গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

দুটি গল্প - কাশীনাথ গুইন ও সীমা ব্যানার্জী রায় এবং একটি রম্য রচনা - রেজওয়ান তানিম


নবজীবন
কাশীনাথ গুইন
                                           (১)

সমুর জীবনে আচমকা ধ্বস - ভূমিকম্পের পর যেমন হয় আর কি । বাড়ীর উৎসাহে ছোটবেলার খেলার সাথী সুমি যেদিন ওর ঘরণী হয়ে গেল তার তিনদিন পরে ওর বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হল। বারো ক্লাসের রেজাল্টের আগেই একটা চাকরী নিয়ে সমু শিল্পাঞ্চলের মেস বাড়ীতে উঠল। সারা সপ্তাহের ক্লান্তি ভুলে যেত সমু যখন শনিবারের রাতে সুমির মুখটা তার পাঁজর ভিজিয়ে দিত। মেসের ছাদে বসে  লুকিয়ে লেখা কথামালা সুমির হাতে গচ্ছিত রেখে নির্ঘুম ভোরে বেরিয়ে আবার কাজ আর মেস জীবন। আটবছুরী এই জীবনে সুমির চাপাকান্নায় বাধানো রোগটা তাকে পৌছে দিল শিল্পাঞ্চলের হাসপাতালে। রোগমুক্তির কটাদিনের স্বামীসঙ্গ স্মৃতি আঁচলে বেঁধে আবার আগের জীবনে তিনবোনকে পাত্রস্থ করা,প্রতিবন্ধী ভাইয়ের দায়িত্ব পালনের  শপথ পালন করতে সমুর-কেটে গেল আরও সতেরটা বসন্ত বাবার মৃত্যুর পর মা আর ছোটভাইকে নিয়ে বাসা-ভাড়া করলো। দুবছর পর সুমিকে আর ছোট্টটাকে আনল স্কুলে ভর্তির জন্য। আর দুবছরের মাথায় আর একটা ছোটু এলো । জীবনের স্বাদ বদলে গেল যান্ত্রিক জৈবিকতায়। কর্তব্যের জালে আটকে ভালবাসার হাসফাঁসুনী শুনতেই ভুলেছে ওরা। দামোদরের অনেক জল লোণা সাগরে মিশলো। চুলের রূপোলী রেখা মন-দুটোকেও মরচেতে ঢাকলো। ত্রিশবছর পাশাপাশি লাশের মত দিনযাপনের গ্লানি ওদের অমোঘের পথেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল আবার একটা ঝোড়ো হাওয়া- কালবোশেখীর রাতে সমু একটা আশ্রয়ের ঠাঁইয়ের নীচে। বাজ পড়লো কাছেই-হঠাৎ আলোর ঝলকে হাতবাড়ানো দূরে যাকে দেখে চমকে গেল সমু তাকে যেন খুব চেনা মনে হল। আলাপ করিয়ে দিল  ওই আঁধারী দুর্যোগ। তারপর প্রলাপ বাড়তে থাকলো স্বনিয়মে সুমির অজান্তে সমুর বনলতা মনে হল তাকে। সুমির নিখাদ ভালবাসাকে কণামাত্র অসম্মান না করে সমু তার বনলতার পুজোয় মেতে নিজের কাছে নিজেকে সৎ রাখার চেষ্টা করেলও সময়ের হাতে মুক্তি মেলেনি তার। ছন্দপতনের ধাক্কা দুজনের মনের বরফ গলিয়ে অকাল বন্যায় নদীর কূল ভেঙ্গে,ভাসিয়ে দিল শরীরের মরচেও। ওরা ফিরলো তিন দশক আগের বাসরঘরে মনের দরজা ভেঙ্গে-যেখানে পরে থাকা মালার দড়িতে আবার টাটকা রজনীগণ্ধার নেশা
                                   (২)
তিন দশকের জমে থাকা অতৃপ্তি নিয়ে বাঁচার অবসানে জীবনটা বদলে গেল সুমি আর সমুর প্রৌঢ়ত্বের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ওরা নতুন করে চেনা শুরু করলো একে অপরকে। নিজদের আবিষ্কারে নিজেরাই হতবাক ওরা। মনের জোয়ারে ভেসে যাওয়া দুটো প্রাণ নতুন করে আবার শরীরী আশ্লেষে টের পেলো অনেক না পড়া রচনা ওদের সামনে খোলা পড়ে আছে। রাতের ভেজা রজনীগন্ধায় প্রাণ পাওয়া দুটো মানুষ- মানুষী আজ যেন অন্য কেউ। মনের সাথে পাল্লা দিয়ে ওদের শরীর দুটোও কী বিভ্রমে যেন যতি মনতে চায় না আর - এতদিনের পাওনা কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে চাইছে। কোন শাসন-বারণ শুনতে চায়না লাশের বুকে ফোটা ফুলের নেশা। বেশ কটা দিনের এই নেশা ওরা আস্তে আস্তে কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে চেয়েও পারলো কই ! সমু চাইলো এই জিওনকাঠির উৎসের সন্ধান সুমিকেও দিতে কমা সেমিকোলন সমেত তার বনলতার কাহিনী শোনাতে দ্বিধা আসেনি সমুর নিষ্কলুষ মনেসুমিও চেনে তার জীবনসাথীর প্রতিটা চুল ওর মনের কোণে কোন মেঘ না এসেও চোখে বাদল এসে গেল। সমুকে লোহার কাঠিণ্যে বেঁধেও ওর শান্তি মেলে কই । সমু সহপাঠীদের না বোঝা পাঠগুলো যে মুন্সীয়ানায় মগজে পাঠাত সেভাবেই সুমিকেও সেদিন বনলতার পাঠ বোঝাল আরও আত্মার গভীরতায়। এই মনের মানুষ খোঁজার কারিগরদের নানা গাথা গাইতে রাতের চোখেও ঘুম নেই। মেসের ছাদে লুকিয়ে লেখা প্রিয়া বিরহের কাব্যর পাশাপাশি আরও কিছু লিখতো সমু বেতারের প্রাত্যহিকীতে সেরার শিরোপাও ওকে ধরা দিত। সেই চুকে যাওয়া নেশায় শান পড়তে শুরু হয়েছিল বনলতার পাঠশালায়। সুমির আব্দারে এবার পদ্য ছেড়ে কঠিন গদ্যে হাত দিতে হল সমুকে লিখতে হবে পিছন পথের পাঁচালী। জানিনা সে নির্বাক চ্যাপলিনী ছায়াছবির দিশা কি হবে 


                                   (৩) 
বিকেলের পড়ন্ত আলোয় সুমির মনে পড়লো তাদের গ্রামের বাড়ির কথা। গোধূলীতে পাড়ার মেয়ে বউরা দল বেঁধে পুকুড় ঘাটে গিয়ে মনের কথা উজাড় করে গায়ে ঢলে পড়তো একে অপরের। তখন সপ্তহান্তে বাড়ী ফেরা সমুটা ওর অপেক্ষায় ছটফট করতো ঘরে। তারপর আঁধার নামা তক জল তোলপাড় করে দেহমন শীতলতায় ভরিয়ে ফিরে এসে রবিবারের সন্ধেগুলোর কথা আজও তার মনের মণিকোঠায় সযত্নে লুকোনো। ঘরে ঢুকতেই সমু ওকে বুকের আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে চাইলে জালে পড়া মাছের মত ও ছটফট করেও নিজেকে ছাড়াতে পারতো কি। ওই সুখটুকু সম্বল করেই তো সপ্তহের বাকী দিনগুলো মনের অতলে শরীরের চাওয়াটাকেও বলি দিতে হত তাকে। এমনি করেই তার সতেরটা বসন্তের বলিদান আজ আর ও মনে রাখতে চায় না। কদিন আগে দুজনের দুজনকে আবিষ্কার ভুলিয়েছে মরা ইতিহাসের ক্লান্ত শোক। নতুন করে স্বামীর ভালবাসা জিতে সুমির আব্দার বেড়ে গেল অনেকটাই। সমুকে আরও নিবিড় করে পেতে চায় তার মন। বাঁধা গণ্ডীটা ছাড়িয়ে দূরে কোথাও ছুটে পালাতে চাইছে সে এখন। সেকথা বলার অপেক্ষায় সারাটা সপ্তাহ সেই পুরোনো অভ্যেসে পার করে রবিবারের বিকেলে তেমনি করে গা ধোওয়ার কথা মনে পড়লো সুমির। পুকুরঘাটের অভাবটা তাকে চানঘরেই মেটাতে হল। ফিরতেই সমুও হারয়ে ফেললো নিজেকে সেদিনের মতই। না, আজ আর সুমি জালে ধরা দিল না সেদিনের মত। সমুকে বলে উঠলো---আমার কিছু কথা আগে শোনো তুমি বলনাগো যা বলার। ---কথা দাও রাখবে।
বলেই দেখোনা গো। না আগে কথা দাও।--বলনা সোনা। আমি আর পারছি না গো। কথা দিয়ে কবে রাখিনি বলো তো সোনা। জানি তো তুমি খুব মন কাড়তে ওস্তাদ। কথা না নিয়ে আর ছাড়বো না কখনও - মনে থাকে যেন। বেশ বাবা। এবারতো বল। আমাকে একটা জয়গায় নিয়ে যেতে হবে,যাবে তো। কোথায় যাবে বলই না।সে আমি কী জানি। তুমিই বলনা- শুধু তুমি আমি কটা দিন নিজেদের মাঝে লুকিয়ে থাকতে চাই। যাবে নিয়ে।নিশ্চয় নিয়ে যাবো। কবে যাবে কোথায় যাবে বলনা। না না,ওসব আমি জানিনা- তোমার দায়িত্ব সব,তুমিই করো। বেশ সোনা তাই হবে। এখন আমার পাওনাটা তো আগে মেটাও। পাওনা মেটাতে সমুর দুহাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে সুমি হারিয়ে ফেললো নিজেকেহারিয়ে ফেললো না হারিয়ে গেল কে জানে…..
                                             (৪)

রবিবারের সকালটা সমুর বাজার-ঘাটে যথানিয়মেই কেটে গেল। জমিয়ে দুপুরের ভোজপর্বের পালাও চুকলো বেশ। বিকেলে সুমি চানঘরের পালা চুকিয়ে আয়নার সামনে সেই যে বসলো ওঠার আর নামটি নেই। অধৈর্য সমু অকারণ পায়চারীতে অনেকবার সামনাসামনি হয়েও সুমির মুখোমুখি হতে পারলো না। চুঁইয়ে পড়া  বিকেলের রোদটাও ফ্ল্যাট বাড়ীটার ওপারে লুকিয়ে গেল তবুও সুমির মুখ আঁধারী আয়নার মুখোমুখি বসে কোথায় হারালো সে! সমু এই প্রথম এমন দৃশ্যের মুখোমুখি। না ডেকে পারলো না আর…..এই একটু চা খাওয়াবে। নিরত্তর সময়টা কালবোশেখীর পূর্বাভাসের মত মনে হলেও কারণটা সমুর বোধগম্য হল না। এই কদিনে ওদের সম্পর্কের জোয়ারে এমন অচেনা ভাঁটার মুখোমুখি হওয়াটা মনে কুডাক দিল সমুর। অন্য রবিবারে এই বিকেলী প্রসাধনে ও সুমিকে যে জ্বালাতনটা করতো সেটাই বা আজ গেল কোথায়! সুমির পিছনে দাঁড়িয়ে আলতো করে ওর কাঁধে হাত রাখল সমু ,বন্দী করতে দ্বিধা এল কেন সেটা ও নিজেও বুঝলো না। মুখের সামনে এসেও ঠোঁটের সমনে গিয়ে থামল কেন ! দুটো পাহাড়ী চোখে অকালবর্ষার প্লাবনে ঠোঁটের কূল যে ছাপিয়েছে তখন। কিন্তু কেন ? না,আর উত্তরের অপেক্ষা নয় বুকের খাঁচায় বন্দী সুমি ফুঁপিয়ে চলে আর পাঞ্জাবীর পর্দা পেরিয়ে তা সমুর অন্তস্থলে আছড়ে পড়ে। কেমনে রোধ করবে এ জলধারা ভেবে না পেয়ে সমু ঠোঁটদুটোই সম্বল করল । অনেকটা সময় বাদে
সুমির ভেজা গলাটা ককিয়ে ওঠে….কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না বলো। -বলো-বলো । ….আবার ওর গলা ভিজে গেল। সমু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বিছানায় টেনে তুলল সুমিকে। আদরে সোহাগে শান্ত করে যা জানলো তাতে অবশ হয়ে পড়লো নিজেই। একটা চিঠি যা প্রাপকের কাছে না পাঠিয়েও রেখে দিয়েছিল সেটাই এই ছন্দপতন এনেছে। চিঠিটা এমন ঘটাবে এমনটা ভাবনি কখনও সমু। আজ রাতে জল অনেক গড়াবে ভেবেই সমু নিজেকে এখন একটু গোছাতে বসল একাকী আঁধারে ….
                                    (৫)  

রাত বাড়ে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে সমুর কপালের ভাঁজও। একটু পরেইতো কথামত সুমিকে ওই গোপন চিঠির ব্যাখ্যাটা শোনাতে হবে। কি বলবে এখনও তো কিছুই ভাবা হল না। অস্থির সমু ছটপট করতে করতে পাড়ার মোড়ের দোকানে গিয়ে বহুদিন পর একটা সিগারেট ধরিয়ে বসল কালভার্টের শানে। ভাবতে ভাবতে আঙ্গুলে ছাঁকা লাগতে হুঁশ ফিরল সমাধান মিলল না। কি সাফাই দেবে সুমিকে ওই গোপন চিঠির। শুধু বনলতাকেই জানাবে ভেবে চিঠিটা লিখেও তা আর পাঠায় নি – কাউকে বিড়ম্বিত না করার জন্যই চেপে গিয়েছিল কিডনির অসুখটা। কিন্তু এখন কি করে ও।সুমি হেঁসেলের কাজ সেরে মুখে আঁচল ঘষতে ঘষতে ঘরে ঢুকে বরকে পাথরের মত বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হল বৈকি !যে মানুষটা ওর কাজ শেষ হতে তর দেয় না সে যেন এতদিন ওকে দেখতেই পায়নি। হলটা কি !..কিগো কোথায় হারালে তুমি । ফাঁকি দেওয়ার মতলব করছো বুঝি আমাকে ফাঁকি কোনদিন দিতে পেরেছো তুমি।
সেই আঠার বছরে বেঁধেছি তোমায় আর আজ দেবে আমাকে ফাঁকি। ভাবলে কি করে।
নিরুত্তর সমু তাও। সুমি ছদ্ম রাগে সমুকে ধাক্কা দিতে গিয়ে নিজেই ধাক্কা খেল। সমুর দুচোখে বন্যা দেখে চমকে উঠল সে। কোন কথা না বলে একগোছা প্রেশক্রিপশান সুমির হাতে তুলে দিল। ভাল কোন কিডনি হাসপাতালে যওয়ার পরামর্শও সাথে। হতবাক সুমি সব বুঝে জড়িয়ে ধরলো সমুকে বুকের মাঝে এতদিন যে নিজেই আশ্রয় খুঁজত কারও আড়ালে সেই হয়ে উঠল আশ্রয়ের আধার। মেয়েরা আর মায়েরাই বোধহয় পারে এমনটা।আরে ! বোকার মত করছটা কী, আমি আছিনা কিচ্ছু হয়নি তোমার। কথা দিয়েছ না বেড়াতে নিয়ে যাবে,কালই টিকিট আনা চাই ভেলোর যাব আমরা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা কর। বলেছি না আমরা কটাদিন একা কাটাব। যাও চোখ ধুয়ে এসে পুরুষমানুষ হওগো বীরপুরুষ। আমাকে আর রাগিয়ো না কিন্তু। রাত জাগতে পারবো না আর।অবাক সমু কলঘরে গিযে ভেবে পেল না একোন সুমিকে দেখল আজ। কত ভুল ভেবেছে ও। সুমির মধ্যে কত অভাবই না দেখেছে এতদিন। অতৃপ্তি নিয়ে খুঁজে বেরিয়েছে মনের মানুষ বনলতাকে । মরূদ্যানের আশায় মরুভূমির তৃষ্ণায় কাঁটাগাছ চিবিয়ে দুই কষ বেয়ে ঝরা নিজের রক্তকে পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছে। কেমন সব ভোজবাজীর মত মনে হল ওর।

(৬) 
ভোজবাজিইতো! কোন যাদুতে সুমি এতখানি মনের জোর পেল তা ভাবার সুযোগও পেল না সমু। সুমি টানতে টানতে বরকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে রাতের রজনীগন্ধ্যা সেজে আবেশে ঘুমের দেশে পৌঁছে দিল। আর নিজেকে আটকাতে পারলো না সুমি। এতক্ষণে বুকের উপর চাপানো পাষাণটা নামানোর অবসর পেল যে পাষাণের স্নেহধারা তুষারের বিন্দু হয়ে দুগাল বেয়ে যেন সিন্ধু হল । গুরু গুরু গর্জন আটকানোর উপায় ওর ছিল না। ভগবানের কাছে দরবারে বসল সে। ফোঁপানো স্বরটা আস্তে আস্তে গর্ভিণী সাপিনীর মত তীব্র জিঘাংসায় জ্বলে উঠতে চাইল।..ওগো ভগবান, তুমি যে দয়াময় এই কি তার প্রমাণ দিলে। দায়িত্ব-কর্তব্যের এতগুলো বছরেও কি তোমার পরীক্ষা শেষ হল না। আজ যখন বুকের ধন ফিরে পেলাম তখন আবার খেলতে চাইলে আমার সাথে। আমিও দেখবো – আর সইবো না। ভেব না। চোখের জ্বলের পূজো আর তোমার জন্য নয়। এসো তুমি আজকের আমি আর তোমাকেশুধু তোমাকেই নয়, ভালবাসার কোন শত্রুকেই ভয় পায় না। এই লড়াইটা আমি একাই লড়বো দেখে নিও তুমি।
চোখের জল শুকিয়ে যেতে নিজেকে নিজেরই অচেনা মনে হলেও খুব সুখী আর সাহসী মনে হচ্ছে সুমির। এইলড়াইটা লড়তে নেমে আজ ওর নিজেকে একটা আস্ত নারী মনে হল। ভাবতে অবাক লাগে ওর এতদিনের লজ্জাবতীর মত ভালমন্দ না বুঝেও চোখ বুজে ফেলার সেই মন্দ স্বভাবটা। তাই কী এতদিন ও সমুকে কাছে পেয়েও এতটা নিজের করে পায় নি। নিজেই টের পেয়ে গেল সমু কেন মনে মনে রাতের আঁধারে তার মানসী, তার বনলতার খোঁজে পথ হাঁটতো দারুচিনি দ্বীপের ভিতর। ওর এই আত্মদর্শনে মনের মেঘ পালকের মত উড়ে যেতেই ঝলমলানো আলোয় নিজেকে গন্তব্যের পথে হাঁটতে দেখলো আজ।
সুমির কাছে এখন উত্তরটা চোখের সামনে। নারী-পুরুষের একে অপরকে বুঝতে ভুল হওয়ার কারণ বোধহয় এটাই – নিজের আসল চাওয়া পাওয়া সমেত আস্ত নিজেকে খুঁজে না পাওয়া আর তার জন্য যে বসে আছে তার ডালির ঢাকনাটা সরাতে না পারা। পর্দাটা সরেছে বলেই না আজ ও এত সাহসী। এতদিন বেকার কষ্ট পেয়েছে নিজর ভালবাসার মানুষটার কাছে নিজেকে অ-দামী দেখে। মনে হত ওকে তরল ভেবে এপাত্র্ ওপাত্রে ঢেলে পরখ করছে পুরুষটার কঠিন প্রাণ। আজ বুঝলো বেচারা ওর কঠিন খোলটা ভাঙ্গতে পারেনি বলেই দেওয়ালে মাথা ঠুকে নিজেকে রক্তাক্ত করে এই কঠিন রোগটা বাধিয়েছে। আজ তাই প্রায়শ্চিত্তের এ লড়াইয়ে উড়িয়ে দেবে সব ছাই আনবেই মেঘের ফাঁকের রোশনাইটার ঘাড় ধরে।
                                               (৭) 

কাল সকাল উঠেই সুমি আজ স্নান সেরে এলোচুলে পিঠে ভরিয়ে রান্নাবান্নায় বসেছে। এ কাজটা সেরে সমুর অফিসের খাবার রেডি করে আজ নিজেই রিজার্ভেশানের পাটটা চুকিয়ে আসতে চায়। আর কোন বোঝা চাপাতে চায় না সমুর কাঁধে। কাজ ভাগাভাগির এই দায়টা আরও আগে নিতে চাইলেও পারেনি নিজের উপর বিশ্বাসের অভাবে। আজ ওর সেই সাহসের অভাবটা ঘুচেছে। রান্নাবান্নার ঝক্কিটা সামলানো হল তাও উঠতে না দেখে সমুর ঘরে ঢুকে ওর কপালে হাত রাখতেই সুমি আটকে পড়ল
বরের খপ্পরে। .. জেগে জেগে আর কড়িকাঠ গুণতে হবে না যাও মুখ ধুয়ে চা খেয়ে উদ্ধার কর। বাসিমুখের প্রেম আর ভাল লাগে না বাপু। আমার কাজ আছে মেলা।অগত্যা সমুকে উঠে বেরোতে হল। সুমি খাবারদাবার সাজিয়ে ঢাকা দিয়ে বেরোনোর সাজে। অফিসের প্রস্তুতি নিয়ে সমু খেতে বসে বউয়ের সাজ দেখে জিজ্ঞাসার চোখে তাকল। ..আমায় একটু বেরোতে হবে। একসাথেই যাই চল।
সমু আর প্রশ্নের অবকাশ পায়নি। বাসন গুছিয়ে রান্নাঘরে গেল সুমি তাড়াহুড়ো নিয়ে। সমুকেও বেরোনোর তাড়ায় চুপ করতে হল। দুজন একসাথে পথে হাঁটল নির্বাক ছায়াছবির চরিত্র হয়ে। বাস ধরে দুজনে দুরাস্তায়। রাতে খাওয়ার পর সুমির বেরোনোর কথাটা জানার চেষ্টা করার কথা ভেবেছিল সমু। হাত ধুয়ে আসতেই টেবিলের খামটা নজরে এল। খুলে দেখে দুজনের ভেলোর যাওয়ার টিকিট। অবাক হওয়ার তখনও কিছু বাকী সুমির হাতের দিকে তাকয়ে। অদৃশ্য বালাজোড়ার ইতিহাস এতক্ষনে মাথায় এল সমুর। টাকার জন্য দেরীর ব্যাপারটা টের পেয়ে শখের গয়না এমেয়ে এমনকরে বিসর্জন দেবে সমু ভাবেনি।
মেয়েরা কখন কি ঘটাতে পারে তার আন্দাজ পাওয়া বুদ্ধিমান পুরুষেরও ধারনার অতীত ভেবে নিজের অক্ষমতা – আর্থিক পরাধীনতার গ্লানিতে দগ্ধ হতে থাকল। অফিসে পি.এফ. অ্যাডভ্যন্সের আবেদন নামঞ্জুর হওয়ার কথাটা জানাতে ওর বেধেছিল। আন্দাজে কিছু বুঝেই সুমি কাণ্ডটা ঘটিয়ছে তা বুঝল। কতখানি মনের টান থাকলে মেয়েরা এমন করে তা আজ ওর বোধের দুয়ারে কড়া নাড়তেই মোচড় খেয়েও মনটা আনন্দ আর ভালবাসায় চোখ ভিজিয়ে দিল। রাতের রজনীগণ্ধ্যার ভিজে মিষ্টি গন্ধটার অপেক্ষায় সমু জানিনা আর কত রাত জেগে রইবে।
                               (৮)
ভোরে উঠেই আজ সমু কলকাতা বেরিয়ে গেল অফিসের কাজ আর টুকিটাকি কেনাকটার জন্যে-বাইরে বেরোনার তাগিদে। মনটা কিছুতেই সুমির গয়না বেচে বাইরে বেরোনোর খরচ জোগাড়ে সায় দিচ্ছে না । এখন আর ভেবে লাভও কিছু নেই অগত্যা কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম ।সমু সব কিছু মিটিয়ে রাতে বাড়ী ফিরল ক্লান্ত হয়ে । সুমিও ওকে আজকের মত বিশ্রামের সুযোগ দিল । কাল সকালের জন্য মনটকে বেঁধে রাখল সে।সকালে সুমির জলখাবার তৈরীর পর সমুকে ডাকার কথা মনে পড়ল।সমু তখনও বিছানায় শুয়ে-গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠল সুমি।গা যে জ্বরে পুরে যাচ্ছে একেবারে,সাড়াও দিল না সে।
পাড়ার ডাক্তারকে খবর পাঠিয়ে মাথায় জলপটী দিতে শুরু করল সুমি। ডাক্তারবাবু এসে কিছু ওষুধ আর পরীক্ষার প্রেস্ক্রিপশান লিখে গেলেন। পরীক্ষাগুলো করিয়ে সন্ধেবেলা রিপোর্ট দেখাতে গেল সুমি। রিপোর্ট দেখে ভ্রু কুঁচকে ডাক্তারবাবু সমুকে কলকাতার ভাল কোন কিডনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন দ্রুত।
পাড়ার ছেলেদের সাহায্যে দক্ষিণ কলকাতার এক নামী প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করে জানতে পারল ডায়ালিসিস্ শুরু হবে তখনই,রোগীর অবস্থা যে সুবিধের নয় তাও জানিয়ে দিল তারা।
সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকালে জানতে পারা গেল রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। সারাদিন পরিস্থিতি একই থাকল-করার মত বিশেষ কিছুই নাকি নেই। তবু আশার খুঁটি শক্ত করতে সুমি ছুটল কালিঘাটের মায়ের কাছে-তখনও ওর বুকভরা আশা, ওর ভালবাসা এমন করে শেষ হতে পারেনা।
কাল সন্ধে থেকে জল পর্যন্ত মুখে তোলেনি বেচারী।মায়ের প্রসাদ স্বামীর মুখে দেওয়ার পর তা মুখে দেবে ভেবেছিল কিন্তু পারমিশন মেলেনি। অনেক কষ্টে প্রসাদী ফুলটুকু মাথায় ছোঁওয়াতে পারল। একরাতেই সমুর মুখটা কেমন অচেনা মনে হল। তবে কি ওদের ভালবাসা ফিরে পাওয়ার এই পর্বটাই অভিশপ্ত!
পাড়ার ছেলেদের জেদাজেদিতে একটু জলমিষ্টি মুখে দিয়ে দিনটা কাটল সুমির। আর বেশী অপেক্ষা করায়নি সমু। সন্ধের শাঁখ এখানে শোনা গেল না। ডাক্তারের মুখের শেষ খবরটা শোনা গেল তখনই-রোগী আর বেঁচে নেই। অনেক দেরিতে না আনা হলে হয়তো বাঁচানো যেত। সুমি কি করে বোঝায় যে পাশে থেকেও সে বোঝেনি যে লোকটা এমন ভিতরে ভিতরে শেষ করে ফেলেছে নিজেকে। এমনি করে বিনা টিকিটেই সে কোন নতুন দেশে চলে যাবে একা তবু তার গয়নার বিনিময়ে তাকে সাথে নেবে না। এ
অভিমানের মানে খুঁজবে সে এখন বাকী জীবনটা ধরে।

এয়ারপোর্ট
সীমা ব্যানার্জী রায়


           
য়ারপোর্ট’ -এই কথাটার মধ্যে যেন একটা বিষাদ আর আনন্দ-এর ছোঁয়া লেগে থাকে। আজকাল আর লোপা দেবীর এই এয়ারপোর্ট নামের ওপরে একটা হতাশা এসে গেছে  নামটা শুনলেই একটা মাইল্ড স্ট্রোক-এর মতন হয় অথচ আগে কি ভালই না লাগত যখন প্রায়-ই এখানে ওখানে যেতে হত স্বামীর সাথে ১৯ বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন । কোলকাতায় ম্যান্ডেভিলি গার্ডেন্সে একটা ২রুম ফ্ল্যাট কিনেছেন বিদেশেই আছে দুই ছেলে আর ৩ মেয়ে। তারা পুরোপুরি সংসারী ওখানে এত বেশী একাকীত্ব সহ্য  করতে না পেরে দেশে ফিরে এসেছেন আজকাল এয়ারপোর্ট-এ যান প্রধানতঃ দুটি কারণে।  ছেলে মেয়েরা আসে। আবার তারা চলে যায় যেদিন আসে সেদিন হার্টের কথা ভুলে যান। স্বামীর গায়েও যেন যৌবন ফিরে আসে।  কেউ দেখলে বলবে না  যে, আট বছর আগে তার শরীরের অর্ধেকটা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। দুজনে মিলে এটা ওটা করেন। আর তিনি ছেলে মেয়েরা ছোটবেলায় কি কি পছন্দ করত তৈ্রী করতে শুরু করেন।  বড় ছেলে চুকচুকে ঘিয়ে ভাজা সুজির বরফি, ছোটছেলে মায়ের হাতের তৈ্রী সাদা চমচম ভীষণ প্রিয় ছিল। এই বয়সেই কলেস্ট্রলের ভয় ঢুকে গেছে তাই এই সব মিস্টি জাতীয় খাবার দাবারআভোয়েড করে। বৌমা নার্সিং-এ স্নাতোকোত্তর তাই চিনির উপর তার কড়া চোখ। মেয়েরাও আজকাল সব কিছুতেই ফ্যাট দেখে। তাও তো মায়ের মন...এ কদিন খেলে কিছু হবে না ভেবে সারাদিন রান্নাঘরে থাকেন।  হার্টের রোগীরা হয়ত বেশিক্ষণ আগুনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না।  বাড়ির কাজের লোকগুলোকে দিয়ে করানোতে তিনি রাজী ননছোট মেয়ের প্রিয় জিনিস চিংড়ি ভর্তা। অনেক করে পেঁয়াজ লবণ ঝাল আর সর্ষের তেল মাখানো ভর্ত্তা যত ঝাল ততই তার পছন্দ ভাজা মরিচ আর তেল মেশানো ছোলার চটপটি আবার মেজ মেয়ের প্রিয় জিনিস বড় মেয়ে আবার মায়ের হাতের এঁচোড়ের চপ খেতে খুব ভালবাসে একটা হাত একটু অচল হয়ে পড়েছে তাতে কি ? সেই হাতেই তৈ্রী করছেন সব খাবার চলে গেছেন নিজের  প্রয়াতা মায়ের কাছে কষ্ট করে মা-ও তো এমনি করে সখের জিনিসগুলো বানিয়ে রাখতেন বিদেশে থাকা ছোটমেয়ের জন্য।

মায়েরা বেঁচে থাকতে তাঁদের কষ্টের কথা আমরা কেউ ভাবি না,মনে মনে বিড় বিড় করে বলে উঠলেন ছেলে মেয়েরা ঘরে ঢুকতেই চলে আসে যাওয়ার দিনটা।  আসার দিনটা চোখের পলকে আসে না, শুধু যাবার দিনটাই আসে। ওরা বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দুয়ারে প্রস্তত হয় বিদায় নেবার জন্য। এয়ারপোর্টের বারান্দায় গিয়ে বাক্সবোঝাই গাড়িটা খালি হয়ে যায়। গাড়ী হালকা হয় কিন্তু মনটা হালকা হয় না মালপত্র চেক-ইন করার পর ওদের সঙ্গে ডিপোর্চার লাউঞ্জএ যান  দুবছর আর তিন বছরের দুই নাতি নাতনি সমস্ত লাউঞ্জ দাপিয়ে বেড়ায় কারুর গায়ে ধাক্কা লাগতে পারে সেদিকে হুঁশ নেই।  মা বাবা পেছন পেছন ছোটে, ঠিক আমাদের মতন এখন আমরা ছুটতে পারি না, শুধু এই মন, অন্ধ নির্বাক মন, কেবলি ছুটে বেড়ায়।

কিছুক্ষণ পর ওরা সিকিউরিটি চেকের দরজা পার হয়ে হাত নাড়তে নাড়তে ভেতরে
ঢুকে যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন দুজনে, একটা ক্লান্তি আর শূন্যতা ঘিরে থাকে দেহে আর মনে।  জীবনের আরো একটা অধ্যায় যেন শেষ হয়ে যায়। এই শেষ আর কোনদিন পূর্ণ হবে না। এই শূণ্যই থেকে যাবে অনন্তকাল। খালি গাড়িতে দুজণ নির্বাক পুতুল বাড়ি ফিরে আসেন।  মনকে সান্তনা দেন...বিদেশে থাকতে ওরা আসত মাত্র দীর্ঘ উইকএন্ডে থাকত দু দিন । তাও তো এখানে কিছুদিন থেকে গেল ; অথচ এই সেদিনও বাবা মাকে, শ্বশুর শাশুড়িকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। যাবার সময় বুকে জড়িয়ে থাকতেন কিছু সময় আর ফেরার সময় মায়ের মুখে আঁচলের খুঁটি আর বাবাকে এড়িয়ে যাওয়া, নয়ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা  তাদের ছেলে মেয়েরাও এখন ঠিক তেমনি এদিক ওদিক না তাকিয়ে ভেতরে ঢুকেযায় বিদায়কে বড় ভয় পান আজকাল  এই বিদায়-ই সব মা বাবাদের নিয়তি  ওরা থাকার জন্য আসে না, ফিরে যাবার জন্য আসে তারপর একদিন মা বাবা ছাড়াই বাড়ির লোকজনেরা আসেন এয়ারপোর্টে একদিন আমরাও পারব না আমাদের  ছেলে মেয়েদের আনতে বা বিদায় জানাতে , অনেক আধুনিক হয়ে গেছে আজকের মানুষ   আধুনিক হয় না শুধু মায়েরা , বাবারা তারা সেই একইভাবে এয়ারপোর্টে গিয়ে নিরিবিলি কোনায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন আজও, চোখের জল চোখেই শুকিয়ে যায়

রম্য রচনা

দিনান্তে
রেজওয়ান তানিম

র্ষা রো

                        খন আমার হাতে তেমন কোন কাজ নেই। বলা যায় একমুঠো নিশ্চিন্ত অবসর। এমন অখন্ড অবসর অমিত বাবুর জীবনে জুটেছিল কিনা নিশ্চিন্ত নই তাহলে এত ব্যাকুল হয়ে তিনি হয়ত বলতেন না-

দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর !
ভালোবাসিবারে
দে অবসর
             এই মুহূর্তে আমার এমনতরো সময় সংকট নেই। আমার মনে নেই কোন অতৃপ্তির বেদনা, কর্মের ব্যস্ত ঘনঘটা। তাই আজ মন খুলে চিকার করে গাইতে ইচ্ছা করছে-

আজ বিরাম নেব সকল কিছুর পর
আজকে আমার চির অবসর!
করবো রচন-
করবো স্বপ্নে চয়ন-
ভালবাসার অনন্ত বাসর!

বাইরে বৃষ্টি ঝছে। একটানা অবিশ্রান্ত বর্ষণ দৃষ্টি সীমায় আঘাত করছে সবকিছূ হয়ে আসছে ঝাপসা। কিছুটা ক্লান্ত লাগছে, শুয়ে পড়লাম বিছানায়। একটু তন্দ্রামত আসল। আমি হারিয়ে গেলাম স্বপ্নে ওই সময়ের কোন এক অজানা সাগরে। সে আমায় নিকট অতীতে নিয়ে গেল।
আমি আরো দূরে যেতে চাইছিলাম, কিন্ত সে সায় দিল না। কী আশ্চর্য- এখানেও বৃষ্টি ঝরছে। এখানে আমি - কারও একজনের আগমন অপেক্ষায় কাতর। কার আসবার কথা ? স্মৃতি মিলিয়ে দেখবার আগেই সে এসে গেল। সে আর কেউ নয়, আমার অতি পরিচিত এক সুহৃদ। তার নামটি না হয় অজানাই থাক।আমার সাথে সে গল্পে মত্ত হল। বিষয় অতি সাধারণ-বৃষ্টিতে ভিজবার গল্প। কিন্ত কী মুগ্ধ হয়ে সেদিন তা শুনেছিলাম-সে আজ বুঝতে পারছি।
             বৃষ্টির গল্প শেষ হলে পরে আরো দু ঘন্টা গল্প হল। দু একটা কাজের কথা হলেও বেশিরভাগই গুরুত্বহীন। তবু সে বাদল মুখরিত দিনের আড্ডা আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে ইল।
                                  
পূ র্বা

হঠা করেই কী এক সপ্তসুর কানে মধুর বাঁশরী সুর ঢেলে দিল। ঘুমটা চলে গেল-কিন্তু রয়ে গেল তার মধুর আবেশ। হাতে দিনলিপিটা তুলে নিলাম।হায় ! নিয়তি আজ আমার সাথে এ কী খেলা খেলছে- বুঝতে পারছি না কতগুলো পাতা নাড়াচাড়া করতেই বেরিয়ে এল সেদিনের অংশটুকু। দেখি তার পাতায় লেখা আছে আমার নিজস্ব কিছু গবেষণা-যাকে পূর্বানুমান বলা যায়-অথবা বলা যায়,মনোবিশ্লেষণ। পাত্র আর কেউ নয়- সেই বর্ষারোহিত ব্যক্তি। ডায়েরীর পাতায় লেখা আছে- মানসিকতা ঝরঝরে বাহুল্যহীনকথাবার্তা মাপা নয় তবে তাতে কৃত্রিমতার পরিমান খুব কম। চালচলন, ভাবভঙ্গি-আশাব্যাঞ্জক
             
ওর একটি অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে-হাসি। এটিই তার সবচেয়ে বড় গুন আবার সবচেয়ে বড় দোষ। হাসবার সময় মনে হয় সে জগতের সবচেয়ে সুখী। মাঝেমাঝে অবশ্য তা অনর্থক মনে হয়। তখন এ হাসি সন্দেহের উদ্রেক করে। হতে পারে-এ হাসি পরিবেশকে অতি লঘু করে ফেলে সবাইকে আপন করে নেবার জন্যে, অথবা সবার আপন হবার এ এক নিগূঢ় পন্থা। যাই হোক, আমার অবশ্য ভালোই লাগল ব্যপারটা। হোক না এ তার দোষ- অনর্থক হাসি। সেতো হাসি,কান্নাতো নয়। তাই সে শুদ্ধ। এমন দোষ থাকলেও ক্ষতি নেই।

আরেকটা কথাও মনে হচ্ছে ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে স্পস্ট করে সোজা বাংলায় বলি- যাকে বলে, জাতে মাতাল তালে ঠিক। অবশ্য তার একটা ব্যাপার আমার কাছে স্পস্ট নয়। সে হল তার প্রকৃতি। সেকি পর্বতের মত অটল,বজ্রের মত নিষ্ঠুর; না কী নদীর মত শান্ত,সাগরের মত বিশাল তার হৃদয়। এ বিষয়ে আমি দ্বিধান্বিত।
               -মন্দ নয়। আমার মন হেসে উঠল কল্পনার সফলতার মধুর জয়গানে। নিজের সঙ্গে নিজেই রসিকতা করলাম- বোধহয় জ্যোতিষী নেমে পড়লেও খারাপ হয় না

রি ত্রা লী

            ডায়েরীর পাতা বন্ধ করলাম। আজকের বাদল দিনে একটা গান না হলেই নয় স্টস্টিরিওতে ছেড়েদিলাম গান। বিশুদ্ধ বর্ষার গান-
                   
এই বাদলের দিনে
দাড়াও না হয় নিভৃত বাতায়নে;
খুঁজে পাবে আমারে,
ঝড়ো হাওয়ার স্পন্দনে, ঐ বাহুডোরে।
ছুয়ে যাব মনের মিনার
হব বাদল কিনার!
    
                
গানের সুরে আমি হারিয়ে গেলাম দূরে বহুদূরে। সেখানে কোন এক মেঘরাণী আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। সে আমার সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দেবার কথা বলছে। কিন্তু তার আগেই চলে এল তেজোদীপ্ত সূর্য। ভীষণ বেরসিক সে। অমিত তেজ তার তবু বিন্দুমাত্র সময় অপরের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি নয়। আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। ইত্যবসরে সে চলে এল।          
           
এসেই আমার হাতে একগোছা কদম ধরিয়ে দিয়ে বলল, শুধু কী জলে ভিজলেই হবে, বর্ষার প্রতীক এ কদম দানা লাগবে না ? আমি হেসে উঠতেই  সেও হেসে দিল। এরপর বদলে দিল গান –

তোমার দুয়ারে এসেছি প্রিয়তম,
হাতে ধরা সিঁদুর মম
রাঙাবে ঔ সিথির কেশরী ,
আমি বাজাব বর্ষার বাঁশরী।
তোমার হাতে নীপবিথীকার মালা  
দুলিতেছে আনমনে, ভুলিতেছে সুরবাণী।
           
আমি অবাক হয়ে গান শুনছিলাম। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলাম- কী ভীষণ মায়া তাতে! আমার ভাবনার জগতে তখন প্রচণ্ড তোলপাড়। সে কে ? কী বলতে চায় সে? কী তার মনের কথা। তার সব কথাই আমার জানা। তবু যেন সব নতুন নতুন মনে হয়

আমার মনের কথা বুঝতে পেরে হেসে বলল -আমি কে? তা জানা কী এতই সহজ! দেখ- আজতক আমি নিজেকে চিনিনি। আমি সহাস্যে বলে উঠলাম- কোন মানুষই মানুষকে চিনতে পারে। হয় তুমি আমাদের মানুষ বলে গণ্য করো না, না হয় তুমি মানবের উর্ধ্বেসে সলাজ কণ্ঠে বলে উঠল – না না, তা নয়। আমি অতি,অতি সাধারণ তোমাদের তুলনায় আমার স্তর অনেক নীচু। আমায় মানবের উর্ধ্বে বলে অপরাধী কোর না’ আমি ওর ইতস্তত ভাবটা দূর করবার জন্য বললাম-ওসব থাক। তার চেয়ে আমি তোমায় কেমন দেখেছি তাই বলি। সে হেসে বলে উঠল -বল দেখি। তোমার দেখায় আমি নিজেকে দেখি, তেমার চেনায় আজ নিজেকে আবার নতুন করে চিনি। আমি আবৃত্তি করতে লাগলাম-

অনেক ভাল তুমি,
সুরের মাঝে যেমন সুর সপ্তমী।
কিন্তু আবার কেমন খাপছাড়া-
মানতে চাওনা নিয়ম বাঁধাধরা।
উড়তে চাও নীলাকাশে-
দেখ যেই পাখি-উড়ে আর ভাসে।
কিন্তু ভুলে যাও হায়,
উড়ার ক্ষমতা দেয়া হয়নি তোমায়।
এ নয় দোষ তব-
মানুষ তুমি
কিছু আছে তোমার, কিছু সর্বগামী-
রেখেছে গোপন করে।
আজ তারে-
আনো বের করে।
অগমের পাড়ে-
যাবার মত শক্তি,সাহস-আ
ভালবাসা-ঐ বুকে বারবার
দোল খায়
বান ডেকে যায়-
অনিবার
তুমি বড় নিঠুর,
যেন মরু পথ বন্ধুর।
এ তোমার খেলা-
যত হয় বেলা, ভাসাও পাষাণ ভেলা।
তাতে কর যাত্রী-প্রিয় যত মানব তব!
ভাবনাই কোনদিন-
ধরণীর গহীন
ঐ ভবপাড়ে,
কি তোমায় ডাকতেছে হাক ছেড়ে!
আমি বলে যাই-
গেয়ে যাই
গলা ছেড়ে-
ভুলে যাও কল্পিত বেদনারে।
জীবনের স্বপ্ন সুখপাখিরে-
একদিন পাবেই খুঁজে।
তার গানে গানে
বাজবে আমার সুর

ক্ষ ণি ক বি দা য়


সে চলে গেল যাবার আগে তাকে কিছুটা বিব্রত দেখালো। তার মনে জেগে উঠেছিল কোন এক অজানা বেদনা। সে আমার দিকে চেয়ে ম্লান হাসি দিয়ে বলল- আজ আসি! আমি বললাম,“আবার কবে দেখা হবে?” সে বলল-কি জানি, হয়ত কাল,হয়ত এক হপ্তা বা এক মাস পর।
             
সে আমাকে একা রেখে বিদায় নিল। দীর্ঘ পনেরটি দিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি রাতে ফোনে কথা হয়নি এদিকে আমার মন ততদিনে বুঝতে পারল সেই সে আমার অস্তিত্বের সাথে কেমন করে যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি আর নিজেকে আলাদা করে ভাবতে পারছি না। আমার পৃথিবীতে কিসের যেন একটা ঝড় আসছে। সে ঝড় আমায় উড়িয়ে নিতে যেতে চাইলো। প্রথমে আমি বিক্ষিপ্ত ভাবে বাধা দিলেও পরে আর কোন বাধা দিলেম না। কারণ সে ঝড়ের তোড়ে উড়ে যেতে মন একান্তই চাইছিল যে ঝড়ে সে দিন উড়ে গিয়েছিলাম- তার নাম ভালবাসার ঝড়। জানি কেউ কেউ একে বাড়াবাড়ি, পাগলামি, খেয়ালি মনের খেলা বলে আঘাত করতে চাইবে। তাতে লেপে দিতে চাইবে অনন্ত রাত্রির কালি। কিন্তু আমি জানি এ ভালবাসা পবিত্র। এর নেই কোন কামনার উন্মাদনা, বাসনার সুরাপাত্র। সেআমার অন্তরের প্রবেশ করেছে বিশুদ্ধ ভালবাসা নিয়ে-যাতে মোহ ছিল না। তাই সে ঝড়ে ডুবে গিয়ে কাদঁলাম, আর গাইলাম

কাঁদালে তুমি মোরে-
ভালবাসারই ঘায়ে
নিবিড় বেদনাতে;
পুলক লাগে গায়ে।

প্র ত্যা র্ত

              আমার বিবেচনা বোধ যত শক্ত ভিতের উপরে দাড়িয়ে থাক না কেন, সেই বর্ষারোহিত ব্যক্তি -আমার ভালবাসার নিষ্ঠুরতার সম্বন্ধে আমি সজাগ ছিলাম না। আর তাই সে সুযোগ পেয়ে গেল। আমায় আঘাত করল। ভালবাসার আঘাত আশ্চর্য এই- সে আঘাতে আমি কোন বেদনা অনুভব করিনি কারণ আমি জানি,ভালবাসা বেদনারই আরেক রূপ। যাকে ভালবাসব-তার প্রতি সদা উদ্বিগ্ন থাকাই ভালবাসা। যুগে যুগে পৃথিবীতে যত অমর প্রেমগাঁথা রচিত হয়েছে-সবই সীমাহীন বেদনার ইতিকথা। তাই আমার এই নিগূঢ় প্রেম- সেও নিবিড় বেদনাময় তাকে এই বেদনার নীলে অবগাহন করিয়ে আমি বেদনাকে কাছে টেনে নিলাম, তার সুখগুলো অনুভব করলাম


সে এবার বুঝতে পারল বেদনার ভাষা। আমায় আলিঙ্গণে নিয়ে বলল- আমার ভুলগুলো তুমি ক্ষমা কর আর কখনো তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না। তোমায় না দেখে থাকা - এ আমার হবে না। কথা দিলাম, আর কোন দিন হারিয়ে যাব না। তোমার পাশে থাকব শেষদিন পর্যন্ত। মৃত্যুর দিনেও আমি তোমার পাশে থাকব- ছায়া হয়ে, পাতা ঝরা বয়েসী কোন অচিন বৃক্ষ হয়ে, গান ভুলে যাওয়া ক্লান্ত কোকিল হয়ে, দলে যাওয়া দূর্বাদল হয়ে, মাড়িয়ে যাওয়া সজনে ডাটা হয়ে, তৃষ্ণার্ত চাতক হয়ে, তোমার এ বেদনার স্বপ্ন গুলো হয়ে।


আমি তখন কিছুকাল আগেই জীবনে আসা সমস্ত বেদনাকে ভুলে গেলাম আমার কন্ঠ আবার সুর ফিরে পেল। প্রকৃতি যেন আমায় জাগিয়ে তুলবার জন্য তার বৃষ্টিতে রিমঝিম ছন্দের নাচন তুলল। আমি গাইতে শুরু করলাম। সেও আমার সাথে গলা মিলিয়ে গাইল-
আমারে তুমি অশেষ করেছ-
এমনি লীলা তব