক না,কারো কোন ক্ষতি তো আর করছে না।“ - “মানে ? ক্ষতি করছে না মানে ? তার মানে আপনি ওকে তাড়াবেন না, তাই তো ? ঠিক আছে আমিও দেখছি।“ রগের চোটে আর কথার পিঠে কথা খুঁজে পান
না বেণুগোপালবাবু। সটান মুখ ঘুরিয়ে অকুস্থল থেকে সম্মানজনক পশ্চাদপসরন
করেন,
মুখের গজগজানিটা অবশ্য
চলতেই থাকে।
সেদিনটা ছিল বাংলাবন্ধ। সকাল থেকেই অঝোরে
বৃষ্টি। প্যাচপেচে দিনটা সকাল থেকেই কেমন যেন মুখ ভার করে রয়েছে ।
এদিকে ঘরে বেণুগোপালবাবু স্ত্রী সুশীলার ধূম জ্বর ।প্রথমে সদাব্যস্ত
স্বামীকে কিছুই না জানিয়ে চুপচাপ ঘরের কাজ সেরে গেছেন, কাজই বা আর কি? মোটে তো দুটি লোক ঘরে। কিন্তু শেষ অবধি জ্বরটা আর চাপা থাকেনি, জ্বরের ঘোরে সুশীলা যখন বেহুঁশ, ঘড়িতে তখন মধ্যরাত।কাকেই বা আর তখন ডাকেন
বেণুগোপালবাবু? এদিকে মোবাইলে
পারিবারিক ডাক্তারবাবুকে
ধরা যাচ্ছেনা, যা দূর্যোগপূর্ণ
আবহাওয়া, টাওয়ার ই নেই মোবাইলে, ল্যান্ডলাইনটাও অচল।পাশের ঘরে তালা
দেওয়া, সপরিবারে কোথাও গেছেন ওনারা, ওপরের কি্বা নীচের তলার ফ্ল্যাট থকে
লোক ডাকবেন ? একে তো মধ্যরাত তায় যা আবহাওয়া, কেই বা আর শুনবে, কেই বা আর উঠবে ! বেণুগোপালবাবু
লোকটিও বিশেষ মিশুকে নন, লোক ডাকাডাকিতে
তাই বড় আপত্তি, তবে যতদূর সম্ভব
মনে হচ্ছে কাছের ওই ট্যাক্সিষ্ট্যান্ডটাতে বোধহয় রাতেও ট্যাক্সি পাওয়া যায়, কোনভাবে সুশীলাকে যদি কোন নার্সিংহোমে
নিয়ে
যাওয়া যায় তো
চিকিৎসাটা অন্তত সময়মত করানো যাবে । অত্যন্ত উদ্বগর সাথে সেদিকেই পা বাড়ান তিনি।অঝোর বৃষ্টি, মধ্যরাতের স্ট্রীটল্যাম্পের ঝাপসা আলোয় জলভরা রাস্তায় হাঁটতে
গিয়েহঠাৎ পা টা একটা গর্তে ঢুকে যায়, বেণুগোপালবাবুও সপাটে রাস্তায় আছড়ে পড়েন । ব্যাস আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতে দেখেন, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন,পাশে উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছেন সুশীলা । ওনাকে ক্লান্ত অসুস্থ লাগলেও ধাক্কাটা
যে সামলে গেছেন সেটা বোঝাই
যাচ্ছে। সুশীলার মুখ থেকেই শুনলেন যে, বৃষ্টিভেজা রাস্তায় বেণুগোপালবাবুকে উল্টে পড়ে যেতে দেখে ঐ বুড়ী ভিখারী ই সেদিন চেঁচামাচি করে আশেপাশের আধাঘুমন্ত
ট্যাক্সিওয়ালা, চায়ের দোকান
বন্ধ করে বেনচে ঘুমানো
দোকানের বয়, আবাসনের
পাহারাদার, সবাইকে জগিয়ে
তুলে ধরাধরি করিয়ে
কোনমতে ওনাকে ঘর অবধি নিয়ে আসে, ঘরের দরজা খোলাই ছিল, খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকে সুশীলাকে ওই
অবস্থায় দেখে মাথায় জলটল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে, এর মধ্যে ফ্ল্যাটবাড়ীর জনাকয়েক প্রতিবেশীকেও পাহারাদার ছেলেটি গিয়ে ডেকে আনে,তারাই ছোটাছুটি করে ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল সব ব্যাবস্থা করে ফেলে। অর্থাৎ
ওই বুড়ী ভিখারীই সেদিন কোনমতে অবস্থা সামলে দেয় । শুনতে শুনতে নিজের আগের
ব্যাবহারের কথা ভেবে লজ্জা পান বেণুগোপালবাবু, বুড়ীর ওর একটা মন কেমন করা সম্পর্কর
টান টের পান, মনে মনে তখনই ঠিক করে ফেলেন বাড়ী
গিয়েই বুড়ীটার জন্য কাজচালানো কোন বৃদ্ধাবাস জাতীয় স্থায়ী আস্তানার ব্যবস্থা করে দেবেন, ভাবতেই মনে মনেই যেন খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করার শান্তি
পান ।
দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে, মানসিক শান্তি না ওষুধের জন্য তা বলা
অবশ্য কঠিন ।
দিন তিনেক পরে ভাঙ্গা পা
নিয়ে হাই ব্লাড প্রেশার, কোলেষ্টরল আর ডায়াবেটিসের রুগী বেণুগোপালবাবু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ীফেরার পথে দেখেন, বুড়ীর বসার জায়গাটা খালি । সাথে ছিল দিল্লী থেকে জরুরী তলব পেয়ে ছুটে আসা মেজছেলে বসন্ত আর ওর
কলেজের বন্ধু, নীচের ফ্ল্যাটের মিষ্টার কাঞ্জিলালের ছোটছেলে মোহন । মোহনকেই প্রশ্ন করে জানতে পারলেন একদা দাপুটে সরকারী আমলা বেণুগোপালবাবুর
অনুরোধ ফেলতে না পেরে আবাসনের সেক্রেটারী বুড়ীকে পুলিশের সাহায্য
নিয়ে ওখান থেকে হটিয়ে দিয়েছে। দুচোখ জ্বালা করে জলে ভরে এলো । সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বিড়বিড়
করে বললেন, “আমায় মাপ করে
দিস মা, আমি তোকে চিনতে
পারি নি।“
বিষন্ন
সকাল
অনুপম
দাশ শর্মা
কোনদিন ভাবেনি সে পারবে। হঠাৎই লোভ হল। চ্যাটার্জি সাহেব ছুটিতে। চেম্বারে শুধু কাবেরীর অবারিত দ্বার। স্টেনোগ্রাফার। বলতে গেলে জোর করেই বান্ধবী রীনা ফেসবুকে আ্যকাউন্ট খুলে
দেয়। রীনা অন্য অফিসে পোস্টেড। ছোট্ট আ্যড্রেস ডায়েরীর শেষ পাতায় নোট, আই-ডি, পাসওয়ার্ড। খুলে গিয়েছিল অন্তর্জাল-এর রঙ্গীন জগত । অনিয়মিত ব্যবহারে এসেছে জনা পাঁচেক বন্ধু । কিছু শুভেচ্ছামাখা ছবি। ইচ্ছে হল নাড়াচাড়া করার সুযোগ
মেলায় । স্টেটাসে দেখা দিল ...."ছিলাম নিভৃতে
একাকী
সুপ্ত ইচ্ছা
পলকে শব্দের মৃদু ঝলকে হল আলোকের জোনাকি। "আশ্চর্য্য..! কম্পিউটারের
ঔজ্জল্য নিমেষে হেরে গেল কাবেরীর মুখ প্রভার তড়িৎ চমকে। পর
পর কমেন্টস্ ভরে দিল উচ্ছাসমাখা ভালোলাগার প্রকাশে, বন্ধু-অবন্ধুর সাবাশে। কাবেরী হাওয়ায় ভাসছে। নিলাদ্রী মিত্র লিখেদিল....
উল্লাস ভরে বলি তোমায়
হাজার মাইল যাব পেরিয়ে
দেখি, কাবেরীকে আজ কে থামায়।"
হাজার মাইল যাব পেরিয়ে
দেখি, কাবেরীকে আজ কে থামায়।"
কাবেরীর সামনে খুশীর পৃথিবী। অবিশ্বাসের নিশ্বাস স্বচ্ছতা পেল। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা । পেনশনের টাকা ওষুধ গিলে নেয় অনেকটাই। একমাত্র বোন স্নাতক উত্তীর্না, চাকুরী
প্রার্থী। সন্তানহীনতা আর অকাল বৈধব্য জীবনের রূপরস শুষে নিয়েছে কাবেরীর। অতএব, নিয়মিত বসা। এবার কবিতার ছত্র অল্প অল্প করে দীর্ঘাবয়ব। নীলাদ্রির মোবাইলে গেঁথে গেছে কাবেরীর ফোন নাম্বার। প্রতিদিন বন্ধুর আবেদনে সাড়া কাব্য চিন্তায় ভাগ বসায়।
দ্রুত পাঁচ থেকে পাঁচহাজার। রবিবারের সারাদিন এখন আর ব্যস্ততায় বন্দী থাকেনা। ঘরোয়া
কাজের ফাঁকে সঙ্গ দেয় ছোট্ট দূরভাষ। হঠাৎ জীবনপ্রবাহের এই মোচড় এতটা উচ্ছসিত
করল, বহু অযত্নে ঘুমান সুরেলা কন্ঠ আবার জেগে
ওঠে অসুখীর সংসারে। ইতিমধ্যে
ছোট্ট ছিমছাম ল্যাপটপ শোভা পেয়েছে কাবেরীর
বেডরুমে। প্রতিদিনের সন্ধ্যা নতুন স্বাদে বর্ণময় হয় কাবেরীর কাব্য সান্নিধ্যে। নীলাদ্রির সাথে ক্রমাগত চ্যাট কখন পার করে দেয় মধ্য রাতের
বর্ডার, টের পায়না। নীলাদ্রি অবিবাহিত, চাকুরে, বছর তিনেক বড়
কাবেরীর। নীলাদ্রি জেনেছে কাবেরীর হতাশা, বৈবাহিক জীবনের অপূর্নতা। বন্ধুত্বের গভীর গুপ্তাকাশে অযাচিতস্বান্তনা পেয়ে কাবেরী কৃতজ্ঞ
নীলাদ্রীর কাছে। এক
একটা রাত দু চোখেঅনিদ্রা লেপে দেয়। কাবেরীর মন সায়রে
উত্তাল খুশীর লহর। নতুন
জগত ,অন্তরঙ্গতার সুনির্দিষ্ট কোন ইঙ্গিত । নীলাদ্রি যখন ফোন করে আবেগঘন কথার তুফান তোলে, যখন কবিতার পংক্তি
ধরে ধরে ব্যখ্যার আড়ালে তীক্ষ্ন আবেদন জানায়.. এক ভবিষ্যতের আবছা রেখা স্পষ্টতর হয়েই চলে বোধের
গভীরে। কাবেরী অজান্তে কেঁপে কেঁপে ওঠে ।
অবশেষে কথা হল পাকা, মুখোমুখি হবার নীলাদ্রীর । কাবেরীকে অনেক বছর বাদে পারলারে দেখে
অবাক হল পাড়ার বন্ধু নয়না। পেশাদার চোখ বুঝে নেয়, নিঃশব্দ হাসি
স্বাগত জানায় । নীলাদ্রির সাথে প্রথম সাক্ষাত
স্বরণীয় রাখতে কাবেরী লিখে রাখল কিছু ছত্র । "ফাগের আকাশ ডাকছে তোমায় শুনতে তুমি চাও- হৃদয় জুড়ে তোমার আমি দেখতে কি গো পাও ?" রেখে দিল হাত ব্যগে। সংগোপনে, হৃদয়বৃত্তির
আঙ্গনভূমে ।
সময়ের একটু আগেই পৌঁচেছে কাবেরী । হালকা গোলাপি শাড়ি আর ময়ূরপঙ্ক্খী রঙের স্লিভলেস ব্লাউজে পিছিয়ে থাকা সময় হঠাৎই যেন হাজির
মহা সমাদরে। খানিকটা দৌড়ে রাস্তা পাড় হয়ে নীলাদ্রী সটান সামনে। সাদা হাফ শার্ট আর আকাশি জিনস্, নিখুঁত কামান
মসৃন গাল সুঠাম চেহারার ব্যক্তিত্বময়তা দেখে অভিভূত। নাস্তিক কাবেরী এই প্রথম পিছু ফেরে। ঈশ্বর
প্রণামে আনত হয়। সামনেই সুরক্ষিত রেষ্টুরেন্ট। পর্দাঘেরা ছোট্ট পরিসর। ওরা বসল। ওয়েটার কাজ সারল। কাবেরীর হঠাৎই গুটিয়ে গেল, মনে মনে আওড়ান
সংলাপ আটকে রইল গলায়। সহজ হবার আন্তরিক প্রয়াস টেনে নিল
নীলাদ্রির চোখে চোখ রেখে। নীলাদ্রি তাঁর ব্যগ থেকে বার করল এক গোছা
ছাপানো কবিতার পাতা। সবটাই কাবেরীর লেখা। -জানো, সুযোগ পেলেই
প্রত্যেকটা কবিতা আমি অন্তত একবার করে পড়ি রোজ ।
নীলাদ্রি মৃদু হাসে । চিলতে হাসি এল কাবেরীর ঠোঁটেও। -তাই! থ্যাঙ্কস্। -অসাধারন লেখ
তুমি। আলতো আঙ্গুল ছুঁলো। 'কাবেরী মনে হল সে যেন এই মুহূর্তে নির্জন
দ্বীপে সবুজের মাঝে। পরিজন নেই কেউ। হারিয়ে গেছে দগদগে নিষ্ঠুর স্মৃতি । খুব আস্তে আস্তে কাবেরী নিজের ব্যাগ থেকে বের করতে লাগল লেখা চার
লাইনের কবিতাটি। ঠিক
তখনি নীলাদ্রীর পকেটে বেজে উঠল মোবাইল। -হ্যাঁ হ্যাঁ..চলে আসো। আছি এখানেই। ফোন
রেখে কাবেরীর দিকে তাকাল। -একদিন তোমার বাড়ি যাব। আলাপ হবে। কাবেরীর আবার শুরু হল গুটানো ভেতর
ভেতর ।
'আচমকা হুড়মুড়
করে পর্দা সরিয়ে ভীড় করল তিনজন মহিলা। -
আরে, এই তো, আলাপ করে দিই..। কাবেরী একা বসে একদিকে । ওরা তিনজন নীলাদ্রিকে মাঝে রেখে একটা কবিতার বই নিয়ে মেতে গেল। ওয়েটার সাজিয়ে দিল টেবিল। - কাবেরী, নাও শুরু করো।
আমরাও। নীলাদ্রির উত্তাপহীনতা কাবেরীকে বিঁধলো।চারজন তুমুল তর্কে মেতে গেল কাব্য সমালোচনায়।কাবেরীর কেমন
যেন শীত অনুভব হল। দ্রুত উঠে দাঁড়াল। -
আমি উঠলাম। নীলাদ্রি তর্ক থামাল। - আর একটু বসো না। বেরবো একসাথেই। আমার তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার, কাজ আছে। ওক্কে। বাই। নীলাদ্রি
ফিরল, ফিরল তর্কও। কাবেরী হঠাৎ ভারি পা দুটো একটানে রাস্তায়। শরীরের কোথাও
যেন ঝড় বয়ে গেছে। আনমনা আঁচল গায়ে জড়িয়ে নিল। মনের কন্দরে বারংবার বিদ্যুতের চমকানি। মাথার ভেতর হাতুড়ির ঘুষি। কাবেরী ভাবল সে তাহলে এতটাই নির্বোধ? না কি... বুঝে নেবার কৌলিন্যই ছিল
ফাঁপা। নীলাদ্রির এতদিনকার আবেগ সবটাই তাঁর কাব্যপ্রিয়তা ? তাহলে
সমর্পনের ইঙ্গিত! তা কি শুধুই আদিখ্যেতা! তিল তিল লালিত বুভুক্ষু স্বপ্নকে এত
অনায়াসে হারিয়ে দিল কবিতার টান।কবিতা এতটা নির্মম হয়ে হাসছে আজ!
কোনমতে শরীর ঠেলে কাবেরী বাড়ি ফিরল। সোজা টয়লেট। কোন চেঞ্জ না করেই
শাওয়ার খুলে দিল। অঝোরে ভিজছে আজ কাবেরী। অকাল বর্ষা ধুয়ে মুছে দিচ্ছে
কয়েক মাসের জমা আবেগ। শরীর বেয়ে মুক্তি পাচ্ছে কয়েক ঘন্টার ক্লেদ কষ্ট,
ধর্ষিত স্বপ্ন। আচমকা খানখান করে ফেটে পড়ল শব্দ কাবেরীর গলা থেকে। চীৎকার কান্নায় চাপা
পড়ে যাচ্ছে কাবেরীর জলপ্রপাত ।
শাওয়ার খুলে দিল। অঝোরে ভিজছে আজ কাবেরী। অকাল বর্ষা ধুয়ে মুছে দিচ্ছে
কয়েক মাসের জমা আবেগ। শরীর বেয়ে মুক্তি পাচ্ছে কয়েক ঘন্টার ক্লেদ কষ্ট,
ধর্ষিত স্বপ্ন। আচমকা খানখান করে ফেটে পড়ল শব্দ কাবেরীর গলা থেকে। চীৎকার কান্নায় চাপা
পড়ে যাচ্ছে কাবেরীর জলপ্রপাত ।
বাড়ি ফেরার সময়
নীলম ত্রিবেদী
ক্যা বেটা গাড়ি নাহি মিল রাহা ? নাহি
ভাই সাব। থোরা লিফট মিল যাতা তো......?
কাঁহা জাওগে ?
জামুরিয়া তরফ যানা থা ?
চল বৈঠ যা, আখালপুর তক ছোড়
দেঙ্গে ।
থ্যাঙ্ক ইউ। ট্রেকারটার পেছনের দিকের একটা সীটে বসে মুখ তুলে তাকাতেই
দেখি ফিরোজ বসে আছে ।
চমকে জিজ্ঞেস করলামঃ আরে তু ? কাঁহা সে লৌট রাহা হ্যায় ?
চমকে জিজ্ঞেস করলামঃ আরে তু ? কাঁহা সে লৌট রাহা হ্যায় ?
আসানসোল গিয়েছিলাম । আপনা বোলো ; কলকাত্তা থেকে আসছিস
?
হুম । রাতের ট্রেনটায়
চাপলাম ।
এখানে
এসে দেখি কিছু নাই । ট্রেকারটা
তো তোর নাকি ?
থা , মানে
বেচে দিলাম আখলপুরের একজনকে ।
হটাৎ ?
তুই কি জানিস একটা রাতে কতকিছু ওলটপালট হয়ে যায় । তুই তো পুরা এক সাল
বাদ আসছিস ।
আমার
আব্বাকে তো তুই জানতিস, বেটা পাঁড় মাতাল । আমার
মাথাটা লজ্জায় ঝুকে গেল,কিন্তু ফিরোজ
নির্বিকার।সে সারাদিনের জমা ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়া চোখের পাতা দুটোকে ওপর দিকে
ঠেলে তোলার চেষ্টা করতে করতে বলে চলেঃ সারাদিন শালা জুয়া খেলে বেড়াতো আর বিকালের
দিকে গিয়ে বসতো বিনয়ের দোকানে । তুই তো জানিস ঐটা
নাম কে ওয়াস্তে হোটেল আসলে একটা দেশি মদের দোকান। বোতল বোতল মদ গিলে রাত করে ঘরে
ফিরে খালি চিল্লানি ।
বউ পেটান
।মেয়েদের
ধরে ধরে পেটান। একদিনের জন্য দেখি নি ট্রেকারে কতো ইনকাম হচ্ছে তার হিসাব নিকাশ
করতে । নৌ্সাদ
কুত্তা যে ১০০-১৫০ টাকা মায়ের হাতে দিয়ে যেতো তাতে তো ঢং সে দিন গুজরান তো হত না
উপর সে মারামারি- কাড়াকাড়ি । শারাব পিয়েগা ? অউর পি । জাহান্নুম
মে তো জী ভর কে পিতা হোগা না ......!
বলেই ট্রেকার টার মেঝেতে ডান পা টা ঠুকে মুখে একটা হাত চাপা দিয়েই ফিরোজ চুপ হয়ে যায় । বোধকরি ভালো করে দম নেওয়ার জন্যই ।
বলেই ট্রেকার টার মেঝেতে ডান পা টা ঠুকে মুখে একটা হাত চাপা দিয়েই ফিরোজ চুপ হয়ে যায় । বোধকরি ভালো করে দম নেওয়ার জন্যই ।
আমি চমকে উঠি । গাড়ি
টা ক্রমশ চেপে বসতে থাকে আমার চারপাশে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একজন আধ উচ্চারনে গেয়ে
চলেছে “থোরি সি তো পী লী হ্যাঁয়.........”,সুরটাও তেমন সুবিধের
নয়। অন্য সময় হলে এই গানটায় গুনগুনিয়ে ভুলটুকু ধরিয়ে দিতে পারতাম,কিন্তু না ! কি একটা
অজানা বিতৃষ্ণায় মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম । মুখটা এদিকে ঘোরাতেই
ফিরোজ বলে ওঠেঃ দিনরাতের কিচির কিচিরে পড়া কতটুকু হতো তুই বুঝতেই পারছিস । দুটো বোনের শাদী তো
হয়ে গেছিল, ছোটির বাকি আছে।ভেবেছিলাম এইচ.এস পাশ করে কোনও একটা কাজ করব
। ম্যাট্রিক
পাশের যে ভ্যকান্সি গুলো বেরয় তার একটা বহুত কষ্টে ভরে ছিলাম ।
কলকাতায়
পরীক্ষা ছিল। ফিরে এসে শুনি যেদিন থেকে গেছি সেদিন থেকে আব্বা ঘরে আসে নাই। পুরা
একটা দিন কোথায় কাটিয়েছে কে জানে ? ব্যাগটা নামিয়ে রাতের বেলাতেই খুঁজতে বেরিয়ে যাই।বহুত
খোঁজাখুঁজি করে দেখি শালা ধানক্ষেতের মাঝে বেহুঁশ পড়ে আছে । কোনরকমে
তুলে ঘরে নিয়ে আসি ।
পরের
দিন সকাল দশটায় সেই যে ব্যাথা শুরু হোল এক ঘণ্টার মধ্যে সব খতম । কি!
আমার ভেতর থেকে শুধু
একটিই শব্দ বের হয় । ফিরোজ
শান্ত স্বরে বলেঃ হ্যারে মরে গেলো। মধ্যরাতের
নিস্তব্ধতা এসে অধিকার করল আমাদের গাড়ি টাকে। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করি গাড়িটাকে
বেচলি কেন ? পয়তাল্লিশ হাজার
টাকা শুধব কেমন করে ।
চল্লিশ
হাজারে বেচে দিলাম । এখনও
৫০০০ বাকি। আমি
চুপ করে থাকি। কিছু পরে বলি চাকরিটা পেলি ? ফিরোজ হেসে ওঠে।আর
বলিস কেন,শালা যতদিনে জানতে পারলাম ততদিনে ইন্টারভ্যুর তারিখ পেরিয়ে
গেছে। তাহলে
এখন কি করছিস? কাজ করছি। কি কাজ? কাম খোঁজাটাও তো
একটা কাজ,কি বলিস ?
একমুখ প্রশান্ত হাসি
নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে জিজ্ঞাসু চোখ মেলে। আমি তাকাতে পারি না । শুধায়
তোর বোন তো এইবছর ম্যাট্রিক দেবে না ? পড়া ছেড়ে দিয়েছে । অবাক
হয়ে জিজ্ঞেস করি তাহলে কি করছে এখন ? ফিরোজ নির্লিপ্ত ভাবে
জবাব দেয় ঘরে ঘরে কামিনের কাজ করছে। আমি
চুপ করে যাই। আর কোনও কথা হয় না। আখলপুরের আগেই
সাতগ্রাম ইনক্লাইন বাবার কলিয়ারি । আমাদের
কোয়ার্টার। অনেকক্ষণ
পড় ফিরোজ হটাৎই চৈতন্য পায় । চেঁচিয়ে বলে ওঠেঃআরে
রোকো, রোকো, দোস্ত কো উতরনা হায়
।
গাড়ি দাঁড়িয়ে যায় । নামার
সময় ফিরোজ বলে ওঠেঃ আজ কাম ঢুঁঢনে গয়া থা । মিলা নেহি। কাল ফ্রি
হ্যাঁয় । গ্রাউন্ড
মে আ জানা ।
কাল
তো রাহেগা না ? উৎসাহে কিছু একটা
বলতে গিয়েও তীব্র মদের গন্ধে মুখটা সরিয়ে নি । গাড়ি টা স্টার্ট
নিয়ে চলে যায় ।
ঘরে ঢুকতেই দেখি
হই-হই কাণ্ড । কথায়
কথায় মা বলেঃ কাজের বউটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছি । বড্ড
কামাই করত । আমার জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে মা জানায় এখন জুলী কাজ
করছে ।