উল্টোরথ
ইন্দ্রনীল
ভট্টাচার্য
ভাবলাম আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরবো । আজ রথ । গতকাল বাড়ি ফেরার পথে মেয়ের জন্য একটা রথ কিনে নিয়ে
গিয়েছিলাম । রথ দেখে মেয়ে খুব খুশি । বলল, “বাবি, স্কুল থেকে ফিরে রথ চালাব, তুমি তাড়াতাড়ি এসো
কিন্তু ।“
আমার বৌয়ের আবার ভিন্ন মত, সে বকতে লাগলো “আবার জায়গা জোড়া হল, একদিন টানবে
তার জন্য এত বড় রথ, কোথায় রাখবো !!” রাস্তায় আজ বাস-ট্যাক্সি
কম, কারণ অনেক রাস্তা বন্ধ । ইস্কনের রথ বেরনোর কথা । কোনও রকমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে
রাসবিহারীর মোড়ে নামলাম । আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম,রাসবিহারী থেকে
পাঁপর-ভাজা আর তেলেভাজা কিনে নিয়ে যাব । একটা
ভাল দোকান আছে । বাড়ি গিয়ে সবাই মিলে চা দিয়ে খাব । সবাই
বলতে আমি, বউ আর
মেয়ে । এখন আমরা আলাদা থাকি । বাবা-মা পুরোনো বাড়িতে থাকে । যেমন ভাবা তেমনি কাজ । সবার জন্য দুটো-দুটো করে তেলেভাজা আর পাঁপর-ভাজা কিনে সোজা
বাড়ি । মনে মনে ভাবলাম, বাড়ি গিয়ে
মেয়েকে নিয়ে একটু রথ টানবো, তারপর সবাই মিলে তেলেভাজা খাবো । যেদিনে যেটা । তাতেই তো মজা, তাতেই তো আনন্দ । বাড়ি গিয়ে দেখি, তালা ঝুলছে ! ভাবলাম বোধহয় মা-মেয়ে মিলে রথ
টানতে নিচে গেছে । আমার কাছে একটা চাবি থাকে । ঠিক করলাম জামা-কাপড় পাল্টে একবার বউকে ফোন করবো । বাড়ি ঢুকে আলোজ্বালতেই মনে একটা সন্দেহ হলো । দেখি ডাইনিং-টেবলে, প্লেট চাপা দেওয়া একটা এগ-রোল রাখা । ঘরে ঢুকতেই দেখি, কালকের কেনা রথ-টা অবহেলায় একটা কোনায় পড়ে
রয়েছে । মাটির জগ্গনাথ-বলরাম-সুভদ্রা প্যাকেট-এ মোড়াই রয়েছে । খুলে দেখার সময় হয়নি কারোর । কি ব্যাপার হল !!! সঙ্গে সঙ্গে বউকে ফোন করলাম । দ্বিতীয়বারের বারের চেষ্টায় পাওয়া গেল । আমার ফোন ধরেই ওপাশ থেকে বৌয়ের গলা ভেসে এল, “ হ্যাঁ গো
তুমি এসে গেছো ?”
“হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা কোথায় ?”
“আর বলো না, বিকেল বেলায় সুদেষ্ণা ওর ছেলে নিয়ে এসে বললো সাউথ সিটি যেতে । তাই আমরা এখন সাউথ-সিটি-তে আছি । একটু পরে চলে যাব । আমরা এখন ফুড-কোর্ট যাচ্ছি, ওখানে কিছু খেয়ে নেব । তোমার খাবার টেবিলে চাপা দেওয়া
আছে, খেয়ে নিও । “ বৌয়ের কথার শেষটুকু শোনার ইচ্ছে
বা মানসিকতা ছিল না । চুপ চাপ “আচ্ছা” বলে ফোন-টা কেটে দিলাম ।
আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে এলাম । কিচ্ছু ভাল লাগছে না । খাওয়ার ইচ্ছাও হল না । সব ঘরের লাইট নিবিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলাম । একটা সিগারেট ধরালাম । মাঝে মাঝে দূরে থেকে ঘন্টার ঠুং-ঠুং
করে রথ টানার আওয়াজ আসছে । বাচ্চারা কোথাও রথ টানছে ।
মন
ভীষণ খারাপ হয়ে আছে । এতো আনন্দ করে সব নিয়ে এলাম । সব পড়ে রয়েছে । ছোটবেলায় এই রথের দিন আমাদের কাছে একটা উত্সব ছিল । আগের দিন বাবা রথ নিয়ে আসতো । রথের দিন সকাল থেকে ওই রথ সাজানোর পালা চলতো । আমার দিদা ময়দা দিয়ে এক বাটি আঠা বানিয়ে দিতো, আর দাদু
মার্বল-পেপার দিয়ে সুন্দর করে রথ সাজিয়ে দিতো । রথের তিনটে তলা তিন রকম রঙের হতো । একটু খারাপ হলে দাদুর উপর বকাবকী করতাম । আবার ঠিক করে দিত । পুরো বাড়ি কাগজে-কাগজে ছড়িয়ে থাকতো । সব সাজানো হলে মা বিকেল বেলায় বাড়ি পরিষ্কার করতো । দিদা,জগ্গনাথ-বলরাম-সুভদ্রার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিতো । মা রথের মধ্যে একটা ছোট থালায় নকুলদানা আর মোমবাতি রেখে
দিতো । পড়ে যখন রথটা টানতে যেতাম, মা ওটা জ্বেলে
দিতো । সন্ধ্যে হলে আমাদের ছাদে রথ-টা নিয়ে যেতাম । অন্যরাও আসতো তাদের রথ নিয়ে । সবাই মিলে রথ চালাতাম । সবার রথে একটা মোমবাতি অথবা প্রদীপ জ্বোলতো । ছাদটা অন্ধকার, তার মধ্যে মনে হতো যেন জোনাকি জ্বলছে । বেশ লাগতো । বড়রা এসে আমাদের কাছ থেকে নকুলদানা চেয়ে খেত । কেউ কেউ এসে খুচরো পয়সা ঠাকুর-কে প্রণামী দিয়ে যেত । এবড়ো-খেবড়ো ছাদে কারোর রথ উল্টে পড়ে যেত, কারোর ঠাকুর
পড়ে যেত । সে খুব কান্না-কাটি করতো । আমার সাথে মা বা দিদা থাকতো । রথটা ধরে থাকার জন্য, যাতে পড়ে না যায় । সবাই মিলে দারুন মজা হতো । তারপর বাড়ি ফিরে আসতাম । এসে দেখতাম বাবা অফিস থেকে এসে গেছে, সঙ্গে এক
ঠোঙ্গা তেলেভাজা । বাবা একটু রথের দড়িতে হাত দিয়ে প্রণাম করতো । মা-দিদা
বলত রথের দড়ি টানা নাকি খুব ভাল । বাবা তারপর পকেট থেকে একটাকা-দুটাকা যা পারতো দিত । দাদু-ও আমাকে কিছু দিতো । দাদু বলতো, “এটাকে পাব্বুনী বলে, রথের-পাব্বুনী।“
আমি গুনতম কত টাকা প্রণামী পাওয়া গেল । ওগুলো মা’কে দিয়ে দিতাম । মা ওগুলোকে ঠাকুরের
ভাঁড়-এ রেখে দিতো । এরপর শুরু হতো সবাই মিলে পাঁপর-ভাজা আর তেলেভাজা খাওয়া, সঙ্গে গল্প । মা ভেজে ভেজে আনতো, আর আমরা সবাই মিলে খেতাম । রাতে-ও ভাতের পাতে পাঁপর-ভাজা
থাকতো । সে একটা আলাদা মজা । বিকেলের পর থেকে সবার মনে একটা অদ্ভুত খুশির ভাব । এই সব চিন্তা করতে করতে মনটা বড় আনমনা হয়ে গিয়েছিলো । সম্বিত
ফিরলো আমার মোবাইল ফোনের আওয়াজে । সিগারেটটা পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, খেয়ালই নেই । গিয়ে ফোন ধরলাম, বউ ফোন করছে ।
“হ্যালো, একটু দেরি হয়ে গেছে, তবে এক্ষুনি আসছি । সুদেষ্ণা
আমাকে পৌঁছে দেবে । তুমি খেয়েছ ? “
আমি “না” বলে ফোনটা কেটে দেব ভাবলাম ।
বউ ওপাশ থেকে বলে উঠল, “ আমরা গিয়ে আর খাবো না । এখানে সিজলার আর কাবাব খেয়ে পেট ভরে গেছে । আমি তোমাকে গিয়ে খেতে দিচ্ছি ।
“আচ্ছা !” বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল ।
আমার আর খাওয়ার ইচ্ছে নেই । এক গ্লাস জল খেতে গিয়ে দেখলাম ঠোঙ্গার তেলেভাজা গুলো ঠান্ডা
হয়ে গেছে । মনে হল সিজলার আর কাবাবের
কাছে হেরে যাওয়ার দুঃখে যেন আরও চুপসে গেছে । জল খেয়ে বারান্দায় গিয়ে আবার একটা সিগারেট ধরালাম । কিছুক্ষণ পরেই বাড়ির বেল-টা বেজে উঠল । মা-মেয়ে দুজনেই এসে পড়েছে । ঢুকেই মেয়ে কলকলিয়ে উঠলো, “জানো বাবি, আজ দারুণ গাড়ি চালিয়েছি ।আর
বাস্কেটবল খেলেছি”।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের মা যোগ করলো, “আজ কাবাব-টা যা বানিয়েছিল না !
দারুণ হয়েছিল । “
“আমি যে তোমাদের জন্য তেলেভাজা এনেছিলাম !”
ও কালকে লক্ষ্মীর মাকে দিয়ে দেব, গরম করে ওরা খেয়ে নেবে । মনে হল কেউ
বুকে ছেঁকা দিল !
একটাও খাবে না ?
দুর, এত রাতে ওসব কেউ খায় ? তুমি আবার খেতে যেও না যেন । আর কিছু বললাম না ।
বউ জিজ্ঞাসা করলো তুমি খাবে তো ? ইচ্ছেটা এমন যেন না বললেই ভাল হয়, কারণ আবার গরম করতে হবে ।
না, আমি খাব না । পেট-টা ভার লাগছে । অফিস-এ খেয়েছি । মিথ্যা কথা বললাম ।
ঠিক আছে, তুমি আর মেয়ে শুয়ে পর । আমি পরিষ্কার হয়ে আসছি ।
বউ চলে যেতে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিরে মা, রথ চালালি না ? তোর জন্য নিয়ে এলাম ।
কি করবো বলো, মামমাম বলল পরের বছর চালাস । কি করবি রথ টেনে, তার থেকে চল
সাউথ-সিটি যাই ।
বেশি কথা বাড়ালাম না । বললাম, যা শুয়ে পর, আমি আসছি ।
আচ্ছা বাবি । বলে মেয়ে চলে গেল ।
বারান্দাটাকে নিজের মনে হয় । তাই আবার বারান্দায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম । হায় ! কি ভাবলাম আর আর কি হল ! আজ আমাদের বাচ্চারা রথ চালানোর আনন্দ থেকে বঞ্চিত । সেই
আগেকার নির্ভেজাল আনন্দ আজ কোথায় হারিয়ে গেছে । তার জায়গা নিয়েছে যান্ত্রিক আনন্দ
। যাদের সাথে সেই সময় আনন্দ করতাম আজ তারা কত দূরে । যাদেরকে নিয়ে আজ আমি আনন্দ করবো, তারা নিজেদের
মত করে আনন্দ করে । নিজের আবেগ দিয়ে বা পছন্দ করে
বাড়ির জন্য কিছু নিয়ে এলে, সেটা স্থান পায় কাজের লোকের বাড়িতে । আজ আমার মনের কথা জানাবার বা বোঝার জায়গা নেই । বাড়ির
মানুষকে নিজের ভিতরের যন্ত্রনা চাপা দিয়ে মিথ্যে কথা বলতে হয় । যন্ত্রনা প্রকাশ
করার কোনও জায়গা নেই । বড় কষ্ট হয় । কেউ বোঝার নেই । নিজেকে ভীষণ একা মনে হল । চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল । মনে রয়ে গেল মনের কথা,শুধুচোখের জল, প্রাণের ব্যথা !
রূপ-কথা
রুপালী নিজের ওড়নার আঁচলটা ঠিক করে নিল যাতে তাকে আরও
আকর্ষণীয় লাগে। যতরকম কসমেটিকস বাজারে পাওয়া যায় তার সবগুলোর বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়
তার শরীর জুড়ে – আসলেই সে সুন্দর যে দেখতে। চাঁদের আলো যেমন ঝোপঝাড় ভেদ করে ঠিকরে পড়ে তেমনি
তার রূপও আমাদের মত খেঁদি পেঁচিদের মাঝে দ্যুতি বের করে হুঙ্কার ছাড়ে – আমাকে দেখুন। দিনের
মধ্যে চার ঘণ্টা তো রূপচর্চাতেই চলে যায় – ওই প্রাতঃকৃত্যাদির মতই
নিয়মিত। ছেলেরা তার জন্য পাগল – এটা তার কাছে খুব
উপভোগ্য। আসলে সবাই তো আর রুপালী, রপশ্রী, তনুশ্রী নয়! কাল সে
তিনখানা প্রস্তাব পেয়েছে প্রেমের এবং দম্ভের সাথে না করে দিয়ে বেশ নিজেকে ইয়ে ইয়ে
লাগছে , তবে এই ইয়ে লাগাটা আজকের নয় তাই এখন আর তেমনটা দাগ কাটে না মনে। নেতিবাচক
উত্তরে যে এত ইতিবাচক আনন্দ হয় তা রুপালীকে চোখে না দেখলে ঠিক বোঝা যায় না। তো যাই
হোক, রুপালী কলেজের দিকে চলল ময়ূরীর বেশে। ময়ূরপুচ্ছের অভাব মেটায় কলেজের ছেলেরা
যাদের জিভ মুখগহ্বরের চেয়ে বাইরে থাকতে বেশি পছন্দ করে। রুপালী একটা ক্লাস শেষ করে
যথারীতি আয়না চিরুনি নিয়ে বসে গেলো সিঁড়ির উপর – কয়েকটা চুল মুখের উপর
বার বার পড়ে যাচ্ছে – কি বিষম যন্ত্রণা দেখো
তো! হঠাৎ একটা ছেলে সিঁড়ির উপর উঠে এসে তার কাছে এসে বলল
- একটু সরে বস আর নাহলে
পার্লারে যাও!
রুপালী তো বেজায় ক্ষেপে গিয়ে মনে মনে বলল – কি! এত স্পর্ধা! আমাকে? তাও আমাকে? কলেজের সব ছেলেরা
যেখানে আমাকে দেখে মূর্ছা যায় আর কোথাকার কোন ব্যাঙ এসে... ! কিন্তু মুখে বলতে
পারল না ছেলেটার চওড়া কাঁধ, পেটানো লোহার মত শরীর
আর গাম্ভীর্য দেখে, শুধু বলল
- ঠিক আছে।
এটাই রুপালীর প্রথম পরাজয়য়। সে ভাবতে লাগলো – এত জলদি সে কি করে হার
মানল! এটা কি ঠিক হল? নানান জল্পনা কল্পনা
করতে করতেই লক্ষ্য করল ছেলেটা হাতে বই নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। সে খানিক্ষন তাকিয়ে
থেকে মনে মনে প্রথমবার বলল – সুপুরুষ। ব্যাস, আর যায় কোথায়? কিউপিড ছোকরা এসে টক
করে তীর মেরে চলে গেলো রুপালীর মনে। এরপর যা হয় আর কি – খাওয়া, ঘুম, পড়া সব গোল্লায় গেলো
কিন্তু এতদিনের অভ্যেস ছেড়ে মাথা নত করতেও তো গায়ে লাগে! কয়েকদিন এভাবেই চলে গেলো।
রুপালী বুঝে উঠতে পারছে না কি বলবে। রোজ দেখা হয় সেই সিঁড়িতেই – কথা হয় না। একদিন সাহস
করে রুপালী বলেই ফেলল তার মনের কথা তাও আবার খানিকটা গলায় রেখে দিয়ে। সবকিছু শুনে
ছেলেটা বলল
- তোমার ক্লাসে একটা মেয়ে
পড়ে তোমার সাথে যার নাম সুনন্দা, ওর সাথে আগে বন্ধুত্ব
করো। কয়েকদিন পর এসে আমাকে জানাবে কি বুঝলে। উত্তর তুমি নিজেই পেয়ে যাবে।
রুপালী তো বেজায় ক্ষেপে গেলো কিন্তু কিছু বলতে পারল না ওই পিছুটানের জন্য।
রুপালী সুনন্দাকে চেনে – মেয়েটা পড়াশুনায় ভালো
কিন্তু দেখতে খুব কালো, চুলগুলো আঁচড়ায় না, জিন্স পরে না... কেমন
গেঁয়ো গেঁয়ো। কিন্তু এটা বুঝতে পারল না, ছেলেটা ওর কথা কেন বলল
হঠাৎ। যাই হোক, ওকে পাবার জন্য তো এইটুকু করাই যেতে পারে। সে সুনন্দার সাথে বন্ধুত্ব করল।
সমস্ত ক্লাসের ছেলেমেয়ে দেখে অবাক যে রুপালী নিজে থেকে একটা কালো মেয়ের সাথে কথা
বলছে। কেউ কেউ খুশী হল, আবার কেউ মুখটা বেঁকিয়ে
বলল – হুম, কেস জটিল! রুপালী এই কদিনে যেটুকু জানল সেইটুকু হল – সুনন্দার বাবা মা কেউ
নেই, সে টিউশন করায় আর পড়াশুনা করে, একা থাকে হোস্টেলে...।
সেদিন ছিল কলেজের
পরীক্ষার ফিস দেবার দিন। রুপালী অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর সামনে এলো।
অফিসের কর্মচারী তার কাছ থেকে টাকা চাইলে সে ব্যাগে হাত দিয়ে দেখে টাকা নেই। এদিকে
ওর পেছনে আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আছে যারা তার মত সুন্দর দেখতে না তাই অনেকক্ষণ ধরে ব্যাগ
হাতড়ে দেখল। এদিকে কর্মচারী তাকে বকা দিতে শুরু করল। এভাবে তাকে কেউ বকে নি, নিজের বাবামাও না। পেছন
থেকে অনেক নিগ্রোর দল টিটকিরি মারছে – ‘টাকাগুলো সব হাওয়া খাবে
বলে বলে রেখে দেয় খোলা জানলায়’...। হাতি পাঁকে পড়লে ব্যাঙও
পেচ্ছাপ করে সেটা সেদিন হাড়ে হাড়ে বুঝল। হঠাৎ সুনন্দা এগিয়ে এসে
তার হাতে দুহাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল
- এই নাও আর তাড়াতাড়ি সরে
যাও নাহলে পেছনের সবাই তোমাকে কথা শোনাবে।
একটা কুৎসিত মেয়ের সাথে ভালোবাসার জন্য না হয় বন্ধুত্ব করা যায় কিন্তু তাই
বলে হাত পাতা! এটা কি ঠিক হচ্ছে? দুমিনিট সে দাঁড়িয়ে ভাবতে
শুরু করল... বাবা যা রাগী, আজই শেষ দিন ফিস জমা
দেবার... এইসব সাতপাঁচ ভেবে সে টাকাটা দিয়েই দিল। বিনিময়ে সুনন্দাকে কিছু না বলেই
সিঁড়িতে গিয়ে বসে গেলো আয়নার সামনে মুখের ঘাম মুছতে।ছেলেটা এসে বলল
- কি হল? চোখমুখ লাল কেন? কার উপর এত রেগে আছো?
- আরে ওই কালো ভূতনিটার
কাছে আজ হাত পাততে হল... তোমার জন্য না হয় দুদিন কথা বল যেতেই পারে তাই বলে...
ছেলেটা সব শুনে বলল
- ও নিজের ফিসটা তোমাকে
দিয়ে দিয়েছে। এবার আর ওর পরীক্ষায় বসা হবে না। আর সুনন্দাকে আমি ভালবাসি।
রুপালী একদম চুপ হয়ে গেলো। এরপর ওই সিঁড়িটা ভেঙে দেওয়া হল কোন কাজে আসে না
বলে। আরও সিঁড়ি আছে উপরে যাবার জন্য। সুনন্দা পরীক্ষায় বসতে পেরেছিল কারণ ছেলেটা
সেদিন তাকে টাকা দিয়েছিল। কয়েকদিন পর ছেলেটার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে রুপালী
একছুটে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেলো যাতে লেখা ছিল –
“আমি অনেক কালো হয়ে গেছি”
মা হাসে
কাকলী মুখোপাধ্যায়
সবার কপালে বলে সরাবন তহুরা মেলেনা । মৃত পিতার সন্তান দের সামনের পরিচিত দেওয়াল গুলো সরিয়া গিয়া যখন তাহাদিগকে বিশাল অচেনা
পৃথিবীর সামনে ফেলে তখনই উহাদের একজনের
সরাবন তহুরা খাইবার সাধ জাগে। অতঃপর সে উঁটের পিঠে উঠিয়া বইসে এবং চলিয়া যায় । আহা সে কী নির্বোধের
মত চলিয়া যায়। কী কষ্টের কী নিরর্থক এই চলিয়া যাওয়া আ হা হা।আমি বুঝিতে পারিয়া অতি
সত্বর তোকমা এবং উলট চণ্ডালের সরবত গুলাইয়া
...চীৎকার করি ভাই এই যে সরাবন তহুরা। সে তখন চলিয়া গিয়াছে। ক্ষুধার্থ এক বালক আমার হাত হইতে সরবতের গ্লাস কাড়িয়া নিয়া
ঢক ঢক করিয়া খাইয়া আমার দিকে তাকাইয়া চোখ মারিলো
লালা ও কস শুকানো ঠোঁট দিয়া চুম্বন ছুড়িয়া
দিল বুঝিলাম আমি খাদ্যে পরিণত হইয়াছি। ঘরে আসিয়া দেখিলাম মা হাসিতেছে ।
ভালো করিয়া তাকাইয়া
বুঝিলাম ইহা হাসি নয় । আহা সেই হাসি সাগরের হাজারো ঢেউ এর
মতো আছড়াইয়া পড়িতেছিল আর আমার ভাইটির জন্য একটা
চাকরির জন্য অনুনয় করিতেছিল। শৈশবে ঠিক নয় বয়ঃসন্ধির কালে নিজেকে মনে মনে এক নির্যাতিত সুন্দরী লক্ষ্মীবালা ভাবিয়া পরম তৃপ্তি
পাইতাম। প্রতিদিন স্বপ্ন দেখিতাম। বান্ধবি
মহলে সেই স্বপ্ন বিশেষ জনপ্রিয় হইয়া উঠিতেই এক ঈর্ষাণ্বিত বান্ধবি বলিল কেহ ধারাবাহিক স্বপ্ন দেখিতে পারেনা।অতএব আামি
মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হইলাম। আমি চিৎকার করিয়া
বলিতে চাইলাম সত্যি স্বপ্ন দেখি প্রতিদিন
একই ভাবে।একদিন বিবাহ করিলাম সানাই বাজিলোনা। মিনি লাল চেলি না পরিয়াই শ্বশুর বাড়ি চলিয়া গেলো। মিনি তো গেল । মিনির মা তখনও হাসিতেছে । মিনি চলিয়া গেল। একদিন
ঘুম থেকে উঠিয়া মিনি দেখিতে পায় কতগুলো শকুন তাহাকে পরখ করিয়া দেখিতেছে । মিনিকে চোখ খুলিতে দেখিয়া তাহারা হাসিয়া বলিল ‘হা কর তোকে সরাবন তহুরা
খাওয়াইয়া দি’ । আমি চিৎকার করিলাম বলিলাম ‘স্টপ স্টপ জেনোসাইড’ ! আমার মা
তখনও হাসিতেছিল হি হি হি ।
[ ‘সরাবন তহুরা’
– বেহেস্তের সরবত যা অনেক পূণ্যের পর মেলে ]
রাজী
মৌ দাশগুপ্তা
ঢং ঢং ঢং ঢং করে পেটা লোহার পাতে শব্দ তুলে আছড়ে
পড়া লোহার ডান্ডাটা বুঝিবা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল কখন প্রথমা উত্তর লেখা শেষ করে
পেনটা হাতথেকে নামিয়ে রাখার ফুরসত পায়! উচ্চমাধ্যমিকের আজ ছিল শেষ পেপার,পলিটিক্যাল সায়েন্স।
বিষয় শক্ত বা দুর্বোধ্য না হলেও খুব লিখতে হয়েছে, তার ওপর রিভিসনের সময়টাও আজ পাওয়া গেল না, মনে মনে ইষ্টদেবতাকে
স্মরণ করে খাতা জমা দিয়ে বাইরে এসে দেখল, আজও ছোটমামা অপু রোজকার মত সাইকেলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভাগ্নীকে দেখে হাসিমুখে হাত নাড়ল। অপু এই শহরে সব্জি বেচে, প্রথমার পরীক্ষার এই
কটা দিন কাজ ফেলে সকালে বিকালে বাড়ী থেকে পরীক্ষাহল আর পরীক্ষাহল থেকে বাড়ী করে
যাচ্ছে।
প্রথমার বাড়ী যে অজ পাড়াগাঁয়ে সেখানে কোন হাইস্কুল নেই। জুনিয়র স্কুল
একটা আছে বটে, সেখানে আর কজন মেয়েই বা পড়ে! তবু মায়ের নীরব প্রশ্রয়, নিজের পড়াশুনার আগ্রহ আর জেদ,গ্রামের ঐ জুনিয়র
স্কুলের মিনি দিদিমনির অদম্য উৎসাহ, ভরসাকে কে সম্বল করে আজ প্রথমা উচ্চ মাধ্যমিকের
গন্ডী পেরোতে চলেছে। বাইরের লোকেরা তো বটেই, ঘরেও বাধা দেবার লোকের খুব একটা কমতি ছিল না। বিশেষত বাবা বা কাকা কাকিমা তো বটেই এমনকি ছোটবোন কাজলী
ছাড়া নিজের ভাইবোনেদের থেকেও কোন সাহায্য ও পায়নি, বরং ক্লাস নাইন থেকে
বাড়ী থেকে ২৫ কিমি দূরের গ্রাম কালীনগরে রোজ স্কুল যাওয়া নিয়ে কম ঝামেলা
হয়নি ঘরে। তাও ভলো রেজাল্ট
করার জন্য অনেক ছোটাছুটি ধরাধরি করে স্কুল ফী মকুব করিয়ে দিয়েছিল মিনি দিদিমনি, বইও মিনি দিদিমনিই
যোগাড় করে দিয়েছে এতদিন। পঞ্চায়েত থেকে একটা সাইকেল আর মাসিক বৃত্তিও পেয়েছিল প্রথমা। ওর
ভাগের জল আনা, কাপড় কাচা,বাসনধোয়া জাতীয় অনেক কাজ মা নয়তো কাজলী ওর বাবাকে
না জানিয়ে ভাগাভাগি করে সেরে রাখতো , যাতে ও ঘরে কিছুটা পড়ার সময় পায়। নয়তো এতদিনে ওর অন্য খেলার সাথীদের মত বিয়ে থা
করে বাচ্চাকাচ্চা সামলে
উচ্চমাধ্যমিকের পড়া তো দূর অস্ত, লক্ষীর পাঁচালী
পড়ারও সময় পেত কিনা কে
জানে। ওর বাবা তো এবারেও পরীক্ষা দেবার আগে ঘরে ভীষণ অশান্তি করেছে,উচ্চমাধ্যমিকের সীট
পড়েছে আরো দূরে, ওদের স্কুল থেকে দুজন শিক্ষক শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে পরীক্ষাকেন্দ্রের
কাছেই বিনামূল্যে ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা মেস মত থাকার ব্যবস্থা করা হলেও গ্রামের লোক
মন্দকথা বলবে,এই অজুহাতে প্রথমার পরীক্ষা দেওয়াটাই ভেস্তে
যাচ্ছিল। শেষে অপু প্রতিদিন বাড়ী থেকে স্কুল আর স্কুল থেকে বাড়ী পৌঁছানোর মহান দায়িত্বটা
সেধে নিজের কাধেঁ নেওয়ায় অন্তত পরীক্ষাটা দেওয়া গেছে কিন্তু আর পড়া চালানো
যাবে কিনাকে জানে! তারাজ্বলা সন্ধ্যার অন্ধকারে পরীক্ষা শেষের আনন্দ আর পড়া চালানো
যাবে কিনা সংশয় নিয়ে ঘরে ঢুকেই আঁতকে উঠলো প্রথমা, বাঁশের নীচু মাচায়
রাখা ওর বইখাতা রাখার জায়গাটা বেবাক খালি, না ঠিক খালি না,ওখানে কয়েকটা শাড়ী জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখা। মা বা কাজলী কাউকে
দেখাও যাচ্ছেনা, অন্যদিন দুজনে অনেকটা রাস্তা এগিয়ে আসে টর্চ হাতে নিয়ে,আজ তো আসেনি। মেঝেয় বসে মুড়ি খাচ্ছিল ছোটভাই পানু, খুব আনন্দের সাথে বলল -“মেয়েছেল্যার বড় সাইকেল নিয়ে ঘোরার শখ না? আর পড়ন লাগে না,বাবায় তর বেবাক বই বেইচ্যা খাইছে। সাইকেলটাও দাদারে দিয়্যা
দ্যেছে। কাইল তরে দ্যাখতে আইবো। বিয়া যাবি এবার”। আশঙ্কা যে এত তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে যাবে বোঝেনি প্রথমা ।
তা শ্বশুরবাড়ী মন্দ ছিলনা প্রথমার।বাপ ছেলের
সংসার, শ্বাশুড়ী মা গত হয়েছিলেন অনেক আগেই, দুই ননদ বিয়ে থা করে নিজেদের সংসারে
ব্যস্ত। শ্বশুরমশাই ওনার ছেলে দুজনেই রেলে কাজ করতেন,তবু প্রাইভেটে বিএ
পরীক্ষা দেবার অনুমতি পেতে পুরো সাত সাতটা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল, তখন সানি সবে স্কুলে যাচ্ছে আর মানি হাটছে টলেটলে। আর আজ? কৃতী বাস্তুবিদ সানি সাগরপারে সংসার পেতেছে আর পেশায় চিকিৎসক
মানি দেশে থেকেও বিয়ের পরে স্বামী সন্তান নিয়ে মায়ের থেকে অনেক দূরে, প্রথমাও তো বিএ, এম এ, বি এডের পালা সাঙ্গ করে সসন্মানে শিক্ষকজীবন থেকে
অবসর নিয়ে থিতু হয়েছে অনেক বছর,ওর মা বাবার মত স্বামী আর শ্বশুরমশাইও আজ ফটো হয়ে ঝুলে আছেন
ঘরের দুধসাদা দেওয়ালে। একলা ঘরে আর সময় কাটেনা ওর, টাকার অভাব না
থাকলেও আপনজনের সান্নিধ্য না পাওয়ার অভাবে কষ্ট হয় বই কি, বয়স হবার লক্ষণ বুঝি একেই বলে !
ছেলেমেয়ের ফেরত আসার আশা আর করেনা প্রথমা,আবার তাদের সংসারে
উটকো আপদ হতেও ভয় লাগে, যদিও সানি মানি বারবারই মাকে নিজের কাছে রাখতে
চেয়েছে । সম্পর্কটা এখন দিনে একবার ফোন,মাসে একবার ব্যাঙ্কে
জমা পড়া মোটা অঙ্কের চেক,আর কচিৎ কদাচিৎ কলকাতায় আসায় সীমাবদ্ধ আছে।অনেক ভেবে ঠিক করেছে বাড়ীটা ও বেচে দিয়ে টাকাপয়সা যা থাকবে তার
একটা ব্যবস্থা করে হাত পা সচল
থাকতে থাকতেই কোন বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে উঠবে,কটা কথা বলার লোক তো
থাকবে, অসুস্থ হলে লোক জানতে পারবে, এখানে একা থাকলে
হয়তো মরে গেলেও লোকে জানবেনা।খটখট শব্দে দরজার কড়াটা অনেকক্ষণ ধরে নাড়াচ্ছে কেউ, লোডশেডিং বোধহয়, কলিংবেলটা বাজছেনা, ঠিকে কাজের মেয়েটা
কাজ শেষ করে চলে গেছে, আজকাল নিজের হাতে কাজ করতে বড় কষ্ট হয় । অবশ্য কাজের লোক
রাখার অভ্যাসটা সেই ব্রহ্মপুরে থাকতেই, তখন সবে পড়নোর কাজটা জুটেছে,বাচ্চাদুটোর স্কুল,শ্বশুরমশাইও অসুস্থ,তখনই রানী বলে একটা
আদিবাসী মেয়ে ঘরের সব কাজ করে দিয়ে যেত । ভাবতে ভাবতেই দরজাটা খুলে দিল প্রথমা । শাড়ীপড়া মাঝারী লম্বা মেয়েটা পা ছুঁয়ে প্রণাম সেরে
হাসিমুখে পরিস্কার বাংলায় বললো,
- চিনতে পারছ বড়মা ? উফফ কতজনকে জিজ্ঞাসা করে করে তবে তোমার ঠিকানা
পেয়েছি। কেমন আছো ?
- না মা , চিনতে পারলাম না তো, কত সালের ব্যাচ ছিলে
?
- আমি রাজী বড়মা। -- এঠি আ রাজী, মার গোড়অ টা ছুঁই যা,- থাক থাক রানী, এ কে রে ?
- রাজী মা, মোর ঝিঅ টা বটি,
- তোর মেয়ে ? বাঃ ভারী মিষ্টি তো। আগে দেখি নি তো।
- মু কেবে আনুনি মা, আজি নেইকে আসিলি,ঘরকু আকেলা থিলা।
- বেশ করেছিস, তা হ্যারে রাজী, স্কুলে যাস? মনে হচ্ছে যেন এই সেদিনের কথা,এর মধ্যে এত বড় হয়ে গেল মেয়েটা?
-ভেতরে আয় রাজী, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ?
রাজীর বাবা রিক্সা টানত আর সময় পেলেই মদ খেয়ে চূর হয়ে থাকত, রানী যখন কাজনেয় তখন
রাজীর বাবা মদ খায় না মদ ওকে খায় বোঝা যেত না। অথচ একচিলতেখাপরার ঘরে দু’দুটো বউ পুষতো।
সারাদিন দুই সতীনে ঝগড়া আর
চুলোচুলি।‘ শ’কারাদি ‘ব’কারাদি গালিগালাজ। তার মাঝেই রাজী পড়ত,খেলত,হাসত।প্রথমা নিজের
কাজ আর সংসার সামলে ফুরসতই পেত না এত কথা জানার যদি নামায়ের অনুপস্থিতিতে সৎমায়ের
হাতে বেধড়ক মার খেয়ে রাজী হসপিটালাইজড হোত। রানীর অসহায় কান্নাকাটিতে আরও অসহায় লেগেছিল ওর, বাড়ীর আপত্তিতে ঘরে
ঠাঁই দিতে না পারলেও একে তাকে ধরে রাজীকে হসপিটাল থেকে ছাড়া পাবার
পরই পড়াশুনা থাকার খরচা নিজের দায়িত্বে নিয়ে একটা সরকারী আশ্রমে পাঠিয়ে
দিয়েছিল, রানী
সারাদিন ওর ঘরেই থাকত খালি রাতে কোন এক ভাইয়ের
বাড়ী ফেরত যেত, কিন্তু সকাল হলেই চলে আসত আবার।এই ব্যবস্থা চলেছিল অনেক বছর, মানে বিএ পরীক্ষার পরপরই রাজী কোথায় একটা কাজ পেয়ে মাকে এসে
নিয়ে যাওয়া অবধি। তারপর অনেক জল গড়িয়েছে গঙ্গার বুকে।প্রথমদিকে চিঠি বা
ফোনের সংযোগটা সময়ের সাথে ঢিলে হয়ে গেছে, ওরাও চাকরী সূত্রে বদলী হয়ে শেষে এসে কলকাতায় থিতু
হয়েছে। কে কোথায় ছিটকে গেছে খবর রাখা যায়নি।তবু তো মেয়েটা খোঁজ করতে করতে
এতদূর এসেছে। কথায় কথায় জানা গেল, প্রায় দুবছর হল রানী মারা গেছে। মারা যাবার
আগে নাকি একবার অন্তত প্রথমাকে দেখতে চেয়েছিল। রাজী একটা আদিবাসী
বাচ্চাদের জন্য বানানো সরকারী হোমের তত্বাবধায়িকা। বালেশ্বর সীমান্তর কাছে ঐ
হোমে আপাতত প্রায় শ’খানেক বাচ্চা আছে। কলকাতায় একটা সেমিনারে এসে
প্রথমার স্কুল থেকে ঠিকানা বার করে এতদূর এসেছে শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে ।
- বিয়ে করলি না রাজী ?
মাকে দেখে বিয়ের শখ
ঘুচে গেছে বড়মা।
- তবু তুই তো ছিল
-কি হবে বড়মা ? এই বেশ আছি, বাচ্চাদের নিয়ে, তুমি না থাকলে কোথায়
ভেসে যেতাম কে জানে, তাই যে টুকু বিদ্যাবুদ্ধি আছে তাই দিয়ে চেষ্টা
করছি আমার মত আরো ক’জনকে বাঁচার রাস্তা দেখাতে।বড় ভালো লাগে গো বড়মা।
অন্যরা না বুঝুক, তুমি তো বুঝবে। উঠতে গিয়েও খানিক ইতস্তত করে প্রথমার হাতটা
দুহাতে চেপে ধরে রাজী,
- আশ্রমেই যখন যাবে বড়মা, আমার সাথে চলো না, বেশ মা বেটি থাকবো, গল্প করবো, গল্প শুনবো, দুজনের কেউ একা থাকবো না, তুমি আমি মিলে আরো
কটা রাজীকে বড় করে তুলবো, তারা আবার বাঁচার মন্ত্র শেখাবে আগামী
রাজীদের। তোমাকে যে আমার খুব দরকার, মানুষ গড়ার কারিগরকে
পাশে পেলে কত রাজীকে যে মানুষ করে তুলতে পারবো সেটা তো ভাবো। যাবে মা?
অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভেসে যেতে যেতে এই প্রথম প্রথমা অনুভব করলো,ভালোবাসা, সংস্কার, শিক্ষা শুধু জন্মগত পূঁজি নয়, রক্তের ঋণ দিয়ে তাকে চেনা যায় না, এদের শিকড় গাঁথা
থকে বুঝিবা সব মানুষের মনে, খালখাঁটি জহুরীর হাতে না পড়লে তা নুড়ি থেকে হীরের
কুচি হয়ে ঝিকমিকিয়ে উঠতে
পারে না। সংসারের মায়ায় আটকে গিয়ে যে কাজ প্রথমা
করতে চেয়েও করে উঠে
পারেনি তা রাজী কিন্তু পেরেছে।
একটি নিছক ভালোবাসার গল্প
ইন্দ্রাণী
সরকার
গরমের ছুটি কাটাতে এসে
নীল আর প্রিয়ার আলাপ |ওদের দুই পরিবার দুটো পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল | হঠাৎ-ই একদিন দুই
পরিবারের মধ্যে আলাপ হয়ে গেল বাজারে | প্রিয়ার বাবা কিছু একটা জিনিষের দর
করছিলেন অনেকক্ষণ, দোকানীর সঙ্গে ওনার বচসা শুনে নীলের বাবা এগিয়ে এসে ব্যাপারটাকে
সহজ করার চেষ্টা করলেন | তারপর কথায় কথায় দুজনে জানতে পারলেন যে তাঁরা পাশাপাশি বাড়িতে
থাকেন | এইভাবেই দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার শুরু | প্রিয়া রোজ সকালে মর্নিং ওয়াকে যেত | চারিদিকে সুন্দর
সুন্দর সব বাড়ি আর মন ভোলানো ফুলের বাগান দেখতে দেখতে ও খুব খুশি হয়ে উঠত | মাঝে মাঝে হাত
বাড়িয়ে দুষ্টু মেয়েটা ফুল চুরিও করত | ভাগ্য ভাল যে অনেক সকাল বলে কেউ উঠত না
তাকে ধরে ফেলার জন্য | একদিন একটা ফুল ও হাত বাড়িয়ে কিছুতেই নাগাল পাচ্ছিল না | হঠাৎ পিছন থেকে কে
যেন বললো - "আমি কি সাহায্য করতে পারি” ? প্রিয়া চমকে পিছন ফিরে দেখল একটি সুন্দর
দেখতে ছেলে তার দিকে চেয়ে মৃদু হাসছে |
প্রিয়া বললো - "কে তুমি” ? ছেলেটি বললো -
"আমার নাম নীল | তুমি বোধ হয় জানোনা আমার বাবার সাথে তোমার বাবার কিছু দিন আগেই
আলাপ হয়েছে | আজ তুমি যখন বাড়ির গেট খুলে বেরোলে তখন তোমায় দেখতে পেলাম | তারপর আমিও তোমার
সাথে আলাপ করার জন্য তোমার পিছু নিলাম” | এই বলে নীল হো হো করে হেসে উঠল | প্রিয়া মনে মনে খুব
রেগে গেলেও দেঁতো হাসি হেসে বললো - "ওহো তাহলে আমার সব পরিচয়-ই তুমি জানো” | নীল বললো -
"না, তেমন বিশদ ভাবে কিছুই জানি না | এই যেমন তোমার নাম, তুমি কি কর কিছুই
জানি না, কিন্তু জানার খুব ইচ্ছে আছে | তুমি কি আমার ইচ্ছাপূরণ করবে?"
প্রিয়া একটু ভেবে বললো - "আমার নাম প্রিয়া | আমি হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে এখানে বাবা মা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছি” | নীল স্মিতহাস্যে বললো - "আমি বি. কম. পাশ করে বেড়াতে এসেছি | আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান | এর পর থেকে মাঝে মাঝে তাদের দেখা আর গল্পগুজব হত | প্রিয়ার ভাই রুকুর সাথে নীলের খুব ভাব হয়ে গেল| প্রায়-ই ওরা দুজনে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলত নীলেদের বাড়ির সামনের জমিতে | প্রিয়াকে ওরা ডাকাডাকি করত, কিন্তু লজ্জায় প্রিয়া ওদের বাড়ি যেত না |
প্রিয়া একটু ভেবে বললো - "আমার নাম প্রিয়া | আমি হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে এখানে বাবা মা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছি” | নীল স্মিতহাস্যে বললো - "আমি বি. কম. পাশ করে বেড়াতে এসেছি | আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান | এর পর থেকে মাঝে মাঝে তাদের দেখা আর গল্পগুজব হত | প্রিয়ার ভাই রুকুর সাথে নীলের খুব ভাব হয়ে গেল| প্রায়-ই ওরা দুজনে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলত নীলেদের বাড়ির সামনের জমিতে | প্রিয়াকে ওরা ডাকাডাকি করত, কিন্তু লজ্জায় প্রিয়া ওদের বাড়ি যেত না |
প্রিয়াদের বাড়ির বাগানে খুব বড় আতা গাছ ছিল | মাঝে মাঝে কিছু
কিছু আতা গাছ থেকে খসে মাটিতে পড়ে যেত | কিন্তু সেগুলো ভেঙে নষ্ট হয়ে যেত বলে কেউ
খেত না | একদিন প্রিয়া হাত বাড়িয়ে একটা আতা ধরার চেষ্টায় বিফল হয়ে বাড়ি
থেকে একটা লাঠি খুঁজে সেটা দিয়ে আতাটা ধরার জন্য লাফালাফি শুরু করল | তারপর হঠাত পপাত
ধরনীতলে | নিজের মনেই বাবারে মারে করে উঠতে গিয়ে সামনে দেখে
"নীল"| নীল ওর হাত বাড়িয়ে বললো - "আমার হাত ধরে ওঠ | লজ্জা করতে হবে না | পড়ে গিয়ে অনেক
লেগেছে | হয়ত কেটেকুটেও গেছে” | প্রিয়ার বুক হঠাত অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল সে
মনে মনে বললো - "নীল তোমাকে আমার ভাল লাগে | খুব খুউব” |
ওরা দুই পরিবার ঠিক করলো ওরা একসঙ্গে গিরিডি-তে উশ্রী ফলস্
দেখতে যাবে | প্রিয়া মনে মনে খুব উত্তেজিত নীল সঙ্গে থাকবে ভেবে | ওরা দুই ফ্যামিলি
দুটো টাঙ্গা ভাড়া করে যাবার মনস্থ করল | নীল প্রিয়াদের টাঙ্গায় রুকুর সঙ্গে কথা
বলার অছিলায় উঠল | তারপর রুকুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রিয়ার দিকে আড়ে আড়ে চাইতে
শুরু করল আর তারপর কথাও বলতে লাগল | প্রিয়া সহজ ভাবেই নীলের সঙ্গে কথা বলতে
থাকল | উশ্রী ফলস্ এ গিয়ে
ত' খুব মজা | এত সুন্দর ঝরনার ধারা পাহাড়ের বুক চিরে
ঝরে পড়ছে | চারিদিকে নানান গাছের মেলা | অনেক দম্পতিরা ঝর্নার জলে গা ভিজিয়ে চান
করছে | কিছু বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কম জলে খেলা করছে | নীল রুকুকে বললো "কি রে রুকু, জলে নামবি না কি” ? রুকু বললো - "না বাবা আমার ভয় করে |" নীল বললো -
"কোন ভয় নেই আমি ত' আছি” | তারপর দুজনে জলে নেমে খেলা শুরু করল | প্রিয়ার তখন কি যে
রাগ হচ্ছিল তা বলার নয় | ও মনে মনে বলছিল -"হে ভগবান, আমি যদি নীলের সঙ্গে জলে নামতে পারতাম
!" তারপর ওরা সঙ্গে আনা খাবারগুলো এক জায়গায় বসে খেতে শুরু করল | খাওয়ার পর অনেকক্ষণ
ওরা হেঁটে হেঁটে চারিদিক দেখতে থাকল | সমস্তক্ষণ নীল, রুকু আর প্রিয়ার
সঙ্গে হাঁটছিল | কি এক ভালোলাগায় প্রিয়ার মন ভরে উঠছিল | তারপর ঘরে ফেরার পালা | ফেরার পথে নীল এক ফাঁকে চুপিচুপি প্রিয়াকে
বললো “আজকের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে”| প্রিয়া আর একটু হলে কেঁদে ফেলছিল | কিন্তু নিজেকে
সামলে নিল | সে ও নীলকে চুপিচুপি বললো - আমারও, তোমার কথা আমার
চিরদিন মনে থাকবে |
ঢাকা,তুমি ও তারা
কাকলী মুখোপাধ্যায়
তার পর, নাঃ তার পর আমাকে উঠতেই হবে
বাসে।পদ্মা পেরিয়ে পৌঁছুতে হবে ফরিদপুর। কিন্তু আমার ঢাকা,ধূলো বালির ঢাকা তাকে ছাড়তে যে আমার
বড় কষ্ট হয়।ধূসর সামিয়ানার নিচে প্রেম কামে ঘামে আড্ডায় মানুষ পড়তে পড়তে কেটে
যাওয়া দিন গুলো আহা সেই যে আমার নানা রং এর দিনগুলি আমি কি করে ভুলি?আমার সঞ্চয় আমার
অর্জন সব টি.এস.সির ঘাসে ঢেলে রেখে খালি ঝুড়ি হাতে বাড়ি ফিরতে আমার যে মন
সরছেনা।তার সাথে দেখা হয়েছিল যাদুঘরের সামনে ।পরনে জিনস এর প্যান্ট গায়ে ঢিলে ঢালা
সার্ট। আর তার চোখে সাত আকাশের গভীরতা।প্রথম
পরিচয়েই বুঝতে পেরেছিলাম সে ভণ্ড আমার মতই। প্রতিটি মুহূর্ত তার কাটে বিনির্মাণের মধ্যে।কখনও সবুজ কখনও কমলা
কখনও লাল কখনও ধূসর আর কখনওবা তার পুরোটাই প্রচণ্ড ঝড়জলের রাতের রং ধরতো।পড়ন্ত
বিকেলে তারে বসে থাকা নিঃসঙ্গ কাকের মতো সে ছিল একা অথচ প্রচণ্ড
বন্ধু বৎসল। খুব হাহা হি হি আড্ডা মারতাম তার
সাথে।তার একাকীত্ব আমাতেও সঙ্ক্রমিত হয়েছিল।সেই থেকে আমি একা।ঝড়ের রাতে নীড় চ্যূত
পাখির মত একা।বাসে উঠতেই হবে।তার পর পদ্মা।আহা পদ্মা আমার দুঃখভরা স্রোত
কাব্য।তোমার বুকে এত জল অথচ তোমার কথা ভাবতেই গলাটা শুকিয়ে কেমন খটখটে কাঠ হয়ে
যায়।
গাবতলী বাস স্ট্যাণ্ডে বসে আছি লোকের চোখ গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে
সর্বাঙ্গে । একটু চা খেলে কেমন হয়! চা খেতাম তার সাথে। পথের পাশে ঝুবরির
মধ্যে। ঘণ দুধ ঘণ লিকার খেতাম আর সর্ন্তপণে কাপের গায়ে লেগে যাওয়া লিপস্টিক
মুছতাম। একদিন দেখে ফেলে মেয়েদের সেকি গোষ্ঠী উদ্ধার করা তার। তারপর কাঁচামিঠা ঝগরা।কত হাজার খুনসুটি।সে আমার পরিচিত থেকে ক্রমশ
বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।শুধুই কি বন্ধু!হ্যাঁ তাই।তার চাপ্টার আমিই একদিন শেষ করে
দিয়েছি গোপন অভিমানে।সে বুঝতেও পারেনি।দাফন করেছি তাকে পদ্মার জলে।বাঃ চাটা চমৎকার
আরেক কাপ খাব কি?থাক খাই।আহা ফুচকা কী আদর করেইনা খাইয়ে ছিল তুহিন রমনার গেটে।এখন
সন্ধ্যা নামতেই সেখানে গণিকার ভীড়।আহা কী চমৎকার কবিতা লিখতো তুহিন! একদিন সে চলে
গিয়েছিলো পুরনো ঢাকার ধূপখোলা মাঠের অন্ধকারে।আর তাকে দেখিনি।খুঁজিওনি।তারপর তুমি
এলে।কেন এলে বলতো? এই অপরাহ্ণে কেন?ঠিক করলেনা।তুমি আমার কে?জীবন দেবতা? কিন্তু তার পরও কোথায় যেন সেই একটা একা মানুষ থেকে যায় ।আমি তাকে
এড়াতে পারিনা।ওঃ সবাই বাসে উঠছে।তোমাদের সবাইকে ফেলে চলে যাব।আবার আসবো কোন এক
ছুতোয়।গাড়ী চলছে।তোমরা কি শুধুই বন্ধু ছিলে? তবে জলে জ্যোৎস্নায় নক্ষত্রে কেন
তোমাদের অবাধ বিচরণ? আর যেখানে যাচ্ছি যার কাছে সেই বা কে। এত দোকান!এত ঘর! ঠিক যেমন
বাসের গতির সাথে পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্য ঠিক তেমনি মানুষ থেকে মানুষে ধূলো থেকে এয়ার
কুলারে চলছি।
ঢাকার রাত ঢাকার দিন. ঢাকার পাপ, ঢাকার পূণ্য সব নিয়েই ভালোবাসি তাকে। কিন্তু
ওই যে পদ্মা উঁকি মারছে গাছের আড়াল থেকে তুই যে কীর্তিনাশা।পদ্মার ঢেউ, মাছ আলা,ফেরি ,টয়লেটের বোটকা গন্ধ সব মিলে একটা
অনুভূতি ঠিক বোঝাতে পারবোনা কাউকে।হঠাৎই বাদাম আলা পঁয়তাল্লিশ বছর ফিরে পাওয়া শৈশব। কোথাও কেউ ছিল আছে আছে কি? তার কাছে তাদের কাছে আমি থাকি না থাকি তারা থাকবে আমাতে,পদ্মার জলে পড়বে
তাদের ছায়া লাল পাড় গরদের শাড়ী পুরু চশমার আড়ালে এক ফোটা চোখের জল অথবা তুমি মায়ের
মত বোনের মতো আবার হন্তারকের মতো দাফন হয়ে গেছ আমার সত্বায়।ফরিদপুর নামলাম।কাল
সকাল সকাল কলেজে যাব।অনেক কাজ জমে গেছে। ঘর, সন্তান আর কিছুই হয়তো সত্যি নয় তাই
বলে বাদাম আলাও কি নয়!!