গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৫ জুলাই, ২০১৮

৭ম বর্ষ ১৫তম সংখ্যা ২৬ জুলাই ২০১৮

এই সংখ্যার লেখকসূচি : তাপসকিরণ রায়, বিজয়া দেব, সুধাংশু চক্রবর্তী, প্রদীপকুমার ঘটক, গৌতম সেন, রত্না ঘোষ, পার্থ রায়, মনোজিৎকুমার দাস ও সেমিমা হাকিম ।

          লেখকের নামে ক্লিক করুন

তাপসকিরণ রায়

হ্যান্টেড কাহিনী- ২৭

রেসকোর্স ময়দানে উইলিয়াম ও তার সাদা ঘোড়া, প্রাইড

শশী বাবু আবার সক্রিয় হলেন। হাওড়া ব্রীজের ভৌতিক ঘটনার অনুসন্ধানের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। বিপত্নীক শশী বাবুর হাতে অফুরান সময়। সংসারে একলা মাত্র লোক। আলাদা ভাবে কোন নেশা বা পেশা তার নেই। এক অলস দুপুরে তিনি ল্যাপটপ দেখতে দেখতে উ টিউবে খুঁজে পেলেন রেসকোর্স ময়দানের এক অলৌকিক ঘটনার কথা। ঘটনার বিবৃতিতে পাওয়া যাচ্ছে এমনি এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ
ঘোড় প্রতিযোগিতায় মুখরিত থাকে ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব খ্যাত রেসকোর্স ময়দানটি। দিনের আলোয় তেমন সমস্যা থাকে না রাতে এখানে ঘটে যায় অলৌকিক সব ঘটনা। কে বা কারা যেন ঘোড়া নিয়ে ছুটে বেড়ান এখানে। স্পষ্ট দেখতে পাওয়া ঘোড়া নিমিষেই বাতাসে মিলিয়ে যায়।
আজও নাকি গভীর রাতে ব্রিটিশ জর্জ উইলিয়াম তার বিখ্যাত সাদা ঘোড়া প্রাইডকে নিয়ে ময়দান চষিয়ে বেড়ান। প্রচুর রেস আর ট্রফি জেতায়, প্রাইডকে তখনকার সময় এক নামেই কলকাতার অনেকেই চিনত। উইলিয়াম ঘোড়াটিকে নিজের প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন।...একদিন সকালে জর্জ দেখেন,খোলা ট্রাকের ওপরে মরে পড়ে আছে তার প্রিয় সাদা ঘোড়াটি।
প্রাইডের শোক আর মায়ায় জর্জও বেশিদিন পৃথিবীতে ছিলেন না। কিন্তু এখনো প্রত্যেক শনিবার পূর্ণিমার রাতে দেখা যায় জর্জ ও প্রাইডকে। রেসকোর্স জুড়ে সে বীরবিক্রমে পরিক্রমা করে। প্রাইড এখনো জীবিত রেসকোর্স ময়দানে, এমনকি কলকাতাবাসী তাকে উইলিয়াম সাহেবের সাদা ঘোড়া হিসেবেই এখনও চেনে।  
এরপর শশী বাবুর মনে প্রশ্ন জাগে, রেসকোর্স ময়দানে তবে কবে পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে ? হাতের কাছে তাঁর পঞ্জিকা নেই যে দেখে নেবেন, আগামী শনিবারে কোন দিন পূর্ণিমা পড়েছে বলে। মোবাইল খুলে গুগলের সার্চ অপশনে লিখে ব্যাপারটা তিনি জানবার চেষ্টা করলেন। একটু সময় ব্যয় হলেও তিনি জানতে পারলেন যে এ মাসের সাতাশ তারিখ এমনি একটা দিন পড়েছে। সে দিন সন্ধ্যের আগে থেকেই পূর্ণিমা লাগছে। তার মানে সে দিন সারা রাতই পূর্ণিমা থাকবে।
আঙুল গুণে দেখলেন শশী আজ দুতারিখ। তার মানে আরও চব্বিশটা দিন হাতে আছে। তবে বন্ধুদের তিনি আজই জানিয়ে রাখতে চাইলেন। প্রথমে তিনি বন্ধু জনান্তিককে ফোন লাগালেন--এক জায়গায় যেতে হবে
জনান্তিক বললেন--কবে ? আজকে নয় তো ?
শশী বললেন, না, আজ নয়দিন চব্বিশ পরেমানে এ মাসের সাতাশ তারিখ।
--আবার সেই ভূতের পেছনে ছুটতে হবে ?
--এবারও আমরা রাত করে যাব--
--কোথায় যাবো আর কত রাতে যেতে হবে?
--রাত এগারটার পরএবার আমরা যাবো এক নির্জন জাগায়। রেসকোর্সের ময়দানে--অত রাতে আমরা তিন বন্ধু ছাড়া আর কেউ বোধহয় থাকব না 
--ওরে বাবা--তার মানে আরও বেশী রোমাঞ্চকর ব্যাপার বল্ ?
--‘মনে তো হচ্ছে তাইতা হলে এখন রাখছি রে !
শশী বাবু অর্ণবকে ফোন করতে গিয়েও করলেন না। সে এখন বাইরে আছে,ব্যাঙ্গালোরে গেছে। তবে ওই সাতাশ তারিখে এখানে থাকবে, এ পর্যন্ত শশী বাবু জানেন।  
জনান্তিক বাবুর আর ধৈর্য ধরছিল না। তিনি জানেন অর্ণব ব্যাঙ্গালোরে আছে। তবু তিনি ফোন লাগিয়ে দিলেন--প্রণব কেমন আছিস ? কবে পর্যন্ত আসছিস ? আমরা কিন্তু আবার প্রোগ্রাম করছি। শশীর ফোন এসেছে, এ মাসের সাতাশ তারিখে আমরা যাব রেসকোর্স ময়দানে। সেই মাঝরাতেই আমারা যাব। যেমনটা হয়েছিল হাওড়া ব্রিজ ঘুরে আসতে গিয়ে, জনান্তিক ঝর ঝর করে সবকিছু বলে গেলেন।
অর্ণবের আপত্তির কোন কারণই ছিল না। এ ভাবেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল সমস্ত প্রোগ্রাম। ওরা মাঝরাতে যাবে রেসকোর্স ময়দানে, সেখানেই ওরা দেখতে চায় উইলিয়াম ও তাঁর ঘোড়া প্রাইডকে। চাঁদনী রাতের অলৌকিকতার মাঝে আজও ওরা কেমন দৌড়ে বেড়ায় রেসকোর্স ময়দানে !
দেখতে দেখতে সেই ঈপ্সিত দিন, মানে সাতাশ তারিখ চলে এলো। তিন বন্ধু আজ রাতেই যাবেন রেসকোর্স ময়দানে। সময় থাকবে সেই গভীর রাত।
এক অদ্ভুত ধরনের রোমাঞ্চ তিন বন্ধু অনুভব করছিলেন। সময় যেন আর কাটতে চাচ্ছে না কখন সন্ধ্যে হবে, কখন রাত হবে, কখন বাজবে রাত এগারটা। রাত এগারটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা শশী বাবুর  কারে বেরিয়ে পড়লেন রেসকোর্স ময়দানের দিকে। ব্যাপারটা ভাবতে গেলেই ওঁদের মনের মাঝে কেমন যেন একটা লৌকিক-পারলৌকিক ভাবনা জড়িয়ে যাচ্ছিল। ওঁরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলেন রেসকোর্স ময়দানের পাশে। এই মুহূর্তে নির্জনতার মাঝে কলকাতার মত রমরমা নগর যেন ঝিমিয়ে পড়ে আছে ! মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি বড় রাস্তা দিয়ে পাস করে যাচ্ছে। রাস্তায় একটাও পায়ে হাঁটা লোক নেই। শব্দ-কোলাহলের শহর কলকাতা নগরী এখন যেন শব্দহীন, নির্জনতায় ঘিরে আছে।
ওই সামনেই রেসকোর্স ময়দান--ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব খ্যাত রেসকোর্স ময়দান।মাথার উপর শনিবারের পূর্ণিমার পূর্ণচাঁদ দেখা যাচ্ছে। আকাশে সামান্য কালো মেঘের ছিটেফোঁটা এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। তাই বুঝি কখনও চমৎকারী জ্যোৎস্নালোক মাঠের মাঝে ঠিকরে পড়ছে ! আবার কখনও আলো হয়ে যাচ্ছে,ম্লান,  মৃতপ্রায়। সামনের বিস্তৃত ঘোড়দৌড় ময়দান যেন নিদ্রাচ্ছন্ন  হয়ে শুয়ে আছে।তিন বন্ধু রোমাঞ্চিত হয়ে অপেক্ষা করছেন, কখন তারা সেই অলৌকিক ভৌতিক দৃশ্য নিজেদের চোখের সামনে দেখতে পাবেন।
শশী বাবু হাতের কব্জি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে নিলেন। রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট।তিনি ফিসফিসিয়ে বন্ধুদের বললেন, হ্যাঁ সময় এসে গেছে, দেখা যাক এবার সেই ঘটনাগুলো আমাদের চোখের সামনে ঘটে কিনা !
বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছেন। আরও ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেল। ওঁদের মনে উঠে আসছিল নানা সন্দেহ জনক প্রশ্ন--তবে কি কিছুই নেই ? এর সবটাই গুজব ?সবটাই রটনা ? এক ধরনের মানুষ আছে যাদের খেয়ে দেয়ে কোন কাজ থাকে না।তারা এই ধরনের বিবৃতি দেয়। বিনা কারণে মানুষকে উৎকণ্ঠিত করে। তবে হ্যাঁ,কখনও কখনও আবার সত্যতাও এর মধ্যে নিহিত থাকে বৈ কি ! এই যে গতবার ওঁরা হাওড়া ব্রিজ ঘুরে এলেন--সেখানকার অলৌকিক ঘটনা সত্যিই তো লৌকিক ছিল না ! তবে হতে পারে, এখানেও হয়ত হঠাৎই শুরু হয়ে যাবে অলৌকিক ঘটনার দৃশ্যপট।
ব্রিটিশ জর্জ উইলিয়াম ছুটে বেড়াবেন রেসকোর্স ময়দান ধরে। তাঁর প্রিয় সাদা ঘোড়া প্রাইডের পেছনে পেছনে। পূর্ণিমা রাতের এক অলৌকিকতা নেমে আসবে এই  বিস্তৃত ময়দানে যার সাক্ষী থাকবেন শশী, জনান্তিক আর অর্ণব। অর্ণব একটু ধৈর্য হারা হয়ে শশী বাবুকে বলে উঠলেন, কই বস, এখনও তো কোন কিছুই আভাস পাওয়া যাচ্ছে    না ? ঠিক এমনি সময় হঠাৎই বন্ধুরা দূর থেকে হ্রেষা ধ্বনি শুনতে পেলো। সে সঙ্গে ওঁরা শুনতে পেলো একটা ঘোড়া যেন উন্মত্ত হয়ে ছুটে চলেছে ময়দানের মাঝখান দিয়ে। তার খুরের শব্দ ভেসে আসছে। ওঁরা স্থির দৃষ্টি নিয়ে ময়দানের দিকে তাকিয়ে আছে। শশী বাবু চাপাস্বরে ফিসফিসিয়ে উঠলেন,ওই, ওই যে, সাদা ঘোড়া, ওই বুঝি প্রাইড। আর সঙ্গের মনুষ্য আকৃতির দীর্ঘ ছায়া উইলিয়াম হবে !
এক অলৌকিকতা নেমে এলো রেসকোর্স ময়দানের চাঁদনী রাতের নিচে। ঘোড়া ছুটে চলেছে, দুর্বার তার গতি। হাওয়ার সঙ্গে যেন ওরা বারবার দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান হচ্ছে।
রয়েল ব্রিটিশ পরিবারের জর্জ উইলসন ছিলেন নামকরা এক ঘোড়সওয়ার। প্রাইড তাঁর প্রিয় সাদা ঘোড়া। প্রাইড ও উইলসনের মধ্যে ছিল এক নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক। প্রাইডের হঠাৎ মৃত্যু হল। উইলিয়াম একদিন সকালবেলা উঠে দেখলেন,এক খোলা ট্রাকের ওপর তাঁর প্রিয় প্রাইড মরে পড়ে রয়েছে। উইলিয়াম দুঃখে ও শোকে মানসিক আঘাতে আর বেশী দিন বাঁচেননি। আর ওদের মৃত্যুর পর থেকেই নাকি প্রতি শনিবারের পূর্ণিমা রাতে প্রাইড ও উইলিয়াম ছুটে বেড়ায় রেসকোর্স ময়দান ধরে।
হঠাৎই অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন শশী বাবু। তিনি ময়দান ধরে ছুটতে লাগলেন। প্রাইড ও উইলিয়ামকে লক্ষ্য করে।
--কি হল ? কি হল ? বন্ধুরা চিন্তাভাবনা করার আগেই ওঁরা দেখতে পেলেন, শশী বাবু রেসকোর্স মাঠ ধরে উন্মাদের মতো ছুটে চলেছেন। জনান্তিক, অর্ণব ওঁরা দিশাহারা হয়ে ধীরে ধীরে শশী বাবুর দিকে ছুটতে লাগলেন। জনান্তিক ভীত চকিত গলায় বলতে লাগলেন, যাস না--যাস না ওখানে শশী ! কে কার কথা শোনে ?উন্মত্তের মতো ছুটে চলেছেন শশী। বন্ধুরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওঁরা এবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এক জাগায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। এই চাঁদনী রাতে ওঁরা যেন নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলেছেন। বাস্তব-অবাস্তব সব কিছু যেন একাকার হয়ে গেছে।
রেসকোর্স ময়দানের মাঝখান দিয়ে ছুটে যাচ্ছে উইলিয়ামের ছায়া। আর আগে আগে তাঁর সাদা ঘোড়া প্রাইড। ঘোড়ার খুরের শব্দ আর হ্রেষা ধ্বনি বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, স্পষ্ট-অস্পষ্ট আওয়াজ অস্তিত্বকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে কোন নিরুদ্দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে...
দুই বন্ধু রেসকোর্স ময়দানের বাইরে এক জায়গায় জড়সড় হয়ে বসেছিলেন। বন্ধুকে না নিয়ে তারা তো ফিরে যেতে পারেন না। যখন ভোর হবে, আলো ফুটে উঠবে, তারপরেই ওঁরা তার বন্ধু শশীর খোঁজ নিতে পারবেন।
এক সময় ভোরের আলো ফুটে উঠল। দুই বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে রেসকোর্স ময়দানের দিকে এগিয়ে গেলেন। ময়দানের এপাশ থেকে ওপাশ সব কিছু অস্পষ্ট,যেন কুয়াশায় ঢাকা। জনান্তিক ও অর্ণব চারদিকে তাকিয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকলেন। ভৌতিক ঘটনা অনেক তাঁরা দেখেছেন। অনেকে ভীষণ ভয় পেয়ে মারা যান কিন্তু তাঁর মৃতদেহ সব ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। অলৌকিকতা থেকে বা কোন ভৌতিক ঘটনা ঘটে যাবার পরও মানুষের মরদেহ কিন্তু ঠিক খুঁজে পাওয়া যায়। এ ভাবে কারও অস্তিত্ব কখনও মিলিয়ে যেতে পারে না।  বন্ধুরা চারদিকে নজর রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলেন। ওঁদের চোখে পড়ল, রেসকোর্স ময়দানে ইতিমধ্যে কিছু লোক প্রাতঃভ্রমণে এসেছে পড়েছেন। মনে হচ্ছে, তাদের অস্তিত্ব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। হঠাৎ এক জায়গায় কয়েক জন লোক চিৎকার চেঁচামেচি করে উঠলো। কি হল ? কিছু একটা তো ঘটেছে। অর্ণব আর জনান্তিক এগিয়ে গেল সে দিকে। তাঁদের কেন যেন মনে হল--হয়ত শশীকে ওরা ওখানে পড়ে থাকতে দেখেছে। বন্ধুরা ছুটে গিয়ে হাজির হলেন সেখানে। হ্যাঁ, ঠিক তাই,ওঁরা শশীকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখলেন। ওঁদের বন্ধু শশী তবে কি মরে গেল ? একটা লোক তার নাকের কাছে হাত রাখল, তার বুকের কাছে কান রাখল,তারপর বলল, না, লোকটা মরে নি এখনও।
জনান্তিক ও অর্ণব একসঙ্গে, শশী, বলে চিৎকার করে উঠলো। তড়িঘড়ি করে বন্ধুরা শশীকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করলেন। ঘন্টাখানেক পরেই সেখানে শশীর জ্ঞান ফিরল। তিনি ফ্যালফেলিয়ে এদিক ওদিক তাকালেন। বন্ধুদের দেখে তিনি একটু স্থির হয়ে তাকালেন। তার মানে বন্ধুদের তিনি হয়ত চিনতে পেরেছেন। এবার শশী বাবু কিছু একটা বলতে চাইছেন কিন্তু মুখ ফুটে শব্দ বের হচ্ছিল না তাঁর। তার মানে শশী বাবুর আরও বিশ্রামের প্রয়োজন।  
তারপর সুস্থ হয়ে শশী বাবু যা বলেছিলেন তা ঠিক এই রকম
আমি যেন নিজের মধ্যে ছিলাম না রে ! ছুটে গেলাম এই ঘোড়া ও তার মালিকের ধারে। আমার পাশ কেটে ওরা দ্রুত একবার বেরিয়ে গেল। আমি চিৎকার করে বললাম, হু, হু আর ইউ ? হাওয়ায় মিলিয়ে গেল আমার কথাগুলি, তারপর দেখলাম মুহূর্ত পরেই আবার ঘুরে ওরা আসছে। আমি আবার চিৎকার করলাম হু,হু আর ইউ, টেল মি--এবার হঠাৎ উইলসন ও তাঁর ঘোড়া দাঁড়িয়ে গেল। দেখলাম দীর্ঘাকৃতি এক ছায়া, পরক্ষণেই ইংরেজ বেশধারী এক চেহারা আমার সামনে ফুটে উঠল। আর সে তার তর্জনী তুলে আমায় কঠোর ভাবে বলে উঠলো, আই এম উইলিয়াম এন্ড মাই ফেভারিট হর্স, প্রাইড। বাট ইউ, হু আর ইউ টু কোশ্চেন ?এরপর আর কিছু আমি বলতে পারব না। আমি কখন, কি ভাবে জ্ঞান হারালাম তাও আমার জানা নেই।
                                                    
  


সুধাংশু চক্রবর্ত্তী / দুটি গল্প

হিরোইনের লাশ

মৃত কিশোরীর ক্ষতবিক্ষত লাশটা তুলে এনে শোয়ানো হয় মর্গের টেবিলে । পাওয়া গিয়েছে রেললাইনের ধারে জলাভূমিতে । মুখ থুবড়ে পড়েছিলো বেআবরু অবস্থায় । ঠিক বেআবরু নয় । গায়ের দামী জামাটা এমন ভাবে ছিঁড়ে ফালাফালা করা হয়েছে যে ঐ শরীরে আব্রু বলে কিছুই আর অবশেষ নেই । পরণের শালোয়ার কোমর থেকে নেমে এসেছে একেবারে হাঁটুর নিচে । মৃত কিশোরীটিকে সেই অবস্থায় তুলে এনে শোয়ানো হয় মর্গের টেবিলে । পুলিশ , ক্যামেরাম্যান এবং মর্গের গুটিকতক কর্মচারি ঘিরে আছে ওর লাশ । ক্যামেরাম্যান লাগাতার ক্যামেরার সাটার টিপে চলেছে, ক্লিক্‌ ক্লিক্‌ ক্লিক্‌ । সেইসঙ্গে ঝিলিক দিয়ে উঠছে ফ্ল্যাশলাইটের তীব্র আলো ।
  
ফ্ল্যাশ লাইটের আলো এসে চোখে পড়তেই কিশোরীর লাশটা বেদম চমকে ওঠে । হায় রে, আজ আবার মরতে হবে ! গত রাত্রে সিনেমাওয়ালা বাবুরা যে এমন করেই ওর ছবি তুলেছিলেন । ওই বাড়ির বাবু বলেছিলেন ওকে নাকি সিনেমার হিরোইন করে দেবেন । গিন্নীমা সেই শুনে নিজের হাতে ওকে সাজিয়েগুছিয়ে পাঠিয়েছিলেন বাবুর সঙ্গে । তারপর......

পরক্ষণে লাশটা লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে চোখদুটো বুজে নেয় । গত রাত্রে হোটেলের ঘরে ওকে নগ্ন করে ছবি তোলার পর লোকগুলো ওর সঙ্গে কুকর্ম করতে যেতে ও প্রবলভাবে বাধা দিয়েছিলো বলেই না আজ এতগুলো মানুষের সামনে ওকে আবার বেআবরু হতে হচ্ছে !

কিশোরীর লাশটা লজ্জায় চোখ বুজে পড়ে থাকে মর্গের টেবিলে । গত রাতে যা যা ঘটেছিলো তারপর এদের আর বাধা দিতে ইচ্ছে করছে না ওর । বাধা দেবার ইচ্ছেটাই যে মরে গিয়েছে ওর মন থেকে ।


অতীতের ছায়াছবি

ষাট বছরের বৃদ্ধ কমলাকান্ত আজও নিয়ম করে খাতা নিয়ে কবিতা লিখতে বসেন । সেই কোন ছেলেবেলা থেকে কবি হবার ইচ্ছে পুষে রেখেছেন মনে । সেই ইচ্ছে পূর্ণতা পায়নি বলে আজও হাল ছাড়েননি । তবে একটা ব্যাপারে খুবই ভাবনায় পড়েছেন তিনি ।  আজকাল অনেক কথাই মনে রাখতে পারছেন না । এমনকি একটু আগে যা যা ভেবেছেন অনেকসময়ে সেসবও ভুলে যান মুহূর্তের মধ্যে । এই যেমন, খানিক আগে হয়তো লিখতে বসেছিলেন হঠাৎ করে মনে উদয় হওয়া একটা কবিতার দুটো লাইন , “পাখিসব করে রব / বিছানা ছাড়ো ভাইসব কিন্তু লেখার সময় লিখে বসছেন পাখি সব করে রব / ছুঁড়ে দাও গম যব

আজকাল এমন অনেক ভুলই করে বসছেন তিনি । এমনকি নিজে ছেলে সুমন্তকেও প্রতিবেশী বন্ধু বলে ভ্রম করে বসেন কখনো সখনো । এই নিয়ে বাপের আড়ালে খুবই রাগ ফলায় সুমন্ত । মাঝেমধ্যে বাপকেও দুটো কথা শুনিয়ে দেয় রাগের বশে । বৃদ্ধ কমলাকান্ত ছেলের অকথা-কুকথাও মনে রাখতে পারেন না ।

আজ সকালে পুরোনো আসবাবপত্রে ঠাঁসা ঘরে কি একটা বস্তু খুঁজতে ঢুকেছিলো সুমন্ত । খুঁজতে খুঁজতে হাতে পেয়ে যায় বাবার অনেক কাল আগেকার একটা ভাঙা ঝর্ণাকলম । ও শুনেছে বাবা নাকি এক সময় এই কলম দিয়ে প্রচুর কবিতা লিখেছেন এবং কোনো একদিন রাগ করে নিজেই আছড়ে ভেঙেছেন এই কলম । ঝর্ণাকলমটা কবে থেকে যেন আশ্রয় পেয়েছে এই আবর্জনার স্তুপে । যাইহোক সুমন্ত ভাঙা ঝর্ণাকলমটা এনে বাবাকে দেখিয়ে শুধোয় এই ঝর্ণাকলমটা চিনতে পারছো বাবা ?

কমলাকান্ত কবিতার খাতা খুলে বসেছিলেন । এখনো কলমের আঁচড় কাটতে পারেননি খাতার সাতা পাতায় । ছেলের কথায় মুখ তুলে চেয়ে একগাল হেসে বলেন আসুন আসুন দীপকবাবু । অনেক দিন পর মনে পড়লো আমাকে ? বসুন বসুন, দুটো কথা বলি আপনার সঙ্গে ।
 ধূস্‌, আমি দীপককাকু নই । আমি সুমন্ত । এই নাও তোমার ভাঙ্গা ঝর্ণাকলম । খুঁজে পেলাম ভাঙাচোরার ভিতর থেকে । সুমন্তর গলায় একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে
 ওহো, অত সুন্দর ঝর্ণাকলমটা ভেঙ্গে ফেলেছো তুমি ? তোমাদের হাতে কি সংসারের কিছুই আর আস্ত থাকবে না বাপ ? কমলাকান্ত ছেলেকে চিনতে পেরে রাগ ফলাতে কসুর করেন না ।

সুমন্ত একপ্রকার জোর করে ঝর্ণাকলমটা বাবার হাতে গুঁজে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় রাগে পা দাপাতে দাপাতে । ঝর্ণাকলমটা হাতে নেবার পরই বৃদ্ধ কমলাকান্তর চোখের সামনে ঝুলে থাকা অদৃশ্য পরদায় ভেসে ওঠে অনেক কাল আগেকার একটা দিনের টুকরো টুকরো কিছু ছবি । ঝর্ণাকলম ছুঁড়ে ফেললেন ......সাদা খাতা বক হয়ে ........
নিবভাঙা ঝর্ণাকলম হাতে নিয়ে চোখের সামনে ঝুলন্ত অদৃশ্য পরদায় বৃদ্ধ কমলাকান্ত দেখে চলেছেন একটার পর একটা ছবি । সেদিনের মতো আজও সাদা খাতার পাতায় একটা আঁচড় কাটতে পারলেন না তিনি ।


বিজয়া দেব

তুলো ও লাজবন্তী

নতুন বাড়ি । মণিমালা দেখছিল চারদিকে খোলা মাঠ , তবে রাতের বেলা , আবছা আঁধার রয়েছে , তাই সবকিছু ঠিক ঠাহর করা  যাচ্ছিল না ।
অভিমন্যু বলল -এই আমাদের বাড়ি । জানি না , তোমার পছন্দ হবে কি না ।
তারা বসে আছে একটা বলেরো গাড়িতে , বেশ দ্রুত চলছে গাড়ি , আশপাশে উঁচুনিচু খোলা জায়গা , হঠাৎ এক একটা বাড়ি , কেমন যেন গা ছমছমে চারদিক ।
আজই বিয়ে করেছে তারা । মণিমালা ও অভিমন্যু । কথাটা বলতে অদ্ভুত শোনালেও বিয়ের আগে এই বাড়ীটা এসে দেখেনি মণিমালা । বলেরো এসে থামল বাড়ির পাশে । বেশ সুন্দর বাড়ি । নতুন রঙ করা হয়েছে । ইলেকট্রিক আলো তেমন ধারালো নয় । বাড়িটা এই আলোতেই দিব্যি ঝকমক করছে । সোমনাথ , ঝিমলি , সুরজ , চৈতালি ওরা আগে থেকেই এসে ঘরদোর সাজিয়ে ফেলেছে । অভিমন্যুর বাবা মা নেই , মণিমালার সাথে একই অফিসে চাকুরিতে আছে । আর মণিমালার বাবা মা এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না । তাদের পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়েতে মণি রাজি হয়নি । সে নিজের মত করে বিয়েটা করেই ফেলেছে । তবে আগামিকাল তারা এসে আশীর্বাদ করে যাবেন , বলেছেন শেষ পর্যন্ত । অভিমন্যু ও মণির সহকর্মীরাই সব সময় পাশে থেকে বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক সাঙ্গ করেছে ।
বাড়িটা কেমন যেন । এমন একটা জায়গায় কেন অভিমন্যু বাড়ি করল ভেবে পায় না মণিমালা । এখান থেকে অফিস খানিকটা কাছে । শুধু এইটুকুই যা সুবিধে । কথাটা আজ বলবে মণি অভিমন্যুকে । তাদের বিয়ের সোজাসাপ্টা আয়োজন চুকে গেছে । মণির মা বাবা এসেছিলেন ।
দুজনেই  নাক সিঁটকে বললেন - শেষকালে তোর কপালে এই ছিল ! এখানে ভাল থাকবি ? এখানে ভাল থাকতে হলে হাতে জাদুকাঠি থাকা চাই । কি বলিস ?
কিছু বলেনি মণি । কথাটা ফেলে দেবার নয় । চারদিক ধু ধু করছে । উঁচুনিচু ঢালাও খোলা জমি ।  খানিকটা কৌণিক দূরত্বে টিনের চালার একটি ছোটো বাড়ি । কিছু ছোটো ছেলেমেয়ে খেলাধুলো করে বিকেলের দিকটায় । সেই সময়টাতে জায়গাটাকে কিছু প্রানবন্ত  মনে হয় ।
অভিমন্যুকে কিছু বলতে হয়নি , নিজের থেকেই বলল - তোমার বাড়িটা পছন্দ হয়নি , তাই না ? আমি ভেবেছিলাম নিরিবিলিতে দুজনে থাকবো কপোতকপোতী যথা...... তারপর কি ছিল মণি , বাকিটা তুমি বলো ।
মণির খুব অদ্ভুত লাগে । কিছু বলে না ।
সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর ডোরবেল বাজলো । দরজা খুলতেই পনেরোষোলো বছরের একটি মেয়ে , কোলে একটি ছোট্ট বেড়ালছানা । কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটি বলে , আমার নাম লাজবন্তী । ঔ বাড়িত্ থাকি । বিলাই রাখবায় নি ?
মণি থমকে যায় । মেয়েটির মায়াভরা দুটি চোখ , কোলে সাদাকালো ছোট্ট বেড়ালছানা । মণি কি বলবে ঠিক ভেবে পায় না ।
লোকটি জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ।
বর্ষা রেগে বলল - আপনার জন্যে এমন হয়েছে । যদি বলি , আপনি মেয়েটাকে খুন করেছেন , তাহলে ভুল বলব কি ?
লোকটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে । যেন অভিযোগ মাথা পেতে নেবার জন্যে সে হাজির । যেন যে কোনও শাস্তি মাথা পেতে নিতে তার কোনও দ্বিধা নেই
-আশ্চর্য! আপনার চোখে ত একফোঁটা জলও নেই । আপনার মত অমানুষের মেয়ে হয়ে জন্মেছিল মেয়েটি । হায় রে , আফসোষ !
বর্ষা যেন হাহাকার করে ।
-আবার সাধ করে নাম রাখা হয়েছিল লাজবন্তী’ ! বর্ষার কণ্ঠে এবার বিদ্রূপ ।
লাজবন্তী ! অস্ফুটে বলে ওঠে মনিমালা ।
লোকটি এবার মুখ তোলে । মণি চমকে দেখে , লাজবন্তীর বাবা । সেই পুরনো বাড়ির প্রতিবেশী ।
-আপনারে খুব ভালা পাইত মেয়েটা । বিয়া দিলাম । শ্বশুরবাড়িত্ শান্তি নাই । মেয়েটারে পুড়াইয়া মারছে ।
-আর তুমিও তাই চেয়েছিলে । -বর্ষার রাগ ষেন উপছে পড়ছে ।
-না দিদিমণি ।
-তাহলে মেয়েটা যখন থাকতে এসেছিল তখন থাকতে দিলে না কেন ?
-একটা মানুষের পেট ,ক্যামনে চালাই......
-ছিঃ ছিছি ! তাই বলে মেয়েটাকে ষমের মুখে ঠেলে দিলে ?
মেয়েদের পুরনো গল্প । লাজবন্তীর কাছে টাকা চাইত শ্বশুরবাড়ির লোকেরা । দিতে পারেনি । অতঃপর পুড়িয়ে খুন । বর্ষার পীড়িত মেয়েদের সুবিচারের এন ,জি,আলোকশিখা তে এসেছে লোকটি সুবিচারের আশায় ।আজকাল মণিমালাও অবসরমত মাঝে মাঝে এখানে আসে । এবারে আইনি ব্যবস্হা নেবার ব্যাপারটি বুঝিয়ে দেবে বর্ষা । কিন্তু এত টাকা লোকটা পাবে কোথায়!  দুমুঠো খাওয়ানোর ব্যবস্হা করতে না পেরে যে নিজের মেয়েটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল সে লড়বে আইনি লড়াই ?

অভিমন্যু শহরতলির ঐ বাড়িটা ভাড়া দিয়ে সহরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে । এত নির্জনতা দুজনেরই ভালো লাগেনি ।গা ছমছম করতো । তবে যে কটা দিন ছিল লাজবন্তীর বেড়ালছানাটিকে
সে পুষেছিল । অফিস থেকে  ফেরার পর রোজ এসে বেড়ালছানার খোঁজ নিত লাজবন্তী । অনেকসময় খাবার নিয়ে আসতো  বাড়ি ছেড়ে আসার সময় বেড়াল ছানাটি বেড়াল হয়েছে । বেশ হৃষ্টপুষ্ট । নাম রাখা হয়েছিল তুলো । তুলোকে লাজবন্তীর কাছে রেখে এসেছিল মণি । অভিমন্যু আজ অফিসের কাজে বাইরে গেছে । মণিমালা আজ একা । খুব খালি খালি লাগছে সবকিছু । তুলো কি বেঁচে আছে ?  লাজবন্তী ও তুলোর কোনও ছবিও নিজের কাছে রাখেনি মণিমালা ।