সেই সব বনজ দিন
শাকিলা তুবা , ঢাকা
শাকিলা তুবা , ঢাকা
“সেদিন অনেক রাত অব্দি বাঁশী বেজেছিল নবীনা’দিদের পুকুরঘাটে । আমি তো নির্বাক শ্রোতা বা দর্শক । ঝুমুরের চোখ দু’টো করমচার মতো লাল দেখেছি, বুঝেছি অনেক কিছুই। বলতে কি পেরেছি কিছু?”----বলতে বলতে বড়’মা কাঁদছিলেন। বড়মা’র ছোট ফুফু ছিলেন এই ঝুমুর, সমবয়সী । অমন রূপবতী মেয়ে বুঝি আর হয় না, বড়মার তাই বলেন । একাব্বুই বছর বয়েসী অশীতিপর এই বৃদ্ধা আমার মায়ের নানু, আমার বড়মা । তিনি বলছিলেন আর আমি সবকিছুই দেখছিলাম বড়মার চোখ দিয়ে---চলে যাচ্ছিলাম অনেক, অনেক যুগ আগে ।
লাল ঢাকাই শাড়ী পরনে এগারো বছরের কিশোরী ছুটে যাচ্ছে কলাই ক্ষেতের ভেতর দিয়ে, আমি দেখতে পাচ্ছি---কিশোরীর গলায় হাঁসুলী, পায়ে রূপার খাড়ু আর কোমর ছাড়ানো ঢেউ খেলানো চু্ল । ফর্সা, ঝকঝকে গায়ের রঙ, মেয়েটি দৌঁড়াচ্ছে আর কেউ পিছু ‘ডাকছে, ওরে ঝুমুর, ঝুমুরি রে---দাঁড়া---‘
আমি সব দেখতে পাচ্ছি----
মাত্র দু’দিন আগে ঝুমুরের বিয়ে হয়েছে । যদিও মেয়ে শ্বশুরবাড়ী যাবে আরো দু’বছর পর তবু এখনো বাড়িতে বিয়েবাড়ীর আমেজ । আর এই মেয়ে ছুটছে সইয়ের বাড়ী । সাথে আমার বড়মা আলতা, ঝুমুরের সমবয়েসী ভাইঝি ।
----শোন আলতা আমি শ্বশুরবাড়ী গেলেও ফিরে আসবো, আর যাব না---বলছে ঝুমুর ।
---ধ্যাৎ তাই কি হয় ? দেখো না ঝর্ণা খালা কত্তো কাঁদলো বিয়ের সময় । আর এখন বলে যাই রে, বাপের বাড়ীতে বেশীদিন থাকলেই আমার ছেলের শরীর খারাপ করে । তুমিও অমনই করবে---আলতাও হেসে উত্তর দেয় ।
---বলেছে তোকে ?
---বলেনি আবার ? বলেই খুব হাসছে আলতা
---দেখবো তুই কি করিস ?
---এমা আমি তো বিয়েই করবো না, বাবাকে বলেছি---আর বাবাও বলেছে সে-ই ভাল, করিস না বিয়ে ।
দূরে উড়ে যাওয়া বকের সারি দেখে দু’জনেই থমকে দাঁড়ায় । এমন অসময়ে বকগুলো ওড়ার কারণ হঠাৎ বেজে ওঠা বাঁশীর সুর । দু’জনে কি এক টানে পায়ে পায়ে ঝোঁপটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় । দেবদূতের মতো দেখতে, একমাথা ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে যে ছেলেটি বসে বসে বাঁশী বাজাচ্ছে ওরা দু’জনেই চেনে তাকে । শ্যামল দাদা, নাবীনাদি’র ছোট ভাই ।
---কি রে ঝুমরি তোর নাকি সেদিন বিয়ে হয়ে গেল ? এখন তবে কেন এত বন বাদাড় ঘুরে মরছিস, যা ঘরে যা---বললো শ্যামল দা ।
---বিয়ে হলেই কি ! ও কি এখনই চলে যাচ্ছে না-কি শ্বশুরঘরে ?
---এখন যাবে না ? বাহ ভালই---
শ্যমলের ঠোঁটের কোনে এক টুকরো বাঁকা হাসি আর ঝুমুরের চোখ ছলছল । সে কেবল পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে মাটি খুঁড়ছে । ভঙ্গিটা কেমন অপরাধীর । একটা নিঃশ্বাস ফেলে শ্যামলদা আবার বাঁশী বাজাতে লাগলো । পাশেই ঝালিঙ্গী নদীর শীর্ণ ধারা কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে । নদীর জলে তীরবর্তী কোন গাছের ছোট ছোট হলদে ফুল ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে কোত্থেকে যে কোথায় চলে যাচ্ছে ! আলতা কেবল দূরের সরিষা ক্ষেতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা পড়ন্ত বিকেলের দিকে চেয়ে থাকে । হঠাৎ লক্ষ্য করে ঝুমুর যেন কেমন মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে শ্যমলদা’র দিকে। বাতাসে শীতের গন্ধ ।
তারপরের ঘটনা সুখের না মর্মান্তিক কে জানে! যে আলতা দর্পিত ভঙ্গিতে বলেছিল, “এমা আমি তো বিয়েই করবো না, বাবাকে বলেছি আর বাবাও বলেছে সে-ই ভাল করিস না বিয়ে - সেই আলতারও বিয়ে হয়ে গেল হুট করেই । আর বাইরে যেতে পারে না আলতা বা ঝুমুর কেউই । তবু কোন কোন উদাস দুপুরে মা-খালারা ঘুমে থাকতে দুই জনে চষে আসে মাঠ-ঘাট । নবীনাদি’দের বাড়ী । শ্যামলদা’র বাঁশী এখনো তেমনি বাজে করুণ থেকে করুণ সুরে । মাঝে মাঝে কেবল ওরা চুপি চুপি পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় শ্যামলদা’র সামনে । কি যে হয়েছে ঝুমরিটার, ওকে দেখলেই কাঁদে । চোখের জলে ভেসে যায় ওর নাক চোখ মুখ । শ্যামলদা’র চোখটাও কি একটু ভেজে ? কি জানি, এ হয়তো আলতার চোখের ভুল !
কথা ছিল দুই ফুফু ভাইঝি শ্বশুর ঘরে যাবে দুই বছর পর যখন ওরা তেরোয় পড়বে । সে-ই দিনও ঘনিয়ে এসেছে । সামনের অঘ্রানের দুই তারিখেই দুই সই পাড়ি জমাবে ভিন গাঁয়ে । বাড়ীতে হাসি-আনন্দ । মা চিড়ে কোটে, দাদী বানায় নাড়ু, শিকায় উঠছে ভাঁড়ের পর ভাঁড় দই । অন্য ফুফুরাও নাইয়র এসেছে । কলকাতা থেকে মেয়েদের জন্যে এসেছে শাড়ী, চুড়ি, ছেলেদের জন্যে জরিপাড়ের লুঙ্গি, কুর্তা , বাড়ীর পরিবেশ জমজমাট । কাজের লোকজনের হাঁক ডাকে বাসায় তিষ্ঠানো দায় । বড় বড় রুই,পাঙ্গাস কুটছে পাড়ার বৌ-ঝি’রা উঠানে বসে । ধামা ভর্তি খই, মুড়কি নিমেষে শেষ হচ্ছে , আর পানের বরজ তো খালি হবার যোগাড় । এমন এক উৎসবমুখর দিনে আলতা আর ঝুমুর কোন ফাঁকে বেরিয়ে পড়েছে কে জানে ! আজ কার্তিকের শেষ দিন।
নদীর ঘাটে যে জংলা মাচাং সেও ছাড়িয়ে দু’জনে চলে গেছে নীরব থেকে নির্জনে । অবেলার কুয়াশায় ঢেকে আছে জায়গাটা , কেমন নিঃস্তব্ধ, শুনশান চারিদিক , পাখিদের ঘরে ফেরার কিচিরমিচির শুধু । এরই মধ্যে গলাগলি করে দু’জনের সে কি কান্না । কে শুনবে তাদের এই হাহাকার ? কে আসবে মোছাতে চোখের জল ? ঘোচাতে বিচ্ছেদ জ্বালা ? আলতা বলেছিল
---মনে থাকবে ঝুমরি, আমরা কিন্তু ও বাড়ী থেকে ফেরত এসেই বিষ খাব।
---কোত্থেকে যোগাড় হবে রে বিষ?
---সে আমি যোগাড় করে আনব, ভাবিস না।
ঝোঁপের ভেতর থেকে মচমচ আওয়াজে ওরা উঠে দাঁড়ালো। অবাক হয়ে দেখছে এই বিজন বনে আবার কে এলো! বাঘ নয়তো! মা বলেছে আলতাকে, ‘দেখিস যেন ওদিকে কক্ষনো যাবিনে। ওখানে বাঘ বেরোয়।‘ তা ওরা তো এখানে আসছে সেই ছেলেবেলা থেকেই। বাঘ কেন বেড়ালও দেখেনি কখনো। তবে ওদের দেশে বাঘের উপদ্রব অনেক। এই তো সেদিনও বাপ-মা মরা এতিম ছেলে শহীদুল্লাহ কে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল বাঘে। ওর বড়ভাই আসাদুল্লাহ পাশেই মাঠের ঘাস কেটে আঁটি বাঁধছিল। কি সাহস ছেলেটার! এক্কেবারে ঘাসকাটার কাঁচি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঘের উপর। আসাদুল্লাহ’র চীৎকার, চেঁচামেচিতে লোক জড়ো হয়েছিল বিস্তর। কিনতু ঐ একলা ছেলেই ভাইকে উদ্ধার করেছিল আর কেঁদে কেঁদে বলেছিল, ‘খোদা হামার মা-বাপ কাইড়্যে নিয়েছ তবু হাউস যায় না, ভাই টাকও নিবার চাও। তুমি এংকা ক্যা খোদা? গরীব দুঃকীর দুক্ক বোঝোনা!’ এসব অবিশ্যি আলতা শুনেছে বাড়ীর ঝি রাসুর মায়ের কাছে । তবে এখন এই সাঁঝলাগা বিকেলে ওর শরীরটাও বাঘের ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে । ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে ।
যাহ বাঘ কোথায়! কোত্থেকে শ্যামল দাদা এসে দাঁড়ালো ওদের পাশে ।
ওরা কিছু বুঝে উঠবার আগেই হঠাৎ করে সে ঝুমুরের ডান হাতটা চেপে ধরে আকুল হয়ে বললো, ---শ্বশুরঘরে যাসনে ঝুমুর । প্রথমে দু’জনেই হতচকিত হয়ে মৃদু একটা চীৎকার করে উঠেছিল, শ্যামল’দাকে দেখে আলতার যেন বুকে পানি ফিরে এল। তবে সামলে উঠেই সেও অবাক হয়ে দেখে শ্যামলদা’র হাতের মুঠোয় ঝুমুরের হাত। এতক্ষনে সম্বিৎ ফেরে ঝুমুরের । হালকা ভাবে হাতটা ছাড়িয়ে নিল আর ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথায় ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নামিয়ে নিয়ে দৃঢ় অথচ অস্ফুট স্বরে কেবল বললো---ছিঃ
তারপরে দু’জনেই ছুট। দু’জনেরই বুক ঢিবঢিব। পেছনে পড়ে গেল কলাই ক্ষেত, সর্ষে ক্ষেত আর শ্যামল দাদা ।
ঘরে ফিরেই ঝুমুর বললো,---আলতা ও কথা যেন কাউকে বলিসনে ভাই ।
---যাহ ও কি বলবার কথা! হ্যাঁ রে তুই ও কি ওকে---?
--- না না কি যে বলিস!
---তা’ও ঠিক। আর ওরা হলো গিয়ে হিন্দু। এ কি সম্ভব?
এবার ঝুমুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ম্লানকণ্ঠে কেমন আনমনে বলে, সে-ই তো ।
এই রাত্তিরটাই শেষ। কালই আলতা চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি গাইবান্ধা জেলা শহরে আর ঝুমুর পলাশবাড়ীর বাঁশকাটায় । জানীপুর গ্রামের দু’টি মেয়ে কি নিমেষে পর হয়ে যাবে স্বজনদের জন্যে! আর ওরা হাসি তামশায় মেতে উঠবে না। ভাইয়ের কাছে পাখি ধরে দিতে বায়না করবে না। মেয়ে দু’টো এটা মানতেই পারছে না। অথচ দেখো ভাই আর মায়েদের খুশীর অন্ত নেই । যেন ওদের জন্মের পর থেকেই চলছিল ওদেরকে পর করে দেবার এই দূরাভিসন্ধি। সত্যি কি নিষ্ঠুর এই জগত ! কেমন করে একটা মেয়ের শেকড় উপড়ে টেনে নিয়ে ফেলে অন্য ঘরে ! কেউ এতটুকু উহ করে না, কেউ দেয় না বাঁধা। আলতার বুকে অভিমানের বিশাল পাহাড়। সে ভাবে, আর কক্ষনো ফিরবে না এই বাড়ী, এই নিষ্ঠুর লোকগুলোর মাঝে । ওরা তো কেউ ওকে ভালই বাসে না। থেকে থেকেই ওদের বুক ফেটে একটা করে দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে যায়। কেউ তা শোনে না। শুধু বাতাস হয়ে রয় সাক্ষী ।
আজ সারাদিন ধরে দুই শ্বশুরবাড়ীর লোকজন এসেছে গরুগাড়ী বোঝাই করে। এখন অনেক রাত। তা’সত্ত্বেও বাসন কোসনের ঝনঝন আর খাওয়া দাওয়ার হুল্লোড় লেগেই আছে । শুধু কোনার এক ঘরে কাঠের মতো শুয়ে আছে আলতা আর ঝুমুর। এত হৈ চৈ ওদের কানে যাচ্ছে না। বাইরে করুণ সুরে বাজছে বাঁশী। থেকে থেকেই ফুঁপিয়ে উঠছে ঝুমুর । ঝুমুরের চোখ করমচার মতো লাল। আলতার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার কষ্টের চেয়েও অন্য এক বেদনায় ।
সেই অন্ধকার থাকতেই বাড়ীর মেয়েরা টেনে তুলেছে ঝুমুর আর আলতাকে। আজ দু’জনে যাবে দুই পথে । এ নিয়ে অবশ্য আপত্তি তুলেছিল মুরুব্বিরা। একই দিনে বাড়ীর দুই মেয়ে তা’ও আবার ফুফু ভাইঝি’র একত্রিত বিদায়! এ তো শুভ লক্ষণ নয় । আলতার দাদাজান মানে ঝুমুরের বাপজান এসব মানেন না বলে সব আপত্তি উড়ে গেছে আগেই। ওই অন্ধকারেই দু’জন কে গোসল করানো হলো সন্দা-মেথি আর হলুদ বাটা মেখে। সে কি শীত! কাঁপছে দু’জন ঠকঠক করে। বেলা উঠবার আগেই সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় দিতে হবে। নইলে দূর পথে ওদের ফিরতে সমস্যা হবে। বেলা বেলা বৌ নিয়ে ঘরে না ফিরতে পারলে শ্বশুরবাড়ীর ওরাই বা নিজেদের লোকজনকে কি করে দেখাবে কেমন বৌ এনেছে! তাই এত দ্রুত সব আয়োজন, তাড়াতাড়ি যাত্রার তোড়জোর । ভেজা চুলেই তেল দিয়ে টেনে বাঁধা হয়েছে বিড়া খোঁপা। এমন শক্ত করে বাঁধা যে দু’জনের কপালের পাশের শিরায় চিনচিন করছে ব্যাথা । অবিশ্যি এ বোধটাও এখন ওদের কাছে নস্যি । কখন মা, দাদী, খালা, ফুফুদের সাথে কান্নার পাট চুকিয়ে ওরা গরুর গাড়িতে গিয়ে বসেছে ওদেরই মনে নেই। দু’জনেই ছইয়ের ভেতর থেকে যতটুকু দেখা যায় দেখলো, দুই গাড়ী চলে যাচ্ছে উঁচু নীচু রাস্তা ভেঙ্গে দুই দিকে ।
দশদিন পরেই অঘ্রানের তের তারিখে আবার একই জায়গায় পরপর এসে দাঁড়ালো দু’জনের গরুর গাড়ী। সেদিন গিয়েছিল ছইয়ের ভেতর একা বসে। আজ দু’জনেই ফিরেছে পাশে বর নিয়ে । আজ বাড়ীতে আনন্দের ঢেউ তেমনি, সেদিন যেমন ছিল । তবে আজ কিনতু ঝুমুর বা আলতা কাঁদছে না। দু’জনের চোখে-মুখেই চাপা খুশী, লাজুক মুখে ঘুরছে । বারেবারে চাপা হাসিতে মুখ চেপে দেখছে দু’জন দু’জনকে। শুধু মন খুলে কথা বলতে পারছে না নানা আনুষ্ঠানিকতার ব্যাস্ততায়। তা হোক সকাল তো পরেই আছে। কত্তো গল্প জমে আছে দু’জনার অন্তরে !
সকালে কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে ঝুমুর। মুখোমুখি আলতা---
---কি রে এনেছিস বিষ ?
---কোত্থেকে আনব ?
---ও মা তুইই না বলেছিলি যোগাড় করবি !
---না রে এখন আর পারবো না। মানুষটা খুব ভাল ।
---কোন মানুষ ভাল রে ?
---যাহ জানিনা
হিহিহি করে হেসে ওঠে ঝুমুর। বলে
---আমারটাও জানিস। আমি বাবা এই জীবনে আর মরতে চাই না ।
---আমিও
---দ্যাখ আলতা এই শাড়িটা সে আমায় দিয়েছে লুকিয়ে
---বাপরে! এরই মধ্যে ঘুষ দেয়াও সারা? আর কি কি দিয়েছে শুনি ?
---সর পাজী কোথাকার !
এবার আলতাও হেসে উঠলো খুব জোরে। কোথায় যেন বাঁশী বেজে উঠলো, কি করুণ সেই সুর! সকালের কাঁচাসোনা রোদ ধুয়ে দিচ্ছে ওদের শরীর। তবু বাঁশীর সুর শুনে দু’জনেই একটু কেঁপে উঠলো যেন ।
হঠাৎ একটা হলদে ঝিলিক। রোদের এত তেজ? এমন ঝিলিক ? মূহুর্তের জন্যে আলতা টের পায় শরীরে একটা লোমশ ছোঁয়া, গরম। ওরই ভারে আলতা পা ভেঙ্গে পড়ে গেল মাটিতে । কুয়োর পাড়ে ধুপধাপ ক’য়েকটা শব্দ। এত দ্রুত, এত দ্রুত যে আলতা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি একবার শুধু চোখ বড় বড় করে দেখলো ওর সামনে ঝুমুর নেই । আর ওর বাসার মানুষজনসহ গ্রামের অনেক লোকের হৈ চৈ চীৎকার---
---বাঘ, বাঘ, ওরে ঝুমুরোক বাঘে নিয়া গেল—ওরেএএএ-----কেটা কুন্ঠে আছ, আউগাও বাহে---বাহে----
ঝুমুরের আধখাওয়া শরীরটা পাওয়া গিয়েছিল সেই জংলা মাচার পাশের ঐ জঙ্গলে । শ্যামল’দাদাই দেখেছিল প্রথম ।
অনেক আগেই গল্প শেষ, শুয়ে পড়েছি আমরা। আমি আর বড়’মা। বড়’মা পাশ ফিরে শুয়ে কাঁদছেন। ফুলে উঠছে শরীর। টের পাই সবই । কিছুই বলি না, কাঁদুক । সারা জীবন যে দুঃখ তিনি বুকে বয়ে বেড়িয়েছেন এটুকু শোক তো এই বৃদ্ধা কেঁদে ঝরাতেই পারেন । আচ্ছা শোক কি কাঁদলে ঝরে যায়? নাকি আটকে থাকে বুকে? খুব ভাবছি, শোক আসলে কি ? শোক কি এমনই ? একহাজার বছর পরেও একই জায়গায় দাঁড়িয়েই থাকে !
(একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)