গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৮ মার্চ, ২০১২


                                        ভবিতব্য
           
             মৌ দা শ গু প্তা

        বিয়ের পরে নতুন বউ শ্বশুরবাড়ী আসামাত্র পাড়া- প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাই একবাক্যে বলেছিল,”বউ তো নয়, যেন লক্ষ্মী প্রতিমাতা সার্থকনামা মেয়েই ছিল বটে প্রতিমা শ্বাশুড়ীমা আশীর্বাদ করে বলেছিলেন,”পুত্রবতী হও মা শ্বাশুড়ীর শ্বাশুড়ীর ছেলেও সে ব্যাপারে মোটেও কার্পণ্য করেন নি বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সর্বসাকুল্যে ১১ টি সন্তান,মরে হেজে এখনও হাতে গোনা ৬টি,তবুও অশীতিপর প্রতিমা এখন ভাগের মা পয়সার জোর কোনকালেই ছিল না,আগে হাতে পায়ে খেটে গায়ের জোরে সব পুষিয়ে যেত,এখন বয়সের ভারে আর সে ক্ষমতাও নেই  নিত্য খিটিমিটি- সংসারে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত সন্তানদের কাছে মায়ের দায় এড়ানোর সবচেয়ে ভালো উপায় বৃদ্ধাশ্রম। অতএব,প্রতিমারও সেখানেই ঠাঁইহল

        প্রথম প্রথম পালা করে সপ্তাহান্তে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী, ছেলেদের বউ বা কোন জামাই, কেউ না কেউ আসতো, ক্রমশ সময়ের ফাঁক বেড়ে সেটা মাসে, দুমাস একবার হতে হতে 
এখন বছরে কেউ একবারও আসে কিনা সন্দেহ প্রতিমারও আর মনটেঁকে না সেখানে যতই অনাদর হোক না কেন, আপনজনের সংসার বলে কথা সবচেয়ে বেশী মন টানে মেজ ছেলের ঘরের ছোট নাতিটা একদম প্রতিমার মুখের আদল বসানো, সেই রঙ, সেই নাক, খালি চোখদুটি বুঝি আরো বেশী মায়াময় ছেলেটার, আদরকরে ঠাকুমা তাই ডাকতোনয়নমণি দেখতে বড় সাধ যায় ওকেদিন- বা আর বাচাঁ কপালে লেখা আছে কে জানে,অতএব সবার চোখ এড়িয়ে টুকিটাকি সম্পত্তি একটা পুঁটুলীতে বেঁধে প্রতিমা অনিশ্চিত পথে পা বাড়ালেন বাড়ী যেতে হবে
কার বাড়ীতে,  কোথায় ঠাঁই পাবেন জানা নেই, কিন্তু পেটের সন্তানরা আর ফেলে
তো দেবেনা ।
           

        দুর্ঘটনা ধনী-গরীব রেয়াত করেনা,নতুন গাড়ী চালাতে শিখে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী প্রমদারঞ্জনের ছোটছেলে প্রতিম যেদিন দুর্ঘটনায়  চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেললো, সেদিন প্রমদারঞ্জন বুঝলেন শুধু পয়সা খরচা করেই সব কিছু কেনা যায় না আই ব্যাঙ্কগুলোতে যথোপযুক্ত সরবরাহ না থাকার কারণে রেটিনার বড় অভাব, অতএব চারিদিকে খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল অবশেষে এক
সরকারী হাসপাতালের মর্গে পথ দূর্ঘনায় মৃত এক বুড়ীর বেওয়ারিশ লাশপাওয়া গেল, যার চোখের রেটিনা তখনও অবধি প্রতিস্থাপনযোগ্য রয়েছে  
                    
               অঢেল পয়সার জোরে তাই কিনে আনা হল সদাশয় প্রমদারঞ্জন দাক্ষিণ্যভরে সে
শবদেহের অন্তিম সৎকারের খরচাটাও হাসপাতালে জমা করে দিলেন নিজের প্রয়োজন মেটার সাথে কিছুটা খুচরো পূণ্যার্জন আরকি প্রতিম এখন আবার দেখতে পায়, শুধু চোখদুটো যে ওর ঠাকুমার, তা জানে না


                  ধরণী সামন্ত , আমি এবং ......
                        ফা ল্গু নি মু খো পা ধ্যা য়

এটা ধরণী সামন্তর গল্প নয়, হলে শোক সভায় অত লোকের মাঝে অমন চিৎকার করে ব্যাপারটা ঘটাতে পারতামনা, কিছুতেই না ।

হ্যাঁ,  শোক সভায় অনেক লোকের মাঝেই আমি ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলেছিলাম । তাতে  শোক সভার সুরটা হয়তো কেটে গিয়েছিল কিন্তু তার জন্য আমার কোন অনুতাপ ছিলনা, কেননা আমার মনে হয়েছিল অনেকেরই সেই শোক সভায় হাজির থাকার অধিকার ছিলনা । কোথা থেকে এত ক্রোধ আমার ভেতরে জমা হয়েছিল কে জানে ! সেই ঘটনার পর কি হয়েছিল আমার মনে নেই, কেউ বে-আদবির জন্য দুয়েকটা চড় চাপড় কষিয়েছিল কিনা তাও মনে নেই । শুধু মনে আছে, একটা আচ্ছন্ন বিধ্বস্ত মানুষের মত শোক সভা থেকে চলে এসেছিলাম – যেন এইমাত্র আমার সর্বস্ব লুট হয়ে গেছে কোন দস্যুর হাতে । আমি অনেক্ষণ বসার ঘরে সেই ছবিটার দিকে তাকিয়েছিলাম । ‘বিসর্জনে’র গোবিন্দ মাণিক্য । আমি যেন শুনতে পেলাম মঞ্চ দাপিয়ে অভিনয় করা গোবিন্দ মাণিক্যের সেই অসাধারণ সংলাপ –
                                      
                                     ‘দাঁড়াইয়া মখোমুখি দুই ভাই হানে
                                      ভাতৃবক্ষ লক্ষ্য করে মৃত্যুমুখী ছুরি
                                      রাজ্যের মঙ্গল হবে তাহে ? রাজ্যে শুধু
                                      সিংহাসন আছে – গৃহস্থের ঘর নেই , 
                                      ভাই নেই , ভাতৃবন্ধন নেই হেথা’ ?

শোক সভায় কেউ জোরে কথা বলেনা । আমি কিন্তু চিৎকার করেই কথাগুলো বলেছিলাম । তখন সবেমাত্র ছবিতে মালা দিয়ে স্মৃতিচারণ শুরু করেছে এ তল্লাটের বেশ কেউকেটা লোক নটবর মিত্র – যাকে নুটু মিত্তির বলেই লোকে চেনে বেশি । নুটু মিত্তির বলছিল ‘যখন এই ভাঙ্গা মঞ্চটাকে বাঁচাতে একটা হিল্লে  করলাম ঠিক তখনই ধরণীদা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন’ । কি হিল্লে করার ব্যবস্থা নুটু মিত্তির করেছিল তা আমি জানতাম, কারণ সেই রাতে সেই সব কথা-বার্তার একমাত্র সাক্ষী ছিলাম আমি, পাশের ঘরে বসে সব কথাই আমি শুনেছিলাম ।
          
শোক সভাটা ছিল ধরণী সামন্ত’র স্মৃতিতে । নাটক ও থিয়েটার বলতে এ তল্লাটে যে মানুষটির নাম এক বাক্যে সবাই বলেন, তিনি ধরণী সামন্ত । গত বিশ-পঁচিশ বছর তাকে মঞ্চে দেখা না গেলে কি হবে – তিনি ধরণী সামন্ত , এ তল্লাটে থিয়েটারের শেষ কথা । সেই ধরণী সামন্ত চলে গেলেন রবিবার ভোর রাতে ।

সকালে সবে চাএর কাপটা হাতে নিয়েছি । ধরণীদার বাড়ি থেকে আয়া মেয়েটির ফোন এল ‘দাদা, জেঠু আর নেই, তাড়াতাড়ি চলে এসো’ ।

ধরণীদার মৃত্যু অনেকের কাছেই কোন বিচলিত হবার মত খবর ছিলনা । একটা থিয়েটারের লোক চলে গেলে কার কি এসে যায় ! ধরণীদা তো সমাজের কোন কেউকেটা ছিলেন না ! আমার এখনই যেতে ইচ্ছা করলনা, কেননা এবার তো ধরণীদার দেহটা নিয়ে কামড়া-কামড়ি হবে – কে কত কাছের লোক ছিল জানাবে একটা নকল কান্নায় । এরকম নকল কান্নার সাক্ষী ছিলাম বৌদি চলে যাবার পর । ধরণীদা বলেছিলেন ‘কেউ মনে রাখে না রে । তোর বৌদিকে ছাড়া আমি কি ধরণী সামন্ত হতে পারতাম ?’

সেই কবে কলকাতার হাটখোলা থেকে লোহা-লক্কড় আর হার্ডওয়ারের কারবারী ঠাশা এই মুলুকে বাসা বেঁধে ছিলেন বেশি বেশি থিয়েটার করবেন বলে । সে অনেক দিনের কথা । এবং কি আশ্চর্য, কলকাতা কর্পোরেশনের একশো দশ – একশো আশির কেরাণী ধরণীদা, তিনচার জন বন্ধু জোগাড় করে বঊদির গয়নাগাটি বিক্রি করে সস্তায় একখন্ড জমি কিনে একটা নাট্যমঞ্চ বানিয়ে ফেললেন । নাম দিলেন ‘অর্ধেন্দু শেখর মঞ্চ’ । ধরণীদা বলতেন ‘দেখ, রবীন্দ্র গিরিশ অহিন্দ্র। শিশির উত্তম – সকলের নামেই মঞ্চ হয়েছে আর যে মানুষটা থিয়েটারকে জমিদারদের বাগান বাড়ি থেকে  উদ্ধার করে আমাদের সকলের কাছে নিয়ে এলো তার নামে কোন মঞ্চ হলনা !’ থিয়েটার করার জন্য অর্ধেন্দু শেখররা তখনকার ইংরেজ সরকারের কত লাঞ্ছনা ভোগ করেছিলেন সেসব গল্পও ধরণীদার কাছ থেকেই শুনেছিলাম । আর ধরণীদাও তো থিয়েটার না করতে পারার যন্ত্রণা নিয়েই চলে গেলেন । এখন যারা ধরণীদার দেহটাকে নিয়ে কামড়া-কামড়ি করবে তাদের কাছে থিয়েটার মানে নাচন কোঁদন ছাড়া আর কি ?

এইসব ছবি দেখতে দেখতে কখন সেই বাড়্টার সামনে চলে এসেছিলাম – খেয়াল ছিলনা । ততক্ষণে ধরণীদার দেহটার দখল নিয়ে নিয়েছে পাড়ার কেষ্ট-বিষ্টুরা । আর আমি কাল সন্ধ্যাতেও ঐ বাড়িটায় এসেছিলাম, এখন একা, ভীষণ একা । একসময় নাটক করতেন, ধরণীদার হাতে গড়া অনেকেই এলেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে মৃদু কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন । আমি নিশ্চিত তারা এখন সেই কবে ঘী খাওয়া আঙুলের ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন । আহা যদি একটা আয়না থাকতো ! নুটু মিত্তিরও চলে এসেছিল এবং যথারীতি কানে মোবাইল গুঁজে চেলাচামুণ্ডা পরিবৃত হয়ে নিজেকে জানান দিচ্ছিল ।
          
          বছর দুএক আগে ধরিণীদা একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন, এই নুটু মিত্তিরকে ধরে যদি কিছু সরকারী সাহায্য পাওয়া যায়, মঞ্চটা বাঁচে । বলেছিলেন ‘নুটু, তোমারতো সরকারী মহলে অনেক জানাশোনা , ফূটবল ক্লাবের জন্য অনুদান আদায় করে দিচ্ছ, আর চল্লিশ বছরের মঞ্চটাকে বাঁচানর জন্য কিছু করবে না’ ?
          
          সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নুটু বলেছিল , ‘না না ধরণীদা, শুধু নাচন কোঁদনের জন্য  সরকারী অনুদান পাওয়া যায়না । আপনাকে তো বলেছিলাম ওটা দিয়ে দিন, কমিউনিটি হল বানানোর ব্যবস্থা করবো , সভা সেমিনার হবে, আপনারা নাটক ফাটক ও করবেন । কেন মড়া আগলে বসে আছেন ধরণী দা’ ? আর এক মুহুর্ত না থেকে ধরণীদা আমাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন । সেই নুটু মিত্তির এখন ধরণীদার দেহ আগলে শেষ যাত্রার তদারকি করছেমনে মনে বলেছিলাম ‘নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে’ ?
                
           নুটু মিত্তিররা বোধয় কার দিন শেষ হয়ে এসেছে তার আগাম গন্ধ পায় । ধরণীদা মারা যাবার আগের দিন অসুস্থ মানুষটাকে দেখতে ধরণীদার বাড়ি এসেছিল । বলেছিল, ‘এবার আপনার অর্ধেন্দু শেখর মঞ্চের একটা হিল্লে হবে ধরণীদা , আপনি শুধু একটা সম্মতি দিন - কাগজ-পত্র সব রেডি করে রেখেছি’ । এই ছবিটাও সরে গেলো, নুটু মিত্তিরের গলার শব্দে, ‘শোন, গাড়ি বলে দিয়েছি এখনি চলে আসবে, সোজা নীলরতনে ঢুকিয়ে দিবি । কে একজন বললো ‘অর্ধেন্দু মঞ্চের সামনে একটু দাঁড়াবে না নুটুদা ?’ নিজের হাতে গড়া মঞ্চে যেতেও মৃত ধরণীদাকে নুটুমিত্তিরের অনুমতি নিতে হচ্ছে । বললো ‘ওখানে বডি নামাবি ? ঠিক আছে পাঁচ মিনিটের বেশি নয় কিন্তু, আর শোন আমি চললাম, আমার আবার থানায় একটা মিটিং আছে’ ।
          
           চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল ‘ময়লা হাতে লোকটা তোমার পবিত্র দেহ ছুঁতে চাইছে ধরণীদা, ওকে ছুঁতে দিওনা’ । কিন্তু বলতে পারলামনা, সাহস পেলামনা ।

   এবং কি আশ্চর্য – সেদিন ধরণীদার শোক সভায় সেই সাহসটা পেয়ে গেলাম । বোধয় ধরণীদাই আমার ওপর ভর করেছিল ।
   
  শোক সভা শুরু হয়েছে , শোকপ্রস্তাব পড়া হয়েছে, আমি কিছুই শুনিনি । সকলের শেষে এককোণে দাড়িয়েছিলাম ধরণীদার ছবিটার দিকে তাকিয়ে । সঞ্চালকের কন্ঠ বললো, ‘এবার স্মৃতিচারণ করবেন এলাকার সুপরিচিত সমাজকর্মী এবং শিল্প-সংস্কৃতির বিদগ্ধ পৃষ্ঠপোষক মাননীয় নটবর মিত্র মহাশয়’ ।
          
   ধরণীদার ছবিতে একটা মালা লটকে দিয়ে নুটু মিত্তির বলতে শুরু করলো, জানালো নাটকের প্রতি তার নাকি গভীর ভালোবাসা আছে । নুটু বলে চলেছে – ‘আজকের এই শোক সভাতে আমি একটা শুভ সংবাদ দিতে চাই । আমি ভাগ্যবান কারণ আমার সঙ্গেই ধরণীদা শেষ কথা বলেছে –নাটক আর মঞ্চ নিয়ে । গতকালই উনি সম্মত হয়েছেন । এই ‘অর্ধেন্দু মঞ্চে’র জমিতে একটা কমিউনিটি হল তৈরী হবে , ধরণীদার স্বপ্ন সার্থক হবে’ ।

   আর ঠিক তখনই আমি কান্ডটা ঘটিয়ে ফেললাম, প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম ‘মিথ্যে কথা, এই লোকটাই ধরণীদাকে আরো কিছুদিন বাঁচতে দিলনা’ । একটা বুক ফাটা চিৎকার উঠে আসছিল 'ধরণীদা গো , কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল এই ফেরেববাজদের মুলুকে এসে থিয়েটার করতে' !

     কে একজন এসে আমাকে বাইরে নিয়ে গেল , বললো ‘কাকে কি বলছিস খেয়াল আছে ‘? খেয়াল ছিল বইকি ! কাল রাতে নুটু মিত্তির যখন মঞ্চের জমিতে কমিউনিটি হল বানানোর সম্মতি চাইছিল তখন ধরণীদা বলেছিলেন ‘যতক্ষণ আমার নিঃশ্বাস পড়বে ততক্ষণ তো পারবেনা নুটু, নিঃশ্বাস বন্ধ হলে দেহটাকে নীলরতনে পুরে দিয়ে তারপর অর্ধেন্দুকে খাবলে খুবলে খেয়ো, তার আগে নয় ‘ । কাল রাতে চলে আসার আগে ধরণী সামন্ত তার শেষ কথা বলেছিলেন। তোরাও আর মঞ্চটাকে বাঁচাতে পারবি নারে,শকুনের দল বড্ড মরিয়া হয়ে উঠেছে ।
                                    ---------X --------------