যেখানে গল্পের শুরু
মগজের ভেতর মন উড়ে যাচ্ছে। মেঘের ভেতর পুঞ্জ পুঞ্জ মন। খেলছে, খুটে খাচ্ছে স্মৃতির দানাগুলো। প্রথম পা পড়েছে এক্সিটের বাইরে। দ্বিতীয় পা তখন কোমর বন্ধের মত ঝুলে আছে আকাশে।গল্পটা এখানে শেষ হলে অনেক ভালো হতো। আসলে গল্পটা এখানেই শুরু।
মগজের ভেতর মন উড়ে যাচ্ছে। মেঘের ভেতর পুঞ্জ পুঞ্জ মন। খেলছে, খুটে খাচ্ছে স্মৃতির দানাগুলো। প্রথম পা পড়েছে এক্সিটের বাইরে। দ্বিতীয় পা তখন কোমর বন্ধের মত ঝুলে আছে আকাশে।গল্পটা এখানে শেষ হলে অনেক ভালো হতো। আসলে গল্পটা এখানেই শুরু।
কিয়স্কে
দাঁড়িয়ে ঘামছে সে। সেলফসার্ভিস বোর্ডিং পাস নিয়ে লাগেজ চেক ইন করে দেবে। সব কাজ
চেক লিস্ট ধরে করেছে। এবার কোন ভুল হয় নি। সামনের পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির মত লম্বা মানুষটা তার বোর্ডিং
পাসটা নিয়ে চলে গেলো কাউন্টারে তার তিনশ’ষাট ডিগ্রী স্যুটকেস্টাকে
চেক ইন করাতে। সেও তার স্যুটকেসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আলতো করে। একই ক্যাটাগরির
স্যুটকেস । ঝকঝক করছে। গতকালই সে কিনেছে। দু’শো পঁচিশ ডলার দিয়ে। এই
স্যুটকেসের সুবিধা হলো,
এটা ঞ্চার চাকার । চারিদিকেই চক্কর খেতে পারে। সোজা হয়ে
চলতে পারে পাশে পাশে। ঘাড়ে ও শোল্ডারে কোন চাপ পড়ে না। স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মত।
পেছনে পেছনে ঘেজর ঘেজর করে না। মোলায়েম আওয়াজ। ইন্সট্রাকশান স্ক্রিন পপ করলো। টাইপ, স্ক্যান।
টাচ স্কিনে হাতের ছোঁয়া দিল। স্ক্যান বাটন নড়ে চড়ে বসলো পরের স্ক্রিনে। ক্রেডিট
কার্ড সোয়াইপ করলো সে। আজকাল ঘরোয়া উড়ানে লাগেজ চেক করতে প্রতি লাগেজে পঁচিশ ডলার
করে চেক ইন ফি দিতে হয়। সাথে একটা ক্যারিওন রাখা যায়। ফি জমা করে দিতেই
ইন্সট্রাকশান, পাসপোর্ট
খাবার জন্য হা করে মুখ খুলে দিলো। মেশিনের চারিদিকে হাতড়াতে শুরু করে সে। কোথায়
আছে সেই মহা খাদক সোয়াইপ স্লট যেখানে সে তার সাধের স্বপ্নের বড় আকাঙ্ক্ষিত নেভী নীল
রঙের পাসপোর্টটা সোয়াইপ করবে। পাশের কিয়স্কে দাঁড়ানো লোকটা কি করছে তাই সে অনুকরণ
করার চেষ্টা করল। স্লটে স্ক্রিনের ডিজিটাল ইন্সট্রাকশান অনুসারে পাসপোর্ট কায়দা
করে ধরলো। ছবির দিকটা উপরে। তার আগের পৃষ্ঠার প্রথমেই একটা স্ক্যান বার আছে। সেই
দিকটা স্লটে যাবে। স্লটে পাসপোর্টের নর্থ ইস্ট কর্ণার ছুঁইয়ে ধীরে ধীরে সে টান
দিলো বাম দিক থেকে ডান দিকে। ব্যথাটা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। বাম দিক থেকে
ব্যথা ডানদিকে প্রসারিত হচ্ছে। নিজেকে বিস্তৃত করছে। সহ্য করা যায়। এমন ব্যথায়
কাঁদতে হয় না। এতো দূর যাবে। তার জন্য অনেক মানসিক শক্তির দরকার। বামদিকের কিয়োস্ক
থেকে অন্তত পাঁচজন লোক চলে গেছে কাউন্টারে। ডানদিক থেকে তার ও বেশী ছাড়া কম হবে
না।
কিয়স্কের
সামনে আজকে কোন এজেন্ট নেই সাহায্য করতে। বারবার সে আশেপাশে তাকাচ্ছে। একটু
সাহায্য আশা করছে। না নেই, কেউ নেই। যেমন
কেউ ছিল না গতকাল, গত
পরশু। বা তার আগের দিন। একাই সব কাজ করেছে। কাজের সময় কেউ থাকে না। সবাই অনেক অনেক
অজুহাত বানাতে মহাদক্ষ ! তাই কারো কাছে সাহায্য চাইবার চেয়ে নিজের উপর ভরসা করে
চলাই সবচেয়ে ভালো সাহায্য। এই কিয়স্ক মানুষ নয়। মানুষের আবিষ্কৃত। কিয়স্ক তার সাথে
মানুষের মত অজুহাত দেখাবে না। ডান পায়ের জুতার গোড়ালি দিয়ে সে এয়ারপোর্টের টাইল
করা ফ্লোরে ঠক করে একটা আওয়াজ তুলে নিজেকে সচেতন করে তুললো। আর কয়েক সেকেন্ড মাত্র, তার
বোর্ডিং পাস হাতে এসে যাবে। ঝকেঝকে প্রিন্টে লেখা থাকবে তার নাম, গন্তব্য
এয়ারপোর্টের নাম, ফ্লাইট
নাম্বার, গেট
নাম্বার, ও
সীট নাম্বার। হা।
পাসপোর্ট বাম দিক থেকে ডানদিকে পুরো রাস্তা গড়িয়ে পার
হলো। তার ব্যক্তিত্বের ধারালো বৈভব নিয়ে। কিন্তু স্ক্যান হলো না। তার ভেতর দিয়ে
কোন এক্সরে রে গেলো কিনা বোঝা গেলো না। ডিজিটাল ছবিটা ইন্সট্রাকশান দিয়েই যাচ্ছে।
হচ্ছে না। কিছুই হচ্ছে না। একবার, দুবার, তিনবার..... বারো
বার, সে
স্ক্যান করলো, হলো না। ওর্গাজম হচ্ছে না। হবার নয়। কোথাও তাকে ঠোক্কর খেতেই হবে।
এ
কেমন জীবন! নিজের উপর নিজেই ক্ষুব্ধ। ঘামছে দর দর করে। অথচ আবহাওয়ায়
এখন শীতের প্রকোপ। মাইনাস ছয় ডিগ্রীতে সে ঘর থেকে বেরিয়েছে। এখন বাইরে হাওয়া
বেড়েছে। উইন্ড শিল্ড বাড়া মানেই তো মাইনাসের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। সে ঘামছে বোবার
মত। তল পেটে প্রচণ্ড চাপ। ভেবেছিল সিকিউরিটি পার হয়ে তারপর রেস্টরুমে যাবে। দুই পা
চিপে ব্লাডারের চাপ কমাতে চেষ্টা করল। সামনের কাউন্টার থেকে ডাক এলো, নেক্সট।
হুড়মুড়
করে পাসপোর্ট হাতে সে প্রায় দৌড়ে গেল। গুড মর্নিং! ইয়েস
গুড মর্নিং । হাউ
মেনি লাগেজ? ওয়ান। হাউ
উইল উ পে? ক্যাশ
ওর ক্রেডিট? এই
এক সুবিধা। এই প্লাস্টিকটা সারাক্ষণ সার্ভিস দিতে থাকে, যদি
মিনিমাম পে করা থাকে প্রতি মাসের ডিউ ডেটে। এর হেরফের হলেই ডিক্লাইন। সে রকম হবার
কোন আশঙ্কা নেই। আসার আগে পুরো বিল শোধ করে দিয়ে আস্ত ক্রেডিট লাইনটা নিয়েই সে
বেরিয়েছে তার গন্ত্যবের দিকে। কত কি প্ল্যান আছে। একটা টেক্সট এসেছে। তার আওয়াজ
কানে আসলো। সেল ফোনটা পকেটে। ভলিউম কমাতে ভুলে গেছে। তাতে কি এয়ারপোর্ট বলে কথা।
চারিদিকে এনাউন্সম্যান্ট। কত রকম নামের ডাক শোনা যাচ্ছে। এই মিস্টার এই লাইনে আসো।
ঐ মিস সেই লাইনে যাও। এককান দিয়ে ঢুকছে আর গারবেজের মত আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে
যাচ্ছে। মগজটা ক্লিয়ার রাখা দরকার। সব কথা নাকি কানে ঢুকাতে নেই। আরে কানে ঢুকলেই
কি আর শোনা হয় নাকি। শুনতে হলে মনোযোগ দিতে হয়। কানে যা যায় তা হলো আওয়াজ।
চারিদিকে আওয়াজ। মনের ভেতর এখন কত রকম আওয়াজ চলছে। ক্রেডিট
কার্ড। হাত বাড়িয়ে কোচ সিগ্ন্যাচার প্লেটেড ক্লাচ থেকে মেরুন রঙের ভিসা কার্ডটা
বের করতে করতে মনে হলো,
এখুনি টেক্সট ম্যাসেজটা দেখা দরকার। সেল ফোনে রিং বাজছে।
কার্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে ফোন ধরতে যাবে।
কাউন্টার
থেকে মিষ্টি কণ্ঠে এজেন্ট বললো, এখানে ফোন ধরা নিষেধ। রেখে দিল ফোন। পকেটে
যেখানে ছিল সেখানে। কিছুটা নড়চড় হতেও পারে। লাইফ তো আর প্রতি মুহুর্তে ফটোকপি নয়।
যা দিলাম তাই কপি হয়ে বেরিয়ে আসবে। পুরো পঁচিশ ডলার চার্জ করে এজেন্ট কার্ড ফেরত
দিল সাথে রিসিট। লাগেজ ট্যাগের ‘পিল হিয়ার’ অংশের ব্যাক সাইড থেকে অয়াক্স পেপারটা পিল
করে তার লাগেজে ট্যাগ লাগিয়ে দিল। লাগেজ টা হাতে দিয়ে দেখিয়ে দিল কোন পথে যেতে
হবে। ফলো দা ব্লু লাইন ফ্রম হিয়ার। মনের ভেতর খচ খচ করছে। সেলফোন
হাতে নিয়ে টেক্সট চেক করতে ইচ্ছে করছে। খুব যত্ন নিয়ে চারিদিকে সে দেখে নিলো, অন্যেরা
সেল ইউজ করছে কিনা। একটু আগেই তো না করলো। বাহ, সবার হাতেই কিছু না কিছু
ডিজিটাল ডিভাইস আছে। ফোন,
আই প্যাড, টেবলেট, নেটবুক। তার স্মার্ট ফোনটা সে
বের করতে পকেটে হাত চালিয়ে দিল। যেন অভিযানে নামিয়েছে হাতের পাঁচ আঙ্গুলকে। পাঁচ
আঙ্গুল মুঠ করে শক্ত বাঁধনে বেধে তুলে আনছে তার পকেট থেকে স্যামসাং গ্যালাক্সি
থ্রি। আই ফোন সে নেয় নি ইচ্ছে করেই। এর চেয়ে কম দামেই সে পেতে পারতো আই ফোন, ফোর
জি এস। মাত্র উনআশি ডলার । সাথে বাবা কালাচাঁদ ট্যাক্, একে ফাকি দেবে এমন সাধ্যি
কারো নেই। তের পার্সেন্ট ট্যাক্স হিসাব করে নাও পাঠক। সব উত্তর লেখক লিখে দিলে
পাঠক কি ভেরেণ্ডা ভাজবে বসে বসে। অংক করে নাও মগজের খেলায়। আজকাল ক্যালকুলেটর সব
ফোনে আছে, আর
ফোন নাই এমন পাঠক দুনিয়ায় নেই বলা চলে। তার দুনিয়া এখন তার পাঁচ
আঙ্গুলের মুঠোয়। ব্লু লাইন ততক্ষণে শেষ। ফোন আবার রেখে দিতে হলো। পাসপোর্ট দেখার
জন্য আরেক জন ওঁত পেতে আছে। এই কাজ করতে এদের বোরিং লাগে না ? রাজ্যের
লোকের হরেক রকম চেহারা দেখে দেখে মনে কি প্রেম ট্রেম জাগে না ? মনের
ভেতর কি কোনা আন্দোলন তৈরি হয় না ? যেমন ওর মন এখন এক প্রবল আন্দোলনে মেতে
আছে। সে তাকে বারে বারে মনে করিয়ে দিচ্ছে । রেস্টরুম, রেস্টরুম।
ক্যারিওন লাগেজ টেনে টেনে সে এগিয়ে গেল সিকিউরিটির চেকপয়েন্টের দিকে। কনভেয়র
বেল্টের পাশেই স্ট্যাক করা আছে নানান রঙের ও সাইজের বিন। বড় একটা বিনে সে তার হাত
ঘড়ি, পকেট
থেকে ফোন, কোমর
থেকে বেল্ট ও পা থেকে চকেচকে ওয়েদার বুটটা তুলে দিল। যা তোরা পার হয়ে যা । গা থেকে
খুলে দিল লাইট ফিদার জ্যাকেট, হ্যান্ডব্যাগ। সাথে রইলো সে নিজে ও তার মন
। তার মনের কোন ব্র্যান্ড নেম নেই। সে একা। আশ্চর্য মোজাটাও খুলতে হলো। হাতের
আংটিগুলো খুলতে হলেই এখন দশজন চাকর-নকর দরকার হতো। ক্যারিওন তুলতেই এজেন্ট জিজ্ঞেস
করলো, তার
সাথে ল্যাপটপ আছে কিনা। সে ক্যারিওন লাগেজের সাইড পকেট থেকে তার গেটওয়ে নেটবুক বের
করে বিনে রেখে দিলো। নোট বুকের ভেতরে আছে অনেকগুলো গল্প। ওরা একসাথে আড্ডা দিচ্ছে।
না কফি হাউস নয়। বিগ ব্যঙ হাউসে। বিল গেট জিন্দাবাদ।
বডি
ডিটেক্টরের দিকে এক পা এগুতেই মনে পড়লো গলায় ট্যানযানাইট স্টোনের প্যান্ডেন্টটা
ঝুলছে। এক পা পিছিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে স্টেনলেস সিলভারের চেইনটা খুলে আবার আরেকটা
বিনে রেখে দিল। বিন টা হাত দিয়ে ঠেলে দিলো এক্সরে মেশিনের দিকে। মেশিনের ওদিকে
অনেক গুলো বিন জমা হয়ে গেছে। সে আশংকায় আছে। একজন মহিলা পার হয়ে গেছে বডি
ডিটেক্টরের ওদিকে বডি চেক করে। সে দেখতে পাছে, একজন মহিলা এজেন্ট তার গায়ে
কোমরে গ্লাবস পরা হাত দিয়ে দিয়ে চেক করছে। মনে পড়ে তার সারা গায়ে ভালোবাসার হাতের
পরশ। অনেক যত্নে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে আদরে আহ্লাদে পরশে বিমোহিত করে রাখতো।
ভৌগলিক দূরত্ব ও বিশ্বাস আনুপাতিক। সাম্রাজ্য ভাগ হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে
মাত্র। হৃদয় ভাগ হয় না। হৃদপিণ্ড যদি হৃদয় হয়, তা হলে তাতে চারটি মেজর ভাগ
আছে। এই চার ভাগের কথা ভেবেই হয়তো মোল্লারা চার বউকে হালাল করেছে। নিজের হৃদপিণ্ড
খুলে তো দেখেনি। গরু ছাগলের টা দেখেই অনুমান করেছে কয় কুঠুরি আছে সেখানে। নারী
হৃদয়ে কয়টা কুঠুরি আছে তার সন্ধান আজো পায় নাই। তাই এক তরফা হাদিস বুনেছে
খেলারামের মাঠে। কি একটা নড়ে চড়ে ওঠে তলপেটে। বডি ডিটেক্টর এর ভেতর দিয়ে পার হয়ে
সে ওপারে পৌঁছে গেলো। মানুষ মরে গেলেও কি এমনি করে বডি ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে পার
হতে হবে? যাবে
তো আত্মাটাই অন্য গ্রহে। নতুন দিনের সন্ধানে। মুল দেহ মাংস ও হাড় সব মজে যাবে
মাটিতে। তারপর হবে কার্বন।
কনভেয়র বেল্ট থেকে সবগুলো জিনিশ কুড়িয়ে হাঁসফাঁশ করতে
করতে সে গিয়ে বসলো একটা অটোম্যানে। কমলা রঙের অটোম্যান। আর ও চারটে কালার আছে।
হলুদ, সবুজ
ও লাল। বাচ্চাদেরকে এন্টারটেইন করতে এই বিশ্বে জায়গায় জায়গায় এমিউজম্যান্টের
ব্যবস্থা এতো সুন্দর, মনে
হয় বাচ্চারাই আমাদের সর্বস্ব। আসলেই তো। ওরা না থাকলে প্রজন্ম পাবো কোথায়? আর
তারা হলো আমাদের অতিথি। তাদের যত্নের ত্রুটি করা চলে না। তার সন্তান এখন তার থেকে
অনেক দূরে। মনের ভেতরে নিত্যই বাস করে সে। তবুও সময় মানুষকে প্রিয়জন থেকে দূরে
থাকতে বাধ্য করে।
একে একে মোজা, বুটজুতা পায়ে পরে নিল। গলায়
লকেট সহ চেইনটা। হাতে বুলভা রিষ্ট ওয়াচ। কোমরে ক্রিম রোজ স্কিনি বেল্টটা টাইট করে
পরে নিল, কালো, নীল
ও ক্রিম কালারের ডলমান স্লিভ ম্যাটালিক নীট ইন্টারনেশানাল কনসেপ্ট সোয়াটারের উপরে।
কনফিডেন্স এখন আকাশ চুম্বী। তলপেটে চাপ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রেস্টরুম।
সাইন। সোজা গিয়ে বাঁয়ে টার্ণ নিতে হবে। পরবর্তী টার্নের আগে মাঝ বরাবর বাম দিকে
উইম্যান রেস্টরুম। ডানদিকে পুরুষদের । দুনিয়ার সব কিছুতে পুরুষদের আদিখ্যেতা নকশা আঁকার
মত ছকে কাটা। একদিন মেয়েরাও এমন সুযোগ পাবে। মনে মনে ভাবছে , জোরে
হাসলে এখানেই পি পড়ে যাবে। দেখার মত দৃশ্য হবে বটে। হ্যান্ড ব্যাগে একসেট এক্সট্রা
কাপড় আছে। তাই বলে এমন অঘটন? না না । পা চালাচ্ছে জোরে। ক্যাট ওয়াক করে
হাঁটলে চাপ কিছুটা কম হবে কিনা ভাবছে। এতে মনটাকে ডাইভার্ট করা যাবে। যাচ্ছে । কাজ
হচ্ছে। ক্যারিওন হাঁটছে তার সাথে। তিনশ ষাট ডিগ্রী মাতাল তালে।
লাগেজ কি কাল রাতে মারগারিটা বা কনিয়াক কিছু পান করেছে নাকি। নাকি নিউ ইয়ারের
উন্মাদনা এখনো তাকে গ্রাস করে রেখটছ ! রেস্টরুম। গ্লোবাল আকৃতির প্রবেশ দ্বারের
সামনে একটা বিশাল অতসী কাচের মত দেয়াল। দুইপাশ থেকে ঢোকা যায় রেস্টরুমে। বিশাল
আয়োজন। এতো বড় একটা ঘর হয়ত অনেকের নেই। তাতে কি ? এয়ারপোর্ট বলে কথা। সব কিছু
নিয়ে দেহটাকে সেঁধিয়ে দিল একটা ক্লিয়ারেন্স রুমে। তলপেট ক্লিয়ার হলে কেমন শান্তি, এর
ব্যাখ্যা দিতে গেলে ফ্লাইট মিস হবার সমূহ সম্ভাবনা । হাতে মাত্র এক ঘন্টা সময়
বাকী। আরাম। হাতে ধুয়ে হাতে স্যানিটাইজার মেখে সব কিছু সাথে নিয়ে বেরিয়ে আসে সে
অলস পায়ে। তাড়া নেই। এক্সটিক ফিলিংস। গেট নাম্বার সি থার্টি ফোরের
দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পকেটে ফোনটা আওয়াজ তুলছে। কেরে বাবা, এই
সকালে এতো ফোন করছে। কেউ তো জানেনা সে আজ তার শহর, দেশ ছেড়ে অন্য শহরে অন্য দেশে
যাচ্ছে। গেলেই বা লোকের কি?
আজকাল
আর কাউকেই বন্ধু বলতে ইচ্ছে করে না। সবাই লোক হয়ে গেছে। লৌকিকতায় পারদর্শি। কিন্তু
মনটা ফাঁকা। ঠনঠনে আওয়াজ তোলে বাজেনা সুরে। ঝংকার নেই আছে শুধু খন্ডকালীন যুদ্ধের
দামামা। পৃথিবীর অনেক দেশেই নিত্য যুদ্ধ চলছে। এই সেদিন ভারতের মুম্বাই শহরে
দামিনী ও একটা করুন মৃত্যুকে বরণ করে নিল। মরেই যুদ্ধের ঘোষণা দিল। বাইরে
বরফ পড়ছে। আকাশ নীল। মনের ভেতর হাজারটা পাখী উড়ছে একসাথে। দুপুর রোদের মত কড়া
ব্ক্তিত্ব নিয়ে পিঠ টান টান করে সে এসে পৌছালো গেট সি থার্টি ফোরের সামনে। দেখলো, বাইরের
দিকে চোখ মেলে দেখা যাবে যতদূর ইচ্ছে সেই রকম কোন সীট আছে কিনা। লাকি। পেয়ে গেল
একটা সীট। পাশেই প্লাগ-ইন ইলেকট্রিক সিস্টেম। এই এয়ারপোর্টে ওয়াই-ফাই ফ্রি ।
মহা খুশী। আবারো ফোনের আওয়াজ। এবার আরেকটা
ম্যাসেজ আসলো। ভাবলো ফেসবুক নোটিফিকেশান। বসার আগে পেটে একটা ধাক্কা
লাগলো। হ্যাঁ । বটে। গতকাল বিকেল পাঁচটায় এক বোল চিকেন ভেজিট্যবল স্যুপ খেয়েছে।
তারপর চলে গেছে দীর্ঘ পনের ঘণ্টা না খেয়ে। খেতে হবে। পাশেই আছে ভিনিফার
রেস্টুরেন্ট। হাঁটা দিলো সেই দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা বড় পোস্টার ম্যাট্রোলিঙ্ক।
বাহ! দারুণ তো। এয়ারপোর্ট থেকে ইউনিয়ন স্টেশান পর্যন্ত সরাসরি সার্ভিস প্ল্যান
করছে । রিজিওনাল
ট্রান্সপোর্টেশান প্ল্যান গ্রেটার টরন্টো এবং হ্যামিল্টন এলাকার লোকদেরকে সার্ভ
করবে। হ্যামিল্টন যাওয়া আর ও সহজ হবে। কবি জয় গোস্বামীর কবিতার মত , কত
সহজ হবে? ভালবাসবে
তবে? নোট
বুকে টুকে নিলো এই তথ্য । পরে গিয়ে এই নিয়ে বিশদ জানা যাবে। কবে শুরু হবে , বাজেট
কত, ট্রেনের
স্পীড কি হবে? ফেয়ার
কত হবে এবং কতদিনে শেষ হয়ে চালু হবে সার্ভিস ইত্যাদি, ইত্যাদি।
জোরে হেসে উঠলো সে । একাই। আশে পাশে লোকেরা জানলো না সে কেন হাসলো?
বাংলাদেশের
টিভির জনপ্রিয় মুখ হানিফ সংকেতের কথা মনে পড়লো। তার আছে ইত্যাদি। ম্যাগাজিন
অনুষ্ঠান। যখন থেকে ইত্যাদিকে জানে, তখন থেকেই তার স্বপ্ন সে একদিন এই শো’তে
যাবে হানিফ সংকেতের সাথে বাৎচিত করবে, এবং কিছু পারফর্ম করবে। তার
বিশ্বাস সে দর্শকের মনোরঞ্জনে পুরো স্বার্থক হবে। হানিফ সংকেতকে দেখলেই তার হাসি
পায়। হাসি স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ উপকারী। স্ট্রেস রিলিফ করে। তা হলে হানিফ সংকেতকে
এখন থেকে থেরাপির জন্য কাজে লাগানো যাবে। তাকে ঢাকার শহরের একটা কেন্দ্রীয় স্থানে উচু
বিল্ডিঙের উপরে ঝুলিয়ে রাখলে সারা ঢাকা শহর দেখবে আর হাসবে আর স্ট্রেস রিলিফ হবে, সবাই একদিন মানুষ হয়ে মানুষ কে শ্রদ্ধা করবে, নিরাপদ
বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। কোন দুর্নীতি থাকবে না, হাসিনা-খালেদা বিবাদের অবসান হবে।
লাইনের
শেষ প্রান্তে সে দাঁড়িয়ে । সামনে একজন মাত্র মাত্র অতি অভিজ্ঞ মানবী লাল রঙের
সোয়েটার গায়ে দিয়ে ক্রিম কালারের প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। বাম হাতের আঙ্গুলে এক
ক্যারাটের একটা ডায়মন্ড রিং ঝলসে উঠছে চিল্কার মত। কি ভালো আমার লাগলো আজ এই সকাল
বেলায় কেমন করে বলি? কেমন
করে বলি, কি
ভালো তোমাকে বাসি।
মে আই হেল্প ইউ? ইয়েস। ইউ ক্যান। আই ওয়ান, ওয়ান
চিনামন ক্রোস্যান্ট টোস্টেড উইথ সেডার চিজ। ডি ক্যাফ কফি নো সুগার। এন্ড আ বোটল অফ
ওয়াটার। রুম টেম্পারেচার প্লিজ। ইফ পসিবল। ভিসা কার্ডে পে করে ফিরে গেল সারিবদ্ধ
চেয়ারগুলোর দিকে। পেছন থেকে কেউ ডাক দিল। ঘুরে তাকাতেই দেখে তার প্রাক্তন কলিগ
তাকে ডাকছে তার সাথে জয়েন করতে টেবিলে। হলো না। ফেসবুকে হানা দেয়া হলো না। মাত্র
৩৫ মিনিট বাকী আছে বোর্ডিং এর। এর মধ্যে সে একবারও ফেসবুকে যেতে পারবে না, সে
কি করে হয়। তবে তার কলিগের ডাককেও উপেক্ষা করা যায় না। ফিরে চললো টেবিলের দিকে।
আন্ডার ওয়ারের একটা এডের পাশ দিয়ে যেতেই বুকটা ধক করে ওঠে। কি লাভ? হ্যান্ডশ্যাক
ও হাগ করেই বসে পড়ে বিপরীত দিকের চেয়ার টেনে। দু’জনে অনেক গল্প করলো প্রাক্তন
অফিসের। কলিগটাও আগের অফিসে নেই। সে নতুন কোম্পানিতে জয়েন করেছে সিনিয়র ভাইস পদে।
কফি পান এর সাথে গল্পের রস মিশে একেবারে যেন একাকার, স্যুফলে। মিশেল। সময়
হলো। স্কাই প্রাইয়োরিটির যারা তাদের ডাক এলো। তার কলিগ চলে গেলো। একই প্লেন’এ তারা
বসবে দুই সামজিক সীটে। যে যেমন পে করেছে। সে ভাইস। বসবেই তো । অফিসের খরচ। জোন
ওয়ান কে ডাকছে। তার হলো জোন টু। জেনারেল। সীট নাম্বার টুয়েন্টি এইট ডি। জানালার
পাশেই। খুব খুশী। অনেক ছবি তুলতে পারবে সে। বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে সাথে আইডি
হিসাবে আছে তার কানাডিয়ান পাসপোর্ট। ক্যারিওন লাগেজে একটা ট্যাগ লাগিয়ে দিলো। কারণ, ক্যারিওন
টা তার সাথে যাবে না। তারা আলাদা জায়গায় রাখবে। পরে আটলান্টায় নামলে তাকে তার
ক্যারিওন হাতে ধরিয়ে দেবে। ভুলে গেছে নেটবুক তার ভেতরে। ক্যারিওনে চড়ে সেও চলে
গেলো। বুকটা
খালি খালি লাগছে। ক্যারিওন চলে গেলো। সেও হাঁটছে জেট ওয়ে ধরে। একটু অস্বস্তি আছে
মনে। ক্যারিওন টা ঠিক মত পাবে তো? হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে ঢুকে গেলো ডেল্টা
এয়ারের পেটের ভেতর। মনে হচ্ছে মায়ের জরায়ুতে ফেরত যাচ্ছে। এমনিও ওয়াটার নেই।
অক্সিজেন আছে। বিরাট লাইন। আঠাশ নাম্বার লাইন মানেই তো সামনে গাদা গাদা লোক
দাঁড়ানো। সময় তো যায়। প্যাসেঞ্জারও হাঁটে, সেও হাঁটে । আরেকটা
টেক্সট মেসেজ। বাজ করছে
তার বাম পাশের পেটের কাছে। সুড়সুড়ি লাগতো যদি সোয়াটার না থাকতো। হাত দিয়ে অনুভব
করলো। তাগাদা নেই। সীটে বসলেই দেখা যাবে। সীটে বসেই মনটা থমকে গেলো। উইং এর উপরে
সীট। কোন ছবি তোলা যাবে না। এই যে একটা শীতল
অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরেছে সে মায়ের জরায়ুতে ঢুকেছে। এর থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। ঘুরে
ফিরে সারা দেহে সেই অনুভূতি। ভয় লাগছে। কেন এমন হচ্ছে। আবার বলছে ধুর, এইসব
কিছু না। হ্যান্ড
ব্যাগ কোল থেকে নামিয়ে সীটের নীচে দিয়ে সীট বেল্ট পরে নিলো। ক্যামেরাটা অকেজো বসে
থাকবে। সাথে আছে নোটবুক কলম। হাতে লেখার অভ্যেস নেই বলেই নেটবুক কিনেছিল। লিখবে
বলে। প্রায় তিনঘণ্টা বসে থাকবে ঠায় সোজা হয়ে। কি করে হয়? নিজের
বোকামীর জন্য নিজের চুল চিড়তে ইচ্ছে করছে। চুল টাইট করে বাধা। উঁচু করে বান বেধেছে
সে আজ। সামনে কোন ব্যং রাখেনি ইচ্ছে করে। বারে বারে চোখে পড়ে। বিরক্ত লাগে।
প্রতিদিন ব্যং রাখে। এটা তার ফ্যাশান। আজ মুড নেই, ছিল না মুড। কে জানে মুড কার
বাড়ি বেড়াতে গেছে। নাকি ফাঁকিবাজি করেছে তার সাথে কেইবা জানে। মুডের
তোয়াক্কা না করে সে এখন ব্যাগ থেকে হ্যান্ড লোশানটা বের করে আলতো করে দু’হাতে
লোশান মাখিয়ে নিল। ইউক্যালিপ্টাস লোশানটা তার এক বন্ধু তাকে উপহার দিয়েছে আরও অনেক
জিনিসের সাথে। এই ফ্রেগ্র্যান্সটা তার মুডকে স্বাভাবিক করে দেয়। কেরামতি। ঘোষণা
। সব
সেলফোন, ইলেক্ট্রনিক
ডিভাইস অফ করে দেওয়ার নির্দেশ। পকেটে হাত দিয়ে সে ফোন অফ করে দেয়। হাতে
তুলে নেয় স্কাইসেল ম্যাগাজিন। আকর্ষনীয় সব জিনিসের বিজ্ঞাপন। বিশেষ করে ফুট পেইন রিলিভের জন্য অনেক রকম এক্সেসরিজ আছে।
কয়েকটা তার জন্য খুব দরকার। তার পায়ের গোড়ালির নীচে একটা স্পার হয়েছে। এই স্পার
তাকে সব সময় একটা করুণ ব্যথার মাঝে রাখে। মাঝে মাঝে সে খুড়িয়ে হাটে।
জুতার নীচে অনেক রকমের প্যাড লাগায়। কখনো কখনো কাজ হলেও সব সময় কাজ করে না। একটা
ম্যাসাজের মেশিন দেখে সেটা তখনি অর্ডার দিতে ইচ্ছে করলো। কভারটা চেক করে দেখলো, ম্যাগাজিনটা
কমপ্লি্মেনটারি কিনা। হ্যা, ফ্রি। তিনবার লেখা। তিন সত্যি। সুখ
পাখী সুখে ডেকে উঠলো বুকে। বুকের ব্যথা এতক্ষণ ছিল কিনা মনে পড়ে নি। এখন নেই। হাফ
ছেড়ে বাঁচল। সামনে এখনো অনেকগুলো বছর প্ল্যান করা আছে। এখনি হার্ট এটাক করা চলবে
না। ঘড়িটা থামিয়ে দিতে হবে। এইসব কাজ হাতে রেখে মরার কোন মানে হয় না। ইচ্ছার ঘড়িতে
সে জোরে দম দেয়। বাচতে হবে। মরে গেলেই অন্য ভুবন। প্লেন টেক অফ করছে। সবাই যার যার
সীটে বসা। এই সময় সবাইকে বসেই থাকতে হয়। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে এয়ার
কানাডার আরেকটা প্লেন টেক অফ করছে। মনে হচ্ছে ছোট্ট দিয়ান তার মায়ের দিকে হাত তুলে
দিয়েছে কোলে নেবার জন্য। একদিন আমরা সবাই এমনি করে হাত তুলে দিতাম বড়দের কাছে, ভাবল
সে। আকাশের চেয়ে বড় কেউ নেই মাটিতে। প্লেন তার কাছে হাত উঁচু করে দিয়েছে তাকে কোলে
তুলে নিতে। গোত্তা খেয়ে তার প্লেনটা চলে গেলো অন্যদিকে। আর দেখা হলো না। অন্য
প্লেনটা কি করে আকাশের কোলে উঠলো। পানির পিপাসা লেগেছে। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে
এক ঢোক পানি গলায় ঢেলে দিল । বাংলায় সবাই পানি খায়। সে চিবোতে পারলো না পানি।
অলমন্ড এর কোটা থেকে বের করলো একটা অলমন্ড। মুখে দিল। পানির সাথে চিবিয়ে
খেল। ফ্রেশানার স্প্রে করে দিল জিহ্বার নীচে। লিক করছে তার স্বাদ। মিন্ট ফ্লেভার।
গলার জন্য খুব উপকারী।
পুরো ম্যাগাজিনটায় তার মন একেবারে এনগ্রেভ হয়ে গেছে।
চারিদিকে কি হচ্ছে। কিছুই খেয়াল করছে না। দেখছে একটার পর একটা বিজ্ঞাপন।
ছেলেদের বিজ্ঞাপনগুলো
এড়িয়ে যাচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্যে। মেয়েদের ফিগার শেপের জন্য একটা মাইক্রো ফাইভারের বডি
শেপার খুব পছন্দ হলো। টিক মার্ক করে পরে্র পৃষ্ঠায় চোখ রাখলো। একটা ইন্টারভিউ ।
নাসার একজন সাইন্টিস্টের সাথে স্কাইসেল ম্যাগাজিনের। খুব আকর্ষণীয়। ব্ল্যাক হোল
নিয়ে অনেক রকম প্রশ্ন। উত্তরগুলো ঠিক পরিস্কার নয়। অনুমানের একটা ধাঁচ বজায়
রেখেছে। অনুমান
নির্ভর উত্তর বিজ্ঞানীকে মানায় না। হাতে সঠিক প্রমাণ না থাকলে বিজ্ঞানীরা নিরেট
উত্তর দিতে পারে না। তার মনে হলো কেউ যদি ব্ল্যাক হোল থেকে একবার ফিরে আসতে পারতো, তা
হলে পৃথিবীর সভ্যতা ভিন্ন দিকে মোড় নিত। এমন সময় পাশের সীটের মহিলা একটি গল্পের বই
বের করে তার ব্যাগ থেকে। নাইনটি মিনিট ইন হেভেন। ইন্টারেস্টিং। নাইনটি
মিনিট ইন হেভেন। এ ট্রু স্টোরি অফ ডেথ এন্ড লাইফ। এবং
নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার বুক। জিজ্ঞেস করার আগেই মহিলা তার নাম ক্রিস্টিনা
বলে বইয়ের কাহিনী বলা শুরু করে। সে তার নাম ডেইনা বলেই চুপ করে শুনতে থাকে। ডেইনা
বইটা হাতে নেবার আগ্রহ প্রকাশ করে। বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। কভারের উপরের
লাল বাসের ছবিটা তাকে খুব আনমনা করে দিচ্ছে। রাস্তায় এমন বাস এসেই কি মানুষকে নিয়ে
যায় অন্য গ্রহে? তা
হলে ইজরাইল বলে আসলেই কেউ নেই কিছু নেই? প্রাণ সংহার এইসব কিছু নয় ? মানুষ চলে যায়
একটি যানবাহন ছেড়ে অন্য রকমের যান বাহনে চড়ে অন্য গ্রহে। দেশান্তরের
মত। গ্রহান্তরে। বস্তুর অবিনাশি শক্তি ! আমরা প্রতিদিন রসায়ন। প্রতিদিন পদার্থ
বিদ্যা। শরীরের ভেতর রসায়ণ বিক্রিয়া শুরু করে। বইটি ফেরত দিয়ে তারা কে কোথা থেকে
এলো , কোথায়
যাচ্ছে এইসব মামুলি গল্পে মেতে গেল । ক্রিস্টিনার
নিবাস হলো গুয়েলফ, অন্টারিও
তে। বয়েস সাতান্ন বছর। তার হাবি ও সে কানাডার শীতের সময়টা থাকে ট্যাম্পা, ফ্লোরিডাতে।
কানাডার গরমের সময় তারা গুয়েলফে ফিরে আসে, গার্ডেনিং করে। অনেক রকমের
ফুলের গাছ লাগায়। ফিশিং এ যায়। ক্যাম্পিং করা তাদের নেশা। তারা সময়কে কিনে নিয়েছে
তাদের আর্থিক সামর্থ্য দিয়ে। ট্যাম্পা থেকে প্রায়ই ক্রুজে যায়। বাহামা ক্রুজ, ক্যারিবিয়ান
ক্রুজ, হাওয়াইন
ক্রুজ । গ্রায়ন্ড চিলড্রেনদের সাথে সামারটা আনন্দেই কাটে। বুকের
ভেতর কেমন যেন একটা চাপ। চাপচাপ ব্যথা, খসখসে ব্যথা। মেঘবতী আনন্দ।
জলঘন আনন্দরশ্মি তাকে মুছে দিচ্ছে আলতো করে। ব্যথা ভুলে যায় সে। একটা ভাইভ চারিদকে
ছড়ানো। খুব পরিচিত একটা পারফিউমের গন্ধ এসে নাকে টোকা দিচ্ছে। না না সে কি করে
এখানে আসবে? সে
তো তার কাজে ব্যস্ত। সে সোজা চলে যাবে গন্তব্যে। দেখা হবে সেখানে। সেই তো
উদ্দীপনা। ব্যাগে অনেক রকমের ভাইটামিন আছে। বেবি এস্পিরিনও আছে। খেতে চাচ্ছে না সে
এখন। আই ইউল উইন দা পেইন অ্যান্ড হার্ট।
প্লেন এসে ঠিক টাইমেই আটলান্টা
এয়ারপোর্টে থামে। নিতে হবে ট্রান্সিশান। কেউ তাড়া করছে না। ক্যারিওন
ব্যগ বের করতে হবে না ওভার হেড বিন থেকে। লাগেজগুলো সামনেই পাবে তারা। হ্যান্ড ব্যাগ
কাঁধে ঝুলিয়ে জ্যাকেটটা বাম হাতের কব্জিতে হ্যাং করে ক্রিস্টিনার পিছু পিছু সেও
বেরিয়ে আসে সীটের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে। আইল ধরে হাঁটছে। সবাই এটিকেট বজায় রাখছে।
মনের ভেতর একটা গান সুর ভাঁজছে। গানের কথা মনে আসছে না। ঈশ এই গানটা যদি ওকে গেয়ে
শোনাতে পারতো। মনের ভেতর ইচ্ছে ঝালমুড়ি। ক্রিস্টিনা বাই বলে চলে গেলো। মনে হলো
পেছনে খুব চেনা কেউ। ঘাড় ঘুরাতে যাবে এমন সময় ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট বললো, হ্যাভ
আ নাইস ডে। বুকের ভেতর বাঁশী বাজছে। ব্যগটা ঠিক করে নিলো কাঁধের উপরে। বাম কাঁধেই
ব্যগ রাখে সে। জ্যাকেটটা আরেকবার টেনে নিলো। জুতার ভেতর পাটাকে টেনে ঠিক করলো।
পীঠের কাছে একটা অদ্ভুত বাতাস শীষ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘাড়টা কেমন যেন শক্ত হয়ে
যাচ্ছে । ঘুরাতে পারছে না। পেছনে কে? এমন কেন লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ, মনে
হচ্ছে সে ভালোবাসা তাকে জাপটে ধরছে। ডান পা জেট ওয়েতে। বাম পা প্ল্যানের ভেতরে।
ডেইনার শরীর পড়ে যাচ্ছে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীত দিকে। জেটওয়ের মেঝে স্পর্শ করার আগেই
পেছন থেকে জাপটে ধরে ডেইনার শরীর। ডেইনা জানেনা। কে? ডেইনার মুখ থেকে ফেনা বেরুচ্ছে।
নীল হয়ে যাচ্ছে শরীর। ম্যাথিউ চিৎকার করে বলছে কল নাইন ওয়ান ওয়ান। ইমারজেন্সী
চারিদিকে। ছুটছে সবাই সবার দায়িত্ব হাতে, কানে, ঘাড়ে
করে। আই ইউল উইন দা পেইন অ্যান্ড হার্ট। ম্যাথিউ চুমোয় চুমোয় ভরে দিচ্ছে ডেইনার
চোখমুখ। অবাক করতে এসে এ কোন অবাক ব্ল্যাকহোলে যাত্রা আরম্ভ হলো? ভেতরে
বাহিরে দু’জনের
হেটে যাওয়া হলো না। হবে এই বিশ্বাস সুদৃঢ়। ডেইনা এমন করতে পারে না। ডেইনার
পাস পোর্ট কোনদিন স্ক্যান হবে না। নাইনটি মিনিট ইন হেভেন। অকারণেই অনেক লোক
খটাখট স্ক্যানারে পাসপোর্ট স্ক্যান করে চলে যাচ্ছে গন্তব্যে, গ্রহান্তরে।
দামিনী যামিনী কাটাতে পারেনি ঘরে। বাসের ভেতর পড়ে গিয়েছিল অকারণে।
নন্দিতা ভট্টাচার্য
ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জ্জী
মিলি এবং জলি দুই বোন । বাবা মা’র আদরের মেয়ে । মিলি মাধ্যমিক পাস করেছে জলি ক্লাস টেন এ পড়ে। মিলি পডাশুনোর চেয়ে টিভি দেখা, আড্ডা দেওয়া , বন্ধুদের সঙ্গে বেডান, এই সবই বেশি করে। বাবা একটা কেরানির চাকরি করতেন । হঠাৎ মারা যান । প্রথম স্ট্রোকেই মারা যান । ঘরে আর কেউ রোজগারক্ষম ছিলেন না । মিলি,জলি কে নিয়ে শহরে মামার কাছে এসে ওঠেন ওদের মা ।
নন্দিতা ভট্টাচার্য
ইছামতির চুপকথা
দুটো
সাইকেল ভ্যানে আমরা ৮ জন শিক্ষিকা বর্ডার থেকে ফিরছিলাম । বর্ডার যাওয়া কোন কাজে
নয় । --নিছক ই বাপ- ঠাকুর্দার ‘ঐপারে সাতক্ষিরে ‘ – আমাদের ও কেমন যেন বুকে মোচড়
দিয়ে ওঠে --কত কথা ছোটবেলা থেকে শোনা ---কেবলই সুখের ছবি আঁকা –স্মৃতির
ফুলঝুরি –কথায়
কথায় ঠাকুমা –বাবা
–মা
দের-- আমরা ঐ বাগানে যেতাম –সেই বাগানে কুল কুড়োতাম -ওখানে পেয়ারা বাগান –জাম
বাগান –আম
বাগান -কাঠাল তলা । উত্তরের পুকুর – দক্ষিনের পুকুর – বড়
পুকুর – ছোট
পুকুর । পুকুরের পার দিয়ে ঝি ডাক দিত আমরা গ্রামের মেয়েরা এক সঙ্গে দলবেধে স্কুলে
যেতাম । ওপারে সবটাই যেন মোরাম বিছানো । আর এপারে সবটাই যেন কাঁটা ।
‘হুই
দূরে দ্যাশ ‘ আমাদের
– সেই
দ্যাশের ছ্যায়া দেখার জন্যে হুটপাটি করে রওয়ানা হওয়া । স্কুলের
মেয়েদের নিয়ে এসেছি টাকিতে ---ইছামতির পারে । ‘ শিক্ষা সফর’ –এক’শ
জন ছাত্রীর দল । বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । টাকি পৌরসভার অতিথিশালায়
দুখানা ঘর নেয়া হয়েছে । বিশ্রাম করার জন্যে । কেউ কেউ একটু গড়িয়ে নিতে চাইছেন , অনেক
সকালে বেরনো হয়েছে । মেয়েরা ইতিমধ্যেই দোলনার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে । বল নিয়ে
হুড়োহুড়ি করছে মাঠে । বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মজার উৎস । এই দিনটির
জন্যে মুখিয়ে থাকে ওরা । একটুখানি স্বাধীন হওয়া আর কি । বাবা মায়ের গার্জিয়ান-ই
থেকে মুক্তি কিছুক্ষনের জন্যে , আবার দিদিমনিরাও সেদিন বেশ ফুরফুরে , বকা
ঝকার বালাই নেই । বাসের মধ্যে ক্ষুদে দিদিমনিদের সঙ্গে নাচতে নাচতে আসা । তারস্বরে
হিন্দিগান আর তার সঙ্গে উদ্দাম নাচ । মজাই মজা । ইতিমধ্যেই রোমিও দের আনাগোনা শুরু
হয়ে গেছে । বয়স্ক দিদিমনিরা সতর্ক হয়ে উঠলেন । চল , চল , চল
ঐ দেখ পার্কে মেয়েরা দোল খাচ্ছে আর ছুঁচোর দল হাজির । স্কুলে ছুটির পর রোজই সেই এক
কাণ্ড । কাল চশমা পরে মোটর সাইকেল বাগিয়ে হিরোরা ঘোরাফেরা করছেন । দিদিমনি ও মা
বাবাদের বুকে ছ্যাঁত । তারপর গরু তাড়ানো । বিশ্রাম চুলোয় গেল , বয়স্ক
দিদিমনিরা পড়িমরি করে ছুটলেন বাইরে গরু তাড়াতে ।
রান্না
বান্না শুরু হয়ে গেছে । বাসে সকালের জলখাবার দেয়া হয়েছে এক প্রস্থ । এখানে এসে চা
-কফির ব্যবস্থা হয়েছে । যত খুশি ইচ্ছে খাও । হঠাৎ দেখি মেয়েরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে , উপছে
পড়ছে । বাঁশি শুনে বুঝলাম সাপ খেলা । আমরাও চার –পাচজন গুটি গুটি এগোলাম ।
সকালের হুটোপাটির পর এখন অবস্থা বেশ স্থিতিশীল । সবাই যে যার কাজে লেগে পড়েছে ।
মেয়রাও বেশ গুছিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যার যার মত পছন্দসই মজায় মেতেছে । এমন
সময় দুজন ভ্যান ওয়ালা এসে হাজির । আমরা চার পাচ জনের একটি দল ছিলাম বলল দিদি
বর্ডারে যাবেন ? .হঠাৎ
কানখাড়া করে সুমিত্রা বলল কি বলছে রে , ভ্যান ওয়ালা ? ওরে
বর্ডারে যাওয়ার কথা বলছে রে, যাবি চ’ ! সুমিত্রা আমাদের নাচুনি বুড়ি ।
সব নাচনের ধুনুচি হচ্ছে ও ! আমরা তো ধোঁয়া দিয়েই আছি । উঠলো বাই তো কটক যাই । পড়ে
রইল মেয়েরা , মেয়েদের
পাহারা দেয়া !
বড়দি কিছু বলবে না’তো রে । ঐ হল জয়া ! ভয়েই মরল
মেয়েটা । মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলো সুমিত্রা । আরে রাখ তোর বড়দি । তেল লাগিয়ে
কুল পাচ্ছে না । করিস তো সরকারি চাকরি । এত ভয় কিসের রে ? ভাল
মেয়ে সাজছেন । আর একটা কথা না বলে ভ্যানে ওঠ । তাড়াতাড়ি কেটে পড়ব । ফিরে আসতে হবে তড়িঘড়ি।
চারটেতে ফেরার বাস ছাড়বে । চেপে বসলাম দুটো ভ্যানে । কারোকে কিছু না বলেই রওয়ানা
হয়ে গেলাম । মেয়েদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও কিশোরী বেলায় ফিরে গেছি যেন !
নদীর ধার
দিয়ে বাঁধের উঁচু রাস্তা । ডান পাশে দোকানে –কোক-পেপসি , মাজা
, হরেক
রকম সফট ড্রিঙ্কস , চিপস
, কৌটোয়
বিভিন্ন রকম বিস্কিট ,
পানপরাগ ইত্যাদি যা যা সব টুরিস্ট স্পটে থাকে সব রয়েছে ।
এসব দোকানের সঙ্গে শহরের দোকান গুলোর খুব তফাত নেই । প্রত্যন্ত
গ্রামেও ভাত না থাকুক পেপসি-কোলার বোতল পাবে । মার্কেটিং কাকে বলে ! বাঁশ – দরমার
তৈরি দোকান। কোনটা আবার তীরের দিকে এগোনো –মাচার মত । তার ওপর কম বয়েসি স্কুল-কলেজ
পালিয়ে প্রেম করতে আসা ছেলেমেয়েরা , পাকা খেলুড়েরাও আছেন । এই ভর দুপুরে বিয়ার
চলছে জমিয়ে । বা দিকে জমিদার রায় চৌধুরীদের আস্ত ভাঙ্গা মিলিয়ে অনেকগুলো বাড়ি পর
পর । সারি সারি দাড়িয়ে আছে এখনও । এর মাঝখানেই তৈরি হয়েছে বিরাট বি এস এফ ক্যাম্প
। গাছে গাছে লেটারবক্সের মত আটকান বাক্স , তাতে রাখা বুলাদি । ঘ্যাচাং
করলেই বেরিয়ে আসে । বর্ডার এলাকা তাই বি এস এফের রমরমা । আর বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা
। জামাই আদর আর কাকে বলে ! আমাদের দেখাশোনা করছেন কি না ! তাই শরীর টা তো রাখতে
হবে ! গুমটিতে ইতস্তত বসে আছেন তেনারা । সোজা বাঁধের রাস্তা আরও এগিয়ে গিয়ে বা
দিকে গ্রামে ঢুকে পড়লাম । বেশ উন্নত । বর্ধিষ্ণু গ্রাম । মাঝে মাঝে বাগান বাড়ি , সরকারি
অফিস , এন
জি ও দের ঠেক । কুমোর পাড়া – কামার পাড়া । পাকা বাড়ি থেকে আস্তে আস্তে
ছোট ছোট বাঁশের বাড়ি ঘর চোখে পড়ল । উঠোনের মাঝখানে বিরাট বিরাট উনুন । রিকশাওালা
কে জিজ্ঞেস করায় সে বলল ওগুলো খেজুর গুড় বানানোর জন্যর রাখা আছে। শুনেই ঠিক করে
ফেললাম ফেরার সময় নিয়ে যেতে হবে । নিশ্চয়ই খাঁটি হবে । পেস্টিসাইড , ক্যামিকাল
সার দেয়া সবজি ইত্যাদি খেতে খেতে ভেজাল খাওয়া আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে । খাঁটি কোন
কিছু পাওয়ার জন্যে সব সময়ই লোভ হয় । মাঝখানে একবার বি এস এফের কাছে তও্ব - তল্লাস
হয়ে গেছে । কজন যাচ্ছে । কারা কারা আছে ইত্যাদি । মাথা গুনে নিল । সত্যি তো যদি
পাচার হয়ে যায় । হাসি পেল । বি এস এফ গুমটি পেরিয়ে আর কিছুতা গ্রামের ভেতরে ঢুকে
গেলাম আমরা । হোগলার বন চোখে পড়ল । লোকালয় ছাড়িয়ে চলে এসেছি । ভ্যানওয়ালা বলল , দিদি
আসুন আমরা এসে গেছি । কিছুটা আপনাদের হেঁটে যেতে হবে । আমরা এখানে অপেক্ষা করছি ।
সবার
ই মনে মনে কিন্তু ভয় করতে লাগল । জায়গাটা বেশ নির্জন । জন মানব নেই। আমরা ক’জনা
শুধু । মনে ধুকপুক নিয়েই হেঁটে রওয়ানা হলাম । পিচের রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তায়
উঠলাম । বর্ডার এলাকায় সরকার রাস্তা গুলো কিন্তু খুব ভাল তৈরি করেছে । তাই পুরো
রাস্তা ই বাঁধানো ,ভাল
পাকা রাস্তা । বা দিকে নদী । হোগলার বনের মাঝখান দিয়ে এগোতে এগোতে নদীর কাদা মাখা
তীরে এসে দাঁড়ালাম । জোয়ারের জল নেমে গেছে । কালো মাটি , ভিজে
থকথকে । দাঁড়াবার কোন জায়গা প্রায় নেই । ওপারে কিছুই দেখতে পেলাম না । নদির
বিস্তৃতি ছাড়া । খুব আশাহত হলাম । এ হরি এই দেখতে এত দূর ছুটে আসা । সুর্য মাথার
ওপর । এপারে ওপারে কিছুই তফাত বুঝতে পারলাম না । কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে ফিরে এসে
ভ্যানে উঠলাম । ভ্যান মানে ভান রিক্সা । মারুতি ভ্যান নয় । আবার সেই গ্রামের মধ্যে
দিয়ে যাত্রা । মাথায় বসে গেছে দিদি খাঁটি খেজুরের গুড় পাবেন । ভ্যানে উঠেই বললাম, চলতো
ভাই কোথায় তোমার খাঁটি খেজুরের গুড় । দেখি রাস্তা দিয়ে একটা লোক চারখানা হাড়ি নিয়ে
আসছে –ঝোলা
গুড় । তাকে আমরা ঘিরে ধরলাম । সে বলল না দিদি আমার কাছে কিছু নেই । বিক্রিবাট্টা
সেরে ফিরছি । আপনারা ওই বাড়িগুলোতে খোঁজ করুন ।
কাছেই
দেখলাম একটি টালির বাড়ি । সেখানে বড় বড় উনুন রয়েছে । তাতে আঁচ নেই যদিও । ছুটলাম
আমরা খাঁটির খোঁজে । প্রায় ৩টে ট বেজে গেছে । নিঝুম দুপুর । এলাকা ঝিম ধরে আছে ।
উঠোনে উনুনগুলো একা একা বার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে । আমরা বাইরে কারোকে দেখতে না পেয়ে
সোজা বারান্দায় উঠে হাঁক পাড়লাম । বাড়ির বৌটি বেরিয়ে এল সঙ্গে লেজুড় হয়ে ঝুলছে
ছানা কোমরে । পেছন পেছন বাড়ির কত্তা ও বেরিয়ে এলেন । দুটি ছেলে উঠোনেই খেলছিল ।
দুজনেরই বেশ ভদ্রস্থ কাপড়চোপড় পরা । আমরা খাঁটি খেজুরের গুড়ের সন্ধান করছি জেনে
হয়ত মনে মনে হাসল । ঝোলা ও এমনি গুড় দুটোই আনল । দাম এবং চেখে যা দেখলাম আমাদের
খাটি পাওয়ার ইচ্ছে উবে গেল । বলল দিদি সে দিন আর নেই সব ভাল জিনিষই বিদেশ চলে যায়
। আমরা গুচ্ছ টাকায় তার তলানি কিনি । যদিও বিদেশে পাঠানোয় সুফল এদের ঘরে পৌঁছোয়
বলে মনে হয় না । লাভের গুড় কাদের ঘরে ওঠে তা আঁচ করতে অবশ্য অসুবিধে হয় না ।
তড়িঘড়ি ভ্যানে বসে ফেরার উদ্যোগ নিলাম । এদিকে দেরিও হয়ে যাচ্ছে । আমরা আরও অনেকটা
এগিয়ে এসে সেই বি এস এফের গুমটি কাছে এলাম । সেখানে একটা কালভার্ট পেরোতে হয় ।
ভ্যান আবার ওখানে দাঁড়িয়ে মাথা গোনাল । ছোট বাঁশের মাচার ওপরে দু জন সিপাই বসা ।
এত গোনা গাথা অথচ মেয়ে পাঁচারের খবর তো রোজ পত্রিকার পাতায় । কত যে বাঁচাল নিয়ম
কানুন !কালভার্ট পেরোলে আবার আস্তে আস্তে ঘরবাড়ি চোখে পড়তে লাগল । আমরা আবার রওয়ানা
হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি । কিন্তু হটাত পা দুটো মাটিতে আটকে গেল ! থমকে গেলাম আমি !
শুনছি একটি বিড়বিড় কথা । কান পাতলাম । অবাক কাণ্ড ! এ কোন ভাষা শুনছি ! কে কে বলছে
? আমার
শিরাগুলো টানটান । এখানে?
হতেই পারে না । আমার কানের ভুল ! সবাইকে বললাম একটু দাঁড়া
। আবার কান পাতলাম , মুর
চুলিটূ টানি পেলাই দিলে । কান কে বিশ্বাস করতে পারলাম না !! আশ্চর্য ! এখানে ? অসম্ভব
। কিন্তু অসম্ভব বললে তো হবে না । কোন বাতাস থেকে উত্তর-পুব ভারতের এলোমেলো অবোধ
কথা বার্তা ভেসে আসছে । জন্মের সুবাদে ভাষা টি আমার খুব পরিচিত । তারপর হিজবিজ বোঝা
না বোঝার দীর্ঘ এক মনোলগ । একক বাক্যালাপের সন্ধান করতে গিয়ে চোখ ঘুরিয়ে দেখি –বি
এস এফের মাচায় ওদের সঙ্গে গায়ে গা ঠেকিয়ে একটি মেয়ে ঠ্যাং দোলাচ্ছে । সালোয়ার
কামিজ পরা । থ হয়ে গেলাম ওর চেহারা দেখে । বেশ লম্বা ছিপছিপে । কোঁকড়া জট পাকান
চুল । রঙ যে এককালে বেশ ফর্শা ছিল বোঝা যায় । এখন তামাটে । কয়েক গুছি চুল কপালের
ওপরে হেলায় পড়ে আছে । পাতলা ঠোঁট । আমার তো সব ওলটপালট হয়ে গেল । উপে গেল সব
উচ্ছাস নাচানাচি । মনের ভেতর যে কি একটা আকুলি বিকুলি হচ্ছিল বোঝাতে পারব না । মনে
হচ্ছিল এ কে ? কোথা
থেকে এল ? সব
খবর আমার এক্ষুনি জানতে হবে, এক্ষুনি । বন্ধুরা বুঝতে পারছে না কি হল ? অবাক
হয়ে আমার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে । কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে আমি ঠিক করলাম, জিজ্ঞেস
করেই ফেলব যা আছে কপালে । দূরে কত গুলো ছেলে বিভিন্ন বয়েসের দাড়িয়ে ছিল ।
গ্রামে
ঢুকলে বাইরে থেকে কে এল গেল এসব খবর রাখার জন্যে কিছু লোক থাকে । তারমধ্যে
রাজনৈতিক দাদাদের চেলারাও থাকে । বাইরের লোক এলে এদের পুঙ্খানুপুঙ্খও খবর পৌঁছে
দিতে হয় ! ওদের দিকে একবার তাকিয়ে বি এস এফের সেপাইকে সটান জিজ্ঞেস করলাম, এই
যে মেয়েটি আপনাদের সঙ্গে বসে আছে ও কি আপনাদের লোক ? কিছুক্ষন আমার মুখের দিকে
তাকিয়ে নির্বিকার অন্য দিকে তাকিয়ে রইল । যেন কোন প্রশ্নই ওকে করা হয় নি ।
বিষণ্ণ
মন নিয়ে ভ্যানে উঠলাম । মনটা খচখচ করতে লাগল। যে উচ্ছাস নিয়ে গিয়েছিলাম ফেরার সময়
যেন পুরো উলটে গেল । উন্মনা হয়ে রইলাম পুরো রাস্তাই । ফিরে এলাম , গুম
হয়ে রইলাম । কিছুতেই আর আগের মনটা পাচ্ছি না । স্কুলে যেতে থাকলাম যথারীতি ।
প্রচুর ছবি তোলা হয়েছে । আজকাল তো আবার ক্যামেরার সিমা সংখ্যা নেই । স্কুলে বসেই
সেগুলো কম্পিউটারে দেখা হচ্ছে । ততই আমার মনটা পাগল পাগল লাগছে । ভীষণ সুন্দর
ইছামতী । ছবিতে পুরানিো জমিদার বড়ির ধ্বংসাবশেষ । বিশাল নদী । মনে হয় যেন দু/ তিন
দিন থেকে আসি । সব কিছু বার বার ফিরে ফিরে আসছিল । সঙ্গে আজানা খচখচ । অন্য এক
ব্যাকুলতা । ভাষার মধ্যে এমন বেদনা বোধ ! বিচ্ছিন্নতা ! একাকীত্ব ! কয়েকটা শব্দ
আমাকে চুম্বকের মত টানছে কেন ? আমার এন জি ও বন্ধু নিবিড় ও বনানীকে বললাম, যাবি
একবার জায়গাটা ভারি সুন্দর ! মনের মধ্যে অন্য ফন্দি । কিছুতেই আর সুযোগ হচ্ছে না
।আবার বনানীকে খোঁচাই চল না রে একবার ।
হঠাৎ
দিন চারেকের ছুটি পাওয়া গেল । কিসের তাড়া ? মনে হচ্ছে যেন একদিন দেরি হলে
সব হারিয়ে যাবে । তর সইছে না । দিন ঠিক হল । হাসনাবাদ লোকালে যাওয়া হবে । সকালে
ট্রেন । পৌঁছলাম । ইছামতির পারে হোটেল গেস্ট হাউস আছে । ইছামতীর পারে জমিদার বাড়ির
কিছু অংশ নিয়ে তৈরি গেস্ট হাউস । ছড়িয়ে ছিটিয়ে খন্ডহর জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ।
অনেক টা জায়গা জুড়ে ছড়ানো । বনানি আমি ও নিবিড় দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে গ্রামের
পথে রওয়ানা হলাম । নিবিড়ের কাজের সুবাদে এখানে কিছু লোকজন চেনা আছে । এটাসেটা
জিজ্ঞেস করে আমরা একটু ভাব জমাতে চাইলাম । হুট করে তো এসব কথা বলা যায় না । কিন্তু
কেউ ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে বলে মনে হল না । আমরা একটা ভ্যান নিয়ে আগে যে পথে গিয়েছিলাম
সেই পথ ধরে বাঁধের সোজা ইছামতিকে ডান দিকে রেখে এগোতে লাগলাম । পেরোলাম বি এস এফ
ক্যাম্প । ইছামতীকে ডান দিকে রেখে এগোতে লাগলাম । এলাম বিএস এফের সেই ঝুপড়ির কাছে
যেখানে মেয়েটিকে দেখেছিলাম ।ওটা চেক পোষ্ট । ওখান থেকেই রাস্তা এঁকেবেঁকে গ্রামের
মধ্যে দিয়ে একেবারে বর্ডার পর্যন্ত চলে গেছে । না আজ আর ওকে দেখতে পেলাম না ।
কিছুটা নিরাশ হলাম । কি ভেবে ছিলাম ? গিয়েই দেখা পাব , আমার
জন্যে ফুল চন্দন সাজিয়ে বসে থাকবে ? নিবিড় জিজ্ঞেস করল - কি রে দেখতে পাচ্ছিস ? আমি
মাথা নাড়লাম । অনেক ক্ষন থেকেই আমাদের মুখে কথা নেই । একটা টেনশন কাজ করছে ।
আমাদের ইতি উতি তাকাতে দেখে কয়েকটি ছেলে এগিয়ে এল । জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল । আজকাল
এত সহজে গ্রামে যে কেউ ঢুকে চলে যেতে পারে না । বাইরে থেকে কে এল না এল তার পুরো
খবর কোথাও পৌঁছে দিতে হয় । এবার নিবিড় এগিয়ে গিয়ে বি এস এফের জওয়ানদের জিজ্ঞেস করতে
শুরু করল । তারা কেউ মুখ খুলল না ।আজকাল আবার সহজে কেউ মুখ খুলতে চায় না । ভাবে
মিডিয়া । সেই ছেলেগুলো বসে বসে আমাদের লক্ষ্য করছিল । কথাবার্তা মনযোগ দিয়ে শুনছিল
। তারা বেশ হুমকির সুরে বলল, এখানে ওরকম কেউ নেই দাদা , আপনারা
চলে যান । দেখবেন আবার না কোন হুজ্জতি হয়ে যায় । বাইরের লোক হুট হাট করে চলে আসেন
! নতুন
জায়গা একটু সমঝে চলতে হয় । বেগতিক দেখে আমরা সেদিনের মত পাততাড়ি গুটোলাম । বনানি
বলল , না
এভাবে অত সহজে হবে না । খবর বার করতেই হবে । মনে হচ্ছে আমার জেদ ও ইচ্ছে সকলের
মধ্যে সঙ্ক্রামিত হচ্ছে । জেদ চেপে গেল আমাদের ।
গেস্ট
হাউসে ফিরে সবাই চুপচাপ ব্যালকনিতে বসে রইলাম । সামনে ইছামতী । বয়ে যাচ্ছে ।
আমাদের মনে তুলকালাম । আকাশে চাঁদ নেই । জলে কালো ছায়া । জলের মাথায় আবছা আলোর
তিরতিরানি । ফিরে
এলাম আমরা পরের দিন । বুঝলাম আরও আটঘাট বেঁধে যেতে হবে । ব্যাপারটা এত সহজ হবে না
। নিবিড়ের
মানবাধিকার কাজের সুবাদে অনেক জানা চেনা । -- স্বভাবটি ওর ভাল ও সৎ বলে প্রত্যেকে
ওকে ওজন দেয় । ও দেখা করল ওর এক এন জি ও বন্ধু শুভ্রর সঙ্গে । শুভ্রর টাকিতে কিছু
জানা চেনা আছে । ও খোঁজ খবর নিতে শুরু করল গোপনে গোপনে । পরের বার আমরা আর গেলাম
না । --মেয়েরা সঙ্গে গেলে আবার সব কিছুর বেশি খবর হয় । যাক নিবিড়ের জেদ চেপে গেছে
দেখে অনেকটা হাল্কা বোধ করলাম । খবর এল ! মেয়েটি টাকির রাস্তায় বাঁধের আশপাশে
ইছামতির পারে ঘুরে বেড়ায় । ক্যাম্পের কাছেই থাকে । যেখানে যখন যেমন খাবার জোটে তাই
খায় । সারাক্ষণ বক বক করে । মাথায় জট । যেমন হয় আর কি ! বাঁধের কাছের ছোট ছোট
খাবার হোটেল গুলো থেকেও খাবার দেয় । শুভ্র খবর সংগ্রহ করার জন্যে উঠে পড়ে লাগলো , জানালো
, খুব
কঠিন ব্যাপার রে কেউ কিছু বলতে চাইছে না । ফিস ফিস গোছের গোপন । মেয়েটিকে
বি এস এফ ক্যাম্পের ভেতরেও ঘোরা ঘুরি করতে দেখেছে অনেকে । শুভ্র গ্রামের কিছু
লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের ওখানে যেতে বলল । বুঝলাম কাজ এগিয়েছে । নিবিড়কে
বললাম , নিশ্চয়ই
কিছু সুরাহা হয়েছে । নাহলে শুভ্র যেতে বলত না ।
আমরা তিনজন আবার একদিন সকালে রওয়ানা হলাম ।
সরাসরি ঠিক করে রাখা গোপন জায়গায় গিয়ে উঠলাম । আমরা চাইনি কাক পক্ষীতে ব্যাপারটা
জানুক । শুভ্রর জানাশোনা লোকজনের সঙ্গে দেখা হল । আমরা ওদের আমাদের উদ্দেশ্য , ইচ্ছে
জানালাম । বেয়ারিস মেয়ে ,
তার ওপর আবার পাগল । গ্রামের লোকেরা আমাদেরই বা কতটা জানে
। নেহাত কথা বলছে শুভ্রর ভরসায় । ওদের চোখে সন্দেহের ছায়া । অলিখিত দায়িত্ব তো
ওদেরও আছে । আমরা কতটা খাঁটি তা তো ওরা জানে না ! আমরা পাচারকারি কি না তার ই বা
কি ভরসা । আজকাল সাজগোজ দেখে তো কারোকে চেনা যায় না ! অনেক করে ওদের বোঝালাম ।
আমাদের বিস্তারিত ঠিকানা তথ্যাদি দিলাম । ওরা আমাদের আশ্বস্ত করে গ্রামে ফিরে গেল
।
পরদিন
ভোর ৪-টে তে শেয়ালদার ট্রেন । দেখলাম ওরা টিকিট কাউন্টারের থেকে একটু দূরে আবছা
জায়গায় দাড়িঁয়ে আছে । সামনে গিয়ে মা জনীকে দেখে আমার বুকের ভেতর টা হু হু করে উঠল
। কত কাছের মানুষ মনে হয় ! বোঝা গেল যাদের সঙ্গে এসেছে তাদের কে ও বেশ ভাল ভাবে
চেনে । চুপ করে দাড়িয়ে আছে । অবাক হয়ে গেলাম ওর ভাব সাব দেখে । আতঙ্কিত ছিলাম । সবটাই
তো জলে ঝাপ দেয়া । আমাদের দেখে কেমন নরম চোখে চেয়ে রইল । কোন কথা বা আলুথালু আচরণ
নয় । স্থির । কি বুঝেছে কে জানে!
নিঃসাড়ে ওকে নিয়ে ট্রেনে উঠলাম ।
অনুপম দাশশর্মা
৪২তম সংখ্যা ৩রা জানুয়ারি ২০১৩ । ৪টি গল্প লিখেছেন - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, শর্মিষ্ঠা ঘোষ, কৌশিক ভাদুড়ী ও ত্রিভুবন মুখার্জী
অনুপম দাশশর্মা
তলিয়ে
যায়নি
‘বৌদি, আসি
তাহলে আজ’। সামান্য
হেসে পিছন ফেরার মুহূর্তে একবার চোখাচোখি । সুতপা দেখল ঋজু ভঙ্গিমায় ক্রমশ মিলিয়ে গেল সুব্রত। সুব্রত
রায়, পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির সুঠাম চেহারা। সুতপার থেকে বছর চারেকের ছোট বয়সে। স্কুলের
সহ-শিক্ষক হিসাবে পাবার আগেই আলাপ পাশের বাড়ির মিসেস তলাপাত্রের সূত্র ধরে। ম্যারেজ
আ্যনিভার্সারির প্রোগ্রাম ছিল মিসেস তলাপাত্রের। ছিমছাম সাজানো ঘরে আলো করে বসা
প্রত্যেক গেস্টকে মাতিয়ে রেখেছিল ভীষণ টগবগে সুব্রত। ‘বৌদি আপনার মুখে আলাদা একটা
জ্যোতি খেলে আপনি বোঝেন না’। অত হট্টগোলের মধ্যে হঠাৎ গলা নামানো শান্ত কথাগুলো
সুতপাকে ছুঁয়ে গেছিল। সামান্য ঘাড় নিচু করে ধন্যবাদ
দিয়েই সুতপার সাড়া সেদিন ‘পাশের ঘরে খাতাটা রয়ে গেছে, এনে
দাওনা প্লিজ’। সুতপা
আশিষের কথা শুনে কিচেন থেকে পাশের ঘরে গেল।
আশিষ
স্যান্যাল। সাহিত্যজগতে যথেস্ট পরিচিত ব্যক্তিত্ব। বেশ কিছু পুরস্কার গর্বের
ঝুলিতে। বছর দুই আগে আ্যক্সিডেন্ট । স্পাইনাল কর্ড হেভিলি ড্যামেজড্।
হুইলচেয়ার। বাড়ি
ফিরে সুতপার কোমর
জড়িয়ে সেদিন হাউ হাউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। সুতপা হেসে
বলেছিল আমাকে অচেনা মনে হচ্ছে নাকি!
অতএব জীবনের ছায়াপথ বদল, নতুন অভ্যেসের উঠোন মানিয়ে নেওয়া।
তবুও বিবর্ণ ক্যানভাস মনে পলি জমায়, নিঃসন্তান সুতপা আড়ালে চোখ ভেজায়। সন্ধ্যের পর বাড়িতে ফিরলেই আশপাশ ঘেরা দমবন্ধ নিরাশা থমথমে ঘরে ছেয়ে যায়। বাঁধা গতের নিয়মমানা জীবন প্রবাহে হঠাৎ মৃদু ঝাঁকুনি। টিফিন পিরিয়ডে সুব্রত বৌদি বৌদি করে মাতিয়ে রাখে মজাদার গপ্পে ।
অতএব জীবনের ছায়াপথ বদল, নতুন অভ্যেসের উঠোন মানিয়ে নেওয়া।
তবুও বিবর্ণ ক্যানভাস মনে পলি জমায়, নিঃসন্তান সুতপা আড়ালে চোখ ভেজায়। সন্ধ্যের পর বাড়িতে ফিরলেই আশপাশ ঘেরা দমবন্ধ নিরাশা থমথমে ঘরে ছেয়ে যায়। বাঁধা গতের নিয়মমানা জীবন প্রবাহে হঠাৎ মৃদু ঝাঁকুনি। টিফিন পিরিয়ডে সুব্রত বৌদি বৌদি করে মাতিয়ে রাখে মজাদার গপ্পে ।
সুব্রতর মধ্যে জীবনের যাবতীয় উদ্দামতা
দেখেছে সুতপা । ওর
উচ্ছলতায় কখনও হেসেছে কখনও ফেলে আসা সোনালি বিকেলগুলো অদৃশ্য পর্দায় ঝালিয়ে নিয়ে অন্য
এক ভাললাগায় মেতেছে সময়ের স্বস্তি তিথিতে । সন্ধ্যের
আঁধার ঘরে সুইচ অন্ করলে আশিষ ভেসে উঠে বলে, এসেছো সুতপা ।
আশিষের চোখে অসহায়তার আর্তি সুতপাকে ভিজিয়ে
দেয়। টানটান কাঁধে মাফলার আলগা করে আশিষ যখন টেনে নিত
মাইক্রোফোন শৌর্য্যে, উল্টোদিকের
আসনে সুতপা গর্বের দানায় মিশে যেত মাটিতে। আর আজ, সমস্ত অনুভুতি বিকর্ষণে হাত
নাড়ে নির্বাক হুইল চেয়ার। পাশে সহোদর দুটি ক্র্যাচ। সুতপা শিশুর মুখ দেখে আশিষের
চোখে। অদ্ভুত বদভ্যাস হয়েছে। স্কুলে যেতেই আগ্রহী নজর ঘুরে বেড়ায় সুব্রতর খোঁজে।
সুব্রত সামনে এলেই এক ঝাঁক রোদ্দুর গোলাপের তোড়া হাতে হাজির।
সেই সুব্রত হঠাৎ একটু চুপচাপ, সুতপা
সামনে এলে দ্রুত পাশ কাটানোর ক্ষীপ্রতা। স্কুলের ফি-বছর পিকনিকে কখনোই যায়না
সুতপা। ভীড়ের মধ্যে সে বিড়ম্বিত হয়, ভালো লাগেনা । বাড়িতে এক জোড়া চোখ বড্ড দু'বাহু
বাড়ায়। তবুও বারংবার পিড়াপীড়িতে সিদ্ধান্ত বদলালো , সুতপা পিকনিকে যেতে রাজি হ’ল । সবুজ
ঘাসে মোড়া চারচৌকো হরেক ফুলের বাগান নীল আকাশের সাথে দুষ্টুমি করছে। দুষ্টুমিতে
মেতে আছে সবাই আনন্দের মৌতাতে। সুতপা ধাতস্থ হতেই একটা আলগা খুশীতে ভেসে উঠলো।
খোলা বাগানের শেষ প্রান্তে টুকরো ঝিল, ঝিলের পাশে মেজাজে এলিয়ে
তালগাছের পরিবার। সুতপা দেখল সুব্রত এক সুবেশা সুশ্রীর সাথে গল্পে জমে গেছে। চিনতে
পারলো। হিস্ট্রী টিচার মিসেস ব্যানার্জীর বোন। বাণিজ্যে স্নাতক, বারকয়েক
স্কুলে এসেছে কিন্তু সুব্রতকে দেখেনি কথা বলতে। অথচ পরিবেশের ভাললাগার সম্মোহনে
জড়তার মুক্তি ঘটে সাময়িক হলেও। সুতপা মুখ নীচু করলো বইয়ের পাতায়। নাহ্ এত হৈচৈ চোখ
পিছলে যায় অক্ষর থেকে। সুতপা দেখতে পেলনা সুব্রতকে, 'থাক গিয়ে' গোছের
ভাবটা এনেও আবার উৎসুক হয়ে পড়া, উঠে পড়লো, আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ঝিলের
দিকে।
ফুরফুরে
হাওয়ায় ঝিলের বুকে মাঝে মাঝে ডুব দিচ্ছে পানকৌড়ি। কখনওবা সাদা হাঁসের দল সরলরেখায়
জল কেটে যায়। এখানে নিস্তব্ধতা পাখনা মেলেছে। সুতপা আরো একটু এগিয়ে আকন্দর ঝোপের
কাছে থমকে দাঁড়ালো। ঝোপের গা ঘেঁষে পাশাপাশি দুটো পামগাছ। সুতপার স্তম্ভিত চোখ
স্থির হয়ে গেল। দুটো গাছের ফাঁকে দুটো শরীর ক্রমশ মিশে যাচ্ছে চারটি ঠোঁটের প্রবল
সুনামিতে । কয়েকটি
মুহূর্ত। একটু দূরে দাঁড়ানো সুতপার নজরে চোখ পড়তেই সুব্রত ছিটকে সড়ে গেল নন্দিনীর
থেকে। বিব্রত নন্দিনী চটজলদি হাঁটা দিল উল্টোদিকে। সুব্রত ধীর পায়ে সামনে এগোতেই
সুতপা পিছন ফিরে চলে গেল পিকনিক ম্যারাপে আমন্ত্রিত সবাই গোল হয়ে
বসে খেলায় মেতে আছে। নন্দিনী সেখানে স্বাভাবিক। সুব্রত একটু তফাতে নখ খুঁটছে।
সুতপার ভেতরে ভেতরে আবার অস্বস্তির পাগলা হাওয়া বইছে। ভেতরের সুতপা বলছে, যা
দেখেছ তা স্বাভাবিক, সত্যি।
হতবাক হবার কোন শর্ত নেই। দুজনেই অনাত্মীয় অ-প্রতিবেশী। এত প্রতিক্রিয়ার কি আছে? দৃশ্যমান
সুতপা বুঝে উঠতে পারছে না রাগের অকারণ কারণ।
সন্ধ্যের আগেই ফেরার বাস ঘরমুখী, গুম
মারা মুখেই বাকী সময় সুতপার একার। প্রতিদিনের অভ্যেস বাড়িতে ঢুকেই বাইরের লাইট অন্
করা। সুতপা আঁধারেই ঘরে ঢুকলো। চেয়ারে চোখ বুজে প্রায় স্থির আশিষের চোখের কোল
ভিজে। অনেকদিন পর আশিষের শরীরে যেন বারংবার হাতুড়ির ঘা পড়েছে। সুতপা দেখল আশিষের
ক্রমাগত সিগারেট টানা ঠোঁটে পুরু চামড়ার কৃষ্ণ ফাটল। ফাটলধরা সমঝোতার অভ্যস্থ
চাদরে সুতপা নিজেকে হঠাৎ বদমেজাজি করে তুলেছে যেন। -বাইরের লাইট একদিন দেরি হলেও
আমাকেই জ্বালাতে হবে। ‘স্যরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম’। আশিষ উঠে বসার চেষ্টা করল। একটু ঝটকা দিয়ে সুতপা কাজটি
সারলো। অন্ধকার ঘর রোজকারের মত হাত বুলায়নি সুতপার চোখের পাতায়।
প্রায় ঘনান্ধকারে সুতপার চোখে চলকে উঠছে পিকনিক হুল্লোড়, আর
তখনি শরীরের ভেতর একটা অদ্ভুত রাগ ছড়িয়ে পড়ছে আপাদমস্তক। আবার নিমেষেই প্রশ্নবিদ্ধ
ভেতর থেকে । দুজন প্রাপ্তবয়স্ক আবেগের ডাকে সাড়া দিয়েছে, তাঁর
উষ্মা আসছে কেন? কেনই
বা অনধিকারের সোজা হিসাব গুলিয়ে দিচ্ছে ঘরোয়া স্বচ্ছতা। তবে কি মনের নিভৃত গুহায়
কোথাও সুব্রত'র
উপর না-বুঝ টান তৈরী হয়েছে এতদিনে ? অথচ সুব্রতর স্বাভাবিক সারল্য কখনই নিপাট
বন্ধুত্বের পাঞ্জাবী ছাড়া আর কোন আবেগের ছাড়পত্র আনে নি।
পাশের ঘরে আশিষের সশব্দ নাকের আওয়াজ
অভ্যস্ত রাতেও বিরক্তি আনছে। সুতপা উঠে পড়ল, নিস্তব্ধ ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে
খোলা আকাশে ঘুম পাঠাল সুতপা। ইদানিং আশিষ একটু বেশি চুপচাপ। সুতপার অহেতুক
অসহিষ্ণু কথায় নিরুত্তর থেকে সে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে। স্কুলে সুব্রত যথারীতি
উচ্ছল। সুতপার সাথে কথাবার্তাও স্বাভাবিক। সুতপা ঘুরেফিরে সুব্রতর খোঁজ নেয়, খোঁজ
রাখে প্রতি মুহূর্তের অবস্থানে। এর মধ্যে এক বন্ধের দিনে সুতপার বাড়িতে জমাটি
আড্ডায় সামিল হয়েছিল স্কুলের অনেকেই। অনেকদিন পর আশিষ চনমনে । সুব্রত
আশিষের কাছ থেকে উঠছিলই না। কিছুদিন হল স্কুলে সুতপা সুব্রতকে অনিয়মিত দেখছে। যখনই
সুব্রতর সামনে পড়ে দেখছে সেলফোনে কথা বলার সময় তাঁর চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার জোরালো
ছাপ। ‘কোনো সমস্যা সুব্রত’ ? সুতপার জিজ্ঞাসা মুখোমুখি সুব্রতর।
- ইয়ে মানে, ওর
বাড়িতে চাপ আসছে বিয়ের।
-ওর মানে?
-নন্দিনী । সুতপা
আচমকা শক্ত হয়ে গেলো। 'ও
আচ্ছা' বলে
সুতপার দ্রুত পায়ে চলে যাওয়াটা সুব্রতর কপালে ভাঁজ স্পস্ট করলো।
সুব্রত সম্প্রতি একটি নতুন ফ্ল্যাটে
এসেছে, একা।
সুতপা জানে ঠিকানা। ভরা শ্রাবণ এখন শুধুই খুঁজে পাওয়া যায় কাব্যাকাশে। তবুও
অনিয়মের হাতেই অনেক সময় ফিরে পাওয়া যায় ফিকে হয়ে যাওয়া চেনা উজ্জলতা । এমনই
এক বর্ষার সারাদিন, কখনও
অঝোরে আবার সাময়িক বিরতি নিয়ে টিপ টিপ জলের বর্শা আর্দ্র আবছায়ায় দিনকে ঢেকে
রেখেছে। সুতপা স্কুলে বেশ অস্বস্তিতে। টানা তিন দিন সুব্রত গরহাজির স্কুলে। ফোন
করলে রিং বেজে যায়, কেউই
পায় নি। ফেরার সময় সুতপা দেখল গোধূলীকে ঘুম পাড়িয়ে অকাল সন্ধ্যে হাজির
মেঘ-সবান্ধবে। সুতপা ঠিক করে নিল । উত্তর
কলকাতায় বিধান সরনিতে ছোট্ট ফ্ল্যাট সুব্রতর। বাস স্ট্যান্ডে অনেকক্ষণ কোনো বাস
নেই। অতএব ট্যাক্সি পিছল রাস্তায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠে তিনতলার বাঁদিকের প্রথম ফ্ল্যাট।
‘আরে বৌদি! আসুন ভেতরে। দশ বাই দশ বেডরুম সুন্দর সাজানো, দেয়ালে
দুটি যামিনী রায়ের তৈলচিত্র। টেবিলে চোখ নামাতে সুতপার চিবুক শক্ত। ল্যামিনেটেড
নন্দিনী হাসছে।
- শরীর
খারাপ’? সুতপা
সোফাতে।
-কিছুটা, আসলে
নন্দিনীদের বাড়িতে ভীষণ ঝামেলা ,ওনাদের পাত্র আগে থেকে নির্বাচিত। সুতপার ভেতর আবার অজানা
অস্বস্তি গুলিয়ে উঠছে। নন্দিনীর নাম কানে আসা মাত্র হাজার সাঁড়াশি যেন সামনে তেড়ে
আসছে। আর তখনই সুব্রতর মোবাইল বেজে উঠলো। ‘হ্যাঁ বলো’। সাথে সাথে সুতপার জিজ্ঞাসা – ‘নন্দিনী’? সুব্রত
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই তড়াক করে সুতপা উঠে দাঁড়ায়, হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মোবাইলটা
ছুঁড়ে দেয় বিছানার উপর। হতভম্ব সুব্রত কিছু বলতে চেষ্টা করবার আগেই সুতপা পাগলের
মত সুব্রতকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট কামড়ে ধরল, নিঃশ্বাস দ্রুত। সুব্রতর শক্ত
শরীর ক্রমশ নরম থেকে নরমতর। দুজনে পরস্পরকে মিশিয়ে দিচ্ছে। মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত, বাইরে
কলিং বেল বেজে উঠল, সুব্রত
এক ঝটকায় সুতপাকে ঠেলে দিয়ে প্রায় দৌড়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দিল। দরজার বাইরে একজন
ক্র্যাচ নিয়ে দাঁড়িয়ে,
একমুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, চোখে অদ্ভুত প্রশান্তি, সাথে
ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি গার্ড। সুতপা এখন স্থানু। কেটেগিয়ে ঠোঁটে রক্তের ছোপ।
ক্র্যাচে ভর করে এগিয়ে আশিষ সুতপার ঠোঁট থেকে রক্ত মুছে দিল হাতের চেটোয়
ঠিক বছর দুয়েক পরে । মেঝেতে
মাদুরে দিব্যি হামাগুঁড়ি দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে তুলতুলে পুতুলটি। বাইরে কলিং বেল
বাজতে সুতপা ধীরে উঠে দরজা খুললো। -এসো ভেতরে। সাবধানে হাত ধরে ভেতরে ঢুকলো ওঁরা। ক্র্যাচটা
একপাশে রেখে আরাম করে সোফায় বসল আশিষ। অবিবাহিতা মেয়েটি পাশে। নন্দিনী। সুব্রত'র
রেজিষ্ট্রী ম্যারেজে এই দু'জন
সুজনকেই সাক্ষী করা হয়েছিল ।
৪২তম সংখ্যা ৩রা জানুয়ারি ২০১৩ । ৪টি গল্প লিখেছেন - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, শর্মিষ্ঠা ঘোষ, কৌশিক ভাদুড়ী ও ত্রিভুবন মুখার্জী
একটি মেয়েলী দুপুর
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল বিজয়া। একরাশ জামাকাপড় কাচা হয়েছে আজ। ক’দিন বৃষ্টি-বাদলা গেল,আজ ঝকঝকে রোদ। চারদিক ঠিকরে পড়ছে আলোয়। ব্রৃষ্টির পর এই রোদটা খুব ভাল লাগে বিজয়ার। দোতলার গ্রীলঘেরা বারান্দা দিয়ে বাগানের দিকে একবার তাকাল সে। বৃষ্টিধোয়া গাছের পাতায় রোদ লেগে চকচক করছে পাতাগুলো। চারিদিকে কেমন একটা খুশি খুশি ভাব। সে কি পুজো আসছে বলে? সত্যি কথা বলতে কি, পুজোর কথা ভেবেই আজ এত কাচাকাচি করেছে সে। এতবড় বাড়িটার দরজা-জানালার পর্দা থেকে শুরু করে, বিছানা-বালিশের ওয়াড়,চাদর,টেবিলের ঢাকা... কি নেই! একহাতে সামলানো কি চাট্টিখানি কথা নাকি! একএকবার ভাবে কি দরকার , কে দেখতে আসছে তাদের বাড়ি । কিন্তু এমন অভ্যেস হয়ে গেছে,পুজো আসার আগে সেই ধোয়া, মোছা। কাজের লোকেরাও জানে, এবাড়িতে পুজোর আগে ছাড়ান নেই। বিজয়াও জানে। মাঝে মাঝে একটু জোর বকাঝকাও হয়ে যায়। কিন্তু তারাও পুরনো লোক, সয়ে গেছে তাদের। তা বিজয়া কি শুধু বকাঝকাই করে, পুজোর বখশিস ,ঠাকুরদেখার ছুটি এসব দেয় না! এসব তো আছেই, উপরি পাওনা ঘরদোর পরিষ্কারের জন্য আলাদা বখশিস। বেশ ভালমতই দেয় থোয় ওদের। একহাতে কয়েকটা কুচোকাচা জামাকাপড় বুকের কাছে জড়ো করে অন্য হাতে আরো দু-একটা জামা উলটে পালটে দিয়ে রাস্তার ধার ঘেঁসে গ্রীলের কাছে এসে দাঁড়াল সে ।
বারান্দার এদিকটা থেকে এ পাড়ার অনেকটা দেখা যায়। এটা হল এখানের পুরনো বনেদী পাড়া। বেশির ভাগই পুরনো দোতলা-তিনতলা বাড়ী। নতুন চকচকে বাড়ী দু-একটা আছে, সেগুলো ওই পুরনোগুলোকেই ভেঙ্গে নতুন করা। বাগানঘেরা বাড়ী এ পাড়ায় এই একটাই আছে। প্রথমেই বেশ খানিকটা বাগান, আর তারপরেই দোতলা বাড়ী। খুব বিশাল কিছু বড় নয়, কিন্তু তাতে কিছু অসুবিধে হয়না। বড় বাড়ী নিয়ে কি হবে তাদের, মানুষ তো দুটি মাত্র, সে আর অবিনাশ, এতেই বেশ চলে যায়। ভাগ্যিস নয়, সারাদিন এই বাড়ীতেই তো দুজন দুদিকে ছিটকে থাকে, আরও বড় হলে তো দেখাসাক্ষাৎই হত না। দুপুরবেলার নিস্তব্ধ রাস্তা,লোকজন আজ কম। সেটা কি রবিবার বলে ! অন্যদিন হলে সকাল থেকেই গাড়ী, সাইকেল, রিক্সা, স্কুটারের ছড়াছড়ি। বিয়ের পর বিজয়া যখন এসেছিল, তখন এত লোক চলাচল ছিল না রাস্তায়। এখন কি বেড়েছে যাতায়াত, ভাবছিল বিজয়া। পুরনো দিনের কোন একটা ঘটনা মনে পড়ায় একটু হাসি হাসি মুখ হল, আবার রাস্তা দেখায় মন দিল সে। দূরে মিত্র বাড়ীর ছাদে ওদের ছোট বউকে দেখত পেল, সেও এসেছে ছাদে জামাকাপড় তুলতে । সব বাড়ীর মেয়েদের একই কাজ, একই রুটিন। একটু কেন অন্যরকম হয় না! যারা চাকরি করে তাদেরও দেখেছে এই একই কাজ করতে। তার নিজের বাড়ীতেও বোন, বউদিকে দেখেছে, কিভাবে চাকরি আর ঘরের কাজকে বজায় রেখে সংসার চালায় তারা। ভাবতে ভাবতেই দেখল উল্টোদিকের সেন মাসিমাদের বাড়ী থেকে একটা সাদা কালোয় মেশা বড় বেড়াল তাদের বাগানের দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে গেল। ও হরি, তাহলে ইনিই তিনি ! গতকাল রঙ্গনগাছের ওপরে পাখীর বাসা থেকে একটা পাখীর ছানাকে মেরে বাগানে ফেলে রেখেছিল। চুপি চুপি শোবার ঘরের সংলগ্ন বাথরুম থেকে এক মগ জল নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে বেড়ালটাকে লক্ষ্য করে। ওর ছুটে পালানো দেখে খিলখিল করে হেসে বাচ্চা মেয়ের মত হেসে উঠল বিজয়া। ‘ঠিক হয়েছে, আর করবে... ’- মনে মনে বলল সে। মগটা হাতে নিয়েই আবারবারান্দায় এল। একা একা কাটতে চায় না দুপুরটা। টিভি, সিনেমা এসব দেখতে ইচ্ছে করে না সবসময়। সিনেমা দেখার ইচ্ছেটা মাঝে মাঝে হয়। তখন একটানা বেশ কয়েকটা সিনেমা দেখে ফেলে বিজয়া। সারাদিন কাজটুকু ছাড়া গান শুনতেই ভাল লাগে ওর । কত যে গান, কত সুর, কত রকমের কথা...মনের মধ্যে বিস্ময় খেলে যায়! সুর যেমনই হোক না কেন, সবই তো কোন না কোন মানুষের লেখা। এত লেখার মত মানুষ আছেন তাহলে! খুব ইচ্ছে করে বিজয়ার লিখতে। আজ কদিন ধরেই ভেবে চলেছে লেখার কথা। ছেলের পুরনো স্কুলের খাতা থেকে সাদা পাতা দিয়ে একটা খাতাও তৈরি করে রেখেছে সে। কি লিখবে? ছেলের কথা নাকি নিজের কথা দিয়েই প্রথম লেখা শুরু করবে? আচ্ছা, অবিনাশের কথা লিখলে কেমন হয়? শান্ত, গম্ভীর মানুষটির ভিতরের কথা লিখলে চিনতে পারবে কি তাকে? যদি জেনে ফেলে, চিনে যায়? বিব্রত বোধ করে বিজয়া। পরক্ষণেই আবার ভাবে, না থাক, তার চেয়ে কবিতা লিখবে। আগে তো লিখেছে, বিয়ের আগে ! এখানে এসে সব বন্ধ হয়ে গেছে বিজয়ার। পড়াশোনা, লেখালেখির কি মূল্য আছে সংসারে, কোন কাজে লাগে শুনি? এমনটাই শুনে এসেছে এখানে এসে, তাই আর লেখা হয় না...তাহলে কি কবিতা দিয়েই শুরু করবে? কিছু একটা লিখতেই হবে। আজ অবিনাশ নেই, বাইরে গেছে মক্কেলদের সঙ্গে, ফিরতে দেরী হবে, আজই তো সুযোগ...আজকেই শুরু করবে সে। মন স্থির করে ভিতরে এলো বিজয়া।
লেখার জন্য খাতা , পেন নিয়ে ঠিক কোথায় বসবে ঠিক করতে পারছিল না বিজয়া। নীচে নেমে এল। নীচের তলায় বড় শোবার ঘরটাকে সে নিজের ব্যবহারের মত করে নিয়েছে। আগে এই ঘরটায় আত্মীয়-স্বজন এলে তাদের থাকতে দেওয়া হত। যারা আসতেন, তারা এখন বয়সের ভারে নত, আসার সুযোগ কম। বাকীরা এখনকার ছেলেমেয়ে। গাড়ী করে আসে, সারাদিন হই-হল্লা করে বিকেলে ফিরে যায়। আগের মত কয়েকদিন ধরে নানারকমের খাওয়া-দাওয়া, হই-চই, বড়বড় খাট জুড়ে বিছানা-বালিশ পাতা এসব উঠে গেছে। নীচের ঘরখানিতেই বিজয়া সারাদিন থাকে। রাত্রে ওপরের ঘরে সে আর অবিনাশ। ছেলে এখন বাইরে, সেই তো মাঝে মধ্যে আসা। টুবলুর কথা মনে করে বিষণ্ণ হল বিজয়া। ঘরে ঢুকে তাকাল চারিদিকে। নীচের ঘরের একপাশে মাঝারি আকারের পুরনো দিনের একটা খাট পাতা। একটা ছোট, আর একটা বড় কাঠের আলমারি। একদিকে একটা টেবিলের ওপর রাখা আছে কম্পুটার, নতুন সংযোজন । আর আছে একটা অনেকদিনের রেডিওগ্রাম। গান শুনতে সে ভালবাসে, অবিনাশের অনেক আপত্তিতেও সে এটা সরাতে দেয়নি , সরাতে চায়ওনি। একটু একটু নিজে নিজেই কম্পিউটার শিখেছে সে। ছেলেই শিখিয়েছে তাকে। এক এক সময় সেও এখানে লিখবে ভাবে, কিন্তু পারবে কি? ভাবতেই বেশ রোমাঞ্চ বোধ করল সে। তাহলে তার লেখাও বেরোবে, পত্রিকাতে? দরজার পাশে পুরোনো দিনের একটা ডেস্কের ওপরে কাগজপত্র রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল বিজয়া। এবার লিখবে সে। কলমের ঢাকা খুলে অনেক্ষণ বসে রইল বিজয়া। ভেবেছিল তার ছেলেবেলা দিয়ে শুরু করবে। কিন্তু লিখতে বসে দেখল ছেলেবেলা তো দুরের কথা, দু-বছর আগের কথাও সে মনে করতে পারছে না। শুধু চোখে ভাসছে অবিনাশের রাগত, থমথমে মুখ,ডান হাতের তর্জনী, যা সে উঁচিয়ে রেখেছে তার দিকে। আর কানে আসছে ভাঙ্গা গলার স্বর--‘তোমাকে ইচ্ছে করলেই বার করে দিতে পারি, আমি ওসব কাজের লোকজন মানি না, ওদের সামনেই রাস্তায় বার করে দিতে পারি তোমাকে। কি হবে লেখাপড়া করে, কোন রান্নায় তা কাজে লাগবে শুনি? স্বামীর ভাল-মন্দে কোন কাজে দেবে...বেরিয়ে যাও, চলে যাও তোমার বাপের বাড়ী, লেখাপড়া ওখানে চলে, এখানে শ্বশুরবাড়ীতে নয়...কি হবে তোমার গল্প লিখে, কবিতা লিখে, দুটো পাতা পড়তে শিখে কি উপকার করেছ, শুনি?...’
দু-হাতে রগ চেপে ধরল বিজয়া। তারপর হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। একথা মনে আসছে কেন? সে তো একথা লিখতে চায়নি। সে কি কথাগুলো ভুলতে পারেনি? আপাতঃ শান্ত, গম্ভীর স্বভাবের অবিনাশ বাতিকগ্রস্ত তার স্ত্রীকে নিয়ে। মেয়েছেলের বাড় বাড়া ভালো নয়, একথাই মানে সে। তাই বাইরে যাওয়া, অন্য কোন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে স্ত্রীকে মিশতে দেওয়ায় তার আপত্তি।
একরকম বন্দীর জীবন বিজয়ার। বাড়ীতে লোক এলে অবিনাশের নজর বিজয়ার শাড়ী-জামার দিকে। কোথাও কিছু বে-আব্রু হয়ে রইল নাতো! রাস্তায় অবিনাশের সঙ্গে বেরোনর সময়েও গরমের দিনে তার নজর স্ত্রীর জামাকাপড়ের দিকে। গরমে ঘামে ব্লাউজের ভিতর দিয়ে অন্তর্বাসের চিহ্ন ফুটে বেরচ্ছে নাতো! তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বিজয়াকে ইশারা, গা ঢেকে নেওয়ার জন্য। পুরুষ মানুষ বাড়িতে এলে তার সামনে বেশিক্ষণ বসা চলবে না। তাহলেই চীৎকার। অপমানে, ক্ষোভে, এতটুকু হয়ে যায় বিজয়া। সম্মানীয় যারা আসেন, একথা বলতে পারে না। সামনাসামনি যেতে পারে না তখন। যদি অপমানে কেঁদে ফেলে তাদের সামনে! কতসময় ভেবেছে বিজয়া, কেন এত খারাপ ব্যবহার করে অবিনাশ। বোঝাতে গিয়ে উত্তর পেয়েছে, স্ত্রীকে শাসনে না রাখলে সে নষ্ট হয়, তার ভাল না লাগলে সে বেরিয়ে যেতে পারে। বাপের বাড়ী চলে যাক সে।
কোথায় যাবে বিজয়া, টুবলুকে ছেড়ে? সে তো অবিনাশকে ভালবাসে না, তাতো নয়, তাহলে ? ভেবে কূলকিনারা পায় না বিজয়া। কিন্তু এসব কথা তো সে লিখতে চায় না। কি করে লিখবে স্বামীর কথা, তার ব্যবহারের কথা, বিজয়ার অপমানের কথা, তাই কি পারে সে? একবার উলটে দেখল খাতাটা। ভিতরের একটা পাতায় টুবলুর ছোটবেলার আঁকিবুকি কাটা। প্রায় পুরো পাতাটাই সাদা ছিল বলে পাতাটা সে ফেলে দেয়নি। ডানহাতের আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটা জায়গাটাতে পরম মমতায় হাত বোলাল বিজয়া আর তারপরই ভেঙ্গে পড়ল বাঁধভাঙ্গা কান্নায়। ফোঁপাতে ফোঁপাতে উচ্চারণ করল...-তুই লিখিস টুবলু। তুই পারবি তোর মা'র কথা লিখতে ... ।
ফেরা
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
-‘উফফ, মরে যাবো , জাস্ট মরে যাবো,কেন এত দারুণ লাগছিস তুই ?’ হই হই করে উঠলো সায়নদীপ ,’ কি ক্রিস্পি , ক্রাঞ্চি , ইয়াম্মি ইয়াম্মি লাগছিস , মনে হচ্ছে কুড়মুড়িয়ে খেয়ে ফেলি , খেয়েই ফেলি !’ বলেই ঝটিতি একটা চুমু খেয়ে ফেলল বনির গালে ।
-‘মদনা,এত অল্পে হবে না, এ দিল মাঙ্গে মোর’। ঘুষি পাকাল বনি , ছদ্মরাগে ।
- ‘ আই নো হানি , অ্যাম ওলয়েস অ্যাট ইয়র সার্ভিস’। বলেই আরেক গালে চকাস করে আরেকটা চুমু খেয়ে ফেলে সায়ন ।
-‘অ্যাই , তোরা দিল্লাগি করবি ত বাড়ি যা , আমরা পর্ণ দেখতে রাজি না পাবলিক প্লেসে ‘, আওয়াজ দিলো স্বাতী ।
- ‘ আই সেকেন্ড’, এবার জয় ।
-‘ ইস , সব নেকু, পুসু, মুনু এলোরে আমার , গাল টিপলে দুদু বেরোবে ,’ চোখ মটকালো সায়ন ।
-‘ তবে রে , এই দ্যাখ , পর্ণ কাকে বলে ‘, বলেই বনি এক ঝটকায় সায়নের একমাথা ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা মাথাটা টেনে নামিয়ে ওর ঠোঁটের ওপর লেগে থাকা ক্যাডবেরির গুঁড়োতে নিজের জিভ বুলিয়ে দিলো । হাততালি দিয়ে উঠলো পাঁচজনের একটা দল , শিস দিলো কেউ , কেউ আওয়াজ দিলো ,’ গুরু , গুরু, চলবে’।
স্বাতী বলল , ‘ মরে যাই ঢং দেখে । এই কালকেই না তুই বললি , সায়নের সাথে তোর কাটটি হয়ে গেছে ফর এভার ?’
-‘ হ্যাঁ , হয়েছেই তো , এটা তো করলাম আমায় কমপ্লিমেন্ট দেবার জন্য ! আমি ওকে থোরি কেয়ার করি’! বলল বনি। ‘
- ‘ বাট আই কেয়ার আ লট । মরে যাব, তোকে ছাড়া মরে যাবো , ‘ বনির সামনে টিপিকাল স্টাইলে হাঁটু গেড়ে বসে সায়ন, বাড়িয়ে দ্যায় একটা ফাইভস্টার ।
খপ করে সেটা নিয়ে ন্যায় বনি ,বলে, ‘এবারের মতো প্ল্যান টা মুলতুবি রইল, যা , আর নাটক করিস না ‘।
-‘শুধু নাটকে পেট ভরবে না, একটা ট্রিট দে, দুজনে মিলে,’দাবী জানালো জনতা ।
- ‘ডান ,’ ‘কোথায় খাবি বল ? তবে আজ বনি খাওয়াবে , আমার পকেট গড়ের মাঠ । বাবাই টা বড় কিপটেমি করে আজকাল । মাসে একবারের বেশি পকেট মানি দ্যায় না ।‘
বনি পার্স খুলে একবার চোখ বুলিয়ে ন্যায় , তারপর বলে , ‘আজ শুধু রোল আর কোল্ড ড্রিংকস , চলবে ?’
- ‘দৌড়বে’, সমস্বরে জবাব এলো ।
-‘ ম্যাডাম , আপনার রোল ‘, চমকে ওঠে বনিতা । সামনে হাসিমুখে দাঁড়ান রোল সেন্টারের ছেলেটা ।
- ‘হ্যাঁ রে , দে । আর এটা তুই রাখ ,’ বলে একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দ্যায় ছেলেটার দিকে । ছেলেটা অপ্রত্যাশিত টিপস পেয়ে লাজুক হাসে । বনিতা, ওরফে বনির চোখ টা অকারণে জ্বালা করে ওঠে । ছেলেটা র বয়েস বছর বিশেক । সেদিনকার বনি কিমবা সায়নের বয়েসি । ছেলেটার কি প্রেমিকা আছে কোন ? ছেলেটা কখনো চুমু খেয়েছে ওকে ? হেসে ফেলে বনি , নিজের মনেই ,‘ ধুর , কি সব ভাবছি আমি ?’ পাশের লোকটি অবাক হয়ে দেখছে বনিকে ।ভাবছে নিশ্চয় ছিটেল মহিলা ।
এই রোলটাই ওর ডিনার আজকের । বাড়িতে একা থাকলে ও রান্না করে না । সায়ন ট্যুরে গেছে । যেমন যায় মাসের মধ্যে কুড়ি দিন । প্রতিরাতে ফোন করে না , দু তিন দিন পর পর জানায় , ভালো আছে , ও যেন চিন্তা না করে , কিছু অসুবিধে হলে যেন বিশু কে বলে ।
বিশু ওদের ড্রাইভার । আছে প্রায় বছর দশেক । কাছের লোক হয়ে গেছে । বনির কোন দরকার হয় না । কিম্বা হতে দ্যায় না । সায়ন কি করে জানবে , বনির প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা বিশুর নেই !
বনির একলা লাগে । দম ঘুটে আসে সন্ধ্যের পর । একলা বাড়িটা ভ্যাম্পায়ারের মতো ওকে গিলতে আসে ।বাচ্চা কাচ্চা ও হোল না । কার সমস্যা দেখা হয় নি এখনো ।
বলা ভালো , সায়ন ডিসকারেজ করেছে । বলেছে , ‘ উই আর হ্যাপি কাপল , নট উই ? কেন খুঁজবো নিজেদের খুঁত ? আর কিছুদিন অপেক্ষা করে অ্যাডপট করবো । সেটা সমাজ সেবাও হবে ।‘
বনি আজকাল রাত আটটা বাজলেই দুটো আল্প্রাজোলাম খেয়ে ন্যায় । তার পরও ঘুম আসতে চায় না কোন কোন দিন ।তখন ভুতের মত বসে থাকে টিভির সামনে । লাইট অ্যান্ড সাউন্ড এফেক্ট টা ভালো কাজ দ্যায় । মনে হয় আশেপাশে লোকজন কথাবার্তা বলছে । ও তাতে অংশগ্রহণ করতে না পারুক , একা লাগে কম কম।
আগে আগে মন খারাপ লাগলেই সায়নকে ফোন করতো । কাজের মাঝে বিরক্ত হোতো সায়ন অহেতুক ফোন করায় । বলত , ‘ কাম অন হানি , আমি কাজ করতে এসেছি এখানে । সাথে আমার পিএ কে নিয়ে ফুর্তি করতে আসি নি ‘। ‘ বিশ্বাস না হয় অফিসে খোঁজ নাও‘।
গলার কাছে কান্না আটকে গেছে বনির । সায়ন কি ভাবে , ও সন্দেহবাতিক ? তাই ফোন করে ? সায়ন , ওর সায়ন , সেই পাগল ছেলেটা , বন্যার মধ্যেও দেখা না হলে থাকতে পারতো না ,হাফ প্যান্ট পরে হাজির হোতো জল ঠেঙিয়ে , দুদিন রাগ করে কথা বন্ধ রাখার জো ছিলনা ওর পাগলামির চোটে । সেই সায়ন ওরফে সায়নদীপ রয়, বিদেশী কোম্পানির এক্সিকিউটিভ হয়ে এতো বদলে গেল যে বনির একদম অচেনা লাগে ? নাকি বনিই টু মাচ ডিমান্ডিং ? বনি ভেবে পায় না । বনিও তো চাকরি করছে , ওর ও ত একটা অফিস আছে , ওকেও ত বসকে তোল্লাই দিয়ে চলতে হয় । তার পরও ও কেন এবং কেমন করে ভাবে কিম্বা ভাবার ফুরসৎ পায় যে আগের মতই থাকবে সবকিছু ? আগের মতই প্রতিরাতে সায়ন ফোন করবে, বলবে , খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বিছানা টা , আদর করবে ফোনেই , কেটে যাবে প্রায় গোটা রাত । যেমন করতো বিয়ের আগে । যেমন করতো বিয়ের পরেও কিছুদিন ।
সায়ন হাসে এসব বললে , বলে , ‘আমাদের এখনকার সম্পর্কে অনেক বেশি নির্ভরতা আছে, অনেক বেশি বেশি বিশ্বাস আছে । তাই আসে না ওসব ছেলেমানুষি’ ।
ছেলেমানুষি ? হবেও বা । বনি কি পিটার প্যান ? ছেলে মানুষ ? দশবছর ধরে বিয়ে নামে একটা প্রতিষ্ঠানের ভার বইতে বইতে বড় ক্লান্ত লাগে বনির । ভাবে ,এবার একটা প্রেম করতে হবে। একটা স্বাদ বদল দরকার । একটা দমকা হাওয়া , যা উড়িয়ে নেবে বনিকে , সায়ন কে । দুজন দুদিকে ছিটকে পড়বে , পাগলের মতো খুঁজবে দুজন দুজন কে । উপভোগ করবে ফিরে পাবার আনন্দ ।
সায়ন কে এসব বলার ভরসা হয় নি । হয়ত বনিকে পাগল ই ভেবে বসবে । ভাববে ডিপ্রেশনে লুজ হয়ে গেছে স্ক্রু । নিজেকেই করতে হবে কিছু একটা । কিছু চ্যালেঞ্জিং , কিছু আনসার্টেন । যা নিয়ে ওর টাইম পাস হবে । ভুলভাল চিন্তা গুলো বন্ধ হবে । সায়নের কাছে নিজের প্রয়োজন ফুরিয়েছে মনে হবে না সব সময় ।
একদিন খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে একটা জিমে গিয়ে ভর্তি হোল । ওরই মত ডিপ্রেশনে মুটিয়ে যাওয়া কিছু মাঝবয়সী মহিলার সাথে সন্ধ্যের সেশনে । প্রথম দিন ই চক্ষু চড়কগাছ । বিশাল বিশাল চর্বির বড়া এক একটা । এন্তার তেল খেয়েছে এতদিন । কোলেস্টেরল আর ইউরিক অ্যাসিডে ভুগে ভুগে , আমবাত , গেঁটে বাত সঙ্গী করে সব এসেছে । চড়া মেকওভারে বয়েস ঢাকার ব্যাপক প্রচেষ্টা । ভাব জমে গেল বেশ কজনের সাথে । কেউ বুটিক চালায় , কেউ গুঁড়ো মশলার ব্যবসা করে । জিম থেকে বেরিয়ে কেউ ফুচকার দোকানে লাইন মারে , কেউ তেলে ভাজার । অফিস ফেরত এদের দলে ভিড়ে ভালই লাগে বনির । জিম ত ছুতো । বনি চর্বি কমিয়ে সুন্দরী না বান্দরি হোল তা দেখার লোক কোথায় ? নিজেকে প্যাম্পার করা ভালো , কিন্তু গোটাটাই যদি নিরর্থক হয় ?
জিমের বান্ধবী সঙ্গীতাদির বাড়ি গেছিল একদিন । বিয়ে করেন নি ভদ্রমহিলা । বাবা, আর একটা বেকার ভাই আছে । ভাইয়ের আবার ছবি আঁকার স্কুল আছে একটা বাড়িতেই । আলাপ করিয়ে দিলেন সঙ্গীতা দি । বেশ গম্ভীর টাইপের লোক । আলাপ বেশিদূর এগোল না । সঙ্গীতা দি ই বরং ঘুরে ঘুরে ভাইয়ের পেইন্টিং দেখালেন । হাত বেশ ভালো ভদ্রলোকের । সঙ্গীতা দি ভাইকে বললেন , ‘ বনির একটা পেন্সিল স্কেচ করে দে না রে । আর কি ই বা দিতে পারি ওকে ? ‘ ‘ঠিক আছে , আপনি দু মিনিট বসুন , দিদির চা করতে করতে , হয়ে যাবে’। বলে অদ্ভুত হাতের দক্ষতায় মুহূর্তে এঁকে দিলেন ওর মুখ । বার কয়েক গভীর চোখে তাকালেন ওর দিকে । ওর গাটা কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো । সায়ন ছাড়া আর কেউ ওকে এত খুঁটিয়ে দেখছে ভেবে কেমন অস্বস্তি হোল । ‘মুখটা একটু বাঁদিকে ঘোরান ত , এদিকটাই ভালো আসবে আপনার ‘, বলে নিজের হাতে ওর মুখটাকে ঘুরিয়ে দিলেন । ওর কেন যেন শুভ দৃষ্টির ক্ষণটার কথা মনে পড়লো । দশ বছর প্রেম করে বিয়ের সময় শুভদৃষ্টির রোমাঞ্চ বলে কিছু ছিল না ওদের ।
দারুণ এঁকেছেন ভদ্রলোক । নাকি বনি সত্যি ই এখনো এত আকর্ষণীয় আছে ? বুড়িয়ে যাওয়া বনিতার ভেতর এ যেন আর একটা বনি ,ভুলে ছিল যাকে এতদিন । যাকে ভেবেছিলো মৃত । আজ এতদিন পর আবার কারও চোখে দেখল নিজেকে । আজ এতদিন পর একজন শিল্পী দেখলেন ওর গালের টোল ,গজদন্ত , কপালের ওপরের ঝুরো চুল , চুমু খাবার সময় চোখ বুজলেই যে চুলগুলো সায়ন ফুঁ দিয়ে ওড়াত , বলত ,’ আমার তিতলি ‘।
কতদিন এভাবে দেখেনি সায়ন ? কতদিন সন্তর্পণে কাঁচের পুতুল হ্যান্ডেল করার মত কেয়ারিং ওয়েতে আদর করেনি ? বনির বুক চিঁরে একটা দীর্ঘশ্বাস হঠাৎ ই বেরিয়ে এলো ।
আচ্ছা , লোকটার প্রেমিকা আছে ?লোকটা কখনো নিশ্চয় এঁকেছে তার ছবি । লোকটা কেমন করে আঁকে তাকে ?যেমন করে পিকাসো ছবি আঁকতেন প্রেমিকার শরীরে ? প্রেমিকার সারা শরীর জুড়ে উল্কির মত আঁচড় টেনেছে এই লোকটা কখনো তুলির টানে ?খুব সুখি বুঝি ওরা ? হেসে ফেলে বনি । এ কি উদ্ভট ভাবার রোগ হোল ওর ?
বাড়ি ফিরেই আজ স্নানে গেল বনি । গিজার খুলে অনেকক্ষণ হট ওয়াটার বাথ নিল । আয়নার সামনে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল অনেকদিন পর । ওই ত সব চেনা চেনা কার্ভ , সায়নের প্রিয় বন্দর সমূহ । সায়নের দ্বীপ , সমুদ্র , লাইট হাউস । সায়ন , সায়ন , সায়ন , লাভ ইউ টু মাচ । কান্ট থিঙ্ক অফ লিভিং ইউ ।
আজ ঘুমের ওষুধ খাবে না । আজ নিজেই ফোন করবে সায়ন কে । চুলোয় যাক ওর কাজ । বাড়ি ফিরেই সায়ন কে বলতে হবে ওর এই স্কেচটার কথা । আলোচনা করতে হবে , কোথায় টাঙ্গানো যায় ছবিটা । কেমন ফ্রেমে বাঁধানো যায় এটাও আলোচনা করতে হবে । সায়নের ও একটা স্কেচ করে দিতে বলবে ভদ্রলোককে । ওর পাশে টাঙানোর জন্য । ওর হুঁকোমুখো হ্যাংলা টা বড্ড বেরসিক হয়ে যাচ্ছে । বদলাবে , নিজেকেই বদলাবে বনি । বলবে , ‘অফিস গুলি মারো । এই আমিও চললাম ট্যুরে , আমার বরের বডিগার্ড হয়ে ‘। বলবে , ‘ আমাদের হানিমুন টা পেন্ডিঙ আছে না ? মরে যাবার আগে সেরে ফেলতে চাই মিস্টার সায়নদীপ রয় । আমি বনিতা বলছি । ইওর হোম সেক্রেটারি। দিস ইস মাই অর্ডার’।
ভিখিরি
কৌশিক ভাদুড়ী
মাণিক বাবু এই পেনটার রিফিল কোথায় পাই বলুন তো? কম্পানি পূর্বাভাস হিসেবে বাঁশের আকারের একটা পেন দিয়েছ। মাণিক বাবু অল্প চিন্তা করে, ড্রয়ার খুলে বোধ হয় রিফিল বার করতে যাচ্ছিলেন।
-আরে না না রিফিলটা ফুরোয়নি এখনও. মানে বাইরে কোনো দোকান-টোকানে পাওয়া যায়?
-এই রিফিলটাই রাখুন না, আমি কম্পানির পেন ব্যবহার করি না।
- মাণিক বাবু আপনার জেশ্চার আমি প্রশংসা করি। তবে আমি চাইছি সল্যুশন, জেনারসিটি নয়।
- সল্যুশন কাকে বলে আর জেনারসিটিই বা কি দেখলেন?
- সল্যুশন হোলো মানুষ মানুষের স্তর থেকে খোঁজে যেটা। আর জেনারসিটি মানুষ অতি বিপন্ন হলে খোঁজে, যেমন প্রকৃত ভিখারীরা, তখন মানুষের স্বাভিমান আর কাজ করে না। একটা গল্প বলি শুনুনঃ-
তখন আমি জঙ্গলের মধ্যে থাকি। ইতস্তত ছড়ান ছিটন ছোট ছোট বাংলো ধরনের কোয়ার্টার্স, সঙ্গে খানিকটা করে খালি জমি। যারা ঘিরে নিয়ে বাগান করতে পারে করে, না পারলে মেলা হয়ে পড়ে থাকে। আমারটা তেমনই ছিল। ওখানে ঝড়ের পরে বাসাহারা বকেরা চড়ত। পোয়াতি খটাশ গর্ত খুঁজে বাচ্চা পাড়ত। গোধিরা পায়চারি করত। ঢ্যামনা সাপ আতাগাছে শালিকের বাচ্চা খেতে আসত। তখনও টাউনশিপ বেশ জনবিরল, আগোছালো জঙ্গল বড় বড় পাথুরে ঢিবিতে ভরা। আশেপাশের গাঁয়ের লোকেদের গরু রাখার গোয়াল আজকের মতই সেদিনও ছিল না। একদিন সকালে উঠে দেখি জমিটাতে একটা সদ্যজাত কিন্তু মরা বাছুর পড়ে আছে। হয়তো বাছুরটা মরাই জন্মেছিল। গরুটা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বুঝতে পেরেছে। ফেলে চলে গেছে। খেয়াল হল সেই রাতে একটা গরুকে একটু বেশীক্ষনই ডাকতে শুনেছিলাম। এমনিতেই কম্পানির ঠিকে ঝাড়ুদারেরা মরা জীবজন্তু ওঠায় না, তার ওপর গরু! অগত্যা লোক খুঁজতে বেরুলাম। একটু দূরেই শনিমন্দির। গেটের সামনে রাস্তার ওপর ক’জন দেখি রোজ বসে থাকে। মন্দিরের দর্শনার্থীরা আসতে যেতে পয়সা-কড়ি কলাটা নাড়ুটা দেন। ওটাই জীবিকা। এরা ভিখিরি।
জিজ্ঞেস করলাম- খেটে খাস না কেন?
বলল-আমরা জাতে হাঁড়ি-পাণ। গাঁ থেকে আমাদের বার করে দিয়েছে।
এ অঞ্চলে গ্রামে যারা ছোট জাত, যতদিন সক্ষম থাকে, অন্যদের জমিতে মজুর খাটে। ওদের বলে ‘মুলিয়া’। ততদিন গ্রামের কেউ কেউ দয়া পরবশ ওদের ঝুপড়ি বানিয়ে থাকতে দেন। তারপর বুঢ় হওয়ার সাথে সাথেই বুড়ো গরুর মতন ওদের সংরক্ষন অনিশ্চিত হয়ে যায়। যক্ষা কুষ্ঠ জাতীয় রোগ হলে, অথবা গাঁয়ে চুরিটুরি হলে সেই মহেন্দ্রক্ষণ এসে যায়, ওরা বিতারিত হয়।
বললাম- একটা কাজ আছে, করবি?
দেখলাম সকালের সূর্য্যটা একবার নেমে এসে ওদের মুখ চুমে গেল। রোদ্দুরটা লেগে রইল।
বলল- বাবু আমাদের তো কাজ কেউ দিতে চায় না। ছোঁয়াচ লাগবে বলে।
দুজনকে নিয়ে এলাম। ওরা মৃত শাবকটাকে হাতে করে নিয়ে অল্প দূরে ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর নীচে ঘন ঝোপের ভেতর ফেলে এসে বলল
- বাবু হাত ধোয়ার সাবান একটু দেবে না?
আমি কোয়ার্টার্সের ব্যাকইয়ার্ডে চৌবাচ্ছাটার কাছে নিয়ে গিয়ে ওদের গা বাঁচিয়ে সংলগ্ন ট্যাপটা খুলে দিলাম, মাটিতে খানিকটা ডিটারজেন্ট গুঁড়ো রেখে দিলাম। বলে দিলাম
- একদম ট্যাপ ছুঁবি না, জল নষ্ট হয় হোক।
আসলে এখানে পুকুর টুকুর খুব বিরল, নইলে...।
এদিকে আমার ঘরনী কি করেছে ওদের দেখেই এক হাঁড়ি ভাত করে থুয়েছে! আর ক’দিন ধরে খাওয়ার যুগ্যি রান্না মুগের ডাল তো ফ্রিজে মজুদই থাকে, ফুটিয়ে নিলেই হলো! ধোয়াধুয়ি সেরে তারা নিজেরাই কার বাগান থেকে চুরি করে কলাপাতা নিয়ে এলো। ভাত ডাল গোটা কতক পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা। ব্যাস আর কিচ্ছু না। একটা ছোট বাতিল বালতি ছিল, সেইটাতে পানের জন্য চৌবাচ্ছার জল। ওরা খেতে আরম্ভ করেছে। এদিকে আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। খাওয়া শেষ হতে হতে আমি দোকান থেকে ফিরে পড়ব দেখে আমি বেরিয়ে পড়লাম। ফিরে এসে দেখি ওরা খাওয়া শেষ করে, উঠোন সাফ-সুতরো করে চলে গেছে। মিসেসকে পয়সার কথা বলতে বলল -
- কই ওরা তো চাইলো না, ভাবলাম হয়তো আগেই দিয়ে রেখেছ।
অগত্যা খুঁজতে বেরুলাম। নেই, শনিমন্দিরের সামনে নেই, কোথ্থাও নেই। হেঁটে হেঁটে ফিরছি। প্রতিবেশী কোয়ার্টার্সে রেডিও বাজছে। তখনও এখানে টিভি আসেনি। আকাশবাণী কটক কেন্দ্রে লিন পিরিয়ডে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর ...
- কাঙ্গাল আমারে কাঙ্গাল করেছে...।
মিলি
ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জ্জী
মিলি এবং জলি দুই বোন । বাবা মা’র আদরের মেয়ে । মিলি মাধ্যমিক পাস করেছে জলি ক্লাস টেন এ পড়ে। মিলি পডাশুনোর চেয়ে টিভি দেখা, আড্ডা দেওয়া , বন্ধুদের সঙ্গে বেডান, এই সবই বেশি করে। বাবা একটা কেরানির চাকরি করতেন । হঠাৎ মারা যান । প্রথম স্ট্রোকেই মারা যান । ঘরে আর কেউ রোজগারক্ষম ছিলেন না । মিলি,জলি কে নিয়ে শহরে মামার কাছে এসে ওঠেন ওদের মা ।
মামার
ইলেক্ট্রিকের সরঞ্জামের দোকান । ভালই চলে । এরা আসাতে মামি বিরক্ত হলেও মামা ওদের ঠাইঁ দেন। ছোট
বোনের এই দুর্দিনে ঠাঁই না দিলে ভগবানের কাছে অপরাধী থেকে যাবে যে! বাবার
পেনসনের কাগজ, প্রভিডেন্ট ফান্ড, এল আই সি র পলিসি এসবের জন্য মামার
প্রয়োজন । তাই মা এবং মামা অফিস্ কাচারি ঘুরে ঘুরে অনেক কষ্টে এক উকিলের
পরামর্শে কিছু কাজ এগুতে থাকে। এরমধ্যে মামা জানতে পারেন এক উকিল বাবুর
নাকি অনেক জানা শোনা আছে । আজকাল অফিসে একটু জানা শোনা না থাকলে কিছুই কাজ হয়না । তার ওপর
ফাইল এগুতে ছোট গান্ধীর প্রয়োজন । উকিল বাবু অনেক সাহায্য করলেন । মামা টাকা পয়সা
দিয়ে সামলালেন । আস্তে আস্তে মা সব পাওনা পেলেন । মায়ের পেনসন এর কাগজ ঠিক
করতে সময় লাগলো । বাবার ডেথ্ সার্টিফিকেট ইত্যাদি সব উকিল বাবু করে দেন
। এই সুবাদে মা এত মুগ্ধ হয়ে যান যে ওনাকে ছেলে বানিয়ে ফেলেন । উকিল
বাবুর নাম জয়ন্ত মিশ্র ।
মিলি, পডা
ছেডে কাজ খুঁজতে লাগলো । ও কম্পুটার এর কি একটা কোর্স করেছিল দেখতে শুনতে ভাল ই ছিল । তাই একটা কাজও
জোগাড় হয়ে গেল। ভারত গ্যাসের দোকানে এল পি জি বুকিং এর কাজ পেল । সকাল নটা
থেকে বিকেল পাঁচটা । জয়ন্ত বাবু ওই কাজটা করিয়ে দেন । মামা অবিশ্যি
ওদের দোকানে সব ইলেকট্রিকাল ফিটিং সাপ্লাই করেছিলেন । সেই সুত্রেও মামার চেনা শোনা
ছিল । মাস গেলে চার হাজার মাইনে । বাবার গ্রেচুইটি, কম্যুটমেন্ট্ এবং জিপিএফ্ এর সব টাকা
ফিক্সড্ ডিপোসিট্ করে দেন মামা, মার নামে । তা ছাডা মা পেনসন পান । পরে এল আই
সি দু লক্ষ টাকা পান , সেটা বড মেয়ের বিয়ের জন্য রেখে দেন তার । সমস্ত
পাওনা গন্ডা টাকা পেয়ে মামাকে সব টাকা পাই পাই শোধ করে দিলেন মা
। আর গজ গজ করতেন না মামি। খাওয়া থাকার সব খরচ মা, মাস গেলে তুলে দিতেন মামার হাতে ।
যাই হোক, ভালই
চলছিল । কথায় বলে, বলে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। ঠিক তাই আরম্ভ হল । মিলি র
সঙ্গে জয়ন্ত র প্রেম শুরু হল। মা কিছুই টের পেলেন না । কাজ সেরে শপিং মল, সিনেমা,আড্ডা,ঘোরা সব
চলল। রাত করে বাডী ফেরা । দামি প্রসাধন ব্যাবহার , দামি
ড্রেস সব জয়ন্ত কিনে দিত । মা পুজো আর্চা নিয়ে থাকতেন । এরকম ই
কিছুদিন চলছিল হঠাৎ মিলি একদিন সিঁদুর পরে ঘরে হাজির জয়ন্ত কে নিয়ে ।
মাকে ধড়াস্ করে দুজনের সাষ্টাঙ্গ প্রণাম ।
কিছু বলার আগেই , মিলি বললো .. বিয়েটা মন্দিরে সেরে ফেললাম ।
মা , মামি সবাই হতবাক্ মেয়ের কান্ড দেখে ।
কিছু বলার আগেই , মিলি বললো .. বিয়েটা মন্দিরে সেরে ফেললাম ।
মা , মামি সবাই হতবাক্ মেয়ের কান্ড দেখে ।
মামি
বলেন,আমি বলেছিলাম এই রকম ই একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে । তখন গা করনি । এখন নাও ঠ্যালা
সামলাও ! মুখে কালি মেখে রাস্তায় ধী ধী করে নাচগে । আমাদের আর মুখটা পুডিও না । উনি এলেই পত্রপাঠ
বিদেয় করব । আমার হয়েছে যত্ত জ্বালা । তা তুমি কেমন ভদ্র লোক হে ? আমাদের
মেয়েটাকে ভুলিয়ে বিয়ে করেছ ! তোমার বাবা মা জানেন এ কথা ? জয়ন্ত বলে , আমার বাবা জেলা জজ্ আমি নিজে ওকালতি করি ।
আপনাদের মেয়ের বয়েস ২০ ও এখন সাবালিকা । আপনাদের মত থাকবেনা জেনেই ও আর আমি আর্য্যসমাজ
মন্দিরে বিয়ে সেরে ফেলেছি । আপনাদের আশীর্বাদ নিতে এসেছি ।
মা নিথর
হয়ে বসেছিলেন । ওদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে । দুচোখ দিয়ে
অশ্রুধারা মানতে চাইছিলনা । চোখ মুছে শুধু বললেন, মিলি তুই ছোট বোনটার কথা একবারও ভাবলিনা মা ? বাবার
বাৎসরিক কাজ শেষ না হতেই বিয়ে করে ফেললি ! মামা,মামি,মাকে জানানোর কোন প্রয়োজন বোধ করলিনা মা ! আমি কি
তোর বিয়ে দিতাম না ? জয়ন্ত বলল, অপরাধ নেবেন না মা !
মা কথা থামিয়ে বললেন আমি হাত জোড করে তোমাকে বলছি তুমি আমাদের কথায় থেকনা। তোমার পেটে এই ছিল বাবা ? মিলি তখন ঘোরে আছে । প্রেমে হাবুডুবু। তার এসব শোনার অবকাশ ছিলনা। সে বলে , ঠিক্ আছে , তোমাদের যখন অপছন্দ আমি আর কি বলব? আমি তাহলে আজ এই ঘর ছেডে চলে যাচ্ছি ! তাই যাও মহারানি কে তোমাকে আটকাচ্ছে ? মামি চেঁচিয়ে বলেন।
মা কথা থামিয়ে বললেন আমি হাত জোড করে তোমাকে বলছি তুমি আমাদের কথায় থেকনা। তোমার পেটে এই ছিল বাবা ? মিলি তখন ঘোরে আছে । প্রেমে হাবুডুবু। তার এসব শোনার অবকাশ ছিলনা। সে বলে , ঠিক্ আছে , তোমাদের যখন অপছন্দ আমি আর কি বলব? আমি তাহলে আজ এই ঘর ছেডে চলে যাচ্ছি ! তাই যাও মহারানি কে তোমাকে আটকাচ্ছে ? মামি চেঁচিয়ে বলেন।
এই সময়
মামা ঘরে ঢোকেন । কি হল এতো চেঁচামিচি কিসের ? ঘরে কি ডাকাৎ ঢুকেছে ? জয়ন্ত কে দেখে মামা ঘাবডে যান । একি আপনি
? তারপর ব্যাপার টা আঁচ করেন মিলি র কপাল দেখে । ও ! তাহলে সব
সেরেই এসেছো তোমরা । আর কি বাকি রাখলি মা ? একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে। সব ই আমার
বোনটার কপাল ? অসময়ে স্বামী হারাল দুটো মেয়ের মুখ চেয়ে ছিল
তাও তোরা দুঃখ দিলি ।
আমি কি করলাম ? জলি ফোড়ন কাটে ।
এক ধমক দেয় মামি । চুপ্ ! আমি কি করলাম !! যা ওঘরে যা ।
মা চোখ মুছতে মুছতে বলেন, দাদা আমার বালা দুটো আর হার টা দিয়ে দাও। ওদের যেতে বল । আমি আর পারছিনা ! আমার অদৃষ্ট ! আঁচলে মুখ ঢেকে ঘর থেকে চলে যান।
মামা মায়ের কথামত ঘর থেকে মামির আলমারি খুলে বোনের গয়না গুলো মিলিকে দিয়ে পরতে বলেন । নিজে ৫ হাজার টাকা হাতে দিয়ে বলেন শাডি কিনে পরেনিবি। আমাদের একটু সময় দিলিনা মা ? মিলি কিছু না বলে মামাকে নমস্কার করে জয়ন্তর সঙ্গে চলেযায় ।
আমি কি করলাম ? জলি ফোড়ন কাটে ।
এক ধমক দেয় মামি । চুপ্ ! আমি কি করলাম !! যা ওঘরে যা ।
মা চোখ মুছতে মুছতে বলেন, দাদা আমার বালা দুটো আর হার টা দিয়ে দাও। ওদের যেতে বল । আমি আর পারছিনা ! আমার অদৃষ্ট ! আঁচলে মুখ ঢেকে ঘর থেকে চলে যান।
মামা মায়ের কথামত ঘর থেকে মামির আলমারি খুলে বোনের গয়না গুলো মিলিকে দিয়ে পরতে বলেন । নিজে ৫ হাজার টাকা হাতে দিয়ে বলেন শাডি কিনে পরেনিবি। আমাদের একটু সময় দিলিনা মা ? মিলি কিছু না বলে মামাকে নমস্কার করে জয়ন্তর সঙ্গে চলেযায় ।
ওরা ঘরে
না ফিরে একটা বাসা নিয়ে থাকে । মিলিকে বাসা তে রাখার কারণ জয়ন্তর মা
বাবা জানেন না ছেলের গুণ কীর্তির কথা। বাডিতে সবাই যানে জয়ন্ত বেডাতে
গিয়েছে । আবশ্য জয়ন্ত মিলি কে নিয়ে তারপর দিন কারে কলকাতা তারপর
মুম্বাই হয়ে ফ্লাইটে ‘গোয়া’ হনিমুনে যায় কলকাতা র নেতাজী সুভাষ বিমান বন্দর থেকে । নাম
পরিবর্তন করে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখিয়ে জয়ন্ত মিলি কে নিয়ে
ফ্লাইট্ এ যায় । মিলির নাম পরিবর্তন করে ‘মিতালি’ নামে । গোয়াতে খুব ফুর্তি করে । কোলবা,কালাঙ্গুট্,ডোনাপাওলা,এরকম প্রায় সব সী বিচ্ দেখে উত্তর গোয়া
দক্ষীণ
গোয়া ঘুরে হোটেল এ দু রাত তিন দিন থেকে ফিরে আসে ।
এরমধ্যে জজ্ সাহেবের কানে মিলি র মামার ইলেকট্রিক্ দোকানের মিস্ত্রি মুনা সব বলে দেয় । মুনা, জজ্ সাহেবের নতুন বাডীর ইলেক্ট্রিকের কাজ করেছিল তাই ওদের বাডীতে যাতায়াত আছে । জজ্ সাহেব তাঁর অপদার্থ ছেলেকে জানেন তাই তরিড়িড়ি ছেলের বিয়ের আয়োজন করে ফেল্লেন । ওনারই সহ পাঠির মেয়ের সঙ্গে । মেয়েটি এম এ সাইকোলজি নিয়ে এই বছর পাস করেছে । দেখতে মন্দ না । সব ঠিক্ ঠাক্ । জয়ন্ত এলেই পাকা দ্যাখা। আশীর্বাদ সেরে বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলবেন ।
এরমধ্যে জজ্ সাহেবের কানে মিলি র মামার ইলেকট্রিক্ দোকানের মিস্ত্রি মুনা সব বলে দেয় । মুনা, জজ্ সাহেবের নতুন বাডীর ইলেক্ট্রিকের কাজ করেছিল তাই ওদের বাডীতে যাতায়াত আছে । জজ্ সাহেব তাঁর অপদার্থ ছেলেকে জানেন তাই তরিড়িড়ি ছেলের বিয়ের আয়োজন করে ফেল্লেন । ওনারই সহ পাঠির মেয়ের সঙ্গে । মেয়েটি এম এ সাইকোলজি নিয়ে এই বছর পাস করেছে । দেখতে মন্দ না । সব ঠিক্ ঠাক্ । জয়ন্ত এলেই পাকা দ্যাখা। আশীর্বাদ সেরে বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলবেন ।
জয়ন্ত
আসার পর কেউ কিছু না জানার ভান করে । সহজ ভাবেই জয়ন্তর মা জয়শ্রী দেবি বলেন হ্যাঁরে
কোথায় কোথায় বেডালি ? জয়ন্ত সব বর্ণনা করল । তারপর মাকে মিলির বিষয় বলল
। মা শুনে আকাশ থেকে পডলেন । তোর বাবা শুনলে আমাকে রক্ষা রাখবেন না । তুই
কি তোর বাবাকে চিনিসনা? কি করে সাহস করলি রে ? একেবারে গোয়া ঘুরিয়ে আনলি? প্লেন
এর টিকিট ?
আমি জানি বাবা রাগারাগি করবেন তাই ফলস্ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখিয়ে কলকাতা থেকে যাই । আসলে এখান থেকে গেলে এয়ারপোর্ট এ ধরা পডার ভয় থাকতো । কলকাতা অবধি বন্ধুর গাড়িতে যাই ওখান থেকে মুম্বাই হয়ে গোয়া ।
আর মেয়েটা ? ওর কথা ভেবনা । ওকে ভাডা ঘরে রেখে দিয়েছি।
মা বলেন আর ওর কাছে যেতে হবেনা ।আমার দিব্বি রইল । বাবা তোর বিয়ের ঠিক করেছেন । ভাল মেয়ে । অনেক পণ দেবে । ভাল ছেলের মতন চুপটি করে যা বলব তাই করবি ।
হ্যাঁ মা তোমার কখনো অবাধ্য হয়েছি ? বল ?
না হও নি ! এটা কি করে এলি খেয়াল রাখিস ?
ভুল হয়ে গেছে । ক্ষমা করে দাও ।
মা ছেলের মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলেন , আর কত জ্বালাবি বুডো বাপ্ টাকে ? রিটায়ারমেন্ট ত মাত্র এক মাস । তার পর কি হবে খেয়াল রাখিস ?
সব ঠিক হয়ে যাবে কিচ্ছু চিন্তা করনা।
তাই যেন হয়।
মিলির কাছে আর যেতনা জয়ন্ত । মিলি কে ফোনে বলতো একটু এদিকটা সামলে নিয়ে পরে তোমার কাছে যাব ।
মিলি র সন্দেহ হয় । জয়ন্ত অন্য নামে তাকে ফ্ল্যাট কেন নিল ? নিজের নাম কেন পালটাল ? এখন হঠাৎ মাতৄভক্ত ছেলের ভুমিকা ! কি ব্যাপার ! ১০-১৫ দিন পর মিলি জয়ন্ত র বাডীর ঠিকানায় যায় কারণ ওদের বাডীর গ্যাসের সিলিন্ডার , মিলিদের ডিস্ট্রিব্যুটার ই পাঠায় তাই জয়ন্ত র ঠিকানা পেতে অসুবিধে ছিলনা । মিলিকে ওর মা দেখেই বুঝতে পারেন । মিলি প্রণাম করে । ওকে ডেকে একটা ঘরে বসতে বলেন। মিলি ওখানেই জয়ন্ত দের বাডিতে কিছুক্ষণ থাকে । জয়ন্তর মা কিন্তু কোন কথা না বলে চাকরকে দিয়ে চা জলখাবার সব পরিবেশন করান । চাকর বলে মা বসতে বলেছেন । মা এখন পুজো করবেন । মিলি কিছু খায় না। ও বাসাতে ফিরে যায়। মনে মনে ভাবে কাল কোর্ট বন্ধ , কালকে যা করার করবে । মিলি যাওয়ার পর মা, বাড়ির কাজের লোক রবিকে বলেন ফোন করে জয়ন্তকে ডাকতে ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জয়ন্ত বাডি ফিরে আসে । তার ঘন্টাখানেকের ব্যাবধানে জজ্ সাহেব চলে আসেন।
এর মধ্যে বলে রাখি মুনা এসে জয়ন্তর মাকে বলে, আমাকে কিছু টাকা দিলে আমি মিলি কে চিরদিনের জন্য সরিয়ে ফেলব । কিন্তু জয়ন্তর মা ওতে রাজি হলেন না। পরে মুনা বলে মা এখানে সুপারি কিলার এমন ভাবে কাজ করে কেউ টুঁ শব্দপাবেনা খালাশ হয়ে যাবে । এ সব কথা তিন তলার একটা অসম্পূর্ণ ঘরে হচ্ছিল ।
মা দু লক্ষ লাগবে । প্রথমে ওরা ১ নেবে কাজ শেষ হলে বাকি টাকা। মা গররাজি হলেন ।
এর মধ্যে জয়ন্ত বলল তোমাদের কিছু ভাবতে হবেনা আমি ব্যাবস্থা করছি। এই বলে জয়ন্ত একটা ব্যাগে কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে পডে । এক বন্ধু র বাডি যায় । মা পই পই করে মানা করেন এ বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামাতে। বন্ধু বান্ধব্দের এ বিষয় জানান উচিৎ কি ? কে কার কথা শোনে ? জয়ন্ত সোজা ওই বন্ধুকে নিয়ে একটা বলেরো গাডি নিয় সোজা মুনাকে কি সব বলেদেয় । মুনার হাতে টাকার বান্ডিল গুঁজে দেয় । তারপর ওখান থেকে বন্ধুকে নিয়ে চলে যায়। মুনা যখন যায় তখন রাত ১১টা হবে ।
মুনা, মিলির ঘরে নক্ করে । মিলি ভেতর থেকে বলে, কে ?
আমি আর জয়ন্ত বাবু এসেছি ।
‘আমি’ কে?
আমি গো বৌদি, মুনা । গলার স্বর শুনে চিনতে পারছোনা ?
তোমাকে মা ডাকছেন । আমরা দুজনে এসেছি তাই ।
মিলি বিশ্বাস করে দরজা খুলতেই দুজন অজানা লোক মিলি কে মুখে হাত চাপা দিয়ে কাবু করে ফ্যালে । মুখে গোঁ গোঁ শব্দ হলেও বিশেষ কেউ জানতে পারেনা। সটান ওকে তুলে ফেলে গাডিতে বসিয়ে দেয় । মুখে ল্যুকো প্লাস্ট দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয় । চোখ রুমাল দিয়ে বাঁধা হয় । কোন শব্দ বেরুনর উপায় নেই । কোথায় যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে কিছুই বোঝারউপায় নেই । গাডী চলে নন্দন কানন এর রাস্তা দিয়ে বারং হয়ে আঠগড এর রাস্তা। তারপর খুন্টুণি । ওখানে কিছু সুবিধে হলনা কারন মোবাইল পেট্রলিং চলছিল । গাডী ঘুরিয়ে আবার ফিরে আসে মহানদীর ওপর । ব্রিজের ওপর থেকে মিলি র পেছনে হাত বেঁধে দেয় এবং পা দুটো বেঁধে ওপর থেকেই ফেলে দেয় । একটা শব্দ হয় ঝপাং । ব্যাস্ ওটা শুনেই ওরা চম্পট্ দেয় গাডী নিয়ে ।
ভোর তখন প্রায় ৫ টা । জোব্রা ব্যারেজের ওপর প্রায় সকলেই মর্নিং ওয়াকে বেরন । হঠাৎ দুজন লোক , একটা গোঁ গোঁ শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায় ! নিচে লক্ষ করেন একটা নারীর দেহ পেছন করা অবস্থায় পড়ে আছে । সঙ্গে সঙ্গে পুলিস কে ফোন করা হয় । মোবাইল পেট্রলিং ভ্যান চলে আসে । বডি কে অনেক কষ্টে ওঠান হয় । ভগবানের দয়া তখন নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চলছে । মানে বেঁচে আছে । যন্ত্রণাতে মহিলাটি কাৎরাচ্ছে আর বয়ান লিখতে বলছে ইশারায় । মিলি বয়ান দেয় জয়ন্ত বাবা গুন্ডা লাগিয়েছিল লাগিয়ে মেরে ফেলার জন্য, ওরাই এখানে ফেলে দিয়ে গেছে । ওকে সঙ্গে সঙ্গে কটক মেডিকাল এ ভর্তি করা হয় । ততক্ষণে সব মিডিয়া, নারী জাগরণ স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা , চলে আসে । মিলি র প্রায় মৄত্যুকালিন বয়ান রেকর্ড করা হয়। ওই পরিপ্রেক্ষিতে জয়ন্ত কে গ্রেফতার করা হয় । মিলি এও বলে তার শ্বাশুডি এবং শ্বশুর তাকে সুপারি কিলার দিয়ে খুন করার জন্য মন্টুকে বলে । মন্টু ফেরার হলেও পরে ধরা পডে পুলিসের হাতে । জজ্ সাহেব, তাঁর স্ত্রী এবং জয়ন্ত সকলকে পুলিস এক ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার করে । জজ্ সাহেবের বেল পিটিশন অগ্রাহ্য হয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন এবং পুলিশ কমিশনার কে বলেন চার্জ সীট্ ফ্রেম করতে যাতে দোষি উচিৎ শাস্তি পায়। কেউ জামিন পায় না। পরে সুপারি কিলার দুটো ধরা পডে । ওরা বিহার থেকে এসেছিল এই জন্যে । মামলা এখনও চলছে । ।
আমি জানি বাবা রাগারাগি করবেন তাই ফলস্ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখিয়ে কলকাতা থেকে যাই । আসলে এখান থেকে গেলে এয়ারপোর্ট এ ধরা পডার ভয় থাকতো । কলকাতা অবধি বন্ধুর গাড়িতে যাই ওখান থেকে মুম্বাই হয়ে গোয়া ।
আর মেয়েটা ? ওর কথা ভেবনা । ওকে ভাডা ঘরে রেখে দিয়েছি।
মা বলেন আর ওর কাছে যেতে হবেনা ।আমার দিব্বি রইল । বাবা তোর বিয়ের ঠিক করেছেন । ভাল মেয়ে । অনেক পণ দেবে । ভাল ছেলের মতন চুপটি করে যা বলব তাই করবি ।
হ্যাঁ মা তোমার কখনো অবাধ্য হয়েছি ? বল ?
না হও নি ! এটা কি করে এলি খেয়াল রাখিস ?
ভুল হয়ে গেছে । ক্ষমা করে দাও ।
মা ছেলের মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলেন , আর কত জ্বালাবি বুডো বাপ্ টাকে ? রিটায়ারমেন্ট ত মাত্র এক মাস । তার পর কি হবে খেয়াল রাখিস ?
সব ঠিক হয়ে যাবে কিচ্ছু চিন্তা করনা।
তাই যেন হয়।
মিলির কাছে আর যেতনা জয়ন্ত । মিলি কে ফোনে বলতো একটু এদিকটা সামলে নিয়ে পরে তোমার কাছে যাব ।
মিলি র সন্দেহ হয় । জয়ন্ত অন্য নামে তাকে ফ্ল্যাট কেন নিল ? নিজের নাম কেন পালটাল ? এখন হঠাৎ মাতৄভক্ত ছেলের ভুমিকা ! কি ব্যাপার ! ১০-১৫ দিন পর মিলি জয়ন্ত র বাডীর ঠিকানায় যায় কারণ ওদের বাডীর গ্যাসের সিলিন্ডার , মিলিদের ডিস্ট্রিব্যুটার ই পাঠায় তাই জয়ন্ত র ঠিকানা পেতে অসুবিধে ছিলনা । মিলিকে ওর মা দেখেই বুঝতে পারেন । মিলি প্রণাম করে । ওকে ডেকে একটা ঘরে বসতে বলেন। মিলি ওখানেই জয়ন্ত দের বাডিতে কিছুক্ষণ থাকে । জয়ন্তর মা কিন্তু কোন কথা না বলে চাকরকে দিয়ে চা জলখাবার সব পরিবেশন করান । চাকর বলে মা বসতে বলেছেন । মা এখন পুজো করবেন । মিলি কিছু খায় না। ও বাসাতে ফিরে যায়। মনে মনে ভাবে কাল কোর্ট বন্ধ , কালকে যা করার করবে । মিলি যাওয়ার পর মা, বাড়ির কাজের লোক রবিকে বলেন ফোন করে জয়ন্তকে ডাকতে ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জয়ন্ত বাডি ফিরে আসে । তার ঘন্টাখানেকের ব্যাবধানে জজ্ সাহেব চলে আসেন।
এর মধ্যে বলে রাখি মুনা এসে জয়ন্তর মাকে বলে, আমাকে কিছু টাকা দিলে আমি মিলি কে চিরদিনের জন্য সরিয়ে ফেলব । কিন্তু জয়ন্তর মা ওতে রাজি হলেন না। পরে মুনা বলে মা এখানে সুপারি কিলার এমন ভাবে কাজ করে কেউ টুঁ শব্দপাবেনা খালাশ হয়ে যাবে । এ সব কথা তিন তলার একটা অসম্পূর্ণ ঘরে হচ্ছিল ।
মা দু লক্ষ লাগবে । প্রথমে ওরা ১ নেবে কাজ শেষ হলে বাকি টাকা। মা গররাজি হলেন ।
এর মধ্যে জয়ন্ত বলল তোমাদের কিছু ভাবতে হবেনা আমি ব্যাবস্থা করছি। এই বলে জয়ন্ত একটা ব্যাগে কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে পডে । এক বন্ধু র বাডি যায় । মা পই পই করে মানা করেন এ বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামাতে। বন্ধু বান্ধব্দের এ বিষয় জানান উচিৎ কি ? কে কার কথা শোনে ? জয়ন্ত সোজা ওই বন্ধুকে নিয়ে একটা বলেরো গাডি নিয় সোজা মুনাকে কি সব বলেদেয় । মুনার হাতে টাকার বান্ডিল গুঁজে দেয় । তারপর ওখান থেকে বন্ধুকে নিয়ে চলে যায়। মুনা যখন যায় তখন রাত ১১টা হবে ।
মুনা, মিলির ঘরে নক্ করে । মিলি ভেতর থেকে বলে, কে ?
আমি আর জয়ন্ত বাবু এসেছি ।
‘আমি’ কে?
আমি গো বৌদি, মুনা । গলার স্বর শুনে চিনতে পারছোনা ?
তোমাকে মা ডাকছেন । আমরা দুজনে এসেছি তাই ।
মিলি বিশ্বাস করে দরজা খুলতেই দুজন অজানা লোক মিলি কে মুখে হাত চাপা দিয়ে কাবু করে ফ্যালে । মুখে গোঁ গোঁ শব্দ হলেও বিশেষ কেউ জানতে পারেনা। সটান ওকে তুলে ফেলে গাডিতে বসিয়ে দেয় । মুখে ল্যুকো প্লাস্ট দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয় । চোখ রুমাল দিয়ে বাঁধা হয় । কোন শব্দ বেরুনর উপায় নেই । কোথায় যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে কিছুই বোঝারউপায় নেই । গাডী চলে নন্দন কানন এর রাস্তা দিয়ে বারং হয়ে আঠগড এর রাস্তা। তারপর খুন্টুণি । ওখানে কিছু সুবিধে হলনা কারন মোবাইল পেট্রলিং চলছিল । গাডী ঘুরিয়ে আবার ফিরে আসে মহানদীর ওপর । ব্রিজের ওপর থেকে মিলি র পেছনে হাত বেঁধে দেয় এবং পা দুটো বেঁধে ওপর থেকেই ফেলে দেয় । একটা শব্দ হয় ঝপাং । ব্যাস্ ওটা শুনেই ওরা চম্পট্ দেয় গাডী নিয়ে ।
ভোর তখন প্রায় ৫ টা । জোব্রা ব্যারেজের ওপর প্রায় সকলেই মর্নিং ওয়াকে বেরন । হঠাৎ দুজন লোক , একটা গোঁ গোঁ শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায় ! নিচে লক্ষ করেন একটা নারীর দেহ পেছন করা অবস্থায় পড়ে আছে । সঙ্গে সঙ্গে পুলিস কে ফোন করা হয় । মোবাইল পেট্রলিং ভ্যান চলে আসে । বডি কে অনেক কষ্টে ওঠান হয় । ভগবানের দয়া তখন নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চলছে । মানে বেঁচে আছে । যন্ত্রণাতে মহিলাটি কাৎরাচ্ছে আর বয়ান লিখতে বলছে ইশারায় । মিলি বয়ান দেয় জয়ন্ত বাবা গুন্ডা লাগিয়েছিল লাগিয়ে মেরে ফেলার জন্য, ওরাই এখানে ফেলে দিয়ে গেছে । ওকে সঙ্গে সঙ্গে কটক মেডিকাল এ ভর্তি করা হয় । ততক্ষণে সব মিডিয়া, নারী জাগরণ স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা , চলে আসে । মিলি র প্রায় মৄত্যুকালিন বয়ান রেকর্ড করা হয়। ওই পরিপ্রেক্ষিতে জয়ন্ত কে গ্রেফতার করা হয় । মিলি এও বলে তার শ্বাশুডি এবং শ্বশুর তাকে সুপারি কিলার দিয়ে খুন করার জন্য মন্টুকে বলে । মন্টু ফেরার হলেও পরে ধরা পডে পুলিসের হাতে । জজ্ সাহেব, তাঁর স্ত্রী এবং জয়ন্ত সকলকে পুলিস এক ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার করে । জজ্ সাহেবের বেল পিটিশন অগ্রাহ্য হয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন এবং পুলিশ কমিশনার কে বলেন চার্জ সীট্ ফ্রেম করতে যাতে দোষি উচিৎ শাস্তি পায়। কেউ জামিন পায় না। পরে সুপারি কিলার দুটো ধরা পডে । ওরা বিহার থেকে এসেছিল এই জন্যে । মামলা এখনও চলছে । ।