গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮

৭ম বর্ষ ১১তম সংখ্যা ১২ মে ২০১৮

এই সংখ্যায় ৬টি গল্প । লেখকসূচি - সুবর্না রায়, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, সুবীর কুমার রায়, নীহার চক্রবর্তী, আফরোজা অদিতি ও তাপসকিরণ রায় ।

সুবর্ণা রায়

খিচুড়ি 

ঘরটার দুটো জানালা। একটা হাট খোলা, মানে কাঠের ফ্রেমটা শুধু আছে, পাল্লা নেই। আর একটাতে পাল্লা আছে। তবে দুটোই খুলে ঝুলে পড়েছে। হাট খোলার সামনে একটা পাম্প স্টোভ। ভসভস করে আগুণ আর আওয়াজ বেরোচ্ছে।
চেয়ারে বসে ফাটা জিনস আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বড় হাঁড়িতে হাতা ঘুরাচ্ছে শিবদাস।
খিচুড়ির সুগন্ধে জানালা দিয়ে মাঝেমাঝেই হামলে পড়ছে কয়েকটা ছোট মাথা। ফিসফিস হাসি শুনে তাড়া মারছে শিবদাস।
"যা পালা এখান থেকে!"
"ও স্যার, আমাদের দেবে না?"
"না, আজ তোরা বাদ।"
"ও স্যার, ও স্যার, শোনো না!"
"অ্যাই তোরা যাবি নাকি আমি যাব?"
অতটাও রাগে নি শিবদাস, কিন্তু ভান করতে গিয়ে হাঁটুর ধাক্কায় টাল খেয়ে গেল হাঁড়ি। প্রায় শ'খানেক জনের রান্না!
বড় সাধ করে রাঁধছে। সন্তানের মতো আগলাতে গিয়ে খালি হাতেই ধরে ফেলল ফুটন্তগরম কানা। চলকেও পড়ল খানিক। হাতের ওপরেই।

সস্তার সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তিতকুটে থুতু ফেলল উমেশ, "হাজার টাকা জলে দিলো সালা! এতো করে বললাম, বিজনেস করব, দাও! দিলো না!"
লালটু বলল, "দোস্ত, আজ বালদিবস। শিবুদা তো ভালোই করছে।"
"সালা! বাল দিবস! ঘর যাব না আজকে। সালা খুঁজে মরুক!"
শিবদাস আঠাশ। উমেশ পনেরো। তেরো বছরের বড় দাদাকে আরো অনেকভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছিল উমেশ। রাগের কারণ আগেই বলেছি।
"হা-ঘর হা-ভাতেগুলো আমার চেয়ে বেশী, না? তোর ভাতে, তোর ঘরে আমি পেচ্ছাপ করি!"

রুক্ষসুক্ষ বসতিটার একদিকে, হাইওয়েতে ওঠার রাস্তার পাশে বটগাছটার নীচে লালটুদের গুমটি দোকান। তার থেকে কয়েক পা এগোলে হালকা জঙ্গল মতো জায়গাটায় পঞ্চাশ-ষাট জন উদ্বাস্তু এসে জুটেছে। মাছি ভনভন করে বাচ্চাগুলোর গায়ে। কতদিন কিছু খায় না ভালো করে, জানা নেই। কিন্তু উৎপাত করে না বসতিতে গিয়ে। দু-দশ টাকাও সাথে আছে কি না সন্দেহ, কিন্তু মানইজ্জত ষোলআনা।
এইলোকগুলো আর তাদের বাচ্চাদের জন্য খিচুড়ি বানাচ্ছে শিবদাস, তার তিনঘরের স্কুলে। নিজেদের অবস্থা ভালো না হলেও, বসতির বাকি লোকেরা বেশ মজা পেয়েছে। হাতে হাতে সাহায্যও করছে। জুলজুল করে হাঁড়ির দিকে দেখতেও ছাড়ছে না। বিগড়েছে শুধু উমেশ। ভাইকে বইমুখো তো দূর, অক্ষর অবধি চেনাতে পারে নি শিবদাস। বাবা-মা থাকলে হয়ত শাসন হত কিছু, শিবদাস পারে না একদম। দু'জনের মধ্যে ফারাক যেন আসমান-জমিন!

খড়খড়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে জমিল এসে প্রায় গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল উমেশের।
"ওই... ওই... স্যারের..."
উমেশ ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল জমিলকে। "ভাগ, স্লা!"
"স্যারের দু'হাত পুড়ে গেছে উমেশদা! দু হাত!" নিজের দুহাত উল্টে দেখাল জমিল। বয়স সাত, তাও গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করল নিজের মতো করে।
আকাশ ফাটিয়ে বাজ পড়ল কোথাও।
"এই লাল্টু! চলে আয়!"
খড়খড়ে রাস্তার ওপর দিয়ে সাইকেলটা নিয়ে উড়ে চলে গেল উমেশ।

লোক জমে গেছে একমাত্র স্কুলঘরটার চাতালে। সঙ্গে সঙ্গে জল দিয়েও লাভ হয় নি। বড় বড় ফোস্কা পড়ে গেছে শিবদাসের হাতে। ফোস্কাওয়ালা মাস্টার চোখের জলে ভাসছে খিচুড়ির হাঁড়ির সামনে বসে- এ দৃশ্যে বেশিরভাগটাই আমোদ বাকিদের কাছে। "আহারে" "উহুরে"র সাথে "দেখ কেমন লাগে" "বেশী পয়সা হয়েছিল, না?" ইত্যাদি মন্তব্যও উড়ে আসছিল। আর শিবদাসের ব্যথাটা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছিল।

বেলা বেড়ে সূর্য মাথার উপরে উঠে মজা দেখছিল, কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। উমেশ হুড়মুড় করে ঢুকে ভিড় ঠেলে ঘরটার মধ্যে এসে দাঁড়াল। স্টোভটায় পাম্প করে আগুণ উসকে দিয়ে বড় হাতাটা দিয়ে খিচুড়ির মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁকডাকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। লাল্টু, কালু, বিশু, লক্ষণ, জগাদের দলটা সামান্য আয়োজনটাকে অসামান্য করে তুলল।

সারসার পাত পড়ে গেল, ক্ষুধার্ত লোকগুলো হাপুসহুপুস করে অমৃত গিলতে লাগল, বসতির লোক ভেঙ্গে পড়ে মজা দেখতে লাগল, শিবদাস ওই চেয়ারটাতেই বসে হাসিমুখে দেখছিল সব, মলম পড়ে জ্বালা কিছুটা কমেছে তার। শুধু একজন তখনও অনড় তার জেদে। বাড়ি সে কিছুতেই ফিরবে না।



--

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

শাড়ি 

আমি তখন সবে শাড়ি ধরেছি। বাড়িতে পুরনো ফ্রকগুলো মাঝে মাঝে পরলেও বাইরে কোথাও যেতে হলে শাড়িই পরি। এক একটা দিন বেশ আনন্দে কেটে যায়, যেদিন বাইরে কোথাও যাবার থাকে। সেদিন সকাল থেকেই মায়ের শাড়ি বাছতে শুরু করি।  আমার নিজের শাড়ি তখনও বিশেষ নেই। ঠিক এমনি সময় খবর এল, শিবুমামার বিয়ে। দারুণ আনন্দ হল, মায়ের বেনারসী পরব বিয়েতে এই ভেবে।   
শিবুমামা আমার আপন মামা নয়, আমার দিদিমায়ের মানুষ করা ছেলে। এতদিনে কলেজ পাশ করে  চাকরি পেয়েছে  দেখে দিদিমাই বললে একদিনএবার বিয়ে-থা করে থিতু হয়ে বস, শিবু। আমি আর কদিন! 

মামীরাই শিবুমামার পাত্রী যোগাড় করল। পাত্রী নাকি একসময় বড়মামীদের কোয়ার্টারের কাছাকাছিই থাকত। ওরা পাঁচ বোন, ভাই নেই। আমরাও দেখেছি তাকে। মামার কাছে বেড়াতে গেলে ওদের সঙ্গে খেলা করেছি। হবু মামীর তিন নম্বর বোন ছিল আমাদের সমবয়সী,বন্ধু। ওদেরই বড় বোনের সঙ্গে মামী শিবুমামার বিয়ে ঠিক করে এলো। হবু মামীর নামশিলু,শীলা। আমাদের বন্ধুর নাম ছিল বুলটি।
 

শিলুদিদির বাবা খুব সামান্য একটা চাকরি করতেন, মেয়েদের খুব বেশিদুর লেখাপড়া শেখাতে পারেননি, স্কুলের গন্ডিটা মেয়েরা কোনরকমে পার করেছিল। কিন্তু মেয়েরা নিজেরাই প্রত্যেকে কিছু না কিছু কাজ করে নিজেদের হাত খরচ, বাড়ির ওষুধপত্র, এটা-সেটা কিনে সাহায্য করত। কেউ সেলাইয়ের কাজ, কেউ বাচ্চাদের পড়ানোর কাজ এমনিভাবে টুকটাক কাজ করত সকলেই। বুলটি, আমাদের সেই বন্ধু কোথাও কোন কাজ না পেয়ে একজনের বাড়িতে বালতি করে জল তুলে দিত। এতে তার কোন দুঃখ ছিল না। বালতি পিছু টাকা পেত। ঐ সামান্য টাকা দিয়েই বুলটি কখনও বাড়ির ওষুধ, কোনদিন বিকেলের পাঁউরুটি এসব কিনে নিয়ে আসত। পাড়ায় একডাকে ওদের বাড়ির নাম জানত, তার কারণ ও বাড়ির মেয়েরা সকলেই ছিল অসাধারণ সুন্দরী। শিবুমামার সঙ্গে শিলুদিদির বিয়ে হবার কারণও ছিল শিলুদিদির রূপ। শিলুদিদি দেখতে খুবই সুন্দরী।  আর  মামীরা নিজেরাও সুন্দরী ছিল বলে শিলুদিদিকেই পছন্দ  করেছিল। ঠিক হল বিয়ে হবে বড়মামীর কোয়ার্টার থেকেই। এতে মেয়ের বাড়ির খরচ কিছু বাঁচবে। আমাদেরও একটু অন্য জায়গায় বিয়ে বাড়ি হলে মুখ পাল্টাবে। সেইমত আমরা বিয়ের কয়েকদিন আগেই বড়মামার কাছে এসে হাজির।

বিয়ের আগের দিন একটু বেলার দিকে বুলটি আমাদের বাড়ি এল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমরা তো শিলুদির বিয়েতে কিছু দেব, সেটা কি? আমি অবাক! এভাবে কেউ জিজ্ঞেস করে নাকি? আমার জানার কথাও নয়, মা-মামীরাই জানে। আমি বোকার মত বুলটিকে নিয়ে মামীর কাছে এলাম। মামী শুনে অপ্রস্তুতে পড়েছে বোঝা গেল। কিন্তু তাও আলমারি থেকে একটা গোলাপী রঙের সিল্কের শাড়ি বার করে বুলটীকে দেখাতে গেল, অমনি বুলটি শাড়িটা একরকম টেনেই নিল মামীর হাত থেকে। বেশ দেখতে শাড়িটা! শিলুদিদি খুব ফর্সা, ফর্সা গায়ে গোলাপী রং মানাবে ভাল। বুলটী হাতে নিয়ে বলল, তার বাবার প্রায় চারমাস চাকরি নেই, কাউকে বলেনি। কয়েকদিন আগে জানা গেছে। দিদির বিয়ের কিছুই কেনা হয়নি। এক কাকা এসে দুটো ছাপা শাড়ি দিয়ে গেছে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পরার জন্য। এই শাড়িটা পরেই তাহলে বিয়ে হবে।
মামী খুব অবাক। তাহলে এতো লোকজন, খরচ-খরচা কে করছে?
-করবে আবার কে? কিছু তো হয়নি, সব লোক দেখানো!
--সে কি! এত যে নিমন্ত্রিত.....’.মামীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বুলটি যা জানালো তা এই---কাউকে প্রায় নেমতন্ন করাই হয়নি। পাড়ার যে দু-একজনকে বলা হয়েছে, তারা তো অবস্থা জানে, কেউ খেতে চাইবে না। মামী স্তম্ভিত! বুলটী শাড়িটা হাতে নিয়ে চলে গেল। মামী আবার কিছু একটা হাতে নিয়ে যেতে হবে বিয়ের দিন এই ভেবে একটু বিরক্ত হল। বুলটির ব্যবহারে মামী কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে, ঠিক এমনটা যেন আশা করেনি। এখনই এইরকম, বিয়ের পর কেমন কুটুম্ব হবে কে জানে! পরের দিন বিয়ে। ঠিক ছিল, শিবুমামারা দুপুর পর্য্যন্ত মামীর বাড়িতেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলে আসবে। সামান্য কয়েকজন বরযাত্রী আসবেন, সেইরকমই কথা ছিল, যাতে মেয়ের বাড়ির উপর চাপ না পড়ে। সন্ধ্যে নাগাদ শিলুদিদির বাড়িতে বিয়ে করতে যাবে এই বাড়ি থেকেই।

বিয়ের দিন সকালের দিকে দেখি ওদের বাড়িতে বেশ কয়েকজন লোকজন দাঁড়িয়ে।  মামী বলল-- বুলটির যেমন কথা! মেয়ের বিয়েতে লোকজন আসবে না, এ কখনও হয় নাকি? মেয়েটা বড্ড পাকা !!
বেলার দিকে একটা গোলমাল কানে এল। আমাদের বাড়ি থেকেও কেউ কেউ বারান্দা থেকে উঁকি দিল। দুপুরের দিকে গোলমালটা আর শোনা গেল না, কিন্তু একটা পুলিশের জিপ গাড়ি আর একটা এম্বুলেন্স দেখা গেল। শিবুমামারা তখনও এসে পৌঁছয়নি। বাড়িতে তো এসময় কাউকে থাকতেও হবে, নানারকম নিয়ম  আছে। তবু, মামী আর আমাদের বাড়ির কয়েকজন ছুটে গেল ওবাড়ি। একে প্রতিবেশী, তায় আবার নতুন  কুটুম্ব, যাওয়াই স্বাভাবিক। আমরাও ছুটলাম। যখন গেলাম তখন শিলুদিদিকে ধরাধরি করে  স্ট্রেচারে করে এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। শিলুদিদি চা করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে গেছে। বাঁচার আশা কম। সমস্ত লোক হাঁ করে দাঁড়িয়ে। শিলুদিদির মা ঘরের ভিতর কি যেন ফিসফিস করে বলছেন আর মুখে কাপড় গুঁজছেন যাতে কেউ কান্না না শুনতে পায়। শুধু বুলটীকেই দেখলাম সেই গোলাপী শাড়ীটা তার ছোট বোনের হাত থেকে কেড়ে নিতে। ছোট বোনটা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিল চারিদিকে । বাবাকে কোথাও দেখতে পাইনি।  

একটা চিন্তা নিয়ে সবাই ঘরে ফিরল। প্রায় আধঘন্টা পরে শিবুমামারাও এসে হাজির। বেলার দিকে পাড়ার  কে যেন খবর দিল, শিলুদিদি মারা গেছে। ঠিক কি কারণে শিলুদিদি পুড়ে মারা গেল গেল জানি না। এক একজন এক রকম কথা বলে। বুলটিরা তো কেউ বাইরেই বেরোচ্ছে না, কথা বন্ধ। ওদের বাড়ির সঙ্গে সেই যে দেখাশোনা, কথা বন্ধ হল, আর কখনও শুরু হয়নি।
বিয়ে বাড়িতে যাতে  আতিথেয়তা করতে নাহয় সেই কারণে, নাকি শাড়ির কারণে, নাকি অন্য কোন কারণে, ঠিক কি কারণে শিলুদিদিকেই চা করতে হল জানি না। বাড়িতে তো আরো চারটে বোন ছিল, মা ছিলেন...কেন বিয়ের কনে স্টোভে চা করতে যাবে? সেটা কোনদিন যানা যায়নি।

না, শিবুমামা এই ঘটনার পর আর কোনদিন বিয়ে করেনি। কে জানে, শিলুদিদিকে হয়ত মামার খুব ভাল লেগেছিল। কার কাকে, কখন ভাললাগে, বলা যায়!  


সুবীর কুমার রায়

বৃদ্ধাশ্রম

বৃদ্ধাশ্রমটি বেশ বড় ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ‘নিরালা’ নামটি সার্থক। শহরের একপ্রান্তে নিরিবিলি দোতলা বাড়িটির একদিকে পরপর মহিলাদের ঘর, কোনটাতে দু’জন, কোনটাতে তিন বা চারজনের থাকার ব্যবস্থা। একজনের জন্য থাকার ঘরের সংখ্যা নিতান্তই অল্প। অপর দিকে একই রকম ঘরগুলোয় পুরুষদের থাকার ব্যবস্থা, মাঝখানে বেশ চওড়া প্যাসেজ। বেশ বড় ডাইনিং হল্। এখানে বেশ বড় একটি টিভি ও অনেকগুলো চারজন বসার টেবিল ও চেয়ার। এখানেও সাধারণত বৃদ্ধরা একদিকে, বৃদ্ধারা অপর দিকে বসে টিভি দেখেন, আহার করেন।

এই আশ্রমেরই একতলার কোনার ঘরটিতে অনিতা মল্লিক একাই থাকেন। অবসরপ্রাপ্তা পঁচাত্তর বছর বয়স্কা অবিবাহিতা এই স্কুল শিক্ষিকাটি আজ প্রায় পাঁচ বছর এই আশ্রমের এই ঘরটিতেই বসবাস করছেন। আগে তিনি এই শহরেই নিজের একটি ছোট ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। এখন তিনি অসুস্থ হলেও, কোনদিনই তাঁকে খুব একটা মিশুকে স্বভাবের বলা যায় না, বরং  শামুকের খোলে ঢুকে থাকার মতো নিজেকে তিনি গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করতেন। বিকেলের গুলতানিতে, সন্ধ্যায় টিভি সিরিয়াল দেখার ফাঁকে, বা রাতে খাবার টেবিলে আর সকলের অতীত দুঃখের খবর পাওয়া যেত। অন্যান্য সকলেরই প্রায় এখানে আসার কারণ ছেলে বা মেয়ের দুর্ব্যবহার, মানসিক বা শারীরিক অত্যাচার। অনিতা দেবী অবিবাহিতা, অবসরপ্রাপ্তা স্কুল শিক্ষিকা, নিজের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে এখানে এসে থাকেন ছাড়া, তাঁর অতীত সকলের কাছেই প্রায় অজানা ছিল। ইদানিং তো আবার অসুস্থতার জন্য মাঝেমাঝেই তাঁর খাবার, ঘরেই দিয়ে আসা হয়।

মাস খানেক আগে এক বৃদ্ধ আবাসিকের মৃত্যু হওয়ার পরেও তাঁর ছেলে মেয়েরা না আসায়, আশ্রম কর্তৃপক্ষ নিজেরাই তাঁর সৎকারের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে ঐ ঘরটি ফাঁকাই পড়ে ছিল। আজ কয়েকজন যুবক রতন চৌধুরী নামে এক অশীতিপর বৃদ্ধকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে ঐ ঘরটিতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে যান। জানা গেল অবিবাহিত এই বৃদ্ধটিকে শেষ বয়সে দেখাশোনা করার কেউ নেই। ভদ্রলোক কোন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন, টাকা পয়সাও যথেষ্টই আছে, তাই শেষ বয়সটা এখানে কাটানোই শ্রেয় বলে মনে করেছেন।

পরদিন দুপুরে ডাইনিং হলের খাওয়ার টেবিলে যে যার মতো গল্প করতে করতে খাবার খাচ্ছেন। কয়েকজন বৃদ্ধ আবাসিক রতন বাবুর সাথে আলাপ পর্ব সারছেন। একটু পরেই অনিতা দেবী হল্ ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। খাবারের থালা নিয়ে টেবিলে বসার আগে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে একটু কুশল বিনিময়ের মাঝখানেই তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে, ভাতের থালা নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উপস্থিত অনেকেই অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাঁকে তুলবার চেষ্টা করলেন। অনিতা দেবী সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন তার উপর সকলেই বৃদ্ধ, তাই কাজটা খুব সহজ হলো না। রতন বাবু এতক্ষণ আলাপচারীতায় ব্যস্ত ছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনিও ব্যস্ত হয়ে অনিতা দেবীকে তুলবার চেষ্টা করতে এসেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর নীচু হয়ে মাটিতে বসে অনিতা দেবীর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে মুখে চোখে বেশ কিছুক্ষণ জলের ঝাপটা দিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফিরে এলে, সকলকে আশ্রমের কর্মচারীদের ডাকার পরামর্শ দিয়ে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। 

অনিতা দেবীকে তাঁর ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার এসে তাঁকে দেখে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র লিখে দিয়ে পরামর্শ দিয়ে গেলেন যে, কোন কারণেই যেন তিনি উত্তেজিত না হন। জানা গেল তার হৃৎপিন্ডের অবস্থা মোটেই ভালো নয়, যে কোন উত্তেজনা তাঁর পক্ষে চরম ক্ষতিকারক হতে পারে।

সন্ধ্যার পরে রতন বাবু সামান্য সান্ধ্যভ্রমণ সেরে আশ্রমে ফিরে দেখেন হই হই কান্ড। শ্বাস কষ্টে অনিতা দেবীর শরীর আবার খুবই খারাপ হয়েছে, তাঁর ঘরে বেশ কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ আবাসিক তাঁকে ঘিরে ভিড় করে আছেন। তিনি ঘরের বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, নিঃশব্দে অনিতা দেবীর ঘরে ঢুকে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।

অনিতা দেবী অস্ফুট স্বরে বললেন “কাল তোমায় দেখেই আমার নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। আমাদের সম্পর্কটা আমার বাড়িতে মেনে নিতে পারে নি বলে আমার অমতে আমাকে কাকার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যাওয়ার আগে তোমার মা-ও আমাকে দিয়ে তোমার দিব্যি করে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন, যে এ জীবনে আমি আর তোমার সাথে দেখা করবো না, মুখ পর্যন্ত দেখাবো না। কাকার বাড়ি থেকে পাশ করে স্কুলে চাকরি। পাছে তোমার সাথে দেখা হয়ে যায়, তাই   একটা দিনের জন্যেও আর বাড়িতে যাই নি। অবসর গ্রহণের পরও বছর দশেক নিজের ফ্ল্যাটেই ছিলাম। তারপর শরীর আর দিলো না, সব বেচে দিয়ে এখানে চলে এলাম। ভালোই ছিলাম, ইদানিং শরীরটা আর ভালো যাচ্ছে না, দিন বোধহয় শেষই হয়ে গেল। তোমার মঙ্গলের জন্য সেই সতেরো বছর বয়স থেকে যে সত্য আমি এতদিন পালন করে এসেছি, আজ পঁচাত্তর বছর বয়সে আমি তা ভেঙ্গে ফেললাম। কিন্তু এতে আমার দোষটা কোথায় বলো”?

“দোষ তোমার নয়, দোষ আমারও নয়, দোষ আমাদের ভাগ্যের। আমি তোমাকে কোথায় না খুঁজেছি। খুঁজতে খুঁজতে কখন বুড়ো হয়ে গেলাম। বাউন্ডুলে জীবনে মাথাগোঁজার আশ্রয় থাকলেও, খাওয়ার কোন ঠিক ছিল না। আজ আলুর দম পাঁউরুটি, কাল কোন ঝুপড়িতে মাছ ভাত। শরীর কত সহ্য করবে? বয়সও তো আশি অতিক্রম করে গেল। পাড়ার কয়েকজন যুবকের পরামর্শে এখানে চলে এলাম। এসে ভাবছিলাম ভুল করলাম কী না। তোমায় দেখেই চিনতে পারি। বুঝলাম  ভুল করি নি, দেরিতে হলেও ভগবান আমাদের আবার একই জায়গায় এনে ফেলেছেন”।

এরকম একটা মিলনান্তক বাস্তব নাটক দেখার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। উপস্থিত সবাই রতন বাবু ও অনিতা দেবীকে বললেন, “এতগুলো বছর পরে যখন আপনারা আবার একই ছাদের নীচে এসে উপস্থিত হয়েছেন, তখন ভগবানের বোধহয় ইচ্ছা, বাকি জীবনটা আপনাদের একসাথে একই ছাদের নীচে কাটিয়ে দেবার”। রতনবাবু চুপ করে রইলেন, অনিতা দেবী শ্বাস কষ্টে কাহিল। এক বৃদ্ধা ছুটলেন তাঁর ঘর থেকে সিঁদুরের কৌটো ও শাঁখটা নিয়ে আসতে। দু’জন গেলেন ফুলের মালা কিনতে। শাঁখ ও সিঁদুর এলো, মালাও এলো, কিন্তু ঘরে তখন উলুধ্বনির পরিবর্তে ক্রন্দনরোল শোনা গেল। অনিতা দেবীর নিষ্প্রাণ দেহটি ততক্ষণে রতন বাবুর কোলে ঢলে পড়েছে। ডাক্তার ডাকা হলো, তিনি নাড়ি দেখে জানালেন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, সব শেষ। চার ঘন্টা পড়ে কেউ গিয়ে যেন ডেথ্ সার্টিফিকেটটা নিয়ে আসেন। রতন বাবু সজল চোখে অনিতা দেবীর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলেন।

সমস্ত ঘটনা শুনে পরিচিত ডাক্তারটি বললেন,“ইচ্ছে করছে অনিতা চৌধুরী নামেই ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখি, কিন্তু তাতে ভবিষ্যতে অসুবিধা দেখা দিতে পারে”। তিনি অনিতা মল্লিকের নামেই ডেথ্ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন।


নীহার চক্রবর্তী

অঞ্জলি শঙ্খ ভাণ্ডার 


অঞ্জলি শঙ্খ ভাণ্ডার বেশ চলছিলো । 
দোকানের মালিক শশধর শাঁখারি তার বাবার ব্যবসা বেশ চুটিয়ে করছিলো । কিন্তু একদিন হঠাৎ সে হৃদরোগে মারা গেলো । তারপর মাস দুয়েক দোকান বন্ধ । এলাকার বৌরা শাঁখা পরতে অন্যদিকে ঘুরে গেলো ।
কিন্তু সইল না শশধরের বিধবা স্ত্রী অঞ্জলির ।
সে তার একমাত্র ছেকে শিবেনকে বলল,''অনেক হল । এবার দোকান খোল ।''
কিন্তু শিবেন তাকে বলল,''এ ব্যবসা আমি ঠিক বুঝি না । বাবাও তো আমাকে কিছু বলতে চায়নি । তাই না ? বরং অন্য ব্যবসা করা যাক । তুমি ভাবো । আমিও ভাবছি ।''
সঙ্গে-সঙ্গে মা বলল শিবেনকে,''এ ব্যবসা হতে পারে না । এ ব্যবসাই চলবে । আমার হাতে শাঁখা নেই তো কি আছে । আগের শাঁখার বুঝি জোর নেই ? তুই না পারিস । আমিই বসবো কাল থেকে ।''
মার কথা শুনে শিবেন বেশ অবাক হল ।
শেষে বিরক্তির সুরে মাকে বলল,''পারলে ভালো । তবে বেশ কঠিন মনে হচ্ছে । আমি কিন্তু এর মধ্যে নেই ।''
বলেই সরে গেলো শিবেন । একা-একা খুব হাসল অঞ্জলি । দু'চোখ ছলছল করে উঠলো তার স্বামী শশধরের কথা মনে করে বুঝি ।

ঠিক তার পরেরদিন অঞ্জলি শঙ্খ ভাণ্ডার খুলে গেলো । আর সাত-সকালেই । দেখে অনেকে বেশ অবাক । কেউ-কেউ অঞ্জলির কাছে এগিয়ে এলো ।
কেউ বলল,''আমরা ভেবেছিলাম ব্যবসা গেলো । শিবেন বুঝি অন্যকিছু ভাবছে ।''
একমুখ হেসে অঞ্জলি উত্তর দিলো,''সে ভেবেছিলো । কিন্তু আমি আমার স্বামীর ব্যবসা চোখের সামনে বন্ধ হয়ে যাক ভাবতে পারিনি । শিবেন বসবে না । আমিই বসবো এখন থেকে ।''
কেউ আবার বলল,''অনেকেই অন্য দোকান ধরেছে ।''
সেই হাসি মুখে নিয়ে অঞ্জলি বলল,''আবার পথ চিনে এদিকেই আসবে । আমার চেয়ে আর কে বোঝে শাঁখার কদর ? আদর করে পরিয়ে দিতে হয় । আমার ব্যবসার সঙ্গে স্মৃতিও থাকবে । সে কি ভোলার ?''

সত্যিই তাই । 
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অনেক সধবা অঞ্জলি শঙ্খ ভাণ্ডারে ফিরে এলো ।
এক তরুণী সধবা অঞ্জলিকে তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,''এ দোকান ছাড়া আমার আবার পোষায় না,দিদি । বেশ করেছেন আবার দোকান খুলে । দাদা কর ভালোমানুষ ছিল । বেশ নরম করে হাতে শাঁখা পরিয়ে দিতো ।''
তখন হাসতে হাসতে অঞ্জলি তাকে বলল,''আমি তার থেকেও নরম করে পরিয়ে দেবো না হয় । আসলে আমি তো নারী । নারীর কোমলতা যায় কোথায় ? আর তোমার দাদার থেকেও বেশ শিখে নিয়েছি আমি ।''
সবাই খুশী । সবাই । শুধু একজন বাদে । ছেলে শিবেন ।

শিবেন একদিন সরোষে মাকে বলল,''আমার লজ্জা লাগে খুব । তুমি কেন দোকানে বসবে ? লোক রাখো না হয় । পয়সার তো অভাব নেই ।''
সাথে-সাথে অঞ্জলি সারা মুখে হাসি নিয়ে শিবেনকে বলল,''পয়সার অভাব নেই সত্যি । কিন্তু ঘরে মানুষের বড্ড অভাব । যে একজন আছে সেই আমার লজ্জার কারণ । ঘরে বসে আর কতদিন রে ?''
অঞ্জলি এমন কথা বলতেই শিবেন সাথে-সাথে রাগে জ্বলতে জ্বলতে হাওয়া । ওর পালানো দেখে অঞ্জলির তখন একা-একা সেকি হাসি ! হাসতে হাসতে তার দু'চোখ জলে ভরে গেলো ।
বসন্তের শুরুরতেদূর কোন বাগান থেকে কোকিলের ডাক শুনে অঞ্জলি নিমেষে আবার হেসে উঠলো । সেই হাসি । ফুলশয্যা রাতের সলাজ-হাসি ।



আফরোজা অদিতি

অপারগতা

 মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকার খুব ইচ্ছা জাগে তাঁর। এই ইচ্ছাতেই কাজ করেন তিনি। মৃত্যু চিন্তা নেই তবুও মনে হয় এখনই যদি হয় শেষ সময়; তাহলে! কোন কাজ আগামিকালের জন্য ফেলে রাখলে চলবে না। জীবনের শেষ মূহুর্ত কখন বলতে পারে না কেউ! জীবন পাখির মতো; একটু আওয়াজ পেলেই ফুড়ুৎ।

    সকলে বলে কবি। ওর লেখাগুলো কবিতা হয় কি না সে বিষয়ে নিজেরই সন্দেহ আছে! কবিতার বিধিবদ্ধ নিয়ম মেনে  লিখেন না তিনি। ওর কাছে কবিতা বহতা নদী;বাঁধ দিলে নদী আর নদী থাকে না যেমন তেমনি কবিতাকে সাজ- পোশাক পরালে কবিতা থাকে না। মনে হয় খোলামেলা নয় একটা আঁটশাট শব্দের গেরোয় বাঁধা কিছু কথা; প্রাণহীন।

          চন্দ্র শাসিত তিনি। মাঝেমাঝেই পাগলামি ভর করে। চাঁদনি রাতে জোছনা মাথায় হাঁটে। কখনও ঝুম বৃষ্টিতে রাস্তায়। প্রায়ই পাখির মতো দুহাত ছড়িয়ে ছাদে। লুনাটিক হলেও বাসা বদলের প্রয়োজন, প্রয়োজন পেটপূজার; অর্থের খোঁজ করতে হয়। সে কারণেই একটা কাজ হাত নিয়েছেন তিনি। ফরমায়েসি; স্বাধীনতার ইতিহাস। 

    স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে ইচ্ছা হয়নি এতোদিন; ইচ্ছা করে না। এবার কাজটা নিয়েছেন তার গ্রামের কথা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য; মানুষকে জানাবার জন্য। অবহেলিত এই গ্রাম কীভাবে যুদ্ধে অবদান রেখেছিল তা জানাবার জন্য। যারা নেই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা একদিন ছিলেন; দেশের আনাচ-কানাচে ছিল তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ছোঁয়া, ছিল স্পর্শ। 

    তিনি এক উদ্ভট পারলৌকিক জালে আটকে যান। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা কী তাদের সাধের এই দেশে আসেন ? তারা কী দেখতে পান তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার অবমূল্যায়ন! বর্তমানের এই দেশ দেখে কী তাঁদের আর একবার মরতে ইচ্ছা করে! কীভাবে জানবে! যুদ্ধে মৃত আত্মার কাছে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মিলবে! কিন' কোথায় পাবেন তাঁদের।

    তারুণ্যে আত্মা হাজির করার অভ্যেস ছিল। এই বয়সে আবার ইচ্ছা করছে। যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন তাঁদের ডেকে জানতে ইচ্ছা করছে তাঁরা কী বর্তমানের বাংলাদেশ দেখে সুখে আছেন ? যখন দেশ সাজে স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে;তাঁরা কী এই  দেশের এই বিজয় উৎসব দেখে খুশি হন ? প্রতিদিনের রক্তের মিছিল দেখে তাঁরা কী প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন! কবির এলোমেলো জট পাকানো মন লিখতে চায় না। কিন' লিখতে তাঁকে হবেই।
কখনও হতে পারবেন না রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা জীবনানন্দ তবুও হাতে কলম তুলে নেন তিনি।  



তাপসকিরণ রায়


ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী২৫

কলকাতার বিপ্র কম্পানী অফিসের ভয়াবহতা


আমার এক বন্ধুর ছেলে বাপী কলকাতার সল্টলেকের বিপ্র কম্পানীর অফিসে কাজ করে। তার কাছেই শুনে ছিলাম গল্পটা। বাপির বিপ্র কম্পানীর অফিস বিল্ডিঙের গল্পটা ছিল এই রকম--
আমি তখন হায়দ্রাবাদ বিপ্র কম্পানীর অফিস থেকে ট্রান্সফার হয়ে কলকাতার সল্টলেকের অফিসে বদলী হয়েছি। সেখানে নতুন জয়েন করে দু-চার দিন কিছুই বুঝতে পারিনি। প্রায় এক সপ্তাহ পরের কথা। একদিন কোন কাজে অফিসের চার তলায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। আসলে আমার তিন তলায় কোন কাজে যাবার কথা ছিল ভুলে লিফটে চার দাবিয়ে দেওয়াতেই বোধ হয় এমনটা হয়ে গিয়েছিল। চার তলায় গিয়ে আমি বেশ আশ্চর্য-চকিত হয়ে গিয়ে ছিলাম  যখন আমি দেখলাম সেখানকার কাগজ-পত্র, ফাইল, এমন কি চেয়ার টেবিল, দু একটা ল্যাপটপও নিচে মেঝের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ! দু-তিনজন স্টাফ হবে সেগুলি গুছিয়ে রাখছিল। আমি কৌতূহলী হয়ে ওদের জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি, এমনটা হল কি ভাবে ?
ওরা কেন যেন নিচু স্বরে আমায় বলল, তুমি জান না ? তুমি কি এখানে নতুন জয়েন করেছো ?
আমি মাথা নাড়িয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ।
এখানকার ঘটনার কথা কি তুমি জান না ? ওদের এক জন আমায় প্রশ্ন করল।
--না তো ? আমি বললাম।
ওদের মধ্যে আর এক জন আমার কাছে এসে কিছুটা গলা নিচু করে বলল, এখানে ভৌতিক ব্যাপার আছে। রাতে প্রায়ই, কখনও সখনও দুপুরেও এমনি ব্যাপার ঘটে যায়। এগুলি কে বা করা করে কেউ তা জানে না। অনেক চেষ্টা করেও জানা যায়নি। তাই ঘটনা অলৌকিক বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে।
আমি আশ্চর্য হলাম।
এক জন আমায় ভয় ভয় সুর নিয়ে বলল, তাই তো এই ফ্লোর ছেড়ে আমরা অন্য ফ্লোরে চলে যাচ্ছি। এ ফ্লোর বিপ্র অথোরিটি খালি করে দিচ্ছে।
ভূত তখন আমি মানি না। ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন উদ্ভট বলে মনে হল। নতুন বলে এ নিয়ে সে দিন আর কিছু বললাম না।
একদিন আমার পাশের কলীগকে ব্যাপারটা বললাম। সে আশ্চর্য না হয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি তো জানি, চার তালায় ফাইল ছোঁড়াছুঁড়ির আওয়াজ আমি দু-দিন নিজে কানে শুনেছি। জানো তো সে রাতে আমরা তিন-চারজন স্টাফ মাত্র ছিলাম। অফিস থেকে ঘরে যেতে সে দিন আমাদের একটু রাত হয়ে গিয়েছিল।
--আচ্ছা, সত্যি ? আমি সামান্য ভীত-চকিত হয়ে চুপচাপ হয়ে ছিলাম। কেন জানি না তখন পর্যন্ত আমি এ রকম ভৌতিক ঘটনা মনে মনে বিশ্বাস করে নিতে পার ছিলাম না।
কলীগ আমার দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোধহয় অনুমান করতে পারছিল। সে বলল, তোমার বিশ্বাস না হয় একদিন রাতে এসে পরখ করে দেখতে পারো।
এরপর আরও মাস খানেক কেটে গেলো। আমি সকাল নটায় অফিস যাই আর সন্ধের আগে ঘরে ফিরে আসি। রাতে থেকে ভৌতিক কার্যকলাপগুলি যাচাই করে নেবার অবসর পাচ্ছিলাম না। তবে ইতিমধ্যে জানতে পেরেছিলাম যে বিপ্র অফিসের বিল্ডিং তৈরির আগে নাকি সল্টলেকের এ জাগা ছিল লোকালয়ের অনেক বাইরে। অতীতের ইতিহাসে এখানে নাকি এক সময় ছিল ভয়াবহ জঙ্গল। ছিল মজা ছোট-বড় জলাশয়। আর অনেকটা জাগা নিয়ে ছিল কবরখানা। কেন জানা যায়নি এখানে এসে নাকি বেশ কিছু লোক আত্মহত্যা করেছিল। এমন মনে হত যে এখানে আত্মহত্যা করার একটা আলাদা প্রবণতার হাতছানি কাজ করত ! এও যেন এখানে এক রহস্যময় ব্যাপার ছিল বলা যায়।  এ ছাড়াও এখানে ঘটেছে ধর্ষণ, চুরি, রাহাজানি, লোকের প্রতি নানান  অত্যাচার। এখানে ছিল নেশার ও জুয়ার আড্ডা। অসামাজিক লোকের অবাধ বিচরণ ছিল এখানে।
বিপ্র কম্পানীর মূল অফিসের ইমারত তৈরি হয়েছিল এখানকার কবরখানার ওপরেই। এ সব নানা কাহিনী শুনেও আমি যেন এখানকার অলৌকিকতাকে সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু একদিন আমার সুযোগ এলো, ইয়ার এন্ডিঙের কাজ সারতে রাতে অনেকটা সময় তখন আমাদের কাজ করতে হচ্ছিল। দু দিন রাতে ডিউটি দেবার পরও যখন অলৌকিক কিছু আঁচ করতে পারলাম না তখন আমার ভৌতিক ব্যাপারটা সম্বন্ধে কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল।
সেটা তৃতীয় দিন রাতের কথা ছিল, আমি বসে একটু ঘুম-ঝিম ভাব নিচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা মেয়েলী সুরের কান্নার আওয়াজে আমি চমকে সোজা হয়ে বসলাম। আমার সে দিনের কলীগ ছুটে আমার কাছে এসে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ওই দেখো, চার তালায় কেউ কান্না করছে। বেশ কয়েক বার কান্নার সুর ধ্বনিত হয়ে থেমে গেল। আমার আশপাশের স্টাফরা এক জাগায় জড়ো হয়ে চুপচাপ ভয় ভয় মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা গেল সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত।
এমনি আরও একদিনের ঘটনা। সে দিনও একটু রাত হয়ে গিয়ে ছিল। হঠাৎ দুজন নাইট গার্ড ছুটে আমাদের হল ঘরে প্রবেশ করল। ওদের চোখে মুখে  আতঙ্কের ছায়া দেখলাম। ওদের মধ্যে থেকে একজন চাপা চীৎকার দিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, স্যার, ওই দেখুন চীৎকার শোনা যাচ্ছে ! আমরা সবাই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম, কয়েক জনের চীৎকার, শোরগোল, ফাইল, কাগজ-পত্র ফেলার শব্দ, চেয়ার টেবিল মেঝেতে ফেলে দেবার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
স্পষ্ট আমার কানে সব আওয়াজ, হট্টগোল আসছিল। স্তব্ধ হয়ে আমরা সবাই শুনছিলাম। এক সময় অলৌকিক উৎপাত থেমে গেলো, চারদিকে তখন পিন ড্রপ সাইলেন্স !
এরপর এক গার্ডের বিপ্র অফিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবার কথা জানিয়ে ছিল এখানকার অন্য এক গার্ড। সে বলে ছিল, সেই গার্ড নাকি সে দিন রাতে ভীষণ ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার নাম ছিল সুশীল। সে লিফট নিয়ে তিন তলায় কিছু ওয়াচ করতে গিয়েছিল। লিফ্ট নাকি তিন তলায় না থেমে একেবারে চার তলায় এসে থেমে ছিল। তারপর লিফটের দরজা যখন আপনি আপনি খুলল তখন সে তার চোখে সামনে এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল। সে দেখে ছিল, তার থেকে হাত দশ দূর দিয়ে একটা মেয়ে আধ-ছায়া আধ-আলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মুহূর্ত কয়েক পরেই সে দেখতে পেলো, মেয়েটার ঈষৎ উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, সে মুখ ছিল রক্তাক্ত ও বীভৎস।