রঙপালকের ডাকে
হলুদ আলোমাখা একটা বিকেল কিশোরীর লাল সালোয়ার কামিজে রঙ
বুলিয়ে গেলে সে শেষবারের মতো লিখে রাখতে চায় রঙের কথা। শুধু কী সালোয়ার-কামিজ, রঙ পরশ
বুলিয়েছে কিশোরীর সর্বাঙ্গেও। বারবার সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সেই স্পর্শে, কখনও কলম
তুলে নিয়ে ভাবে, লিখে যাব এই বিকেলটুকুর কথা। হলুদ রঙে পেখম মেলে ধরাকে সে বন্দি করতে চায় আশ্চর্য কারুকাজময় রঙবিকেলের
শব্দে।
কিছুক্ষণ পর কিশোরীর চন্দ্র অভিযান। কিছু আঁকিবুকি কাটে সে
পাতা জুড়ে আর ভাবে লিখে যাওয়া পাতা থেকে এই বিকেলটা উঠে এসে তার চলে যাবার কথা বলে
দেবে,সবাইকে।
ধীরে ধীরে আলো মরে আসে। কিশোরী কলম থামিয়ে অপলক দেখে সে ম্লান
আলোয় সমস্ত ঘরে নৃত্যরত জলপরিদের আবছায়া। ঘোর লাগা চোখে অপার্থিব আলো খেলে, দূর
থেকে ভেসে আসে সুললিত সুর। কিশোরী বিমোহিত। সে ভাবে চন্দ্র অভিযানের এই তো সময়, জলপরিরা
বুঝি তাকে ডাকতেই এসেছে। আচ্ছন্নের মতো চেয়ারে ঝুলে থাকা ওড়নাটাকে সন্তর্পণে গলায় পেঁচাতে থাকে আর পরির হাত ধরার
চেষ্টায় সে ঘরের চারদিকে ঘুরপাক খায়। পরি তাকে ইশারায় ডাকে ঘর থেকে দরজার বাইরে..
সিঁড়ি পেরিয়ে সিঁড়িঘরে, সিঁড়িঘর পেরিয়ে রেলিংবিহীন ছাদে, ছাদ থেকে ছাদের কিনারায়,
যার বাইরে পা ফেললেই অপেক্ষমাণ এক পুষ্পরথ। তাতে করে সে পাড়ি দেবে চন্দ্রপথ। স্বপ্নাবিষ্ট
কিশোরী তার ডান পা-টি মেলে ধরে শূন্যে ভেসে থাকা পুষ্পরথের দিকে।
আচমকা হাওয়া ওঠে তখনই আর পাশে এসে দাঁড়ায় এক ছায়ামূর্তি, তার
সহোদর। বজ্র কঠিন দু’হাত কিশোরীর কাঁধ খাঁমচে ধরলে তার পুষ্পরথে পাড়ি দেবার
সম্ভাবনা বিনষ্ট হয় আর সেই ক্ষোভে কিশোরী কামড়ে দেয় সহোদরের হাত। আঁচড়ে দেয় তার বুক,
মুহূর্তে সে যেন অশরীরী শক্তির অধিকারী। সহোদর সমস্ত সামলে নেয় শান্তভাবে। অবশেষে
হার মানা নিঃশেষিত শক্তিটুকু দিয়ে আর্তস্বরে সে জানায় তার ভ্রমণ পরিকল্পনার কথা।
ততক্ষণে পাঁজাকোলা করে ভাই তাকে নামিয়ে এনেছে ঘরে।
ঘরে নেমে এসেছে মানসিক বৈকল্যের রাত। ওষুধের ওভারডোজে তার
চোখ ঢুলুঢুলু, দ্রুত। বোনের জন্য শঙ্কিত ভাই সদা যত্নবান মা-কে তার বেখেয়ালিপনার
জন্য ভর্ৎসনা করতে করতে ফোন করে মনোচিকিৎসকের নাম্বারে।
অস্থির মা তখন এলোমেলো পা
ফেলে এঘর ওঘর করে আর বিনবিন করে কাঁদে। মেয়েটা তো তার সুস্থ হয়েই উঠছিল ক্রমে,
নিজের ভেতর থাকলেও টুকটাক কথা বলত, ছবি আঁকত, গুনগুন করত.. এমনকি নিজে হাতে ওষুধ
খেতেও শিখেছিল। সময়মতো হাতে ওষুধ তুলে দিলে নিজেই খেয়ে নিত। ঘরের বাইরে একা একা
যেত না কখনও। তাহলে ভুল হলো কোথায়...
কোথাও কোনো চিহ্ন! কিছুই তো
পড়ে নেই কিশোরীর হঠাৎ ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠার পিছনে। মুখে নানা প্রশ্নচিহ্ন তুলো এবার
ওরা খুঁজতে থাকে চিহ্ন।
সাদা বৃত্তের আসল রহস্যটুকু
চাপা পড়ে থাকে পড়ার টেবিলের বইয়ের ফাঁকে, পেনহোল্ডারের ভেতর আর ফুলের টবে...