গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১৮

আফরোজা অদিতি

একটি স্ক্র্যাবারের  মনকথা


আমি একটি স্ক্র্যাবার। অনেক রঙের আছে আমার সমব্যথিতেরা; তাদের আমার ভাই বন্ধু বলা যায়। আমরা বিভিন্ন রঙের হতে পারি, তবে আমার রঙ সবুজ; আমি সবুজ রঙের স্ক্র্যাবার। সবুজ রঙ বাংলাদেশের পতাকার রঙ; এই রঙ বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের রঙ। এই রঙ শুধু বাংলাদেশের রঙ বা এই দেশের মানুষের প্রিয় রঙ তা নয় অন্য দেশের অন্য মানুষের অনেকেরই প্রিয় রঙ আছে এই সবুজ। আমি বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্ম তাই বাংলাদেশের রঙেই আমার রঙ। যদিও আমার মা নেই, তবুও বলি, আামার মায়ের লালটিপ বুকে নিয়ে ওড়ে যে পতাকা সেই পতাকার রঙেই আমার প্রকাশ। বাংলাদেশ আমার প্রিয় দেশ। ১৯৪৭-এ দ্বিজাতি তত্ত্বে ভাগ হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান তারপর থেকেই তো শুরু জাতিভেদ, ভাষাভেদ, সাম্প্রদায়িকতা। আমি রাজনীতি করি না, রাজনীতি বুঝি না তবুও বলব, যে মাটিতে ১৯৫২ তে ভাষার জন্য ঝরল তাজা প্রাণ, ১৯৭১ এ স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য রঞ্জিত হলো যে দেশের মাটি, আমি সেই সাহসী দেশের স্ক্র্যাবার অর্থাৎ মাজুনি। এই দেশের একটি ছোট্ট কারখানাতে আমার জন্ম।

আমার মুখের ভাষা নেই, কথা বলতে পারি না। কথা বলতে পারি না অধিকাংশ নির্যাতিত মানুষের মতো! এই অধম স্ক্র্যাবারের মুখে ভাষা নেই কিন্তু অনেক অনেক মানুষ আছে যাদের মুখে ভাষা থাকা সত্ত্বেও, কথা বলতে পারা সত্ত্বেও তারা কথা বলতে পারে না কারণ কথা বলার স্বাধীনতা নেই তাদের! স্বাধীন হয়েও তারা পরাধীন। তারা অত্যাচারিত হয় অহরহ কিন' প্রতিবাদ করতে পারে না! একটি সাধারণ কথাও মুখ ফুটে বলতে পারে না তারা; তারা বলতে পারে না তাদের চাওয়া-পাওয়ার কথা, অধিকারের কথা। ওরা শুধু ব্যবহৃত হয়; ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে, ব্যবহৃত হয় পোশাক কারখানায়, ব্যবহৃত হয় ওয়েল্ডিং-এর কাজে, বাসাবাড়িতে! এই বাসাবাড়িই আমার কর্মক্ষেত্র!
  কৃষিকাজে লাঙল দেওয়া, বীজ বপন, ফসল কাটা, ঝাড়াই-মাড়াই করা, পোশাক কারখানা আর ওয়েল্ডিং-এর কাজ একই রকম! যেখারকার যে কাজ তা সবসময় সে কাজ একভাবেই সম্পন্ন করতে হয় বা করা যায়। কিন' বাসাবাড়ির কাজ? হরেক কিসিমের কাজ হয় বাসা বাড়িতে; ঘর ঝাড়-, ঘর মোছা, রান্না-বান্না, থালাবাসন পরিস্কার করাসহ আরও হরেক রকম কাজ; আমি এই থালাবাসন পরিস্কার করার কাজে ব্যবহৃত হই। মাঝেমধ্যে আবার ঘরের মেঝে পরিস্কারের কাজে, বাথরূমের মেঝে ধোয়র কাজে ব্যবহার করা হয় আমাকে; ব্যবহার করে কারা? ওরা! যারা নির্যাতিত, নিপীড়িত ওরাই ব্যবহার করে আমাকে! ওরা ছেড়ে দেয় না আমাকে। কারণ ছেড়ে দেওয়ার কথা উঠতেই পারে না। আমাকে ব্যবহার না করলেও কাপড়ের টুকরা, নেটের ব্যাগ দিয়েও ওরা মাজুনি বানিয়ে ব্যবহার করবেই। আমি না ব্যবহৃত হই ব্যবহৃত হবেই আমার জ্ঞাতি-গুষ্ঠিরই কেউ! ওরা ব্যবহার করবেই আর আমাকে ব্যবহৃত হতেই হবে আর আমাকে ব্যবহার করবে তারাই যারা আমারই মতো নির্যাতিত, নিপীড়িত। ওরা খুব ব্যথা দিয়ে কাজ করে। মাঝেমধ্যে ময়লা গাদায় ফেলে দেয়! উঃ দুর্গন্ধে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে! অবশ্য মাঝেসাঝে নিপীড়কেরাও ব্যবহার করে; তবে তারা সীমিত! নিপীড়িত, নির্যাতিত যারা, তারাই ব্যবহার করে সকল সময়; এই আমার নিয়তি! 
আমার নিয়তি যাই হোক, কথা বলতে পারি বা নাই পারি, মনের কথা জানাতে পারি বা নাই পারি যাই হোক, সকল সময় মনে মনে বলি যে কথা তা হলো; অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষেরা শোন, আমি যে শুধু অন্যায় অবিচার অত্যাচার হতে দেখি তা নয়, আমি জানি দেখ তোমরাও! তোমরা জান যেমন আমি অত্যাচারিত হই তেমনই তোমরাও অত্যাচারিত হও। একটি পরিবারে স্বামী নিপীড়ন করে তার স্ত্রীকে, শ্বশুর শাশুড়ি অত্যাচার করে তাদের বউমাকে! বউমা আর স্ত্রীর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে সন্তানের ওপর কখনও বাড়িতে রাখা কাজের বুয়াদের ওপর। আর বুয়ারা নিজের তেজ দেখায় মাজুনিদের ওপর। মানুষের ধর্ম এইরকম; তাদের সমস্ত রাগ-জিদ-তেজ গিয়ে পড়ে তার অধস্তনের ওপর। আমরা মিটিং মিছিল করতে পারি না, তোমরা পারো, মাঝেমধ্যে করো; মিছিল করো, আন্দোলন করো কিন্তু তোমাদের ওপর জলকামানের জল ছিটিয়ে, ছররা মেরে, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে আহত করা হয়! কখনও কখনও লাঠিপেটা করে টেনে-হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় তোমাদের। তখন আমার সঙ্গে পার্থক্য থাকে না তোমাদের! 
এই তো সেদিন ছাত্রী হোস্টেল থেকে দেখলাম গভীর রাতে ছাত্রীদের বের করে দেওয়া হলো। প্রতিবাদ করতে পারতো, ওরা বলতে পারতো এতো রাতে আমরা যাবো না, কিন্তু তারা বলতে পারেনি কারণ তাদের মুখ বন্ধ, কথা বলার অধিকার নেই তাদের। আমি অধম আমারও তো সেই একই অবস্থা। আমি তো আবার এক কাঠি সরেসলাফিয়ে চলে যেতে পারি না। তোমরা মাঝেমধ্যে তো প্যাকিং-স্যাকিং করে বিদেশ পাঠিয়ে দাও, চলে যাই কিছুই বলতে পারি না; মুখ বন্ধ আমার। তোমাদের ওপর রাগ হয় কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবি তোমাদের করণীয় নেই কিছুই আমারও নেই! আমি তখন মেনে নেই আমার ভবিতব্য; অধিকাংশ নির্যাতিত, নিপীড়িত জন তাই তো ভাবে, নিজেদের তারা ছেড়ে দেয় ভাগ্যের হাতে, ঈশ্বরের হাতে! 

যাকগে, আমি একটি স্ক্র্যাবার, বড়ই ঘরোয়া পরিবেশে থাকি। তৈরি হওয়ার পরে হাত বদল হয়; হাত বদল হতে হতে চলে আসি একদিন কারো রান্নাঘরের সিংক-এ। তারপর নির্যাতন সহ্য করতে করতে একদিন পৌঁছে যাই ভাগাড়ে! এই আমার নিয়তি। নিয়তির হাতের পুতুল এই বিশ্বব্রম্মান্ডের সবকিছু! আমি সবুজ রঙের স্ক্র্যাবার। পৃথক রঙেরও আছে, আছে ছোট কিংবা বড়, গোল কিংবা লম্বা, পাতলা কিংবা মোটা। ঘচঘচে তীক্ষ্ণ ধারের তারের স্ক্র্যাবার আছে, আছে নরম ফোমের!
  তোমাদের মতো আমাদের মধ্যেও রকমফের আছে, থাকবেই। যতোই আমাদের রকমফের থাকুক না কেন কাজ সেই একই-নির্যাতিত হওয়া। আমরা দেশ-বিদেশ সর্বত্র নির্যাতিত হই! আমরা এই জগতের নির্যাতিত মানুষের প্রতিভূ।