গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৩

মুহসীন মোসাদ্দেক

আঁধারের আশীর্বাদ
রাইত ম্যালা হইছে মনে হয়, এইবার যাওন যায়।গাঁজায় লম্বা করে টান দিয়ে কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো টিপু। মাঘ মাসের মাঝামাঝি, ঘন কুয়াশায় হাত সমান দূরত্বেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর অমাবশ্যা আজ। এখন ঘন অন্ধকার সময়। ফাঁকা মাঠের ঠিক মাঝামাঝিতে বসে গাঁজা টানছে টিপু আর আয়নাল। রাতের এ ঘন আঁধার ভয়ঙ্কর, সর্বনাশের আধার। অথচ এ পরিবেশটাই খুব কাঙ্ক্ষিত ওদের। শীতের এমন রাতে পাড়া-গাঁ সন্ধ্যার পরই ঘুমিয়ে পড়ে। অমাবশ্যার আঁধার সেখানে বোনাস। তারপরও রাত গভীর হওয়ার অপেক্ষায় ছিল দুজন। , এখন যাওন যায়’
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই, সকাল-বিকাল-রাত সব বেলাতেই আয়নাল-টিপু দুজন দুজনের প্রিয় সঙ্গী। সেই হামাগুড়ি দেয়ার বয়স থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা, যতো কুকাম-সুকাম সব একসাথেই ঘটানো। তরুণ বয়সে প্রেমও হয়েছে একসাথে, বিচ্ছেদও। বিয়ে হয়েছে কাছাকাছি সময়ে পাশাপাশি গ্রামে। ব্যত্যয় ঘটেছে বাচ্চা হওয়াতে। প্রতিবছর আয়নালের ঘরে একটা করে বাচ্চা হাজির হলেও টিপুর ঘর শূন্যই ছিল। আয়নালের ঘরে গুনে গুনে তিনটা বাচ্চা হাজির হওয়ার পর টিপুর ঘরে একটা জুটেছে এবং ওই একটাই। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় টিপুর। একটাই বাচ্চা সে পেয়েছে, সেটা চির কাঙ্ক্ষিতছেলে। আয়নালের পরে আরো একটা হয়েছে। প্রথমটা ছেলে হওয়ার পর সব মেয়ে হওয়ায় ব্রেক মেরেছে আয়নাল। কলকে খালি করে উঠে দাঁড়ালো দুজন। আয়নাল চাদরটা গায়ের সাথে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। চাদরটা বিয়ের পর প্রথম শীতে দিয়েছিল শ্বশুর। কম করে হলেও এক যুগ পেরিয়েছে। জায়গায় জায়গায় ফুটো। চাদরের তলে হাফহাতা একটা উলের সোয়েটার, মায়ের হাতে করা। মা মরেছে সেই কবে! দিন-তারিখ খেয়াল নেই আয়নালের। সোয়েটারটাতে বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় উলের গিঁট খুলে গেছে। বার্ধক্যের ব্যারামে জর্জরিত সোয়েটারের তলে একটা ফুলহাতা গেঞ্জি পড়েছে আয়নাল। মাঘ মাসের মাঝামাঝিতে হাড় কাঁপানো শীতে ফাঁকা মাঠে এইটুকুই তার শীত নিবারণের সম্বল। টিপুর অবস্থা আয়নালের চেয়ে ভালো। ফুলহাতা সোয়েটার পড়েছে মোটা চাদরের তলে। চাদর-সোয়েটার কোনোটাই বেশি পুরনো নয়। মাঠটা গ্রামের বসতি থেকে বেশ দূরে। বিশাল ফাঁকা মাঠ। শীতের রাতে এরকম ফাঁকা মাঠে প্রচণ্ড শীত পড়ে। গাঁজাতেই কিছুটা রক্ষা হলো।

মাঘ মাসের মাঝামাঝিতে হাড় কাঁপানো শীতের রাতে যখন বৃষ্টির ফোঁটার মতো শিশির পড়ছে তখন ফাঁকা মাঠের মাঝামাঝিতে বসে থেকে রাত গভীর হওয়ার অপেক্ষা করা স্পর্ধাই বটে! আগুন জ্বালিয়ে যে কিছুটা উষ্ণতায় থাকবে তার কী উপায়! কোথাও কোনো লোক জেগে থাকলে এ উপস্থিতি টের পেতে কতোক্ষণ! শীতে ঠক ঠক করে কাঁপলেও সে ভাবনা আসে নি তাই ওদের। গাঁজার টান আর শরীরের উত্তেজনা যেটুকু উষ্ণতা দিয়েছে তাই-ই যথেষ্ট। কষ্ট করলেই না কেষ্ট মেলে! মাঝারি একটা বস্তায় সব যন্ত্রপাতি ভরা। মাঝারি দুইটা শাবল, ছোট ছোট কয়েকটা চাকুর সাথে গরু জবাই করা ধারালো চাকু, মোটা লম্বা দড়ি, লোহা কাটার করাত, ডুপলিকেট চাবির একটা গোছা, দুইটা হাতুড়ি, কালো কাপড়ের বড়সড়ো দুইটা রুমাল, ক্লোরোফরমের বোতল, কাপড়ের একটা পুঁটলি, মোমবাতিপ্রয়োজনীয় সবকিছু বস্তায় আছে কী না চেক করে নেয় আয়নাল। কখন কী কাজে লাগে বলা মুশকিল। এসব দেখা আয়নালেরই কাজ, বহন করাটাও। টিপু সবসময় আয়নালের ওপর লিডারগিরি ফলায়। কাজের সময় যদি দেখা যায় প্রয়োজনীয় কিছু নেই তবে সব দায় আয়নালের ঘাড়েই বর্তায়। আয়নালও টিপুকে হয়তো লিডার মেনেই নিয়েছে। তা না হলে তার ওপর লিডারগিরি ফলানোর সাহস টিপু পায় কীভাবে! সব ঠিকঠাক?’ লিডারের মতো বলে টিপু। , ঠিকঠাক।’ ‘, যাই তাইলে। একটু দেরিই হয়্যা গেলো মনে হয়!’ ‘নাহ, টাইম ঠিকই আছে। রাইত এখনো ম্যালা বাকি।চাদরটা ভালোভাবে গায়ের সাথে জড়িয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করে টিপু। বস্তাটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে আয়নালও।

ফাঁকা মাঠের মাঝ দিয়ে হাঁটছে দুজন। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে, দুই-একবার কুকুরের ঘেউ ঘেউও শোনা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে নিশিপোকার গান। এর বাইরে আর সবকিছু ঘুমন্ত। চুরি করার জন্য খুবই উত্তম পরিবেশ। কারো পায়েই স্যান্ডেল নেইশিশিরে ভিজে স্পঞ্জের স্যান্ডেলে পঁচ পঁচ শব্দ হয়। নৈঃশব্দ্য  নৈঃশব্দ্য তাদের প্রয়োজন। শিশিরসিক্ত শীতল ঘাস-মাটির ওপর দিয়ে তাই নগ্ন পায়ে যেতে হচ্ছে ওদের। উপায় কী!

আজ গন্তব্য বাবুলের বাড়ি। বাবুল বিদেশে আছে বছর দশেক। বহুত মাল কামায় নাকি বিদেশে। মাল যে ভালোই কামায় তার প্রমাণদশ গ্রামের একটাই দোতলা বাড়ি ওদের। বাসায় থাকে কেবল বাবুলের বুড়ি মা, বউ, সাত-আট বছরের একমাত্র ছেলে আর চৌদ্দ-পনেরো বছরের কাজের ছেলে। বিশাল বাড়িতে থাকে না আর কেউ। দুইদিন-চারদিন পরই অবশ্য বাবুলের শালা-সম্বন্ধিরা এসে খোঁজখবর নিয়ে যায়। বাবুলের সাথে তেমন ভাব ছিল না টিপু-আয়নাল কারোরই। পথে কিংবা হাটে মুখোমুখি হয়ে গেলে দু-একটা কথা কেবল হতো। তবুও চাচি, চাচিবলে ডাকতে ডাকতে একদিন বাবুলের বাসার অন্দরে হাজির হয়েছিল দুজন। অন্দর মহল সম্পর্কে অন্ধ থাকলে কাজ করা মুশকিল। মাল কোথায় আছে ঠাওর করতে করতেই রাত কাবার হওয়ার যোগাড় হয়। অন্দর মহল সম্পর্কে জ্ঞান থাকা তাই দরকার। পাকা চোর হলে অবশ্য আলাদা কথা, কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকেই ঘরের কোথায় মাল আছে ঠাওর করে ফেলে। বাবুলের বাসার অন্দরে প্রবেশ করা টিপু-আয়নাল কারোর জন্যই সমস্যা হয় নি। গাঁয়ের ছেলে, এক-দুইবার আসতেই পারে। তাছাড়া চোর হিসেবে এখনো খ্যাতি পায় নি কেউ-ই। বড় কোনো চুরিই তো কোনোদিন করে নি। ধারও পড়ে নি একদিনও। বড় বড় মোড়লের বাড়িতে চুরি করে এক-দুইবার ধরা পড়লে না নাম-ডাক হবে! বাবুলের সুন্দরী বউটা টুল এগিয়ে দিয়ে ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল খানিক দূরে। বুড়ি মা সামনে পিঁড়ি পেতে বসেছিল। কোলে ছিল নাতি। টিপু-আয়নাল চকলেট বাড়িয়ে দিয়েও কাছে টানতে পারে নি তাকে। দাদির কোলের চেয়ে নিরাপদ মনে হয় নি আর কিছুকে। আয়নাল-টিপু দুজনই আড়চোখে চেয়ে বাবুলের বউয়ের মুখ দেখার চেষ্টা করছিল। হালকা-পাতলা শরীরটা খুব মায়াকাড়া, কিন্তু মুখ দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। টিপু-আয়নালের আড়চোখে চাওয়া হয়তো টের পেয়েছিল বাবুলের বউ। হঠাৎ কোমর দুলিয়ে সে অন্দরে ঢুকে গিয়ে আয়নাল-টিপুর তেষ্টা অপূর্ণই রেখে দিয়েছিল

কথায় কথায় বুড়ি মার সাথে অনেক কথাই হয়েছিল ওদের। বাবুলের ইনকাম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। ঘুরে ঘুরে দেখা হয়েছিল পুরো অন্দর। শহরের মতো বাউন্ডাড়ি ঘেরা বাড়ি হলেও ভেতরে গেরস্থ বাড়ির কোনো আয়োজনেরই কমতি নেই। মাটির চুলোয় খড়ি-খড় দিয়ে রান্না হয়, হাঁস-মুরগি-কবুতর আছে, গোয়ালঘরে গরু-ছাগল আছে গ্রামের আর দশটা গেরস্থ বাড়ির মতোই। হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল দেখার জন্য আছে চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছেলে সুমন। ব্যতিক্রম শুধু এই দোতলা বিল্ডিং। অন্দরে আসবাবের ব্যবস্থাও বেশ ভালো। সব শহুরে কায়দায় সাজানো। দেখে প্রশংসার লালা ঝরিয়ে যাচ্ছিল টিপু-আয়নাল, বুড়ি মা অহংকারে নাক উঁচু করে আরো আগ্রহী হয়ে সবকিছু দেখাচ্ছিল এ ঘর ও ঘর ঘুরে। আহ্লাদ করে আয়নাল একবার বিদেশ যাওয়ার বাসনাও প্রকাশ করেছিল, ‘চাচি, বাবুল ভাইরে কয়্যা আমাগোরেও বিদ্যাশ যাওয়ার ব্যবস্থা কইরা দ্যাও না! আয়নাল-টিপুর চেয়ে বয়সে বড় হবে না বাবুল। বরং এক-দুই বছরের ছোটই হবে। বয়সে বড় না হলেও টাকাওয়ালা মানুষকে শুধু নাম ধরে না ডেকে ভাইযুক্ত করে ডাকার মতো এইটুকু শ্রদ্ধা করো যেতেই পারে! বুড়ি মা নাক উঁচু করে বলেছিল, ‘কইলেই কি বিদ্যাশ যাওন যায়! ট্যাকা লাগবো না! ট্যাকা আছে তগো! তোমরা একটু দয়া করলেই তো ব্যবস্থা হয়্যা যায়!’ ‘বিদ্যাশ যে যাবি, কামাই করবি, বিদ্যাশি মানুষগুলার লগে কথা কইতে হইবো না! কইবি ক্যামনে! পড়াশুনা শিখছোস কিছু!নাক উঁচু করেই বলে বুড়ি মা। বাবুল ম্যাট্রিক পাশ দিয়েছে। আয়নাল-টিপু প্রাইমারিই পার হতে পারে নি। বুড়ি মার কথা তাই মোটেই গায়ে লাগে না কারো। আয়নাল হালও ছাড়ে না, ‘বাবুল ভাই একটু শিখাই দিবো, তাইলেই তো মিট্যা যায়!’ ‘অতো সুজা নারে বাপ! বিদ্যাশ যায়্যা ট্যাকা কামানো অতো সুজা না।বুড়ি মা বিষয়টা উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গি করে। আয়নাল বুড়ি মাকে আর ঘাঁটায় না। বাবুলের বউয়ের মায়াকাড়া হালকা-পাতলা শরীর আরো কয়েকবার দেখার সুযোগ হলেও সৌভাগ্য হয় নি মুখটা দেখার। ঘোমটার আড়াল থেকে ওটা উন্মুক্ত হয় নি একবারও। তাতে বিশেষ আশাভঙ্গও হয় নি কারো। বাবুলের বউয়ের মুখ দেখে কী হবে, বাবুলের মাল ওদের দরকার।

দোতলায় শয়নঘরে এসে চোখ আটকালো ওদের। সিন্দুকের মতো কিছু একটা কাপড়ের পর্দা দিয়ে ঢাকা। ভেতরের সব আসবাবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেও বুড়ি মা একবারও পর্দার আড়ালের বস্তুটার পরিচয় দিলো না। টিপু আয়নালের বুঝতে বাকি থাকলো না ওদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু ওটাই। দোতলা দালান বাড়ি আর আলিশান আসবাবের তুলনায় আপ্যায়ন খারাপই হয়েছিল। কয়েকটা চিড়ার মোয়া আর তিলের নাড়ুদিয়েছিল খেতে। এ তো ওরা ওদের কুঁড়েঘরে বসে রোজই খায়! বুড়ি মা ওদের বিদায় দিয়েছিল নাক উঁচু করেই। সেটাতে তারা মোটেও অসম্মান বোধ করে নি। সেদিন থেকেই বেশ উত্তেজিত আয়নাল-টিপু। হেব্বি মাল পাওয়া যাবে বাবুলের ঘরে। বের করে আনতে পারলে বাকি জীবনের হয়তো একটা গতি হয়ে যাবে। বিষয়টা ভাবতেই উত্তেজনার স্রোত বয়ে যায় দুজনের শরীরে। অনেকদিন থেকে তক্কে তক্কে থেকে অবশেষে শীতের এই অমাবশ্যা রাতটাকে বেছে নিয়েছে ওরা। গ্রামের ভেতর ঢুকে সতর্ক পায়ে চলে। কোনো বাসার ভেতর থেকে দুই-একবার ঘেউ করে উঠতে পারে প্রহরী কোনো কুকুর। পরিচিত ঘ্রাণ পেয়েই হয়তো চুপ করে যাবে। কিন্তু ওই এক-দুইটা ঘেউও সর্বনাশ করে দিতে পারে। বাবুলের বাসার সামনে এসে আরো সতর্ক হয়। শরীরের ভেতরে তীব্র উত্তেজনা টের পায়, একটু ভয়ও! চারপাশে চোখ বুলায়। ঘন কুয়াশায় হাত সমান দূরত্বেও কিছু দেখা যায় না। তবুও চারপাশে চোখ বুলায়, মনে হতে থাকে কেউ যেন দূর থেকে চোখ রাখছে ওদের ওপর।

বাসার পেছন দিকে এসে দাঁড়ায় দুজন। কোমরে বাঁধা গামছা দিয়ে মুখ আড়াল করে নেয়। উন্মুক্ত থাকে কেবল চোখ দুটো। বাসার নিচতলায় থাকে সুমন। কিন্তু ঠিক কোথায় থাকে জানা যায় নি। বাবুল নিশ্চয় বোকা না। এতো মাল কামাবে, ঘরে সিন্দুকে জমিয়ে রাখবে আর তার বাসা অরক্ষিত থাকবেএটা আশা করা চূড়ান্ত পর্যায়ের বোকা লোকের পক্ষেই সম্ভব। সুমন-ই যে সে রক্ষী নয় তা কী করে বলা যাবে! কে জানে, হয়তো রাত জেগে সে পাহারা দেয়। সুমনের বিষয়ে অন্ধ থাকায় বেশ ঝুঁকিতেই থাকতে হচ্ছে আয়নাল-টিপুকে। বাসার উঠোনে একটা লাইট জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। আয়নাল-টিপু তাই পেছন দিকে চলে এসেছে। পাঁচিল টপকাতে হবে। সতর্কভাবে প্রথমে পাঁচিল টপকালো টিপু। যন্ত্রপাতির বস্তাটা আয়নাল পাঁচিলের ওপর দিয়ে টিপুকে ধরিয়ে দিলো। তারপর আয়নাল পাঁচিল টপকাতেই কাছেই কোথায় একটা কুকুর ঘেউ করে উঠলো। পাঁচিলের ওপারে কয়েক মুহূর্ত ঘাপটি মেরে থাকলো দুজন। প্রকৃতি বলছে শীতে জমে যাবে যেকোনো কিছুই। অথচ ওদের শরীরে বইছে চৈত্রের উত্তাপ। ওরা ধরেই নিয়েছিল কুকুরটা ওদের ধরে ফেলেছে। পাঁচিলের কাছে এসে এখন ঘেউ ঘেউ করতে থাকবে। আর বাসা থেকে ইয়া মোটা বাঁশ হাতে ছুটে আসবে সুমন। দেখে বাচ্চা মনে হলেও গায়ে জোর আছে বেশ, পাগলা একটা ষাঁড়কে একাই সামলে নেয়! শেষ পর্যন্ত কুকুরটা কিছুই করলো না। শীতের তীব্রতা তো সেও টের পাচ্ছে। হয়তো শীতের এই অলস সময়ে টহল দিতে মন চাইছে না তার। ঘেউ করে হয়তো জানান দিলোসে সতর্কই আছে! একজন করে সামনে এগুনোর প্ল্যান। লিডারগিরি ফলিয়ে টিপু সামনে এগিয়ে গেলো। আয়নাল যন্ত্রপাতির বস্তা নিয়ে সামনে এগুলো খানিক পরে।

বারান্দার কাছে এসে দেখা গেলো কেউ একজন দড়ির খাটে পুরো শরীর জরে-পল্টে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে বোঝার উপায় নেই। বারান্দার কাছে ঘাপটি মেরে থাকে টিপু। আয়নালও আসে। বস্তা থেকে কালো কাপড়ের একটা রুমাল বের করে ভাঁজ করে ক্লোরোফরমে ভেজায় টিপু। শীতের রাতে লেপ-কাঁথা জরে-পল্টে ঘুমায় মানুষজন। পা-মাথার হদিস পাওয়া মুশকিল। মাথার হদিস পাওয়া গেলেও নাকের হদিস পাওয়া ঝামেলা। শীতের রাতে ক্লোরোফরম দিয়ে কাজ করা তাই রিস্কি। কিন্তু, এছাড়া আর উপায় কী! হামাগুড়ি দিয়ে টিপু হাজির হয় দড়ির খাটের পাশে। পেছন পেছন হাজির হয় আয়নালও। মাফলার জড়ানো সুমনের মাথা বের হয়ে আছে। কিন্তু নাক লেপের ভেতরে। এক ঝটকায় লেপ সরিয়ে সুমনের নাকে রুমাল চেপে ধরে টিপু। আর শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সুমনকে জাপটে ধরে আয়নাল। কয়েক মুহূর্ত ধড়ফড় করে নিস্তেজ হয়ে যায় সুমন। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে আয়নাল-টিপু দুজনই। প্রথম ও সবচেয়ে বড় কাজটাই শেষ। সতর্ক পায়ে দোতলায় উঠতে থাকে টিপু, পিছে আয়নাল। বাইরের প্রকৃতির চেয়েও নিস্তব্ধ এ বাড়ি। সিঁড়ির পাশের দেয়ালে টিকটিকি সতর্ক কিংবা বিপদ সংকেত বাজালো। ধুকপুক সংকেত বাজছে টিপু-আয়নালের বুকের ভেতরে ছোট যন্ত্রটায়। শয়নঘরের দরজা আধো ভেড়ানো। নিচে সুমনের ভরসায় হয়তো এ দরজা লক করার প্রয়োজন মনে হয় নি। ঝুঁকি কমে আসায় উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পায়। সতর্ক পায়েই ঘরে ঢোকে টিপু, আয়নাল যথারীতি পেছনে। জিরো বাল্বের হালকা আলো ঘরে। বুড়ি মার নাকের বাঁশি বাজছে। আর অন্ধকার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের মতো বাবুলের বউয়ের মুখ দেখা যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত দুজনেরই চোখ আটকে থাকে সেখানে। আলতো করে একটু ছুঁতে মন চায়। মুহূর্ত কয়েক পরেই সংবিৎ ফিরে পায় দুজনই। গভীর রাতে বাবুলের বউয়ের চাঁদ মুখ দেখা, আলতো করে একটু ছোঁয়াএমন প্রণয় কল্পনা তাদের জন্য না। দুটো রুমালকে ক্লোরোফরমে ভিজিয়ে রেডি করা হয়। টিপুর ভাব দেখে স্পষ্ট বোঝা গেলো বাবুলের বউয়ের নাকে রুমাল চেপে ধরবে সে। বাবুলের বউকে একটু ছোঁয়ার সাধ তো তবু মিটবে টিপুর। আয়নাল ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে ফুঁসতে বুড়ি মার নাকে রুমাল চেপে ধরার প্রস্তুতি নিলো। মাঝখানে বাবুলের ছেলে। ওর টের পাবার কথা না। ও তাই অপারেশনের বাইরে। বাইচান্স যদি টের পেয়ে যায়, তখন দেখা যাবে। দুজন একসাথে ঝটকা দিয়ে লেপ সরিয়ে নাকে রুমাল চেপে ধরে। বাবুলের বউয়ের নরম হাতের ছোঁয়া পায় টিপু। শরীর শিরশির করে ওঠে ওর। আর বুড়ির শুকনো হাতের ছোঁয়াতে গা জ্বলে ওঠে আয়নালের। কয়েক মুহূর্তে নিস্তেজ হয়ে যায় শরীর দুটো। টিপু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাবুলের বউয়ের দিকে। হালকা-পাতলা ধস্তাধস্তিতে বুকের কাপড় সরে গেছে বাবুলের বউয়ের। টিপুর খুব মন চায় লেপ সরিয়ে মায়াকাড়া শরীরটার পুরোটা দেখে, আলতো করে একটু ছোঁয়। কিন্তু মুহূর্তেই সে চাওয়া দমিয়ে ফেলে। যে কারো জ্ঞান ফিরে গেলে, বিশেষ করে সুমনেরকেলেঙ্কারি হয়ে যাবে, সব শ্রম জলে পড়বে। বাবুলের বউয়ের মায়াকাড়া শরীর থেকে তাই জোর করে মনোযোগ ফিরিয়ে নিতে হলো তাকে। ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে ফুঁসতে বুড়ি মার পরিচয় করিয়ে না দেয়া কাপড়ের পর্দা দিয়ে আড়াল করে রাখা বস্তুটা উন্মুক্ত করলো আয়নাল। অনুমিত সেই বস্তুটাইসিন্দুক। যন্ত্রপাতি বের করে সিন্দুকের দুর্ভেদ্যতা ভেদ করার কাজ শুরু করে দিলো আয়নাল। টিপুও হাত লাগালো। বেশ কষ্ট হলো সিন্দুকের দুর্ভেদ্যতা ভেদ করতে। নকল চাবির গোছা দিয়ে কোনোই কাজ হলো না। শাবল আর লোহা কাটা করাত দিয়ে বহু চেষ্টাতেও সিন্দুকের মুখ খোলা যাচ্ছিল না। একটা পর্যায়ে মাঘ মাসের এ শীতেও ঘাম জমে গিয়েছিল দুজনেরই কপালে। শঙ্কা হয়েছিল সব শ্রম বৃথা যাবার। মনে হচ্ছিল সুমনের জ্ঞান ফিরে যাবে, তারপর ওদের বেঁধে রাখবে। সকালে বিচার বসিয়ে...
অবশেষে এসব হয় নি। সিন্দুকের মুখ খোলা গেছে। ভেতরে একগাদা সোনার গয়না আর নগদ টাকা! নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয় না কারো! কাঁপা কাঁপা হাতে দ্রুত কাপড়ের পুঁটলিতে বেঁধে ফেলে সব। দামি দামি আর মাত্র কয়েকটা জিনিস যন্ত্রপাতির মাঝারি বস্তায় ভরেই কাজ শেষ করে। আর কিছু নেয় না। আর কিছু দরকারও তো নেই! যথারীতি সতর্ক পায়ে নেমে আসে আয়নাল-টিপু।

বুকের ভেতরের যন্ত্রে ধুকপুক সংকেত বাজে। বারান্দায় এসে দেখা যায় সুমন তেমনিই অচেতন হয়ে পড়ে আছে। পাঁচিল টপকে দ্রুত পা চালায় টিপু। সোনা আর নগদ টাকার পুঁটলি তার কাঁধে। আয়নাল টিপুকে এগিয়ে যেতে দেয় না, পাশাপাশি যেতে থাকে যন্ত্রপাতির সাথে মাঝারি বস্তায় মাত্র কয়েকটা দামি জিনিস কাঁধে। গ্রাম থেকে বেরিয়ে ফাঁকা মাঠে চলে আসে। হঠাৎ করে ওদের মনে পড়ে মাঘ মাসের হাড় কাঁপনো শীতের গভীর রাতে খোলা আকাশের নিচে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। বহুক্ষণ পড়ে শীত টের পায় ওরা। জার তো জবর পড়তিছে রে!এক হাত দিয়ে চাদরটা গায়ের সাথে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিতে নিতে বলে আয়নাল।
হুঁ, এতোক্ষণ টের পাই নাই। এখন মনে হতিছে ফিরিজের মধ্যে দিয়া হাঁটতেছি।টিপুও নিজের চাদরটা গায়ের সাথে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিতে থাকে।
তয়, কাজ যে এতো সহজে করতে পারবো ভাবি নাই! সুমনরে নিয়া ভয়ে আছিলাম।’‘এর জন্যেই তো শীতের ভেতর কাজটা করার প্ল্যান করছিলাম। গরমের ভেতর করলে এতো সহজ হইতো না।’ ‘ঠিক কইছোস। চল, ভাগ-বাটরা এখনই সাইরা ফেলি।’ ‘চল তাইলে, মাঠের ওই মাথাত যাই।বৃষ্টির মতো টুপ টুপ করে শিশির পড়ছে। শেয়াল ডাকছে দূরে, কুকুরও ডাকছে দুই-একবার, আর ডাকছে নিশিপোকার দল।

টিপু আয়নাল ফাঁকা মাঠের মাঝ দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলে জীবনের আরেকটি সফল চুরি শেষে। খুব সম্ভবত এই চুরিই বাকি জীবনের গতি করে দেবে! ভাবনাটা আয়নালের ভেতরটাকে কুঁড়ছে কিছুক্ষণ থেকে। সোনা কম করে হলেও বিশ ভরি হবে, সোনার যা দাম এখন! নগদ টাকাও লাখের কম না। কাপড়ের পুঁটলিতে বাঁধা আছে এই বিপুল সম্পদ। পুঁটলিটা টিপুর কাঁধে। মাঠে বসে ভাগ হবে এখনই। কিন্তু সবকিছু এককভাবে পেতে ইচ্ছে করছে আয়নালের।

কিছুক্ষণ থেকেই এককভাবে সব ভোগ করার বাসনাটা ঘুরপাক খাচ্ছে আয়নালে মাথায়। কিন্তু কী করে সম্ভব! সম্ভব। কেবল একটা উপায়েই সম্ভব। দুই কদম পিছিয়ে আসে আয়নাল। বস্তা হাতড়িয়ে গরু জবাই করা ধারালো চাকুটা বের করে। টিপু হাঁটছে নিজের মনে। অনেকটা ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে টিপুর মুখ চেপে ধরলো আয়নাল। মুহূর্ত দেরি না করে চাকুটা টিপুর গলায় চালিয়ে দিলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রক্তে ভেসে গেলো টিপুর শরীর। গোঙ্গানোর শব্দ হতে লাগলো। জবাই করার সময় গরু যেমন সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছাড়া পাবার শেষ চেষ্টা করে, টিপুও শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছাড়া পাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রস্তুত আয়নালের সঙ্গে পেরে উঠলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই নেতিয়ে পড়লো টিপু। শ্বাসনালী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে টিপুকে ছেড়ে দিলো আয়নাল। মাটিতে পড়ে থড়বড় করতে থাকলো টিপুর দেহটা। রক্তে ভিজে গেছে আয়নালের কাপড়ও। সেটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামালো না সে। এখন ঘন অন্ধকার সময়, কুয়াশায় হাত সমান দূরত্বেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। আলো ফোটার আগে, কুয়াশা কেটে যাবার আগে অনেক দূরে চলে যেতে হবে আয়নালকে, নাগালের বাইরে। বস্তাতে টাকা আর সোনার পুঁটলিটা ভরে ভালো করে বেঁধে নিয়ে ঘাড়ে ঝুলিয়ে টিপুর নিথর দেহটাকে আরেকবার পরীক্ষা করে সে হাঁটা শুরু করলো। এতো বছরের সঙ্গীকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে, পরিবারের চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে, ঘন অন্ধকার ও কুয়াশার ভেতর দিয়ে আয়নাল চললো নতুন জীবনের খোঁজে। রাতের এ ঘন আঁধার আয়নালের জন্য এখন পরম আশীর্বাদের।