গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৩ মে, ২০১৩

দুপুর মিত্র


রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী
অধ্যায়- ১

একদিন গভীর রাতে করিম একটি বাস স্ট্যান্ডে নেমেই দেখতে পেল বাস স্ট্যান্ডটির একটি কোনায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে কাঁদছে। এত রাতে বাস স্ট্যান্ডে তেমন মানুষ-জন নাই, একা একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি মেয়েকে কাঁদতে দেখে প্রথমে তার মেয়েটির কাছে যেতে ইচ্ছে হলেও পরে ভয়ে পিছিয়ে আসল। ভয়টা তেমন কিছু না। মানে বাস স্ট্যান্ডে একা একা জিন-পরীরাই থাকে, এই জাতীয় পূর্বধারণাই তাকে ভয়ের ভেতরে ফেলে দেয়। কিন্তু সে এই ঘটনা এড়িয়েও যেতে পারছে না। এত রাতে একটি মেয়ে কাঁদছে, লোকজন তেমন নাই, যারাও আছে, তারাও কেউ এই ঘটনায় এগিয়ে যাচ্ছে না। আমার কাছে মনে হল মানে গল্পকারের কাছে মনে হল করিমের যাওয়াই উচিত। মানে আমি নিয়ে গেলাম বিষয়টা এরকম নয়, করিমই মেয়েটির কাছে গেল। তারপর যা ঘটল, তাতে আমার বিন্দুমাত্র হাত ছিল না। মানে গল্পকার হিসেবে আমারও ধারণা ছিল না যে রাতে অনেক বাস স্ট্যান্ডে মেয়েরা এরকম কান্নার অভিনয় করে ছিনতাইয়ের মত কাজ করে। করিম দেশের বাড়ি থেকে এই মাত্র ঢাকায় ফিরেছে মানে বাস স্ট্যান্ডে নেমেছে। এর মধ্যে এরকম একটি ঘটনা ঘটবে কে জানত। আবার একমও নয় যে করিমের ঢাকায় কোনো আত্মীয়-স্বজন আছে, ছিনতাইকারীরার তাকে সর্বস্বান্ত করলেও তাতে করিম খুব একটা সমস্যায় পড়বে না। কিন্তু ঘটনা যেটা ঘটল, করিম সর্বস্বান্ত হল। মেয়েটির কাছে যেতেই কয়েকজন ছেলে তাকে ঘিরে ধরল। বলল- কোনও কথা না বাড়িয়ে সব কিছু দিয়ে চলে যেতে। তা না হলে এই রাতে এখানেই মরে পড়ে থাকতে হবে। এত রাতে কেউ তাকে বাঁচাতেও আসবে না। আর এখানে যারা আছে, সবাই তাদেরই লোক। চিল্লাচিল্লি করলেও কাজ হবে না। আমার অবশ্য একবার মায়াও হল। ভাবলাম বেচারা করিমের ঘারে এরকম একটা ঘটনা কি না ঘটালেই নয়। কিন্তু গল্প কি আর গল্পকারের কথা মানে। মানে করিম সর্বস্বান্তই হল। যা নিয়ে এসেছিল, এমন কি ঢাকায় এসে করিম যার বাড়িতে গিয়ে ওঠবে, সেই টাকাটাও নিয়ে নিল। এত দূর হেঁটে হেঁটে এখন করিম কিভাবে সেই বাসায় যাবে, আর বাসে ঢাকায় চড়ে গেলেই হয়, জায়গা চিনতে হয় না। কিন্তু এখন তো করিমের হাঁটতে হবে। হেঁটে হেঁটে চিনে করিম কি আর সেই বাড়িতে যেতে পারবে? আসলে পারবে না।

অধ্যায় - ২

করিম  পারল না। মানে হাঁটতে হাঁটতে করিম সাভার বাস স্ট্যান্ডের মানে কাঁচাবাজারের পাশের একটি রাস্তা ধরে চলে এসেছে রাজা হরিশ্চন্দ্রের ঢিবিতে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে করিম ঢিবিটির এক পাশে গিয়ে বসল। হঠাৎ সে দেখতে পেল একজন লোক এত রাতে ঢিবির পাশ দিয়ে হাঁটছে। তার শরীরের পোশাক থেকে এত ঘন কালো রাতেও নানান রঙ ঝলমল করছিল। করিম একটু ভয় ও সংকোচের সাথেই তার কাছে গেল। যাওয়া ছাড়া আর উপায়ও ছিল না করিমের।
কারণ এত রাতে কোনও মানুষ খুঁজে পাচ্ছিল না করিম। আর কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে, কি করবে এই জাতীয় প্রসঙ্গ কার সাথে আলাপ করবে সেই সিদ্ধান্তও নিতে পারছিল না। করিম প্রথমে ভেবেছিল লোকটি দরবেশ টাইপের কেউ একজন হবে। এবং এই লোকটিই সত্যিকার অর্থে তাকে সাহায্য করতে পারবে। করিম কি বলবে কি বলবে এরূপ ভাবতে ভাবতে লোকটিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল- আপনি যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। লোকটি বলল- কর। করিম বলল- আপনি এত রাতে এখানে পায়চারি করছেন। আপনার ঘরবাড়ি নাই। লোকটি বলল- ঘরবাড়ি। সবই তো আমার ঘরবাড়ি। এটাও আমার ঘর। তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পার নি। আমি রাজা হরিশ্চন্দ্র। কি হয়েছে তোমার বলতে পার। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। করিমের কাছ থেকে হরিশ্চন্দ্র সমস্ত কাহিনী শোনার পর বললেন এবার আমার কথা শোন
ইন্দ্রের সভায় নাচার সময় তাল কেটে একবার এক নর্তকী অভিশাপ পেয়ে এলেন মর্ত্যে। মর্ত্যে এসে সে বিশ্বামিত্রের তপোবনে রোজ ডাল ভাঙত। তাই দেখে একদিন মুণি ফাঁদ পেতে রাখলেন। যথারীতি পরের দিন এসে সেই নাচুনি ধরা পড়ল ফাঁদে। সেদিনই আবার আমি বনে শিকার আসি। মেয়েগুলো আটকে আছে দেখে আমি ছেড়ে দেই। সকালে বিশ্বামিত্র এসে দেখেন হ্যাঁ, কেউ তো বাঁধা পড়েছিল তার ফাঁদে, কিন্তু কেউ একজন তা মুক্ত করে দিয়েছে। খবর নিয়ে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি বললাম, দেখুন মুণি, আমি তো রাজা, সবার ভালো করাই আমার কাজ-তাই ওই মেয়েটা মুক্তি চেয়েছে বলে আমি তাকে মুক্তি দিয়েছি। আমি তো জানতাম না, সে যে আপনার শিকার। আমার তেমন দোষ নেই। মুণি বললেন, তোমার কাছে মুক্তি চাইল আর তুমি দিয়ে দিলে? আমি তোমার কাছে যা চাইব তা তুমি দিবে? মুণি তখন আমার কাছ থেকে রাজ্য চেয়ে বসেন। আমি আমার অযোধ্যা রাজ্য কিন্তু দিয়ে দিয়েছি। এখন নিজেরই আর থাকার জায়গা নাই। সেই থেকে আমি এভাবে ঘুরে বেড়াই। তোমার আর আমার ঘটনার মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নাই। পার্থক্য একটাই, আমি মুণির ফাঁদে পড়েছিলাম আর তুমি ছিনতাইকারীদের ফাঁদে। তাতে কি। তোমার যদি কোনও আপত্তি না থাকে তো তুমি আমার সাথে থাকতে পার। সেই দিন থেকে করিম হরিশ্চন্দ্রের সাথে থাকতে শুরু করল।