রম্যরচনা
একটি ভিন্নমাত্রিক প্রেমের গপ্প ও
স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তুবায়ন
স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তুবায়ন
কথা কবিতা
বসন্তের অবসানে গ্রীষ্ম আসি আসি করিতেছে । রৌদ্রের খরতাপে চোখ ঝলসাইয়া যায়। ঝরাপাতার স্তুপ সামান্য বাতাসেই
খরখরাইয়া উঠে । কোকিলের কন্ঠে গরমের ছোঁয়া লাগায় সেই আগের
সুমিষ্ট ধবনি যেন আর নাই। পড়ন্ত বৈকালে আধামরা সবুজ ঘাসের উপর প্রেমিক প্রেমিকা উভয়েই মুখ-ব্যাদন করিয়া
বসিয়া রহিয়াছে । সামনের সমস্যার হিমালয় । বর্তমানে হিমালয়ের চূড়া ডিঙাইয়া আসা নারী পুরূষ উভয়ের জন্য সহজলভ্য হইলেও
ইহাদের জন্য তাহা দূর্লঙ্ঘনীয় হইয়া পড়িয়াছে । অথচ দুইজনারই এই দুস্তর পথ অতিক্রমণের
আন্তরিক চেষ্টার অভাব নাই, ইহা দুর্মুখেরাও স্বীকার করিবেন ।
নীরবতা ভঙ্গ করিয়া সহসা দুইজনার মধ্যে
কথোপকথন শুরু হইল। প্রেমিকা তার আজন্মলালিত কান্নার
প্রবলস্রোতে ভাসিতে ভাসিতে কহিতে লাগিল, “হৃদয় সঁপিয়া ভালোবাসিলেও যে কেহ কেহ আপন
হয়না এই সত্য তোমাকে দিয়াই বুঝিতে পারিলাম। কী কারণে আমায় ছাড়িয়া গেলে তাহা জানিতে
পারিলে অবুঝ মনকে প্রবোধ দিতে পারিতাম”।
প্রেমিক রুষ্ট হইয়া কহিল, “চারটি কারণ, চার সংখ্যার যোগফলে আমি তোমাকে পরিত্যাগ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছি।
প্রেমিকা - স্ত্রী তালাকের ক্ষেত্রে তিন সংখ্যা ব্যবহৃত হয়
জানি। প্রেমিকা তালাকের ক্ষেত্রে চার সংখ্যা লাগে তাহা আমার জানা ছিল না । একটু
বিশদ বর্ণনা করিলে বিষয়টা পরিস্কার হইত ।
প্রেমিক - তোমাকে আর বলিব কী ? তোমার চোখে আঙুল দিয়া দেখাইলেও আমি বিড়াল বলিলে তুমি মেউর বলিবে।
প্রেমিকা -
আর বলিব না ।
প্রেমিক - প্রথমতঃ আমি তোমাকে বলিয়াছিলাম, আমেরিকা আর কিউবার শীতল সম্পর্কের অবসান হইতে চলিয়াছে, তুমি আমার এ কথা গ্রাহ্য করো নাই ।
কান্না থামাইয়া ধাতস্থ হইয়া প্রেমিকা
পূর্বাপেক্ষা একটু সবল কন্ঠে কহিল, আমেরিকা- কিউবার শীতল সম্পর্ক তরলীকরণের সাথে আমাদের প্রেমের সংঘর্ষ
কোথায় তাহা অনুধাবন করিতে পারিতেছি না। তারপরও আমি এই বিষয়ের উপর তোমার ধার্য করা খেসারত আর
কাফফারা দিয়াছি। ইহা তো চুকিয়া গিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ আমি অসাধারণ ব্যক্তি। আমার মধ্যে
যে ভিন্নমাত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে যাহা দশটি পুরূষের মধ্যেও নাই তাহা তুমি আবিষ্কার
করিতে অক্ষম হইয়াছ ।
প্রেমিকা -
দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নাই। তুমি সামনে আগাও।
তৃতীয়তঃ
ইতস্তত করিয়া প্রেমিক একটা ঢোক গেলিয়া থামিল। তারপর কহিল,
চতুর্থতঃ
তুমি আমাকে যথাযথভাবে ডীল করিতে পারো নাই।
প্রেমিকা চিনচিন করিয়া কহিল,চতুর্থ বিষয়টি সমন্ধে আমি একমত নহি। কারণ আমি তোমাকে প্রেমে চাহিয়াছি।
ডীল করিয়া নহে। ডীল শব্দটির মধ্যে কেমন জানি একটা বাণিজ্যক লেন-দেনের গন্ধ
রহিয়াছে। যাহা আমার নাকে আসিয়া লাগে।
প্রেমিক - তুমি তৃতীয় বিশ্বের প্রেমিকা। তোমার মধ্যে এখনো কর্পোরেট প্রেম
দানা বাঁধিয়া উঠিতে পারে নাই। ইহাই বড় আফসোসের বিষয়। তুমি যদি ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ
করিতে তাহা হইলে প্রেমের বাজারে ডীলের কাটতি যে কেমন তাহা বুঝিতে পারিতে। প্রেমিকা এ
কথার উত্তর না দিয়া পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরিয়া যাইয়া বলিল,তৃতীয় বিষয়টি মনে হয় অন্য কোন সুরভিত
আঁচলের সুগন্ধিতে তোমার মন-প্রাণ মাতিয়া উঠিয়াছে।
প্রেমিক উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, তুমি যাহা ইচ্ছা তাহা বসিয়া বসিয়া ভাবো।
তবে আমি যাহা চাহিয়াছি তুমি তাহা দিতে পারো নাই। তুমি যদি আমায় ৩০% পারসেন্টও দিতে
তবে আমি তোমাকে ১১০% পারসেন্ট দিতাম। কী আর বলিব ? আমার প্রেম তোমার কপালে নাই।আমার বিশ্বাস, বিয়ে,প্রেম এগুলো নিয়তি দেখভাল করে।তাই যাহার
সাথে সংযোগ ঘটিবার তাহার সাথেই ঘটিবে। ইহাতে তোমার আমার কাহারো হাত নাই।। আমি
চলিলাম।
প্রেমিকা একাকী বসিয়া এইবার প্রেমের ব্যথায়
ভুলিয়া লোভনীয় পারসেন্টেজের হিসাব লইয়া পড়িল। প্রথমে সে ইহা আইন স্টাইনের আপেক্ষিক
তত্ত্ব প্রয়োগ করিয়া মনে মনে বলিল, আমি যদি ৩০% দেই তবেই না ১১০% মিলিবে ? আর যদি কিছুই না দেই ? তাহা হইলে কী হইবে ? প্রেমিকার চোখের সামনে বড় একটা শূন্য
সংখ্যা প্রাপ্তির ঘরে জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতে লাগিল। আচ্ছা প্রেমের নাম যদি
ডীলতত্ত্ব হয়,
তাহা হইলে
ইহা অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিলে কী ফল পাওয়া যাইতে পারে ! মালথ্যাসের থিওরিতে
গণিত আর জ্যামিতিক হারের কথা উল্লেখ আছে, আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ম্যালথাসের তত্ত্ব সুফল বহন করিয়া না আনিলেও
জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ইহা ম্যাজিকের মত ফল দিয়াছে। নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন তাহার
দারিদ্র্য বিমোচন তত্ত্বেও এ ধরণের কোন ফর্মুলা সংযুক্ত করিতে পারেন নাই। ডঃ
ইউনুসের নগদ সুদের বাণিজ্যেও সুদের হার এর চেয়ে কম। বাংলাদেশে ডেসটিনি আর এল এল এম
নামের ফক্কর ব্যবসায়ীরা এর চেয়েও কম লোভনীয় লভ্যাংশে মনোরঞ্জন করিতে গিয়া ধরা
খাইয়াছে ।
প্রেমিকার মনে এই নতুন ডীলতত্ত্ব চৈত্রের
বাতাসের মত ঘুরপাক খাইতে লাগিল। হঠাৎ তাহার মলিন চেহারা চকমকাইয়া উঠিল। উচ্ছ্বসিত
হইয়া মনে মনে কহিল, প্রেমিকের
আবিষ্কৃত এই নব্য থিওরি কিছুতেই ফেলিয়া দেওয়া চলিবে না । কবিগুরু বলিয়াছেন, জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা। যেখানে
দেখিবে ছাই ঊড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো মানিক রতন। কী করা যায়, কী করা যায় ভাবিতে ভাবিতে তাহার মনে হইল, আচ্ছা এই থিওরি কী শেয়ার বাজারে প্রয়োগ করা যায় না ? তাহা হইলে তো মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়া
শেয়ার হোল্ডারগণ নব উদ্যমে আবার ঘুরিয়া দাঁড়াইতে পারিবে। হঠাৎ তাহার মনে হইল
পদ্মাসেতুর কথা । এই সেতু লইয়া
দেশব্যাপিয়া ঝড় বহিতেছে। কারণ বিশ্বব্যাংক বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকের মত কথাভঙ্গ
করিয়াছে। ফলে চিরকালের হঠাৎ জ্বলিয়া উঠা বাঙালিচেতনা আবার মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছে।
এবার তাহারা নিত্য ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে ২৫ পয়সা সার চার্জ প্রয়োগ করিয়া, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মান করিয়া
দেখাইয়া দিবে যে,
আমাদের
অসাধ্য কিছুই নাই।
কথাটা সত্য। কিন্তু এই সৎ উদ্দেশ্য আর সাহসী
উদ্যোগকে পুঁজি করিয়া দূর্নীতিবাজরা তাহাদের টাকার থলিয়া বড় করিবার জন্য দর্জির
বাড়িতে দৌঁড়াইবে - এই কথা চিন্তা করিয়া দেশপ্রেমিকের দল উভয় সংকটে পড়িয়াছে।
ভিন্নমতের রাজনৈতিক অনুসারীরা এই সুযোগের সদব্যবহার করিয়া আসর মাতাইয়াছে।দলছুট ও
পতিত রাজনীতিকবৃন্দ এই সুযোগে মুখের তুবড়ি ছুটাইয়া রাজনীতিমুক্ত নতুন সংগঠনের নামে শর্ত আরোপ
করিয়া বলিতেছে,রাজনীতিই সকল নষ্টের মূল। অতএব, আমাদের মত লেজকাটার দল ছাড়া দেশের মঙ্গল
চিন্তা আর কেহই সুচারু রূপে করিতে পারিবে না। মিয়ানমারের জাতিগত শুদ্ধি ও
সাম্প্রদায়িকতার কারণে উদ্বাস্তু বিশ লাখ রোহিঙ্গার জন্য নব্য মানবতাবাদীর দল
কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করিয়া চলিয়াছে। এই রকম বহুমাত্রিক সংকট হইতে উদ্ধার করিতে পারে
একমাত্র ৩০% আর ১১০% পারসেন্টেজের এই আলাদিনী হিসাব। এই সূত্র প্রয়োগ করিলে বিশ
লাখ রোহিঙ্গাকে জামাতা আমন্ত্রন জানানো যাইবে,খাদকের দল দুইহাতে লুটিয়া পুটিয়া চাটিয়া খাইলেও স্বপ্নের ত্রিমাত্রিক
পদ্মাসেতুর বাস্তবে এক তীর হইতে অন্য তীরে সটান বেগে ধাবিত হইতে বিন্দুমাত্র সময়
লাগিবে না ।
সন্ধ্যা
ঘনাইয়া আসিল।রাত্রির পরীরা দল বাঁধিয়া কালো চাদর দিয়া পৃথিবী মুড়াইয়া দেওয়ার
উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছে। এক ধরণের শীতল হাওয়া অনুভব করিতেই প্রেমিকা আধামরা সবুজ
ঘাসের আসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইল। পূর্ব দিগন্তে তখন পূর্ণিমার প্রকান্ড চাঁদটি গাছের আড়াল হইতে আত্মপ্রকাশ করিবার
চেষ্টা করিতেছে ।
অনু গল্প
পাখি
ডঃ কাকলী
মুখোপাধ্যায়
চোখে নীল ব্যাথা ছলকে
ওঠে । ছোট্ট মেয়ে নীলা এগিয়ে
এসে হাত ধরে। বাবা কিছু খাব। হু এই যে দিচ্ছি মা। অনভ্যস্ত হাতে ডিম
ভাজার আয়োজন করে তুহিন। মেয়েটা একদম মায়ের আদল পেয়েছে। সেই দুধে আলতা রং সেই রেশমের মত সিল্কি চুল -----।
কোন রকমে ডিম ভেজে ঘেমে
নেয়ে ওঠে তুহিন। নে মা এতে চলবেতো ? মেয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। কোথায় ঘর কোথায় সংসার কোথায় রেশমী চুড়ি কোথায় তপ্ত রাতের খুনসুটি কোথায় শীত
রাতের রূপকথা? 'আমি ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়' নীলা গেয়ে ওঠে। তুহিন চমকে তাকায় মেয়ের
দিকে। নাঃ কিছু না বুঝেই
গাইছে মেয়েটা। গলা পেয়েছে ওর পিসীর। তিন বছর আগে ক্যানসারে
মারা গেছে ছোট বোন কাকলী। তার দু বছর আগে মা আর বাবাতো সেই কবে। তুহিন ভাবে আচ্ছা একটা
লিস্ট বানাইতো মৃত পরিজনদের। নাম লিখতে লিখতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বিকেলে ছোট মামা আসেন
বাসায়। বাবা আবার সংসারী হও। এভাবে হাত পুড়িয়ে আর কত
দিন রেঁধে খাবে? তুহিন এ কথা সে কথা বলে এড়িয়ে যায়। চার বছর ধরে কৃষ্ণা সেই
যে অ্যালবামে ঢুকেছে আর বের হয়নি। তুহিন কত রাত মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকেছে নাঃ কই সে!কোথাউ নেই।মৃত্যু মানে
এতটাই শেষ?এত চেঁছে মুছে শেষ? তবে রবীন্দ্রনাথ কেন
বলে 'আমার এ ঘর বহু যতন করে ধুতে হবে মুছতে হবে' মৃত মানুষটি আসবে বলে ?
নাঃ আবার ফিরে দাঁড়াতে
হবে। নীলা হোস্টেলে চলে যায়। নতুন মা রান্না ঘরে। কৃষ্ণার ছবি স্টোর
রুমের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে হাসে। কোন অভিযোগ নেই তার। নবনীতা পায়েস রেঁধে নিয়ে আসে। আকাশে চাঁদ। বারান্দায় বসে পায়েস খেতে খেতে চাঁদের দিকে তাকায় তুহিন।মনে হয় শাঁখা পড়া
একটা হাত তাকে ডাকছে।তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয় নবনীতার দিকে।শ্যামলা 'পাখিটি ছাড়ল কে' ? কে ছাড়লো ? কেই বা ছেড়ে দেয় এই
ভাবতে ভাবতে পঁয়তাল্লিশ বছর পার করে দিল তুহিন । দাড়ি কামাতে বড্ড আলসেমি তার । চুল আঁচড়ালো কি আঁচড়ালোনা কৃষ্ণা কে দেখা মাত্র সব
ভুলে দাঁড়িয়ে পড়ে ও । চারিদিকে থমথম করছে বিশাল ঘর আর দেয়ালে হাসছে কৃষ্ণা । 'তুমি কি কেবলি ছবি'? একটা প্রচণ্ড ধাক্কায়
ঘাতক ট্রাক ফাল্গুনের রোদেলা দুপুরে শেষ করে দিল সব। তুহিনের ঋষি ঋষি চেহারার মাঝে গভীর দুটো মুখে লাল
সিঁদুরের টিপ জ্বল জ্বল করছে।'কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম
ফোটে'। সংসার ঘর নতুন মোড়কে মুড়ে দিয়ে গেছেন বিধাতা পুরুষ
নীলার বিয়ে। সাজ সাজ রব। নবনীতার ছোটাছুটি কে
দেখে। তুহিন কদিন ধরেই
কৃষ্ণার কাছে নানা বিষয়ে মাফ চেয়ে নিচ্ছে মনেমনে। বিয়ে সুসম্পন্ন হল। কাঁদতে কাঁদতে নীলা রওনা হল শ্বশুর বাড়ি। রাত দুটোয় ফোন বেজে
উঠলো। নীলা নেই।গাড়ী খাদে পড়ে
বর বধূ সব শেষ।এখনও সকালে বাজারের থলি হাতে তুহিন বের হয়। একটা ফ্ল্যাট কেনা যায়
কিনা তাই ভাবছে দিনরাত।
বৃশ্চিক
সুমান আচার্য্য। তিরিশের কোঠায় ছুঁই
ছুঁই শরীরে এখনও প্রাক যৌবনের উদ্দামতা । সদ্য একটি প্রাইভেট কনসার্নের রিসেপসনিষ্ট। প্রত্যেকদিন সুবেশা গেস্ট
হ্যান্ডেল করে করে পাক্কা লেডি কিলার। ফুরফুরে মেজাজের মিষ্টতা গায়ে লেপ্টে থাকে
ততক্ষণই যতক্ষণ বাইরের গতিবিধি সচল । বাড়িতে আছেন রিটায়ার্ড জাজ্ অতীন্দ্র আচার্য্য। বাবা । সুমানকে শৈশব থেকে আজও আতঙ্কে রেখেছে
বাবার দুটো তীব্র চোখ । পারতপক্ষে বাবার মুখোমুখি
না হবার চেষ্টা যখন বিফল হতো, দাঁড়াতে হতো সামনে, তাঁর চোখে চোখ রাখতে কাঁপুনি দিতো । অবশ্য বাবা তেমন রাশভারী নন। শুধু বাবার চোখে তাকালে সুমানের মনে হতো চোখের
দৃষ্টিতে এমন কিছু আছে যা যে কোন মুহূর্তে অনুসন্ধানী বুলডোজারে ভেতরের যাবতীয়
গোপনীয়তা ভেঙ্গেচুরে উলঙ্গ করে দেবে ।
ভোরে উঠে অল্পবিস্তর ব্যায়াম রোজকার রুটিন। সুমানদের ছাদের পাশে দুটো বাড়ি পরেই আরো একটা পুরোনো ভাঙ্গা ছাদ । গত মাস তিনেক সুমানের মন বড্ড ঐ ছাদ টানে । দ্বিতল বাড়ির মালিক মধুসূদন পাত্র একজন মদ্যপ লম্পট সফল ব্যবসাদার । ব্যবসার কাজে মাঝে মধ্যেই বাড়ি থাকেন না। নিঃসন্তান স্ত্রী মাধবী রোজ সকালে ছাদে বাসি কাপড় কেচে ওখানেই স্নান সেরে তুলসী টবে প্রণাম করে নীচে নেমে যান । সুমান চোখে ভোগ করে অটুট নারী শরীরের উদ্দামতা । কতবার চোখে চোখ পড়েছে, মাধবী নির্বিকার । সে তাঁর রোজকার কাজ সেরে নেমে যায়, পিছনে ফেলে যায় এক কামুক পুরুষের চোখে ভাসা জলে লেপ্টে থাকা কাপড়ের পর্দায় টগবগে যৌবন ।
ভোরে উঠে অল্পবিস্তর ব্যায়াম রোজকার রুটিন। সুমানদের ছাদের পাশে দুটো বাড়ি পরেই আরো একটা পুরোনো ভাঙ্গা ছাদ । গত মাস তিনেক সুমানের মন বড্ড ঐ ছাদ টানে । দ্বিতল বাড়ির মালিক মধুসূদন পাত্র একজন মদ্যপ লম্পট সফল ব্যবসাদার । ব্যবসার কাজে মাঝে মধ্যেই বাড়ি থাকেন না। নিঃসন্তান স্ত্রী মাধবী রোজ সকালে ছাদে বাসি কাপড় কেচে ওখানেই স্নান সেরে তুলসী টবে প্রণাম করে নীচে নেমে যান । সুমান চোখে ভোগ করে অটুট নারী শরীরের উদ্দামতা । কতবার চোখে চোখ পড়েছে, মাধবী নির্বিকার । সে তাঁর রোজকার কাজ সেরে নেমে যায়, পিছনে ফেলে যায় এক কামুক পুরুষের চোখে ভাসা জলে লেপ্টে থাকা কাপড়ের পর্দায় টগবগে যৌবন ।
সেদিন সকাল থেকেই নিম্নচাপের ছোঁয়ায়
মেঘলা আকাশ, একটানা টিপটিপ
বৃষ্টির সারিগান । সুমান দেখেছে সকালেই
মধুসূদন ব্লেজার আনলো লন্ড্রী থেকে । আজ বেরোবে । দু'দিন ভোরে মাধবীকে দেখেনি । সুমান দ্রুত ভেবে নিলো । দরজায় টোকা, খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরের ভেতর সুমান । মাধবীর কপালে বিস্ময়ের বিরক্তি রেখা ।
-একি ! আপনি । কি দরকার এখানে ?
সুমান হাসিহাসি মুখ করে জানালো, বৌদি আলাপ করতে এলাম । আমি সুমান, আপনাদের বাড়ির...
- "জানি"..মাধবী থামিয়ে দেয়, “অতীন জেঠুর সাথে
আমার কথা হয় । তা আমাকে কি প্রয়োজন
আপনার ?
- অনেকদিন ধরেই
ভাবছি পাশেই থাকেন অথচ আলাপ নেই..তাই । আচ্ছা একটু জল খাওয়াবেন প্লিজ । মাধবী ভেতরে যেতেই দ্রুত ঘরের ছিটকানি
আটকায় সুমান । জলের গ্লাশ টেবিলে রেখেই
মাধবীর নজর, 'এ কি দরজা বন্ধ
কেন?' সুমান তক্ষুনি এগিয়ে এসে মাধবীকে জাপটে
ধরে টেনে হিঁচড়ে বিছানায় শুয়ে দিল । মাধবী দাঁতে দাঁত সজোরে পিছনে ঠেলতে সুমান আরো পাশবিক ক্ষমতায় মাধবীর
ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেললো। উন্মুক্ত স্তন লাফিয়ে বেরিয়ে আসতেই সুমান মুখ নামালো। কিন্তু
আচমকাই আবার স্থির হয়ে কবজি আলগা করলো মাধবীর হাতের উপর । সুমানের নজর মাধবীর বুকের উপর আটকে আছে।
মাধবী দেখলো তাঁর ডান স্তনের উপরে দুটি লালচে ফোলা ক্ষতের উপর সুমানের চোখ স্থির । সুমান বিড়বিড় করলো, 'এগুলো কি’? মাধবীও এবার নরম
হলো । -'পুরুষত্বের চিহ্ন। সিগারেটের ছ্যাঁকা । কেন, ভালো লাগছে না ! সুমানের শরীর বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত
কাটতে কাটতে নিচে নামছে । ধস্তাধস্তিতে ক্ষত দিয়ে
রক্ত গড়াচ্ছে । কয়েকটা মুহূর্ত । সুমানের মনে হচ্ছে গোল দুই ক্ষত ওখানে
নেই, সেগুলো তাঁর বাবার অগ্নিচোখ হয়ে গেছে।
সেই তীব্র রক্তাক্ত নজর সুমানের কপালে স্বেদবিন্দু ভরিয়ে দিচ্ছে ।
'থামলেন কেন ? লুটেপুটে নিন’ মাধবী সুমানকে টানলো । সুমান ঝট করে মাধবীকে ঠেলে দিয়ে উঠে
পড়লো। আবার চোখ টেনে নিচ্ছে লাল ক্ষত । আবার সেগুলো বাবার চোখ । যেন ভস্ম করছে সুমানের আপাদমস্তক । সুমান নেমে পড়লো । জামাটা গলিয়ে পকেট
থেকে পার্স বের করে কয়েকটা হাজার নোট বিছানায় ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে অনেক
কষ্টে অসাড় জিভে উচ্চারণ করলো..'ডাক্তার '। মাধবীর দুই চোখে এখন সমুদ্রের উদারতা ।
কুমির ও লাল ফ্রক
সকাল থেকেই থেকে থেকে মড়াকান্নার আওয়াজে বিরক্তি লাগছিল চেনা’র। দুদিন হল, কিছুটা বাধ্য হয়ে আসানসোল এসেছে
সে। গত পরশু ভোরবেলা মা ফোন করে মেজকাকার খবরটা জানাল; বলল, “পারলে একবার ঘুরে যা।” যাবার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু
মা-বাবার কথা ভেবে আর দীপ জোর করায়, তার এবারের আসা। তার আসা মানেই, তার চার বছরের
ছোট্ট গুড়িয়ার স্কুল কামাই হওয়া। অবশ্য, পড়ে তো মোটে ‘আপার কেজি’তে। মেয়েটা দীপের মতই সুন্দর দেখতে
হয়েছে—
টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, বড় বড় চোখ, এক মাথা কুচকুচে কালো ঝুপুস ঝাপুস চুল, সত্যি যেন পুতুল।
মা’র
ফোন অনুযায়ী, মেজকাকার নাকি এখন-তখন অবস্থা, শয্যাশায়ী; মারণরোগ ক্যান্সার নাকি
এবার শেষ বার সপাটে থাবা বসিয়েছে—
হয়ত এবার আর নিস্তার পাবে না...এই ছিল খবর। ভাবলেশহীন মুখে ভালোমানুষ দীপকে খবরটা
শোনানোমাত্র, সে তক্ষুনি যাবার ব্যবস্থা করে দিল। বলল, শুক্রবার অফিস ফেরত সেও
আসানসোল চলে আসবে; তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। গুড়িয়াকে নিয়ে তাই এবার এভাবেই হঠাৎ তার আসা।
এসে থেকেই বাড়ি ভর্তি গিজগিজে লোকজন। খুড়তুতো, পিসতুতো দাদা-দিদিরা, তাদের
ছেলেমেয়েরা, মোটামুটি সবাই হাজির। সেই ছোটবেলার একান্নবর্তী পরিবারটাকে আবার দেখতে
পাচ্ছিল চেনা। এখনও সবাই একই বাড়িতে, হাঁড়ি আলাদা, কোথায় যেন আত্মা গুলোও আলাদা
হয়ে গেছে। চাকরিসূত্রে বা বিবাহসূত্রে সব ভাইবোনেরাই বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, তবু
এতদিন পড়ে সবাইকে একসাথে পেয়ে আবার সেই ছোটবেলায় ফিরে যাবার ইচ্ছেটা পেয়ে বসছে। কোনরকমে মেজকাকার ঘরে রোজ দায়সারা একবার করে ঘুরে এসেছে সে।
লোকটার মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখেনি, গা
ঘিনঘিন করছিল ওর। মা বুঝতে পেরে আর বারেবারে ওঘরে যেতে বলেনি। শুধু গুড়িয়াকে
সারাক্ষণ চোখেচোখে রাখছিল মা। ওকে চেনাও চোখের আড়াল হতে দেবেনা কিছুতেই। চেনা
নিজেও যে ভুলতে পারে না আজও সেই দশ বছরের লাল ফ্রক পরা ভয় পাওয়া চেনাকে। দুপুরবেলা
নিঝুম বাড়ির ছাদে বসে কত ছবিই না আঁকত মেয়েটা। সেই সুযোগে রক্তের সম্পর্কও ভুলে
গিয়ে মানুষ বুঝি রাক্ষসে পরিণত হয়! সেই দুপুরে তার চীৎকার শুনে মা ছুটে না এলে হয়তো সেদিন
চরম ক্ষতি হয়ে যেত ওর; কিন্তু, ততক্ষণে বাইরের শরীরের সাথে তার শিশু মনটাও আতঙ্কে-লজ্জায়-ঘেন্নায় কুঁকড়ে গেছে। এরপর কতদিন চলে গেছে, মেজকাকা জামশেদপুর চলে
গেছে, চেনা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে সেদিনের কথা মা
কাউকে বলেনি, ওকেও বারণ করে দিয়েছে কাউকে বলতে। বলেনি ও, নিজেই নিজেকে ঘেন্না
করেছে। মা হয়তো বা বাবাকে বলেছিল, কিন্তু এ’নিয়ে আর কোনও কথা হল
না। এরপর কেটে গেল আরও প্রায় পনেরো বছর। দীপ এলো চেনা’র
জীবনে... গুড়িয়া এলো তারও প্রায় তিন বছর পরে। এতদিনেও এসব কথা কাউকে বলতে পারেনি
ও।
চোখে পড়ছে, বাগানে গুড়িয়া বাকি সব বাচ্চাদের সাথে খেলা করছে... সেই চেনা’র
নিজের ছোটবেলার কুমিরডাঙ্গা খেলা। সব আত্মীয়স্বজনরা লাল চোখ, লাল নাক নিয়ে ঘুরছে;
মনে হচ্ছে, সবার একসাথে সর্দি করেছে। কেউ কি এখন চেনা’র
ভেতরের খুব খুশি খুশি লাল ফ্রক পরা মেয়েটাকে দেখে ফেলবে
? “রাক্ষস মরে গেছে ! রাক্ষস মরে গেছে! চল না, একটু কুমিরডাঙ্গা খেলে আসি...”। সেই
রাক্ষস... আজ শেষ। সম্বিত ফিরল আবার সেই বীভৎস কান্নার রোলে...। লাল ফ্রক পরা
মেয়েটা হেঁটে চলল বাগানের বাচ্চাদের সাথে কুমিরডাঙ্গা খেলবে বলে।