প্রতিবেশি সাহিত্য : অসমিয়া গল্প
আলো / অরূপা বরুয়া
[অসমিয়া সাহিত্যে বর্তমান প্রজন্মের এক সংবেদনশীল
লেখিকা অরূপা বরুয়া । প্রবল জীবন বোধ ও
আধুনিক মনন তাঁর লেখায় মূর্ত । সমাজ ও মানুষের ভন্ডামি , আমাদের বিষন্ন জিজ্ঞাসা
অরূপার লেখাকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে । ]
আড়াই মাসের বাচ্চাটার গোলাপি রঙ যেন জমকালো মহিলার পাশে আরো বেশি উজ্বল হয়ে
জ্বলে উঠেছে । সিস্টার দেবিকা ওর কোলে বাচ্চাটাকে তুলে দেওয়াতে ওর মুখখানি এক
অনাবিল আনন্দে ভরে গিয়েছিল । এই মুহুর্তটাই সত্যি । হাহাকার, শূন্যতাহীন এক মুহুর্ত ।
মহিলার স্বামী ডাঃ বরার দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় সই করে একটু অনভ্যস্ত হাতে
বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল । এমন সন্তর্পনে তুলে নিল যেন মনে হয় খুব হালকা কাঁচের
জিনিস সে নিজের দুই বাহুর মাঝখানে নিয়ে নিল তার চারপাশে থাকা নার্স, ডাক্তার,
ওয়ার্ড বয় সকলে সশব্দে হেসে উঠল । লোকটির চেহারা দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ । হাস্পাতালের কাছেই তার চামড়ার জুতো সারাইয়ের নানান সাজ-সরঞ্জামের দোকান আছে । লম্বা সরু একটা ঘর । সেখানে একরাশ জিনিসের মধ্যে
সারাদিন বসে থাকে । দূর দেশ থেকে জিবীকার খোজে নিজের গ্রাম, আত্মীয়স্বজন, পরিচিত
পরিবেশের নিরাপত্তা – সবকিছু ছেড়ে একরকম উদবাস্তু মানুষ সে । রামনাথ তার মা বাবার
কাছ থেকে নিজের নামটার বাইরে আর কিছুই পায়নি । বহু কষ্টে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে
বর্তমানে স্থিতি পাওয়া রামনাথ, খালি পেটে কোন দোকানের বারান্দায় নেড়িকুকুরের সঙ্গি
হয়ে কত রাত কাটিয়েছে । বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলায় থাকা বাড়ির কথা মনে করে উথাল
পাথাল হয়েছে তার মন । কত রাত কাটিয়েছে এভাবে ।
‘ওর নাম কি রাখবে ? মায়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে কিছু একটা রাখতে হবে তো’, রাধা সিস্টারের
কথায় মুখ তুলে চাইলো রামনাথ । নিবিষ্ট হয়ে সে তার সন্তানকে দেখছিল । নামতো একটা
কিছু রাখতেই হবে । পুরো ব্যাপারটা রামনাথকে এমন উদ্বেলিত করেছে যে সে নাম রাখার মত
একটা অসাধারণ ব্যাপারও ভুলে গিয়েছে ।
-
রাখতে হবেই - আপনারটা বলুন, আমিও ভাববো ।
যেটা ভালো লাগে সেটা রাখব আরকি । বলে রামনাথ বোকার মত হাসলো । আশ্চর্যের কথা এই ছত্ত প্রাণীটি হঠাৎ তাদের জীবনকে নাড়া
দিয়ে দিল ।
রামনাথের মায়ের কথা মনে হ’ল । নাতির মুখ দেখার সদিচ্ছা নিয়ে চোখ বুজেছেন । বাচ্চাটাকে
দেখলে মা’র কত আনন্দ হ’ত । কথাটা ভেবে রামনাথের চোখ জলে ভরে উঠল ।
মা থাকতে রামনাথকে প্রতিবছরই বাড়ি যেতে হ’ত । স্ত্রী রুক্মিনী বিহারী হলেও জন্ম কর্ম সব অসমে । রামনাথের সঙ্গে বিয়ের পরই প্রথম বিহারে
গেছে । ওর মা বাবার কোন নিকট আত্মীয় বিহারের গ্রামে ছিলেননা বলে সেখানে যাওয়ার
প্রয়োজন হয়নি ।রুম্মিনীর ময়ূখে অসমিয়া ভাষা শুনলে তাকে হিন্দিভাষী বলে কেউ ভাববেনা
।
মায়ের মৃত্যুর পর দুবছর সে বাড়ি যায়নি । রামনাথের পরিবারের অন্যদের প্রতি রুক্মিনীর
কোন টান তৈরি হয়নি । তা্র কারণও আছে । বিয়ের আট বছর পরও রামনাথ নিঃসন্তান ছিল ।
রুক্মিনী তিনটি মৃত সন্তান প্রসব করে । রামনাথ অশিক্ষিত হলেও এ নিয়ে কোন কথা
শোনায়নি । স্বাভাবিক বিশ্বাস নিয়েই ঘটনাকে নিজের অদৃষ্ট ও দুর্ভাগ্য বলে মেনে
নিয়েছে । কিন্তু আত্মীয় স্বজনরা রুক্মিনীকে রেহাই দেয়নি – অলক্ষুণে অপবাদ জুটেছে ।
রামনাথকে ভালোবাসে বলেই যে তারা এরকম বলেছে তা নয় । এতে তারা এক ধরণের বিকৃত আনন্দ
পায় । তাকে নিয়ে ঠট্টা মস্করা করাতে রামনাথ আত্মীয় পরিজনদের থেকে দূরত্ব বাড়িয়েছে
। গত দুবছর তাই তারা আর গ্রামে যাওয়ার তাগিদ বোধ করেনি ।
আজ গোলাপ ফুলের মত এই বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মনে হচ্ছে এক্ষণি ছুটে গিয়ে
বিহারগামী কোন গাড়িতে চেপে বসে ।যেন মনে হচ্ছে বিকৃত হিংসায় নীল মুখের সামনে দিয়ে
গোলাপসুন্দরীকে কোলে করে সে ও রুক্মিনী দুজনে রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শনী করবে, এসো
, দেখো ! অনেক কথাইতো বলেছিলে ! রামনাথ না পেরে বাচ্চাটাকে এমন ভাবে চেপে ধরলো যে
বাচ্চাটা না কেঁদে পারলনা ।
সিস্টার রাধা বলল – “আমি এতদিন ভীষণ আদরে রেখেছিলাম ওকে, যত্ন নিও । একটু
ঠান্ডা পড়ছে । মাথায় তেল দিওনা, ঠান্ন্ডা লাগবে” । রাধার কথা শেষ হওয়ার আগেই
রঙ্গিলী বলল “ এ কিন্তু কিছুক্ষণ থেকে একবারও পেট ভরে খায়নি ঘন ঘন খায়, কিন্তু কম
খায় ।দেখবে যাতে ক্ষিদেতে কষ্ট না পায়” । আহ্লাদে আহ্লাদে দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে বলে
সে বাচ্চাটার গাল টিপে টিপে লাল করে দিল ।
ভীষণ যত্নে রেখেছিল গত দুমাস হাসপাতালের ডাক্তার নার্স সকলে । যেন ওর
দুর্ভাগ্য থেকে বাঁচাতে চাইছিল, ওর প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে পড়েছিল । বাচ্চাটা রুক্মিনীর
নয় । বাচ্চাটার মা ওর জন্মের পরই মারা যায় । বাড়ির কোন মানুষ আর খবর করতে আসেনি ।
এমনকি মৃতদেহ নেবার জন্যও কেউ আসেনি । কয়দিন মর্গে পড়ে থাকার পর হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ মিঊনিসিপালিটির হাতে মৃতদেহটি তুলে দেয় । নোংরা ফেলার গাড়িতে করে
মৃতদেহটি নিয়ে যাবার সময় ডিউটিতে থাকা সকলের মুখই আঁধার হয়ে যায় , চোখে জল এসে যায়
।
সবাই ভেবেছিল বাচ্চাটাকে নিতে কেউ না কেউ আসবে । কিন্তু আড়াইমাস কেটে গেলেও
কেউ আসেনি । ইতিমধ্যে ম্যালেরিয়ায় ভোগা
রুক্মিনী সব কথাই শুনতে পেয়েছিল । খাসিয়া সিস্টার ইন চার্জ হঠাৎই যেন রুক্মিনীর মনের কথা বলে ফেললেন
, “রুক্মিনী বাচ্চাটাকে তুমিই নিয়ে নাও , তোমারতো বাচ্চা-কাচ্চা নেই
। পূণ্য হবে ।
তোমার ভালো হবে , নিয়ে যাও”।
বৃষ্টির পরই আকাশ পরিস্কার হ’ল । বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে রুক্মিনীর সাথে
হাসপাতাল ত্যাগ করার সময় ডাঃ বরার সঙ্গে সকলে এসেছে তাদের বিদায় জানাতে । সবার মন
একই সঙ্গে হরষিত-বিষাদ গ্রস্ত ! কার পরিত্যক্ত সন্তানকে কে যে অমূল্য রতনের মত
বুকে আগলে নিয়ে যাচ্ছে ! এই দেশ কি বিচিত্র ! সত্য সেলুকাস !
বাচ্চাটির বাবার চেহারা এখনও মনে আছে ডাঃ বরার । সুন্দর চেহারার পেছনে এক পশু
যেন । মেয়েটিকে হাসপাতালে আনার সময় কাগজের মত সাদা ও দুর্বল ছিল ।বহু চেষ্টা করেও
বাঁচানো যায়নি । বয়স বেশি ছিলনা । পরপর তিন কন্যাসন্তান হয়ার জন্য হয়তো অনাদর
অবহেলায় স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল । পুত্রসন্তান হওয়ার আশায় তৃতীয়টি একবছর হওয়ার
আগেই আবার গর্ভবতী হয়ে পড়ে । বাচ্চার মায়ের অন্তিম সময়টি বড় মর্মান্তিক । বারবার স্বামীর খোঁজ করায় ডাঃ বরা বলে উঠেছিলেন –‘এরকম পাষন্ড মানুষও থাকে পৃথিবীতে ! যদি কখনও দেখা হয় ধরে প্রচণ্ড চড় মারব
। কি অমানুষ’ !
শিশুটি সবার আদরে আহ্লাদে চন্দ্রকলার মত দিনে দিনে বাড়ছিল । ডঃবরার মনে একটা
কথা ধীরে ধীরে আকার পাচ্ছিল । তার দাদা ইঙ্গিনীয়ার সীমান্ত বরা নিঃসন্তান । বিয়ের
প্রায় বারো বছ হল । স্ত্রী বন্দনা দুবারই রুক্মিনীর মত মৃত সন্তান জন্ম দিল । এখন
সকলেই ওদের নিয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছে ।
-নিজের যখন নেই, অন্যের সন্তান নিয়ে লাভ কী ? অন্যের সন্তান কখনো আপন হয়না । আমি
অন্তত পক্ষে বিশ্বাস করিনা । এসব বাদ দে দিগন্ত । বন্দনা ও আমি শান্তিতেই আছি ।
আমাদের কোন অশান্তি নেই ।
পরে আবার বোঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছিল ডাঃ দিগন্ত বরা । সে একটা কথা বুঝেছিল
যে সীমান্ত যেভাবে ভাবছে বন্দনা সেভাবে শান্তিতে নেই মোটেই ।সে উপলব্ধি করতে পারেনা,
বা ওর চোখে ধরা পড়েনি যে বন্দুনা আস্তে আস্তে শামুকের মত গুটিয়ে যাচ্ছে । এত নিবিড়
ভাবে কাছে থেকেও নারীর মনবেদনা বোঝার জন্য যে সংবেদনশীল মন দরকার সে মন সীমান্তর
নেই ।
আসলে ডাঃ বরা দাদার থেকেও বৌদির কথা বেশি ভেবেছিল । ভেবেছিল একটি শিশুই পারে
বৌদির জীবনে আনন্দের জোয়ার আনতে । সীমন্তর জাত্যাভিমান, বন্দনার পরিপূর্ণতার
সম্ভাবনার মূলে আঘাত করেছিল । বলার কিছু ছিলনা ।
গভীর বিষাদপূর্ণ মন নিয়ে ডাঃ দিগন্ত বরা ডিউটি রুমে ঢুকে গেল । একটা
সিজারিয়ান সেকসন আছে । কেসটা জটিল । অপারেশন করতেই হবে । কাল বিকেল থেকে ভদ্রমহিলা
বড়ো কষ্ট পাচ্ছেন । আগে দুটো ছেলে । ভদ্রমহিলার স্বামী নারাঙ্গীর পাথর কারখানায়
কাজ করে । কাল মজা করে ডা বরা জিজ্ঞেস করেছিলেন –
-
কী চাই বলুন , মেয়ে না ছেলে ?
এভাবে জিজ্ঞেস করার জন্য ভদ্রমহিলা অত্যন্ত লজ্জা পেলেন । একটু নীচু গলায়
বললেন “দুটো ছেলে আছে । এবার মেয়ে হলে ঘরে আমার লক্ষী এলো বলে ভাববো” । ঘর আমার
আলো হবে” ।
লেবার রুমে ঢুকে যাওয়ার আগে
কথাগুলো মনে করে ডাঃ বরার হাসি পেল । মানুষের বিচার, বিবেচনা ভালো-মন্দের ধারণা কত
বিচিত্র । অবাক লাগে । কেউ কন্যাসন্তান হয়েছে বলে নিজের পত্নীর মৃতদেহ পর্যন্ত
নিতে আসেনি ! কন্যাসন্তান বলে আত্মজকে পরিত্যাগ করতে পারে ! হয়তো মানুষ বলেই পারে
। এরা কী মানুষ । পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব ! নরাধম পশু ! পশুও তার সন্তানকে ভালোবাসে,
স্নেহ করে, রক্ষা করে । আর মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য সন্তানকে পরিত্যাগ করে । অথচ
লেবার রুমে যে চিৎকার করছে সেই মহিলার স্বামীতো কন্যাসন্তান চেয়েছেন তার ঘর আলো
করে রাখবে বলে ।
মহিলার চিৎকারে সন্বিত ফিরে
পেয়ে তড়িৎগতিতে ডাঃ বরা ঘরে ঢুকে গেলেন । ঘড়ির দিকে তাকালেন । তিনি দুটো পর্যন্ত
অপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন । চেয়েছিলেন স্বাভাবিক ভাবে সন্তান হোক । এখন সময় পেরিয়ে
যাওয়ায় আর অপেক্ষা করতে চাইলেন না । একরাশ আলোর জন্য কী ভয়ানক যন্ত্রণা পচ্ছেন
মহিলাটি । এই যন্ত্রণা সব নারীর । প্রতিটি মানুষ জন্মে একই যন্ত্রনার ইতিহাস । ডাঃ
বরা ভাবলেন পারব কি এই যন্ত্রণার পরিবর্তে একমুঠো সোনা-রোদ আলো এনে দিতে পৃথিবীতে
! গোলাপ ফুলের মত ছোট্ট কোমল শিশু । একঝাঁক আলোর রোশনাই । যা রামনাথ ও রুক্মিনীর
জীবনে বিদ্যুতের ঝলক এনেছিল তেমনি সোনালি আলোমাখা ভোর আনার উদ্যোগ নিলেন ডাঃ
দিগন্ত বরা ।
মানুষ জনের গল্প
সীমান্তের কাছের এক মফস্বল শহর ।
থানা শহরে যেরকম থাকে - একটা ছন্নছাড়া রেলস্টেশন ,
ঘেয়ো
কুকুরের ঘোরাঘুরি , ব্যস্ত বাস স্ট্যান্ডের পাশে চা
সিঙ্গাড়ার দোকান ,কয়েকটা টিনের বেড়ার আড়তের পরেই
একমাত্র সিনেমা হল । হলে শো শুরু হবার আগে দর্শক টানতে মাইকে গান বাজে - তুমি যে
ডাকাত , তুমি যে চোর / চুরি করেছো হৃদয় মোর
। কেবলমাত্র
আজানের সময়ে কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে । স্টেশনের দিকের রাস্তায় কিছুদূর এগুলেই
বড় বড় শিরিষের তোরণের পাশেই করাতকল ।করাতকলের লাগোয়া চায়ের দোকানটাই ইয়াসিনের
। দুপুরবেলা
ইয়াসিনের দোকানে রাতজাগা মানুষেরা আস্তে আস্তে অসময়ের ঘুম থেকে উঠে ভিড় জমায় ।
আজকের আড্ডাটা অনেকক্ষণ জ্বাল দেয়া দুধের মতোই ক্রমশ গাঢ় আর স্বাদু হয়ে উঠছে
।মমিনের বউয়ের লুজ ক্যারেকটারের গল্প (মমিন আড্ডায় অনুপস্হিত ) ,দেশে কেয়ামতের আলামতের নানাবিধ বিবরণ থেকে
আড্ডার বিষয়বস্তু এখন পুলিশ সংক্রান্ত নানা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনার দিকে
মোড় নিয়েছে । দেখা যাচ্ছে প্রায় সবারই একটা করে বলবার মতো দারুণ সত্য ঘটনা আছে ,আর একজন আরেকজনের আগে সেই গল্প বলার জন্য
প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছে । সম্মিলিত কোলাহলে আড্ডা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে
বেল্টু মিয়া আর বসে থাকতে পারেনা , ফ্যাঁসফেঁসে
গলায় চেঁচিয়ে ওঠে -‘ সুমুন্দির ছেইলেরা থাম , তুরা কি মানসির পয়দা ? একজন একজন কইরে কতি পারিসনে ?’
ধমকে
কাজ হয় । বেল্টু
মিয়াকে সমীহ না করে উপায় নেই - কষ্টিপাথরের মতো নিকষ কালো বিশাল
দেহ , ধবধবে সাদা বুকপকেটওয়ালা পাঞ্জাবীর
ফাঁক থেকে উঁকি দেয়া গোল্ডলিফের প্যাকেট আর পাঁচশো টাকার নোট তাকে একটা অন্যরকম
মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে ।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর ল্যাংড়া আজিবর
গলা খাকারি দ্যায় , মনে হয় কোন একটা কথা বলার জন্য সে
সাহস সঞ্চয় করছে । বেল্টু বলে ওঠে -‘ এই শালা
ন্যাংড়া তুই আগে ক’ ,তোরতো শালা অনেক অভিজ্ঞতা-পুলিশের
বাখারি খাইয়েই তো তুই ন্যাংড়া হয়ছিস’ !
আজিবর
বলে ওঠে -‘সিডা সত্যি কতা , কিন্তু আমরা যারা বর্ডারের এদিক ওদিক ঘুইরে
পেট চালাই তাগের সগলেরই মাঝেমদ্যি কচন খাতি হয় ! এখেনে কিডা
আছে বুকি হাতদিয়ে কতি পারে একবারো পুলিশির ঠাপ খায়নি ?’
আবারো নীরবতা নেমে আসলে ,বেল্টু
মিয়াই নীরবতা ভেঙে নরম স্বরে বলে - ‘কদিনি ,এ্যাতো তত্ত্ব কতা বাদ দিয়ে ।’
আজিবর নেভী সিগারেটে একটা জোর টান
দিয়ে বলে -‘একবার সাইকেলের টিউবের মদ্যি
ফেনসিডিল আনতিছিলাম ।বর্ডার পার হতিই এ্যাক শালা হাবিলদার ধইরে বইসলো - মনে হয়
আমাগের মদ্যিই কোনো বাইনচোত খবর দিয়িলো !অবশ্যো হাবিলদারডা খুব ভালো ,আমারে কিছু না কইয়ে সুজা এসপি সাহেবের
কাছে নিয়ে গেলো । আমারে পরথম লাথিটা মাইরেলো স্বয়ং এসপি সাহেব , কোন কনেস্টবাল আমার গায় হাত দ্যায়নি ! বারবার এসপি সাহেবের কথা উল্লেখ করতে করতে
একধরনের অহংকারের ভাব ফুটে উঠছিলো আজিবরের ভাঙা চোয়ালে আর ঘোলাটে বাল্বের মতো
চোখে ।
আজিবরের গল্প শেষ হতেই টেকো শমসের
বলতে শুরু করলো তার দেখা এ্যাক সত্যি ঘটনা । এ্কবার নাকি
সে ট্রেনে করে কালিগঞ্জ থেকে খুলনা যাচ্ছিলো ,পথে শুরু হ’ল চেকিং । মেয়েছেলেদেরও
গায়ে হাত দিয়ে চেক করছিলো জি আর পি ।এমন সময় একজন যুবতী মেয়ে পুলিশকে বলে উঠলো
-‘দ্যাকো বাবা , তুমার সুমান একটা ছেইলে আমারও আছে পুলিশ
ডিপারমেনে -গায় হাত দিবানা !’
পুলিশটি হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে -‘তোমার এই বয়সে আমার মতো ছেইলে ?’
যুবতীটি উত্তর দেয় -‘ সিডা অবশ্যি
আমার বিয়ের আগের ছেইলে , আর শুনিছি বিয়ের আগের ছেইলে ছাড়া
তোমাগের ডিপারমেনে ন্যায়না !’
ঠা ঠা হাসিতে
ফেটে পড়ে ইয়াসিনের দোকান । বেল্টু মিয়া একটা গোল্ডলিফ এগিয়ে দেয় টেকো শমসেরের
দিকে ।
রুদ্রাক্ষ
ছোট্ট গ্রাম, নাম তার হরিনারায়ানপুর । কৃষি প্রধান গ্রাম , অর্থনৈতিক সচ্ছলতা
নেই বললেই হয় । যে বছর ভাল বৃষ্টি হয় ফসল ভাল , নাহলে কপালে হাত । ফি বছর বন্যা তে গ্রাম প্লাবিত
হয় আর ফসল হানিহয় । গ্রামে কুঁড়ে ঘরই বেশি । যারা গ্রাম ছেডে সহরে চলে গিয়েছে
তারা প্রায় গ্রামের মুখ দেখেনা বললেই চলে ।দুর্গা পুজর সময় আসে , কদিন থেকে চলে যায় । এমনই এক গ্রামের বাসিন্দা কুঞ্জ বিহারি প্রধান । তার এক মাত্রছেলের নাম রুদ্রাক্ষ প্রধান । ডাক নাম রুদ্র । শিব রাত্রীর দিন রুদ্রাক্ষ র জন্ম তাই নাম ‘রুদ্রাক্ষ’ । ছেলেটা ধীর স্থীর মিষ্ট স্বাভাবের । কুঞ্জ আর তার স্ত্রী , লক্ষ্মী দুঃখে কষ্টে দিন কাটাত । রুদ্রাক্ষ গ্রামের স্কুলে ক্লাস
থ্রী তে পডত । পড়াশুনায় ভালো । মাস্টার মশাই রুদ্রাক্ষ কে খুব স্নেহ করতেন।
একদিন গ্রামেতে লোকের ভিড । অনেক গাডি তার সঙ্গে কিছু নেতা , গ্রামের মোডল নিশিকান্ত চৌধুরী । বাবুদের দেখে গ্রামের ছেলে ছোকরা, বুড বুডি সকলেইএকজোট হল। নিশিকান্ত বাবু বললেন, এই গ্রামের সুদিন
এল । আপনাদের আর দুঃখকষ্ট
থাকবে না । আপনারা এবার গাডি ঘোঁড়া চোডে বাবুদের মত থাকবেন । এখানে বাঁধ হবে । সরকার আপনাদের জন্য এখানে
বাঁধ করলে কৃষির উন্নতি সাধন এরসঙ্গে অর্থনৈতিক সাচ্ছলতা আসবে । ৭২৬ পরিবারকে যাদের জমি নেওয়া হবে, পুনর্বাসন দেওয়া হবে । তাদের জন্য সরকার
আলাদা বসতি নির্মাণ করবেন । স্কুলের এক শিক্ষক পঞ্চানন প্রধান বিরধিতার সুর আরম্ভ করে বললেন,সরকার আগে বিস্থাপিতদের জন্য নতুন বসতি,রাস্তা,স্কুল,ডাক্তারখানা,পানীয় জলের
ব্যাবস্থা এবং বিদ্যুৎ সংযোগ করুন তারপর আমরা এই
বিষয়ে সম্মতি জানাবো । নিশিকান্ত চৌধুরী খেঁপে লাল। শিক্ষক মহাশয় বিনম্রতার
সঙ্গে বললেন আপনারা এই গরীব গ্রামবাসীদের জমি নিয়ে নেবেন আর তার বিনিময়ে যা যা
ঘোষণা করছেন তার ... বিধায়ক মাহাশয় নিশিকান্ত কে থামিয়ে বসতে বললেন । তার পর শুরু করলেন ‘আমি এখানে কারুর পেটের দানা ছিনিয়ে নিতে আসিনি বরং কিছু দেওয়ার
প্রতিশ্রুতি দিতে এসেছি । আপনারা ধৈর্য্য ধরে শুনুন সমস্ত বিষয়টা, তারপর আপনাদের কথা শুনব। গ্রামে আর
কি কি হবে সে সব প্রতিশ্রুতিও দিলেন বিধায়ক মশাই । এর মধ্যে কিছু লোক চেঁচা মিচি শুরু করে দেয়
নিশিকান্ত সরকারী দালাল আমরা এ ভিটে মাটি ছাডবোনা। আমাদের বাপ দাদার ভিটে
মাটি ছেডে কোথাও যাবনা’ । ছেলেদের চিৎকারের সঙ্গে অন্যরাও সুর মেলাল । বিধায়ক মহাশয় যত বোঝালেও কেউ রাজি হলনা কি চিৎকার থামল না । অগত্যা সরকারি বাবুদের নিয়ে সবাই ফিরে গেলেন । পরদিন পুলিশ এসে পঞ্চানন বাবুকে ধরে গেল । প্রথমে পঞ্চানন বাবু ওয়ারেন্ট দেখতে চান কিন্তু পুলিশ কিছু না দেখিয়েই ধরে
নিয়ে যায় তাঁকে । সবাই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থেকে যে যার ঘরে চলে গেল । রুদ্রাক্ষ সব দেখে নির্বাক । বয়স অল্প হলেও তার মনে প্রতিবাদের
বহ্নিশিখা জ্বলতে থাকে , বুঝল যা হচ্ছে সেটা অন্যায় । পেছনথেকে পুলিশ এর জীপ কে লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ে রুদ্রে । বাড়ি
ফিরে বাবাকে বলাতে, বাবা গুম হয়ে
বসে থাকেন, মা কিছু বললে বিরক্ত হন । আকাশ পানেচেয়ে কিছু বিড় বিড় করেন।
এর পরের ঘটনা - গ্রামেতে ক্যাম্প বসে । তাহসিলদার, আর আই,আমিন চেন নিয়ে মাপ জোক আরম্ভ করে দেয় । পল্লিসভা হল, কিন্তু নিশিকান্তবাবুর
গুণ্ডাদের ভয়ে টুঁ শব্দটি করেনা কেউ। হঠাৎ কুঞ্জ বাডি থেকে একটা কাটারি নিয়ে নিশিকান্তর দিকে দৌডয়
রাগে গজরাতে গজরাতে, বলেন ‘তোর চোদ্দ পুরুষের বাপের জমিদারী যে আমাদের জমি নিতে
এসেছিস’ । সবাই রে রে করে তাকে আটকায় । তহসিলদার কাগজে সই করতে বলেন, কুঞ্জ কাগজটা কুচিকুচি করে
ছিড়ে ফেলে বলে ‘অমন টাকা আমরা চাই না’ । পরের
দিন পুলিশ এসে কুঞ্জকেও নিয়ে গেল কোন ওয়ারেন্ট ছাড়াই । কুঞ্জর
নিজের জন্যে চিন্তা হয়না । তার বউ ছেলের
যদি কোন ক্ষতি হয় তারচেয়ে মৄত্যু ভাল । হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে কুঞ্জ । নিশিকান্ত
আর বিধায়ক ভগবান চৌধুরী,কুঞ্জ
কে বল্লেন , ‘দেখ কুঞ্জ আমরা তোমাকে ইচ্ছে করলেই জেল হাজতে পাঠাতে পারি কিন্তু তাতে
কি লাভ তোমার বউ ছেলে না খেয়ে মারা যাবে
। তুই কি তাই চাস ?”
কুঞ্জ হাউ হাউ করে কেঁদে বলে, ‘না
বাবু ওরকমটি করবেন না ! আমি আপনারা যা
চাইবেন তাই করব’ । দারোগা বাবু বল্লেন , ‘বাবুদের
অশেষ দয়া তা নাহলে তোর নামে ৪
টে দফা লাগিয়ে তোকে জেলে ভরতাম বুঝলি ?
বিধায়ক মশাই নিজে এসেছেন তোকে ছাড়াতে আর তুই কিনা কাটারি নিয়ে গিয়ে ছিলিশ মারতে’ ?
বিধায়ক দারোগাকে থামিয়ে বলেন ‘আমি যে জন্য এসেছি সেটা করুন’ ।
এই সময় বাইরে লক্ষীর গলার আওয়াজ এল। কুঞ্জর বৌ লক্ষী
গজরাতে গজরাতে ভেতরে ঢূকলো ‘আ মরণ , পোড়ার মুখোরা , বলি আমার সোয়ামী ছাড়া গেরামে
কি আর লোক ছিলনা যে মিনসে তাকে ধরে নিয়ে এলি’ ? ‘দেখছিস কুঞ্জ তোর বউ এর চোপা’ ! দারোগা বাবু বলে উঠলেন
। লক্ষীকে বলে ‘এই কে তোকে থানাতে আসতে বলেছে ? যা এক্ষুনি । নাহলে এক্ষুনি তোকেও
লক আপ এ ভর্তি করে দেব’ । লক্ষী কাঁদতে থাকে । বিধায়ক সান্তনা দেন ‘আমরা এখানে কুঞ্জ কে ছাডাতে এসেছি । আপনি ঘরে যান, সব ঠিক হয়ে যাবে’ । কুঞ্জ ভাবে – সেতো ঘরে ফিরবে, কিন্তু মাষ্টার মশাই ? কে জানে এরা
কি করবে । লক্ষীর ওপরও রাগ হয় কুঞ্জর ,মেয়েমানুষ হয়ে ও থানায় এলো কেন ?
কুঞ্জ
বাড়ি ফিরল, তার পরদিন মাষ্টার মশাইও ফিরে
এলেন । মাষ্টার মশাইয়ের এখানে কেউ থাকেন না, উনি একাই এই গ্রামে প্রায় বছর দশেক
আছেন । তিনি নিজে ছাত্রদের শিখিয়েছেন অন্যায়কে সহ্য করা এবং অন্যায় করা দুটোই অপরাধ । অন্যায়কে প্রতিবাদ কর হিংসা দিয়ে নয় যুক্তি
দিয়ে । কুঞ্জ যেটা করল সেটা ভূল । সে
ভূলের মাসুল তাকে দিতে হল।
কুঞ্জ
অবাক হয় তার বাপ দাদার আমলের জমি নিধিরাম এর নামে কি করে ? কি
করে হয় আমিন জানালো ‘তোর ভাইকে গিয়ে জিজ্ঞেশ কর সব বুঝে যাবি । তুই যখন জেলে ছিলি, ও তখন কাগজে সই
করে দিয়েছে । কুঞ্জর মাথায় বজ্রাঘাত হলো যেন ! কুঞ্জ
বিশ্বাস করতে পারলোনা । গ্রাম থেকে কিছু দূরে একটা টেলিফোন বুথ আছে সেখানে কুঞ্জ সাইকেলে যায় টেলিফোন করতে । রাত প্রায় দশটা,
কুঞ্জ নম্বর মিলিয়ে ডায়াল করল । অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপার থেকে নিতাইএর কন্ঠ
স্বর ভেসে এল। হ্যালো । কুঞ্জ উৎসাহেরসঙ্গে বললো ‘হ্যাঁরে তুই ভাল
আছিস নিতাই ?
-
হ্যাঁ কেন ?
-
না মানে আমি বলছিলাম কি তুই আমাদের জমির কোন কাগজে সই
করেছিলি কি?
কুঞ্জ আর নিজেকে সামলাতে পারলনা
।
হাউ হাউ করে
কাঁদতে লাগলো । ফোনটা হাত থেকে পডে গেল । বাডিতে ফিরে এলো । যে কিটনাশক কিনে
এনেছিল পোকা মারার জন্য সেটা সকলের অজান্তে গলায় ঢেলে দিলো রাত্তিরে । কুঞ্জ বমি
করতে করতে নেত্যে পড়ে, লক্ষী সর্বনাশের আঁচ পেয়ে ডুকরে কেদে ওঠে । এ গ্রামে
ডাক্তার নেই আছে এক কম্পাউন্ডার, সে এসে
দেখেন মুখ থেকে গেঁজা বেরুচ্ছে, বুঝতে পারে শেষ হয়ে গেছে , বলে ‘এটাতো সুইসাইড কেস
। পুলিস কে খবর দিতে হবে’ । লক্ষীর বুক ফাটা কান্নাইয় ভোরের আকাশ তখ ভারি
হয়ে গেছে ।
রুদ্রাক্ষ সব দেখছিল শুনছিল কিছুই মুখ
থেকে শব্দ না করে গুম হয়ে বসে ছিল । হঠাৎ তার বাবা যে কাটারটা দিয়ে নিশিকান্ত কে তাডা করেছিল সেটা
নিয়ে দৌড়তে লাগলো । সবাই কে মেরে ফেলব । আমার বাবাকে আমায় ফিরিয়ে দাও নাহলে সকলকে
মেরে ফেলব । রুদ্রাক্ষ কোথায় গেল কেউ জানেনা । নিশিকান্তদের নাগাল সে
কোনদিন পাবে কি না তাও কেউ জানে না। শুধু পঞ্চানন মাষ্টার মনে মনে বলে ‘দৌড়ক , রুদ্রাক্ষ
দৌড় লাগাক , তবে যদি... ।
পঞ্চানন রুদ্রাক্ষকে খুজতে
বেরোলেন । তাকে বুঝিয়ে ঘরে নিয়ে এলেন , অভয় দিলেন ‘আমিতো আছি রুদ্র , ঘরে চল, মার
কাছে যাও, অনেক কাজ তোমাকে করতে হবে’ । রুদ্রর ভেতরের আগুনটা পঞ্চানন চিনতে
রুদ্রকে নিয়ে পঞ্চানন কুঞ্জর বাড়ি ফিরলেন , ওখানে জড়ো হওয়া মানুষজন মনে
বল পেল । পঞ্চানন কুঞ্জর নিথর দেহ ছুয়ে তাদের শপথ নিতে বললেন ‘আর কোন কুঞ্জকে যেন
আত্মহত্যা করতে না হয়,আর কোন কুঞ্জর জমিতে যেন শকুনের নজর পড়তে না পারে’ ।
পরদিন দৈনিক সংবাদ পত্রে একটা ছোট খবর
বেরোল ‘হরিনারায়ণপুর গ্রামে এক কৃষকের আত্মহত্যা’ এই শিরোনামে ।
বিরহী বাঁশিতে সুহাসী ফুঁ
আজ অবেলার সূর্যটা যাবে যাবে করেও কেন জানি
যাচ্ছে না,
বারংবার উঁকি
দিচ্ছে জানলার কাঁচে। বিকেলের সোনারোদ যা মিষ্টি, কতদিন তাকে ছোঁয়া হয় না । সেই কবে তাকে ছুঁয়েছিলাম বেভুল বনে গেলো, আর আনমনা ভালো লাগা আমার করিডোরে হেঁটে
বেড়াতো অলস সময়ে। ল্যাপটপটা অন ছিল, হঠাৎ শুনলাম ফেইসবুক ম্যাসেজের শব্দ। কিরে পাগলী আমার, কি করিস? মিশু একি সঙ্গে পড়ে, খালি ক্ষ্যাপায়। সেই কলেজ লাইফ থেকে এখন
অবধি,
ইউনিভার্সিটি
শেষের পথে,
পিছু যেন
ছাড়বে না । অবশ্যই সে না থাকলে এতদিন হয়তো এইভাবে বেঁচে থাকা যেতো না।কত আড্ডা , ঘুরা , খাওয়া,
মাস্তির কোন
শেষ রাখি নি । যখন রাইয়ানের সঙ্গে বিয়ে হল- তারপর খানিক নিরুদ্দেশ । এখন আবার পাইছে আমারে । অবশ্যই
এই রকম একজন ভালো বন্ধু প্রতিটা মানুষের জীবনে শতভাগ দরকার। নাহলে জীবন কি তা
উপলব্ধি করা অনেক মুশকিল ।
আজ কেন জানি মনের গোপন কুঠরিতে কার জন্য
চিনচিনে ব্যাথা শুরু হল । কেমন আনমনা খারাপ লাগা চেপে বসলো হৃদের
বারান্দায়। ইউনিভার্সিটির বড় ভাই হিসেবে রাইয়ানের সঙ্গে পরিচয়। তারপর দেখা, নাম্বার আদান প্রদান, ফোনে কথা, দেখা করা এবং চুটিয়ে প্রেম করা। পরে বাবা- মা’র অসম্মতিতে বিয়ে। এরপরে অবশ্যই সবই ঠিক
হয়েছিল,
বাবা মেনে
নেয়ার পরে জামাই হিসেবে স্বীকৃতিও পায়। সেই দু’বছর আগে যাকে ছাড়া একবিন্দু কল্পনা করা দুরুহ ছিল, তাকে ছাড়া আজ ছটা মাস কিকরে যে কাটল টের
পাওয়াটাই মুশকিল । প্রেমের প্রথম দিকে কি রোমান্স- সারাদিন রিকশা ভ্রমণ, ঘোরা, খাওয়া, এবং ছেড়ে যাওয়ার বেদনা সবই এখন অতীত। ফুচকা ছিল আমার খুব প্রিয় খাবার, বের হলেই ফুচকা আমার চাইই- চাই । আবার ফুচকার
সাথে বেশি কাচা লংকা না হলেও চলত না, একদিন ফুচকা আমি মরিচ একটু বেশি খেতে পছন্দ
করতাম।কিন্তু সে জানত যে আমি অসুস্থ আর ডাক্তার আমায় মরিচ কম খেতে বলেছে। তাই
রাইয়ান আমাকে মরিচ খেতে বারণ করত , আসলে ও আমার অনেক খেয়াল করতো, প্রতিটি কাজে যে আমায় কত সাহায্য করতো তার কোন ইয়ত্তা নেই।
প্রেমে পড়ার পর
প্রতিটা কাজে সে আমায় খবর রাখত। একদিন খুব ভোরে রাইয়ান ফোন করে , অবশ্যই এতো সকাল সে ফোন করে না । আমি চোখে ঘুম নিয়ে ফোন ধরি । প্রাচী, জানো, কাল রাতে তোমায় নিয়ে সারাদিন ঘুরেছি
স্বপ্নে। শহরের এপার ওপার সব দৌড়েছি, তারপর দুপুরে লাঞ্চ করে বাসায় ফিরি। এবং সব শেষে তোমায় একটা..... না থাক
দেখা হলে বলব। জান, ঐ স্বপ্নের
পর থেকে আর ভালো লাগছে না। আচ্ছা শোন, আজ একটু শীঘ্র বের হবে । আমি ঠিক ১০.৩০ এ ইউনিভার্সিটির সামনে এসে তোমায়
কল দেব, তারপর আজ সারাদিন আমি এবং শুধু তুমি। আর শোন আসার সময় লাল ফতুয়া আর জিন্স,
কানে বড় দুল হাতে কাঠের চুড়ি ও বড় একটা কালো টিপ পরে আসবে । ও.কে এখন রাখছি এলে সব কথা হবে। ফোনের লাইন
কাটার পর আমি ভাবলাম, রাইয়ান আমাকে
অনেকবার বলেছে তাকে একটা কিস করতে, আমার জানি কিন্তু কেন জানি ওসব ব্যাপারে মন আগায় না। মাঝে মাঝে করতে
ইচ্ছে হয়,
কিন্তু আবার
কেন জানি অন্য এক ভাবনায় দূরে চলে আসি। আর আমার হাবাগোবা প্রেমিকটাও একবারের জন্যও
জোর করে কিস করে না। আরে ও কি বোঝেনা যে মেয়েদের ‘বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না’। হাঁদারাম, এক্কেবারে
গালি দিতে ইচ্ছে করে, আমার কি সব
বলে কয়ে দিতে হবে। ফোনের মধ্যে কত্ত মুরুব্বী মার্কা কথা, আমার সামনে আসলে যেন কিছুই বোঝে না।
ঠিক ১০.৩০ হতেই এসে
হাজির আমার মহারাজা! ও আবার সময় সম্পর্কে অনেক সচেতন। সেইদিন রাইয়ান জিন্স, টি-শার্ট ও গলায় একটা মালা এবং হাতে চেইনের
বড় ঘড়ি পরেছে। আর একটা খয়েরি গ্লাস । মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটিকে আমি ভালবেসেছি। আমি যে এরকম
একটা রাজপুত্রের সাথে প্রেম করি তা কিন্তু আগে জানা ছিল না। এই ভেবে নিজে একটু
গর্ববোধ করলাম। সময়ের করিডোরে কত কিছুই পালটায়, শুধু পালটায় না আমাদের ভালোবাসা, আবেগ সবই ... রাইয়ান রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি কিছুক্ষণ দেখলাম আমার আপন পৃথিবীর দিকে, রাইয়ান বলল- এই ওঠ না , দেরী হচ্ছে তো ? আজ সারাদিন
ঘুরবো। আমি আবার আড্ডাবাজিতে, ঘুরাঘুরিতে অনেক চটপট। আমি উঠে বসলাম, রিকশা চলছে ।
চলেছে মনের অনেক কথন, রাইয়ান আবার
মাঝে মাঝে দু’চার লাইন বলে কি সব ছাইপাঁশ-
শিখণ্ডী শরীরে, আবেগি অম্বরে
স্রোতস্বিনী তরঙ্গ বাজায় মাদল।
বিটপী সমীরণ, অধরা রঙ্গন,
পোড়ায় কুহরমাঠ ফাটা আদল।
আমি হাত তালি দিলাম, ঘুরতে ঘুরতে আমাদের অনেক কিছুই খাওয়া হল। রিকশা ওয়ালাও আমাদের সাথে খেল, রাইয়ান দু’টা আইসক্রিম নিল । ওর একটা বদভ্যাস কিছুতে পাল্টানো গেলো না, আজো তার ব্যাতিক্রম হল না, খেতে খেতে আমার নাক কে আইসক্রিম না খাওয়ালে
মহারাজার ভাত হজম হয় না। রাইয়ান বলল মহারাণী আমার, এবার একটু রাজার হাতটা ধরো তো? আমি বললাম , না মহারাজ এই
পাবলিক যায়গায় হাতটা ধরতে না পারার জন্য খুবই দুঃখিত। হঠাৎ আকাশেরও দেখি কেমন জানি
মন খারাপ হল,
গুড়ুম গুড়ুম
শব্দে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটু পর তার কেরামতি আমাদের সামনে সামিল
করবে। যেই কথা সেই কাজ, শুরু হল অঝোর বরিষণ। রিক্সার ঝাঁপি যেন বেসু্রে ড্রাম
বাজাচ্ছে। শুনতেও খারাপ লাগছে না , একটু রোম্যান্টিক ভাব লাগছে। আর মনটা কেমন জানি আবেগী হল , ইচ্ছে করছে রাইয়ানের গালে আলতো একটা চুমু
দেই। কিন্তু সাহসে হচ্ছে না। আর বেয়াদবটাও নিজ থেকেও দিতে পারছে না। বৃষ্টিও যেন
থামছে না,
এমন ভিজা
ভিজলাম মনে হচ্ছে এই মাত্র পুকুর থেকে ডুব দিয়ে আসলাম। রাইয়ান কেমন জানি আমার দিকে
অপলক চেয়ে রইল,
জিজ্ঞেস
করলাম ‘কি দেখ অমন করে’ ? বললো ‘কেন তোমায় দেখি , আমার পাশে যে আর কেউ নেই দেখার । শুদ্ধতার মাতমে তোমার চেহেরায় কি অনাবিল
পেলব ভাব,
আহারে! চোখে
নেশা শরীরে আবেগী জিনিসগুলো মাত্রা বেড়েছে দিগুণ। আমার আবেগি পেয়ারির আবেগ গুলো
যেন এখনি ঝরে পড়বে’।
-শোনো রাইয়ান
এখন ফাজলামির সময় নয়।
-ও কে আমার
আদুরে ডল,
বুঝলাম, এখন ফাজলামি করা চলবে না। চুপ রাইয়ান এখন
চুপ,
কোন কথা হবে
না। অবলিলায় বলে রাইয়ান।
বৃষ্টি থেমে
গেলো,
বৃষ্টির পর
মেঘেদের ফাঁকে সূর্য কথা বলছে, অমনি আমার কবি সাহেব বলে উঠলেন-
শুভ্র বিকেলে মেঘেদের আনাগোনা,
আনমনা রোদ ক্ষণে দেয় হানা ।
মলিন ভাঁজে হৃদপুরের চিক্কুর,
অগোছালো সময় বড়ই নিষ্ঠুর।।
এক পশলা বৃষ্টির পরে
সূর্যের এমন হাসি দেখে নিজেরই ভালো লাগছে, রাইয়ান পকেট থেকে রুমাল বের করে আমার মাথা মুছে দিল। আমি কেমন জানি আনমনা
ভালো লাগা অনুভব করলাম। আমি বুঝতে পারছি না, পুরুষের স্পর্শ এতো কি মধুর? এটাই কি প্রেম নাকি ভালোবাসা নাকি দেহের চাহিদা বুঝতে পারছি না। শুধু
এইটুকু বুঝলাম রাইয়ান আমাকে অনেক ভালবাসে।
রাইয়ান বলে ‘প্রাচী
একটু নামতো’?
-কেন?
-বুথে যাব, টাকা নাই?
-তো তুমি যাও, আমার যাওয়ার প্রয়োজন কি। আমি রিকশায় বসি
তুমি গিয়ে টাকা নিয়ে আস?
-বেশি কথা
বললে এক্কেবারে ভালো লাগেনা, কালরাতের স্বপ্ন এখনও শেষ হয় নি যে? নামো তাড়াতাড়ি নামো?
আমিও নেমে বুথে ঢুকলাম, রাইয়ান মানিব্যাগ থেকে কার্ড বের করে আমায় দিল, আর বলল এটা দাও। আমিও কথা মত দিলাম, রাইয়ান আমার পিছনে ছিল- কার্ড দেওয়ার পর
মেশিন বলল- প্লিজ টাইপ দা পাসওয়ার্ড। তখন রাইয়ান আমাকে জড়িয়ে ধরা স্টাইলে আমার ডান
হাত চেপে কী বোর্ড টিপলো, আর আমি অনুভব করলাম অনেক ক্ষুধার্ত একটা ঠোঁট আমার ঠোঁটে
আলতো ছুঁয়ে আছে। আনমনা আবেগী ভালোবাসা আমার চারপাশ ঘিরে ধরল।নিদারুণ এক ভালোলাগায়
জর্জরিত আহত পাখির মত দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো। আমার অবোধ বালকটি
এতো সাহস পেল কি করে তা ভেবে?
-প্রাচী চল, রিকশা দাঁড়িয়ে আছে?
-কেন, তুমি টাকা নেবে না?
-আরে কি যে বল
তুমি,
সেই কখন যে
টাকা নিলাম।
-তুমি আবার
কখন টাকা নিলে ?
-কি বলে আমার
মহারাণী,
এইযে ঠোঁটে
আলতো দুটো ঠোঁট পড়লো তাতেই আমার টাকা নেওয়া শেষ হল।
-যা,
টাকার সাথে
আমার তুলনা,
তাই না ? আর তুমি এমনিতেই একটু বেশি কর।
-আচ্ছা করি , চল এবার ।ঃ
সে দিনের প্রথম কোন
পুরুষের সুহাসী চুম্বন আজো নাড়ায়। আর এই অবোধ নরাধমটি আমায় ফেলে এতোদিন কেমন আছে
কে জানে?
সামান্য
ভুলের জন্য ৬ মাস পার হল। ওই দিন এমন ঝগড়াটা না করলে কি চলত না। আমার ফেইসবুক খোলা
ছিল,
এক অপরিচিত বন্ধু,
যার সাথে ফেইসবুকেই আমার ভালো আলাপ, এমন কি আমার আদ্যোপান্ত সে জানে, আর আমিও তার আদ্যোপান্ত সব জানি। সেই দিন
রাইয়ান আমার পাশে বসা ছিল, হঠাৎ ম্যাসেজের শব্দ শুনেই দু’জনেই তাকালাম। অ্যাই লাভ ইউ জানু। আমার চোখ কপালে উঠলো। কি সাহস, রাইয়ানের সামনে আমি আর কিছুই বলতে পারলাম
না। এই নিয়ে অনেক ঝগড়া হল। তারপর দু’ জনেই এমন উত্তেজিত হলাম, রাইয়ান আমাকে ফেলে বের হয়ে গেলো। আমিও কাপড় চোপড় নিয়ে বাবার বাসায় উঠলাম , মামলা খতম।
এখন মনে হচ্ছে এমন করাটা
আসলেই উচিৎ হয় নি। একটু ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে দিলে রাইয়ান বুঝত। আর এই ৬ মাস কেউ
কাউকে একটা ফোন পর্যন্ত করে নি, এমনকি এসএমএস ও না। আজ মনটা খুবই খারাপ, রাইয়ান কে ভেবে আরও খারাপ হল, আমি যে আর পারছি না। হাতে মোবাইল নিয়ে এস এম এস লিখলাম- ‘খুবই ভালো আছ না, আমাকে একা ফেলে’ ?
সঙ্গে সঙে
রাইয়ানের এসএমএস।
-হ্যাঁ , খুবই ভালো আছি।
আমি আবার
লিখলাম-
‘কম্প্রোমাইজ ইস এ স্টলিং বিটউইন টু ফুল’স এন্ড সরি , এগেইন সরি’।
-আবার সঙ্গে
সঙ্গে রাইয়ান উত্তর দিল- ‘আমি আসছি, তোমায় নিতে। আধ ঘণ্টা পর’ ।
আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল বইছে, আর ভাবলাম এবং বুঝলাম ভালোবাসার প্রধান শর্ত হল খানিকটা আপোষ আর খানিকটা
পারস্পরিক বোঝাপড়া ।