গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১৮

৭ম বর্ষ ১৩তম সংখ্যা ২২ জুন ২০১৮

এই সংখ্যার লেখকসূচি - অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, অনিমেষ গুপ্ত, সুধাংশু চক্রবর্তী, অমিতাভ দাস, নীহার চক্রবর্তী, রত্না ঘোষ, আফরোজা অদিতি, মনোজিৎকুমার দাস ও তাপসকিরণ রায় ।

অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

ভীষ্মের প্রথম শরশয্যা

তার আঠারো বছরের জীবনে এমন সংকটে আর কখনও পড়েনি অম্বা।
গত বছর রাজকার্যে বারাণসী এসে অনতিনবীন, রূপবান, সৌভরাজশাল্ব কাশীরাজের আতিথ্য নিয়েছিল। সেই অবসরে সে এক গোধুলিবেলায় নির্জন রাজোদ্যানে পায়চারি করছিল অলসমগ্নতায়। ভেবেছিল উদ্যানে সে একাই। ভুল ভেবেছিল। আসলে এক পঞ্চবীথির আড়ালে ভুজগলতার দোলনায় দোল খেতে খেতে তিন জোড়া কিশোরী নয়ন তার গতিবিধি অনুসরণ করছিল। আনমনা হয়ে চলতে চলতে শুকনো পাতায় ঢাকা তিন্তিড়ি গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে সে পড়ে যেতেই জলতরঙ্গের মতো ঐকহাসি উদ্যানময় ছড়িয়ে পড়ল। চমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি ভূতলে উঠে বসল শাল্ব। ওদিকে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া দুই বোনকে ফেলে রেখে এক লাফে দোলনা থেকে নেমে পড়ে ছুটে এল অম্বা। পথ ও বাগানের বিভাজিকার প্রস্তরখণ্ডে আঘাত লেগে শাল্বের কপাল বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে রক্তধারা। সে হতভম্ব। দ্রুত পদক্ষেপে অম্বা বাগানের ওষধিলতা ছিঁড়ে দুহাতে ডলতে ডলতে শাল্বের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল এবং পরম যত্নে লতামণ্ড তার কপালের ক্ষতে চেপে ধরল। কপালের সামান্য ক্ষত ক্ষত্রিয় রাজার মনোযোগের বিষয়বস্তুই নয়; বরং সে ভালো করে নিরীক্ষণ করল দৈবযোগে নেমে আসা বিদ্যুল্লতাটিকে। কটি ক্ষীণ, কটিনিম্ন সুবর্তুল, আর তার শরীরের উপর ঝুঁকে পড়া পরিস্ফুট দুই অমলিন পয়োধর ও পুষ্ট দশনচ্ছদ। যৌবনপুষ্ট কুমারীদেহের স্পর্শে সম্বিত হারানোর মতো অনভিজ্ঞ নয় শাল্ব। কিন্তু দুটি কৃষ্ণনয়নে সমবেদনার জলাভাস লুপ্ত করে দিল তার বিবেচনাবোধ। সে দুহাত বাড়িয়ে পুষ্পগন্ধীকে জড়িয়ে ধরে তার অধরে এঁকে দিল দীর্ঘস্থায়ী প্রণয়চুম্বন।  এই করতে গিয়ে তার কপালের রক্তে রঙিন হয়ে উঠল অম্বার সীমন্ত। তার কুমারী শরীর প্রথম পরুষস্পর্শে কেঁপে উঠল থর থর করে, স্তনবৃন্ত দৃঢ় হয়ে কাঁচুলির দেওয়ালে মাথা কুটল, কণ্ঠ থেকে স্বর গেল হারিয়ে। ছুটে এল অম্বিকা ও অম্বালিকা। জ্যেষ্ঠার রক্তিম সীমন্ত লক্ষ্য করে আর্তনাদ করে উঠল তারা, --- এ কী করলেন আর্য!

শাল্ব বিচলিত হল না। যৌবনের শুরু থেকেই এ-সবে অভ্যস্ত হতে হয় ক্ষত্রিয় রাজকুমারদের। সে স্মিত হেসে প্রশ্ন করল, --- অপরূপা, কী তোমাদের পরিচয়?

অম্বিকা বলল, --- আমরা কাশীরাজ-দুহিতা। আপনি যার সিঁথি রাঙিয়েছেন সে আমাদের অগ্রজা, অম্বা।

রাজা বলল, --- আমার সৌভাগ্য। অম্বাকে আমি গান্ধর্ব মতে গ্রহণ করলাম। আপাতত কাশীরাজকে জানানোর প্রয়োজন নেই। শুনেছি তিনি অনতিবিলম্বে তোমাদের স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করবেন। সেদিন আমি উপস্থিত থাকব তোমাদের এই মায়াক্ষী অগ্রজার হাতের বরণমালাটিকে গলায় পরতে।
আজ সেই স্বয়ম্বর সভা। তামাম আর্যাবর্তের, তরুণ রাজকুমার থেকে শুরু করে প্রৌঢ় অধিপতি সকলেই আমন্ত্রিত। একে একে উপস্থিত হয়ে উন্মুক্ত সভারচারদিক ঘিরে তারা সবাই নিজের নিজের পছন্দসই জায়গায় আসন করে নিয়েছে। প্রত্যেকের উষ্ণীষে জ্বলজ্বল করছে পরিচয়-জ্ঞাপক চিহ্ন। কাশীরাজ সভায় উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্দরমহল থেকে সমবেত শঙ্খধ্বনি ভেসে এল। একটু পরেই মৃণালহস্তে বরণমালা জড়িয়ে মৃদুচরণে একে একে সভায় ঢুকল অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকা। অম্বার চঞ্চল দৃষ্টি সমবেত রাজপুরুষদের মধ্যে একটি প্রিয়মুখের সন্ধান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। লজ্জারুণ অম্বিকা ও অম্বালিকা নতমুখ।
--- আঃ মরণ! তোদের পায়ের তলায় পছন্দের মানুষ বসে আছে নাকি! সামনে না তাকালে চার চোখ মিলবে কেমন করে!
লজ্জাবতী দুই কনিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে কথা কটি উচ্চারণ করতে না করতেই শাল্বর চোখে চোখ পড়ে গেল অম্বার। দ্রুত পদক্ষেপে তার দিকে এগোতে যাবে, চকিতে কী যে ঘটল কিছুই বোধগম্য হল না। নিমেষ না ফেলতেই দেখে অপরূপ এক কুমারের বলিষ্ঠ দুহাতের ঘেরাটোপে তারা তিন বোন বন্দী। চিন্তার অবসর মিলল না, কেবল এক ইন্দ্রিয়াতীত বোধ অম্বাকে জানিয়ে দিল এই পরুষস্পর্শে যত্ন আছে, অনুরাগও আছে কিন্তু কাম নেই। কে এই কুমার? পর মুহূর্তেই সভার অনতিদূরে অপেক্ষমাণ রথে স্কন্ধারূঢ় তিন কন্যাকে নিয়ে অনায়াসে উঠে বসল কুমার। চারিদিকের কোলাহল ছাপিয়ে উচ্চগ্রামে ধ্বনিত হতে লাগল একটিই নাম ভীষ্ম ভীষ্ম ভীষ্ম! ততক্ষণে তিন কন্যাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে সামনের আসনে বসিয়ে দিয়েছে দেবব্রত।

এই তবে কুরুকুলতিলক ভীষ্ম! পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে এবার তার দিকে তাকাল অম্বা। কে না জানে ভীষ্মের নাম? এই আর্যাবর্তে তার সমকক্ষ যোদ্ধা কেউ নেই। কিন্তু সে যে এমন কন্দর্পকান্তি তা তো জানা ছিল না। ভীষ্ম কি তাঁদের তিনজনকেই বীর্যশুল্কে জয় করতে চাইছে? ক্ষাত্রধর্মে গায়ের জোরে স্বয়ম্বরাদের ছিনিয়ে নেওয়া অনৈতিক নয়। কিন্তু অম্বা যে শাল্বর বাগদত্তা, তার অধরে আঁকা হয়ে গেছে তার প্রণয়ছাপ।
ভীষ্মের ক্ষিপ্রতায় সমবেত রাজন্যবর্গ অপ্রস্তুত। কেউ লক্ষ্য করেনি কখন তার রথ এসে সভার     অনতিদূরে দাঁড়িয়েছিল। তার তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ শরীরে তিন শ্যামাকে ধারণ করে যখন সে সভা থেকে তার রথে গিয়ে উঠল, মনে হল এক স্বর্ণাভ সিংহ চিতার ক্ষিপ্রতায় এক দংগল হায়েনার মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিল। মুহূর্তের জড়তা ভেঙে শাল্বের নেতৃত্বে তারা ভীষ্মের রথ ঘিরে ধরল। কিন্তু অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ভীষ্মের শরজাল একই সঙ্গে চতুর্দিকে রচনা করে ফেলল এক চক্রব্যূহ। তাকে ভেদ করে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠল রাজাদের পক্ষে। ভীষ্ম যে নিপুণ ধনুর্ধর তা তারা জানত কিন্তু সে নিপুণতা যে এতখানি সূক্ষ্ম হতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব হত।

     রথের মধ্যে অম্বা পড়ল চরম সংকটে যা তার আঠারো বছর বয়সের পক্ষে বড্ড বেশি ভারী বোধ হচ্ছিল। তার চিন্তাশক্তি যেন রহিত হয়ে গেল। সে কি লাফ দিয়ে নেমে শাল্বের কাছে ছুটে যাবে? একজন ক্ষত্রিয় রমণীর সেটাই তো উচিত কর্তব্য। কিন্তু নবীন দেবব্রতর বলিষ্ঠ দেহের আঘ্রাণে, তার কার্মুক চালনার মনোহারিত্বে, সর্বোপরি তার অপরূপ সুন্দর মুখাবয়বে লেগে থাকা বিষাদময়তায় সে এমনই মোহাবিষ্ট হয়ে গেল যে রথ থেকে লাফ দেবে কি চোখের পলকটুকুও ফেলতে ভুলে গেল।
সামান্য কয়েক দণ্ডেই ভীষ্মের প্রহরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রাজন্যদের প্রতিরোধ। তার শরাঘাতে শাল্বের রথ চূর্ণ, অশ্ব ভূপতিত, সারথি পলাতক। শাল্বকে পালানোর পথ করে দিয়েভীষ্মের রথ যখন মহাবেগে হস্তিনাপুরের দিকে এগিয়ে চলেছে অম্বার চিত্ত তখন ভীষ্মময়। তবে যে শুনেছিল ভীষ্ম তার পিতার মনোবাসনা পূর্ণ করার কারণে আজীবন বিয়ে না করতে শপথবদ্ধ! কী এমন ঘটল যে সে আজ প্রতিজ্ঞা ভাঙতে উদ্যত? তবে কি সে অম্বার কারণেই? তার রূপলাবণ্য, বিদ্যা আর মেধার কথা শুনেই কি ভীষ্ম নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি? পিতা কাশীরাজ কি পূর্বেই ভীষ্মের বাসনার কথা জানতে পেরেছিলেন? তাই কি তিনি অম্বার তুলনায় দৈহিক ও মানসিকভাবে নিস্প্রভ তার দুই অনুজাকেও ভীষ্মের হাতে তুলে দিতে একই সঙ্গে তিনজনের স্বয়ম্বরের ব্যবস্থা করেছিলেন? অম্বার খেয়াল হল, রাজারা যখন ভীষ্মের রথ ঘিরে ধরেছিল তখন কাশীরাজ সভা থেকে বরাভয়ের ভঙ্গীতে ভীষ্মের দিকে তাকিয়ে তাঁর দুহাত তুলে ধরেছিলেন। সে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল তার কারণেই ভীষ্ম আজ প্রতিজ্ঞাভ্রষ্ট। আর সেজন্যেই তার মুখে বিষাদের ছায়া।

--- ওই ছায়াটুকু তোমার অনিন্দ্যসুন্দর মুখে লেগে থাকুক দেবব্রত। চিরকাল আমার মনে পড়বে আমাকে জয় করতেই তুমি অমূল্য প্রতিজ্ঞা ভেঙে ওই ছায়াটুকু অর্জন করেছিলে আর তোমার রূপ ও শৌর্যের সঙ্গে ওই ছায়াময়তা দেখেই আমি নিমেষে আত্মহারা হয়েছিলাম।
এই স্বগত উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে গত বছরের শাল্ব-সন্দর্শনের ঘটনাটি স্মরনে আসতেই আত্মধিক্কারে মাথা নিচু হয়ে গেল অম্বার।

হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে পৌঁছতেই শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিয়ে পুরনারীরা তিন কন্যাকে বরণ করে মহারাণী সত্যবতীর কক্ষে নিয়ে গেল। সত্যবতী তাদের শিরচুম্বন করে তাদের আহার ও বিশ্রামের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তখনই তাঁর অনুমতি নিয়ে সেই কক্ষে প্রবেশ করল ভীষ্ম। বিমাতাকে প্রণাম করে বলল, -- আলোকসামান্যা অম্বা আর অপরূপা অম্বিকা ও অম্বালিকাকে জয় করে আপনার চরণে এনে দিলাম মাতা। প্রিয়দর্শন ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে এদের পরিণয় সুসম্পন্ন করার ব্যবস্থা করুন। আমি নিশ্চিত যৌবন-মদালসা এই তিন নন্দিনী অচিরেই কুরু রাজবংশের উত্তরাধিকারী লাভ করার ও আপনার পৌত্র-পৌত্রীর মুখদর্শন করার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করবে।

অম্বা নিমেষে বজ্রাহত! ভীষ্মের কথাগুলি তার কানে যেন বিষ ঢেলে দিল। হস্তিনাপুরের পথে ভীষ্মের রথে সে তবে শূন্যে সৌধ রচনা করতে করতে আসছিল! ভীষ্ম কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করছিল। হৃদয়ের হাহাকার ঢাকতে কণ্ঠে নিষ্ঠুর তীক্ষ্ণতা মিশিয়ে অম্বা বলল, --- দাঁড়ান আর্য।

    বিস্মিত ভীষ্ম ঘুরে দাঁড়াতেই অম্বা একই রকম স্বরে বলতে শুরু করল, --- আপনি যদি গ্রহণই না করবেন তবে আমাকে স্পর্শ করলেন কেন আর্য? রমণী গৃহসজ্জার উপকরণ নাকি যে তাকে তুলে এনে আপনার খুশিমতো যার তার হাতে তুলে দেবেন! তার নিজস্ব সত্তা নেই? ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই? আমি তো মহারাজ শাল্বের বাগদত্তা। তাঁর গলায় মালা পরিয়ে দেওয়ার সুযোগটুকু না দিয়ে কেন আমাকে জোর করে হরণ করে আনলেন?

ভীষ্ম মাথা নিচু করলেন, বললেন, --- আমার অজানিত ভুল ক্ষমা করুন আর্যা। আমি বুঝতে পারিনি আপনার মনোবাসনা। তবে আপনি তো জানেন সুকুমারি, আমি আপনাকে কামভাবে স্পর্শ করিনি। প্রত্যেক নারীকে আমি সন্তানের মমতা নিয়ে দেখি। তাদের সামগ্রী ভাবার নীচতা যেন কোনোদিনআমার হৃদয়কে স্পর্শ না করে। আপনি গাত্রোত্থান করুন মহীয়সী, আমি অবিলম্বে আপনাকে সসম্মানে মহারাজ শাল্বের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব।

অম্বার চোখ অনলের তীব্রতায় জ্বলে উঠল, --- থাক, আগে না বুঝলেও এখন আমি নিঃসংশয় হয়েছি, আপনি মহাত্যাগী মহাপুরুষ! আপনি রাজত্বের উত্তরাধিকার ত্যাগ করেছেন, আপনি বিবাহ, এমনকি নারী-সহবাসের অধিকারও ত্যাগ করেছেন। কিন্তু কোন মহান সংকল্পে এই ত্যাগ আমায় বলবেন আর্য? এক অনিচ্ছুক রমণীকে রাজমাতা হওয়ার লোভ দেখিয়ে ইচ্ছুক করে তুলতে নয় কি? শুনেছি কোনও কোনও কীট সঙ্গিনীর মিখের সামনে খাবার ধরে দিয়ে নিজের সঙ্গমেচ্ছা পূর্ণ করে। আপনি কি ঠিক তাই করেননি গঙ্গাপুত্র? আপনি নিজে করেননি আপনি তো ত্যাগী এক বৃদ্ধের পছন্দসই নারীসংসর্গের লালসা মেটাতে সাহায্য করেছেন। হলেনই বা তিনি আপনার পিতা, এক বিকৃতকাম বৃদ্ধের সম্ভোগবাসনা আপনি তৃপ্ত করেছেন নিজেকে প্রণয়-অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ছিঃ দেবব্রত ছিঃ! আপনি কি জানেন না পরস্পরের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল দুই নরনারীর দেহমিলনই তাবৎ সৃষ্টিজগতের পবিত্রতম অধ্যায় এবং পরমানন্দের আধার? আপনি কিনা সেই আধারটিই পরিত্যাগ করলেন ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারের বিনিময়ে! হায়, যে কিনা সারাটা জীবনই কাটাবে ভ্রাতা-ভ্রাতুষ্পুত্রদের জন্যে যুদ্ধ করে, পররাজ্য জয় করে আর নপুংসক ভ্রাতার অঙ্কশায়িনী করতে নারী লুণ্ঠন করে তার জীবনই বা কী, মৃত্যুই বা কী, ইচ্ছামৃত্যু তো নিরর্থক পরিহাস!

 অম্বার ভর্ৎসনা শুনতে শুনতে ভীষ্মের মুখে আলগা হয়ে লেগে থাকা বিষাদ গাঢ় হয়ে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে হাহাকার করে উঠল অম্বার হৃদয়, তার চোখের অনল মেঘভারে স্তিমিত হয়ে গেল, যেন নাভিমূল থেকে উৎসারিত হল গাঢ়স্বর, -- আমার ইচ্ছা করছে দেবব্রত তোমার প্রতিটি উপবাসী অঙ্গকে প্রেমদংশনে কণ্টকিত করে তুলি যাতে তুমি বুঝতে পারো কেন জন্ম, কেন এ জীবন!

আর্তনাদ করে উঠল ভীষ্ম, -- নিজেকে সম্বরণ করো অম্বা, তোমাকে আমার জীবনে জড়াতে পারব না ঠিকই, তবে ত্যাগও করতে পারব না। তোমার প্রণয়-প্রত্যাশা সূচীমুখ শরের মতো বিঁধে থাকবে আমার প্রতিটি অঙ্গে। কেউ দেখবে না আমার এই শরশয্যা। কৃষ্ণ দ্বৈপায়নও না। তোমাকে শিখণ্ডী বানিয়ে তাঁর এই না-দেখার প্রায়শ্চিত্ত তাঁকে একদিন করতে হবে অর্জুনের হাতে আমার শরশয্যার আয়োজন করে। সেইদিন সেইদিন অম্বা, তুমি না হয় শিখণ্ডীর রূপেই অর্জুনের অজস্র তিরের মাঝে একটি মাত্র শরসন্ধানে এঁকে দিও তোমার প্রণয়চুম্বন আমার দশনচ্ছদে।



ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ফাঁদ

         ধূ ধূ মাঠ, কোথাও কোন জনমনুষ্য নাই। বহুদুরে দুই-একটি মাত্র মাটির ভাঙ্গা ঘর ছায়ার মত দেখা যাইতেছে। চতুর্দিকে ভগ্ন প্রস্তর  ছড়ানো, মাঠ ঘাট গুল্মলতায় পরিপূর্ণ। সেই জনহীন প্রান্তরের উপর দিয়া একখানি শীর্ণ পায়ে চলার পথ বহুদুর পর্য্যন্ত বিস্তৃত। সীতাপতি বধূর  হাত ধরিয়া সেই প্রান্তরে উপস্থিত হইল...এই পর্য্যন্ত পড়েই বিকাশ বইটির পাতায় একখানি পাখির পালক রেখে বইটি  মুড়ে বিছানার পাশে রাখল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে ভাবল,বাস্তবিকই এই  জায়গাটিও যেন সেইরকমই।  ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই, দূরে কিছু ভাঙ্গা, মাটির ক্ষয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি। প্রভাত কি সীতাপতি,যে বধূর হাত ধরে এই জনহীন প্রান্তরে এসে বসবাস করছে! বেশ একটু মজাই লাগল ভাবতে। তাহলে একদিন দেখতে হবে পায়ে চলার শীর্ণ পথটি কোথাও আছে কিনা, থাকলে সে কোথায় গিয়ে মিশেছে।


        মাত্র  কিছু লোকজন মিলে এখানকার  বসবাস।  নতুন রেললাইনের কাজ চলছে, সামনে একটি ইঁটভাঁটা আছে।  রেলের কর্মী আর ইঁটভাঁটার লোকজনেরাই এখানে থাকে। বেশির ভাগই শ্রমিক, দিনমজুরের দল। দু-চার জন বাবু আর একজন মাত্র অফিসার গোছের লোক। কে তাকে এখানে আসার কথা বলেছিল, এখন আর মনে নেই। কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পক্ষে এর চেয়ে নিরাপদ  জায়গা আর কিই বা হতে পারে! কিন্তু কতদিন অন্যের উপরে নিজের ভার চাপিয়ে এভাবে থাকা যায়, তার মত কলকাত্তাইয়া বাবু আর কতদিন এভাবে  থাকতে পারে!


       অনেকক্ষণ থেকেই মন চা চা করছিল, কিন্তু বন্ধুর স্ত্রীটিকে নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে বিব্রত করতে বিকাশের মন চাইছিল না। অন্যের ওপর জোর জুলুম করা সাজে না। এপাশ ওপাশ চাইতেই দেখে রুক্মিণী নিজেই দুকাপ চা হাতে নিয়ে এঘরে  আসছে। বারান্দা দিয়ে আসার সময় কার সঙ্গে যেন কথা বলল, তারপর ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলচা হোবে?

        রুক্মিণী উত্তর বিহারের মেয়ে, আরা না ছাপরা না সীতামারি কোন এক জেলার অজ এক গাঁয়ে  তার বাপের বাড়ি।  চেহারা  অনিন্দ্যসুন্দর  বললেও কম বলা হয়। বিকাশ  তার জীবনে এত সুন্দরী মেয়ে কখনো দেখেনি। রুক্মিনীর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে অসুবিধে বোধ করে, কেমন যেন অস্বস্তি করে। কিছু করারও নেই। প্রভাত সেই ভোরবেলা বেরিয়ে যায়, আসে প্রায় চারটে  নাগাদ। ততক্ষণ রুক্মিণীর সঙ্গেই কথাবার্তা চালাতে হয়, যা দরকার চাইতে হয়। প্রভাতের মত সাধারণ এক চাকুরিজীবির কি করে এত সুন্দরী একজনের সঙ্গে বিয়ে হল, বিকাশ  সেই কথাটাই শুধু ভাবে, যেন সাধারণ মানুষের   সুন্দরী কে বিয়ে করতে নেই। কিছু কিছু কথা জেনেছে  বিকাশ, প্রভাতই বলেছে তাকে। গরীব বাপের মেয়ে, টাকা-পয়সার জন্য বিয়ে আটকে যায়, প্রভাত তাকে উদ্ধার করেছে। এমন মেয়েরও বিয়ে আটকায়! অবাক হয়ে ভাবে সে। রুক্মিণী এসে বাধা দেয়। --কি ঘরে বসিয়ে আছেন ভাইয়া, বাহার যাও, দেখো চারোঁ  তরফ...বহোত কুছ হ্যায়...খালি ঘরে বসিয়ে থাকেন আপ জি!
--তুমি দেখেছ?
--সব না দেখলো...কুছু কুছু দেখেছি।বলেই মিষ্টি হাসি হেসে বলে আপ্‌সে জ্যাদা দেখ লিয়া...
কখন যাও, প্রভাত তো সারাদিন বাইরেই থাকে
--হম তো বাহার না রহে, ঘর মে থাকি।বাংলা বলার চেষ্টা করে রুক্মিণী। অর্থাৎ সে তো আর বাইরে বাইরে ঘোরে না প্রভাতের মত, সুতরাং তার এখানকার সবকিছু না দেখার কি আছে! প্রভাতের কাছ থেকে কিছু কিছু বাংলা শিখেছে সে। কি যেন একটা কথা  বলতে গিয়েও চুপ করল, বিকাশের দিকে একবার তাকিয়ে ঘরের  বারান্দায় এল রুক্মিণী। একটু পরেই আবার বিকাশের ঘরে এসে ওর খাটের কাছে মেঝেতে বসল। বিকাশ হাঁ-হাঁ করে উঠলআরে...আরে, এ কি! এখানে কেন?’ বলল, আবার খাটে তার সঙ্গে বসতে বলতেও পারছে না, কিসের এক অস্বস্তি ধরে  রেখেছে। অবাক হল রুক্মিণী।  --কিঁউ, আপনাকে বাড়িতে কেউ জমিন মে বসে না? আমরা বহুত গরীব ভাইয়া,হামাদের এত্ত বড়া ঘর নাহি  এক কামরা, উসিমে সব...খানা,  বৈঠনা, সো না...সব  কি কথার কি উত্তর! লজ্জ্বা পেল নিকাশ। কিন্তু মাটিতে রুক্মিণী বসে আছে বলে ওর নিজের খাটের ওপর বসে থাকতে খারাপ লাগছিল। খালি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে ভিতরের বারান্দায় যাবে, রুক্মিণী   তড়াক করে উঠে হাত থেকে চায়ের কাপ নিল---মুঝে দিজিয়ে ভাইয়া...ওহ্‌ গুসসা  করেঙ্গেভুরু কোঁচকালো বিকাশ--কেন, গুসসা করবে কেন? 
--আপ মেহমান যো হ্যায় থতমত খেল বিকাশ,রুক্মিণী কি মনে করিয়ে দিল!

        সত্যি,আর কতদিন এভাবে অতিথি হয়ে থাকা যায়! মুখে কিছু না বললেও অসুবিধে কি হয় না। একটা মেয়ে সারাক্ষণ একবাড়িতে অন্য একটা লোকের সামনে খাওয়া-বসা, গল্প করা, রান্না করা...এসব করতে পারে! একটা মাত্র কলঘর...তার নিজের দরকার থাকলেও বলতে পারে না। সে তো তার নিজের কেউ নয়, বরের বন্ধু, তবে! খারাপ লাগছিল বিকাশের। দু/একদিনের মধ্যেই চলে যাবে সে। অন্য কোথাও জায়গা খুঁজে নেবে। কিন্তু মুশকিল হল, যাবে কোথায়, তেমন নিরাপদ জায়গা আর আছে কি? কেউ না কেউ তাকে দেখে ফেলবেই। এ একেবারে পৃথিবীর একপ্রান্তে, কেউ বোধহয় জানেই না এই জায়গাটার কথা, তাই এমন সহজে থাকতে পারছে। তাছাড়া সে কেন এসেছে, কি কারণে এসেছে,এসব এখানে খুব সহজেই বুঝিয়ে বলা গেছে, প্রভাত কি তার বউ রুক্মিণী একটুও সন্দেহ করেনি। করলে বিকাশের পক্ষে মুশকিল হত। যাবে বললেই তো যাওয়া সহজ হবে না,দেখা যাক্‌।

(২)

       বিকেলের আলো মরে আসছিল। জানলা দিয়ে দুরের ছোট ছোট গাছপালা, অনেক দুরের মাটির ভাঙ্গা ঘরগুলো কেমন যেন আবছা লাগছিল,ক্যালেন্ডারের ছবির মতন। ওখানে কি কোন মানুষজন থাকত একসময়,ওই ঘরগুলোয়?  জানতে ইচ্ছে করে, কারা তারা? চলে গেছে, নাকি মরে গেছে? একটা  গোটা গ্রাম এভাবে শেষ হয়ে যায়!  নাকি আরো গভীরে আছে অন্য কোন ঘটনা, কি সে?বাইরের দিকে চেয়ে চেয়ে এইসব চিন্তাই করছিল বিকাশ। অন্যদিন প্রভাত প্রায় এইসময়েই এসে পড়ে। আজ দেরি হচ্ছে কেন কে জানে!  সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বিকাশ বললতুমি ওখানে গেছ,ওই ভাঙ্গা মাটির ঘরগুলোর কাছে?’
--আমাদের বিহারে নিজের ঘরই ত ভাঙ্গা আছে,আবার দুস্‌রা কে ভাঙ্গা ঘর কেনোদেখব? সব তো একই আছে...ই জায়গা যেমন আছে,আমরাকে ঘর তো ওইসে হি ...তো কেনো যাব!যেন প্রশ্ন করে বিকাশকে।  
--সারা জিন্দগী ত এমনি ভাঙ্গা কাটল, তো নয়া কি আছে জি? আপনি দেখ কে আসুন, লেকিন আপনাদের কি সব বড়া বড়া লোক আছে,বহুত পয়সাওয়ালা? গরীব নাই কোই?  জিন্দগী ভি তো এমনি আছে ভাইয়া, কভি টুটা-ফুটা, তো কভি রওশন। ...দেখো, এখানে রেল লাইন আছে, বাজার আছে,  আদমী  লোগ আতে যাতে হ্যাঁয়, আবার কিসি জগহ দেখো একদম সুনা...একদম সুনা, সুখা পড়া হুয়া...ইয়ে সব দেখতে ভালো লাগে? আপনার মন মে ...দুখ নহি লগতা!...আপনি কি ইয়ে সব দেখনে কে লিয়ে আসেছেন...ক্যা ভাইয়া?
একনাগাড়ে অনেক কথা বলে চুপ করল রুক্মিণী। বিকাশ চুপ করে আছে, কোন কথা বলছে না দেখে আবার বলল সে---আমি জানে আপনি এখানে কেনোআসেছেন। আপনে কেনো এমন করলেন?  যো দুখী ভাইয়া, কেনো উকে ঔর দুখী বানাবে। কেনো মারলে উকে? সুখ কে লিয়ে বহোত কম চিজ লাগে,বহোত কম...ওটা  কেন নিয়ে লিবে? অগর নিবে তো পালাবে কেন?  আপনি জানে, কি উয়ারা আপনাকে ধরিয়ে দিবে...সেজন্যে আপনি পালাবে, তো লিয়া কিউঁ?  বুরা মত মানিয়ে ভাইয়া,যো লেতে হ্যায়, বহ তো দেতে নহি...তো লেনা ভি নহি চাহিয়ে।
আমি বহুত দেখেছি, আপসে ভি জ্যাদা...ইয়ে,আপনি ইখানে যো সুনা দেখছেন, আমার অন্দর উস্‌সে ভি সুনা, খালি পড়ে আছে। আপ মুঝে ক্যা দেখাবে,মত দিখাও মুঝে। আমি সব জানি, জগহ ভি জানি, সব আদমী কো ভি জানি।  আদমী বহোত শয়তান আছে!
--প্রভাত কি বলেছে তোমাকে,সব বলেছে?
-আমি জানতে পারি, হামি আদমী দেখলে বুঝতে পারি,আপনার মুখে দাগ আছে ...উ আমাকে বোলে নাই...আমি নিজে জানি।
-কি জান, তুমি?’ রুক্ষ হয়ে উঠল বিকাশের গলার স্বর।
--এহি,কি আপনার ডর লাগছে আমাকে...আপনি দোস্তকে বিস্‌ওয়াস করছেন না...কাল সুবহ আপনে চলিয়ে  যাবেন, নেহি তো...
-না হলে কি?
কঠিন চোখে তাকাল রুক্মিণী,নহি তো,আমি ধরিয়ে দিবো...
--কাকে চেন তুমি এখানে?কাকে বলবে আমার কথা? তুমি কতদিন এসেছ এখানে, কাউকে চেন, যে তুমি বলবে?’
ক্রুর হাসি হাসল রুক্মিণী,রেল কোম্পানী ঔর ইঁটভাঁটার কাম করে আদমী লোগ সব পাক্কা চোর  আছে। ওহি আদমী সব কে পকড়বার জন্য  লোক আছে সরকার সে, জাসুস জানে আপনি, জাসুস...ওহি কাম করে আমার আদমী,আপনে দোস্ত...ওহ  চোর, ডাকু, বদমাশ  পাকড়ায়...আপনার অগর বিশ্বাস না  হোচ্ছেতো পুছে নিবেন। আমার আদমী  সব চোর-বদমাশ আদমীকে ধরে লিয়ে ঐ দূর ভাঙ্গা ঘর মে ছোড়কে আতে হ্যাঁয়...একেলা...মরনে কে লিয়ে। সব মর যাতা...সব।  খানা নহি,আদমী নহি,পানি নেহি...কুছু না মিলে। বিসোয়াস না হোলে পুছে নিবেন...চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে যায় রুক্মিণী।   

       এ কোন ফাঁদে পা রাখল বিকাশ! দুরের ভাঙ্গা ঘরগুলো যেন  হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। অন্ধকারের দিকে চেয়ে ঘরগুলোকে আরো দুরের মনে হয়। ধূ ধূ প্রান্তর যেন আরো শূন্য...জনহীন। আবছা অন্ধকারে দিকে চেয়ে নিঃসাড়ে বসে রইল বিকাশ...