ত্যাল
মেঘ অদিতি
সালিশ বসেছে আজিজের উঠানে। ঘরের ভিতর থেকে আজিজের বউয়ের একটানা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। হামাগুড়ি দেওয়া একটা ছেলে উঠানে বসে একমনে কাদামাটি ছানছে । ওর গায়ে ধুলো, কোমরে কালো সুতোয় তাবিজ, নাক দিয়ে সিকনি গড়াচ্ছে। শিশুটি আজিজের সন্তান। উঠানের এক কোণে আজিজের মা ছেঁড়া শাড়িতে গতর ঢেকে ঋজুভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে, মায়ের পাশে আজিজ। আজিজের রোদেপোড়া শরীরটা রোগাটে নয় মোটেও বরং একবার তাকালেই ওর শিলার মত শক্ত শরীর বলে দেয় ও কতটা শক্তি ধরে শরীরে, চোখদুটো রক্তজবার মত লাল। অপরদিকে ঘরের ভেতরে ক্রন্দনরত আজিজের বউ ছোটোখাটো গড়নের, ফর্সা ছোট রোগাটে শরীর নিয়ে দিনমান খাটতে পারে। উঠানের আরেক কোণ ঘেঁসে আজিজের শ্বশুর মুবারক আলী ঘাড় নিচু করে বসে । তাকে ডেকে আনা হয়েছে সমন শোনাবার জন্য ।
বিচার হবে । কার বিচার ? কেন, সমাজে কার বিচার হয় ! দুর্বলের বিচার। সবলের কোনো অন্যায় নেই তাই সবলের কোনো বিচার নেই । এখানেও আজ আজিজের বউ কমলার বিচার হবে, এখুনি শুরু হবে ।
গ্রামের মাতব্বর ছাড়াও মসজিদের ইমাম সাহেব আর পাশের বাড়ির নবা চাচা আছে । নবা মানে নবাব মিঞার চালু নাম । মুরুব্বী, তায় গ্রামের মাথা তারা, নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে কোন বিষয়ে সঠিক ও একক সিদ্ধান্তে মিলিত হতে গলার স্বর ফিসফিসের পর্যায়ে নিয়ে তিনমাথা প্রায় এক করে ফেলেছে। তাদের ঘিরে বিচার দেখার আশায় অর্ধগোলাকারে দাঁড়িয়ে উৎসুক জনতা । আড়ালে দাঁড়িয়ে কান পেতে ঠায় অপেক্ষার কৌতুহলে ফেটে পড়া প্রতিবেশী ঘরের বৌ রহিমা কুলসুমেরা ।
- মুবারাক মিঞা, যে জন্য সালিশ ডাকা হৈছে তা আপনে ছাড়াও উপস্থিত সকলেই অবগত আছেন। আপনার মাইয়ার মুরুব্বী মানসিন্ নাই। তার শাউড়িরে চুরির অপবাদ দিয়া সে অত্যন্ত গর্হিত কাজ করছে । আইজ্যা তারে বহুবার মাফ চাইতে বইলাও, নানাভাবে বুঝাইয়াও তারে দিয়া মাফ নিতে পারে নাই। আর যে বিয়াইত্যা মাইয়া বিয়ার পর স্বামীর ঘরে থাইকাই অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখে সেই মাইয়ারে জন্ম দেওনই তো পাপ গো মিঞা । সকলে মিল্যা চেষ্টা কইরাও এই বেহায়া মাইয়ার মুখ থেকে একটা কথা বাইর করতে পারে নাই। সে তার স্বামীরেও মানে না, কথায় কথায় আকথা কুকথা শুনাইয়া কাইজ্যা করে, তার মাথারও দোষ আছে । এই অবস্থায় আমার কাছে তারা ন্যায্য বিচারের দাবী জানাইছে। আইজ্যাও আমাগো জানাইছে এইরম খারাপ চরিত্রের মাইয়া সে আর আর কোনভাবেই ঘরে রাখবে না । তালাক দিবে সে। এমন মাইয়ারে দোররা মারার বিধান থাকলেও আমরা ইমাম সাহেবের লগে সকলরকমের বোঝাপড়া কইরা এই বিবেচনায় আসছি যে, আপনার মাইয়া আপনে লয়া যান। তালাকের ব্যাপারেও কথা হৈল, আইজ্যা আইজকাই সব সাইরা ফেলবে ।
বিচারের রায় ঘোষণা করে মাতবর সম্মতির আশায় ডানে বামে তাকালে ইমাম সাহেব আর নবাব মিঞা ঘনঘন ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলে উৎসুক জনতার মধ্যে বিচার ঠিক কি বেঠিক এই নিয়ে মৃদু গুঞ্জন ওঠে। মাতবর সাহেব তার বাকি দল নিয়ে উঠে পড়েন, মুবারাক মিঞা মাথায় হাত দিয়ে ঠাস করে উঠানে বসে পড়ে। আইজ্যার বউ কমলার কান্না এবার আরও জোরেসোরে উঠানে আছড়ে পড়ছে। ভিড় ভেঙে কিছু লোকজন যার যার কাজে যাবার জন্য বেরিয়ে পড়ে আর কেউ কেউ এহেন বিচারের জন্য আক্ষেপ করে ।
আক্ষেপই সার। ওখানেই গুঞ্জন শুরু আর শেষ ।
আজিজের তালাক দিতে খুব বেশী বিলম্ব হলো না ।
কমলার চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু নামছে । বিদায় সংসার থেকে, স্বামীর কাছ থেকে ওর ছুটি হয়ে গেছে। অসহায়ের মত ছেলেকে একহাতে ধরে শেষবারের মত নিকানো উঠান আর তাদের শোবার ঘর দুটোর দিকে করুণ চোখে চায় আর ঘনঘন চোখ মোছে। যেখানে শাশুড়িকে নিয়ে তারা এতকাল কাটিয়েছে সেই ঘরের দিকে বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে বাপজানের সাথে বেরিয়ে পড়ল। আজিজ বা ওর মা কারও চেহারাই দেখা গেলো না। মুবারাক মিঞার ভ্যানে করেই কমলা ওর ছেলে বুকে করে বাপজানের ভিটায় ফিরে গেলো ।
বাপের ভিটের দাওয়ায় বসে কমলা এখন কাঁথা সেলাই করে কাজ না করলে খাবে কি, ছেলেকে খাওয়াবেই কি ! রোজকার কাজে ফাঁকি দিলে মা ছেলের খাওয়া খরচ নিয়ে বাপের বাড়িতেও কথা শুনতে হয় বলে যত দ্রুত সম্ভব কাপড়ে লতাপাতার নকশা তোলার চেষ্টা করে সে । কিন্তু মন বসে কই! কাজের মাঝে থেকে থেকেই কমলার মন উদাস। ভেসে ওঠে টুকরো টাকরা স্মৃতি । একটা ঘর, পাশে একচিলতে একটা রান্নার জায়গা। মাচা ছেড়ে ঘরের চাল ছাওয়া লাউগাছ, বৈভব কিছুই ছিল না তবু কত সুখ ছিল সেই জায়গাটুকু ঘিরে। বিকেল হলেই কমলা উঠানে পিড়ি পেতে চুল বাঁধত লাল ফিতেতে। বিয়ের পর আজিজ ঘরে ফিরত সন্ধ্যের একটু পরপর। হারিকেনের মৃদু আলোয় কমলা তখন হয়ত রাঁধতে বসেছে । দাওয়া থেকেই আজিজ ওর সাথে কথা বলত, কখনও বা চুলোর পাশে বসে খুনসুটি জুড়ে দিত । কমলার রহস্যময়ী হয়ে উঠবার রাতগুলোতে চাঁদের আলো বেড়ার ফাঁক গলে দুজনের কাছে এসে পড়ত। সেই আলোর টুকরোগুলো কখনও আজিজের বুকে এসে পড়লে কমলা যেন তা মুঠোবন্দী করত অনায়াসেই। সেসব মনে হলে এখনও কমলার চোখদুটো আলো আলো হয়ে ওঠে। মানুষটা রাগী ছিল, দুএকটা ভুলচুকে পিঠে মার পড়ত ঠিকই কিন্তু পরে আবার আদর দিয়ে সব পুষিয়েও দিতে জানত লোকটা। শুধু নেশা-ভাঙের অভ্যেসটা না থাকলে তাকে খারাপ বলে কার সাধ্যি । নেশা করলেই ওর শাশুড়ি সেটার সুযোগ নিত। আকথা কুকথা লাগিয়ে কাইজ্যা বাধালেই আজিজ চন্ডালের মত কমলার পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙত ।
আবার মনে পড়ে যায় সেইদিন, সব আঁধার হয়ে যাবার শেষ দিনের কথা মনে পড়ে কমলার সব গোলমাল হয়ে যায়।
সেদিনের কমলা দুপুরের রান্না শেষ করে পুকুরে নাইতে গেছিল। যাবার আগে চুলোর চারপাশ পরিষ্কার করে, রান্না করা ভাত তরকারি, রান্নার সরঞ্জাম ঘরে তুলে তবেই বেরিয়েছিল। ফিরে এসে চুলোর পাশে তেলের শিশি আর মাটি শুষে নেবার পরও মাটিতে ক্ষতচিহ্ন রেখে যাবার মত তেলের দাগে কমলার চোখে প্রশ্ন দেখা দেয়, কমলার মন দুলে ওঠে। ওর অনুপস্থিতির সুযোগ নেওয়া শাশুড়ির দিকে ঘুরে তাকায় ও, শাশুড়ি তখন নিজের হাড়ির ভাত তরকারি ঘরে তুলছে। শাশুড়িকে তেলের কথা জিগ্যেস করার আগেই শাশুড়ি কমলার চোখের প্রশ্ন পড়ে ফেলে উল্টো রাগে নিজেই ফেটে পড়ে -
-আবাগির বেটি, আইজ্যার কামাইয়ের পয়সায় ফুর্তি খালি। ত্যালের শিশি ফালাইয়া গোসলে গেছো কার লাইগ্যা। কুন ভাতার তোরে দেখার লাইগ্যা খাড়ায়া থাকে ? কমলা এহেন অশ্লীল বাক্যে সহসা বাক্যহারা হয়ে পড়ে, পরক্ষণে মাথায় রক্ত চড়ে গেলে সেও চেঁচিয়ে ওঠে, - অকথা কুকথা বলতেছেন কেন আম্মা ? ত্যালের শিশি আমি না তুইলা গোসলে যাই নাই। বাড়িতে আপনে ছাড়া আর কেউ আছিলো না । আপনে ত্যাল নিয়া রানছেন কইলেই তো হয় ।
কী কইলি তুই ? আমি চোর , তুই আমারে চোর কইলি রে কমলি ? ওই ছিনাইল্যা ঘরের ছিনাল, তুই ভাবছ মাইনষে কিছু বুজে না? চোখ কান নাই তাগো? তোর কুকীর্তির কথা কারও জানতে বাকি আছে ভাবছস ?
- সমাজে মুখ দ্যাহাইতে পারিনা আমরা ।
- আইজ্যা আইজ ঘরে আসুক । তোর কী করি খালি চাইয়া চাইয়া দ্যাখ তুই।
কমলার মুখের কোন কথাই কমলার পক্ষে যায়নি। আইজ্যার মা’র মাতম তুলে কান্নার শব্দে দু দশ ঘর জেনে যায় কমলার কুকর্মের কথা । অদৃশ্য নাগরের জন্য হাতের কাজ ভুলে আনমনা হয়ে যাওয়া কমলার দৌড়ে দৌড়ে পুকুর ঘাটে যাওয়ার কথা বাতাসে রটতে থাকে দ্রুত । আশেপাশের ঘরের চেনা সমবয়সী বৌরাও কেউ এগিয়ে আসে না বানোয়াট কথাকে ভেঙে দেবার প্রতিবাদে। চারদিকে চাউর হতে থাকা কথার গোলা আইজ্যার কানে পৌঁছাতে সময় নেয়না। উঠানে পা দেবার সাথে সাথে কমলার শাশুড়ি আইজ্যার উত্তেজনাকে বিরতিহীন বাক্যবাণ আর মাতমে উস্কে দিতে থাকলে আইজ্যা ক্রোধে হিংস্র হতে থাকে, একসময় সে হুংকার ছেড়ে কমলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় । মাথার চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে উঠানে নিয়ে ফেলে পরপর লাথি মারতে শুরু করে। একসময় সে ক্লান্ত হয়, পিপাসার্ত বোধ করে, পা দুটো পরিশ্রমে ঝিমিয়ে পড়ে। সে তখন কমলার অচেতন শরীরকে আবারও টানতে থাকে। টানতে টানতে কাঁঠাল গাছের কাছে নিয়ে এসে কমলার হাতে বোনা দড়ি দিয়ে কমলাকে কষে গাছের সাথে বাঁধে। সারারাত কমলা পড়ে থাকে সেভাবেই কিছু চেতনে কিছু অচেতনে।
উফফ্.... সুঁই ফুটে গেছে বামহাতের মধ্যমায়। ঝাপসা চোখ দেখে আঙুলে ফুটে উঠছে রক্তবিন্দ । বিন্দু বিন্দু রক্ত ওর মুখের স্বাদকে নোনতা করে দেয়।
ফিরে আসে সে, বর্তমান ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সুতো পরানো সুঁই। তেলবিহীন রুখুসুখু চুল উড়ে এসে পড়ছে ওর মুখে, সে চুল একহাতে সরিয়ে কমলা ফের ব্যস্ত হয়ে ওঠে, রঙিন সুতো আর সুঁই এর ফোঁড়ে কাপড়ে ফুটতে থাকে মঙ্গলঘট, লতাপাতা, কলসী কাঁখে রমণী আর পরিচিত সুখি সুখি ঘর-বাড়ির দৃশ্য। দৃশ্যপট ফুটিয়ে তুলতে দ্রুত ওঠানামা করে কমলার হাত আর ভেজা সেই চোখ দুটো আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে চৈত্রদিনের মত খরখরে ।